দরসে হাদীস : নাজাতের পথ
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيد الأنبياء والمرسلين سيدنا ومولانا محمد وعلى آله وأصحابه أجمعين، أما بعد.
فعن عقبة بن عامر رضي الله عنه قال : قلت : ما النجاة يا رسول الله! قال : املك عليك لسانك وليسعك بيتك وابك على خطيئتك. أو كما قال رسو الله صلى الله عليه وسلم.
মুহতারাম বুযুর্গোঁ, আযীযোঁ আওর ভাইয়ো!
আমার এখানে আসার কারণে আপনারা যে মহববত ও ভালবাসা প্রকাশ করেছেন এবং আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিয়েছেন এজন্য আমি আপনাদের শোকরগোযারি করছি। এ সম্মান ও ভালবাসা মূলত আমার ব্যক্তির কারণে নয়, ঐ আযীম দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের কারণে, যা আমাদের বুযুর্গদের আমানত। ঐ আযীম দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের দ্বীনী খিদমতের কারণে এর সাথে সম্পৃক্ত যে কোনো ব্যক্তিকেই মানুষ অন্তর থেকে ভালবাসে। এ মূলত ঐসব বুযুর্গানে দ্বীনের ইখলাসের বরকত, যারা তা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এর জন্য ত্যাগ ও কোরবানী দিয়েছেন আর আল্লাহর কাছে তাঁদের কোরবানী কবুল হয়েছে।
আমি নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীস পাঠ করেছি। খুব সংক্ষেপে এর উপর কিছু কথা আরজ করছি।
এ হাদীস আমি এজন্য নির্বাচন করেছি যে, আমাদের উস্তায ও মুর্শিদ হযরত মাওলানা মুফতী মাহমূদ হাসান গাঙ্গুহী রাহ. তাঁর ওয়ায ও বয়ানে আকছার এ হাদীস পাঠ করতেন। জামে তিরমিযী-এর হাদীস (২৪০৬)।
সাহাবী হযরত উকবা ইবনে আমির রা. বলেন-
"قلت: ما النجاة يا رسول الله!"
‘‘আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নাজাতের উপায় কী?’’
‘নাজাত’ অর্থ ধ্বংস থেকে মুক্তি পাওয়া, আযাব থেকে রক্ষা পাওয়া।
নাজাত দুনিয়াতেও প্রয়োজন, আখেরাতেও প্রয়োজন। দুনিয়াতে নাজাত হচ্ছে, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত শয়তানের আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকা, সব ধরনের গোমরাহী থেকে মুক্ত থাকা, পার্থিব ক্ষতিসমূহ থেকে মুক্ত থাকা। আর আখিরাতের নাজাত হচ্ছে আল্লাহ তাআলার আযাব ও গযব থেকে, জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া।
আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরামের উপর তাঁর অশেষ রহমত নাযিল করুন তাঁদের বিভিন্ন প্রশ্নের কারণে কুরআন মজীদের অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মূল্যবান নির্দেশনা এসেছে। ফলে আমাদের জন্য ইলমের আমলের অনেক দরজা উন্মুক্ত হয়েছে।
কুরআন মজীদে অনেক জায়গায় আছে-
يسئلونك
‘‘তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে।’’ এরপর সে জিজ্ঞাসা উল্লেখ করে কুরআন মজীদ তার জবাব দিয়েছে।
এ হাদীসে হযরত উকবা ইবনে আমির রা.-এর জিজ্ঞাসার জবাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি কথা বলেছেন, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং খুব মনোযোগের সাথে শোনা দরকার।
প্রথম কথা-
أملك عليك لسانك
তোমার যবানকে তোমার নিয়ন্ত্রণে রাখ।
