ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বিপদাপদের বিচার-বিশ্লেষণে (২)
আপনারা নামায পড়েন, আল্লাহর পথে চলেন, তাও আপনাদের এত বিপদ? অবুঝদের এজাতীয় ফজুল কথায় অনেকেই দমে যায়। মন খারাপ করে। বেবুঝ হয়ে ভাবতে শুরু করে, ঠিকই তো আমার কেন এত বিপদ? ওরা দ্বীনের পথে চলে না অথচ ওদের কত সুখ! তারা চিন্তা করে না অবুঝদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে শয়তান এভাবে তাদের সব অর্জন ধুলিস্যাৎ করছে। শয়তান ও তার দোসরদের এমন মওকা দেওয়া কেন? নিজ মেরুদন্ডকে আরও শক্ত করা চাই। ব্যক্তিত্বহীনতার কারণেও অনেক সময় ব্যক্তির ধার্মিকতা বিপর্যস্ত হয়। দরকার বিশ্বাসের দৃঢ়তা। ওইসব অভিযোক্তাদের বিপদ কি কিছু কম? বরং আরো বেশি, কিন্তু সে খবর তাদের নেই এবং এটা তাদের আরও মস্ত বিপদ।
আল্লাহর পথের পথিকও বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। সেটা পথের সমস্যা নয়। চলার ত্রুটি। তাই দমে না গিয়ে পথিকের উচিত নিজ আমলের খতিয়ান নেওয়া। তাহলে অনেক কসুরই চোখে পড়বে। তখন অভিযোগের তীর অন্য কারও দিকে নয়, অন্য কিছুর দিকে নয়, বরং নিজের দিকেই ছুটবে। সেই তীর বিবেককে বিদ্ধ করবে। চেতনাকে খোঁচাবে। তাতে ঘুম ভাঙবে। মনের ভেতর সৃষ্টি হবে খওফ ও ইনাবত-আল্লাহভীতি ও আল্লাহ অভিমুখিতা। এটাই আলোচ্য বিষয়ে তৃতীয় কথা। অর্থাৎ বিপদাপদে মুষড়ে না পড়ে বিপদ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। খুঁজতে হবে বিপদের উৎস।
ব্যবসা করছিলাম নির্ঝঞ্ঝাট, চাকরিতে ক্রমোন্নতি হচ্ছিল। জীবন চলছিল নিরুপদ্রব। সিঁড়ি ভেঙে তরতর করে উপরে উঠছিলাম, কিন্তু হঠাৎ যে কী হয়ে গেল! উটকো এক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লাম। মিথ্যা মামলায় ফেঁসে গেলাম, কিংবা ব্যবসায়ে ধ্বস নামল অথবা পারিবারিক জীবনে এমনই এক অবাঞ্ছিত ঘটনার সূত্রপাত ঘটল বা এমনই এক দুরারোগ্য ব্যাধি হানা দিল, যা হঠাৎ করেই সুন্দর ছন্দোবদ্ধ জীবনটাকে তছনছ করে দিল। কেন এমন ঘটল? আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় অকারণ দুর্বিপাক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অকারণ নয় মোটেই। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَمَا أَصَابَكَ مِنْ سَيِّئَةٍ فَمِنْ نَفْسِكَ
যা কিছু অকল্যাণ তোমার ঘটে তা তোমার নিজেরই কারণে ঘটে। (নিসা : ৭৯)
কোন এক দুর্বল মুহূর্তে এক গুরুতর অপরাধ হয়ে গিয়েছিল। তাৎক্ষণিক কোন প্রতিকারের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। ক্রমে তা ভুলেই গিয়েছি। অতপর জীবন বেশ সাবলীলই বয়ে চলেছে। ওদিকে অদৃশ্যলোকে সে অপরাধের প্রতিফল তৈরি হতে থাকে। মানুষের ভালো-মন্দ কোন কাজই বৃথা যায় না। মানুষ কোন তুচ্ছ সৃষ্টি নয়। তার কোন কাজ অবজ্ঞেয় হতে পারে না। সবকিছু লেখা হচ্ছে। সবই সংরক্ষিত থাকে। ফিরিশতাদেরকে দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলার হুকুমে তারা আপন আপন কাজ করে যাচ্ছে। তারা হেফাজতের কাজও করে শাস্তিদানের কাজও। কোন অপরাধের কী প্রতিফল হবে, দুনিয়ায় হবে না আখিরাতে, না উভয়স্থানে, তা স্থির করা আছে। প্রতিফলের ধরন নির্দিষ্ট আছে। কখন কোথায় কিভাবে প্রকাশ পাবে সবই স্থিরীকৃত। কখনও তা রোগ-ব্যধি আকারে প্রকাশ পায়। কখনও মামলা-মকদ্দমা আকারে। কখনও তা ব্যবসায়ে হানা দেয়, কখনও চাকুরিতে। ব্যবসা হয়ত সৎভাবেই চলছিল, কিন্তু অন্য জায়গায় যে গলদ হয়ে গেছে তার কুফল এখানে প্রকাশ পেয়েছে। সে গলদের কথা ভুলে গেছি কিংবা স্মরণ থাকলেও উভয়ের মধ্যে মিল খুঁজে পাই না। তাই ভাবি এটা অকারণ উৎপাত। কোনও দোষ করিনি, তাও মামলায় জড়িয়ে গেছি। আসলে তো তা নিজ কৃতকর্মেরই খেসারত। কুরআন মাজীদের ইরশাদ (তরজমা) মানুষের জন্য তার সামনে ও পেছনে একের পর এক প্রহরী নিযুক্ত আছে। তারা আল্লাহর আদেশে তার হেফাজত করে এবং আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না সে নিজে নিজ অবস্থা পরিবর্তন করে (রা‘দ : ১১)।
অর্থাৎ মানুষ যখন শুদ্ধাচারী থাকে হেফাজতের ফিরিশতা তাকে বিপদাপদ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু সে যখন নিজ অবস্থা বদলে ফেলে, পাপকর্মে লিপ্ত হয়, শরী’আতবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ে, তখন সেই হেফাজত তুলে নেওয়া হয় এবং তদস্থলে আযাবের ফিরিশতা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় কর্তব্য নিজ ভুল-ত্রুটির কথা স্মরণ করে তওবা ইস্তিগফার করা এবং বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হওয়া। উচিত তো ছিল অপরাধ হওয়ামাত্র তওবা করা। সেটাই মুমিনের শান। ইরশাদ হয়েছে (তরজমা) ‘আল্লাহ অবশ্যই সেইসব লোকের তওবা কবুল করেন যারা ভুলবশত অন্যায় করে, তারপর অবিলম্বে তওবা করে।’ (নিসা : ১৭)
কিন্তু তা যখন করা হয়নি তাই বান্দাকে সতর্ক করার জন্য আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়ার লঘু বিপদের সম্মুখীন করেছেন। যাতে সে উদাসীনতার ঘুম থেকে জেগে ওঠে। কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয় এবং শীঘ্র তওবা করে আখিরাতের মহামসিবত থেকে বেঁচে যায়।
বেদ্বীন অপেক্ষা দ্বীনদারের সাথেই আল্লাহ তাআলার এ আচরণ বেশি হয়। কারণ সে আল্লাহ তাআলার প্রিয়। প্রিয়জনের শরীরে কোন পাপের ময়লা লেগে থাকুক তা তো কাম্য হতে পারে না। জাহান্নামের আগুন দ্বারা তাঁর পরিশোধন কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। সে জন্যই এ লঘু শাস্তির ব্যবস্থা। দ্বীনদারের এতে দুঃখবোধের কারণ নেই। বরং খুশীর কথা যে, আল্লাহ তাআলা তাকে সতর্ক করে দিয়েছেন।
হাঁ মানুষ বড় দুর্বল। শারীরিক ও মানসিক কোন কষ্টই তার বরদাশত হয় না। তাকে কষ্টে ফেলে রাখা আল্লাহর অভিপ্রেতও নয়। বিপদ যেমন তিনিই দেন, ত্রাণও তিনিই করেন। তিনি চান বান্দা ত্রাণের জন্যও তারই দ্বারস্থ হোক। এটা তাঁর পসন্দ। আল্লাহ বড় প্রেমময়। যে কোন ছলে বান্দাকে তাঁর দ্বারস্থ করতে চান। সুতরাং অনাকাঙ্ক্ষিত মসিবত দেখা দিলে মুমিন বান্দা আল্লাহ তা’আলার অভিমুখী হবে। কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করবে না; বরং সেজন্য নিজেকেই দায়ী ঠাওরিয়ে নিজ কৃতকর্মের জন্য আল্লাহ তা’আলার কাছে তওবা করবে এবং নিজেকে সংশোধন করবে। সেইসাথে আপতিত বিপদ থেকে মুক্তির জন্য তারই কাছে কাতর প্রার্থনা জানাবে। সর্বশ্রেষ্ঠ মুমিন নবী-রাসূলগণও তাই করতেন। তাঁরা ছিলেন মাসূম-অপাপবিদ্ধ। তা সত্ত্বেও বিপদাপদ তাদেরও দেখা দিত।
