মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন একই দিনে ঈদ-প্রসঙ্গ দায়িত্বশীলদের উপর ছেড়ে দিন-১০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চাঁদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কার কাজ?
ঐ বন্ধুরা চিন্তা করেননি যে, চাঁদের সিদ্ধান্ত কে বাস্তবায়ন করবেন। রোযা ও ঈদের ঘোষণা কি নাগরিকসাধারণের কাজ, না রাষ্ট্র-প্রধান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দায়িত্বশীলদের কর্তব্য?
সুন্নতে নববী, হাদীস ও আছার এবং ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাসের উপর যাদের দৃষ্টি আছে, উম্মাহর অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা এবং উম্মাহর মুজতাহিদ ও ফকীহগণের ফতোয়াসমূহের বিষয়ে অবগতি আছে তারা জানেন, শরীয়ত রোযা ও ঈদকে ব্যক্তিগত ইবাদতের মতো ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেয়নি; শরীয়ত একে সম্মিলিত ইবাদত সাব্যস্ত করেছে এবং এর ব্যবস্থার ভার অর্পণ করেছে রাষ্ট্র-প্রধান ও তার নায়েবগণের উপর। আর জনসাধারণকে আদেশ করেছে তাদের আনুগত্যের। এ এক ইজমায়ী (সর্বসম্মত) মাসআলা, যাতে নির্ভরযোগ্য কোনো ফিকহী মাযহাবের ভিন্নমত নেই। নবী-যুগ ও খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ থেকে অবিচ্ছিন্ন কর্মধারায় এ নীতি অনুসৃত।
এ প্রসঙ্গে হাদীস-আছার ও ফিকহের কিতাবসমূহের উদ্ধৃতি সহকারে বিশদ আলোচনা করা যায়, কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রবন্ধটি দীর্ঘ হয়ে পড়েছে; তাছাড়া প্রসঙ্গটিও আলাদা প্রবন্ধের দাবি রাখে তাই সংক্ষেপনের স্বার্থে শুধু কটি মৌলিক বিষয়ের দিকে ইশারা করছি :
1. হাদীসের যে কোনো কিতাব থেকে রমযান, শাওয়াল ও যুলহিজ্জাহর চাঁদ সংক্রান্ত হাদীস ও আছারগুলো পাঠ করুন এবং ফিকহ-ফতোয়ার যে কোনো কিতাবে সওম ও ঈদের মাসায়েল অধ্যয়ন করুন, তাহলে আপনার কাছে এ বাস্তবতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে।
2. হাদীসে দেখুন, যারা চাঁদ দেখেছেন তারা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে সাক্ষ্য দিচ্ছেন আর তিনি সাক্ষ্য কবুল করে সওম ও ঈদের ফয়সালা করছেন এবং ঘোষক দ্বারা ঘোষণা করাচ্ছেন। একই অবস্থা ছিল খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও।
৩. তারীখ ও সীরাতের কিতাবসমূহ পাঠ করুন, দেখবেন, একই অবস্থা পরের আমীর ও খলীফাদের আমলেও ব্যাপকভাবে জারি। কেন্দ্রে এ ফয়সালা করছেন স্বয়ং আমীরুল মুমিনীন, অন্যান্য অঞ্চলে সে জায়গার গভর্ণর বা তার আদেশে প্রত্যেক শহরের কাযী (বিচারপতি)।
৪. ফিকহে ইসলামীর যে কোনো গ্রন্থে ‘কিতাবুস সওম’ অংশটি পাঠ করলে দেখবেন, চাঁদ সংক্রান্ত সকল মাসআলা এ মৌলনীতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত যে, চাঁদের প্রসঙ্গ কাযীর উপর ন্যস্ত। তার কাছেই সাক্ষ্য উপস্থাপিত হবে এবং তিনিই তা যাচাই করবেন ও ফয়সালা করবেন।
৫. সাহাবা-তাবেয়ীনের আছার ও চার মাযহাবের ফিকহের কিতাবসমূহে এ মাসআলা আলোচিত হয়েছে যে, এক বা একাধিক ব্যক্তি রমযানের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দিল। কিন্তু ইমাম (রাষ্ট্র-প্রধান বা তার নিয়োগকৃত কাযী বা দায়িত্বশীল) কোনো কারণে তার সাক্ষ্য কবুল না করায় ত্রিশ শাবান ধরে সাধারণ জনগণ রোযা থেকে বিরত থাকল, এক্ষেত্রে এ ব্যক্তির করণীয় কী? তেমনি এ মাসআলাও এসেছে যে, দুই ব্যক্তি ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দিল, কিন্তু ইমাম কোনো কারণে সাক্ষ্য রদ করল তো এরা কি অন্যদের সাথে ত্রিশ রোযা রাখবে, না নিজে নিজে ঈদ করবে?
এ বিষয়ক সকল রেওয়ায়েত ও সকল ফিকহী ইবারত পাঠ করুন, কোনো কোনো ফকীহর এটুকু কথা তো আপনি পাবেন যে, এ ব্যক্তি চুপে চুপে নিজের রোযা রাখবে, কিন্তু সে অন্যদেরও রোযা রাখার আদেশ করবে-এ অনুমতি কেউ দেননি। তেমনি ঈদের চাঁদের মাসআলাতেও অধিকাংশ ফকীহ বলেছেন, তাকে ত্রিশতম রোযা রাখতে হবে। রোযা না রাখারও অনুমতি নেই, ঈদ করারও অনুমতি নেই। আবার কোনো কোনো ফকীহ বলেছেন, সেদিন সে রোযা রাখবে না তবে তা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকবে। ঈদ তো অবশ্যই করবে অন্য সবার সাথে, একা একদমই নয়।
৬. এ সকল মাসাইল দ্বারা একদিকে যেমন পরিষ্কার হয় যে, রমযান ও ঈদের চাঁদের ফয়সালার অধিকার রাষ্ট্র-প্রধানের বা তার পক্ষ হতে নির্ধারিত ব্যক্তি বা মজলিসের, সাক্ষ্য তাদের কাছেই পেশ করা হবে এবং তারাই তা যাচাইয়ের পর শরীয়তের বিধান অনুসারে ফয়সালা জারি করবেন, তেমনি এ সকল মাসাইল থেকে এ-ও প্রতীয়মান হয় যে, ব্যক্তিবিশেষের অন্যদের থেকে আলাদা হওয়ার অনুমতি নেই, এমনকি তারও না যে নিজ ধারণায় চাঁদ দেখেছে ও তার সাক্ষ্যও দিয়েছে।
৭. ফিকহ ও ফতোয়ার গ্রন্থাদিতে এ মাসআলাও আলোচিত হয়েছে যে, অমুসলিম দেশগুলোতে অবস্থানকারী মুসলিমগণ রোযা ও ঈদ কীভাবে করবেন, যেখানে না আছেন মুসলিম রাষ্ট্র-প্রধান, না কোনো মুসলিম কাযী। তেমনি গ্রামের লোকেরা কী করবেন, যেখানে কোনো কাযী থাকে না। ফিকহ-ফতোয়ার সমকালীন গ্রন্থাবলিতে এ মাসআলাও এসেছে যে, কোনো মুসলিম দেশে সরকারী হেলাল কমিটি আছে, কিন্তু চাঁদের ফয়সালার ক্ষেত্রে তারা শরীয়তের বিধিবিধান অনুসরণ করে না; বরং ফিকহে ইসলামীর ইজমায়ী ও সর্বসম্মত বিধানও লঙ্ঘন করে ফেলে, এক্ষেত্রে মুসলিম জনগণের করণীয় কী।
ফিকহের এ সকল মাসআলাও প্রমাণ করে, চাঁদের ফয়সালার প্রকৃত হকদার হচ্ছেন রাষ্ট্র-প্রধান বা তার পক্ষ হতে নিয়োজিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ। এতে সাধারণ মানুষের না অনুপ্রবেশের হক আছে, না সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার।
হ্যাঁ, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা যদি তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে-একেবারেই পালন না করে বা খোলাখুলিভাবে শরীয়তের নীতি ও বিধান লঙ্ঘন করতে থাকে তখন আলিমদের অবশ্য-কর্তব্য, তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া আর সাধারণ মানুষের কর্তব্য, আলিমদের ফতোয়া অনুযায়ী আমল করা। তবে এক্ষেত্রেও বিচ্ছিন্নতা ও বিশৃঙ্খলার অনুমতি নেই।১
