সেই পায়ের একটুখানি ধূলোর জন্য-২
মাগরিবের আযান হতে তখন খুব সামান্যই বাকি। যানজটের শহরে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মাগরিবের ঠিক পূর্বমুহূর্তে পৌঁছতে পেরে মনে হলো হুযূর খুব স্বস্তি বোধ করছেন। বললেনও, ‘আল্লাহর শোকর, ঠিক সময়ে পৌঁছতে পেরেছি। আসলে মাওলা সাহায্য করেছেন। না হলে সম্ভব ছিলো না।’
এখানেই পার্থক্য। কেউ ভাবে, মাওলা সাহায্য করেছেন; কেউ বলে, রাস্তাটা ফাঁকা ছিলো। একটা হলো অন্তর্দৃষ্টি, একটা শুধু চোখের দৃষ্টি।
আযান শুরু হয়ে গেলো, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার- আল্লাহ সবার বড়! আমাদের সবার কানেই ধ্বনিত হলো আযানের ধ্বনি। মুআয্যিনের কণ্ঠে আমরা সবাই শুনলাম আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা। আমরা শুনলাম, আর হুযূর যেন অন্তরে তা ধারণ করলেন। চেহারা দেখে মনে হয়, ভিতরে সেই বড়ত্বের কম্পন শুরু হয়েছে। এমনভাবে জওয়াব দিচ্ছেন আযানের প্রতিটি কালিমার, যেন বাইরের ধ্বনি ভিতরে গিয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। আমরাও আযানের জওয়াব দিলাম। পার্থক্য এই যে, আমরা উচ্চারণ করেছি, আর তিনি সত্যায়ন করেছেন। মনে মনে প্রার্থনা করলাম, হে আল্লাহ, যা দেখলাম, শুনলাম, তা যেন শিখতে পারি।
অনেক দিন সুযোগ হয়নি, আজ হলো, হুযূরকে আযানের দু‘আ পড়তে শুনলাম। যখনই শুনেছি রোমাঞ্চিত হয়েছি, আজো রোমাঞ্চিত হলাম। দু‘আ শেষ করে হুযূর বললেন, বান্দা যখন ইহতিমামের সঙ্গে আযান শোনে, জওয়াব দেয়, আর হুযূরে কলবের সঙ্গে আযানের দু‘আ পড়ে। তারপর নামাযে দাঁড়ায় সেটা হয় আল্লাহর মা‘ইয়্যাতওয়ালা[1] নামায। আযানের প্রতি গাফলাতের নামাযে সেই রূহ ও রূহানিয়াত কীভাবে আসবে?!
কথাগুলো হুযূর বললেন, আযানের সময় আমাদের কিছু হালাত দেখে।
হুযূরের পাশে দাঁড়িয়ে মাগরিব পড়লাম। আল্লাহর শোকর, অনেক দিন পর আজ কিছুটা খুশু-খুযূ’-এর হালাত পয়দা হলো।
***
মজলিস শুরু হয়েছে আছর থেকে। মাগরিবের পর হুযূরের বয়ান হবে। তারপর আওয়াল ওয়াক্তে এশা এবং ভালুকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা, এই ছিলো তারতীব। কিন্তু হঠাৎ তারতীবে নড়চড় হলো। হওয়া উচিত ছিলো না, তবু হলো। ভালো ভালো মানুষ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন। কেন করেন, তারাই ভালো জানেন। বাইতুস্-সালামের মুহতামিম ছাহেব, হুযূরের প্রিয় ছাত্র, তিনি পেরেশান হলেন, হয়ত তখন তাঁরও কিছু করার ছিলো না। ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি আমারও পেরেশানির কারণ ছিলো, তবু নীরব থাকাই ভালো মনে হলো। আল্লাহর যা ইচ্ছা তাই তো হবে!
এবং আল্লাহর ইচ্ছা, হুযূর যখন মাহফিলে যাবেন, আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। হুযূর পেরেশান হয়ে দু‘আ করলেন এবং বিশ্রাম করার কথা বলে মসজিদে গেলেন। ছেলে আমার কাছে থাকতে চাইলো। আমি বললাম, হুযূরের ছোহবতে থাকো। আমি ইনশাআল্লাহ একটু বিশ্রাম নিতে পারলে সুস্থ হয়ে যাবো।
কে একজন দয়া করে বাতিটা নিভিয়ে দিলেন। কিছুটা ভালো লাগলো। চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকলাম। মনে হলো, সবকিছু দুলছে। ইয়া আল্লাহ, তুমি আসান করো।
একসময় চোখটা লেগে এলো, আর আমি স্বপ্নের জগতে চলে গেলাম। দেখি, আলোঝলমল এক মাহফিল! বহু দূর পর্যন্ত শামিয়ানা টানানো। লোকে লোকারণ্য। তেলাওয়াতের সুমধুর আওয়ায ভেসে আসছে। তারপর বয়ান শুরু হলো এবং তা হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর বয়ান! দূর থেকে তাঁর নূরানি চেহারা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তিনি তো যুবক ছিলেন না, বৃদ্ধ ছিলেন! আর তিনি তো দুনিয়াতে নেই, ইন্তিকাল করেছেন। দিলে কেমন এক ঢেউ উঠলো, আমাদের হযরত যুবক হয়ে দুনিয়াতে ফিরে এসেছেন! কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সম্ভব হলো না।
হযরত তাওবার কথা বলছেন, আর মানুষ জারজার কাঁদছে। আমি কাঁদতে চেষ্টা করছি, কিন্তু কান্না আসছে না। খুব আফসোস হচ্ছে, মানুষ এমন করে কাঁদছে, আমার কেন কান্না আসছে না! এর মধ্যে চোখটা খুলে গেলো। কানে তখনো যেন অনেক দূর থেকে কান্নার আওয়ায আসছে।
আসলে দরজার বাইরে আওয়ায হচ্ছে। সবাই হুযূরকে নিয়ে আসছে। উঠে বসলাম। বেশ সুস্থ মনে হলো। কে জানে, বিশ্রামের ফল, না খাবের বরকত! দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। মাশাআল্লাহ! হুযূর তো গিয়েছেন দস্তারবন্দির মাহফিলে তালিবানে ইলমকে পাগড়ি পরাতে। হুযূরের মাথায়ও দেখি পাগড়ি! নতুন পাগড়িতে হুযূরকে তখন কেমন মনে হচ্ছিলো তা শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। যে শব্দটা মনে এসেছে এবং কলমের মুখে আসতে চাচ্ছে তা হয়ত শায়ানেশান হবে না। আচ্ছা, জ্যোতির্ময় শব্দটা বলা যায়। অপলক দৃষ্টিতে আমি শুধু তাকিয়েই থাকলাম আমার প্রিয় হযরতের জ্যোতির্ময় মুখমন্ডলের দিকে! হুযূর যেদিন তাঁর উস্তাযের হাতে দস্তারে ফযীলত ধারণ করেছিলেন, কেমন দেখা গিয়েছিলো তাঁকে তখন! পাগড়ি একটুকরো কাপড় ছাড়া আর কী! কিন্তু কোন পবিত্র হাত যখন তালিবে ইলমের মাথায় তা পরিয়ে দেয় তখন এ ‘বস্ত্রখন্ড’ই হয়ে যায় ইলমের তাজ ও ফযীলতের দস্তার! হুযূরের মাথায় আজ কে তুলে দিয়েছে এই দস্তার! স্বপ্নের সেই নূরানি মাহফিল এবং হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর বয়ান, তার সঙ্গে কি এর কোন সংযোগ আছে! হয়ত আছে, হয়ত নেই। গায়বের কতটুকু আমরা জানি! খাবের হাকীকত কতটুকু বুঝি!