তাঁদের কেন বিপদ আসত সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। পরে ইনশাআল্লাহ সে প্রসঙ্গ আসছে। সেই নিষ্পাপ মহামানবগণ যখন কোন বিপদের সম্মুখীন হতেন কোন অভিযোগ-বাক্য তাদের মুখে আসত না; বরং নিজেকে অপরাধী ঠাওরিয়ে বিপদ যিনি দিয়েছেন কাতরভাবে নিজেকে তাঁরই হাতে সঁপে দিতেন এবং তা থেকে মুক্তির জন্য কেবল তাঁরই কাছে দয়া ভিক্ষা করতেন। সুতরাং হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম জপতে থাকেন-
لا إله إلا أنت سبحانك إني كنت من الظالمين
হে আল্লাহ! আপনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। আপনি মহান, পবিত্র। নিশ্চই আমি অপরাধীদের একজন।
হযরত আয়্যূব আলাইহিস সালাম বলেন-
أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
(হে আমার প্রতিপালক! আমি দুঃখ-কষ্টে পড়েছি। (আমাকে দয়া কর) তুমি তো শ্রেষ্ঠতম দয়ালু (আম্বিয়া : ৮৩)। হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম বলেন-
إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ
আমি আমার বেদনা ও দুঃখের কথা শুধু আল্লাহর কাছে নিবেদন করছি। (ইউসুফ : ৮৬)
তায়েফ থেকে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যাত নবী চারদিকে যখন ঘোর অন্ধকার দেখতে পচ্ছিলেন তখন আল্লাহর কাছে তাঁর সমর্পিত প্রাণের আকুতি ছিল-
أعوذ بنور وجهك الذي اشرقت له الظلمات وصلح عليه أمر الدنيا والآخرة أن يحل بي غضبك أو ينزل بي سخطك لك العتبي حتى ترضى ولا حول ولا قوة إلا بالله.
‘আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি তোমার নূরের, যার জ্যোতিতে ঘুচে যায় সব অন্ধকার, ঠিক হয়ে যায় দুনিয়া ও আখিরাতের সব কিছু। আশ্রয় গ্রহণ করছি যাতে আমার উপর না পড়ে তোমার গজব, নেমে না আসে তোমার অসন্তোষ। সর্বাবস্থায় আমি তোমার প্রতি খুশি, যাতে তুমি খুশি থাক হে পরওয়ারদেগার।
এভাবে বিপদাপদে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করা ও আল্লাহ-অভিমুখী হওয়াই ইসলামের শিক্ষা। এটা নেক বান্দাদের আদর্শ। এ আদর্শ অনুসরণ করলে মসিবতে কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। নগদ যে ক্ষতি দেখা যায় প্রাপ্তির তুলনায় তা অতি তুচ্ছ। এতে লাভ হয় ত্রিবিধ। গুনাহ মাফ হয়, আল্লাহ তাআলার কাছে মর্যাদা বৃদ্ধি হয় এবং নগদ যে ক্ষতি হয়ে গেছে অন্য কোনওভাবে তা পূরণ করে দেওয়া হয়; বরং আরও বেশি দেওয়া হয়। কাজেই মসিবতকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে নয় ; বরং ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা উচিত। এটাই এ প্রসঙ্গে চতুর্থ কথা। অর্থাৎ মুমিনের পক্ষে মসিবত অত্যন্ত লাভজনক। তাকে লাভের দৃষ্টিতেই নিতে হবে।
মসিবত দ্বারা গুনাহ মাফ হয়, যেমন এক হাদীসে আছে, মুমিন নর-নারীর জানমাল ও সন্তানের উপর বালা-মসিবত আসতে থাকে, পরিশেষে যখন সে আল্লাহ তাআলার সাথে মিলিত হয় তখন তার কোন গুনাহ থাকে না। (তিরমিযী ২৪১১)
অপর এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মুসলিম ব্যক্তি যদি কোন ক্লান্তি, রোগ, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট আর পেরেশানিতে পড়ে, এমনকি তার পায়ে কাঁটাও ফোটে, তার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তার পাপ মার্জনা করেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস ; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৭২, ৫৬৪০)
মসিবত দ্বারা আল্লাহ তাআলার নৈকট্যলাভ ও মর্যাদা বৃদ্ধি হয়। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহ সবরকারীদের সাথে (বাকারা : ১৫৩) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে বান্দার জন্য যদি কোন মর্যাদা স্থিরীকৃত থাকে আর সে নিজ আমল দ্বারা তাতে উপনীত হতে না পারে, তবে আল্লাহ তাআলা তার জানমাল ও
সন্তানের দিক থেকে তাকে কোন বালা-মসিবতে ফেলেন এবং তাকে তাতে সবরের তাওফীক দান করেন আর এভাবে তাকে সেই স্থিরীকৃত মর্যাদায় পৌঁছে দেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩০৯০; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২১৮৩৩)
এক হাদীসে আছে, দুনিয়ায় যারা নিরাপদে ছিল তারা কিয়ামতের দিন বিপন্নদের পুরস্কার দেখে আক্ষেপ করবে, আহা, দুনিয়ায় যদি কাঁচি দ্বারা তাদের শরীরের চামড়া কেটে ফেলা হত! (জামে তিরমিযী , হাদীস ২৪০২)
মসিবতে সবর দ্বারা দুনিয়ায়ও তার উত্তম বদলা পাওয়া যায়। হযরত আলী রা. বলেন, ‘আল্লাহর কসম! কোন সুখী-স্বচ্ছল সম্প্রদায়ের সুখ-স্বাচ্ছন্দ ঘুচলে তা কেবল তাদের পাপাচারের কারণেই ঘুচেছে। না হয় আল্লাহ তাআলা বান্দাদের উপর জুলুম করেন না। দুঃখে কষ্টে পড়ার পর বান্দা যদি খাঁটি মনে আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হয় তবে আল্লাহ অবশ্যই সে কষ্ট দূর করে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে দেন।’
হৃত-সর্বস্ব হযরত আয়্যূব আলাইহিস সালাম যখন কাতরভাবে আল্লাহকে ডাকলেন আল্লাহ বললেন, ‘আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম, তার দুঃখ-কষ্ট দূর করলাম। তাকে তার পরিবার-পরিজন ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সাথে অনুরূপ আরও দিলাম’ (আম্বিয়া : ৮৪)
আল্লাহ তাআলার ওয়াদা হচ্ছে-
فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا l إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا
কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে। অবশ্যই কষ্টের সাথে আছে স্বস্তি’ (ইনশিরাহ ৫-৬)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা সুসংবাদ নাও। এক কষ্ট কখনও দুই স্বস্তিকে পরাভূত করতে পারে না। (তিরমিযী : ৩৫৭১)
এক হাদীসে আছে, যে কোনো বান্দার যে কোনো মসিবত দেখা দেয় তাতে সে যদি বলে-
إنا لله وإنا إليه راجعون، أللهم اؤجرني في مصيبتي واخلف لي خيرا منها
‘আমরা আল্লাহরই এবং আমাদেরকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে। হে আল্লাহ! এ মসিবতে আমাকে আশ্রয় দাও এবং আমাকে এর উত্তম বিকল্প দাও’। তবে আল্লাহ সে মসিবতে তাকে আশ্রয় দেবেন এবং তাকে উত্তম বিকল্প দান করবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯১৮)
এত কিছু লাভ যেই বালা-মসিবতের মধ্যে তা তো দুশমনদের নয়, বরং আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দা তথা মুমিনদেরই ভোগ করার কথা। সুতরাং ‘আপনারা ধার্মিক মানুষ, আপনাদের কেন এত কষ্ট?’ এজাতীয় শ্লেষবাক্যে দমে না গিয়ে বরং এই ভেবে স্বস্তি বোধ করা উচিত যে, বালা-মসিবত ধার্মিকেরই ধন। বেদ্বীনের উপর যদি বালা-মসিবত না আসে বা কম আসে তাই বলে মুমিনের উপর না আসবে কেন? আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) ‘আমি কি অনুগত বান্দা ও অবাধ্যদেরকে সমান করে দেব?’ (কলাম : ৩৫)।