চাঁদের ফয়সালা, রোযা ও ঈদের ঘোষণা রাষ্ট্র-প্রধান বা তার পক্ষ হতে নিয়োজিত ব্যক্তি বা কমিটির কাজ, এ সর্বসম্মত ও ব্যাপকভাবে বর্ণিত ও অনুসৃত মূলনীতি উপলব্ধি করার পর খুব সহজেই বুঝে আসবে যে, কেউ যদি উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মাযহাব অনুসরণ করতে চান তাহলে সে মাযহাবের প্রবক্তাদের কাছেও এর পদ্ধতি এই নয় যে, স্বদেশবাসীদের থেকে আলাদা হয়ে কিছু লোক নিজেদের রোযা শুরু করবেন বা ঈদ করবেন। কেউ এমন করলে তা ভুল হবে। সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে, ঐ মাযহাব অনুসরণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দায়িত্বশীলদের (উলামা ও উমারা) উদ্ধুদ্ধ করা। তারা তা মেনে নিয়ে সে অনুসারে ফয়সালা করলে অধীনস্ত সকলের সে অনুযায়ী আমল করা জরুরি হবে। কিন্তু যে পর্যন্ত দায়িত্বশীলগণ এ ফয়সালা না করেন সে পর্যন্ত তাদের কর্তব্য, দায়িত্বশীলদের অনুগত থেকে দেশবাসীর সাথে রোযা শুরু করা।
এ ফতোয়া শুধু ঐ আলিমদের নয়, যারা উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রাহ্য করেন; বরং এ ফতোয়া তাঁদেরও, যারা উদয়স্থলের ভিন্নতা অগ্রাহ্য করেন। এমনকি সমকালীন ঐসব আলিমেরও, যারা উদয়স্থলের ভিন্নতা অগ্রাহ্য করার মাযহাব থেকেও অগ্রসর হয়ে সরাসরি রোযা ও ঈদে ঐক্যের আহবান করেন।
মুনাসিব মনে হচ্ছে, তাঁদের কয়েকজনের ফতোয়া এখানে উল্লেখ করি। আল্লাহ করুন, আমাদের ঐ বন্ধুদেরও সঠিক কথা বুঝে এসে যায়। তবে এর আগে হাদীস ও আছার থেকে আকাবিরে উম্মতের এ সর্বসম্মত ফতোয়ার দু-একটি সূত্র নমুনাস্বরূপ পেশ করা হচ্ছে :
1. তাবেয়ী ইমাম মাসরূক রাহ. বর্ণনা করেছেন, তিনি ও তার সাথী আরাফার দিন আয়েশা রা.-এর নিকটে গেলেন (ঐ দিনটি এমন ছিল, যা ‘ইয়াওমুন নাহর’ হওয়ারও সন্দেহ ছিল) আয়েশা রা. খাদেমাকে বললেন, তাদেরকে সুমিষ্ট করে ছাতুর শরবত পান করাও। আমি যদি রোযাদার না হতাম তাহলে আমিও পান করতাম। মাসরূক ও তার সঙ্গী বললেন, ‘আপনি রোযা রেখেছেন! আজ যদি কোরবানীর দিন হয়ে থাকে?!’ (মাসরূক এ কথাও বলেছিলেন, যে, আমি তো শুধু এই ভেবে রোযা রাখিনি যে, যদি আজ কোরবানীর দিন হয়?’) উম্মুল মুমিনীন বললেন-
إنما النحر إذا نحر الإمام وعُظْمُ الناس، والفطرُ إذا أفطر الإمام وعُظْمُ الناس.
অর্থাৎ কোরবানী তো তখন যখন ইমাম (মুসলমানদের রাষ্ট্র-প্রধান) ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কোরবানী করে এবং ইফতার (রোযা না-রাখা) তো তখন যখন ইমাম ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইফতার করে।
অন্য বর্ণনায় কথাটি এভাবে আছে-
إنما يوم الأضحى يوم يضحي الإمام وجماعة الناس.
অর্থাৎ কোরবানীর দিন তো সেটি যেদিন ইমাম ও জনগণ কোরবানী করে।
অন্য আরেক বর্ণনায় আছে-
إنما يوم النحر يوم ينحر الناس، ويوم الفطر يوم يفطر الناس
অর্থাৎ কোরবানীর দিন তো সেটি যেদিন লোকেরা কোরবানী করে এবং ফিতরের (ঈতুল ফিতরের) দিন তো সেটি যেদিন লোকেরা রোযা ছাড়ে।
(মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/১৫৭, হাদীস : ৭৩১০; মাসাইলু আহমদ, আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ-আহকামুল ইখতিলাফ ফী রুয়াতি হিলালি যিলহিজ্জাহ, ইবনে রজব পৃষ্ঠা : ৩৪-৩৫; কিতাবুল আছার, ইমাম আবু হানীফা, রেওয়ায়েত ইমাম আবু ইউসুফ পৃষ্ঠা : ১৭৯, হাদীস : ৮১৮; আসসুনানুল কুবরা বাইহাকী ৪/২৫২)
ইমাম ইবনে রজব রাহ. লেখেন-
فهذا الأثر صحيح عن عائشة رضي الله عنها، إسناده في غاية الصحة، ولا يعرف لعائشة مخالف من الصحابة.
অর্থাৎ হযরত আয়েশা রা. থেকে এ বাণী প্রমাণিত। এর সনদ সর্বোচ্চ মানের সহীহ সনদ এবং এ সিদ্ধান্তে তাঁর সাথে কোনো সাহাবীর দ্বিমত পাওয়া যায় না। (আহকামুল ইখতিলাফ, ইবনে রজব পৃষ্ঠা : ৩৬)
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর এ বাণী তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিল না; এ তো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীরই প্রতিধ্বনি। সামনের হাদীসটি দেখুন :
2. আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الصوم يوم تصومون، والفطر يوم تُفْطِرُون، والأضحى يوم تُضَحُّون.
অর্থাৎ, সিয়াম হল যেদিন তোমরা রোযা রাখ; ‘ফিতর’ হল যেদিন তোমরা রোযা ছাড়। আর কোরবানী হল যেদিন তোমরা কোরবানী কর। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭০৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৩২৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৬৬০; আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকী ৪/২৫১-২৫২)
ইমাম তিরমিযী রাহ. এ হাদীসকে ‘হাসান’ বলেছেন, কিন্তু এর একাধিক সনদ আছে, যার সম্মিলনে তা ‘সহীহ’ হওয়া প্রমাণিত হয়। (আলমাজমূ শরহুল মুহাযযাব, নববী ৭/৪৪৫; আল আলামুল মানশূর, তকীউদ্দীন সুবকী পৃষ্ঠা : ১৮; ফয়যুল কাদীর, মুনাভী ৪/৪৪১; আততালীকুল মুগনী আলা সুনানিদ দারাকুতনী ২/২২৪; ইরওয়াউল গালীল ৪/১১)
ইবনুল মুনকাদির এর বর্ণনায় আছে, আয়েশা রা. নিজেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইরশাদ নকল করেছেন-
عرفة يوم يعرف الإمام، والأضحى يوم يضحي الإمام، والفطر يوم يفطر الإمام
আরাফা হল যেদিন ইমাম আরাফায় উকুফ করে, কোরবানী হল যেদিন ইমাম কোরবানী করে, আর ফিতর হল যেদিন ইমাম রোযা ছাড়ে। (আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকী ৫/১৭৫, باب خطأ الناس يوم عرفة)
রমযান ও ঈদ প্রমাণ হওয়ার বিষয়ে এ হাদীস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে বেশ কিছু মৌলিক মাসআলার দলীল রয়েছে। আমি শুধু দুটি মাসআলা উল্লেখ করছি :
ক. রোযা, ঈদুল ফিতর, কোরবানী ও হজ্ব-এসব ইবাদতের সময় সম্পর্কে ফয়সালা করার অধিকার ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের নয়, এ ফয়সালা করবেন ইমাম (রাষ্ট্র-প্রধান) বা তাঁর নায়েব। যেদিন শরয়ী দলীলের ভিত্তিতে ইমাম ও জনগণ রোযা শুরু করবে সেদিনই পয়লা রমযান। যেদিন তারা রোযা ছাড়বে সেদিন ঈদ। যেদিন আরাফায় উকুফ করবে তা হজ্বের দিন আর যেদিন কোরবানী করবে তা কোরবানীর দিন। এ সকল বিষয়ে তাদের থেকে আলাদা হওয়ার অধিকার কারো নেই।
ইমাম তিরমিযীর ভাষায়-
وفسر بعض أهل العلم هذا الحديثَ، فقال : إنما معنى هذا : الصوم والفطر مع الجماعة وعُظْم الناس.