হুযূর কামরায় এসে বসলেন। মাহফিলে যাওয়ার আগের ক্লান্তিটা এখন নেই; এখন বেশ সজীব সতেজ। আমার অবস্থা জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম, এখন বেশ সুস্থ বোধ করছি। আপনাকেও খুব সজীব মনে হচ্ছে।
হুযূর কেমন যেন লাজুক হেসে বললেন, ‘দেখেন না, আমারে পাগড়ি পরায়া দিছে! বলছে, আমিও নাকি তালিবে ইলম, আমারও পাগড়ি পরতে হবে, আল্লাহ যেন ওদের কথা কবুল করেন।’
আমার মনের সেই অনুভূতিটা এবং সেই শব্দটা সাহস করে বললাম। হুযূর মৃদু হেসে বললেন, জাযাকাল্লাহ!
তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কি জানা আছে, বাইতুস্-সালাম মাদরাসা যে হযরত (হাফেজ্জী হুযূর রহ.) ইফতেতাহ করেছেন?
বললাম, জ্বি, আপনার কাছেই শুনেছি। প্রথম যেদিন আপনার সঙ্গে এসেছিলাম, সেদিনও বলেছিলেন।
হুযূর বললেন, আমাকে এখানে হযরত এনেছিলেন, আর আপনাকে এনেছি আমি গোনাহগার! এই মাদরাসাটাকে খুব মুহববত কইরেন। এই মাদরাসাটা হলো হযরতের ইয়াদগার[2]।
***
সেদিনটির কথা আজো স্পষ্ট মনে আছে; চিরকাল মনে থাকবে। হুযূর আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য, এখানে যেন মাদানী নেছাবের দরস শুরু হয়।
এ অধম ছাত্রের প্রতি হুযূরের কেমন মায়া-মুহববত এবং স্নেহ-শফকত, আল্লাহর শোকর, তার সকৃতজ্ঞ অনুভূতি আমার আছে; তবে সেদিন আল্লাহ আমাকে দেখিয়েছেন হুযূরের মায়া-মুহববত ও স্নেহ-শফকতের অন্য এক অপার্থিব রূপ। দেখেছি আর নিজের অপদার্থতার কথা ভেবে লজ্জিত হয়েছি। আল্লাহর শোকর আদায় করেছি, আর দু‘আ করেছি, হে আল্লাহ, অধম ছাত্রের প্রতি তাঁর ‘হুসনে যান’কে[3] তুমি কবুল করো, আর তাঁকে তোমার শান মুতাবেক জাযা দান করো।
এখানকার যারা পরিচালক, হুযূর তাদের কতভাবে বুঝালেন, তারগীব দিলেন মাদানী নেছাব শুরু করার জন্য! পারলে যেন তাদের সামনে নিজের দিল-কলিজা খুলে রেখে দেন! হুযুর যতই বোঝান, ‘কমিটি’র দ্বিধা যেন দূর হয় না। শেষ পর্যন্ত হুযূর নিজের চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলেন না; বললেন, এখন তো আমি আব্দার করছি, ইনশাআল্লাহ একসময় আসবে যখন ....!
আমার হযরতকে আল্লাহ শায়ানে শান জাযা দান করুন। তাঁরই বরকতে মাদরাসাতুল মাদীনাহর পর এখানেই প্রথম মাদানী নেছাব শুরু হয়, তারপর আনওয়ারুল উলূম, তারপর আরো অনেক মাদরাসায়। আল্লাহ আমাদের ছহীহ নাহ্জের উপর দায়েম কায়েম রাখুন।[4]
আমার নিজের তো কোন যোগ্যতা ও ছালাহিয়াত নেই, আল্লাহ যেন হুযূরের চোখের পানির লাজ রক্ষা করেন, আমীন।
***
ছেলের হাতে দেখি, সম্ভবত কিতাবের একটি সুন্দর প্যাকেট। বললো, তোমাকে হাদিয়া দিয়েছে, তুমি ছিলে না, তাই হুযূর তোমার পক্ষ হতে আমাকে গ্রহণ করতে বলেছেন।
প্যাকেটের উপরে লেখাটা দেখলাম, ভালো লাগলো। সুন্দর অভিব্যক্তি। বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগিতায় যারা জয়ী হয়েছে তাদের কিতাব পুরস্কার দেয়া হয়েছে। আমি তো প্রতিযোগিতায় ছিলাম না, আর বুড়ো বয়সে তরুণদের সঙ্গে পেরে ওঠাও কঠিন। তবু পুরস্কার পেলাম! কিছুক্ষণের জন্য দূর অতীতে তারুণ্যের দিনগুলোতে ফিরে গেলাম। অস্পষ্ট মনে পড়ে, আমিও কোন কোন প্রতিযোগিতায় কিতাব-কলম পুরস্কার পেয়েছি। প্রাপ্তির আনন্দের কথা যেমন মনে আছে, তেমনি মনে আছে পুরস্কার না পাওয়ার বেদনার কথা। আমার জীবনের দূর অতীতের সেই আনন্দ-বেদনার যুগপৎ দৃশ্য একটু পরে একেবারে পূর্ণ ‘বর্তমান’রূপে নিজের চোখে দেখতে পেলাম।
অযু করতে যাচ্ছি; দেখি, ছোট্ট একটি ছেলের হাতে পুরস্কারের কিতাব। মাসুম বাচ্চার কী মাসুম চেহারা! ভিতরের আনন্দ যেন চেহারায় উপচে পড়ে! মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, পুরস্কার পেয়েছো? এতটুকুতেই যেন ধন্য! উচ্ছ্বসিত হয়ে ‘জ্বি’ বললো, আর কিতাবটা এগিয়ে দিলো। পাশে একই বয়সের একটি ছেলে। মুখটা ভার, কারণটাও পরিষ্কার। দু’টি ছেলে যেন আমারই জীবনের দূর অতীতের দু’টি রূপ।
প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের এই একটা মন্দ দিক। একজনের মুখে হাসি ফোটে অনেক মনের কষ্টের বিনিময়ে। অথচ যারা পুরস্কার পায় নি তাদেরও মধ্যে আছে কোন না কোন সুপ্ত প্রতিভা! শুধু শুধু মনটা ছোট হয়ে যায়!