ওরা যে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে আছে, তাতে ওরা থাকুক। আপাতদৃষ্টিতে যত মধুরই মনে হোক প্রকৃতপক্ষে তা আযাব। আল্লাহ তাআলা বলেন (তরজমা) ওদের ধনজন দেখে তুমি মুগ্ধ হয়ো না যেন। আল্লাহ তো তা দ্বারাই পার্থিব জীবনে তাদেরকে শাস্তি দিতে চান। (তাওবা : ৮৫)
কিন্তু মুমিনদের যে দুঃখ-কষ্ট প্রকৃতপ্রস্তাবে তা রহমত-
بَاطِنُهُ فِيهِ الرَّحْمَةُ وَظَاهِرُهُ مِنْ قِبَلِهِ الْعَذَابُ
‘তার বহিরাঙ্গনে আছে আযাব আর অন্তর্ভাগে প্রভূত কল্যাণ’। (হাদীদ : ১৩) অর্থাৎ বাহ্যিক কষ্ট-ক্লেশকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করলে উপরিউক্ত কল্যাণসমূহ তো লাভ হয়ই, সেই সঙ্গে কৃতজ্ঞতাবোধ, অল্পেতুষ্টি, ঈমানের আস্বাদ, পরশ্রীকাতরতামুক্ত চৈত্তিক স্বাচ্ছন্দ্য প্রভৃতি কারণে যে মানসিক প্রশান্তি লাভ হয় তা দ্বারা মুমিনের ইহজীবনও পরমানন্দময় হয়ে ওঠে। সেই অনির্বচনীয় আনন্দের কল্পনা কোন অধার্মিকের পক্ষে কখনও করা সম্ভব নয়। তা এহেন কল্যাণপ্রসূ কষ্ট বেদ্বীনরা পাবে কেন? এটা তো পাবে কেবল তারাই যারা আল্লাহর অতি প্রিয়ভাজন। এক হাদীসে আছে, সর্বাপেক্ষা বেশি দুঃখ-কষ্ট পেয়ে থাকেন নবীগণ, তারপর যারা তাদের যতটা অনুসারী সেই অনুপাতে তারা।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (তরজমা) ‘আল্লাহ যার কল্যান চান তাকে বিপদে ফেলেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৬৪৫)
আরেক হাদীসে আছে, মহাপ্রতিদান তো মহাসিবতেই লাভ হয়। আল্লাহ যখন কোন সম্প্রদায়কে ভালোবাসেন তাদেরকে বালা-মসিবত দেন। যে ব্যক্তি তাতে খুশি থাকে আল্লাহ তার প্রতি খুশি হন আর যে তাতে নাখোশ হয় আল্লাহ তার প্রতি নাখোশ হন। (জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৯৬)
বালা-মসিবতের ইহলোক ও পারলৌকিক সুসংবাদ সম্পর্কে প্রচুর হাদীস আছে। আয়াতও আছে অনেক। তাতে আমাদেরকে শেখানো হয়েছে, কারও বালা-মসিবত দেখে তার ঈমান-আমল সম্পর্কে সন্দেহ করা উচিত নয়। তার নিজেরও উচিত নয় এ ব্যাপারে অন্যের শ্লেষবাক্যে দমে যাওয়া। কেননা এর ভেতর প্রভূত কল্যাণ নিহিত থাকে। প্রথমত এটা নিজের সম্পর্কে সুধারণার লাগাম টেনে ধরে। অনেক সময় নিজ আমলের দিকে তাকিয়ে আমরা মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। মনে হয় আমি বেশ দ্বীনদার। অথচ ইখলাসের কমতিসহ বহুমাত্রিক ভুল-ত্রুটি নিজের মধ্যে রয়ে গেছে। মসিবত দিয়ে আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে দেন যে, নিজ খামতির দিকে নজর দাও।
দ্বিতীয়ত মসিবত সম্পর্কে সাধারণভাবে নেতিবাচক দৃষ্টিভংগি পোষণ করা হয়। এটাও বিপজ্জনক প্রান্তিকতা। এর ফলে হতাশা জন্ম নেয় ও নানারকম ওয়াসওয়াসার সৃষ্টি হয়। পরিশেষে অতীত আমলের সওয়াব বরবাদ হয় এবং দ্বীনের পথে অগ্রযাত্রা থেমে যায়। এমনকি আল্লাহ পানাহ এ দৃষ্টিভংগি কারও কারও জন্যে ঈমানহারা হয়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সত্যি কথা হচ্ছে, কোনও অবস্থাই মুমিনের পক্ষে মন্দ নয়। ইতিবাচক মনোভাব থাকলে মুসিবতের ভেতর থেকেও সে প্রভূত কল্যাণ অর্জন করতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সেইসব কল্যান অর্জনের লক্ষ্যে আমরা কি বালা-মসিবত চেয়ে নেব? কিংবা কোন মসিবতে পড়লে তা যেন দূর না হয় সেই দুআই করব? না তা কক্ষনওই নয়। সেটা আরেক