এবং আবুল হাসান সিন্ধীর শব্দে-
الظاهر أن معناه أن هذه الأمور ليس للآحاد فيها دخل، وليس لهم التفرد فيها، بل الأمر فيها إلى الإمام والجماعة، ويجب على الآحاد اتباعهم للإمام والجماعة.
(হাশিয়াতু সুনানি ইবনে মাজাহ, আবুল হাসান সিন্ধী খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৩০৬, দারুল মারিফাহ, বৈরুত)
খ. দায়িত্বশীলরা যখন শরীয়তের বিধান অনুসারে এসকল ইবাদতের মাসের চাঁদ সম্পর্কে ফয়সালা করবে তো সেটা যদি বাস্তবসম্মত না-ও হয়, যা আমাদের অজানা, তো এ কারণে আল্লাহর কাছে কোনো জবাবদিহী হবে না। আল্লাহ তাআলা ইবাদত কবুল করবেন।
ইমাম তকীউদ্দীন সুবকীর ভাষায়-
وهذا معناه ـ والله أعلم ـ إذا اجتمع الناس على ذلك فلا يكلفون بما عسى أن يكون في نفس الأمر ولم يعلموا به.العلم المنشور ص ١٨
আরো জানার জন্য দেখুন : মাআলিমুস সুনান, ইমাম আবু সুলায়মান খাত্তাবী (৩৮৮ হি.) ২/৮২; শরহুস সুন্নাহ, ইমাম বগভী ৬/২৪৭-২৪৯; তাহযীবু সুনানি আবু দাউদ, ইবনুল কাইয়্যিম ৩/২১৩-২১৪; নায়লুল আওতার, শাওকানী ৩/৩৮১; কিতাবুল ঈদাইন; মাআরিফুস সুনান, ইউসুফ বানূরী ৫/৩৫৬-৩৫৭
এ ভূমিকার পর এবার আকাবির আলিমগণের ফতোয়া লক্ষ্য করুন। তাঁদের মধ্যে যারা উদয়স্থলের বিভিন্নতা গ্রাহ্য করেন এবং যারা গ্রাহ্য করেন না, আর কিছু আলিম যারা আরো অগ্রসর হয়ে ঈদ ও সিয়ামের ঐক্যের বিষয়ে উৎসাহ দান করেন তাদের সবাই এ বিষয়ে একমত যে, কারো জন্য নিজ দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ ও মুসলিম জনগণ থেকে আলাদা হয়ে রোযা ও ঈদ করা জায়েয নয়।
চাঁদের বিষয়ে স্বদেশবাসী থেকে আলাদা হওয়া জায়েয নয়
1. শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ.
এ শিরোনামে সবার আগে শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. (১৩৩২-১৪২০ হি.)-এর নাম উল্লেখ করছি। কারণ তিনি শুধু উদয়স্থলের ভিন্নতা অগ্রাহ্যই করেন না, সকল মুসলিম দেশে একই দিনে রোযা ও ঈদেরও তাকীদ করেন। তিনি সাইয়েদ সাবেক মিসরী রাহ. (১৩৩৩-১৪২৫ হি.)-এর কিতাব ‘ফিকহুল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ’-এর উপর একটি পর্যালোচনা-গ্রন্থ রচনা করেছেন, যার নাম, ‘‘তামামুল মিন্নাহ ফিত তালীকি আলা ফিকহিস সুন্নাহ’’। এতে তিনি সাইয়েদ সাবিক রাহ.-এর উপর এ আপত্তি করেছেন যে, তিনি উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মতকে অগ্রগণ্য করেননি। শায়খ আলবানী রাহ.-এর বক্তব্য এই যে, صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته শীর্ষক হাদীসটি একদম ‘আম’ (ব্যাপক)। যে কোনো অঞ্চলের চাঁদ দেখার ইলম যে কোনো জায়গায় পৌঁছবে সেখানের অধিবাসীদের উপর এ হুকুম আরোপিত হবে। এতে দূরত্ব বা ইকলীমের কোনো পার্থক্য নেই।
শায়খ আলবানী আরো বলেন-
وهذا أمر متيسر اليوم للغاية كما هو معلوم، ولكنه يتطلب شيئا من اهتمام الدول الإسلامية حتى تجعله حقيقة واقعية إن شاء الله تبارك وتعالى.
وإلى أن تجتمع الدول الإسلامية على ذلك، فإني أرى على شعب كل دولة أن يصوم مع دولته، ولا ينقسم على نفسه، فيصوم بعضهم معها، وبعضهم مع غيرها، تقدمت في صيامها أو تأخرت، لما في ذلك من توسيع دائرة الخلاف في الشعب الواحد، كما وقع في بعض الدول العربية، منذ بضع سنين. والله المستعان.
অর্থ : আর এ তো (অর্থাৎ দূর-দূরান্তের অঞ্চলসমূহে চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার ইলম হাসিল হওয়া) এ যুগে একেবারেই সহজ, কিন্তু এর জন্য ইসলামী দেশগুলোর মনোযোগ দরকার, যাতে-আল্লাহ করুন-তা বাস্তবায়ন করা যায়।
কিন্তু যে পর্যন্ত সকল ইসলামী দেশ এ বিষয়ে একমত না হবে, আমার সিদ্ধান্ত, সকল দেশের অধিবাসী নিজ দেশের জনগণের সাথেই রোযা রাখবে। এমন যেন না হয় যে, তারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল, কেউ স্বদেশবাসীর সাথে রোযা রাখল আর কেউ অন্য দেশের সাথে। সে দেশে রোযা-ঈদ আগে হোক বা পরে। কারণ এমনটা হলে মতভেদের গন্ডি আরো প্রশস্ত হবে, যেমনটা কয়েক বছর যাবৎ আরব দেশগুলোতে দেখা যাচ্ছে। বাস, শুধু আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাওয়া যায়।
(তামামুল মিন্নাহ ফিততালীক আলা ফিকহিস সুন্নাহ ৩৯৮, দারুর রায়াহ, রিয়ায ১৪২৬ হি., মোতাবেক ২০০৫ ঈ., পঞ্চম সংস্করণ)
শায়খ আলবানী রাহ. এ বিষয়ে ‘‘সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহা ওয়া শাইউম মিন ফিকহিহা ওয়া ফাওয়াইদিহা’’তেও আলোচনা করেছেন। এ কিতাবে ২২৪ নম্বরে ঐ প্রসিদ্ধ হাদীস উল্লেখিত হয়েছে, যার আলোচনা এখনি হয়েছে-
الصوم يوم تصومون، والفطر يوم تفطرون، والأضحى يوم تضحون.
