মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন একই দিনে ঈদ-প্রসঙ্গ দায়িত্বশীলদের উপর ছেড়ে দিন-১১
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কিছু পুস্তিকা : সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
সওম ও ঈদে ঐক্য ফরয দাবি করে অনেক প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। পুস্তকও কম নয়; কিন্তু অধিকাংশ প্রবন্ধ ও পুস্তিকা এমন লোকদের লেখা, যাদের যথানিয়মে ইলমে দ্বীন হাসিল করার সুযোগ হয়নি। এ সত্ত্বেও শুধু ব্যক্তিগত পড়াশোনাকে পুঁজি করে, যা কিছু কিতাবের শুধু অনুবাদ পাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, একটি একান্তই দ্বীনী ও ইলমী বিষয়ে কলম ধরেছেন যা বেশ কঠিনও বটে। শুধু কলমই ধরেননি একদম বিচারকসুলভ ভঙ্গিতে ও আক্রমণাত্মক ভাষায় ‘অনেক কিছু’ লিখে ফেলেছেন। আল্লাহ তাদের মাফ করুন এবং তাদের সদিচ্ছা ও ভালো কাজের প্রেরণাকে সঠিক ক্ষেত্রে সঠিক পন্থায় ব্যবহারের তাওফীক দান করুন। আমীন।
কিছু পুস্তিকা এমনও আছে, যেগুলোর লেখক হয়তো পদাধিকার বলেই নিজেকে এ বিষয়ে কলম ধরার যোগ্য মনে করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হল, সেগুলোতেও রয়েছে অনেক অবান্তর-অমূলক কথা। সাথে সাথে আলিমগণের প্রতি অজ্ঞতা, ভীরুতা, বাপ-দাদার অন্ধ অনুকরণ ও সত্য গোপনের অভিযোগ। তাছাড়া একটি ইজতিহাদী ও ইখতিলাফী মাসআলার এমন উপস্থাপন তারা করেছেন, যেন তা এক মানসূস আলাইহি অকাট্য ও ইজমায়ী মাসআলা!!
পুস্তিকাগুলি (বিশেষ করে যেগুলি কোনো পদাধিকার বলেও লেখা হয়নি) যদিও নীতিগতভাবে কোনো খন্ডন বা পর্যালোচনার যোগ্য নয়, তথাপি যেহেতু অনেকে এ ধরনের বইপত্রের কারণে বিভ্রান্তির শিকার হন সেজন্য একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা মুনাসিব মনে হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা এর দ্বারা আমাদের সকলকে উপকৃত করুন। আমীন।
কিছু কথা এমন আছে, যা অধিকাংশ পুস্তিকায় এক এবং সেগুলোর কয়েকটির উপর ইতিমধ্যে পর্যাপ্ত আলোচনা হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। যেমন-
এক. উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না-হওয়াকে হানাফী মাযহাবের ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বলে দাবি করা। এবং দুই. উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না-হওয়া আর গোটা বিশ্বে রোযা ও ঈদ একই দিনে হওয়াকে সমার্থক মনে করা। ইতিপূর্বে দলিল-প্রমাণসহ বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে যে, এ মাসলাক (উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না-হওয়া) হানাফী মাযহাবের ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ হওয়া প্রমাণিত নয়; বরং অন্য মাসলাকটিই হানাফী মাযহাবের অধিকাংশ বড় বড় ফকীহদের সিদ্ধান্ত। আর তা হচ্ছে উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য এবং দূর-দূরান্তের শহর-নগরে এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলে অবশ্য-অনুসরণীয় নয়। তদ্রূপ একথাও বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে যে, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার অনিবার্য অর্থ এই নয় যে, সওম ও ঈদ এক করার প্রচেষ্টা শরীয়তের দৃষ্টিতে জরুরি।
সুতরাং ‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়’-এ মাসলাকের উল্লেখ কোথাও দেখলে এ মনে করে আনন্দিত হয়ে যাওয়া যে, এতে সিয়াম ও ঈদের বিষয়ে ঐক্য কাম্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে নিতান্তই বালখিল্যতা।
এ কথাও অনেক বিশদভাবেই বলা হয়েছে যে, ‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়া’র মাসলাককে বাহানা বানিয়ে নিজ দেশের ওলামা ও উমারা থেকে আলাদা হয়ে পৃথক পৃথক দিনে রোযা ও ঈদ করা বিচ্ছিন্নতার শামিল, যা থেকে বেঁচে থাকা অপরিহার্য।
আলোচিত পুস্তিকাগুলোর অভিন্ন বক্তব্যসমূহের অনেক কথাই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অমূলক। আর কিছু কথা অসার ও হাস্যকর। তবে আফসোসের বিষয় এই যে, এসব কথাকেও অনেকে বাস্তব ও ওজনদার মনে করে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। তাই এই অভিন্ন বক্তব্যগুলোর পর্যালোচনা কিছুটা বিস্তারিতভাবে করার ইচ্ছ রাখি। আর তা হবে নিম্নের শিরোনামসমূহের অধীনে।
১. কুরাইব রাহ.-এর বর্ণিত হাদীস ‘ছুবূত’ ও ‘দালালত’ (হাদীস হিসেবে প্রমাণিত হওয়া ও তা থেকে বিধান সাব্যস্ত হওয়া) উভয় দিক থেকে নির্ভরযোগ্য দলিল।
২. উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য হওয়া দলিলের দাবি, বিশেষ কোনো সময় বা পরিবেশের বিধান নয়।
৩. দেশের রাজনৈতিক সীমা ও পৃথক পৃথক হেলাল কমিটি : একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিকহী বিশ্লেষণ।
৪. সিয়াম ও ঈদে ঐক্য এবং জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতির্বিদগণ : একটি বস্ত্তনিষ্ঠ বিশ্লেষণ।
৫. কিছু অনর্থক আপত্তি
ক) ফরয রোযা ত্যাগ করে হারাম রোযা রাখা প্রসঙ্গ
খ) এক একটি রোযার জন্য ৬০টি করে রোযার কাফফারা
গ) নাজায়েয কাজে রাষ্ট্রের আনুগত্যের অপবাদ
ঘ) আরাফা দিবসের রোযা, তাকবীরে তাশরীক, ঈদুল আযহা, শবে কদর ইত্যাদি নস্যাৎ হওয়া
৬. কিছু হাস্যকর আপত্তি
৭. সিয়াম ও ঈদ বিষয়ে ঐক্যের প্রবক্তাদের প্রতি কয়েকটি প্রশ্ন
ক) ফরয কিংবা ওয়াজিব হওয়ার দলিল কী?
খ) এই ফরযের উদ্ভাবন দেড় হাজার বছর পরে কেন?
গ) কী হবে ঐক্যের ভিত্তি-সৌদি আরবের হেলাল কমিটির সিদ্ধান্ত, প্রথম চাঁদ দেখা, নাকি চান্দ্র ক্যালেন্ডার?
ঘ) ঐক্য সাধনের দায়িত্ব কে পালন করবেন?
ঙ) বাস্তবতার আলোকে ঐক্যের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে ভাবা হয়েছে কি?
আল্লাহ তাআলার ফযল ও করমে এসব বিষয়ে আলোচনা করার পর ইনশাআল্লাহ প্রবন্ধের সর্বশেষ শিরোনাম হবে-‘‘সিয়াম ও ঈদে ঐক্য : দলিল ও বাস্তবতার আলোকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ মতামত’’
প্রবন্ধের এই শেষ অধ্যায়ের আগে এ বিষয়ে লিখিত কয়েকটি পুস্তিকা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন কিছু কথা আলোচনা করা
মুনাসিব মনে করছি। যেন পাঠকবৃন্দ সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন যে, আমাদের দেশে যারা সিয়াম ও ঈদে ঐক্যের আড়ালে ওলামায়ে কেরামের প্রতি জনমনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করছেন তারা আসলেই কি কোনো ইলমী ও দ্বীনী বিষয়ে কলম ধরার অধিকার রাখেন?