প্রান্তিকতা। মসিবতের উপরিউক্ত কল্যাণ তখনই লাভ হয় যখন তা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে আসে এবং আসার পর বান্দা আল্লাহর ইচ্ছায় খুশি থাকবে বটে, কিন্তু নিজেকে একজন দোষী ও অক্ষম বান্দা গণ্য করে তা থেকে মুক্তির জন্য কাতর প্রার্থনাও করবে। মসিবতের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ একরকম ধৃষ্টতা এবং মসিবত আসার পর তা থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর অভিমুখী না হওয়াও এক ধরনের ঔদ্ধত্যপনা। বান্দার পক্ষে এরূপ আচরণ চরম ধ্বংসাত্মক; বরং এক্ষেত্রে মধ্যপন্থা হল মসিবত চাওয়া তো নয়ই; বরং শান্তি ও নিরাপত্তালাভের জন্যই নিজের সীমিত বুদ্ধি-বিবেচনা ও শক্তি-ক্ষমতার ব্যবহার করা এবং সে লক্ষ্যেই আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করতে থাকা।
সুস্থতা ও নিরাপত্তা আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। এ নিআমত রক্ষা করা ও এর জন্য শুকর আদায় করাই শরীআতের হুকুম। এমন কোন পন্থা অবলম্বন জায়েয নয় যা দ্বারা এ নিআমত নষ্ট হতে পারে। হাদীস-গ্রন্থসমূহ পাঠ করলে পাওয়া যায় স্বাস্থ্যসচেতনতার তাগিদ। স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর খাদ্য ইসলামে নিষিদ্ধ। তারপর কোন কারণে রোগ-ব্যাধি দেখা দিলে উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়েছে। হাদীসে বিভিন্ন খাদ্যের ঔষধী গুণাগুণও বর্ণিত হয়েছে। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে অন্যদেরকে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এর অনেক ফযীলতও বর্ণিত হয়েছে।
দারিদ্র্য বিমোচন শরীআতী সমাজব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ। উপার্জন করতে প্রবলভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে; বরং ব্যক্তিক ও সমষ্টিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানের প্রচেষ্টাকে দেওয়া হয়েছে ইবাদতের মর্যাদা।
মানুষে-মানুষে বিভেদ ঘুচিয়ে সমস্ত মানুষকে প্রীতিবন্ধনে আবদ্ধ করার শিক্ষা ইসলামের দান। বলা হয়েছে শত্রুকে বন্ধু বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে । তা সত্ত্বেও কেউ শত্রু হয়ে গেলে সে যাতে ক্ষতি করতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। একক বা সংঘবদ্ধ শত্রু থেকে আত্মরক্ষার জন্য সবরকম প্রস্ত্ততি গ্রহণের জোর তাগিদ রয়েছে ইসলামের শিক্ষায়।
মোটকথা অসুস্থতা ও অনিরাপত্তা তথা সর্বপ্রকার বিপদাপদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ ইসলামী বিধানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ব্যবস্থাজনিত দুর্বলতার কারণে বিপদ দেখা দিলে সে দায় মানুষের নিজের। ইসলাম সে অবহেলাকে সমর্থন করে না। কোন কোন ধার্মিকের, যারা ইসলাম ধর্মের শিক্ষাকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারেনি, তাদের এক্ষেত্রে অবহেলা রয়েছে। এটাও একরকম