শায়খ প্রথমে এ হাদীসের বরাতসমূহ উল্লেখ করেছেন এবং এর সনদের উপর আলোচনা করেছেন, যার সারকথা, এ হাদীস তাঁর দৃষ্টিতে ‘হুজ্জত’ (দলিল হওয়ার যোগ্য)। এরপর এ হাদীসের মর্ম ও নির্দেশনা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, এ হাদীসের সহজ অর্থ তা-ই যা আবুল হাসান সিন্ধী রাহ. ‘‘সুনানে ইবনে মাজাহ’’র টীকায় উল্লেখ করেছেন, যার সারমর্ম এই যে, সওম, ফিতর (ঈদুল ফিতর) ও আযহা (কোরবানী)র মতো সম্মিলিত ইবাদতসমূহের ব্যবস্থাপনা ব্যক্তির হাতে নয়; বরং ‘ইমাম’ ও ‘আলজামাআ’ (রাষ্ট্র-প্রধান ও সংখ্যাগরিষ্ঠে)র হাতে। ব্যক্তির কর্তব্য, তাদের অনুগত থাকা।
শায়খ বলেন, মাসরূকের প্রশ্নের উত্তরে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. যে এ হাদীস পেশ করেছেন তা থেকেও এ অর্থের সমর্থন হয়। আর এ অর্থই শরীয়তের শান উপযোগী। শরীয়তের এক গুরুত্বপূর্ণ মাকসাদ উম্মাহর ঐক্য অটুট রাখা, তাদের ছত্রভঙ্গ হতে না দেওয়া এবং যত ব্যক্তিগত মতামত তাদের ঐক্যে ফাটল ধরায় তা থেকে তাদের দূরে রাখা।
এ কারণে কারো ব্যক্তিগত মত, তা শরীয়তের দৃষ্টিতে সঠিক হলেও, সম্মিলিত ইবাদতের ক্ষেত্রে, যেমন রোযা, ঈদ ও জামাতের নামায, শরীয়ত গ্রাহ্য করে না।
সামনে শায়খ সাহাবায়ে কেরামের কর্মপন্থার উদ্ধৃতি দিয়ে হুঁশিয়ার করেছেন যে, এ হাদীস থেকে ও সাহাবায়ে কেরামের কর্মপন্থা থেকে ঐ সকল লোকের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, যারা শাখাগত বিষয়ে মতভেদের কারণে কোনো ইমামের পিছনে ইকতিদা করা থেকে বিরত থাকে এবং যারা জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবে পারদর্শিতার দাবি করে নিজ মুসলিম ভাইদের থেকে আলাদা হয়ে রোযা ও ঈদ করে। তারা চিন্তা-ভাবনা করলে এ আলোচনায় আছে তাদের অজ্ঞতা ও অহঙ্কার-ব্যধির উপশম।
শায়খ আলবানীর ভাষায়-
وهذا المعنى هو المتبادر من الحديث ...، وهذا هو اللائق بالشريعة السمحة التي من غاياتها تجميع الناس وتوحيد صفوفهم، وإبعادهم عن كل ما يُفرِّق جمعَهم من الآراء الفردية، فلا تعتبر الشريعة رأي الفرد، ولو كان صوابا من وجهة نظره، في عبادة جماعية كالصوم والتعييد وصلاة الجماعة ...
فليتأمل في هذا الحديث وفي الأثر المذكور أولئك الذين لا يزالون يتفرقون في صلواتهم ...، وبعض أولئك الذين يدعون العلم بالفلك ممن يصوم وحده ويفطر وحده، متقدما أو متأخرا على جماعة المسلمين، معتدا برأيه وعلمه، غير مبال بالخروج عنهم.
فليتأمل هؤلاء جميعا فيما ذكرناه من العلم، لعلهم يجدون شفاء لما في نفوسهم من جهل وغرور، فيكونون صفا واحدا مع إخوانهم المسلمين، فإن يد الله على الجماعة.
(সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহা ১/১, পৃ. ৪৪৪, হাদীস : ২২৪)
‘‘সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহা’’য় (হাদীস নং : ২৬২৪-এর অধীনে) শায়খ আলবানী রাহ. দ্বিতীয়বার এ মাসআলা আলোচনা করেছেন এবং ‘‘তামামুল মিন্নাহ’’-এর আলোচনার মতো পরিষ্কার বলেছেন, সকল মুসলিম দেশের পক্ষ হতে সম্মিলিত ব্যবস্থা হওয়ার আগে আমরা প্রত্যেক দেশের অধিবাসীদের নিজেদের ঐক্য অটুট রাখাকে জরুরি মনে করি। কিছু লোক স্বদেশবাসীর সাথে আর কিছু অন্য দেশের অধিবাসীদের সাথে-এভাবে নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাওয়াকে আমরা জায়েয মনে করি না।
শায়খ আলবানীর এ দুই আলোচনা শায়খ হুসাইন আলআওযাইশাও তাঁর কিতাব ‘‘আলমওসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলমুইয়াসসারা ফী ফিকহিল কিতাবি ওয়াস সুন্নাতিল মুতাহহারা’’য় (৩/২০৮-২১৩) নকল করে সমর্থন করেছেন।
2. ড. ইউসুফ কারযাভী (হাফিযাহুল্লাহু ওয়া রাআহু)
ড. কারযাভীও ঈদ ও সিয়ামে ঐক্যের সমর্থনকারীদের অন্যতম। এ সত্ত্বেও তিনি তাঁর ফতোয়া-সংকলনে পরিষ্কার লিখেছেন, রোযা ও ঈদে মুসলমানদের এক হওয়া কাম্য। এ বিষয়ে নিরাশ হওয়া উচিত নয়, তবে যে বিষয়ে জোর দেওয়া ওয়াজিব এবং যে বিষয়ে কখনোই ত্রুটি হওয়া উচিত নয় তা এই যে, আমরা যদি বৈশ্বিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম না হই তবে অন্তত আঞ্চলিক ঐক্য অটুট রাখা তো ওয়াজিব।
তাই একই শহরের বা একই দেশের লোকেরা দুই ভাগে বিভক্ত হবে-কেউ পয়লা রমযান বলে রোযা রাখবে আর কেউ ত্রিশ শাবান বলে রোযা রাখা থেকে বিরত থাকবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। তেমনি মাসের শেষে কেউ ত্রিশ রমযান বলে রোযা রাখবে আর কেউ পয়লা শাওয়াল বলে ঈদ করবে-এ মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ ইজমায়ী ও সর্বসম্মত বিধান এই যে, হাকিমের ফয়সালা বা দায়িত্বশীলের সিদ্ধান্ত মতভেদপূর্ণ মাসআলায় মতভেদের সমাপ্তি ঘটায়।
এ কারণে কোনো মুসলিম দেশে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান যদি রোযা ও ঈদের ফয়সালা করে তাহলে সে দেশের মুসলমানদের তা মান্য করা অপরিহার্য। কারণ এ ‘তআত ফিল মারূফ’ (ন্যায়ের ক্ষেত্রে আনুগত্যের) মধ্যে পড়ে (যা শরীয়তের দৃষ্টিতে ফরয)। যদিও তার সিদ্ধান্ত অন্য দেশের সিদ্ধান্তের বিপরীত হয়। কারণ হাকিমের ফয়সালা এখানে ঐ মাযহাবকেই নির্ধারিত/অগ্রগণ্য করেছে, যাতে বলা হয়েছে, প্রত্যেক জনপদে নিজেদের চাঁদ দেখা অনুসরণীয়। হাদীস শরীফে প্রমাণিত-
صومكم يوم تصومون، وفطركم يوم تفطرون، وأضحاكم يوم تضحون.
ড. কারযাভীর আরবী ইবারতের এক অংশ দেখুন-
ولكن الذي يجب تأكيده وعدم التفريط فيه بحال، هو : أننا إذا لم نصل إلى الوحدة الكلية العامة بين أقطار المسلمين في أنحاء العالم، فعلى الأقل يجب أن نحرص على الوحدة الجزئية الخاصة بين أبناء الإسلام في القطر الواحد.
(ফাতাওয়া মুআসিরা, ড. ইউসুফ কারযাভী ২/২২২-২২৪)
3. শায়খ আবদুল আযীয ইবনে বায (১৩৩০-১৪২০ হি.)
শায়খ ইবনে বাযের কয়েকটি ফতোয়া আমরা বিগত সংখ্যাগুলোতে পাঠ করেছি। এখানে আরো একটি ফতোয়া উদ্ধৃত করছি। তাঁর কাছে পাকিস্তান থেকে প্রশ্ন এসেছিল যে, পাকিস্তানে রমযান ও শাওয়ালের চাঁদ দেখা যায় সৌদিয়ার পরে, কখনো দুই দিন পরে। এখন প্রশ্ন এই যে, আমরা কি সৌদিয়ার সাথে রোযা শুরু করব, না পাকিস্তানবাসীর সাথে।
প্রশ্নকারী পাকিস্তানে বসবাস করলেও পাকিস্তানের নাগরিক ছিলেন না। সম্ভবত সৌদী ছিলেন। শায়খ ইবনে বায যে উত্তর দিয়েছিলেন তা নিম্নরূপ :
الذي يظهر لنا من حكم الشرع المطهر أن الواجب عليكم الصوم مع المسلمين لديكم، لأمرين : أحدهما : قول النبي صلى الله عليه وسلم : الصوم يوم تصومون، والفطر يوم تفطرون، والأضحى يوم تضحون. خرجه أبو داود وغيره بإسناد حسن، فأنت وإخوانك مدة وجودكم في الباكستان ينبغي أن يكون صومكم معهم حين يصومون وإفطاركم معهم حين يفطرون، لأنكم داخلون في هذا الخطاب.
