শাওয়াল ১৪৩৫   ||   আগস্ট ২০১৪

উসতাযুল উলামা আল্লামা কুতবুদ্দীন রাহ.

আতাউল কারীম মাকসুদ

সকল প্রাণীই মরণশীল। মৃত্যু কোনো অপরিচিত বিষয় নয়। দুনিয়াতে জন্ম গ্রহণ করা হয় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্যই। তবে কিছু কিছু মানুষ মৃত্যুর পরও অমর হয়ে থাকেন। পরবর্তীদের জন্য হন প্রেরণা ও চেতনার আলোকবর্তিকা। পীরজী হুযূর রাহ., সদর ছাহেব রাহ., হাফেজ্জী হুযূর রাহ.,  খতীব ছাহেব রাহ., শায়খুল হাদীস রাহ. প্রমুখ হলেন সে ধারারই উজ্জ্বল একেকটি তারকা। সে কাতারে আরও একটি তারকা যুক্ত হল। তিনি হলেন উস্তাযুল উলামা ওয়াল মুহাদ্দিসীন শায়খুল হাদীস আল্লামা কুতবুদ্দীন জালালাবাদী রাহ.। ইখলাস, খোদাভীরুতা ও দুনিয়াবিমুখতা ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত হয়ে যারা সমগ্র বাংলাদেশে সহীহ ইলম ও দ্বীন প্রচার করছিলেন, আমাদেরকে এতিম করে তারা একে একে পরপারে পাড়ি জমাচ্ছেন। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের  চতুর্দিকে আল্লাহ ওয়ালাদের উপস্থিতি দেখা যেত। কিন্তু একে একে পরকালে পাড়ি জমানোর কারণে বাংলাদেশ কেমন যেন মুরববী শূন্য হয়ে পড়ছে। সৃষ্টি হচ্ছে অপূরণীয় শূন্যতা। আল্লাহ তাআলা নিজ মেহেরবানীতে ঐ সকল বুযুর্গদের সঠিক উত্তরসূরী সৃষ্টি করে দিন। আমীন।

জন্ম : ১৯৩৫ সালে সিলেট জেলার কানাইঘাট থানার তালবাড়ী নামক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত দ্বীনী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন আল্লামা কুতবুদ্দীন। তার পিতার নাম মৌলভী আনফর আলী। পিতা তৎকালীন বৃটিশ আমলে শরহে জামী জামাত পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তার মাতা অত্যন্ত ইবাদতগুজার ও দ্বীনদার মহিলা ছিলেন।

প্রাথমিক শিক্ষা : হযরত রাহ.-এর পিতা দ্বীনদার ও মৌলভী হওয়ার কারণে সর্বপ্রথম শিক্ষা তিনি পিতার কাছেই গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর গ্রামের পাশের একটি স্কুলে তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। কালের বিবর্তনে সে স্কুলটি আজ আর নেই।

তাঁর বয়স যখন সাত/আট বছর তখন তার বাড়ির কাছেই যুগশ্রেষ্ঠ ওলিয়ে কামিল হযরত শায়েখ নিছার আলী রাহ. ফয়জে আম মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত কুতবুদ্দীন রাহ. স্কুল ছেড়ে মাদরাসায় চলে আসেন। তিনি ছিলেন সে মাদরাসার প্রথম ছাত্র। তখন থেকেই তিনি হযরত নিছার আলী রাহ.-এর নেক দুআ ও তাওয়াজ্জুহ লাভ করতে থাকেন।

হযরত নিছার আলী রাহ. একজন বড় মাপের বুযুর্গ ও অতি উচ্চস্তরের আল্লাহর ওলী ছিলেন। তার শায়খ হযরত আতহার আলী রাহ. তাকে তাসাওউফের ক্ষেত্রে সাইয়্যিদ আহমদ কবীর রেফায়ী রাহ.-এর সমপর্যায়ের মনে করতেন। এমন এক আল্লাহর ওলীর স্নেহের ছায়ায় তিনি পড়াশোনা করতে থাকেন। পরবর্তী জীবনে তিনিই হয়ে উঠলেন হযরত নিছার আলী রাহ.-এর সবচেয়ে প্রধান ছাত্র ও তার জা-নাশীন। আমাদের এলাকার কাউকে নিছার আলী রাহ.-এর প্রধান ছাত্র ও তার জা-নাশীন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে বিনা দ্বিধায় সে হযরত কুতবুদ্দীন রাহ.-এর নাম উল্লেখ করবে। তার ইন্তেকালের পর নিছার আলী রাহ.-এর ছেলে মাওলানা আব্দুর রহীম ছাহেবকে এই প্রশ্ন করা হলে তিনিও একই উত্তর প্রদান করেন। নিছার আলী রাহ.-এর ইন্তেকালের পর তিনি ক্বাতফুসসিমার মিন হাদয়িন নিসার নামে উর্দুভাষায় তাঁর একটি জীবনী রচনা করেন।

হেদায়াতুন্নাহু জামাত পর্যন্ত তিনি এখানেই পড়ালেখা করেন। পড়া লেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকায় নিছার আলী রাহ. এক বছরেই তাকে হেদায়াতুন্নাহু পর্যন্ত সকল কিতাব পড়িয়ে দেন। কাফিয়া জামাত পড়ার জন্য তিনি ভর্তি হন সিলেট জেলার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান রানাপিং মাদরাসায়।

মাদরাসাটি তার বাড়ি হতে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। এক বছর তিনি সে প্রতিষ্ঠানেই লেখাপড়া করেন। ওই সময় তার বয়স ছিল বার বছর। তখন তার পিতা ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন পিতার বড় সন্তান। পরিবারে উপার্জন করার মত কোনো মানুষ ছিল না। এজন্য অভাব অনটন ও দুঃখ কষ্টকে সাথে নিয়েই তাঁকে বড় হতে হয়। তার স্পষ্ট উদাহরণ হল, রানাপিং মাদরাসায় পড়ালেখা করা অবস্থায় তিনি বাড়ি হতে আসা যাওয়া করতেন। দীর্ঘ এক বছর আসা যাওয়া করেছেন পায়ে হেঁটে। অর্থের অভাবে কোনোদিন গাড়িতে উঠেননি। অথচ সে সময় গাড়ি ভাড়া ছিল এক আনার অর্ধেক। বৃষ্টির মৌসুমে ছাতা কেনার সামর্থ্য না থাকায় কলা গাছের পাতা ব্যবহার করতেন। এ কথা অসংখ্যবার আমি তার মুখে শুনেছি।

এ মাদরাসাতেই তিনি ইমামুল আসর হযরত কাশ্মিরী রাহ.-এর সুযোগ্য শাগরিদ আল্লামা রিয়াছত আলী চৌঘরী রাহ.-এর সোহবত লাভ করেন। তখন থেকেই তিনি হযরত আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহ.-এর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। পরবর্তী জীবনে আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহ.-এর জীবনী ও  মালফুয দ্বারাই তার মজলিস মুখরিত থাকত। তার কাছে বসে কোনো বিষয়ে কথা বলে আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহ.-এর নাম না শুনে উঠেছি জীবনে এমন খুব কমই হয়েছে। শাহ ছাহেবের প্রতি তাঁর মুহাববতের গভীরতার প্রভাব অনুমান করা যায় যে, তার জীবনের সর্বশেষ কুরবানীতে আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহ.-এর পক্ষ হতেও তিনি কুরবানী আদায় করেছেন। একদা আমি অধম তাকে বললাম- হাদীস শরীফে এসেছে

المرء مع من أحب

শাহ সাহেবের সাথে আপনার এত অত্যধিক ভালোবাসা থেকে মনে হয় শাহ সাহেবের সাথেই আপনার হাশর হবে। তখন আমীন বলে ডুকরে কেঁদে উঠেন।

রানাপিং মাদরাসায় পড়ালেখা শেষ করে ১৯৫২ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের ইলমে দ্বীন বিতরণের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা আশরাফুল উলুম বড়কাটারা মাদরাসায় শরহে জামী জামাতে ভর্তি হন। দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত তিনি এখানেই পড়ালেখা করেন। প্রখর মেধা ও মেহনতী স্বভাব থাকার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আসাতিযায়ে কেরামের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন।

আসাতিযায়ে কেরামের খেদমতের প্রতি ছিল তার সীমাহীন আগ্রহ। এ বিষয়ে তার জীবনের অসংখ্য ঘটনার মধ্যে কেবল একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। বায়তুল মুকাররম মসজিদের খতীব আল্লামা ওবায়দুল হক রাহ. তখন সবেমাত্র দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে এসে উস্তায হয়েছেন। সাধনা ঔষধালয়ের (গেন্ডারিয়া) পাশে ছিল তাঁর বাসা। তখন ওই এলাকায় পানির খুব সমস্যা ছিল । এজন্য প্রতিদিন আসর নামায পড়ে দুই কলসি পানি ভরে তিনি বড় কাটারা হতে খতীব ছাহেবের বাসায় পৌঁছে দিতেন। একাধারে দুই বছর তিনি এই খেদমত আঞ্জাম দেন। অথচ বড় কাটারা হতে গেন্ডারিয়ার দূরত্ব হল প্রায় চার কিলোমিটার। অনেকবার তার মুখে শুনেছি, খতীব ছাহেবের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের প্রশ্রাব পায়খানাযুক্ত কাপড় তিনি অসংখ্যবার ধুয়ে দিয়েছেন। এভাবে তিনি আসাতিযায়ে কেরামের খেদমতের জন্য নিজেকে বিলীন করেছিলেন। বড় কাটারা মাদরাসায় তার উস্তাযের মধ্যে হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব পীরজী হুযুর রাহ., মুফতী মুহিউদ্দীন রাহ., মাওলানা মুহিববুর রহমান রাহ., মাওলানা তাফাজ্জুল হক কুমিল্লায়ী রাহ. ও খতীব উবাইদুল হক রাহ. প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ইলম অর্জনের প্রতি তার ছিল সীমাহীন আগ্রহ। এ বিষয়ে একটি ঘটনার মধ্যে আমাদের জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়।

বড় কাটারা মাদরাসায় পড়াকালীন একবার মাদরাসা বিরতিতে তিনি বাড়ি গেলেন। হঠাৎ করে সারা দেশ বন্যায় প্লাবিত হয়ে যায়। ঢাকার সাথে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঐদিকে মাদরাসায় আসার দিন ঘনিয়ে আসায় তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন, খোলার দিন কীভাবে মাদরাসায় হাযির হবেন। চিন্তা করে তিনি যে উপায় আবিস্কার করলেন তা মনে হলে এখনও আমার গা শিউরে উঠে। বাড়ি থেকে রওয়ানা হয়ে নৌকা যোগে তিনি সিলেট শহরে আসেন প্রায় ৩০ কিলোমিটার। সেখান থেকে পণ্যবাহী লঞ্চ যোগে চাঁদপুর এসে পৌঁছেন। চাঁদপুর হতে মালবাহী লঞ্চে আসেন নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ হতে সাড়ে সাত ঘন্টা পায়ে হেঁটে বড় কাটারা মাদরাসায় এসে উপস্থিত হন। ঐ সময় পীরজী হুযুর রাহ. মাদরাসার দফতরে বসে চিন্তামগ্ন ছিলেন যে, আসাতিযায়ে কেরাম ও ছাত্ররা কীভাবে আসবে। আববাজান রাহ.-কে দেখে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কীভাবে সিলেট থেকে এসেছ? বিবরণ শুনে পীরজী হুযুর রাহ. আববাজানকে জড়িয়ে ধরে দুআ করতে লাগলেন। আববাজান রাহ. প্রায়ই বলতেন, আমার ইলম অর্জনের পথে পীরজী হুযুর রাহ.-এর সেদিনের দুআ অনেক সহায়ক হয়েছে। (পীরজি হুযুরের সাথে আববাজানের অনেক ঘটনা রয়েছে। আল্লাহর মেহেরবানীতে সে ঘটনাগুলো আলাদাভাবে লেখা শুরু হয়েছে। আল্লাহ পূর্ণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন)   

তার ছাত্রজীবনের আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা জরুরি মনে করছি। তাতে বর্তমান যুগের তালিবে ইলমদের জন্য অনেক কিছু শেখার রয়েছে।

আববাজান রাহ. একবার ছাত্রদের প্রশিক্ষণ সভায় উর্দু ভাষায় বক্তৃতা করেন। তৎকালীন বড় কাটারা মাদরাসার শিক্ষক মুফতী রহমতুল্লাহ সাহেব রাহ. মন্তব্য করলেন, উর্দু পুরা সহীহ হয়নি। একথা শুনে তিনি এক সপ্তাহ খতীব ছাহেব রাহ.-এর সংস্পর্শে থেকে রাতদিন মেহনত করে উর্দু ভাষা পুরা সহীহ করে পরের সপ্তাহে বক্তৃতা করেন। বক্তৃতা শুনে মুফতী ছাহেব মন্তব্য করলেন আলহামদুলিল্লাহ, এখন উর্দূ শুদ্ধ হয়েছে। পরবর্তী জীবনে তার উর্দূ ভাষায় রচিত ক্বাতফুসসিমার দেখলে বুঝে আসে তার উর্দূ কত বিশুদ্ধ ও স্পষ্ট।

বড় কাটারা মাদরাসা হতে দাওরায়ে হাদীস পড়ার পর ইলমের অশেষ আগ্রহ তাকে নিয়ে যায় তৎকালীন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিস, জা-নাশীনে কাশ্মিরী রাহ., মুহাদ্দিসুল আসর আল্লামা ইউসুফ বানুরী রাহ.-এর সান্নিধ্যে। হযরতের প্রতিষ্ঠিত জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়ায় তিনি আড়াই বছর পড়াশুনা করেন। আল্লামা ইউসুফ বানুরী রাহ. ইতিপূর্বে শুধুমাত্র বুখারী শরীফ প্রথম খন্ড  ও তিরমিযী শরীফ প্রথম খন্ডের দরস দান করতেন। আববাজান রাহ. যেদিন প্রথম সবকে বসলেন তখন বানুরী রাহ.-কে একটি প্রশ্ন করেছিলেন। বানুরী রাহ. ঐ দিন সবক থেকে গিয়ে মাদরাসার নাযিমে তালিমাতকে ডেকে বললেন, বাংলাদেশ হতে একজন ছাত্র এসেছে। আমার মনে হয় হাদীসের বিষয়ে তার যথেষ্ট ইলম রয়েছে। এজন্য এবছর আমি পূর্ণ বুখারী ও পূর্ণ তিরমিযী শরীফের দরস দিব। বানূরী রাহ-এর ধারণাই সহীহ প্রমাণিত হল। বার্ষিক পরিক্ষায় সহীহ বুখারীতে তিনি এত বেশি নম্বর পেয়েছিলেন যে, বাইরের কোনো ছাত্র ইতিপূর্বে কখনো এত বেশি নাম্বার ওই মাদরাসায় পায়নি। ফলে তাকে বিশেষ পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হল। জামিয়াতুল উলুমে অবস্থানকালে তিনি বানূরী রাহ.-এর খাছ খাদেম ও অত্যন্ত মুহাববাতের ছাত্রে পরিণত হন। হযরত বানুরী রাহ. তাকে খুব ভালবাসতেন। আববাজানের মুখে একটি কথা বারবার শুনেছি যে, বাংলাদেশে পড়ালেখা কালীন তার জামা ছিল মাত্র একটি। সেই একটি জামা নিয়েই তিনি পাকিস্তান যান। বানুরী রাহ. ঐ সময়ের ৭৫ টাকা ব্যয় করে একটি জামা ও একটি পাজামা বানিয়ে দিলেন আববাজান রাহ.-কে। একথা তিনি খুব আগ্রহের সাথে বর্ণনা করতেন । হযরত বানুরী রাহ. তাকে কত আদর করতেন, এ ঘটনা দ্বারা তা বোঝা যায়।

জামিয়াতুল উলূম হতে মাসিক ভাতা বাবদ ভিনদেশী ছাত্রদেরকে আঠার রুপি দেওয়া হত। হযরত বানুরী রাহ. নিজের পক্ষ হতে আরো সাত রুপি যোগ করে আববাজানকে মাসিক পঁচিশ টাকা দিতেন। আববাজান রাহ.-কেও দেখেছি তার উস্তাযদের মধ্যে হযরত বানুরী রাহ.-এর আলোচনা-ই সবচেয়ে বেশী করতেন। এমনকি একেবারে বৃদ্ধ বয়সেও যখন হযরত বানুরী রাহ.-এর নাম উচ্চারণ করতেন, প্রায় সময়ই তার চোখে পানি এসে যেত। কোনো আলোচনা প্রসঙ্গে যদি হযরত বানুরী রাহ.-এর নাম উচ্চারিত হত তাহলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু তাঁর আলোচনাই করতেন। হযরত বানুরী রাহ.-এর অনেক ছাত্রকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, তাঁর কোনো ছাত্রের মুখে হযরত বানুরী রাহ.-এর নাম এত অধিক উচ্চারিত হতে দেখিনি। কোথাও যদি তিনি  সামান্য সময়  বয়ান করতেন তাহলে হযরত বানুরী রাহ.-এর নাম কয়েক বার উচ্চারিত হত। জীবনের সর্বশেষ বয়ান করেছিলেন ফয়জে আম মাদরাসার বার্ষিক সম্মেলনে। শারীরিক অসুস্থতা ও দুর্বলতার কারণে মাত্র ছয় মিনিট বয়ান করেন। এই ছয় মিনিটে হযরত বানুরী রহ.-এর নাম তাঁর মুখে উচ্চারিত হয় কয়েকবার। জীবনের প্রায় প্রতিটি কুরবানীতে তিনি হযরত বানুরী রাহ.-এর পক্ষ হতে কুরবানী করতেন। মাআরিফুস সুনান (১ম খন্ড ) প্রকাশিত হলে হযরত বানুরী রাহ. তাকে এক কপি হাদিয়া পাঠান। সে কিতাবটিকে সারাজীবন চোখের সামনেই রাখতেন। মাঝেমধ্যে তাতে চুমু খেতেন এবং বুকে জড়িয়ে রাখতেন।

হযরত বানুরী রাহ.-এর সাথে তার

মুহাববতের অবস্থা এ সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়। (আলহামদুলিল্লাহ এ বিষয়েও পৃথকভাবে লেখা শুরু হয়েছে। আল্লাহ তাআলা পূর্ণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন)

কর্মজীবন : পাকিস্তানে পড়ালেখা চলাকালীন একবার আল্লামা আতহার আলী রাহ. করাচী গেলেন। তখন তাকে বললেন দেশে ফিরে আর কোনো মাদরাসায় না গিয়ে আমার মাদরাসায় (জামিয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ) চলে আসবে। হযরতের কথা অনুযায়ী তিনি জামিয়াতে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হলেন। একাধারে ১৭ বছর তিনি এ জামিয়ায় শিক্ষকতা করেন। উলুমে ইসলামিয়ার সকল ফনের কিতাবাদি অত্যন্ত সুনামের সাথে দরস দান করেন। তার দরস হত অত্যন্ত প্রাণবন্ত। ছাত্ররা শুরু হতে শেষ পর্যন্ত পূর্ণ উদ্যমের সাথে সবকে উপস্থিত হত। তার সবকে কোনো ক্লান্ত বা অমনোযোগী হওয়ার কোনো উপায় ছিল না।

দরস ছাড়া অন্য সময় তিনি কুতুবখানায় গিয়ে কিতাব মুতালাআয় ব্যস্ত থাকতেন। কিতাব মুতালাআ ছিল তার জীবনের অন্যতম প্রিয় কাজ। ক্বাতফুসসিমার গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি নিজেই বলেন সে সময় জামিয়া এমদাদিয়ার কুতুবখানায় আট হাজার কিতাব ছিল। প্রতিটি কিতাবের প্রতিটি লাইন আমি মুতালাআ করেছি। এমন কোনো কিতাব ছিল না, যা আমি মুতালাআ করিনি

ইন্তিকালের সাড়ে তিন মাস আগে হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন এল যে, তোমার আববার শরীর বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছে। ফোন পেয়ে সাথে সাথে বাড়িতে চলে যাই। গিয়ে দেখি এই অসুস্থ অবস্থায় তিনি তার শায়খ আরেফ বিল্লাহ হযরত মাওলানা শাহ হাকীম মুহাম্মাদ আখতার ছাহেব রাহ.-এর একটি কিতাব মুতালাআ করছেন। জীবনের শেষ সময়ে তার সবচেয়ে প্রিয় ব্যস্ততা ছিল কুরআনে কারীমের তেলাওয়াত ও আপন শায়েখের লিখিত কিতাবাদি মুতালাআ করা।

জামিয়া ইমদাদিয়ায় শিক্ষকতাকালীন আসাতিযায়ে কেরামের অনেক পরামর্শ সভায় তিনি অনুপস্থিত থাকতেন। এমনকি তার কিতাব মুতালাআর আগ্রহ দেখে আতহার আলী রাহ. তাকে শিক্ষক সভায় আসার জন্য কোনো প্রকার চাপ দিতেন না।

শিক্ষকতার একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশ হওয়ার পর আতহার আলী রাহ. এবং ময়মনসিংহ বড় মসজিদের ইমাম, ফেরেশতা সিফাত বুযুর্গ, মাওলানা ফয়জুর রহমান রাহ.-এর সাথে তিনিও কারাগারে বন্দী জীবন যাপন করেন। কারাগারে রমযান মাস আসলে শারীরিক অসুস্থতার কারণে আতহার আলী রাহ. এবং ফয়জুর রহমান রাহ. তারাবীহ পড়ানো থেকে ওজর পেশ করেন। সকলেই চিন্তিত ছিলেন যে, মনে হয় এ বছর কুরআন খতম শুনা হবে না। কারণ সাথীদের মধ্যে আর কোনো হাফেজ ছিলেন না। আতহার আলী রাহ. আববাজানকে ডেকে বললেন দেখ তুমি কুরআন শরীফ মুখস্থ করতে পার কি না। আববাজান বললেন আপনি দুআ করে দিন। আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে তিনি মুখস্থ করা শুরু করলেন। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি প্রতিদিন এক পারা মুখস্থ করতেন এবং ওই রাতে তারাবীহতে শুনিয়ে দিতেন। এভাবে মাত্র একমাসে তিনি পূর্ণ কুরআনে কারীম মুখস্থ করেন।

জামিয়া ইমদাদিয়ায় ১৭ বছর শিক্ষকতা করে তিনি চলে যান বাংলাদেশের সুপ্রসিদ্ধ দ্বীনী প্রতিষ্ঠান সিলেট শাহজালাল রাহ.-এর দরগাহের সন্নিকটে অবস্থিত জামিয়া কাসিমুল উলুমে। এখানেও তিনি হাদীস, তাফসীর, ফিক্হ ইত্যাদি কিতাবের দরস দান করেন এবং আরেফবিল্লাহ হযরত আকবর আলী রাহ.-এর সোহবতে উপকৃত হতে থাকেন।

প্রায় সাত বছর শিক্ষকতা করার পর মাদানী রাহ.-এর প্রিয় শাগরিদ শাইখুল হাদীস মাওলানা জাওয়াদ রাহ.-এর পরামর্শে তিনি চলে যান রাজাগঞ্জ মাদরাসায়। সেখান থেকে তিনি তার অন্যতম রাহবার, তাবলীগ জামাতের বিশিষ্ট মুরুববী, মাওলানা হরমুজ উল্লাহ রাহ.-এর পরামর্শে নারায়ণগঞ্জ আমলাপাড়া মাদরাসায় যোগদান করেন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন হাদীসের দরস দান করেন। প্রায় পনের বছর তিনি এখানেই তালিবানে উলুমে নবুওতের মধ্যে ইলমে দ্বীন বিতরণ করেন। সেখান থেকে তিনি চলে যান হযরত মাদানী রাহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা, শায়খ সন্দীপী রাহ.-এর প্রতিষ্ঠিত, দারুল উলুম মাদানী নগর মাদরাসায়। এখানে তিনি চার বছর হাদীসের দরস দান করেন। এরপর তিনি জীবনের সর্বশেষ কর্মস্থল তার প্রিয় শায়খ আরেফ বিল্লাহ মাওলানা শাহ হাকীম মুহাম্মাদ আখতার রাহ.-এর প্রতিষ্ঠিত ঢালকানগর মাদরাসায় চলে যান। চার বছর এখানে শিক্ষকতার পর তিনি অসুস্থ হয়ে বাড়িতে চলে আসেন। আট বছর তিনি বাড়িতেই অবস্থান করেন এবং অবশেষে রফীকে আলা মাহবুবে হাকীকীর সান্নিধ্য গ্রহণ করেন। ।

শিক্ষকতার এই দীর্ঘ জীবনের একেবারে শুরু হতেই তিনি রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীসের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এবং প্রায় চল্লিশ বছর সহীহ বুখারীর দরস প্রদান করেছেন। এ ছাড়া শিক্ষকতার এ দীর্ঘ সময়ে তিনি আরো বিভিন্ন মাদরাসায় খন্ডকালীন দরস প্রদান করেন। যেমন পীরজঙ্গি মাদরাসা মতিঝিল ঢাকা, কুমিল্লা দয়াপুর মাদরাসা, জামিআ ইসলামিয়া মোমেনশাহী, মারকাজুল উলুম মেজরটিলা।

তার ছাত্রবৃন্দ : শিক্ষকতার এ দীর্ঘ জীবনে বহু ছাত্র তার নিকট হতে ইলমে দ্বীন অর্জন করেছেন। তার সঠিক পরিসংখ্যান এ মুহূর্তে উল্লেখ করা কষ্টসাধ্য। উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি-

১ হযরত মাওলানা আতাউর রহমান খান রাহ., কিশোরগঞ্জ   

২. শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আনওয়ার শাহ, কিশোরগঞ্জ

৩.শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ 

৪.শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান, যাত্রাবাড়ী

৫. হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুল মান্নান, নায়েবে মুফতী, জামিয়া দারুল উলুম করাচী

৬. শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আব্দুল্লাহ হরিপুরী রাহ.

৭. মাওলানা আব্দুর রহমান হাফেজ্জী মোমেনশাহী

৮. শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা হাফেজ মাহমুদ হুসাইন, লন্ডন

৯. শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা খলিলুর রহমান, পীর সাহেব, বরুনা

১০. মুফাসসিরে কুরআন হযরত মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলিপুরী

১১. বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মাওলানা আবুল কালাম যাকারিয়া সুনামগঞ্জী

১২. বিশিষ্ট মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা সালেহ আহমাদ জকিগঞ্জী

১৩. শায়খুল হাদীস মাওলানা মুজিবুর রহমান রাহ., মিরপুর-৬

১৪. হযরত মাওলানা আহমদুল হক হবিগঞ্জী

১৫. শায়খুল হাদীস মুফতি মুজিবুর রহমান ছাহেব, আঙ্গুরা, মুহাম্মাদপুর, সিলেট

১৬. মাওলানা যায়নুল আবেদীন, মুহাদ্দিস, উমেদ নগর মাদরাসা, হবিগঞ্জ 

আধ্যাত্মিকতা: করাচী জামিয়াতুল উলুমে পড়াকালীন  ইউসুফ বানুরী রাহ.-এর পরামর্শে তিনি সর্বপ্রথম বায়আত হন হযরত থানভী রাহ.-এর অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী খলিফা জামিয়া আশরাফিয়া লাহোরের প্রতিষ্ঠাতা মুফতী হাসান আমরতসরী রাহ.-এর হাতে। তাঁর ইন্তেকালের পর হাকীমুল ইসলাম কারী তায়্যিব ছাহেব রাহ.-এর হাতে তিনি বায়আত গ্রহণ করেন। আববাজান রাহ.-এর অনেক ছাত্রের মতে তিনি উপরোক্ত দুই বুযুর্গ হতেই খেলাফত লাভ করেন। এ বিষয়ে আমি স্পষ্টভাবে তার কাছ থেকে কিছু শুনিনি। তবে কারী তায়্যিব ছাহেব রাহ.-এর খেলাফতের বিষয়টি আমার ছোট ভাই রেজাউল করীম আবরার তাঁর মুখ থেকে সরাসরি শুনেছে বলে সে আমাকে জানিয়েছে।

কারী ছাহেব রাহ.-এর ইন্তেকালের পর তিনি ময়মনসিংহ বড় মসজিদের ইমাম বিশিষ্ট বুযুর্গ মাওলানা ফয়জুর রহমান রাহ.-এর হাতে বায়আত হন এবং তাঁর নিকট হতে খেলাফত লাভ করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তিনি বিশ্ববিখ্যাত বুযুর্গ আরেফ বিল্লাহ মাওলানা শাহ হাকীম মুহাম্মাদ আখতার সাহেব রাহ.-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন এবং প্রথম সাক্ষাতের কিছুদিন পরই খেলাফত লাভে ধন্য হন। এ ছাড়া দাওয়াত ও তাবলীগের বিশিষ্ট মুরুববী ওলিয়ে কামিল মাওলানা হরমুজুল্লাহ রাহ.-ও তাকে খেলাফত দান করেন।

এত বুযুর্গের খলীফা হওয়ার পরও নিজেকে তিনি এমনভাবে মিটিয়েছিলেন যে কোনোদিন কাউকে বুঝতেও দেননি, তিনি যে একজন শায়েখে কামিল। অসংখ্যবার দেখেছি অনেক উলামায়ে কেরাম তার কাছে বায়আত হওয়ার আগ্রহ পেশ করেছেন। আর তিনি কবুল না করে অন্য কোনো হক্কানী পীরের নাম বলে তার নিকট বায়আত হওয়ার হুকুম দিয়েছেন। এ দৃশ্যও দেখেছি যে, ঐ পীর সাহেবের নিকট ফোন করে তাকে বায়আত করে নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন। এত কিছুর পরও কিছু উলামায়ে কেরাম তার পিছনে এমনভাবে জুড়ে ছিলেন যে, তাদেরকে বায়আত না করে পারেননি। তন্মধ্যে আমার জানা মতে কেবলমাত্র তিনজনকেই তিনি খেলাফত দান করেছেন।

জামাতের প্রতি গুরুত্ব : আল্লাহর কিছু বান্দা আছেন, আযানের ধ্বনি যাদের হৃদয় জগতে ঝড় তোলে। আযান শুনে তাঁরা ঘরে বসে থাকতে পারেন না, ছুটে যান মসজিদে। তাঁরা ঘরে থাকেন, কিন্তু তাঁদের হৃদয় থাকে মসজিদে। যেন তাঁরা মসজিদ থেকে ঘরে আসেন আবার মসজিদে ফিরে যান। মসজিদই তাঁদের ঠিকানা। আববাজান রাহ. এমনই ছিলেন; আযান হলেই সকল ব্যস্ততা রেখে হাযির হয়ে যেতেন মসজিদে। লাববাইক ইয়া রাব, বান্দা হাযির। শত ব্যস্ততাও তাকে ঘরে ধরে রাখতে পারত না। বরং অনেক সময় আযানের আগেই হাযির হয়ে যেতেন মসজিদে। আমার বুঝ হওয়ার পর থেকে তাকে আমি এমনই দেখছি। জামাত তো দূরের কথা তাকবীরে উলাও কখনো ছুটত না এবং সফরে-হযরে জীবনে কখনো তাকে আমি মাসবুক হতে দেখিনি।

তাঁদের থেকে আমরা শিখতে পারি, আযান হলেই সকল ব্যস্ততা পিছে ফেলে কীভাবে মসজিদে ছুটে যেতে হয়। শয়তান ধোকা দেয়; এখনো তো বেশ সময় আছে হাতের কাজটা সেরে নাও। তাঁরা বাস্তবে আমাদের শিখিয়ে গেছেন, আযান হলেই সকল ব্যস্ততা কীভাবে এক ব্যস্ততার সামনে সমর্পিত হয়। তা হল, মাওলার ডাকে সাড়া দেয়ার ব্যস্ততা। 

রাজনীতি ও সামাজিক জীবন

পাকিস্তান আমলে আল্লামা আতহার আলী রাহ.-এর নেতৃত্বে কিছুদিন তিনি নেজামে ইসলামের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ হওয়ার পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলেন। হাফেজ্জী হুযূর রাহ.-এর খেলাফত আন্দোলনের সময় তিনি তাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। এর পরে আর কখনো তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক রাখেননি। আমি কোনো দিন তাকে কোনো রাজনৈতিক সভায় অংশগ্রহণ করতে দেখিনি। ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রাম হত, কিন্তু তিনি মাদ্রাসায় বসে যিকির আযকার বা কিতাব মুতালাআ অথবা ছাত্রদেরকে সময় দেওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। ঐ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করা না করা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি মুচকি হেসে বলতেন, ভাই আমি ছোট মানুষ! রাজনীতি করা বড়দের কাজ। আমি ওগুলো বুঝি না। বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া প্রতিষ্ঠা হলে দুইবার ১৪০৬ হিজরী ও ১৪০৯ হিজরীতে তিনি কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া মাদরাসায়ে নিছারিয়া ফয়জে আমের আজীবন প্রতিটি মজলিসে শুরায় তিনিই সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। আল ইখওয়ান পরিষদের প্রতিষ্ঠা হতে আমৃত্যু এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন হতে প্রকাশিত সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অনুবাদের দুই পারা তার অনূদিত। খুতবাতে হাকীমুল ইসলামও তিনি অনুবাদ করেন। এছাড়া হযরত আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ.-এর জীবনী গ্রন্থ নক্বশে দাওয়ামের অধিকাংশ অনুবাদ তিনিই সম্পন্ন করেছেন।

পাকিস্তান আমলে উর্দূ ভাষার নিয়ম কানুন সম্বলিত একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কিন্তু ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তা হারিয়ে যায়। কিতাবটি প্রায় দেড়শত পৃষ্ঠা সম্বলিত ছিল। পরবর্তী জীবনে তা আর সংকলন করা হয়নি। এ ছাড়া তিনি আর মৌলিক কেনো গ্রন্থ রচনা করেননি। তার বিশিষ্ট শাগরিদ মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ ছাহেব দা. বা. আমার সামনেই একবার তাকে বুখারী শরীফের শরাহ লেখার আবেদন

জানালে তিনি তার স্বভাবগত মুচকি হেসে বড়দের কাজ এগুলো বলে এড়িয়ে গেলেন। তার মুখে নিজের ব্যাপারে বিনয়ের চূড়ান্ত করে উচ্চারিত একটি কথা অনেক বার শুনেছি, তিনি বলেছেন, ইমাম বুখারী রাহ. যদি কবর থেকে এসে দেখতেন যে, আমি বুখারী শরীফের দরস প্রদান করি তাহলে তিনি অজ্ঞান হয়ে যেতেন যে, তোমার মত অযোগ্য ও গুনাহগারের জন্য কি আমি এ কিতাব সংকলন করেছি?

অসুস্থতা ও ইন্তেকাল : ১৪২৬ হিজরীতে ঢালকানগর মাদরাসার শায়খুল হাদীস থাকাকালীন জুমাদাল উখরা মাসের ২৭ তারিখ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করে সিলেট চলে যান। এরপর হতে শারীরিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েন। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ডাক্তার ও হাসপাতাল হতে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। ডাক্তার আহবাব হুসাইন সিলেট ওসমানী হাসপাতাল, ঢাকা খিদমাহ হাসপাতাল, সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইত্যাদিতে তিনি চিকিৎসা গ্রহণ করেন। সর্বশেষ ৯ই সফর ১৪৩৫ হিজরী শুক্রবার সকাল হতে অজ্ঞান হয়ে যান। কেবল মাত্র জোরে জোরে শ্বাস গ্রহণ করছিলেন। শরীরে কোনো অনুভূতি বাকি থাকেনি। তবে প্রতিটি শ্বাসের সাথে আল্লাহ আল্লাহ জিকির শোনা যাচ্ছিল। ১০ই সফর শনিবার সকাল বেলা তাকে সিলেট উইমেন্স হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিডনি বিভাগ সেখানে না থাকায় নর্থ ইস্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিছু সময় তাকে আই সি ইউতেও রাখা হয়। ডাক্তারদের মুখে নৈরাশ্যের কথা শুনে মাগরিবের পর তাকে আবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়। তখনও প্রতিটি শ্বাসের সাথে জিকির শোনা যাচ্ছিল। মির্জাগড় পৌঁছার পর দেখতে  পেলাম, শ্বাস নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। তখন আমি তার বুকের পাশে বসে মুনাজাত শুরু করে দিলাম। মুনাজাত শেষ করে সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত শুরু করলাম। রাজাগঞ্জ দারুল হাদিস মাদরাসার নিকটে আসার পর তার পরম প্রিয় মাহবুব আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে ডাক এসে যায়। সে ডাকে সাড়া দিয়ে এ নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে তিনি মালাকুল মাউতের ডাকে সাড়া দেন। সে দিন ছিল ১০ই সফর ১৪৩৫ হিজরী ১৪ই ডিসেম্বর ২০১৩ ঈ. শনিবার রাত ৮টা। বিশ্বজগত হতে আরো একটি তারকা খসে পড়ল। যে তারকা অর্ধ্ব শতাব্দী ক্বালা রাসূলুল্লাহ-এর খেদমত আঞ্জাম দিয়েছে। পরদিন ফয়জে আম মাদরাসা সংলগ্ন মাঠে তাঁর নামাযে  জানাযা হয়। স্থানীয় কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। আল্লাহ তাআলা তার কবরকে নূর দ্বারা ভরপুর করে দিন এবং জান্নাতুল ফেরদাউসের উচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন।

 

মৃত্যুর সময় তিনি তাঁর সহধর্মীনী, পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে যান। আল্লাহ তাআলা তাদের সবাইকে হায়াতে তায়্যিবা দান করুন। 

হযরত রাহ.-এর জীবনী সম্বলিত একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের ইচ্ছা রয়েছে। পাঠকবৃন্দের নিকট  দুআর আবেদন করছি। আল্লাহ তাআলা সহজ করে দেন, কবুল করেন। আমীন। ষ

লেখক : ছাহেবযাদা

 

 

 

advertisement