প্রান্তিকতা। কেউ তো এরকম প্রান্তিক দৃষ্টিভংগীই পোষণ করে থাকে যে, ইবাদতেই সব কিছুর সমাধান। বৈষয়িক বা বস্ত্তগত কোন ব্যবস্থাগ্রহণের দরকার নেই এবং কেউ কেউ দৃষ্টিভংগী সঠিক রাখলেও কর্মগতভাবে এ প্রান্তিকতার শিকার। অথচ ইসলামের শিক্ষা এরকম নয়। ইসলামের সর্বাপেক্ষা পূর্ণাঙ্গ অনুসারী ও শ্রেষ্ঠতম ইবাদতগোযার ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। তাদেরকেই বলা হয়েছে (তরজমা) যখন নামায আদায় হয়ে যায় তখন যমীনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) সন্ধান করো। (জুমুআ : ১০)
এবং তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্ত্তত রাখবে। (আনফাল : ৬০)
এটিই জগত চালনায় আল্লাহর সাধারণ রীতি। এর ব্যতিক্রমও হতে পারে এবং সে ক্ষমতা অবশ্যই আল্লাহ তাআলার আছে। কিন্তু সেটা তার নিয়ম নয় এবং সেরকম হুকুম তিনি বান্দাকে করেননি। সুতরাং সাধারণ নিয়ম উপেক্ষা করে বা তাতে অবহেলা করে ব্যতিক্রমকে নিয়ম মনে করা নিঃসন্দেহে প্রান্তিক কর্মপন্থা, যা শরীআত অনুমোদন করে না।
তো যখন স্বাস্থ্য, জীবিকা ও আনুষঙ্গিক সকল দিক থেকে নিরাপত্তার জন্য সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণই শরীআতের হুকুম, তখন রোগ-বালাই, অভাব-অনটন ও দুর্যোগ-দুর্বিপাক চেয়ে দুআ করা বা তা বলবৎ রাখার জন্য আবেদন জানানোর কি অবকাশ থাকতে পারে? বালা-মসিবত কল্যাণকর হওয়ার অর্থ এ নয় যে, বান্দা তা চেয়ে নেবে। বরং চেষ্টা থাকবে যাতে সর্বতোপ্রকারে নিরাপদ থাকা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনো বিপদ এসে গেলে মনে করতে হবে এর মধ্যে অবশ্যই কোন মঙ্গল আছে। সে মঙ্গল লাভ হবে তখনই যখন পূর্বোক্ত দৃষ্টিভংগীতে তা গ্রহণ করা হবে। তার একটা অংশ এইও যে, কাতরভাবে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করা হবে যেন তিনি সে বিপদ থেকে মুক্তি দান করেন।
হাদীস-গ্রন্থসমূহে বিভিন্নরকম বালা-মসিবত থেকে উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন রকম দুআ বর্ণিত আছে। আল্লাহ না করুন কোন বিপদ দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট দুআটি বেছে নিয়ে সর্বান্তঃকরণে তা পাঠ করা চাই। যেহেতু তার বিশেষ কার্যকারিতা আছে। আর তা জানা না থাকলেও যে কোনও ভাষাতেই বান্দার বিনয়-কাতর ডাকে আল্লাহ সাড়া দিয়ে থাকেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যত বিপদ থেকে নিরাপত্তার জন্যও বিভিন্ন দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন
اللهم إني أسئلك العفو والعافية في ديني ودنياي وأهلي ومالي، اللهم استر عوراتي وآمن روعاتي واحفظني من بين يدي ومن خلفي وعن يميني وعن شمالي ومن فوقي وأعوذ بعظمتك أن أغتال من تحتي.
‘হে আল্লাহ! আমি আমার দীন ও দুনিয়ার ব্যাপারে তোমার কাছে ক্ষমা ও নিরাপত্তা চাই এবং আমার পরিবার-পরিজন ও অর্থ সম্পদের ব্যাপারেও। হে আল্লাহ! আমার গোপন বিষয়গুলো ঢেকে রাখ এবং যে সব বিষয়ে শংকাবোধ করি তা থেকে আমাকে নিরাপদ রাখ। আমাকে হেফাজত কর আমার সম্মুখ দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডানদিক থেকে, বামদিক থেকে এবং উপর থেকে। আর তোমার মহিমার আশ্রয় গ্রহণ করছি যাতে আমি নিচের দিক থেকে বিপন্ন না হই’। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৮৭১; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৯৬১)l