ওরও মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, আর বললাম, পুরস্কার পাওনি তাতে কী! মেহনত করো, ইনশাআল্লাহ তোমরা সবাই বড় আলিম হবে।
একথায় সামান্য হলেও তার মুখে হাসির উদ্ভাস দেখা দিলো। আবার বললাম, মানুষের কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়া কঠিন। কেউ পায়, কেউ পায় না। কিন্তু আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়া খুব সহজ, আর যে চায় সেই পায়। তুমি নামায পড়ে যখন মুনাজাত করবে, তখন আল্লাহর কাছে খুব দিল দিয়ে চাইবে, হে আল্লাহ, আমাকে ইলম দান করো, আমল দান করো, আর সারা জীবন আমাকে সাহায্য করো, তখন আল্লাহ খুশী হয়ে তোমার দু‘আ কবুল করবেন।
সুবহানাল্লাহ! কত ছোট্ট ছেলে, অথচ কী উদ্ভাসিত মুখে কত বুদ্ধিদীপ্ত কথা বললো, ‘আপনি যে আমার সঙ্গে কথা বললেন, এটা তো আল্লাহর পক্ষ হতে পুরস্কার!’
বাচ্চা ছেলেটির কথায় দিলটা ঠান্ডা হয়ে গেলো। আসলে আমি তাকে কিছু দিতে পারিনি, আমাকেই সে অনেক বড় সম্পদ দান করলো। হে আল্লাহ, আমাদের সকল অযোগ্যতা, সকল অযত্ন-অবহেলা সত্ত্বেও এই সব ফুলের কলি যেন জীবনের উদ্যানে পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়, তুমি সে তাওফীক দান করো, আমীন।
***
আমি তো অসুস্থতার কারণে মসজিদে যেতে পারিনি, তাই হুযূরের বয়ানও শোনার তাওফীক হয়নি। মুহতামিম ছাহেবের মাধ্যমে বয়ানের মযমূন সম্পর্কে অবহিত হলাম। খুব সাদামাটা কথা, কিন্তু অন্তরের গভীরে রেখাপাত করে। দিলের এখলাছে মুখের সাধারণ কথাও অসাধারণ হয় এবং তা শ্রোতার দিলের জাহান আবাদ করে, শাদাব[5] করে।
বয়ানে হুযূর বলেছেন, ‘আগে যখন এখানে আসতাম, হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. আমাকে সঙ্গে আনতেন। তখন জোয়ানি ছিলো, এখন বুড়ো হয়ে গেছি। বার্ধক্য এখন কাবু করে ফেলেছে ...’
আসলে আমার হুযূর এভাবে জোয়ানদের সতর্ক করেন, সবাই যেন জোয়ানিকে গনীমত মনে করে কাজে লাগায়। কারণ জোয়ানি দু’দিনের, দেখতে দেখতে চলে যায়, বার্ধক্য এসে পড়ে। তারপর আসে মউত। মানুষ গাফলতের মধ্যে পড়ে থাকে, আর মউত এসে থাবা দেয়।
হুযূর এখন তাঁর প্রায় বয়ানেই এভাবে নছীহত করেন। আমাদের কর্তব্য দিলের কান দিয়ে শোনা এবং কবুল করা।
বয়ানের মাঝখানে আযান শুরু হলো। হুযূর বয়ান স্থগিত করে আযানের জওয়াব দিলেন, আযানের দু‘আ পড়লেন। তারপর বললেন, ‘যখন আযান হয় তখন মুস্তাহাব হলো প্রথমে আযানের জওয়াব দেয়া, তারপর আযানের দু‘আ পড়া। আলহামদু লিল্লাহ, আযানের জওয়াব দেয়া হয়েছে; দু‘আও পড়া হয়েছে। তোমরা তালিবে ইলমরা জওয়াব দিয়েছো? দু‘আ পড়েছো? না হলে এখন করে নাও।
আযান যে শোনে তার প্রথম কাজ হলো আযানের প্রতিটি কালিমার জওয়াব দেয়া। দ্বিতীয় কাজ হলো, আযানের শেষে দুরূদ পড়া, তৃতীয় কাজ হলো আযানের দু‘আ পড়া। আল্লাহর পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে এই তিন কাজ করবে-وجبت له شفاعتي (তার জন্য আমার শা‘ফা‘আত ওয়াজিব হয়ে যাবে।)
এখানে যারা উস্তায তারা তো তাঁর ছাত্র এবং ছাত্রের ছাত্র। তিনি অত্যন্ত দরদের সঙ্গে তাদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘দরসের মধ্যে যখন আযানের আওয়ায কানে আসবে তখন দরস বন্ধ; আর সবক চলবে না।
ওস্তায নিজে যখন ইহতিমামের সঙ্গে আযানের জওয়াব দেবে তখন তার আমল থেকে তালিবে ইলমও সেটা শিখবে।’
এটাও হুযূরের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি নছীহত যা তিনি সবসময় করে থাকেন যে, শিক্ষকের কাজ শুধু কিতাব পড়িয়ে দেয়া, আর সবক বুঝিয়ে দেয়া নয়। যিনি শিক্ষক তিনি তালিবে ইলমের সারা জীবনের সমস্ত কাজের শিক্ষক। শিক্ষকের ঘুম ছাত্রের ঘুমের জন্য শিক্ষক; শিক্ষকের খানাপিনা ছাত্রের খানাপিনার জন্য শিক্ষক। শিক্ষকের পড়া ও মুতালা‘আ ছাত্রের পড়া ও মুতালা‘আর জন্য শিক্ষক, শিক্ষকের মু‘আমালা-মুআশারা ও আচার-আচরণ ছাত্রের মুআমালা-মুআশারা ও আচার-আচরণের জন্য শিক্ষক। মোটকথা, শিক্ষকের প্রতিটি আমল ছাত্রের ঐ আমলের জন্য শিক্ষক। আমার আমল দেখে আমার ছাত্র নিজের জীবনে তা শিখবে। সে যদি দেখে, আমি ইহতিমামের সঙ্গে আযানের জওয়াব দিচ্ছি, মেসওয়াক করছি, ইত্যাদি তখন তার মধ্যে ঐ আমলের অভ্যাস এসে যাবে।
সুবহানাল্লাহ, কত মূল্যবান নছীহত! আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম আমাকে, তারপর আমার সমস্ত তালেবানে ইলম ভাইকে এই নছীহতের উপর আমল করার তাওফীক দান করুন; আমীন।