১. ফাতাওয়া-এ-ইছাহাকীয়া
সাদ্রা, হাজীগঞ্জ
অনেক আগে থেকেই শুনে আসছি যে, সাদ্রা, হাজিগঞ্জ, চাঁদপুরের পীর সাহেব ও তাঁর মুরীদরা প্রতি বছর সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে ঈদ করেন এবং এ-ও শুনতাম যে, তার খানদানে এ নিয়ম অনেক পুরানো। আমাদের আশ্চর্য লাগত যে, কেন তাদের এই নিয়ম? কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকহে ইসলামীতে চাঁদ দেখা, বা রমযান ও ঈদ প্রমাণিত হওয়ার জন্য কি সৌদি আরব বা বিশেষ কোনো অঞ্চলকে মানদন্ড বানানো হয়েছে? আরো চিন্তা করতাম যে, দ্রুতগতির যোগাযোগ মাধ্যম আসার আগে সৌদিয়ার চাঁদ দেখার সংবাদই বা তাদের কাছে কোন সূত্রে পৌঁছত? ‘তরীকে মুজিবে’র প্রসঙ্গ না হয় বাদই রইল।
মোটকথা, উদয়স্থলের ভিন্নতাকে ধর্তব্য বলুন বা না বলুন, উপরের নিয়মে সৌদিয়ার সাথে ঈদ করা, একটি আবেগপ্রসূত কর্মপন্থা তো হতে পারে, ইলমী কর্মপন্থা হতে পারে না।
পরে মাওলানা আবু যোফর মুহাম্মদ আবদুল হাই সাদ্রাভী অনূদিত পুস্তিকা ‘‘চাঁদ, রোযা ও ঈদের ফতোয়া’’ (ফাতাওয়া ইছাহাকীয়া) হস্তগত হল, যা মূলত তার পিতা ও পীর মাওলানা মুহাম্মদ ইছ্হাক রাহ.-এর একটি অমুদ্রিত পুস্তিকা।
পুস্তিকাটি অধ্যয়ন করে দেখা গেল, এতে ফিকহের কিছু কিতাবের উদ্ধৃতিতে ‘‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়’’-এই মাসলাক প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এতেও আমার আশ্চর্য কমল না। কেননা ‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ এই মাযহাবের দাবি তো এই নয় যে, সৌদি আরবের চাঁদ দেখা ধর্তব্য হওয়া উচিত; বরং এর দাবি হল, সবার আগে দেখা চাঁদ ধর্তব্য হবে। তাহলে তাদের নিকট উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার অর্থ যদি এই হয় যে, অন্যান্য এলাকার চাঁদ দেখার সংবাদ সংগ্রহ করা ও তা যাচাই করা জরুরি তবে তো সবচেয়ে আগে দেখা চাঁদ অনুযায়ী আমল করতে হবে। আগে দেখা চাঁদের বিষয়টি যাচাই করা ছাড়াই প্রতি বছর চোখ বন্ধ করে সৌদি আরবের সাথে কেন সিয়াম ও ঈদ পালন করেন? তাও আবার নিজ দেশের ওলামা ও উমারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে? অথচ এ ধরনের বিচ্ছিন্নতা সর্বসম্মতিক্রমে অবশ্যপরিত্যাজ্য। এছাড়া কোন্ ‘তরীকে মুজিবে’র মাধ্যমে পীর সাহেব সত্তর বছর আগেও সৌদি আরবের চাঁদ দেখার বিষয়টি সময়মতো অবগত হতেন? তেমনি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা কাযীর ফয়সালা তার কর্তৃত্বের সীমানার বাইরে আমলযোগ্য হওয়ার বিষয়টিও পীর সাহেব ফিকহ-ফতোয়ার কোন্ কিতাব থেকে গ্রহণ করলেন?
পরে পীর সাহেবের (আবু যোফার মুহাম্মদ আবদুল হাই হাফিযাহুল্লাহ) আরেকটি পুস্তিকা ‘ইয়াসআলূনাকা আনিল আহিল্লাহ’ হস্তগত হল। এর দ্বিতীয় অংশে পীর সাহেবের সম্মতি ও সমর্থনসহ দৈনিক মানব জমিন পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় (২০০৬ ঈ.) প্রকাশিত রানা জামানের নেওয়া একটি সাক্ষাৎকার পড়ে প্রথম আশ্চর্য আরো দৃঢ় হল। কারণ এই পুরো সাক্ষাৎকারে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার প্রসঙ্গ কোথাও নেই; বরং পরিষ্কার ভাষায় এ কথাই বলা হয়েছে যে, তারা সৌদিয়ার অনুসরণে (নিজ দেশের উলামা ও উমারা থেকে আলাদা হয়ে) রোযা আগে শুরু করেন এবং ঈদও আগে করেন এবং এর ইতিহাস ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, উনিশ শতকের প্রথম-দ্বিতীয় দশকের দিকে নোয়াখালির বসিকপুর (বর্তমানে লক্ষ্মীপুর)-এর মাওলানা আবদুল হামীদ সাহেব সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে ঈদ করেছিলেন। ঐ সময় সাদ্রার সাবেক পীর সাহেব মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ছিলেন বসিকপুর মাদরাসার তালিবে ইলম। ঐ সময় তিনি হাদীস ও বিভিন্ন দ্বীনী কিতাব পড়ে এ কথার দলিল পান যে, ঈদ ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে উদযাপন করা চাই। এরপর তিনি নিজ এলাকায় এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের সংকল্প করেন। সেমতে ১৯২৮ খৃ. তিনি এর চেষ্টা করেন। প্রথম দিকে সফল না হলেও পরে ধীরে ধীরে এ ধারা ব্যাপক হতে থাকে। (ইয়াসআলূনাকা আনিল আহিল্লাহ পৃ. ৮)
পীর সাহেবের হালত আমার জানা নেই। তবে আমরা শুদ্ধ আকীদার সুন্নত ও শরীয়তের পাবন্দ পরহেযগার বুযুর্গদের সম্মান করি, কিন্তু স্বয়ং ঐ বুযুর্গদের শিক্ষা এই যে, পীর সাহেবের কথা-কাজ শরীয়তের দলিল নয়; বরং তিনি নিজেও শরীয়তের দলিল অনুযায়ী চলতে ও মুরীদগণকেও সে অনুযায়ী চালাতে বাধ্য। এজন্য আদবের সাথে আমাদের প্রশ্ন, কোন্ হাদীসে ও কোন্ দ্বীনী কিতাবে পীর মুহাম্মদ ইসহাক সাহেব ও তার উস্তায এ মাসআলা পেয়েছেন যে, সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে ঈদ উদযাপন করা উচিত? কোনো ‘হাদীসে’ এ কথা থাকলে তো সেটা পৃথিবীর মানচিত্রে সৌদিয়ার জন্মের পর প্রস্ত্ততকৃত ‘হাদীস’ হবে! সহীহ হাদীসে সৌদিয়ার কথা কীভাবে থাকতে পারে? অতপর হাদীসের ভাষ্যগ্রন্থ, তাফসীর গ্রন্থ এবং ফিকহ-ফতোয়ার কোন কিতাবে এ মাসআলা আছে যে, সৌদি আরবের সাথে ঈদ কর?! এ তো কিছু আবেগপ্রবণ মানুষের আবেগপ্রসূত কর্মকান্ড। কোনো শরয়ী দলিলের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
