গিয়েছিলাম আহমদনগরে
আমি ও আমার এক সহপাঠী একটা কাজে পঞ্চগড় দারুল উলূম মাদরাসায় গেলাম।
দুপুরের পর ইচ্ছে হল একটু বাইরে বেড়িয়ে আসার। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো একজন রাহবারও পেয়ে গেলাম। যিনি আশপাশের এলাকাগুলো ভালোভাবেই চিনেন।
কোথায় যাওয়া যায়? তিনি বললেন, পাশেই একটা গ্রাম আছে, যেখানে কয়েকশ পরিবার কাদিয়ানী হয়ে গেছে। আপনারা চাইলে আমরা সে গ্রামের অবস্থা দেখতে যেতে পারি। তার মতটি আমাদের পছন্দ হল। সেই গ্রামের দিকে রওয়ানা হলাম। গ্রামটি পঞ্চগড় জেলার কোতওয়ালী থানার ধাক্কামারা ইউনিয়নের অধীনে। কাদিয়ানীরা গ্রামটির নাম রেখেছে ‘আহমদনগর’। আমরা সেই গ্রামে ঢুকে প্রথমে মুসলমানদের মসজিদে গেলাম যা কাদিয়ানীদের এবাদতখানার দক্ষিণপাশে অবস্থিত। ২০০২ ঈ. সালে কুয়েতী সংস্থার পক্ষ হতে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। আমরা যখন সেই মসজিদের সামনে পৌঁছলাম তখন ছিল আসরের ওয়াক্ত। মসজিদে আমরা কাউকেই পেলাম না। জানতে পারলাম পাশেই মুয়াজ্জিন সাহেবের বাড়ি। আমরা তাকে ডাকলাম। আসরের নামায পড়ে তার কাছে এলাকার পরিস্থিতি জানতে চাইলাম। পরে তিনি আরেকজন যুবক ভাইকে ডাকলেন যিনি আহমদনগরের কাদিয়ানীদের অবস্থা সম্পর্কে বেশ ভালো জানেন।
এই গ্রামে কত সংখ্যক কাদিয়ানী পরিবার আছে জানতে চাইলে তারা বললেন, এখানে দেড়শত বা দুইশত পরিবার কাদিয়ানী। আহমদনগরের পাশেই আরেকটি গ্রাম, যার নাম সালসিড়ি। সেখানেও এই পরিমাণ কাদিয়ানী আছে। অত্যন্ত আফসোসের বিষয় হল, স্থানীয় অধিকাংশ মুসলমানই জানে না, কাদিয়ানী সম্প্রদায় কী? তাদের আক্বিদা-বিশ্বাস কী, তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যই বা কোথায় ও কতটুকু? এক ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, কাদিয়ানীদের সাথে আমাদের পার্থক্য কতটুকু? সে বলল, তেমন তো কোনো পার্থক্য নেই। তারা ইমাম মেহেদীকে মানে আর আমরা মানি না। অন্যথায় তারাও তো আমাদের মত, নামায পড়ে, আযান দেয়, রোযা রাখে। তাদের সব কিছুই তো আমাদের মতো।
হায়! এ কী অবস্থা! আমরা তো শুনে অবাক!
জানতে পারলাম স্থানীয় মসজিদে সারা বছরে কোনো জুমার বয়ানে কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা হয় না, যার কারণে সাধারণ লোকেরাও জানে না যে, কাদিয়ানী ও মুসলমানদের মাঝে কী পার্থক্য বা তাদের আক্বিদা কী?