***
এশার নামায হলো। দস্তরখান বিছানো হলো। বেশ লম্বা দস্তরখান এবং যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তাতে গরম গরম রুটি ছিলো, চিকন, সুগন্ধি চালের ভাত ছিলো; ধোঁয়া ওঠা গোশত ছিলো; মাছ ছিলো, সবজী ছিলো; দই ছিলো, দুধ ছিলো এবং ... থাক; তালিকার শেষ মাথায় যেতে সময় লাগবে।
খাওয়া শুরু হলো। যেহেতু পদে বৈচিত্র্য ছিলো, আর পরিমাণে প্রাচুর্য ছিলো সেহেতু যার যেদিক থেকে পছন্দ তিনি সেদিক থেকে শুরু করলেন। মেযবানের এ অভিযোগ করার সুযোগ ছিলো না যে, কোন মেহমান দস্তরখানের পূর্ণ আয়তনের প্রতি মনযোগী ছিলেন না। এমনকি যিনি দুধ নিলেন তিনি দধিও বাদ দিলেন না। যিনি রুটি খেলেন, তিনি ‘চালটা মনে হচ্ছে বাশমতি’ বলে তিন চামচ ভাতও নিলেন।
যে জিনিসটা প্রায় সবখানে দেখি, এখানেও দেখলাম। আর কখনো লিখিনি; আজ ইচ্ছে হচ্ছে লেখার, হয়ত কারো উপকারে আসবে। দস্তরখানে কেউ যদি কারো অপেক্ষা না করে, বরং যে যার মত খাবার নিয়ে খাওয়া শুরু করে, আমার মনে হয় সেটা রুচি ও আদবের খেলাফ। একটু অপেক্ষা করা উচিত, যাতে সবাই খাবার নিতে পারে এবং একসঙ্গে খানা শুরু হতে পারে। বিশেষ করে মুরুবিবর আগে খানা শুরু করা তো কিছুতেই শোভন নয়। সবচে’ ভালো হয়, সবাই খাবার নেয়ার পর মুরুবিব, বা মেযবান যদি বিসমিল্লাহ বলে শুরু করিয়ে দেন। এটা না হলে বিশৃঙ্খলা হয় এবং
দস্তরখানে একটা ‘আজনাবিয়াত’ এসে যায়। একদস্তরখানের যে বরকত ও নূরানিয়াত তা ফৌত হয়ে যায়।
দস্তরখান শুধু খাওয়ার জন্য নয়, কিছু শেখারও জন্য। দুধ খাওয়া এবং ডাল খাওয়াটাও শেখার বিষয়। মাদরাসাতুল মাদীনার দস্তরখানে কৌশলটা ছেলেদের শেখাতে চেষ্টা করি যে, কীভাবে নিঃশব্দে ডাল খেতে হয়।
দস্তরখানে কারো হাঁচি আসে; আসতেই পারে। তবে সতর্ক থাকা উচিত, যাতে অন্যের বিরক্তি বা কষ্টের কারণ না হয়। পরিবেশটা আরো ভারি হয়ে যায় যখন হাঁচির পরে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ না থাকে। হাঁচির পুরো সুন্নতটি আদায় হলে দস্তরখানের পরিবেশটা আগের মত সুন্দর হয়ে যায়।
আমার ক্ষুধা ছিলো, ইচ্ছেও ছিলো, কিন্তু অসুস্থতার কারণে সতর্কতার প্রয়োজন ছিলো। তাই সামান্য খেলাম। মনে হলো, আমার সামান্যতার কারণে ছেলেটা ভালো করে খেতে পারলো না। সে অবশ্য মানতে রাজী নয়, বলে, এমনিতেই কম খেয়েছে। খাওয়ার তেমন ইচ্ছে ছিলো না। হতে পারে। একটু দই নিতে বললাম, তাও না। দস্তরখানে চক্ষুলজ্জাটা দেখছি ভবিষ্যতে ওকে যথেষ্ট ভোগাবে!
দস্তরখানে হুযূরের কাছে বসার সুযোগ হলো না। কারণ আল্লাহর এক বান্দা হুযূরের ছোহবত ও সান্নিধ্য লাভের আশায় আগেই বসে পড়েছেন। আমাকে দেখে অবশ্য তিনি উঠে আসতে চাইলেন। দিলাম না। যিনি আগে বসেছেন, আমার জন্য উঠে আসবেন এটা ঠিক নয়!
খাওয়াটা হুযূরের জন্য এখন কত কষ্টের, অনেক দিন পর আবার দেখলাম। দেখে কষ্ট হলো।
***
দস্তরখান থেকে ফারেগ হতে হতে সাড়ে নয়টা হয়ে গেলো। মনটা আমার বেশ দমে গেলো। ভালুকা এখান থেকে অন্তত ষাট পঁয়ষট্টি কিলোমিটার। এত রাতে খোলা মাঠে হুযূরকে কীভাবে নিয়ে যাই! আবার ফিরতেও তো হবে! খাওয়ার পর হুযূরের যে স্বাস্থ্যগত অবস্থা দেখছি তাতে তো মনে হয় এখন এত দূর নিয়ে যাওয়াটা যুলুম হয়ে যাবে। কিন্তু এমন সুযোগ আর কবে আসবে!
অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর আরয করলাম, হুযূর, মনে হয় এখন বাসায় ফিরে যাওয়াই আপনার জন্য আরামের হবে। ভালুকার জন্য দু‘আ এখান থেকে করলেই হবে, আর দিলের দু‘আ তো সবসময় রয়েছেই।
হুযূর বললেন, এর চেয়ে ভালো মওকা আর কবে পাবো! চলেন, যাই। আপনি ঠিক আছেন তো! আপনার কষ্ট হলে না হয়, থাক।
সুবহানাল্লাহ! বাবার স্নেহ আর উস্তাযের শফকত যখন একত্র হয়, এমনই হয়! এই মানুষটি ভাবছেন আমার কষ্টের কথা!
বললাম, হুযূর, তখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, এখন আলহামদু লিল্লাহ পূর্ণ সুস্থ আছি। তবে অনেক রাত হয়ে যাবে তো, আপনার খুব কষ্ট হবে।
এর উত্তরে তিনি যা বললেন, আমার জন্য তা সারা জীবনের সম্পদ হয়ে থাকলো, বললেন, ‘আপনি সঙ্গে আছেন, সারা রাত হলেও কষ্ট নাই।’
বাইতুস্-সালামের মুহতামিম ছাহেব বললেন, ‘বড় গাড়ীটায় একজনের জায়গা আছে, আমার দিল চায় সঙ্গে যেতে।’
এমন ভালো মানুষের সঙ্গ অস্বীকার করি কীভাবে?! বললাম, চলো, তোমার বরকতও নিয়ে নিই।
এরপর শুনি, কয়েকজন শিক্ষক এরই মধ্যে নিজেদের উদ্যোগে গাড়ী ঠিক করে ফেলেছেন, তাদেরও আরযূ, হুযুরের সঙ্গে যাবেন। যখন দেখি বাধা দেয়ার সুযোগ নেই, তখন বললাম, শর্ত এই যে, রাহাখরচ আমার। তারা বললেন, বড় মধুর শর্ত, কবুল!