যাইহোক, ওই সাক্ষাৎকার দ্বারা এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সাদ্রাওয়ালাদের এই বিচ্ছিন্ন কর্মপন্থা মূলত আবেগপ্রসূত। কিন্তু ফাতওয়া ইছাহাকীয়া ও ইয়াসআলূনাকা আনিল আহিল্লা-এর প্রথম অংশে ‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না-হওয়ার মাসলাকের অবতারণা তাদের কর্মপন্থা আবেগপ্রসূত হওয়ার বিষয়টি গোপন করার প্রচেষ্টামাত্র। তাই এ সম্পর্কেও সংক্ষেপে কয়েকটি কথা আরয করছি :
ক. ‘‘ফাতাওয়া ইসহাকিয়্যাহ’’ ও ‘‘ইয়াসআলূনাকা আনিল আহিল্লাহ’’-এর প্রথম অংশের সকল আলোচনার ভিত্তি পীর সাহেবের ভাষায় এই যে, আমরা বাংলাদেশের অধিবাসীদের অধিকাংশই হানাফী মাযহাবের মুকাল্লিদ। আর মুকাল্লিদের জন্য নিজ মাযহাবের বিরোধিতা বৈধ নয়। হানাফীদের জন্য শাফেয়ী মাযহাব অনুসারে আমল করা শরীয়তে জায়েয নয়।
এবং হানাফী মাযহাবের জাহিরুর রিওয়াহ’র ফয়সালা এই যে, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়। পশ্চিমের লোকেরা চাঁদ দেখলে পুবের লোকদের উপর রোযা ফরয হয়ে যায়। আর হানাফী মাযহাবে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’র ফয়সালা অকাট্য ও চূড়ান্ত। সুতরাং কোনো কিতাবে এর বিপরীত কিছু থাকলে তা গ্রহণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, না জায়েয ও অবৈধ। (ফাতাওয়া ইসহাকিয়্যাহ পৃ. ৪২, ২৬-৩২, ইয়াসআলূনাকা আনিল আহিল্লাহ পৃ. ১১)
যেহেতু পীর সাহেবের সকল আলোচনার সারসংক্ষেপ এ কটি কথাই এজন্য বিস্তারিত পর্যালোচনার প্রয়োজন নেই। কারণ প্রথমত ‘‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়া’’ শীর্ষক মাসলাক ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ হওয়াই প্রমাণিত নয়। দ্বিতীয়ত এ কথাও ঠিক নয় যে, ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’র বিপরীতে কোনো মাসআলা গ্রহণযোগ্য নয়; পীর সাহেবের জানা থাকার কথা, তিনি কমপক্ষে ইবনে আবেদীন শামীর ‘শরহু উকূদি রাসমিল মুফতী’ অবশ্যই পড়ে থাকবেন। আর না হয় ‘আদ্দুররুল মুখতার’ ও ‘ফাতাওয়া শামী’র ভূমিকায় লিখিত ‘রাসমুল মুফতী’ তো পড়েছেনই। তাই এ বিষয়ে তার কোনো বিভ্রান্তি থাকার কথা নয়। একটু খেয়াল করলে তিনি তার নিজের ভুল নিজেই সংশোধন করে নিতে পারেন। কত স্পষ্টভাবে এসব কিতাবে এবং উসূলুল ইফতার অন্যান্য নির্ভরযোগ্য কিতাবে এ নীতির উল্লেখ রয়েছে যে, ‘আসহাবুত তারজীহ’শ্রেণীর ফকীহগণ মাযহাবের যে রেওয়ায়েতকে বা মাশায়েখে মাযহাবের যে ‘ক্বওলকে’ অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করেন তার উপর আমল করা জরুরি।
আলোচ্য বিষয়ে অধিকাংশ বড় বড় হানাফী ফকীহ, যাদের অনেকেই আসহাবুত তারজীহের অন্তর্ভুক্ত, দূর দূরান্তের শহর-নগরে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য হওয়ার মাসলাকই গ্রহণ করেছেন। যেমনটা তাদের বরাতসমূহে গিয়েছে। আলকাউসার যিলহজ্ব ১৪৩৪ হি. ও
মুহাররম ১৪৩৫ হি. সংখ্যায় এ বিষয়ে পাঠকবৃন্দ অনেক নির্ভরযোগ্য উদ্ধৃতিতে সে সকল ফকীহগণের ইবারত/মূলপাঠ দেখেছেন। তাই এ বিষয়ে অতিরিক্ত পর্যালোচনার প্রয়োজন নেই।
খ. পৃষ্ঠা ২৭-এ দাবি করা হয়েছে, হেদায়া কিতাবে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার কথা আছে। অথচ হেদায়ায় এ ধরনের কোনো কথা মোটেই নেই; বরং হেদায়া লেখক ইমাম আবু বকর আলমারগীনানী (মৃত্যু : ৫৯৩ হি.)-এর কিতাব ‘‘আততাজনীছু ওয়াল মাযীদ’’ ও ‘‘মুখতারাতুন নাওয়াযিল’’-এ দূর-দূরান্তের শহর-নগরে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য হওয়ার ফতোয়া আছে। ইতিপূর্বে তার বরাত ও উদ্ধৃতি উল্লেখিত হয়েছে।
হেদায়ার মতো একটি প্রসিদ্ধ কিতাবের নামে এ অমূলক উদ্ধৃতি কীভাবে দেওয়া হল তা আল্লাহ তাআলাই জানেন।
গ. পৃষ্ঠা ৪১-৪২-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘তাকরারুল মা’সিয়াতি কুফরুন’ বা ইছরারুন আলাল মা’ছিয়াতি কুফরুন’ এবং ব্র্যাকেটে তরজমা করা হয়েছে : ‘গুনাহ বার বার করা কুফরী’
পীর সাহেব একে এ বিষয়ে প্রয়োগ করেছেন যে, প্রতি বছর নিজ দেশের চাঁদ দেখার উপর আমল করার কারণে তাকবীরে তাশরীক নয় যিলহজ্বের স্থলে দশ বা এগার যিলহজ্বে শুরু হয়। এভাবে প্রতি বছর পাঁচ বা দশ ওয়াজিব ফওত হয়ে যায়। পীর সাহেব বলেন, এর প্রেক্ষিতে আমার ঐ মত ‘‘গুনাহ বারবার করা কুফরী’’ মনে পড়ে এবং দিল কেঁপে ওঠে। (পৃষ্ঠা : ৪২)
প্রশ্ন এই যে, উপরোক্ত কথাটি কুরআনের কোন আয়াত বা কোন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত? আর তা হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য কোন কিতাবে আছে?
এ কথা মূলত কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবেই নির্ভরযোগ্য দলিলসহ বিদ্যমান নেই। সমঝদার সবাই বুঝে, এটি একটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা।
কোনো মুমিন এক গুনাহ বারবার করতে পারে না। গুনাহ হয়ে গেলেই তাকে তওবা করে নিতে হবে। কিন্তু এ কথা কে বলল যে, কোনো গুনাহ বারবার করা হলে সেটা কুফর হয়ে যায়!!
তো প্রথম কথা হল, পীর সাহেবের এই বক্তব্যটিই ভুল। দ্বিতীয় কথা হল, তিনি এটাকে একটি মুজতাহাদ ফীহ ইখতিলাফী মাসআলায় প্রয়োগ করেছেন, যে ব্যাপারে সকল মুজতাহিদের ঐকমত্য রয়েছে যে, এজাতীয় মাসআলায় প্রত্যেক মুজতাহিদ ও তার অনুসারী মুকাল্লিদগণ নিজেদের মাসলাক অনুযায়ী আমল করবেন। যদিও অন্য মুজতাহিদের দৃষ্টিতে তার এ কাজ ভুল হোক না কেন!?