ফলে কাদিয়ানীদের সাথে মুসলমানেরা অবাধে মেলামেশা করছে। ধর্মীয় বিষয়েও অংশগ্রহণ করছে। তাদের বাড়িতে দাওয়াত খাচ্ছে। কাদিয়ানীরা প্রত্যেক বছর জলসা করে সেখানে মুসলমানদের দাওয়াত করে। অনেক মুসলমান সেখানে যায়। তাদের আলোচনা শোনে।
আরেকটা বিষয় হল, সেখানে কাদিয়ানীদের ছেলে-মেয়েদেরকে নানা ধরনের প্রশ্ন শিখিয়ে দেওয়া হয়। ফলে দেখা যায় এরা সাধারণ শিক্ষিত কোনো মুসলমানকে সেই প্রশ্নগুলো করলে উত্তর না দিতে পারায় সাধারণ মুসলমানরা ভাবতে থাকে কাদিয়ানীদের ছেলে-মেয়েরা ধর্মীয় জ্ঞানে অনেক অগ্রসর। দ্বীনী বিষয়ে তাদের জ্ঞান অন্য সাধারণদের চেয়ে বেশি। এটা কাদিয়ানীদের একটা বড় চাল। প্রত্যেক কাদিয়ানীকে কিছু কিছু প্রশ্ন মুখস্থ করানো হয় সাধারণ লোকদেরকে ধোকা দেওয়ার জন্য। যেমন, হযরত ঈসা আ. জীবিত না মৃত? যদি জীবিত হয়ে থাকে, তাহলে কী খান ইত্যাদি। তাছাড়া সেখানে কাদিয়ানীদের মধ্যে শিক্ষিতদের হারও বেশি। মুসলমানেরা দরিদ্রতার কারণে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে না। প্রত্যেক শিক্ষিত কাদিয়ানীই তাদের মতবাদের এক-একজন মুবাল্লিগ।
ঐ এলাকার একটি ছেলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়ে। সে মুসলিম থেকে কাদিয়ানী হয়েছে। শুনলাম তাকে কাদিয়ানী জামাতের পক্ষ থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য আফ্রিকা পাঠানো হবে। মুয়াজ্জিন সাহেব আমাদেরকে বিশাল একটা জায়গা দেখালেন, যা প্রায় ৪০ একর হবে। কাদিয়ানীরা এই জায়গা কিনেছে। তাদের পরিকল্পনা হল এখানে তারা হাইস্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল করবে। এভাবেই তারা ধীরে ধীরে স্থানীয় মুসলমানদের কব্জা করার চেষ্টা করছে। ফলে সাধারণ মানুষদেরকে দাওয়াত দেওয়াও তাদের পক্ষে সহজ হয়ে যাচ্ছে।
জানা গেল, বেশ কয়েক বছর আগে এখানে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন হয়েছিল। তারপর থেকে ঐ এলাকায় নতুন করে কেউ কাদিয়ানী হচ্ছে না। কিন্তু কাদিয়ানীরা তাদের দাওয়াতের ধরন পরিবর্তন করেছে। তারা দূরের গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সাধারণ মুসলমানদেরকে তাদের এখানে নিয়ে আসে। পরে তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বায়আত পড়িয়ে কাদিয়ানী বানিয়ে ফেলে।
যদি দূরে কোনো গ্রামে কাদিয়ানীদের কোনো আত্মীয় থাকে তাহলে তারা এটাকে দাওয়াতের একটা ময়দান মনে করে তাদের বাড়িতে বেড়াতে যায় বা তাদেরকে দাওয়াত করে নিয়ে আসে। তখন আশেপাশের লোকদেরকেও দাওয়াত করে। উত্তমরূপে মেহমানদারির পরে তাদের মাঝে কাদিয়ানী মতবাদ প্রচার করা হয়।
আফসোসের বিষয় হল, স্থানীয় লোকেরা এই মনে করে সন্তুষ্ট আছেন যে, নতুন করে আর কেউ কাদিয়ানী হচ্ছে না। অথচ কাদিয়ানীরা তাদের প্রচারের পন্থা পরিবর্তন করে ভিন্ন পন্থায় প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দূর-দূরান্তের গ্রামের লোকদেরকে তারা টার্গেট করছে। হে আল্লাহ! তুমি এই সকল ভোলাভালা মুসলমানদের ঈমানের হেফাজত কর।
আগেই বলেছি, আহমদনগরের পাশেই আরেকটি গ্রাম আছে সালসিড়ি নামে। ঐ গ্রামটাও কাদিয়ানী কবলিত। আমরা ঐ মুয়াজ্জিন সাহেবসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে সালসিড়ি গ্রামটাও দেখতে গেলাম। এই গ্রামেও তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এক-দেড়শ পরিবার কাদিয়ানী হয়েছে। যাওয়ার সময় রাস্তায় এক কাদিয়ানী যুবকের সাথে দেখা হল। তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পরে সে তাদের মুআল্লিমকে ডাকল। প্রায় আধা ঘন্টা পর মুআল্লিম এল। আমরা তাদের মেহমানখানায় বসে আলোচনা করতে লাগলাম। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কীভাবে এবং কেন কাদিয়ানী হলেন?’ সে বলল, হাদীস শরীফে আছে, ঈমান যদি ছুরাইয়া তারকার মধ্যেও চলে যায় তাহলে পারস্য-বংশীয় এক ব্যক্তি ঈমানকে পুনরায় যমীনে নিয়ে আসবেন। এই হাদীসে ইমাম মাহদীর কথা বলা হয়েছে যে, তিনি পারস্য বংশীয় হবেন। আর মির্যা সাহেবও পারস্য-বংশীয় এবং তিনি মাহদী হওয়ার দাবি করেছেন। সুতরাং তিনিই মাহদী। তাই আমরা তার জামাতে বায়আত হয়েছি।
আমি বললাম, এই হাদীসে মাহদীর কথা কোথায় পেলেন, এখানে তো ইমাম মাহদীর উল্লেখও নেই, ইঙ্গিতও নেই। আর হাদীস শরীফে আছে, ইমাম মাহদীর নাম আমাদের নবীর নামে হবে। মাহদীর পিতার নাম নবীর পিতার নামে হবে। অর্থাৎ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ এবং হাদীসে একথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, তিনি কোথায় থাকবেন, কোথায় মানুষ তার হাতে বায়আত হবে। মির্যা সাহেবের সাথে কি সেগুলো মিলে?
আমরা যখন এগুলো বললাম, তিনি বললেন, ভাই আপনাদের জানার থাকলে বকশী বাজার যান সেখানে সব হাদীস পাবেন, তারা যদি ঠিক হয়ে যায় আমরাও ঠিক হয়ে যাব। তাদেরকে আপনারা বুঝাতে পারলে আমরাও বুঝে যাব। আমরা তাকে বললাম, ভাই, আমরা আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী ও কল্যাণকামী। আমরা আপনার ভালো চাই। তাই আপনার মঙ্গলের জন্য একটা কথা বলছি। আপনি হাদীসের কিতাবগুলো নিন। সেখানে মাহদীর অধ্যায় বের করে হাদীসগুলো নিজেই পড়ুন এবং একা একা চিন্তা করুন যে, মির্যার সাথে হাদীস শরীফে বর্ণিত মাহদীর আলামতগুলো মিলে কি না? এই কাজটা করলে আপনারই উপকার হবে। লোকটি আর কিছুই বলল না। শুধু একই কথা, সামনে বকশী বাজারে আমাদের জলসা সেখানে আপনারা আসেন। সেখানে আমাদের বড় বড় আলেম আছেন তারা আপনাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিবেন।
এরপর তাকে আমরা খতমে নবুওত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম এবং বললাম, আচ্ছা ভাই, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তো নবী হবার দাবি করেছে তাই না? আপনার কাছে কি মির্যা সাহেবের লিখিত ‘এক গলতী কা ইযালা’ (যাতে তার নবী দাবি করার স্পষ্ট উল্লেখ আছে) নামক পুস্তিকাটি আছে? সে বলল, সেগুলো আলমারীর মধ্যে তালা মারা। চাবি পাচ্ছি না। আমরা তাকে বললাম, ভাই, আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী। কুরআন শরীফে আল্লাহ রাববুল আলামীন একথা স্পষ্টভাবে বলেছেন এবং হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أنا خاتم النبيين، لا نبي بعدي
‘আমিই শেষ নবী, আমার পরে আর কোনো নবী নেই’।
আর আপনি জেনে থাকবেন যে, মুসাইলামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরে নবুওতের দাবি করেছিল। আবু বকর সিদ্দিক রা. খেলাফতে এসেই তার মোআমেলা পরিষ্কার করেছেন। ইয়ামামার যুদ্ধে বিশাল সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম শাহাদাত বরণ করেছেন। কিন্তু মিথ্যা নবুওতের দাবিদারকে সাহাবীগণ এক মুহূর্তের জন্যও সহ্য করেননি।
সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনসহ সকল ইমাম ও উম্মতে মুসলিমার ইজমায়ী আকীদা এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী। তাঁর পরে আর কোনো নবী নেই। সেখানে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নবী হওয়ার দাবি করেছে!
সে এ কথা শুনে বলল, আসলে মির্যা সাহেব স্বয়ংসম্পূর্ণ নবী হওয়ার দাবি করেননি; বরং তিনি তো উম্মতী
নবী হওয়ার দাবি করেছেন। (যিল্লি ও বুরুজী নবী)
আমরা বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরে উম্মতী নবী আসবে এ কথা কুরআন হাদীসের কোথাও নেই। সে বলল, আছে। অনেক জায়গায় আছে। বললাম, যেমন? বলল, আগের যুগের নবীদের আনুগত্যের মাধ্যমে মানুষ সিদ্দিক, সালেহ ও শহীদ হতে পারত। কিন্তু আমাদের নবী সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। তার আনুগত্যের মাধ্যমে যেমনিভাবে সিদ্দিক, সালেহ ও শহীদ হওয়া যায়। ঠিক তেমনিভাবে নবীও হওয়া যায়। এই কথাটাই আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন।
(তরজমা) ‘‘আর যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে তারা সেই সকল লোকের সঙ্গে থাকবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, অর্থাৎ নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সালিহগণের সঙ্গে। আর কতই না উত্তম সঙ্গী তারা।’’
তো বুঝা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্যের মাধ্যমে মানুষ নবী হতে পারে; কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ নবী না; উম্মতী নবী। যিল্লি নবী ও বুরুজী নবী। আর এভাবেই মির্যা সাহেব নবুওত লাভ করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ)
এটা কুরআনের আয়াতের এমন এক বিকৃত তরজমা ও ব্যাখ্যা যা চৌদ্দশত বছর যাবত কেউ করেনি। আমরা তাকে বললাম, হাদীস শরীফে এসেছে
التاجر الصدوق الأمين مع النبيين الصديقين والشهداء.
(অর্থাৎ সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ীগণ নবী, সিদ্দিক, শহীদগণের সাথী হবে)
তাকে বললাম এর অর্থ কি এটা যে, যে ব্যক্তি সততা ও আমানতদারীর সাথে ব্যবসা করবে সে নবী হবে। সিদ্দিক হবে, সালেহ হবে?