সাড়ে নয়টার পরে বিসমিল্লাহ বলে রওয়ানা হলাম। রাস্তা মোটামুটি যানজটমুক্ত। গাড়ী তার নিজস্ব গতিতেই চলছে। ভাই হানিফ দুপুর থেকেই গাড়ীতে আছেন, কিন্তু তাকে ক্লান্ত মনে হলো না। আসলে ক্লান্তি প্রথমে শরীরে আসে না, আসে ভিতরে। ভিতরের সজীবতা শরীরকেও সজীব করে রাখে।
কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি অদ্ভুত অবস্থা। ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথ যাকে বলে একেবারে ফাঁকা, কিন্তু ঢাকামুখী পথে গাড়ীর দীর্ঘ লাইন। তখন মনে পড়লো সফরের শুরুতে ভাই হানিফের সেই কথাটি, আশুলিয়া হয়ে আসলে সমস্যা হতে পারে। এবং সমস্যা হয়েছিলো। হুযূরের গাড়ীর চালক, ‘বুদ্ধি করে’ মুহম্মদপুর দিয়ে না এসে আশুলিয়া হয়ে এসেছে এবং র্যাব-পুলিশের তল্লাশীতে পড়েছেন। তাই বাইতুস্-সালাম পৌঁছতে তাদের প্রায় এশা হয়েছিলো।
আগামী পরশু ১২ই মার্চ বিএনপির নেতৃত্বাধীন আঠারো দলীয় জোটের মহাসমাবেশ ঠেকানোর মহৎ উদ্দেশ্যে ঢাকা শহরের সবক’টি প্রবেশপথে চলছে কড়া তল্লাশি। এ এক আশ্চর্য গণতন্ত্র! পর দিন রোববার পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিলো, ‘সরকার নিজেই ঢাকা অবরোধ করেছে’। নৌপথেও লঞ্চ-স্টীমার চলছে না, এমনকি বুড়ীগঙ্গায় নৌকাপারাপারও বন্ধ। আওয়ামী লীগের বড় কৃতিত্ব হলো, ‘বউ হোক বা শাশুড়ী’, জিত হবে তারই।
তা যাক, আমি ভাবছি, ফেরার পথে কী হবে। তল্লাশির নামে যদি আটকা পড়ি, হুযূরের কী কষ্ট হবে? আল্লাহ, তুমি হিফাযত করো।
***
বাইতুস্-সালাম থেকে প্রধান সড়কে এসে উত্তরে কিছু দূর এগুলে চোখে পড়ে ‘হামদর্দ’-এর আলোঝলমল নিয়ন বিজ্ঞাপন। ঢাকা শহরে যখন হামদর্দ-এর বিজ্ঞাপন বা বিক্রয়কেন্দ্র দেখি, মন আমার কেমন করে ওঠে! চিকিৎসার কী সুন্দর, কী মায়াদার নাম, হামদর্দ! কী হতে পারে এর বাংলা প্রতিশব্দ? সহানুভূতি? নাহ, ‘হামদর্দ’ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। অসুস্থতায় মানুষ বড় অসহায় হয়ে পড়ে, চিকিৎসকের কাছে মানুষ তখন কী চায়? একটু মমতা, সহানুভূতি, একটু হামদর্দি! উপমহাদেশের সুবিখ্যাত হাকীম সাঈদ আহমদ হলেন হামদর্দ-এর প্রতিষ্ঠাতা। বড় মানবদরদী মানুষ ছিলেন। আর্তমানবতার সেবায় এমন নিবেদিত মানুষ পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই এসেছেন। দুর্ভাগ্য, সেবার আদর্শ তুলে ধরতে আমাদের শুধু মনে পড়ে অন্য দেশের, অন্য সভ্যতার মানুষের কথা। ভুলে যাই, মুসলিম জাতির মধ্যেও রয়েছে গর্ব করার মত কত ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব। হাকীম সাঈদ আহমদ, সারা জীবনের সাধনা দিয়ে গড়ে তুলেছেন হামদর্দ চিকিৎসাব্যবস্থা। উপমহাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ উপকৃত হয়েছে এর দ্বারা। বড় দুঃখ হয়, আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত এমন মানুষটিকে জীবন দিতে হয়েছে শিয়া-সুন্নী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে। তিনি তো শাহাদতের মর্যাদা লাভ করেছেন, কিন্তু মুসলিম জাতির জন্য তাঁর শাহাদতের ঘটনা হয়ে থাকবে অনেক বড় একটা কলঙ্কতিলক। হামদর্দ পাকিস্তানে এখনো স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহু বছর আগে সম্ভবত করাচীতে। বাংলাদেশে হামদর্দ-এর অবস্থা বড় করুণ। প্রথমে ছিলো যাকে বলে লাওয়ারিছ সম্পত্তি; এখন কিঞ্চিৎ উন্নতি লাভ করে হয়েছে ওয়াকফ সম্পত্তি। ধুকে ধুকে যাহোক এখনো টিকে আছে।
আমি যখন হামদর্দ-এর চিন্তায় মগ্ন তখন হুযূর হঠাৎ বলে উঠলেন, আফনানকে হামদর্দ-এর ছাফী খাওয়ালে ভালো হয়। আমি তো অবাক! ঘটনা এই যে, বেশ কিছুদিন থেকে আমার নাতি আফনান ‘স্কিনডিজিজ’-এ খুব কষ্ট পাচ্ছে। চিকিৎসা করা হয়েছে অনেকভাবে অনেকের কাছ থেকে। ফল তেমন কিছু হয়নি। যতক্ষণ ঔষধ চলে, কিছুটা ভালো থাকে, ঔষধ বন্ধ হলো তো অবস্থা আগের মত। বাইতুস্-সালামে আসার পথে আফনানের জন্য হুযূরের কাছে দু‘আ চেয়েছিলাম। সেটা স্মরণ করেই হুযূরের একথা বলা। কিন্তু ঠিক এ সময়ে! এটা কি, বাংলায় যাকে বলে কাকতালীয়, সেই রকম কিছু, না গায়বের কোন ইশারা!