ولأن الرؤية تختلف بحسب اختلاف المطالع، وقد ذهب جمع من أهل العلم، منهم ابن عباس رضي الله عنهما، إلى أن لأهل كل بلد رؤيتهم.
الأمر الثاني : أن في مخالفتكم المسلمين لديكم في الصوم والإفطار تشويشا ودعوة للتساؤل والاستنكار وإثارة للنزاع والخصام، والشريعة الإسلامية الكاملة جاءت بالحث على الاتفاق والوئام والتعاون على البر والتقوى وترك النزاع والخلاف، ولهذا قال تعالى : واعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرقوا.
وقال النبي صلى الله عليه وسلم لما بعث معاذا وأبا موسى رضي الله عنهما إلى اليمن : بشرا ولا تنفرا وتطاوعا ولا تختلفا.
শায়খ এ প্রজ্ঞাপূর্ণ ইলমী ফতোয়ায় ঐ প্রশ্নকারীদের বলেছেন, তোমাদের বিষয়ে পবিত্র শরীয়তের বিধান আমাদের এ-ই মনে হচ্ছে যে, যাদের সাথে তোমাদের অবস্থান তাদের সাথেই তোমাদের রোযা রাখা জরুরি। এটা দুই কারণে : এক. ঐ হাদীসের ইরশাদ, যাতে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
الصوم يوم تصومون، والفطر يوم تفطرون، والأضحى يوم تضحون.
এ কারণে তুমি ও তোমার সাথীরা যে পর্যন্ত পাকিস্তানে থাকবে তোমাদের রোযা ও ঈদ তাদের সাথেই হওয়া চাই। কারণ তোমরা এ হাদীসের সম্বোধনে শামিল।
দ্বিতীয় কারণ, তোমরা যেখানে আছ, রোযা ও ঈদে যদি ঐখানের মুসলমানদের বিরোধিতা কর তাহলে বিশৃঙ্খলা হবে। অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের পথ খুলবে। ঝগড়া-বিবাদ হবে, অথচ শরীয়তের আদেশ নিজেদের একতা ও সম্প্রীতি রক্ষা করা এবং নেকী ও খোদাভীরুতার পথে পরস্পর সহযোগী হওয়া।
(এরপর আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.সহ আহলে ইলমের এক জামাত যখন প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য আলাদা আলাদা চাঁদ দেখার প্রবক্তা তখন পাকিস্তানের অধিবাসীরা যদি নিজেদের চাঁদ দেখা অনুসরণ করে তাহলে এটিও নেকীর কাজ। এতে তাদের সহযোগিতা করা জরুরি। ওখানে অবস্থান করে তাদের বিরোধিতা করে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ তোমাদের নেই।)
(মাজমূউ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাতুম মুতানাউইয়াহ, শায়খ ইবনে বায ১৫/১০৩-১০৪, তৃতীয় প্রকাশ ১৪২৮ হি.)
একই নির্দেশনা শায়খ ইবনে বায অন্যান্য ফতোয়াতেও দান করেছেন যা তার ঐ কিতাবে দেখা যেতে পারে। (১৫/১০০-১০২)
4. ড. হুসামুদ্দীন ইবনে মূসা
জামেয়াতুল কুদস ফিলিস্তীনের ‘‘কুল্লিয়াতুদ দাওয়াহ’’-এর প্রফেসর ড. হুসামুদ্দীন ইবনে মূসার ‘‘ইয়াসআলূনাকা আন রমযান’’ কিতাবে এ বিষয়ে একাধিক প্রশ্ন আছে। জবাবে তিনি একটি কথাই বলেছেন, যদিও আমি উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মাসলাককেই অগ্রগণ্য মনে করি এবং আমারও ইচ্ছা, সকল মুসলিম একই চাঁদ দেখার উপর ঐক্যবদ্ধ হোক, কিন্তু এ বাস্তবতা উপেক্ষা করাও সঠিক নয় যে, উদয়স্থলসমূহের ঐক্য সাধনের মাসলাক এখনো পর্যন্ত একটি নীতিমাত্র, যা নবী-যুগ থেকে এ যুগ পর্যন্ত কখনো বাস্তবতার মুখ দেখেনি।
এজন্য আমি বলি-
يجب على أهل كل بلد من بلدان المسلمين أن يصوموا في يوم واحد، وأن يكون عيدهم في يوم واحد، فنحن أهل فلسطين علينا أن نصوم جميعا في يوم واحد وأن يكون عيدنا واحدا، لأن في هذا الأمر محافظة على وحدتنا الجزئية إلى أن تتحقق وحدة العالم الإسلامي الكلية، فلا يقبل أن يختلف أهل البلدة الواحدة أو المدينة الواحدة أو القرية الواحدة، فبعضهم صائم وبعضهم يصلي العيد.
وضابط هذا الأمر هو الالتزام بما يصدر عن أهل العلم في ذلك البلد، وهم القضاة في المحاكم الشرعية، وطاعتهم في ذلك طاعة في المعروف، وإن كان هذا مخالفا لرؤية أهل بلد آخر، لأن الأصل في الصوم أن يكون مع جماعة المسلمين وعامتهم، لما ثبت في الحديث من قول الرسول صلى الله عليه وسلم : الصوم يوم تصومون، والفطر يوم تفطرون، الأضحى يوم تضحون. رواه الترمذي وأبو داود والبيهقي، وهو حديث صحيح ...
অর্থ : প্রত্যেক মুসলিম-দেশের অধিবাসীদের অবশ্য-কর্তব্য নিজেরা একই দিন রোযা শুরু করা এবং একই দিন ঈদ করা। বৈশ্বিক ঐক্য বাস্তবায়িত হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্তত আঞ্চলিক ঐক্য সংরক্ষণ করা জরুরি। এ কারণে একই দেশের জনগণ বা এক শহরের অধিবাসী নিজেদের মধ্যে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া-কেউ রোযাদার, কেউ ঈদ উদযাপনরত-মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এখানে মূলনীতি এই যে, প্রত্যেক দেশে স্থানীয় দায়িত্বশীল আহলে ইলমের পক্ষ হতে চাঁদের বিষয়ে যে ফয়সালা প্রকাশিত হয় গোটা দেশবাসী তা অনুসরণ করবে এবং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের আনুগত্য করবে। কারণ তা ‘‘ইতাআত ফিল মারূফ’’ (ন্যায়ের ক্ষেত্রে আনুগত্য)-এর অংশ। তাদের চাঁদের ফয়সালা যদি অন্য কোনো দেশের চাঁদ দেখার বিরোধীও হয় তবুও তাদের আনুগত্য করবে এবং তাদের ফয়সালা অনুসরণ করবে।
হাদীস শরীফে আছে-
الصوم يوم تصومون، والفطر يوم تفطرون، والأضحى يوم تضحون.
তিরমিযী, আবু দাউদ ও বাইহাকী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তা সহীহ হাদীস। এ হাদীসের দাবি তা-ই, যা উপরে বলা হয়েছে। (ইয়াসআলূনাকা আন রমাযান পৃষ্ঠা : ২৯-৩০)
ড. হুসামুদ্দীন আরো লেখেন-
وأخيرا أقول : إن على المنادين بوحدة المسلمين في الصوم أن يكفوا عن هذه الدعوى لما فيها من تفريق المسلمين في البلد الواحد، وأن يسعوا سعيا حقيقيا إلى الوحدة الحقيقية للمسلمين، لا مجرد كلام وتنظير فلسفي.
وعليهم أن يتركوا قضية إثبات الهلال إلى دور الإفتاء والقضاء في دول مسلمي اليوم، وإن الذي يكفل وحدة المسلمين الحقيقية هو اتفاقهم على العمل بكتاب الله وسنة رسوله صلى الله عليه وسلم في جميع شؤونهم، وليس مجرد اتفاقهم على الصيام والعيد في يوم واحد.
অর্থ : ‘‘সবশেষে আমি বলতে চাই, রোযা ও ঈদে ঐক্যের শ্লোগান দানকারীদের এ শ্লোগান পরিহার করা কর্তব্য। কারণ এভাবে তারা একই দেশের মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করছে। তাদের কর্তব্য, শুধু মৌখিক জমা-খরচের স্থলে মুসলমানদের মাঝে বাস্তব ঐক্য প্রতিষ্ঠার কার্যকর প্রয়াস গ্রহণ করা। তাদের কর্তব্য, প্রত্যেক দেশের চাঁদের ফয়সালা সে দেশের ফতোয়া-বিভাগ ও বিচার-বিভাগের উপর (সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের উপর) ছেড়ে দেওয়া। আর যা দ্বারা সকল মুসলিমের ঐক্য প্রতিষ্ঠা হতে পারে তা হচ্ছে, সকলে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ মোতাবেক আমলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। শুধু একদিন একসাথে রোযা ও ঈদে সম্মত হওয়া প্রকৃত ঐক্য নয়। (ইয়াসআলূনাকা আন রামাযান পৃষ্ঠা : ৩৫)
ড. হুসামুদ্দীন এ কিতাবে আরো লেখেন-
إن الصوم والفطر ليس عملا فرديا يقوم به فرد أو أفراد لوحدهم بل الصيام والعيد عبادة جماعية تتم مع الجماعة فلا يصح أن يصوم أحد رمضان لوحده، وكذلك لا يصح أن يعيد فرد لوحده، وهذا هو المفهوم المستمد من سنة النبي صلى الله عليه وسلم حيث قال : الصوم يوم تصومون والفطر يوم تفطرون والأضحى يوم تضحون. رواه الترمذي وأبو داود والبيهقي، وهو حديث صحيح ...
অর্থ : রমযানের রোযা ও ঈদ কোনো ব্যক্তিগত আমল নয় যে, এক বা একাধিক ব্যক্তি নিজেদের মতো করে তা পালন করবে। বরং রমযানের রোযা ও ঈদ হচ্ছে সম্মিলিত ইবাদত, যা সম্মিলিতভাবে আদায় করা হয়। এ কারণে কেউ একা নিজের মতো রোযা রাখা বা একা ঈদ করা জায়েয নয়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ থেকে তা গৃহীত। তিনি ইরশাদ করেছেন-
الصوم يوم تصومون، والفطر يوم تفطرون، والأضحى يوم تضحون.
(প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা : ৩৯)
5. ড. শায়খ আবদুল মুহসিন আলআববাদ আলবদর
মসজিদে নববীর ইমাম ও মুদাররিস এবং জামিয়া ইসলামিয়া মদীনা মুনাওয়ারার প্রফেসর শায়খ আবদুল মুহসিন আলআববাদ ‘‘সুনানে আবু দাউদ’’-এর ভাষ্যগ্রন্থে বলেছেন, মনে তো হয় যে, সকল মুসলিমের একসাথে রোযা শুরু করাই ভালো, কিন্তু যখন তা হচ্ছে না তখন প্রত্যেক দেশের অধিবাসী নিজেদের আলিমগণের ফতোয়ার উপর আমল করবে, তাঁরা অন্য কোনো দেশের চাঁদ দেখা অনুসরণ করুন বা নিজের দেশের চাঁদ দেখা। এটাই সঠিক পন্থা।
(শরহে সুনানে আবু দাউদ, শায়খ আবদুল মুহসিন আলআববাদ, দরস নং : ২৬৮ باب إذا رؤي الهلال في بلد قبل الآخرين بليلة يلة)
6. শায়খ আবু আবদিল মুয়িয ফারকূস
সালাফী আলেম ‘‘জামেয়াতুল জাযাইর’’-এ ‘কুল্লিয়াতু উসূলিদ্দীন’-এর প্রফেসর শায়খ আবদুল মুয়িয মুহাম্মাদ আলী ফারকূস তার ‘‘ফিকহু আহাদীসিস সিয়াম’’ সিরিজের তৃতীয় কিতাব ‘‘হাদীসুল আমরি বিস সওমি ওয়াল ইফতার লিরুয়াতিল হিলাল’’-এ উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মাসলাককেই অগ্রগণ্য ও পছন্দনীয় বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন, কোনো শহরে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে পৃথিবীর যত শহর ঐ শহরের সাথে রাতে বা রাতের কোনো অংশে শরিক সব জায়গায় ঐ চাঁদ দেখা অবশ্য-অনুসরণীয়। আর যে সব জায়গায় ঐ সময় দিন হয়ে গেছে সেখানে তাদের নিজেদের চাঁদ দেখা অনুসরণীয়।
এরপরও তিনি পরিষ্কার লেখেন-
على أن الميزان المقاصدي يقتضي أنه إذا ثبت عند ولي المسلمين وإمامهم الأعلى أحد النظرين المجتهد فيهما، وأصدر حكما على وفقه لزم على جيمع من تحت ولايته التزام بصوم أو إفطار لاعتقاده بأحقيته في اجتهاده ـ كما تقدم ـ ولو في خصوص بلد إسلامي، إذ الاعتبار الشرعي في العبادات الجماعية مع الجماعة وإمامهم، لقوله صلى الله عليه وسلم : الصوم يوم تصومون، والفطر يوم تفطرون، والأضحى يوم تضحون.
وعليه فلا تجوز مخالفته شرعا قولا واحدا، درءًا للنزاع ودفعا للمفسدة وإبعادا للفرقة، سواء عند من اعتبر المطالع في ثبوت الأهلة أو من نازعه في هذا الاعتبار.
অর্থ : এ সত্ত্বেও মাকাসিদে শরীয়া ভিত্তিক মানদন্ডের দাবি এই যে, যখন রাষ্ট্র-প্রধান (বা তার পক্ষ হতে চাঁদের ফয়সালার জন্য নির্ধারিত ব্যক্তি বা কমিটি)র কাছে ইজতিহাদী দুই মাসলাকের কোনো একটি প্রমাণিত হবে এবং তাদের পক্ষ হতে সে অনুযায়ী কোনো ফয়সালা প্রকাশিত হবে তখন সে রাষ্ট্রের অধীনে বসবাসকারী সকলের এ ফয়সালার আনুগত্য করা জরুরি।
রোযা রাখার বিষয়েও এবং রোযা ছাড়ার বিষয়েও ...। কারণ সম্মিলিত ইবাদত-বন্দেগীতে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি এটাই যে, সকলে (দেশের) সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ও তাদের রাষ্ট্র-প্রধানের সাথেই থাকবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الصوم يوم تصومون، والفطر يوم تفطرون، والأضحى يوم تضحون.
এ কারণে সর্বসম্মত শরয়ী নীতি এই যে, এ বিষয়ে রাষ্ট্র-প্রধানের বিরোধিতা জায়েয নয়। যারা উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রাহ্য করেন তাঁদের কাছেও, যারা গ্রাহ্য করেন না তাদের কাছেও। (হাদীসুল আমরি বিস সিয়ামি ওয়াল ইফতারি লিরুয়াতিল হিলাল, শায়খ আবু আবদিল মুয়িয ফারকূস ৯১-৯২, মুদ্রণ : ১৪২২ হি., মোতাবেক ২০০১ ঈ.)
হুবহু এ কথাই তিনি তাঁর ‘‘ফাতাওয়া’’তেও বলেছেন। দেখুন : সিয়াম সংক্রান্ত ফতোয়াসমূহে ফতোয়া নং : ১৬২, তারিখ ২৪ শাবান ১৪১৬ হি. মোতাবেক ১৫ জানুয়ারি ১৯৯৬ ঈ. (www.ferkous.com)
আরেক ফতোয়ায় ‘কেউ এক দেশে রোযা শুরু করে অন্য দেশে গেলে তার ঈদের নিয়ম কী হবে’ এ প্রশ্নের উত্তরে শায়খ আবু আবদিল মুয়িয বলেন, ‘যে দেশে তার/তাদের অবস্থান ওখানের রাষ্ট্র-প্রধান ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের নিয়মে তারা রোযা ও ঈদ করবে। দেশে দেশের হিসাবে, প্রবাসে ওখানের হিসাবে। ... হাদীস দ্বারা এমনটাই প্রমাণিত হয় যে, সওম ও ইফতার এবং ঈদ ও কোরবানীর মতো সম্মিলিত ইবাদতে ব্যক্তির কোনো ইতিবার নেই এবং এসব ক্ষেত্রে কারো বিচ্ছিন্নতা অবলম্বনের সুযোগ নেই। যে দেশে তার অবস্থান ওখানকার মুসলিম জনগণ ও রাষ্ট্র-প্রধানকে ছেড়ে অন্য দেশের লোকদের অনুসরণ তার জন্য জায়েয নয়। যেখানে সে আছে সেখানের মুসলমান ও রাষ্ট্র-প্রধানের সাথে তাকে রোযা রাখতে হবে ও রোযা ছাড়তে হবে। আর এ কারণে যদি ঐ মুসাফিরের রোযা ২৯-এর কম থেকে যায় তাহলে একটি রোযা কাযা করতে হবে। আর যদি ত্রিশের বেশি হয় তবুও যে দেশে তার অবস্থান সেখানের লোকদের সাথেই ঈদ করবে। অতিরিক্ত রোযা তার জন্য নফল হবে ...।
(ফতোয়া নং : ৫০০, ১১ রমযান ১৪২৭ হি., মোতাবেক ৪ অক্টোবর ২০০৬ ঈ.)
ফতোয়ার আরবী পাঠের মূল অংশ নিম্নরূপ :
ومنه يفهم أنه في العبادة الجماعية كالصوم والإفطار والأضحية والتعييد ونحوها لا عبرة فيها للآحاد، وليس لهم التفرد فيها، ولا أن يتبعوا الجماعة غير الجماعة التي يتواجدون بينهم، بل الأمر فيها إلى الإمام والجماعة التي وجد معهم صوما وإفطارا ... .
৭. শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ উছাইমীন (১৩৪৭ হি .-১৪২১ হি.)
বিগত সংখ্যাগুলোতে আমরা শায়খের বিভিন্ন বক্তব্য পাঠ করেছি। বাংলাদেশে অবস্থিত সৌদী দূতাবাসের এক কর্মকর্তার পক্ষ হতে শায়খের কাছে যে প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল তাতে শায়খ বাংলাদেশে অবস্থানকারী সৌদী নাগরিকদেরও এখানের জনগণের সাথে রোযা ও ঈদ করতে বলেছেন এবং এখানের তারিখ অনুসারে আরাফার রোযা রাখতে বলেছেন।
8. কুয়েত ফতোয়া বোর্ড
কুয়েত ‘ওযারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুউনিল ইসলামিয়্যাহ’র ফতোয়া বোড,র্ যা ওখানের ফিকহ-ফতোয়ার বড় বড় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য মনে করে না। এ সত্ত্বেও তার দৃষ্টিভঙ্গি এই যে, যতদিন গোটা মুসলিম বিশ্বে রোযা ও ঈদে ঐক্য প্রতিষ্ঠা না হবে ততদিন প্রত্যেক মুসলিম দেশ নিজেদের (নির্ভরযোগ্য) সরকারী হেলাল কমিটির অনুসরণ করবে। আর অমুসলিম দেশগুলোতে মুসলিম সংগঠনগুলোর ফয়সালা অনুসরণ করা হবে।
এক প্রশ্নের উত্তরে বোর্ড লিখেছে-
ولكن لما كان العمل في البلاد الإسلامية جاريا على الرأي الأول، وهو اختلاف المطالع، وأن لكل بلد رؤيته، فترى الهيئة العامة للفتوى بالكويت أنه ينبغي على المسلمين في أمريكا الشمالية اتباع اللجنة المشكلة من جماعة المسلمين هناك، وأنه ينبغي طاعتها في هذا الأمر وسائر ما فيها مصلحة المسلمين، لأنه تقوم بالنسبة لمسلمي أمريكا مقام الهيئات الدينية الرسمية في البلاد الإسلامية، والله أعلم.
(মাজমূআতুল ফাতাওয়াশ শরইয়্যাহ, কুয়েত ওযারাতুল আওকাফ ৩/৬৫-৬৬)
কুয়েত ফতোয়া বোর্ডে একবার এ মর্মে অনেক প্রশ্ন এল যে, কুয়েত হেলাল কমিটির ফয়সালা অনুসারে ১৪০৩ হিজরীর রমযানুল মুবারক শুরু হয় ১২ জুন (১৯৮৩ ঈ.)। অথচ কোনো কোনো ইসলামী দেশে সে বছর পয়লা রমযান ছিল ১১ জুন (১৯৮৩ ঈ.)। প্রশ্নকারীদের জিজ্ঞাসা ছিল, তাদের কি একদিনের (শনিবারের) রোযা কাযা করতে হবে।
কুয়েত ফতোয়া বোর্ড জবাব দিয়েছে-
إنه بالنسبة لأهل الكويت والمقيمين فيها يجب التقيد بما قررته هيئة الرؤية الشرعية في الكويت، لأنها الجهة المختصة المعينة من الدولة لهذه المهمة الشرعية.
وبناء عليه لا يلزم قضاء يوم السبت المشار إليه، لأن أول رمضان في حق أهل الكويت والمقيمين فيها هو يوم الأحد الموافق ١٢⁄٦⁄١٩٨٣ ...
অর্থাৎ কুয়েতবাসী ও কুয়েতে অবস্থানকারী প্রবাসীদের কুয়েত হেলাল কমিটির ফয়সালা অনুসরণ করা অপরিহার্য। কারণ রাষ্ট্রের পক্ষ হতে এ কমিটিই এ ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের (চাঁদের সিদ্ধান্ত দেওয়ার) জন্য নির্ধারিত। তাই শনিবারের রোযা তাদের কাযা করতে হবে না। তাদের জন্য পয়লা রমযান ছিল রবিবার অর্থাৎ ১২ জুন, ১৯৮৩ ঈ.।
(মাজমূআতুল ফাতাওয়াশ শরইয়্যাহ ১/২৩৩-২৩৪)
9. শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম
হযরত মাওলানা ‘‘রুয়াতে হেলাল’’ (চাঁদ দেখা) বিষয়ে লিখিত তাঁর প্রবন্ধে, যা তাঁর আযীমুশ শান ফিকহী কিতাব ‘‘বুহূছুন ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআসিরা’’র দ্বিতীয় খন্ডে মুদ্রিত, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মাসলাককে দলিলের দিক থেকে শক্তিশালী বলেছেন এবং এ-ও বলেছেন যে, এ মাসলাক অনুসারে সারা বিশ্বে চাঁদের মাসগুলোর সূচনায় ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
এ সত্ত্বেও হযরত মাওলানা পরিষ্কার বলেছেন, যতদিন এ বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনা শরীয়তসম্মত উপায়ে না হবে ততদিন প্রত্যেক দেশের জনগণ নিজ দেশের সাথেই রোযা ও ঈদ করবেন। স্বদেশবাসী থেকে আলাদা হওয়া তাদের জন্য জায়েয নয়।
হযরতের দুরূসে বুখারীর যে সংকলন ‘‘ইনআমুল বারী’’ নামে প্রকাশিত হয়েছে এর পঞ্চম খন্ডে কিতাবুস সওমের হাদীসসমূহের ব্যাখ্যা রয়েছে। সহীহ বুখারীর কিতাবুস সওমের পঞ্চম বাবের দরসে সংশ্লিষ্ট মাসাইলের উপর তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ওখানে সৌদী আরবের রুয়াতে হেলাল (চাঁদ দেখার) বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
سوال يہ ہے كہ كيا كوئى شخص يہاں (باكستان ميں) رہتے ہوئے سعودى عرب كے مطابق عمل كر سكتا ہے؟ اس كا جواب يہ ہے كہ يہاں رہتے ہوئے سعودى عرب كے مطابق عمل كرنا جائز نہيں، اس لئے كہ يہاں پر سعودى عرب كے فيصلے كو ولايت حاصل نہيں، اور جس كو ولايت حاصل ہے اس نے اُس كے مطابق يہاں فيصلہ نہيں كيا، يہاں تو يہاں كى ولايت كے مطابق (عمل) ہوگا.
‘‘প্রশ্ন এই যে, কোনো ব্যক্তি কি এখানে (পাকিস্তানে) থেকে সৌদী আরবের অনুসরণ করতে পারে? জবাব এই যে, এখানে থেকে সৌদী আরবের অনুসরণ করা জায়েয নয়। কারণ এখানে সৌদী আরবের ফয়সালার ‘বিলায়াত’ (ক্ষমতা) নেই। আর যার ক্ষমতা আছে তিনি ঐ অনুযায়ী এখানে ফয়সালা করেননি এখানে তো আমল হবে এখানের ‘‘বিলায়াত’’ অনুসারে।
(ইনআমুল বারী দরসে বুখারী, হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তকী উছমানী ৫/৪৯৭)
অধম প্রবন্ধকার হযরতওয়ালার খিদমতে ২৫ জুমাদাল উখরা ১৪৩৪ হিজরীতে এ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম। হযরত ৮ রমযানুল মুবারক ১৪৩৪ হি. সেগুলোর জবাব লেখেন। এ পত্রে হযরতওয়ালা বলেছেন, যদি ‘‘খবরে মুস্তাফীয’’ (চারদিক থেকে ব্যাপকভাবে আসা সংবাদ)-এর সূত্রে অন্য দেশে রোযা শুরু হওয়ার ইলম হয় তাহলে এর উপর আমল করা এই শর্তের সাথে যুক্ত যে, এর দ্বারা নিজ দেশের ‘‘বিলায়াত’’ (দায়িত্বশীল)-এর বিরোধিতা হবে না।’ আরো বলেছেন, الصوم يوم تصومون ... শীর্ষক হাদীস থেকে জানা যায়, এতে সম্মিলিত রূপ থাকা চাই।
এ চিঠিতে হযরত এ কথার সমর্থন করেছেন যে, রমযানের চাঁদ ও শাওয়ালের চাঁদ দুটোই ‘‘ইস্তিফাযায়ে খবর’’ ও ‘আদমে ইস্তিফাযা’ (সংবাদ ব্যাপকভাবে আসা বা ব্যাপকভাবে না আসা) উভয় অবস্থায় ‘বিলায়াতে’র অধীনে থাকবে।
বর্তমান প্রবন্ধ পুস্তিকা আকারে প্রকাশের সুযোগ হলে এতে হযরতওয়ালার পুরো চিঠি শামিল করার ইচ্ছা থাকল।
১০.অন্যান্য ফিকহ-ফতোয়া বিশারদ
উদয়স্থলের ভিন্নতা অগ্রাহ্যকারী ফকীহ ও আলিমগণের ফতোয়াই যখন এই যে, রোযা ও ঈদে নিজ দেশের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করা বৈধ নয়, তেমনি সমসাময়িক এমন কিছু আলিমের ফতোয়াও যখন এ-ই, যারা সরাসরি রোযা ও ঈদে ঐক্যেরও উৎসাহ দেন তখন ঐ সকল আলিম ও ফকীহের ফতোয়া কী হবে, যারা দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য ধর্তব্যই মনে করেন না। বলাবাহুল্য, তাঁদের ফতোয়াও এ-ই হবে যে, কোনো দেশে বসবাসকারীর জন্য ঐ দেশের সাধারণ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন জায়েয হবে না। বিগত সংখ্যাগুলোতে আমরা এ বিষয়ে যত ফিকহী উদ্ধৃতি পড়েছি সবগুলোর দাবি তা-ই। বিশেষত প্রবন্ধের প্রথম কিস্তিতে উল্লেখিত ‘‘আলমাজমাউল ফিকহিল ইসলামী মক্কা মুকাররমা’’ এবং ‘‘হাইআতু কিবারিল উলামা সৌদী আরব’’-এর সদস্যবৃন্দের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত তো এখানে আবার উল্লেখ করা যায়। আশা করি, পাঠকবৃন্দ তা আরেকবার দেখে নিবেন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত মুসলিম বিশ্বের আরো কয়েকটি ফিকহী বোর্ড ও সেমিনারে গৃহীত হয়েছে। দীর্ঘতার আশঙ্কায় সেগুলোর উল্লেখ থেকে বিরত থাকছি।
আলহামদুলিল্লাহ, মুসলিম জাহানের বিভিন্ন দেশের ফকীহবৃন্দ ও আকাবির আহলে ইলমের ফতোয়া সামনে এসেছে। কিছু বরাত ও আলোচনা পরে আসছে। আর এখানে যতটুকু উল্লেখ করা হয়েছে এর কয়েক গুণ বরাত-উদ্ধৃতি আছে ফিকহের কিতাবসমূহে, হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহে ও ফতোয়া সংকলনগুলোতে। তবে বিষয়ের উপলব্ধি ও উপদেশ গ্রহণের জন্য এটুকুও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি।
সারকথা এই যে, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মাসলাকের উপর নির্ভর করে আমাদের এখানের যে বন্ধুরা রোযা ও ঈদের ঐক্য ফরয বলতে চান আর এ কারণে তারা স্বদেশের উলামা, রাষ্ট্রপরিচালনাকারী দায়িত্বশীল ও সাধারণ জনগণ থেকে আলাদা হয়ে রোযা ও ঈদে আগে-পরে হয়ে যান তাদের এ কর্মপন্থা গোটা মুসলিম জাহানের প্রত্যেক মাযহাবের ফকীহ ও মুফতীগণের সিদ্ধান্ত অনুসারে অশুদ্ধ, ভুল। সুতরাং তাদের কর্তব্য, নিজ দেশের আলিমদের নিন্দার পরিবর্তে নিজ কর্মপন্থা সংশোধন করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে কল্যাণের বিষয়ে অগ্রগামী হওয়ার তাওফীক দিন এবং সকল অকল্যাণ থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
এ প্রবন্ধ এখানেই সমাপ্ত করা যেত কারণ যে প্রেক্ষাপটে তা লেখা হয়েছে, তার জন্য প্রয়োজনীয় আলোচনা হয়ে গেছে। এরপরও মনে হচ্ছে, ঐ সকল প্রবন্ধ ও পুস্তিকার উপরও একটি হালকা পর্যালোচনা হয়ে গেলে ভালো হয়, যেগুলো অনেক দিন ধরে অধমের কাছে পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে রাখা আছে। আগামী আলোচনার অধিকাংশই এ নিয়ে হবে ইনশাআল্লাহ।
وبالله التوفيق، ولا حول ولا قوة إلا بالله، عليه توكلت وإليه أنيب.
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
টীকা :
টীকা : ১.
قال الراقم : ولا يغرن أحدا ما وقع في البحر ورد المحتار من أن هلال رمضان لا يدخل تحت الحكم، فإن عدم دخول شيء تحت الحكم أو القضاء من حيث الاصطلاح لا يلزم منه أن لا يكون ذلك الشيء من فرائض الحاكم والقاضي، فهلال رمضان وإن كان مما لا يدخل تحت الحكم فهو وهلال شوال لا ريب في كون الحكم بثبوتهما من فرائض الولاة أو نوابهم من القضاة والحكام، وهذا أمر معلوم من التاريخ ضرورة. وتأمل كم من مسألة في البحر ورد المحتار بنيت على أن أمر الهلال، هلال رمضان كان أو هلال شوال، إلى الخليفة أو نائبه من وال أو قاض.
ولأجل تلك العبارات المبهمة والموهمة في بعض كتبنا وبعض كتب المذاهب الأخرى اشتبه الأمر على بعض المصنفين، فوقعوا في تخليط في هذا الباب، كما تراه عند بخيت المطيعي، ومحمد بن عبد الرزاق المَرَّاكُشِي، وأحمد الغُماري وغيرهم، فلا تغتر بكلامهم وتذكر ما قاله العلامة السيد يوسف البنوري رحمه الله تعالى في معارف السنن ٥⁄٣٥٧ في باب ما جاء أن الفطر يوم تفطرون والأضحى يوم تضحون، تحت قول الإمام الترمذي : وفسر بعض أهل العلم هذا الحديث، فقال : إنما معنى هذا الصوم والفطر مع الجماعة وعُظْم الناس.
قال البنوري رحمه الله تعالى : ومن هنا أدار الفقهاء حكم ثبوت الهلال على قضاء القاضي، ثم ما يذكر في كتب الفقه من أن القضاء لا ينفذ إلا في المعاملات ولا مدخل له في العبادات، فقال الشيخ الإمام (أنور شاه الكشميري) : ليس هذا مطردا عاما، فإنا نجد لقضاء القاضي مدخلا في العبادات، ألا ترى أن إقامة الحج والأعياد وصلاة الكسوف مفوضة إلى الإمام والحاكم، ...، وكذلك الصيام يحتاج ثبوتها إلى حكم القاضي على الشهادة أو الإخبار عند الغيم، فإن رد القاضي الشهادة لا يكون قوله حجة.