সফর ১৪৩১   ||   ফেব্রুয়ারী ২০১০

সরকারী অনুদান প্রত্যাখ্যানঃ কওমী মাদরাসা বোর্ডের দায়িত্বশীলদেরকে ধন্যবাদ

কওমী মাদরাসা বোর্ড-বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়্যার দায়িত্বশীলগণ পাঁচ কোটি টাকার একটি সরকারী অনুদান প্রত্যাখ্যান করে যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন সেজন্য আমরা তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। তাদের এই পদক্ষেপ কওমী মাদরাসার নীতি ও আদর্শকেই প্রতিফলিত করেছে। ইলম ও হামিলীনে ইলমের পক্ষে অবমাননাকর এবং দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী কোনো দান-অনুদান গ্রহণ না করাই কওমী মাদরাসার নীতি। কওমী মাদরাসার ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে এবং যারা কওমী মাদরাসার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রাখেন তারা এ বিষয়ে উত্তরূপে অবগত।

যে কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠান জাতির সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। এদেশের সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও জনগণের অর্থেই চলে স্কুল-কলেজ ও ইউনিভার্সিটিগুলোর জন্য যে সরকারী বাজেট হয় তা বাস্তবায়িত হয় জনগণের অর্থে। সরকার এর ব্যবস্থাপক মাত্র। এজন্য

সরকারী ব্যবস্থাপনায় যখন জাতির আশা-আকাঙ্খার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে না তখন জাতি কিছু দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেয়। আমাদের দ্বীনী-প্রতিষ্ঠানগুলো যে সকল প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে কোনো রকম সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই যুগ যুগ ধরে টিকে রয়েছে-এর রহস্য এটাই। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের মাধ্যমে এই দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করছেন।

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অশুভ অনুপ্রবেশের পর এ অঞ্চলের দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দেওয়ার বহু চক্রান্ত হয়েছে। সরকারী আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা তুলে নেওয়া হয়েছে। মিথ্যা প্রপাগাণ্ডার মাধ্যমে সমাজে এর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, এমনকি হুমকি-ধমকি জুলুম-অত্যাচারের মাধ্যমে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করেছেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে এ অঞ্চল ত্যাগ করতে হয়েছে, কিন্তু দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলো আজও টিকে আছে। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পরিহার করেছে তখন এইসব মাদরাসার পৃষ্ঠপোষকতার ভার জাতি নিজ হাতে তুলে নিয়েছে। আমাদের ক্ষমতাসীনদের উপলব্ধি করা উচিত যে, এই সব দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের শিকড় তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত না থাকলে চলমান প্রপাগাণ্ডা ও অসহযোগিতার মুখে এগুলো টিকে থাকত না।

দ্বীনী মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধে যেসব প্রচার-প্রচারণা বিশ্বব্যাপী চলছে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও স্বরূপ সম্পর্কে এখন আর তেমন অস্পষ্টতা নেই। কিছু স্বার্থবাদী মহল ছাড়া সাধারণ জনগণের সামনে এইসব প্রচার-প্রচারণার উদ্দেশ্য মোটামুটি পরিষ্কার। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে, এদেশে ক্ষমতার মসনদে যারাই আরোহন করেন খুব দ্রুত তারা জনগণের আশা-আকাঙ্খা, আবেগ ও অনুভূতি সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যান। কিছুদিন আগে সরকারের এক মন্ত্রী বলেছিলেন, কওমী মাদরাসাগুলো জঙ্গিবাদের প্রজণন কেন্দ্র। কিন্তু যখন প্রতিবাদ করা হল তখন তিনি তার বক্তব্যের ‘ব্যাখ্যা’ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আলোচিত বিষয়েও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। অনুদানের জন্য লোকমারফত যে বার্তা পাঠানো হয় তাতে মাদরাসার ছাত্রদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ‘দারিদ্রের কারণে বিভিন্ন সন্ত্রাসমূক বা চরমপন্থী কাজে তাদের ব্যবহার করা হয়। ফলে তারা সহজেই বিপথগামী হয়।’ (দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২৬ জানুয়ারি, ১ম পৃষ্ঠা)

আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে, এ টাকা যদি সন্ত্রাস দমনের জন্যই ব্যয় করতে হয় তাহলে এর সবচেয়ে উপযুক্ত খাত হচ্ছে ঐ সকল সোনার ছেলে যারা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে প্রতিপক্ষের উপর হামলা করে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই যেভাবে চরদখলের মতো হল দখল, পুলিশের নাকের ডগায় অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও টেণ্ডারবাজির যে রমরমা অবস্থা চোখে পড়ে তাতে মনে হয় না যে, এরা এ সরকারকে অন্য কোনো কাজের সুযোগ দিবে। অতএব আগে ঘরের খবর নিন এবং অতিশীঘ্র এই সোনার ছেলেদের সব ধরনের ‘দারিদ্র’ মোচন করুন। আমরা কওমী মাদরাসা বোর্ডের দায়িত্বশীলদের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাই এবং আশা করি, ভবিষ্যতেও তারা কওমী মাদরাসার নীতি ও আদর্শের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করবেন।

 

advertisement