***
দেখতে দেখতে তুরাগনদীর পোল এসে গেলো। রাতে অবশ্য পানির চেহারাটা দেখা যায় না, তবে বুড়ীগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার চেয়ে খুব একটা যে ভালো নয়, দিনে সেটা ঠিকই বোঝা যায়। ঢাকা শহরকে যে চারটি নদী ঘিরে রেখেছে তার চতুর্থটি হলো বালুনদী। রাজধানী ঢাকার এ ভৌগলিক সৌন্দর্যের কথা প্রথম আমি জেনেছি জেনারেল নিয়াজির বই থেকে। নদীবেষ্টিত ঢাকার সামরিক কৌশলগত অবস্থান তিনি সুন্দর করে তুলে ধরেছেন তাতে।
একসময় তুরাগের পানি এত স্বচ্ছ ছিলো যে, ইজতিমায় এসে লালবাগ মাদরাসার ছাত্রদের সঙ্গে তুরাগে সাঁতার কেটেছি; জাল ফেলে মাছধরা দেখেছি। এখন এই চারনদীর পানি এমনই দূষিত যে, নাকে রুমাল দিতে হয়। শুধু এই চারটি নদী এবং শহরের ভিতরে খাল-নালাগুলো যদি বাঁচিয়ে রাখা যেতো তাহলে ঢাকা হতে পারতো পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত শহর। আসলে প্রকৃতি অকৃপণভাবেই আমাদের দান করেছে, কিন্তু দান গ্রহণ করার এবং ধরে রাখার যোগ্যতাও থাকতে হয়। কিছু দিন আগে এক সড়কদুর্ঘটনায় তুরাগ-নদীতে একটি বাস ডুবে গিয়েছিলো। তাতে বহু যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছিলো। তখন একটি পত্রিকার মন্তব্য ছিলো, ‘কিছু দিন পর হয়ত তুরাগে ‘মানুষ ডুবে মরে’ এ পরিমাণ পানি থাকবে না।’
পোল পার হওয়ার পর বাঁয়ের রাস্তাটি গেছে টঙ্গী ইজতেমার বিশাল ময়দানের দিকে, ১৯৬৪ সাল থেকে যেখানে তাবলিগজামাতের নিয়মিত ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মনে পড়ে, কয়েক বছর আগে, হুযূর তখন যথেষ্ট সুস্থ, বাইতুস্-সালাম থেকে আমরা ক’জন হুযূরের সঙ্গে পায়ে হেঁটে ইজতিমায় এসেছিলাম আখেরি মুনাজাতে শরীক হওয়ার জন্য। কী কারণে যেন নৌকায় তুরাগনদী পার হতে হয়েছিলো। হুযূরের সঙ্গে টঙ্গী ইজতিমায় আসা, সেটাই ছিলো প্রথম এবং শেষ। মূল শামিয়ানার ভিতরে গিয়ে মুনাজাতে শরীক হয়েছিলাম। আশ্চর্য রকমের আত্মিক প্রশান্তি ছিলো সেই মুনাজাতে। জীবনে সে এক স্মরণীয় মুনাজাত। ঘটনাটি হুযূরকে স্মরণ করালাম। তিনি শুধু বললেন, ‘আচ্ছা!’ বোঝা গেলো না, হুযূরের মনে আছে কি না।
***
এখন জয়দেবপুর চৌরাস্তা; উত্তরা থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে। পূর্বদিকে রাস্তাটি গেছে জয়দেবপুরের দিকে। বহু বছর আগে, জয়দেবপুরে বাড়ী, এক সহপাঠীর সঙ্গে এখানে বেড়াতে এসেছিলাম। এটি ছিলো বিখ্যাত ভাওয়াল রাজাদের রাজধানী। রাজবাড়ীটির কথা এখনো মনে পড়ে। যদিও সবকিছুতে কালের ছাপ ছিলো, তবু দেখতে বেশ সুন্দর মনে হয়েছিলো। বহু মানুষ তখন ভাওয়াল রাজার বাড়ী দেখতে আসতো। শুনেছি, এখনো রাজবাড়ীটি আছে এবং গাজীপুর জেলার দফতররূপে ব্যবহৃত হচ্ছে।
চৌরাস্তা থেকে কিছু দূরে রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাস। আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে এই মার্চ মাসেরই ১৯ তারিখে এখানে বাঙ্গালী সৈনিকরা পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছিলো। জেনারেল আরবাব ঢাকা সেনানিবাস থেকে কিছু সৈন্য নিয়ে এসেছিলেন বাঙ্গালী সৈন্যদের অস্ত্র জমা নিতে। অস্ত্র জমা নেয়া তো দূরের কথা, তিনি যে নিরাপদে ফিরে যেতে পেরেছিলেন সেটা ছিলো তার ভাগ্য। সম্ভবত সেই ঘটনারই স্মৃতিরূপে মোড়ের চত্বরে উঁচু বেদির উপর বন্দুকহাতে সৈনিকের ভাস্কর্য তৈরী করা হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব সবারই প্রিয়, সবারই গর্বের বিষয়, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য করে বলতেই হয়, ছবি, মূর্তি, ভাস্কর্য যে নামেই হোক, ইসলাম তা সমর্থন করে না। বছর কয়েক আগে সম্ভবত ঢাকা বিমানবন্দরের প্রবেশপথে ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো, যা আলিমসমাজের প্রবল প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত বাদ দেয়া হয়েছে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তখন বেঁচে ছিলেন। তিনি তাঁর এক লেখায় এটাকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘মাদরাসা-বালকদের কান্ড’ বলে। তাঁর মত লেখকের এমন তরল লেখা পড়ে কষ্ট হয়েছিলো। মাওলানা আব্দুল মালেক ছাহেব এর অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ একটি জবাব লিখেছিলেন খুব মার্জিত ভাষায়, যা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। কোন লেখায় যদি যুক্তি থাকে এবং থাকে সংযম, তাহলে বিবেকবান মানুষ অবশ্যই তার কদর করে। আর যদি সঙ্গে থাকে কিছুটা দরদ, তাহলে মানুষ তা গ্রহণও করে। মাওলানা আব্দুল মালেক ছাহেবের ঐ লেখায় এ তিনগুণেরই সমাবেশ ছিলো। হুমায়ূন আহমেদ আজ বেঁচে নেই। কামনা করি, আল্লাহ তাঁকে মাফ করুন এবং জান্নাত নছীব করুন, আমীন।
উত্তর দিকে রাস্তাটি চলে গেছে গাজীপুর। এটাকে বলা যায় গাজীপুর ও জয়দেবপুরের মিলনস্থল। কবে কীভাবে এ অঞ্চলের নাম হয়েছে জয়দেবপুর, আর বৃহৎ অঞ্চলটির নাম হয়েছে গাজীপুর, আমার জানা নেই। তবে যখনই এখানে আসি, মনে অদ্ভুত এক ভাবের উদয় হয়। এ যেন সংখ্যালঘু হিন্দুসম্প্রদায়ের প্রতি বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম-সমাজের সম্প্রীতি ও সৎপ্রতিবেশিতারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের কী অবস্থা! প্রতিবছর কত শত দাঙ্গা হয় সেখানে এবং কত হাজার অসহায় মুসলিম নর-নারী বলি হয় মা-কালির চরণে! তবু ভারত হলো মহান ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক দেশ, আর বাংলাদেশ হলো সংখ্যালঘুদের জন্য অনিরাপদ ভূমি। মিথ্যাচারেরও কি কোন সীমা থাকতে নেই!
হুযূর তখন অনুচ্চ কণ্ঠে যিকির করছেন। সাহস করে বললাম, হুযূর! একাশীর নির্বাচনের সময় হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. এখানে চৌরাস্তায় একটি পথসভা করেছিলেন কিশোরগঞ্জ-মোমেনশাহী যাওয়ার সময়। সৌভাগ্যক্রমে সেই সফরে আমি হুযূরের সঙ্গে ছিলাম। মরহূম মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেব আমাকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
হুযূর এবারও শুধু বললেন, ‘আচ্ছা!’ বোঝা গেলো, তিনি এখন নীরব থাকতে চাচ্ছেন। হয়ত তাঁর অন্তর্জগতে কোন জোয়ার-তরঙ্গ ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
বলছিলাম, একাশীর নির্বাচনকালে হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.এখানে পথসভায় বক্তব্য রেখেছিলেন। কোন পূর্বঘোষণা ছাড়াই তাতে এমন সমাগম হয়েছিলো যে, বিশ্বাস করাই কঠিন। বক্তব্যের কোন কথা অবশ্য এখন স্মৃতির পাতায় সংরক্ষিত নেই। ইত্তেফাকের মরহূম নাজিমুদ্দীন মোস্তান পুরো সফরেই হযরতের সঙ্গে ছিলেন এবং অত্যন্ত প্রশংসনীয় রিপোর্টিং করেছিলেন। তাঁর সেই বিখ্যাত মন্তব্যটি এখনো মনে পড়ে, ‘আপনারা ঘটনা সৃষ্টি করেন, আমরা আপনাদের পিছনে ছোটবো, নইলে আপনাদের ছুটতে হবে আমাদের পিছনে প্রেসরিলিজ নিয়ে।’
***
আমাদের গাড়ী এখন ফ্লাইওভারের উপরে। নীচে বাম দিকে কিছুটা দূরে পাশাপাশি দু’টি কবর। জানা নেই, কারা ঐ কবরদু’টির বাসিন্দা। তবে কেন জানি আমার মনে হয়, ওরা ছিলো দু’ভাই এবং নেককার! মনে হওয়ার কোন কারণ নেই, তবু মনে হয়। যাওয়া-আসার পথে এই যুগলকবর আমার দৃষ্টি কাড়ে। মনটা কেমন যেন নরম হয়ে ওঠে। দূর থেকে চলন্ত অবস্থায় যিয়ারত করি, ফাতেহা পড়ি। নিজের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। ভাবি, কোথায় হবে আমার কবর!
সম্ভবত প্রথমবার, গাড়ী থামিয়ে কাছে গিয়ে যিয়ারত করেছিলাম। বলতে দ্বিধা হয়, তবু বলি, কিসের যেন সুঘ্রাণ পেয়েছিলাম এবং মনে অন্যরকম একটা পবিত্রতা অনুভব করেছিলাম।
আবারও আমার আশ্চর্য হওয়ার পালা! কবরদু’টি যখন পার হচ্ছি, হঠাৎ হুযূরের কণ্ঠে শুনি-كل نفس ذائقة الموت এমন কোমল-করুণ আওয়ায, মনটা যেন গলে গেলো! ভিতরে আত্মাটা যেন কেঁপে উঠলো। হুযূর বললেন, মনে হলো, নিজেকে সম্বোধন করে বলছেন, ‘মউত কার সামনে কখন হাযির হবে কেউ বলতে পারে না। সবসময় মউতের জন্য তৈয়ার থাকা চাই।’
***
উত্তরা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরত্বে এলাকাটির নাম হলো শালনা। এখানে
রাস্তার বামপাশে ছোট্ট সুন্দর একটি মসজিদ। নাম ‘মাওলানা বাড়ী জামে মসজিদ’। একদিন জুমু‘আ এবং একবার মাগরিব পড়েছি এখানে। ভালো লেগেছে এখানে নামায পড়ে। এ বাড়ীর মাওলানা নিজের জমির উপর মসজিদ করেছেন। বর্তমান মুতাওয়াল্লী হচ্ছেন মাওলানা আবুবকর ছিদ্দীক ছাহেব। ওয়াক্ফের শর্ত অনুযায়ী বংশপরম্পরায় এরাই হবেন মসজিদের মুতাওয়াল্লী।
বহু বছর থেকে আমার মনে একটি চিন্তা, বলতে গেলে সেই ‘ছাত্রজীবন’ থেকে। একটা মসজিদ, একটা মাদরাসা এমন পাওয়া যায় না, যার জমি দান করেছেন কোন ‘মাওলানা’। ফলে সাধারণত মসজিদ-মাদরাসার কমিটি থাকে এমন সব লোকের নিয়ন্ত্রণে যাদের চিন্তা-চেতনা ইলমি মেযাজের সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না। মাদরাসা-কমিটির লোকদের সন্তানেরা মাদরাসায় পড়ে না বলে বামপন্থী লেখক বদরুদ্দীন ওমর যে কটাক্ষ করেছেন, স্বীকার করতেই হবে, তথ্যটি মোটামুটি সত্য।
এমনকি অনেকের অন্তরে দ্বীনী শিক্ষার প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধও থাকে না। তারা কমিটি পরিচালনা করেন নিছক ‘সোশ্যাল ওয়ার্ক’ হিসাবে। মসজিদ-মাদরাসা হলো দ্বীনের দুর্গ, অথচ তিক্ত হলেও বাস্তব সত্য যে, এগুলোর নিয়ন্ত্রণ আহলে ইলমের হাতে নেই। এর বড় কারণ এটাই যে, মসজিদ-মাদরাসা আলিমের নিজের খরিদা ও ওয়াকফ-করা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়; অথচ মদীনায় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদ তৈরী করেছেন নিজের খরিদা জমির উপর, যার মূল্য আদায় করেছেন হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রা.। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দান করা জমির উপর মসজিদ করতে রাজী হননি। বাংলাদেশে অন্তত কিছু মসজিদ-মাদরাসা কি হতে পারে না আলিম-মাওলানাদের খরিদা জমির উপর, যার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে তাদেরই হাতে! শুরু থেকে চেষ্টা করা হলে সহজেই তা সম্ভব ছিলো, বিশেষ করে জাতীয় পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব যাদের তাদের জন্য। আল্লাহর রহমতে শুরু থেকে সে চেষ্টাই করা হচ্ছে মাদরাসাতুল মাদীনাহর মাধ্যমে। হোক সামান্য পরিসরে, আজ পঁচিশ বছর ধরে আমার বাবার বাড়ীর উপর মাদরাসাতুল মাদীনাহ চলছে। ভালুকায় মাদরাসার জন্য যে জমি খরিদ করা হয়েছে, একটু একটু করে সঞ্চয় করা নিজের পয়সায় করা হয়েছে। ইনশাআল্লাহ আমার ওয়াকফ করা জমির উপর মাদরাসা ও মসজিদ হবে, যা আহলে ইলমের মজলিস দ্বারা পরিচালিত হবে। আল্লাহ যদি তাওফীক দান করেন, আমি একটি নমুনা কায়েম করতে চাই, যাতে আমার ছাত্ররা এর উপর চলতে পারে। মাদরাসা, হোক ছোট্ট আকারের, সেটা যেন হয় আহলে ইলমের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত। আমার বাড়ী যেমন আমার, মাদরাসাও যেন হয় ‘আমার’।
এই ছোট্ট জীবনে অনেক তিক্ত বাস্তবতা দেখেছি; তাই আমার আন্তরিক ইচ্ছা, আগামী দিনের মসজিদ-মাদরাসা যেন কমিটি-মুক্ত হয়। আমি আহলে ইলমের অধীনে থাকতে চাই। যুলুম যদি করে আমার ভাই করুক, গায়র-এর হাতে আর লাঞ্ছিত হতে চাই না।[6] অনেক দিনের না বলা কথাগুলো আজ বলা হয়ে গেলো। আল্লাহ খায়র দান করুন, আমীন।
***
এলাকাটির নাম মুনিপুর। যাওয়ার পথে হাতের ডানপাশে সবসময় দেখি একটি বৃদ্ধ-বৃদ্ধাশ্রমের সাইনবোর্ড। নীচে লেখা, ‘অসহায় প্রবীণদের জীবনের শেষ ঠিকানা’। যখনই দেখি বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে, নিজের অজান্তে চোখদু’টো ভিজে ওঠে। ইউরোপ-আমেরিকায় বস্ত্তসভ্যতার দেশগুলোতে বৃদ্ধ মা-বাবা সন্তানের কাছে বোঝা হয়ে পড়েছে বহু আগেই। তাই সেখানে শেষ জীবনে বৃদ্ধ মা-বাবার অনিবার্য ঠিকানা হলো বৃদ্ধাশ্রম। এ কারণে পাশ্চাত্যে বহু ‘আদর্শ’ বৃদ্ধাশ্রম গড়ে ওঠেছে, যেন বুড়োদের শেষ জীবনটা স্বস্তিতে কাটে। দুনিয়ার আরাম-আয়েশ ও বিনোদনের সব ব্যবস্থা সেখানে থাকে।