অর্থাৎ যা বলতে হয় চিন্তা-ভাবনা করে বল। মনে রেখো, যা কিছু বলবে তার ফলাফল তোমার কাছে ফিরে আসবে। যা কিছু বলবে তা তোমার আমলনামায় সংরক্ষিত থাকবে। মুখ থেকে বের হওয়া এক এক শব্দ-বাক্যের হিসাব কিয়ামতের দিন দিতে হবে। কুরআন মজীদের ইরশাদ-
ما يلفظ من قول إلا لديه رقيب عتيد
‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে।’ (সূরা ক্বফ ৫০ : ১৮)
একইভাবে চিন্তা কর, এ কথার ক্ষতির দিকগুলো কী। যদি কথাটা এমন হয় যে, এর দ্বারা কেউ কষ্ট পেতে পারে, কারো হক নষ্ট হতে পারে তাহলে তা বলা থেকে বিরত থাকবে। অন্যায়ভাবে কারো দোষারোপ করা হলে, মিথ্যা বলা হলে, গীবত-শেকায়েত করা হলে এতে যেমন গুনাহ হবে তেমনি বান্দার হকও নষ্ট করা হবে। এ শুধু তওবা দ্বারা মাফ হবে না। যাকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে, গালি দেওয়া হয়েছে, অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে, গীবত করা হয়েছে, তার কাছে মাফও চাইতে হবে। মাফ না চেয়ে শত তওবা করলেও কাজ হবে না। আল্লাহ নিজের হক মাফ করেন, বান্দার হক মাফ করেন না।
আর সাধারণত ঝগড়া-বিবাদ মুখের অসাবধানতার কারণে হয়। একজন একটি কড়া কথা বলল, আরেকজন আরো কড়া জবাব দিল। এরও রাগ চড়ে গেল, ওরও।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যে ঝগড়া-বিবাদ হয় তা-ও সাধারণত যবানের অসাবধানতার কারণে হয়। যবানের কারণে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া হয়, সম্পর্ক নষ্ট হয়। এমনকি একের দ্বারা অন্যের জান-মালের ক্ষতি হয়। তো আল্লাহর রাসূলের নির্দেশনা-যবানকে নিয়ন্ত্রণে রাখ, কথার বিষয়ে সাবধান থাক।
হাদীস শরীফে আছে, সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি আমাদের মুখের কথার কারণে ধৃত হব? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
وهل يكب الناس على مناخرهم إلا حصائد ألسنتهم
অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ তো তাদের ‘মুখের ফসলে’র কারণেই জাহান্নামে যাবে। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৬১৬)
আরো ইরশাদ হয়েছে, জাহান্নামে নারীর সংখ্যা হবে বেশি। জিজ্ঞাসা করা হল, কেন? বললেন, এরা গঞ্জনা-অভিশাপ বেশি দেয় এবং স্বামীর না-শোকরি করে।
এক নারী আরেক নারীকে কথা দ্বারা কষ্ট দেয়। অতীতের পুরানো পুরানো কথা তুলে খোঁটা দেয়, গঞ্জনা দেয়। তো নাজাতের জন্য প্রথম কথা হল, আপন যবানকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
দ্বিতীয় কথা-
وليسعك بيتك
‘‘তোমার ঘর যেন তোমার জন্য প্রশস্ত হয়।’’
অর্থাৎ ঘরে অবস্থান করবে। বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে না। ঘরে আছ তো নিরাপদ। জান-মাল নিরাপদ। ইজ্জত-আব্রু নিরাপদ। ফিৎনা থেকে নিরাপদ। ঘর থেকে বের হলেই গুনাহ হতে পারে। চোখের গুনাহ, কানের গুনাহ, মুখের গুনাহ হতে পারে। কোনো গোমরাহ লোকের কথায় ফেঁসে ঈমান-আকীদা নষ্ট হতে পারে। আমল নষ্ট হতে পারে। কোথাও ঝগড়া-বিবাদ হল, তুমি নিরপরাধ, কিন্তু সেখানে উপস্থিত থাকার কারণে তুমিও ফেঁসে গেলে। মোকদ্দমায় তোমারও নাম এসে গেল। জান-মালের ক্ষতি হয়ে গেল। তো ঘর হচ্ছে নিরাপদ। বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ো না। ঘরে স্ত্রীকে সময় দাও, সন্তানকে সময় দাও। কিংবা অন্তত বিশ্রাম নাও। বিশ্রাম দ্বারা উদ্যম সৃষ্টি হবে। এ উদ্যম নেককাজে ব্যয় করতে পারবে।