দ্বিতীয়ত, আয়াতের অর্থ তো একদম স্পষ্ট। কিন্তু আরবী না জানার কারণে সাধারণ মানুষকে তারা প্রতারিত করে। আয়াতে মোটেও একথা নেই যে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে তারা নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সালিহতে পরিণত হবে। বরং আয়াতে আছে তারা নবীগণের, সিদ্দীকগণের, শহীদগণের ও সালিহগণের সঙ্গে থাকবে। আর তারা কতই না উত্তম সঙ্গী। নবীতে পরিণত হওয়া আর নবীর সঙ্গী হওয়া কি এক কথা? সাহাবীরা তো জীবনভর নবীর সঙ্গী ছিলেন, তাঁরা কি নবী ছিলেন। আর এর চেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয় কী হতে পারে যে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা., হযরত ওমর রা., হযরত উসমান রা. হযরত আলী রা. ও অন্যান্য সাহাবী যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সবচেয়ে বেশি আনুগত্য করলেন তাদের কেউ নবী হলেন না। তাবেয়ীরা হলেন না, তাবে তাবেয়ীরা হলেন না, ইমামগণ কেউ হলেন না। নবী হয়ে গেলেন গোলাম আহমদ কাদিয়ানী। এমন অবাস্তব অর্থহীন কথা তো একজন সাধারণ চিন্তাশীল মানুষও বুঝতে পারে।
আয়াতের শানে নুযুল জানা থাকলে আয়াতের সঠিক অর্থ-আরো পরিষ্কার হবে।
‘‘এক আনসারী সাহাবী চিন্তিত অবস্থায় নবীজীর দরবারে আসলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, তোমাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি একটি বিষয় নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। নবীজী বললেন, তা কী বল। তখন সাহাবী বললেন, আমরা সকাল-সন্ধ্যা আপনার দরবারে আসি, আপনাকে দেখি, আপনার কাছে বসি। কিন্তু আখেরাতে তো আপনার মর্যাদা অনেক উঁচু হবে, আপনি নবীদের সাথে থাকবেন; আমরা তো আপনার পর্যন্ত পৌঁছতে পারব না (এ বিষয়টি নিয়ে আমি খুব চিন্তিত ও ব্যাথিত)। নবীজী তৎক্ষণাৎ কোনো জবাব দিলেন না। ফলে আয়াত নাযিল হল, (তরজমা) আর যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে তারা সেই সকল লোকের সঙ্গে থাকবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, অর্থাৎ নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সালিহগণের সঙ্গে। আর কতই না উত্তম সঙ্গী তারা। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, সুসংবাদ গ্রহণ কর। (তাফসীরে তাবারী ৪/১৬৬ (সূরা নিসা ৪ : ৬৯); তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৭৯৯; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস : ১৩১৭; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস : ১২৫৫৯)
এই কথা বলার পরে সে একটু রাগের স্বরে বলল, আপনারা বকশীবাজার যান। সেখানে গেলে সকল প্রশ্নের উত্তর পাবেন।
এরপরে আমরা তাকে বললাম, ভাই, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তো অনেক দাবী করেছে। একবার বলে আমি মাসীহ, আরেকবার বলে, আমি মাহদী, আমি নবী, আমি কৃষ্ণ, আমি মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (নাউযুবিল্লাহ)। যে ব্যক্তি নিজে এতগুলো দাবি করে তার ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
তার একই কথা আপনারা বকশী বাজার যান। একপর্যায়ে বললাম, বকশী বাজার হতে আপনাদেরকে মুআল্লিম হিসাবে এখানে পাঠানো হয়েছে। আপনারা প্রত্যেক কথায় বলছেন, বকশী বাজার যান। তাহলে আপনারা এখানে এসেছেন কী জন্য? যাইহোক দীর্ঘ আলোচনার পরে আমরা চলে এলাম।
একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম যে, সেখানকার অধিকাংশ কাদিয়ানী মনে করে মির্যা নবী হওয়ার দাবি করেনি; মির্যা হচ্ছে শুধু ইমাম মাহদী। নিঃসন্দেহে এটি কাদিয়ানীদের দাওয়াতের একটি কূট-কৌশল। প্রথম পর্যায়ে অর্ধেক ও অস্পষ্ট গোমরাহির ফাঁদে ফেলে, পরে পুরো ঈমানেরই বিলুপ্তির ব্যবস্থা করে। যেমন আমরা মুআল্লিমের সাথে কথোপকথনে দেখলাম যে, সে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে উম্মতী নবী, যিল্লি নবী, বুরুযী নবী দাবি করছে। আর সাধারণ মানুষ বলছে, আমরা তাকে মাহদী হিসেবে মানি।
আমরা সালসিড়ি হতে ভ্যানে আহমদনগরের দিকে আসছিলাম। ভ্যানওয়ালা ছিল কাদিয়ানী। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই, আপনি কীভাবে কাদিয়ানী হলেন? মির্যা কাদিয়ানীকে আপনি কী মনে করেন? লোকটি বলল, আমার বাড়ি ময়মনসিংহ। আমি এখানে এক কাদিয়ানী পরিবারে বিবাহ করেছি। আমাকে তারা জায়গা দিয়েছে ও ঘর বানিয়ে দিয়েছে। আমার মা-বাবা সবাই মোহাম্মাদী (মুসলমান)। আমার পরিবারে আমি একাই আহমদী। আমরা বললাম, মির্যা সাহেবকে আপনি কী হিসাবে মানেন? সে বলল, আমরা তাকে ইমাম মানি। বললাম, তাকে নবী মানেন না? বলল, না; আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই তো শেষ নবী। তার পরে আর কোনো নবী আসবে না।
এইভাবে এখানকার প্রায় ৮০ ভাগ সাধারণ কাদিয়ানী মুখে মুখে বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই শেষ নবী আর মির্যা কাদিয়ানী নবুওতের দাবি করেনি, শুধু ইমাম মাহদী হওয়ার দাবি করেছে।
কাদিয়ানী উস্তাদরা প্রথম পর্যায়ে সাধারণ লোকদের কাছে মির্যার নবুওত দাবির বিষয়টা প্রকাশ করে না। যখন দাওয়াতপ্রাপ্তরা কাদিয়ানী মতবাদের ওপর কিছুটা মজবুত হয়ে যায় তখন তাদেরকে বলা হয় মির্যা সাহেব উম্মতী নবী। এইভাবে ধোকা দিয়ে তারা সাধারণ মুসলমানের ঈমান নষ্ট করছে।
আর এদের কানে কখনও হকের দাওয়াত পৌঁছেনি। লোকগুলো না বুঝে ঈমানহারা হচ্ছে। তারা জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি হারাচ্ছে - ভাবতেই কষ্ট লাগে! বড় কষ্ট লাগে!
আমরা চলে আসার সময় মুআজ্জিন সাহেব আমাদেরকে বললেন, হুজুর! আমরা এদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। আপনারা যদি আমাদের জন্য ছোট ছোট কিছু বই পাঠান তাহলে আমাদের বড় উপকার হয়। বিষয়টা নিয়ে খুব
ভাবলাম। আসলে এজাতীয় বিষয়ে আমাদের অনেক ছোট ছোট বইয়ের প্রয়োজন। কাদিয়ানীদের কাছে কেউ গেলে তার হাতে কয়েকটা চটি বই ধরিয়ে দেয়। অপর দিকে আমাদের উল্লেখযোগ্য পুস্তিকা ও ছোট বই নেই। কাদিয়ানী মতবাদের উপর আকাবিরগণ যে কিতাবের ভান্ডার লিখে গিয়েছেন তার কিছু অংশও যদি অনুবাদ করে উপযোগী আয়তন ও কলেবরে পরিবেশন করা হয় তাহলেও যথেষ্ট। আফসোস! এতগুলো মানুষ ঈমানহারা হয়ে গেছে, আর আমরা তাদের ব্যাপারে বে-ফিকির হয়ে আছি।
হে আল্লাহ! আমাদের সবাইকে এই সকল ভাইদের ঈমান হেফাযতের ফিকির করার তৌফিক দান করুন। আমাদেরকেও ঈমান-পরিপন্থী সব ধরনের ফেৎনা থেকে হেফাযত করুন। আমীন। ষ