৫ ও ৬ মে : নিবেদনের পাঠশালা
নিঃসন্দেহে এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যে, যখনই ইসলামের ওপর কোনো মারাত্মক হামলা এসেছে তখনই ইসলামের পক্ষে নিবেদিত মানুষের কাফেলা এসে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। বিনা চ্যালেঞ্জে ও বিনা ত্যাগ ও সাধনায় কখনো দ্বীনের প্রতি কোনো হামলার ঘটনাকে উম্মাহ ছেড়ে দেয়নি। সেই সাহাবীযুগেই এর উজ্জ্বল নজির বিদ্যমান। এরপর প্রায় প্রতি শতাব্দীতেই বিভিন্ন ভূখন্ডে এজাতীয় প্রতিরোধ ও ত্যাগ কিংবা আত্মদানের ঘটনা ঘটেছে। কোনো কোনো শতাব্দীতে তো এজাতীয় ঘটনার মাত্রা ও সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। কখনো এসব হামলা এসেছে ক্ষমতাসীনদের চরিত্র ও শাসনতান্ত্রিক নীতির বিচ্যুতি নিয়ে। কখনো ভুল ও বদ আকীদার বিষাক্ত অবয়ব ধরে। কখনো আল্লাহ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কুরআন, দ্বীন ও শিআরে দ্বীনের প্রতি তীব্র অবিশ্বাস ও অবমাননার রূপ ধরে এবং কখনো কখনো সহীহ দ্বীনের ওপর অবিচল মানুষগুলোকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করে নির্মূল প্রক্রিয়ার পোশাকী অভিযান হয়ে। হামলা যেভাবেই আসুক উম্মাহর সদস্যরা আত্মনিবেদনের মধ্য দিয়েই পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন প্রতিবার।
এজন্যই দ্বীনের ওপর বিচিত্র হামলার বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার আকুতিময় সংগ্রামকে অনেকেই বলেন ঐতিহাসিক পরম্পরা। এ কেবল ঐতিহাসিক ঘটনামাত্র নয়, ইসলামী ইতিহাসের পরম্পরার ধরনটাও এ রকমই। ভিন্ন ভিন্ন ভুখন্ডে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ঘটলেও ঘটনাগুলোর সাদৃশ্য ও সাজুয্য ইতিহাসের এক অমোঘ বাস্তবতা। সেকারণেই বাংলাদেশের বুকে ২০১৩ সনের ৫ ও ৬ মের রক্তাক্ত পাঠশালাকে বিবেচনা করতে হবে ইসলামী ইতিহাসের ঘটনা, পরম্পরা কিংবা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার আয়না সামনে নিয়ে। তাহলেই বেদনাদায়ক ঘটনাটির প্রেক্ষাপট ও পরিণতির সবকটি দিক পরিষ্কার হবে।
দ্বীনের ওপর অবিচলতা কিংবা দ্বীনের জন্য গায়রত ও হামিয়্যতের এই অমলিন নজির কেবল উম্মতে মুহাম্মদির ইতিহাসেই সীমাবদ্ধ নয়। আগের যুগে সত্য দ্বীন গ্রহণের ‘অপরাধে’ আসহাবুল উখদূদকে আগুনের গর্তে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। দ্বীনের ওপর অবিচলতার শর্তে তারা সেটা হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। সাপের যাদু দেখাতে এসে সত্যের ওপর ঈমান এনেছিলেন হযরত মূসা আ.-এর যুগের যাদুকররা। ক্ষতবিক্ষত ও ‘সর্বস্বান্ত’ হতে হয়েছে তাদের স্বঘোষিত খোদা ফেরাউনের বাহিনীর হাতে। কিন্তু তারা বিন্দুমাত্র দমেননি। আর আসহাবে কাহফকে তো শত শত বছর ‘নিভৃতে’ কাটাতে হয়েছে ঈমান নিয়ে শুধু বাঁচার জন্য। ঈমানের ওপর থাকা এবং ঈমান বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা - এ যেন যুগ যুগের বিশ্বাসী মুমিনের এক অনিবার্য ধারাবাহিক নিয়তি। আর এ নিয়তির ভেতরেই তার সাআদাতমন্দি। উম্মতে মুহাম্মদির দেড় হাজার বছরের ইতিহাস তাই এমনতর বহু স্বর্ণালী নিয়তিরই দাস্তান। ঈমান বিধ্বংসীদের কর্মকান্ডের ফাঁদ এবং ঈমানদারদের অনমনীয় ঈমানী দৃঢ়তার হাল কখনো কখনো এমন হয়ে যায় যে, সেক্ষেত্রে সব রকম হিকমত কিংবা ক্ষয়ক্ষতি-বিমুখ সুস্থিরতার চিন্তা রুদ্ধ হয়ে যায়। আত্মদান ও ত্যাগ স্বীকারই হয়ে যায় তখন চেতনার পাঠশালা। আর সেই চেতনার রাজপথ ধরেই দ্বীনের ওপর পথচলা মানুষের পথনকশা তৈরি হয়। সেভাবেই রচিত হয় পরের যুগের ইতিহাস। হযরত সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. তার এক ভাষণে বলেছেন : ‘এজন্যই হযরত হোসাইন রাযি.-এর এই দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে যে, না, এভাবে চলবে না। কিছু লোকের এমনও হওয়া উচিত যে, এ দুঃসহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় পরোয়াহীনভাবে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এরই ফল হল, পরের যুগের মুজাহিদদের ইতিহাস। যদি আপনারা পড়ে দেখেন সে ইতিহাস, অধ্যয়ন করেন তাদের মনস্তত্ত্ব ও মানসিকতা, তাদের সংলাপ ও বক্তব্য তাহলে অবশ্যই অনুভব করবেন বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন দেশে যেসব সংস্কারবাদী আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, যেসব বৈপ্লবিক প্রয়াস উচ্চকিত হয়েছে, সেসব কটিরই পেছনে হযরত হোসাইন রাযি.-এর স্থাপিত দৃষ্টান্ত ভূমিকা রেখেছে। আমীর আবদুল কাদের জাযায়েরী, আবদুল করীম রেফী, শায়খ সান্নুসী, শায়খ শামিল দাগিস্তানী অথবা সাইয়েদ আহমদ শহীদ আর শাহ ইসমাইল শহীদ, যার কথাই ধরুন, এদের প্রত্যেকের আত্মবিশ্বাস ও সৎসাহস বাড়িয়ে তোলা আর সংগ্রামের আবেগ ও প্রত্যয় জাগিয়ে তোলার পেছনে ভূমিকা রেখেছিল হযরত হোসাইন-এর এই দৃষ্টান্ত। তারা ওই দৃষ্টান্ত থেকে অনুধাবন করেছেন, এজাতীয় প্রতিরোধ শিশুসুলভ কোনো চাঞ্চল্য নয়, নয় কোনো উত্তেজক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অস্থিরতা। বরং এটি হচ্ছে হোসাইনী সুন্নত। হযরত হোসাইনের আদর্শ-নীতি। এ প্রতিরোধের ধারা আমাদের এ যুগেও চালু আছে।’ (মাসিক আলকাউসার, নভেম্বর সংখ্যা ২০১২ ঈ.)
মূলত রাজনৈতিক আবরণ গায়ে চড়িয়ে একদল অবিশ্বাসী তরুণ-তরুণী পথে নেমে এসেছিল। সেটাই ছিল ঘটনার সূচনা। তাদের পেছনে ছিল দেশি-বিদেশী মিডিয়া, সুশীল ও ষড়যন্ত্রকারী শক্তির প্রকাশ্য মিছিল। এরা ঔদ্ধত্বের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ চালিয়েছে। ইসলামের নবী, পবিত্র কুরআন, উম্মাহাতুল মুমেনীন, ইবাদাত ও ইসলামের অন্যান্য শিআর নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও অবমাননার বন্যা ছুটিয়েছে। আহত ও ক্ষত বিক্ষত মানুষ হৃদয় ও চোখে অশ্রু নিয়ে তখন রাস্তায় নেমে আসেন সেই ইবলিসী মহড়ার বিরুদ্ধে। দেড় মাসের মাথায় ৬ এপ্রিল ঢাকার বুকে সরকারি মদদপুষ্ট ‘নাটকীয় হরতালী বাধা’ অতিক্রম করে বিস্ময়কর জনস্রোতের লংমার্চ সম্পন্ন হয়। এরপর চলতে থাকে দেশজুড়ে শানে রেসালাতের শান্তিময় অভিযাত্রা। ঠিক একমাস পর ৫ মে প্রতীকী ঢাকা অবরোধ ও অবস্থানের সময় ঘটে হৃদয়বিদারক ঘটনাপুঞ্জ। দিনব্যাপি থেমে থেমে মানুষ হত্যা, অগ্নিসংযোগ, পবিত্র কুরআন শরীফ পুড়ানো এবং রাস্তায় রাস্তায় দলীয় বাহিনী দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের রক্তাক্ত করা আর মধ্য রাতে এক নারকীয় বীভৎস রক্তক্ষয়ী বাতি নেভানো অন্ধকার অভিযান। কতজন শহীদ, কতজন নিখোঁজ, কত হাজার আহত-কেউ জানে না। যারা কিছু জানে, তারা গ্রেফতার ও শাস্তির ভয়ে আর কিছুই বলে না। এক অব্যক্ত যন্ত্রণার ইতিহাস হয়ে গেল শাপলার বাংলাদেশ। কিন্তু ৫ ও ৬ মের এই শাপলা কি কখনো মুখ খুলবে না? ইতিহাস তো বলে, খুলবে এবং ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আত্মনিবেদনের এই ময়দানে যারা এগিয়ে ছিলেন, সময় তাদের অবশ্যই অভিবাদন জানাবে ইনশাআল্লাহ।
এ ভূখন্ডে যে সন্তর্পনে অবিশ্বাসের কত বিষবৃক্ষ তৈরি হয়েছে ৫ ও ৬ মের পাঠশালা সেটা আমাদের জানিয়ে দিতে পারে। বলে দিতে পারে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধরদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঈমানবিরোধীরা কতটা আশকারা পাওয়ার অধিকার ভোগ করে আর ঈমানদারেরা কতটা পীড়িত হতে বাধ্য হয়। একইভাবে ৫ ও ৬ মের পাঠশালা সাব্যস্ত করতে পারে দ্বীনের জন্য লড়াই ও প্রতিরোধ সংগ্রামের ধারাবাহিকতার অনিবার্যতার ঘটনাকেও। আমরা ৫ ও ৬ মে থেকে অসতর্কতা, অদূরদর্শিতা কিংবা দুর্বলতার জন্য সংঘটিত বিপর্যয় সম্পর্কেও সচেতন হতে পারি। সর্বোপরি দ্বীনের জন্য অবিনাশী সংগ্রাম ও বিপর্যয়ের এই পাঠশালা আমাদের জন্য ত্যাগ, নিবেদন, সতর্কতা, দূরদর্শিতা এবং বহুমুখি উপলব্ধি অর্জনের মোহনা হয়ে উঠতে পারে। ষ