প্রয়োজনের কারণে বের হতে পার। জামাতে নামায পড়ার জন্য মসজিদে যাবে। পড়া-শোনার জন্য মাদরাসায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য, উপার্জনের জন্য কর্মস্থলে যাবে। আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাতের জন্য, খোঁজখবর নেওয়ার জন্য যাবে। কিন্তু রাস্তা-ঘাটে ঘোরাঘুরি করো না, হাটে-বাজারে, চা-স্টলে, পার্কে শুধু শুধু বসে থেকো না, গল্প-গুজবে সময় নষ্ট করো না। জীবনের এক একটি মুহূর্তের হিসাব দিতে হবে।
কিয়ামতের দিন প্রত্যেককে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে, যার একটি হচ্ছে-
عن عمره فيما أفناه
জীবন কোথায় ব্যয় করেছে।
وعن شبابه فيما أبلاه
যৌবন কোথায় খরচ করেছে।
(জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৪১৬)
তো জীবন-যৌবনের এক এক মুহূর্তের হিসাব দিতে হবে এবং জবাব দেওয়ার আগ পর্যন্ত এক পা-ও নড়তে পারবে না। এ হচ্ছে দ্বিতীয় নসীহত, ঘরে থাকবে, বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে না।
তৃতীয় কথা হচ্ছে-
وابك على خطيئتك
‘‘এবং নিজের গুনাহর উপর কাঁদতে থাক।’’
আল্লাহর সামনে রোনাজারি কর, শেষ রাতে উঠে কান্নাকাটি কর। নিজের কর্মের হিসাব নাও-কী করা উচিত ছিল, আর কী করেছি। মালিকের সামনে অপরাধ স্বীকার করে অশ্রু ঝরাও। অনুতপ্ত বান্দার চোখের পানি আল্লাহর কাছে অতি পছন্দের।
দুইটি ফোঁটা আল্লাহর অতি প্রিয় : এক. মুজাহিদের রক্তের ফোঁটা, যা ভূমিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে মাফির কারণ হয়ে যায়। আর দুই. আল্লাহর ভয়ে বান্দার চোখ থেকে ঝরা অশ্রুর ফোঁটা।
হাদীসে আছে, সাত শ্রেণীর মানুষ কিয়ামতের দিন আরশের ছায়ায় স্থান পাবে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হচ্ছে-
رجل ذكر الله خاليا ففاضت عيناه
ঐব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করেছে আর তার চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হয়েছে। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৩৯১)
নিজ গুনাহর কথা স্মরণ করে, আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্বের কথা স্মরণ করে বান্দার চোখ থেকে যে অশ্রু ঝরে তা আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক অনেক প্রিয়। আর এটা নাজাতের রাস্তা। এ বান্দা দুনিয়াতেও হেফাযতে থাকবে, আখিরাতেও নাজাত পাবে।
তো এ হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি উপদেশ দিয়েছেন : এক. নিজের যবানকে সংযত রাখ, দুই. বিনা প্রয়োজনে বাইরে ঘুরো না, নিজের ঘরকে নিজের জন্য আল্লাহর রহমত মনে কর এবং ঘরে অবস্থান কর। তিন. নিজের ভুলত্রুটির জন্য আল্লাহর সামনে কাঁদতে থাক।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين
[উত্তরা ৭ নং সেক্টর জামে মসজিদে জুমা-পূর্ব বয়ানের অনুবাদ। অনুবাদে : মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ, ধারণ ও লিখন : তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব]