শাবান-রমযান ১৪৩৫   ||   জুন-জুলাই ২০১৪

মনীষীদের স্মৃতিচারণ

হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী

হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী দামাত বারাকাতুহুম এক বৈচিত্রপূর্ণ অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সত্তরোর্ধ একজন প্রবীণ আলেম। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের আকাবির উলামা মাশায়েখের সাথে তাঁর উঠাবসার সুযোগ হয়েছে। তাঁদের বিভিন্ন ঘটনা ও স্মৃতি আজো তাঁর স্পষ্ট মনে আছে। তিনি এক জীবন্ত ইতিহাস। আর ইতিহাস এমন এক সম্পদ, যা পূর্বসূরীর নিকট থেকে উত্তরসূরীর পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁর নিকট বিনীত দরখাস্ত করেছিলাম, আপনার মাশায়েখ ও আপনার সময়ের উলামা-মাশায়েখের আলোচনা করুন। তিনি তা মঞ্জুর করেছেন এবং সময় ও মনোযোগ দিয়ে তাঁর সময়ের মাশায়েখদের স্মৃতিচারণ করেছেন।

অধম তাঁর অনুমতিক্রমে সেই আলোচনা রেকর্ড করেছি এরপর হুবহু লিখে তাঁকে দেখিয়েছি। তিনি গুরুত্বের সাথে সেই কপি সম্পাদনা করেছেন এবং ছাপানোর অনুমতিও দিয়েছেন। সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে পাঠকদের জন্য আলোচনাটি সুবিন্যস্ত করে উপস্থাপন করার।

আল্লাহ তাআলা তাঁকে উত্তম বিনিময় দান করুন এবং সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু দান করুন।

মূলত এটি এমন একটি স্মৃতিচারণ, যাতে উঠে এসেছে তাঁর সময়ের বরেণ্য উলামায়ে কেরামের কথা। তাঁদের ইলম ও আমলের কথা, তাঁদের তাকওয়া-খোদাভীরুতা, বাতিলের বিরুদ্ধে পাহাড়সম দৃঢ়তা, তাঁদের উচ্চ চিন্তা-চেতনা, সিরাতে মুস্তাকিমের উপর অবিচলতা, সূলূকের কথা ইত্যাদি। এ স্মৃতিচারণে এমন গুমনাম বুযুর্গদের কথাও উঠে এসেছে, যাদের আলোচনা কোনো গ্রন্থে পাওয়া দুষ্কর।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ আলোচনা থেকে পূর্ণরূপে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন।-অনুলেখক

আল্লাহর ফযল ও করমে জীবনে অনেক বুর্যুগানে দ্বীনের সোহবত পেয়েছি। তবে নিজের অযোগ্যতা, দুর্বলতা, অলসতা ইত্যাদি কারণে তাঁদের সোহবত থেকে যেভাবে উপকৃত হওয়া দরকার ছিল সেভাবে উপকৃত হতে পারিনি। তাঁদের এক অযোগ্য ছাত্র আমি। তাদের কী আলোচনা আমি করবো! তবু তুমি যেহেতু অনুরোধ করেছ এবং আমিও ভেবে দেখেছি যে, এ আলোচনা কল্যাণকর হবে ইনশাআল্লাহ, তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেসব বুযুর্গ-মনীষীদেরকে কাছ থেকে দেখেছি তাঁদের কিছু আলোচনা করব। এতে বর্তমান প্রজন্মের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় থাকবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের এ আলোচনার মজলিস কবুল করুন এবং একে উপকারী বানিয়ে দিন। আমীন।

শিক্ষাজীবনের বিবরণ

আমার পড়ালেখা শুরু হয় জামিয়া ছাদীয়া রায়ধর মাদরাসা থেকে। রায়ধর হবিগঞ্জ জেলা শহরের অদূরে ধুলিয়াখাল গ্রামের নিকটবর্তী একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম। প্রথমে এটি একটি খানকাহ ছিল।  তেরশ বাংলা সনের এক প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা শাহ ছাদ উরফে আছাদুল্লাহ রাহ. (১২৮২/৮৩-১৩৫২ বঙ্গাব্দ) এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রথমে সিলেট ফুলবাড়িয়া মাদরাসায়, এরপর ভারতের আমরুহাতে দ্বীনী উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। সুন্নতে নববী ও সমাজ সংস্কারের এক মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। এখানে খানকাহভিত্তিক তালিম, তরবিয়ত দেয়ার পাশাপাশি শিরক-বিদআতসহ নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলন পরিচালনা করতেন। (তাঁর সম্পর্কে আরো আলোচনা সিলেট বিভাগীয় আলেমদের স্মৃতিচারণ শিরোনামে করা হবে ইনশাআল্লাহ)। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁরই সুযোগ্য ভ্রাতুষ্পুত্র মাওলানা আব্দুল লতিফ রাহ. (মৃত্যু : ১৩৮২ বঙ্গাব্দ) এ খানকাহ পরিচালনার দায়িত্ব পান। খানকার কার্যক্রমকে আরো বেগবান করার লক্ষ্যে তিনি একে মাদরাসায় রূপ দেন। এটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন মাদরাসা। এখানে মুখতাসার জামাত পর্যন্ত পড়েছি। সে সময়ে এ মাদরাসায় যাদেরকে পেয়েছি তাদের অন্যতম হলেন পূর্বোক্ত মাওলানা আব্দুল লতিফ ছাহেব। তিনি সম্পর্কে আমার মামা। আমাকে অনেক আদর করতেন। তাঁর বাড়িতে জায়গীর থাকতাম। তিনি ছাড়াও সেখানে ছিলেন ক্বারী মাওলানা মেছবাহুজ্জামান কদুপুরী ছাহেব। মাওলানা আব্দুল কদ্দুস ছাহেব, মাওলানা আশরাফ আলী ছাহেব। রায়ধর মাদরাসার (মাওলানা আব্দুল লতিফ রাহ. কর্তৃক খানকাহ যখন মাদরাসায় রূপান্তর হয়) প্রথম শিক্ষক হন মুফতী আব্দুল গফুর দরিয়াপুরী রাহ. (মৃত্যু : ১৯৯৮ ঈ.)। তাকে হবিগঞ্জের মুফতী আযম বলা হত। ভারতে মাযাহেরুল উলূম সাহারানপূরে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেন। মাওলানা শরফুদ্দীন (শায়খে বেড়াখালী)। তিনি মাদানী রাহ.-এর শাগরিদ। এ অঞ্চলে তিনি এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ছিলেন। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ছিল অতুলনীয়। আরেকজন মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা মুখলিছুর রহমান ছাহেব। রায়ধর মাদরাসার প্রথম ছাত্র। তিনিও মাদানী রাহ.-এর শাগরিদ। সেই বিখ্যাত আলেম শাহ আছাদুল্লাহ রাহ.-এর সুযোগ্য পুত্র। বাতিলের বিরুদ্ধে এক অকুতোভয় আলেম হিসেবে তিনি পরিচিত।

হাটহাজারী মাদরাসায় গমন

৫৭-৫৮ ঈ. সনে হাটহাজারী মাদরাসায় যাই। সেখানে ৪ বছর ছিলাম। ওই যামানায় হাটহাজারী মাদরাসায় যেসব আকাবির হযরতদের পেয়েছি তাঁরা হলেন, হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাব মিশকাতুল মাসাবিহ-এর উর্দূ শরাহ  তানযীমুল আশতাত-এর লেখক মাওলানা আবুল হাসান রাহ., মাওলানা মোহাম্মদ আলী ছাহেব, যিনি শরহে আকাইদের টীকা লিখেছেন। মুফতি আহমদুল হক ছাহেব, মাওলানা হামিদ ছাহেব, মাওলানা শাহ আব্দুল ওয়াহহাব মুহতামিম ছাহেব।

মাওলানা আহমদ শফী ছাহেব দা.বা. তখন নতুন উস্তায। দেওবন্দ থেকে এসে সরাসরি হাটহাজারী মাদরাসায় খেদমত শুরু করেন। মাইবুযী পড়েছি তাঁর কাছে। সবচেয়ে বেশি কিতাব যাদের কাছে পড়েছি তাঁরা হলেন শাইখুল হাদীস মাওলানা আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর, মাওলানা আবুল হাসান ছাহেব, মাওলানা মোহাম্মদ আলী ছাহেব, মুফতী আযম ফয়যুল্লাহ ছাহেব রাহিমাহুমুল্লাহ। তাঁদের সান্নিধ্য বেশি পেয়েছি। কিতাবের সংখ্যা হিসাব করলে দেখা যায় উপরোক্ত মাশায়েখদের মধ্যে মুফতী আযম রাহ.-এর নিকট বেশি কিতাব পড়া হয়েছে। তাঁর বাড়িতে গিয়েও পড়েছি। এ সুবাদে মুফতী ছাহেব রাহ.-এর সাথে আমার বিশেষ সম্পর্ক তৈরী হয়। জালালাইন-এর বছর হুযুরের কাছে বাইআত হই। তিনি আমাকে অনেক সেণহ করতেন। তাঁর সুপারিশেই মেশকাত, দাওরা একসাথে হাটহাজারীতে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। বিষয়টা হল, সকল ফুনূনাতের কিতাব যখন পড়া শেষ হয়ে গেল , দেখা গেল শুধু মেশকাত কিতাবটি বাকী আছে। তখন আমি ও মাওলানা আব্দুল হান্নান দিনারপুরী ইচ্ছা করলাম, যেহেতু মেশকাতের সাথে আর কোনো কিতাব নেই তাই এ বছর মেশকাতের সাথে দাওরার কিতাবগুলিও পড়ে নিব। এরপর আগামী বছর দেওবন্দ যাব ইনশাআল্লাহ। আমরা এ মর্মে একটি দরখাস্ত লিখে মুফতী ছাহেব হুজুরের নিকট পেশ করলাম। হুজুর তাতে আমাদের জন্য সুপারিশ করে দস্তখত করেন। নাযীমে তালীমাত শাইখুল হাদীস মাওলানা আব্দুল কাইয়্যুম ছাহেব দরখাস্ত মঞ্জুর করে নিলেন। এতে একসাথে মেশকাত, দাওরা পড়ার সুযোগ হয়। এটি হাটহাজারী মাদরাসার এক বিরল ঘটনা। এরকম সাধারণত হয় না।

মুফতী আযম রাহ.-এর বিশেষ ইজাযত

সহীহ বুখারী পড়াতেন মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম ছাহেব রাহ.। তিনি হাদীস পড়েছেন মাদানী রাহ.-এর কাছে। ইলম ও আমলে এক অনন্য ব্যক্তি ছিলেন। সবাই তাকে মাদারযাদ ওলী বলত। তখন মুহতামিম ছিলেন মাওলানা শাহ আব্দুল ওয়াহহাব ছাহেব। তিনি মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম ছাহেবেরও উস্তায। তিনি চাইতেন তাঁর পরে মুহতামিম হবেন মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম ছাহেব। কিন্তু  মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম ছাহেব তা চাইতেন না। তিনি দুআ করতেন আল্লাহ তাআলা যেন তাকে এ দায়িত্ব না দেন। আল্লাহ তাআলা সম্ভবত তাঁর দুআ কবুল করেছিলেন। এজন্য মাওলানা শাহ আব্দুল ওয়াহাব ছাহেবের আগেই তাঁর

ইন্তেকাল হয়।

ওই বছর আমরা কয়েকজন ইরাদা করলাম, মুফতী ছাহেব হুজুরের কাছ থেকেও হাদীসের সনদ নিব। এ উদ্দেশে তাঁর কাছে কুতুবে সিত্তাহ পড়ার আবেদন করলাম। হযরত প্রথমে রাজি না হলেও পরে আমাদের পীড়াপীড়িতে আবেদন মঞ্জুর করে নেন। আমরা কিতাব নিয়ে হযরতের বাড়িতে যেতাম। আমাদেরকে দেখে আরো অনেকেই যাওয়া শুরু করল। এদের মধ্যে ছিলেন, হাটহাজারী মাদরাসার দুজন হাদীসের উস্তায মাওলানা মুফতী আহমদুল হক ছাহেব ও মাওলানা হামিদ ছাহেব। দুজনই মুফতী ছাহেবের খলীফা। তাঁরাও দরসে উপস্থিত হতেন।  সপ্তাহে একদিন শুধু শুক্রবার দরস হত। হযরত আরবী, ফার্সী ও উর্দূ তিন ভাষায় তাকরীর করতেন। তবে ফার্সী বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। সহীহ বুখারী দিয়ে দরস শুরু হল। হযরত এই কিতাবের সনদের ইজাযত দিলেন। এরপর আমরা আবেদন করলাম, হাদীসের বাকী কিতাবগুলোও কিছু পড়িয়ে সনদের ইজাযত দিয়ে দিন। হযরত রাজি হলেন। এভাবে আমরা হযরতের কাছে শামায়েলে তিরমিযী ছাড়া কুতুবে সিত্তার সবগুলো কিতাবের সনদের ইজাযত লাভ করি। শামায়েলে তিরমিযী মাদরাসায় পড়াতেন। এর সনদের ইজাযত মাদরাসা থেকেই পেয়েছি। মুফতী ছাহেব হাদীস পড়েছেন হযরত কাশ্মীরী রহ.-এর কাছে।

মুফতী আযম রাহ. : কিছু স্মৃতিচারণ

মুফতী আযম রাহ.-এর পীর ও

উস্তায ছিলেন সন্দীপের বড় আলেম, শাইখুল হাদীস হযরত সাইদ আহমদ রাহ.।  তিনি হযরত শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান রাহ.-এর ছাত্র ও খলীফা ছিলেন। আমার জানামতে বাংলাদেশে একমাত্র তিনিই শাইখুল হিন্দের খলীফা ছিলেন। তাঁর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, বাংলাদেশের তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিসে শুরার সদস্য ছিলেন। শাইখুল হিন্দের বড় বড় শাগরিদদের তিনি একজন। মাঝেমধ্যে তিনি এত উচ্চাঙ্গের ইলমী আলোচনা করতেন যা সকলের পক্ষে বুঝা সম্ভব হত না।

মুফতী ছাহেবের আরেকজন উস্তায হলেন বহুমুখী আত্মিক ও বাহ্যিক গুণের অধিকারী কুতুবুল আলম শাহ সূফী মাওলানা যমীরুদ্দীন নানুপুরী রাহ. (মৃত্যু : ১৪৩২ হি.)। তিনি ফকীহুন নফস রশীদ আহমদ গঙ্গোহী রাহ.-এর খলীফা ছিলেন। মুফতী ছাহেব ছিলেন শাইখুল হাদীস হযরত সাইদ আহমদ রাহ.-এর খলীফা। দারুল উলুম দেওবন্দে মুফতী ছাহেবের উস্তাযগণের মাঝে অন্যতম হলেন আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ.। তিনি কাশ্মীরী রাহ.-এর যৌবন কালের শাগরিদ ছিলেন। 

হযরত ইব্রাহীম বলীয়াভী রাহ. এর সাথে মুফতী ছাহেবের অনেক বেশি তাআল্লুক ছিল। এর এক কারণ তো এই যে, বলিয়াভী রাহ.ও শাইখুল হিন্দের খলীফা ছিলেন। সুতরাং তিনি মুফতী ছাহেবের পীরের পীর ভাই। তখন দেওবন্দে মাওলানা ইজাজ আলী রাহ., মুফতী শফী রাহ., ক্বারী তৈয়ব ছাহেব রাহ., মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রাহ. প্রমুখ আকাবিরে দেওবন্দ ছিলেন। মুফতী ছাহেব দেওবন্দে দুই বছর ছিলেন। এরপর হাটহাজারী মাদরাসায় এসে খেদমত শুরু করেন। তখন হাটহাজারী মাদরাসার শাইখুল হাদীস ছিলেন শাইখুল হাদীস সাইদ আহমদ রাহ.। তিদি সহীহ বুখারী পড়াতেন। আর মুফতী ছাহেব জামে তিরমিযী পড়াতেন। সাথে ইফতার দায়িত্ব পালন করতেন।

মুফতী আযম রাহ. বহুমুখী গুণের অধিকারী ছিলেন। দুনিয়াবিমুখতা তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি বলতেন, আমি হজ্বে আল্লাহর কাছে ওয়াদা করেছি, দেশে এসে দুনিয়াবী কোনো বিষয়ের সাথে জড়াব না। আল্লাহ তাআলা তাঁর এই ওয়াদা এত বেশি কবুল করেছেন যে, জমিদার বংশের সন্তান হয়েও সম্পদের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। গুমনাম-প্রচারবিমুখ ব্যক্তি ছিলেন। চিটাগাং থেকেও চিটাগাং শহরে আমার জানামতে মাত্র দুইবার গিয়েছেন। তাঁর হায়াতেই একথা মাশহুর ছিল যে, তিনি মাদারযাত ওলী।

তিনি প্রায়ই বলতেন, ফরয-ওয়াজিব নয়, আমাকে তোমরা মুস্তাহাব পরিপন্থী কোনো কাজও কি করতে দেখেছ? মুফতী ছাহেব জীবনে মাত্র একবার হজ্ব করেছেন। এর কারণ হযরত নিজেই বলতেন, ফটো তোলা হারাম। নফল হজ্বের জন্য আমি ফটো তুলতে পারব না। তিনি জরুরত/রুখসত নয়; বরং সর্বোচ্চ তাকওয়া ও সতর্কতার উপর চলতেন।

চিটাগাং-এর এক দ্বীনদার ধনাঢ্য ব্যক্তি আদালত খাঁ জানতেন, হযরত ফটো তুলে হজ্বে যাবেন না। তাই তিনি সৌদি হজ্ব কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে হযরতের জন্য দুজন জামিন হয়ে ফটো না তুলেই হজ্বে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই একবারই হযরত হজ্ব আদায় করলেন। ফটো তুলতে হয় এজন্য জীবনে আর নফল, বদলি কোনো হজ্ব করেননি।

একসময় মুফতী ছাহেবের পীর ও

উস্তায আল্লামা সায়ীদ আহমদ রাহ. হাটহাজারী মাদরাসা থেকে অব্যাহতি নেন। তখন মুফতী ছাহেবও অব্যাহতি নিয়ে নিজ বাড়ির কাছে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্ররা নিজের খরচে পড়ত। কোনো চাঁদা-কালেকশন করা হত না। কেউ দান করতে চাইলে হযরত বলতেন, আমাদের প্রয়োজন নেই। হাটহাজারী মাদরাসায় নিয়ে যান।

হযরত যখন শুতেন তখন ডান দিকে ফিরে হাটু ভেঙ্গে জড়োসড়ো হয়ে শুতেন। হযরতের প্রথম যিন্দেগী ছিল অনেক কষ্টের। হযরত নিজেই বলতেন, বিবিসাব যখন বাজারের ব্যাগ হাতে তুলে দিতেন তো মাঝেমধ্যে এরকম হত যে, বাজার করার মতো টাকা পয়সা হাতে থাকত না। তখন গ্রামের সবজী ব্যবসায়ীরা সবজী নেয়ার সময় রাস্তায় যা ফেলে দিত তা তুলে নিতাম। পরবর্তীতে যখন সচ্ছলতা এসেছে তখন আর খাওয়ার সামর্থ্য বাকি থাকেনি। মুফতী ছাহেব সাধারণত থানভী রাহ.-এর ফাতাওয়াকে গুরুত্ব দিতেন। ফাতেমা জিন্নাহ ও আইয়ুব খানের প্রেসিডেন্সি ইলেকশনের সময় মুফতী ছাহেব হুযুর এক ঐতিহাসিক ফতোয়া দিলেন যে, ফাতেমা জিন্নাহ না-আহাল হায়, আওর আইয়ুব খান ফাসেক হায়। অর্থাৎ ফাতেমা জিন্নাহ অযোগ্য আর আইয়ুব খান ফাসেক হলেও যোগ্য। এই ফতোয়ার এত প্রভাব ছিল যে, শেষ পর্যন্ত ফাতেমা জিন্নাহ নির্বাচনে হেরে গেল। জমিয়ত এই ফতোয়া পেয়ে পোস্টার করে দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়ে দিয়েছে। এটি হযরত নিছক দ্বীনের খাতিরে করেছেন, রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্যে নয়।

আমি মাঝেমধ্যে ফতোয়া লিখে মুফতী ছাহেবকে দেখাতাম। একবার এক মাসআলা নিয়ে এক ছাত্র ভাইয়ের সাথে মতবিরোধ হল। মাসআলাটি হল, সূরা হজ্বের দ্বিতীয় তিলাওয়াতে সেজদা নিয়ে আমাদের সাথে অন্যান্য ইমামদের যে ইখতিলাফ তা ওয়াজিব নিয়ে নাকি ইস্তিহবাব নিয়ে। আমার তাহকীক ছিল, এ ইখতিলাফ ওয়াজিব নিয়ে; ইস্তিহবাব  নিয়ে নয়। তাই সূরা হজ্বের দ্বিতীয় সেজদা ওয়াজিব না হলেও তা আদায় করা মুস্তাহাব। মুফতী ছাহেবের নিকট আমরা উভয়ে ফতোয়া লিখে দেখালে মুফতী ছাহেব আমারটা দস্তখত করেন। এজন্য আমি সূরা হজ্বের দ্বিতীয় তেলাওয়াতে সেজদা আদায় করি।

মাদরাসার নায়েবে মুফতী ছিলেন মুফতী আহমদুল হক ছাহেব। তিনি ফতোয়া লিখে মুফতী ছাহেবকে দেখাতেন। মুফতী শফী রাহ. ও মাওলানা আতহার আলী রাহ. যে বছর ইন্তেকাল করেন মুফতী ছাহেবও ওই বছর ইন্তেকাল করেন। (অর্থাৎ ১৩৯৪ হি.) এটি ছিল ওই বছরের এক বড় হাদেছা। একই বছর বড় বড় তিনজনের পরলোকগমন। খতীবে বাঙাল মাওলানা সিদ্দীক আহমদ রাহ. মুফতী ছাহেবের ছাত্র ও খলীফা ছিলেন। তিনি বলতেন, মাকুলাত বিষয়ে মুফতী ছাহেবের অগাধ জ্ঞান ছিল। হযরত মাদরাসা থেকে বাড়িতে যাওয়ার পথে হযরতের কাছে মাকুলাতের কঠিন কঠিন কিতাব পড়েছি। আমি একটু বলতাম, এরপর হযরত তাকরীর শুরু করতেন। কিতাবাদির ব্যপারে হযরতের এত বেশি ধারণা ছিল যে, কিতাব না দেখেই পৃষ্ঠা নাম্বার এমনকি পৃষ্ঠার ডান-বাম পর্যন্ত বলে দিতে পারতেন। এ হল মোটামুটি হাটহাজারী মাদরাসার মাশায়েখদের আলোচনা। আরো অনেক কিছুই বলার ছিল। কিন্তু বয়সের ভারে এখন সবকিছু মনেও নেই। ষ    

(চলবে ইনশাআল্লা)

[অনুলেখক-আব্দুল্লাহ মাসুম]

 

 

advertisement