এজন্য যেসকল ফকীহ ও তাদের অনুসারীগণ নিজ নিজ এলাকার চাঁদ দেখা অনুযায়ী আমল করেন তাদের ব্যাপারে এই দাবি করা যে, তারা তাকবীরে তাশরীক শুরু করেন পরে এবং এভাবে তারা গুনাহগার হন-এ কথা সম্পূর্ণ ইজমা পরিপন্থী। অন্যথায় উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মাসলাক অনুযায়ী আমলকারীদের ব্যাপারে এ ধারণা করা যাবে যে, তারা নির্ধারিত সময়ের আগেই তাকবীরে তাশরীক শুরু করে দেয় এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করে। ফলে তাদেরও পাঁচ বা দশ ওয়াক্তের তাকবীর ফওত হয়ে যায়। কুরবানী ১০ যিলহজ্বের পরিবর্তে ৯ যিলহজ্বে করে।
রোযা পহেলা রমযানের পরিবর্তে ৩০ শাবানে শুরু করে। ঈদুল ফিতর পহেলা শাওয়ালের পরিবর্তে ৩০ রমযানে করে। পীর সাহেব কি এসব কথা মেনে নিবেন? অথচ তার এসব মেনে নেওয়া উচিত। কারণ তাদের আমল তো কোনো মুজতাহাদ ফীহ
মাযহাব অনুযায়ীও হচ্ছে না; বরং ভুল কর্মপদ্ধতির কারণে তারা ‘শুযূয’-এর সীমানায় চলে যান।
তো তাদের দৃষ্টি নিজেদের ভুল কর্মপদ্ধতির উপর না পড়ে সঠিক পদ্ধতিতে আমলকারীদের উপর গিয়ে পড়ছে। এমনকি সেজন্য তাদের উপর পরোক্ষভাবে কুফরের অপবাদও চাপিয়ে দেওয়া চ্ছে।
ঘ. ‘ফাতাওয়া ইসহাকিয়্যাহ’ পৃষ্ঠা : ৩৪-এ লেখা হয়েছে-
‘‘কুরআনে পাকের কোন আয়াত বা কোন হাদীছ শরীফের ব্যাখ্যা করিতে হইলে নিজ মাযহাবের রায় অনুপাতে করিতে হয় তাই ঐসমূহের অছুল এবং নিজ ইমাম বা মাহযাবের মতামত ভালরূপে জানা আবশ্যক।
অন্যথায় মনগড়া ব্যাখ্যার কারণে বিভ্রান্তি ও বিপদ ঘটে এবং গোমরাহ হওয়ার ভয় থাকে।’’
এ আশ্চর্য বাক্য পীর সাহেবের কলমে কীভাবে এল? এ ধরনের অসতর্ক কথা বা অসতর্ক বাক্যের দ্বারা মানুষের আকীদা নষ্ট হয় এবং মাযহাব ও তাকলীদের বিরোধিতাকারীরাও সুযোগ পায়।
কুরআনের তাফসীর ও হাদীসের ব্যাখ্যার জন্য নিয়ম-নীতি আছে, যা উসূলে তাফসীর, শরহে হাদীস ও উসূলে ফিকহের কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে। ঐ নীতিমালা শরয়ী দলিল দ্বারা প্রমাণিত। মুজতাহিদ ইমামগণ ঐ সকল নীতির আলোকেই কুরআন-হাদীস থেকে মাসাইল আহরণ করেছেন। আর এই সকল নীতির কোনো কোনোটি ইজতিহাদী ও ইখতিলাফী হওয়ায় এবং কোনো কোনো নীতির প্রয়োগের ক্ষেত্রে মতভিন্নতার সম্ভাবনা থাকায় কিছু আয়াত ও কিছু হাদীসের অর্থ নির্ধারণ ও তা থেকে বিধান আহরণের ক্ষেত্রে তাদের মাঝে মতভেদ হয়েছে, তবে নবী-যুগ ও সাহাবা-যুগ থেকে তাওয়ারুছের সাথে বর্ণিত ও ‘মুতালাক্কা বিল কবুল’ (সর্বসম্মতভাবে প্রমাণিত ও ইসলামের শুরু যুগ থেকে ব্যাপকভাবে অনুসৃত) কোনো তাফসীর বা ব্যাখ্যায় ইমামদের মাঝে মতভেদ হয়নি।
কিছু মুলহিদের রীতি, তারা আয়াত ও হাদীসের ‘মুতালাক্কা বিল কবুল’ ও ‘ইজমায়ী’ অর্থ অস্বীকার করে ইসলামী আকীদাসমূহের ‘তাহরীফ’ ও অপব্যাখ্যা করে থাকে। আর কিছু লোকের নিয়ম, ইজতিহাদী-ইখতিলাফী বিধান, যা ইখতিলাফী ও ইজতিহাদী হওয়া সর্বজন স্বীকৃত; তাতে একটি ব্যাখ্যা গ্রহণ করে অন্য সকল ইজতিহাদী ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা অস্বীকার করে। আর স্বীকৃত তাকলীদকে অস্বীকার করে পরোক্ষভাবে মানুষকে নিজের তাকলীদে বাধ্য করে।
পীর সাহেব সম্ভবত ঐ ‘মুতাআসসিব’ লোকদের ভুল কর্মপন্থার দরজা বন্ধ করার জন্য এ কথা লিখেছেন, কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেননি, তার বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ থেকে কত বড় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে!!
কে না জানে যে, কুরআন ও সুন্নাহ হচ্ছে মূল আর মাযহাব তার ব্যাখ্যাতা। মাযহাব যিনি সংকলন করেছেন তিনি ইমাম, মা’সূম নন। কোথাও তার ভুল হয়ে থাকলে না সেই ভুলকে কুরআন ও হাদীসের তাফসীর বানানো যায় আর না তা মাযহাবের অনুসরণযোগ্য অংশে শামিল হতে পারে। কিন্তু অমুক মুজতাহিদ অমুক মাসআলায় সত্যিই ভুল করেছেন এ সিদ্ধান্ত শুধু অন্য মুজতাহিদ ও গভীর পান্ডিত্যর অধিকারী আলিমগণই দিতে পারেন। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, সাধারণ আলিমদের পক্ষেও তা সম্ভব নয়। আর এ ফয়সালা শুধু দাবির দ্বারাই প্রমাণিত হবে না, তা প্রমাণিত হতে হবে দলিল দ্বারা।
মোটকথা, কুরআন ও হাদীসের তাফসীর কোনো বিশেষ ইমামের বিশেষ মতকে ভিত্তি বানিয়ে হবে না; বরং তা হবে তাফসীর ও শরহে হাদীসের স্বীকৃত নীতিমালার ভিত্তিতে। আর সে অনুযায়ী নির্ভরযোগ্য আহলে ইলমের পক্ষ থেকে যে তাফসীর হবে তা থেকে ইজমায়ী বিধানগুলোর অকাট্যতা স্পষ্ট হতে থাকবে এবং ইজতিহাদী বিষয়গুলো ইজতিহাদী হওয়া প্রমাণিত হবে। তেমনি কোনো মুফাসসির বা ভাষ্যকার থেকে তাফসীর বা ভাষ্যে এবং কোনো ফকীহ থেকে কোনো হুকুম ইস্তিম্বাতে ভুল হয়ে থাকলে তা থেকে সেটার ভুল হওয়াও স্পষ্ট হতে থাকবে।
যা হোক, এ তো ছিল পীর সাহেবের ঐ বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী অস্পষ্ট বাক্যের উপর প্রয়োজনীয় সংশোধনী, কিন্তু প্রশ্ন এই যে, এখানে এ আলোচনার সূত্রপাত করার প্রয়োজনই বা কী ছিল। তিনি কি তার নিজের বানানো এই নীতি দ্বারা রোযা ও ঈদ বিষয়ে তার বিচ্ছিন্ন কর্মপন্থা প্রমাণ করতে পারবেন? কিংবা তার উপর উত্থাপিত আপত্তিসমূহের জবাব দিতে পারবেন? বলাবাহুল্য, কোনোটাই সম্ভব না। তাহলে শুধু শুধু এ আলোচনার অবতারণা কেন?
ঙ. ‘‘ফাতাওয়া ইসহাকিয়্যাহ’’য় কয়েক জায়গায় এ-ও লেখা হয়েছে যে-
يجب العمل بالأسبق رؤية
অর্থাৎ শুধু প্রথম চাঁদ দেখা ধর্তব্য হবে। (পৃষ্ঠা : ৩৬, ৫০)
যেমনটি আগেও বলা হয়েছে যে, কথা যদি এই হয় তাহলে সৌদি আরবের সাথে কেন, যে মাসে যে অঞ্চলে প্রথম চাঁদ দেখা যাবে ঐ মাসে তাদের সাথেই মাসের হিসাব রাখতে হবে। তাহলে সৌদি আরবকে মাপকাঠি বানানো কেন? প্রত্যেক রমযান বা প্রত্যেক শাওয়ালে প্রথম চাঁদ দেখা কি সৌদিতে হয় যে, সবসময় তার সাথে মিল রেখেই আমল করা হবে?! (বিশদ আলোচনার জন্য প্রবন্ধের শেষ অধ্যায় দেখুন)
চ. সৌদি আরবের চাঁদের ফয়সালাকারী আলিম ও কাযীগণ হাম্বলী মাযহাব অনুসারে ফয়সালা করেন। যেমন তাদের মাসলাক এই যে, উদয়স্থল একদম পরিষ্কার হলেও রমযান প্রমাণিত হওয়ার জন্য দুই সাক্ষীর বেশি জরুরি নয়; বরং তাদের কোনো কোনো আলিম এক সাক্ষীও যথেষ্ট মনে করেন। তেমনি ঈদের চাঁদ প্রমাণের জন্যও তারা আকাশ পরিষ্কার থাকার ক্ষেত্রেও দুই সাক্ষীর বেশি শর্ত করেন না।১
তাদের হেলাল কমিটি সবসময় এ নীতি অনুযায়ী ফয়সালা করে থাকে।২
পক্ষান্তরে হানাফী মাযহাবের রাজেহ কওল এই যে, আকাশ পরিষ্কার থাকার ক্ষেত্রে ‘জম্মে গাফীর’ অর্থাৎ অনেক মানুষের চাঁদ দেখতে হবে। দুই নির্ভরযোগ্য সাক্ষীর সাক্ষ্য যথেষ্ট নয়।৩
সৌদিয়ার চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করা হলে হানাফী মাযহাবের এ মাসআলার উপর আমল কীভাবে হবে, যা দলিলের দিক থেকেও রাজেহ এবং শক্তিশালী? সৌদি চাঁদ দেখার উপর এ দেশে আমল করা উচিত কি না-এ বিষয়ে ‘ফাতাওয়া ইসহাকিয়্যাহ’ ওয়ালাদের অন্তত এদিক থেকে তো চিন্তা করা উচিত।
কিন্তু তারা এসব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করবেন না। কেননা নিয়ম-নীতি বহির্ভূত, আবেগপ্রসূত কর্মপন্থা অবলম্বনকারীরা আর যাই হোক উসূল অনুযায়ী চিন্তা করবেন কীভাবে?
পীর সাহেবের সাথে একবার ফোনে কথা হয়েছিল। তিনি জানালেন, রানা জামানের প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বশিকপুরের আবদুল হামীদ সাহেবের নিজ এলাকায় সৌদি আরবের তারিখ অনুযায়ী ঈদ করার যে কথা লেখা হয়েছে এর সত্যতা তার জানা নেই।
তবে এ কথা ঠিক যে, আবদুল হামীদ সাহেব ‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়া’র মাযহাবটি খুব প্রচার করতেন। আর পীর মুহাম্মাদ ইসহাক এই শিক্ষা সর্বপ্রথম তার কাছ থেকেই লাভ করেছেন।
পীর সাহেব আরো বলেছেন, রেডিও আসার পর আমরা রেডিওর খবরের উপর নির্ভর করে থাকি। তবে এর আগে আমরা চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রোযা শুরু করতাম। আর ঈদের জন্য সৌদি আরবে রোযা কবে শুরু হয়েছে তা চিঠির মাধ্যমে জেনে নিতাম এবং সে হিসাবে ঈদ করতাম। কিন্তু এরপরও পরবর্তীতে আমরা চিঠির মাধ্যমে জানতে পারতাম যে, কখনো কখনো সৌদি আরবে ঈদ আমাদের আগেই পালিত হয়ে গেছে।
পীর সাহেব আরো বলেন, যখন আমরা চাঁদ দেখে রমযান শুরু করতাম তখনো আমাদের চাঁদ দেখা দেশবাসীরও আগে হত। আমরা লোকদেরকে বলতাম, শরীয়তে অমাবস্যা নামে কিছু নেই। তোমরা চাঁদ তালাশ কর। তখন তালাশ করলে চাঁদ দেখা যেত!!
পীর সাহেব খোলামেলাভাবেই সব কথা বলে দিয়েছেন। আসলে এসব কথা ছাড়া তার পূর্ণ কর্মপন্থা বোঝাও সম্ভব হত না। তবে এটি এক ভিন্ন প্রসঙ্গ যে, তার এই কর্মপন্থা সঠিক না ভুল।
এবার একটু লক্ষ্য করুন :
১. চাঁদ দেখা প্রমাণিত হওয়ার জন্য যেখানে শাহাদত প্রয়োজন, শুধু সংবাদ যথেষ্ট নয় সেখানে রেডিওর খবরের উপর নির্ভর করার হুকুম কী হবে? রেডিও বা টেলিভিশনে শাহাদত দেওয়া হলে তা কি গ্রহণযোগ্য হবে?
২. রেডিওতে যদি কোনো দায়িত্বশীলের ফয়সালা প্রচার করা হয় তাহলে দায়িত্বশীলের ইখতিয়ার বহির্ভূত এলাকায় সে ফয়সালার উপর আমল করার বিধান ও পদ্ধতি কী?
৩. কেউ চাঁদ দেখে রোযা শুরু করল। পরবর্তীতে চিঠির মাধ্যমে জানতে পারল যে, অমুক স্থানে ১/২ দিন আগেই রোযা শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে কি শুধু এই চিঠির উপর ভিত্তি করে সাতাশ বা আটাশতম রোযার পরই ঈদ পালন করার বিধান আছে? অথচ না নিজেরা ঈদের চাঁদ দেখল, না অন্য কোনো স্থানের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য পেল।
৪. শরীয়তে অমাবস্যা নেই-এই কথা কোন দলিল দ্বারা প্রমাণিত? আর কোন ইমাম এ কথা বলেছেন? এই ভিত্তিহীন কথায় প্রতারিত হয়ে লোকেরা যদি অমাবস্যার সময় নতুন চাঁদ তালাশ করতে থাকে এবং কেউ চাঁদ দেখার দাবিও করে বসে তবে নিঃসন্দেহে তা হবে কাল্পনিক চাঁদ। কেননা অমাবস্যার চাঁদ তো হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন, যা দেখার মতো চাঁদ বা হেলাল নয়। এ দৃষ্টিগোচর হওয়াই সম্ভব নয়। তবে কি শরীয়তে এ ধরনের কাল্পনিক চাঁদের ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ করার অনুমতি আছে?
এসব প্রশ্নের জবাব সম্পর্কে উসূল ও দলিল-প্রমাণের আলোকে পীর সাহেব ও তার অনুসারীরা চিন্তা করারও প্রয়োজন বোধ করবেন না। কারণ তাদের কর্মপন্থা তো গোড়া থেকেই আবেগভিত্তিক, নিয়ম ও উসূলভিত্তিক নয়। বিচ্ছিন্ন কর্মপন্থার লোকেরা নীতি ও উসূলের আলোকে চিন্তা-ভাবনা শুরু করলে তাদের বিচ্ছিন্নতা বাকি থাকবে কীভাবে?
ছ. ‘ইয়াসআলূনাকা আনিল আহিল্লাহ’ দ্বিতীয় অংশে এ-ও বলা হয়েছে যে, পীর মুহাম্মদ ইসহাক সাহেব ফুরফুরার পীর সাহেব হযরত মাওলানা আলহাজ আবু বকর সিদ্দীকী রাহ.-এর খলীফা ছিলেন। (পৃষ্ঠা : ৭)
ফুরফুরার হযরতের তো আমাদের এ দেশে মাশাআল্লাহ আরো খলীফা আছেন। ছারছীনার পীর সাহেবও ঐ সিলসিলার। মাগুরা, কুমিল্লা ও কিশোরগঞ্জেও ফুরফুরার সিলসিলা আছে। আমাদের জানামতে তাদের কেউ সওম ও ঈদে এখানের উলামা-উমারা সম্মিলিত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন না। তাহলে সাদ্রার ওই ভাইদের কী প্রয়োজন ছিল নিজেদের পীর ভাইদের থেকে আলাদা পথে যাওয়ার?
জ. ফতোয়া ইসহাকিয়্যাহয় (পৃষ্ঠা : ২৭) দুটো কিতাবের নাম এভাবে আছে ‘‘মাজমাউল আনহার’’ ও ‘‘জাওয়াহেরুন্নাইয়্যারা’’। এটি ভুল। শুদ্ধ হল ‘মাজমাউল আনহুর’ ও ‘আলজাওহারাতুন নাইয়িরাহ’।
ফতোয়াতেই যদি ফতোয়ার কিতাবের নাম ভুল লেখা হয় তাহলে?
ঝ. পৃষ্ঠা ১৮ তে ظن المؤمن خيرا বাক্যটি উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর তরজমা এই করা হয়েছে : মোমেন লোকের ধারণা ভাল। সাথে সাথে তা হাদীস বলে দাবি করা হয়েছে। প্রশ্ন এই যে, হাদীসের কোন কিতাবে এটি আছে এবং এর সনদ কী? এরপর এর যে ই’বারত ও তরজমা উল্লেখ করা হয়েছে তা কি সঠিক? আরবী ব্যাকরণের একজন প্রাথমিক তালিবে ইলমেরও এ ধরনের ভুল করা উচিত নয়!
আমরা তো এ উক্তি শুনেছি-
ظنوا بالمؤمنين خيرا
যার অর্থ, ‘মুমিনদের বিষয়ে সুধারণা রেখো।’ তবে তা হাদীস হওয়া তো প্রমাণিত নয়।
তাহলে বিষয়টি এমন নয় যে, ‘ফতওয়া ইছাহাকীয়া’য় শুধু ভুল ফতোয়া আছে। এতে ভুল ফতোয়ার পাশাপাশি অন্যান্য অনেক ধরনের ভুল-ভ্রান্তিও রয়েছে। সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় এরচেয়ে দীর্ঘ আলোচনা সম্ভব নয়। আর নসীহত ও কল্যাণকামিতার জন্য এটুকু আলোচনাই যথেষ্ট। যদি কল্যাণকামিতার কোনো কদরকারী পাওয়া যায়!
টীকা :
টীকা : ১. আলইনসাফ ফী মা’রিফাতির রাজিহি মিনাল খিলাফ আলা মাযহাবিল ইমামি আহমদ, মারদাভী খ : ৩, পৃষ্ঠা : ২৭৩-২৭৫
টীকা : ২. আহকামুল আহিল্লাহ ওয়াল আছারুল মুতারাত্তিবাতু আলাইহা, আহমাদ ইবনে আবদুল্লাহ
টীকা : ৩. আততাজরীদ, কুদূরী ৩/১৪৬৭; আলইখতিয়ার লিতালীলিল মুখতার ১/৪০৪; হেদায়া ও ফাতহুল কাদীর ২/২৫১-২৫২
২. আল-হেলাল
আব্দুল্লাহ আল-মা’রূফ
আলহেলাল প্রকাশনীর প্রকাশিত পুস্তিকা ড. আবদুল্লাহ আলমারূফ মুহাম্মাদ শাহ আলমের লিখিত ‘‘আলহেলাল’’ও হস্তগত হয়েছে। এ বিষয়ের অন্যান্য পুস্তিকার তুলনায় কোনো কোনো দিক থেকে বিশেষত্বের অধিকারী। কিন্তু দাবি প্রমাণে এ পুস্তিকাও ব্যর্থ। পাশাপাশি উদ্ধৃতি বর্ণনা ও তরজমার ক্ষেত্রে বেশ কিছু অসতর্কতাও রয়েছে। লক্ষ্য করুন :
১. প্রথমে সংক্ষেপ কথা এই যে, পুস্তিকার দাবি, সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদ ও অন্যান্য ধর্মীয় উৎসব পালন করাই বিধান। (আলহেলাল পৃ. ১)
এখন এ বিধান কি ফরয, না ওয়াজিব, সুন্নত না মুস্তাহাব তা স্পষ্ট ভাষায় পুস্তিকার কোথাও পাইনি। তবে গোটা পুস্তিকায় এমন অনেক বাক্য আছে, যা থেকে বোঝা যায়, তিনি একে ফরয বিধান মনে করেন।
দুঃখের বিষয় এই যে, তিনি এ দাবির উপর না ফিকহে হানাফীর কোনো কিতাবের উদ্ধৃতি নকল করেছেন, না অন্য কোনো মাযহাবের বরাত! ১৪ পৃষ্ঠায় যদিওবা লিখেছেন-
‘‘প্রিয় পাঠকবৃন্দ আমরা জানলাম চারটি মাযহাবের মধ্যে হানাফীসহ অন্য তিনটি মাযহাব এই ঐক্যমতে পৌঁছেছে যে সারা বিশ্বে একই চাঁদের অনুসরণে ঈদ-রোযা একই দিনে হবে। আশা করি এতগুলো অকাট্য দলিল প্রমাণের পর আর কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংশয়-সন্দেহ থাকার কথা নয়।’’
কিন্তু কোনো মাযহাবের কোনো কিতাব থেকেই তিনি নকল করেননি যে, একই চাঁদ দেখা অনুসারে গোটা পৃথিবীতে রোযা ও ঈদ করা ফরয। যা কিছু নকল করেছেন তা শুধু উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়া সংক্রান্ত উদ্ধৃতি। অথচ ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে যে, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না-হওয়ার অপরিহার্য অর্থ এই নয় যে, সিয়াম ও ঈদ একই দিনে হওয়া জরুরি। এ কারণে তিন মাযহাবের যে ফকীহগণ উদয়স্থলের ভিন্নতাকে অগ্রাহ্য করেছেন, আমার জানামতে তাদের কেউ অন্য অঞ্চলের চাঁদ দেখার সংবাদ সংগ্রহ করা বা এ অঞ্চলের চাঁদ দেখার সংবাদ অন্য অঞ্চলে পৌঁছানোকে ফরয বলেননি। সহজ কথা যে, গোটা বিশ্বে এক দিনে রোযা বা ঈদ ফরয হলে প্রত্যেক যুগের উপকরণ অনুযায়ী সম্ভাব্য সীমা পর্যন্ত চাঁদের খবর আদান-প্রদানও ফরয হত। কিন্তু এর একটি নযীরও কি পাওয়া যায় খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবা-তাবেয়ীনের আমলে কিংবা কোনো ফকীহ ও মুজতাহিদের উক্তিতে? একটি নির্ভরযোগ্য উদ্ধৃতিও কি পেশ করবেন ড. আবদুল্লাহ?
২. আলহেলাল পৃষ্ঠা : ১২ ও পৃষ্ঠা : ১৫ তে ‘‘আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহূ’’-এর বরাত আছে। কিন্তু তার বক্তব্য পূর্ণাঙ্গভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এ কিতাবের লেখক ড. ওয়াহবা যুহাইলী শাফেয়ী; উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মতকে অগ্রগণ্য করেছেন এবং দ্বিতীয় খন্ডের ৬১০ পৃষ্ঠায় নিজ বুঝ অনুযায়ী এর হিকমতও এভাবে বয়ান করেছেন-
توحيدا للعبادة بين المسلمين، ومنعا من الاختلاف غير المقبول في عصرنا.
অর্থাৎ যাতে ইবাদতে (রোযায়) মুসলমানদের মাঝে ঐক্য সম্ভব হয় এবং অযৌক্তিক/অগ্রহণযোগ্য ইখতিলাফ থেকে তারা বাঁচতে পারেন।
এ সত্ত্বেও ড. ওয়াহবা পরিষ্কার বলেছেন-
ولا خلاف في أن للإمام الأمر بالصوم بما ثبت لديه، لأن حكم الحاكم يرفع الخلاف، وأجمعوا أنه لا يراعى ذلك في البلدان النائية جداً، كالأندلس والحجاز، واندونيسيا والمغرب العربي.
অর্থাৎ (উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য কি না-এ বিষয়ে যদিও ইখতিলাফ আছে, কিন্তু) এতে কোনো ইখতিলাফ নেই যে, রাষ্ট্রের কর্ণধারের কাছে যে মাসলাকই প্রমাণিত হবে, সে অনুযায়ী ফয়সালা করার অধিকার তাঁর আছে। কারণ হাকিমের ফয়সালা ইখতিলাফের সমাপ্তি ঘটায়।
তদ্রূপ এ বিষয়ে ইজমা আছে যে, অনেক দূর-দূরান্তের শহর-নগরে এক জায়গার দেখা অন্য জায়গার জন্য ইতিবার নেই। যেমন স্পেন ও হিজায বা ইন্দোনেশিয়া ও মরক্কো। (আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু ২/৬০৬)
আলহেলাল ১৫ পৃষ্ঠায় যে কথার উপর আলফিকহুল ইসলামীর বরাত দেওয়া হয়েছে ঐ কথার সাথেই ড. ওয়াহবা যুহাইলী লেখেন-
والاحتياط هو الاكتفاء بتوحيد الأعياد في حدود البلاد العربية بدءا من عمان في الشرق إلى المغرب الأقصى.
অর্থ : সতর্কতা এতেই যে, ঈদ এককরণ শুধু আরব দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ রাখা। আম্মান থেকে মাগরিব পর্যন্ত। (আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু ২/৬১০)
আবদুল্লাহ আলমারূফ ছাহেব কি আলহেলালে ড. ওয়াহবা-এর এ দুটি কথা নকল করতে পারতেন না? তাহলে কেন তা করলেন না?
যাইহোক, পাঠকবৃন্দের কাছে নিবেদন এই যে, ড. ওয়াহবা-এর বক্তব্য-
ولا خلاف في أن للإمام الأمر بالصوم بما ثبت لديه، لأن حكم الحاكم يرفع الخلاف.
(রাষ্ট্রের কর্ণধারের কাছে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য হওয়া বা না-হওয়ার দুই কওলের মাঝে যেটি প্রমাণিত হবে সে অনুযায়ী তাঁর রোযার ফয়সালা করার অধিকার আছে। কারণ হাকিমের ফয়সালা ইখতিলাফের সমাপ্তি ঘটায়।) সবসময় স্মরণ রাখুন।
ইখতিলাফের সমাপ্তি ঘটানোর অর্থ, ঐ হাকিমের কর্তৃত্বের সীমানায় যারা থাকেন তাদের মাযহাব আলাদা হলেও হাকিমের ফয়সালার কারণে তারা এ বিষয়ে হাকিমেরই আনুগত্য করবেন, নিজের মাযহাব ত্যাগ করবেন।
সকল মুজতাহাদ ফীহ ইখতিলাফী মাসআলায় শরীয়তের এ ফয়সালা ইজমায়ী। ফাতাওয়া শামীর ভূমিকায় ‘জাহিরুর রিওয়াহ’র কিতাবের বরাতে এ মূলনীতি উল্লেখিত হয়েছে। ড. আবদুল্লাহ আলমারূফের অবশ্যই তা জানা থাকবে। যদি শুধু এ মূলনীতির মর্ম এ সকল পুস্তিকা লেখকদের স্মরণ থাকত তাহলেও তাদের লেখার ভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা হত; বরং হয়তো তারা এ বিষয়ে কলম ধরারও প্রয়োজন বোধ করতেন না।
৩. পৃষ্ঠা ২-এ ‘‘জাহিরুল মাযহাব’’-এর তরজমা করা হয়েছে, ‘এটা (হানাফী) মাযহাবের চূড়ান্ত মত (ظاهر)।
এ তরজমার সূত্র কী? কোনো বরাত তো অবশ্যই লাগবে। আমাদের জানামতে ফিকহে হানাফীর কিতাবাদির প্রসিদ্ধ ব্যবহার হিসেবে এ শব্দকে ‘‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’’-এর সমার্থক মনে করা হয়।
৪. পৃষ্ঠা ৩-এর عليه الفتوى -এর তরজমা করা হয়েছে :
আর এ সিদ্ধান্তের পক্ষেই পরবর্তী আলেমদের ফতোয়া বিদ্যমান।
এতে ‘পরবর্তী আলিমদের’ কথাটা কোন শব্দের অনুবাদ?
৫. পৃষ্ঠা ৩-এ বলেছেন-
‘এমনকি তাঁরা বলেছেন যে, যদি পৃথিবীর পশ্চিমাংশের বাসিন্দারা নতুন চাঁদ দেখেন তাহলে তাদের এ দেখাতেই পূর্বাংশের লোকদের উপর (রোযা ও ঈদ) ওয়াজেব হয়ে যাবে।’
পশ্চিমের লোক রমযানের চাঁদ দেখলে পুবের লোকের উপর রোযা জরুরি হয়ে যায়-এ তো শুধু শামসুল আইম্মা হালওয়ানীর সাথে সম্বন্ধ করা হয়েছে। একে ‘এমনকি তাঁরা বলেছেন’ বলে সকল হানাফী ফকীহগণের বক্তব্য বানিয়ে দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল?
এ বাক্যের সাথে আলহেলাল ৩ পৃষ্ঠায় আলবাহরুর রায়েক, মাজমাউল আনহুর, আলহিন্দিয়া, ফাতহুল কাদীর ও আলবাযযাযিয়া’র বরাত যুক্ত করা হয়েছে। বাহর, হিন্দিয়া ও আলবাযযাযিয়া এবং এরও আগে আলখুলাসায় একে শুধু সম্বন্ধ করা হয়েছে হালওয়ানীর সাথে। ফাতহুল কাদীরে বক্তার নাম নেই, শুধু ‘‘মাজমাউল আনহুর’’-এ এখানে قالوا শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
ড. আবদুল্লাহর কর্তব্য ছিল, ‘মাজমাউল আনহুর’ থেকেও অধিক প্রাচীন ও নির্ভরযোগ্য অন্যান্য কিতাবের বর্ণনা থেকে মাজমাউল আনহুর-এর এই ‘তাসামুহ’ (ভ্রম) সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সে বিষয়ে সংশোধনী নোট লিখা কিংবা অন্তত এর উল্লেখ থেকে বিরত থাকা। অথচ তিনি সেই ভ্রমকেই তরজমা করে সাধারণ পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন হানাফী মাযহাবের অকাট্য সিদ্ধান্তরূপে!
৬. পৃষ্ঠা ৭-এ দাবি করা হয়েছে যে-
صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته
এ হাদীসই সারা দুনিয়ায় এক হুকুমের সুদৃঢ় ভিত্তি, যা ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহ. ও প্রখ্যাত আলিমগণ দলিল হিসেবে পেশ করেছেন।
আমি বিনীতভাবে ড. আবদুল্লাহ আলমারূফের কাছে শুধু একটি নির্ভরযোগ্য উদ্ধৃতি চাচ্ছি, যাতে এ তিন ইমাম সারা বিশ্বে এক চাঁদ দেখা কার্যকর করার বিষয়ে এই হাদীসকে দলিল হিসেবে পেশ করেছেন।
শুধু একটি উদ্ধৃতি!
৭. পৃষ্ঠা ৩১-এ লিখেছেন-
‘‘আর যদি অন্য দেশের সরকারী মুফতী বা হেলাল কমিটির ঘোষণা সরাসরি অন্যদেশে বসে শোনা যায় তাহলে তো আর দোসরা সাক্ষীরই দরকার নেই। যেমন আজকাল আমরা ঘরে বসে সেকেন্ডে দুনিয়ার এক প্রান্তের কাজীর ঘোষণা অন্য প্রান্তে বসে নিজ কানে শুনতে পারছি।’’
প্রশ্ন এই যে, কোনো দেশের সরকারি মুফতী বা হেলাল কমিটির ঘোষণা তার কর্তৃত্ব সীমার বাইরে অনুসরণীয় হওয়ার কথাটা কোন দলিলের ভিত্তিতে বা কোন ফিকহী বরাতের আলোকে লেখা হয়েছে? এ তো সাধারণ বিবেক ও শরয়ী বিধান দু দিক থেকে স্বীকৃত যে, কোনো দায়িত্বশীলের ফায়সালা তার কর্তৃত্বের সীমার বাইরে অনুসরণীয় নয়। আপাতত শুধু ছাহেবে হেদায়ার একটি ইবারতের দিকে আলহেলাল লেখকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই, যা হেদায়া লেখকের ‘‘আততাজনীসু ওয়াল মাযীদ’’ গ্রন্থে (খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৪২৩) চাঁদ দেখার আলোচনায় রয়েছে-
أهل مصر اشتبه عليهم الهلال، فشهد شاهدان عند القاضي برؤيته، وقضى بذلك، لا يظهر هذا الحكم في أهل أمصار أخر، ويظهر في أهل قرى المصر ومحاله.
ولو شهد عند قاضي بلدة شاهدان ولم ير أهله الهلال، أن قاضي مصر كذا قضى بالهلال من وقت كذا، واستجمعت الشرائط، يقضي القاضي به، ذكره في مجموع النوازل.
والمعنى فيه أن في الوجه الأول قاضي هذا المصر ليس له ولاية على مصر أخر، أما له ولاية على القرى، فيظهر قضاؤه على أهل قرى مصره، لا على أهل مصر أخر، وفي الوجه الثاني يلزمهم الصوم بإمضاء قاضي مصرهم، حكمَ قاضي ذلك المصر الأخر... .
قال رضي الله عنه : وهذا إذا تقاربت مطالع البلدتين، أما إذا تباعدت ليس للثاني أن يمضي قضاء الأول في أهل مصره، مطالع سمرقند وبخارا قريب، فيمضي قاضي أحدهما قضاء قاض آخر.
(التجنيس والمزيد ج ٢ ص ٤٣٠-٤٣٢، مسألة ١٢٤٩، ١٢٥٠، طبع إدارة القرآن كراتشي)
ইমাম আবু বকর আলমারগীনানীর উপরোক্ত বর্ণনা মনোযোগ সহকারে পড়লে আশা করি ড. আবদুল্লাহ বুঝতে পারবেন যে, তিনি উপরোক্ত কথাটিতে কত বড় ভুলের শিকার হয়েছেন।
৮. পৃষ্ঠা ৩৪-এ ‘রাহমতী’ কে অখ্যাত বলা হয়েছে। অথচ তিনি ছিলেন এগার শতকের অনেক বড় ফকীহ। ইনি আদ্দুররুল মুখতার-এর টীকা লিখেছেন। ইলমুল ইসনাদেও তাঁর বিশেষ স্থান ছিল। পুরো নাম আবুল বারাকাত যাইনুদ্দীন মুসতফা ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে রাহমাতুল্লাহ আলআনসারী আররাহমাতী, দামেশকে ১১৩৫ হিজরীতে জন্ম, ১২০৫ হিজরীতে মৃত্যু। মক্কা মুকাররমায় সমাহিত।
ফিহরিসুল ফাহারিস খ : ১, পৃষ্ঠা : ৪২৪-৪২৫; রওযুল বাশার পৃষ্ঠা : ২৪২; মুনতাখাবাতুত তাওয়ারীখ লিদিমাশক খ : ২, পৃষ্ঠা : ৬৭৭; হাদিয়্যাতুল আরেফীন খ : ২, পৃষ্ঠা : ৪৫৪ এবং খাইরুদ্দীন যিরিকলীর ‘‘আলআ’লাম’’ (৭/২৪১)-এ তাঁর তরজমা (পরিচিতিমূলক আলোচনা) আছে এবং তাঁর যে বক্তব্যে আলহেলাল লেখক অসন্তুষ্ট হয়েছেন তা অনেক ফকীহ গুরুত্বের সাথে কবুল করেছেন।
৯. পৃষ্ঠা ৪০-এ ডক্টর সাহেব আলিমদের বিষয়ে অভিযোগ করেছেন যে, ‘তাঁরা পড়াশোনা করেন না’। বান্দার প্রশ্ন, আলহেলাল লেখক তো মাশাআল্লাহ পড়াশোনা করেন এবং কোনো কোনো আন্তর্জাতিক লাইব্রেরি থেকে উপকৃত হওয়ার উল্লেখ তো তিনি নিজেই করেছেন। এরপরও হানাফী, মালেকী ও হাম্বলী মাযহাবের এত বিপুল সংখ্যক ফকীহ, যাঁরা উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য বলে মতপ্রকাশ করেছেন তাদের বক্তব্য কীভাবে তাঁর অজানা থাকল? আর জানা থাকলে কী কারণে অনুল্লেখিত রইল? বিশেষত এত বিপুল সংখ্যক হানাফী ফকীহর স্পষ্ট বক্তব্যগুলো কীভাবে তিনি এড়িয়ে গেলেন? আলকাউসারের গত যিলহজ্ব ও মুহাররম সংখ্যায় পাঠক ঐ বক্তব্যগুলো পাঠ করেছেন।
এরপর যখন তিনি
لا عبرة لاختلاف المطالع
সম্পর্কে বললেন যে, এ ‘জাহিরুল মাযহাব’ ও ‘জাহেরুর রিওয়ায়াহ’ এবং পৃষ্ঠা ২-এ ‘‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’’-এর তরজমা করেছেন : আর এটাই মৌলিক বর্ণনায় রয়েছে (যা প্রতিটি মাযহাবের উৎস ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বর্ণনা) তখন সমীচীন ছিল, ঐ মৌলিক ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থগুলো পাঠ করে সেগুলোর বরাত দেওয়া। এ কি হতে পারে না যে, তিনি ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর ছয় কিতাবের কোনো একটি থেকে, মাযহাবের অন্যান্য মৌলিক সূত্র থেকে এবং ষষ্ঠ শতকে সংকলিত খানিয়া-খুলাসার আগের কোনো কিতাব থেকে ঐ বাক্য এবং তা ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর বাণী হওয়ার কোনো উদ্ধৃতি এনে দিবেন? তাহলে আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
‘আলিমরা পড়েন না’ এ অভিযোগ করার সময় তো একবার নিজের পড়াশোনার সীমাটাও দেখে নেওয়া দরকার। গ্রন্থের জগতের সাথে আছে এমন কেউ কি প্রকাশকের অসতর্কতায় ‘ফাতহুল কাদীর’-এর প্রচ্ছদে ‘‘শরহু ফাতহিল কাদীর’’ মুদ্রিত দেখে একে অন্য কিতাব মনে করতে পারেন?
এবং ফাতহুল কাদীরের বরাত দেওয়ার সময় ‘‘ফাতহুল কাদীর ...শরহু ফাতহিল কাদীর’’সহ এমন শব্দ লিখতে পারেন? অথচ ঐ সমগ্রে ফাতহুল কাদীরের কোনো শরহ বা ভাষ্য বিদ্যমানই নেই। প্রকাশক ফাতহুল কাদীরকেই শরহু ফাতহুল কাদীর লিখেছে। উদ্দেশ্য, এ কথা জানানো যে, ফাতহুল কাদীর একটি শরহ বা ভাষ্যগ্রন্থ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তা হেদায়ার শরহ বা ভাষ্যগ্রন্থ বটে।
১০. বলার মতো অনেক বিষয় আছে, সে সব রেখে সর্বশেষ যে কথাটি নিবেদন করতে চাই তা এই যে, আলহেলালের শুরুতে মাওলানা মুহাম্মাদ খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দীকী ছাহেবের যে অভিমত, তাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। কথাটি খুবই মনোযোগের দাবিদার। তিনি লিখেছেন, চার মাযহাবের শাফেয়ী মাযহাব ব্যতীত বাকি তিন মাযহাবেই সারা মুসলিম জগতে এক দিবসে ঈদ করার জাওয়ায বিদ্যমান। (আলহেলাল পৃষ্ঠা ৯, ভূমিকা)
আমার জানা নেই, আলহেলাল লেখক তাঁর এ কথাটা মনোযোগের সাথে পড়েছেন কি না। মুহতারাম মাওলানা মুহাম্মাদ খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দীকী ছাহেব এ অত্যন্ত গোড়ার কথা লিখেছেন। আসলে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মাযহাবের সাথে একদিনে ঈদ ও সিয়ামের (যদি সম্ভাব্য সীমার ভিতরে সংশ্লিষ্ট শর্তসমূহ পূরণ করে বিধান অনুযায়ী হয় এবং উলুল আমর উলামা-উমারার ফয়সালা অনুসারে হয়) খুব বেশি হলে জাওয়ায (বৈধতা)ই প্রমাণিত হতে পারে। এর বেশি কিছু নয়। আমাদের এ গবেষকবৃন্দ যদি এ বাস্তবতাটুকুও উপলব্ধি করতে পারেন, যার দিকে মুহতারাম সিদ্দীকী ছাহেব ইশারা করেছেন তাহলে ইনশাআল্লাহ তাদের সব বিবাদের নিষ্পত্তি হতে পারে।
কারণ প্রথমত একটি পদ্ধতির ‘জাওয়াযে’র অর্থ তো এটাই যে, তা জরুরি নয়। এ কারণে তা প্রতিষ্ঠার জন্য না মানুষকে বাধ্য করা যায়, আর না সে কারণে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করা যায়। দ্বিতীয়ত, ফরয ও ওয়াজিব আমল আদায় করারও বিশেষ নিয়ম ও পদ্ধতি আছে, যার অন্যথা করা জায়েয নয় তাহলে যে কাজ শুধু ‘জায়েয’ (বৈধ) পর্যায়ে তা করতে গিয়ে শরীয়তের নীতি ও বিধানের অন্যথা করা কীভাবে জায়েয হবে? তাই শুধু আবেগবশত অধৈর্য হওয়ার সুযোগ নেই; বরং যে পর্যন্ত না নিয়ম অনুযায়ী ‘উলুল আম্র’ (উলামা-উমারা)-এর পক্ষ হতে নীতি ও বিধান অনুসারে শরীয়তসম্মত ব্যবস্থা হয় ঐ পর্যন্ত যে নিয়মে আমল চলছে (আর তা-ও একটি সঠিক নিয়ম) সে অনুযায়ীই আমল করতে হবে। তৃতীয়ত কোনো ‘জায়েয’ পর্যায়ের কাজ না করার কারণে নিন্দা-সমালোচনার তো প্রশ্নই আসে না, এখানে ‘নাহি আনিল মুনকার’ নীতি প্রয়োগ করাও জায়েয নয়।
কিন্তু এই মাসআলায় উসূল অনুযায়ী না ড. আবদুল্লাহ আলমারূফ চিন্তা করবেন আর না তার সমমনা লোকেরা। কারণ তাদের এই কর্মপন্থা পুরোপুরি আবেগপ্রসূত। উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মাসলাকের উদ্ধৃতি একটি আড়ালমাত্র। অন্যথায় আপনারা আমাকে বলুন, আবদুল্লাহ আলমারূফ ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের বইয়ের সাথে কীভাবে একাত্মতা ঘোষণা করলেন? অথচ তিনি তাতে আয়াত ও হাদীসের তাহরীফ করেছেন, ইজমায়ে উম্মতের বিরোধিতা করেছেন এবং স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, হিসাবের ভিত্তিতে পূর্ব তৈরিকৃত চান্দ্র ক্যালেন্ডারের তারিখ অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করাই কুরআনের হুকুম এবং এটিই শরীয়তের বিধান।
এ ধরনের আরো অসংখ্য শরীয়তবিরোধী বিষয় যার পুস্তিকায় আছে আব্দুল্লাহ আলমারূফ তার সমর্থন কীভাবে করেন? এ কারণেই করতে পারেন যে, উদ্দেশ্য শরীয়তের অনুসরণ নয়, শুধু সিয়াম ও ঈদে ঐক্যের বিষয়ে নিজের আবেগ চরিতার্থ করা। তা যে কোনো মূল্যেই হোক না কেন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)