সন্তান মা-বাবাকে ‘যত্নের সঙ্গে’ আশ্রমে রেখে আসে; ব্যয়ও বহন করে। সন্তান খুব ভালো হলে পর্বে উৎসবে বুড়ো মা-বাবাকে আশ্রমে গিয়ে দেখেও আসে।
আমাদের দেশে তো এ অবস্থা ছিলো না! পরিবারে সবচে’ মর্যাদার, সবচে’ আদর-শ্রদ্ধার মানুষটিই ছিলেন বৃদ্ধ মা-বাবা। তাদের সেবা যত্নকে সন্তান মনে করতো দুনিয়া-আখেরাতের সৌভাগ্য লাভের উৎস। দেখতে দেখতে কী হয়ে গেলো! পাশ্চাত্য সভ্যতার সর্বপ্লাবী ঢল মুসলমানদের সমাজ-সভ্যতার সব মূল্যবোধ যেন কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলো! এখন আমাদের দেশেও গড়ে উঠছে ‘অসহায় প্রবীণদের জীবনের শেষ ঠিকানা’। একদিন ভিতরে গিয়ে খোঁজ নিয়েছি। বুড়োদের সেবাযত্ন ও মনোরঞ্জনের মোটামুটি সবই আছে; নেই শুধু জীবনের শেষ দিনগুলো ঈমান- আমলের সঙ্গে যাপনের ব্যবস্থা।
যত নির্মম হোক, বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। সন্তানের মধ্যে দ্বীনের সমঝ এবং আখেরাতের ভয় যেন আসে সে চেষ্টা যেমন আমাদের করে যেতে হবে, তেমনি অসহায় বৃদ্ধদের আশ্রয় –দানের চিন্তাও আলেমসমাজকেই করতে হবে, যেন শেষ বয়সে তারা ধর্মহীন পরিবেশের শিকার না হয় এবং তাদের আখেরাত বরবাদ না হয়। আল্লাহই উত্তম তাওফীকদাতা।
***
ভালুকা যাওয়ার পথে শ্রীপুরে হলো আমার প্রিয় (মাওলানা) সালমানের কারখানা। মূল সড়ক থেকে বাম দিকে দুই কিলোমিটার ভিতরে। আমার কথা মত সালমান সেখানেই ইনতিযার করছে হুযূরকে ইস্তিকবাল করার জন্য। রাত সাড়ে দশটায় আমরা কারখানায় পৌঁছলাম। হুযূর গাড়ী থেকে নেমে চারদিকে তাকালেন। সামনে বাগান-ঘেরা ছোট্ট মসজিদটি দেখে বললেন, মাশা‘আল্লাহ! তারপর মুহম্মদকে খোঁজ করলেন? কাছেই ছিলো। এগিয়ে পাশে দাঁড়ালো। হুযূর সস্নেহে মাথায় হাত রাখলেন। হাত ধরে মূলভবনের সিঁড়ির দিকে গেলেন। সালমান কাছে এসে সালাম দিলো; মুছাফাহা করলো। হুযূর তারও মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ধীরে ধীরে দোতালায় উঠলেন। একটু বিশ্রাম নিয়ে হাম্মাম থেকে ফারেগ হলেন। তারপর দু‘আ করলেন। সালমানকে একটাদু’টো নছীহত করলেন। সততা ও সত্যবাদিতার সঙ্গে তিজারতের ফযীলতওয়ালা হাদীছটি শুনিয়ে বললেন, বর্তমান যামানায় ঐ রকম তেজারাত করা খুব কঠিন, তবে তার আজর-ছাওয়াবও অনেক। আদীব ছাহেবের মশওয়ারামত যদি চলতে পারো, ইনশাআল্লাহ কামিয়াব হইবা। দু‘আ করি, আল্লাহ যেন তোমাকে কামিয়াব করেন।
হালকা নাশতা ও ফলমূলের ইন্তিযাম ছিলো। হুযূর শুধু চায়ের কাপটা নিলেন। অর্ধেক পান করে সালমানকে দিয়ে বললেন, তুমিও খাও, সবাইকে দেও।
এগারটা বেজে গেছে। হুযূরকে দেখে মনে হলো, একটু বিশ্রাম নিতে পারলে আরাম হতো, কিন্তু নিজেই বললেন, আর দেরী করা যায় না।
এখান থেকে আরেকটি গাড়ীতে করে সালমান, আনিস ও অন্যরা হুযূরের সঙ্গী হলো। আল্লাহ তাদের সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
***
গাড়ী মূল সড়কে উঠে আবার উত্তরমুখী হলো। হুযূর বললেন, সালমানের কারখানা দেখে খুশী হয়েছি। তাকে সবসময় নছীহত করবেন, নামাযের এবং জামাতের ইহতিমাম যেন করে।
ভালুকায় মূল সড়ক থেকে জমির দূরত্ব হলো ঠিক দেড় কিলোমিটার। এককিলোমিটার পাকা রাস্তা, বাকি আধাকিলোমিটার কাঁচা, তবে জমি পর্যন্ত গাড়ী যায়।
কাঁচা রাস্তাটার একটু আগে একটা মসজিদ হচ্ছে। ছাদ হয়ে গেছে। যখন প্রথম আসি তখন মাত্র ভিটি হয়েছে। খালি ভিটিতেই দু’রাকাত নামায পড়ে দু‘আ করেছিলাম। মনে বড় শান্তি হয়েছিলো। এখানে জায়গা নেয়ার জন্য মন আগে বেড়েছিলো। মাওলানা আব্দুল মালেক ছাহেবও এসেছিলেন দ্বিতীয়বার। তাঁরও পছন্দ হয়েছিলো। পরে হুযূরের ইজাযতে জমি খরিদ করা হয়। হুযূরকে হাতের ডান পাশে মসজিদটা দেখালাম। বললেন, ইনশাআল্লাহ বড়ই নেক ফাল[7]।
কাঁচা রাস্তা ধরে গাড়ী জমির পাশে গিয়ে থামলো।
যুবক ছেলে ইবরাহীম, সর্বপ্রথম যার জমি খরিদ করা হয়, পাশেই বাড়ী। খবর পেয়ে দৌড়ে এলো। হুযূরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ছোহায়ল, খুব চৌকশ ছেলে, যার মধ্যস্থতায় জমি খরিদ করা হয়েছে, সেও এসেছে। হুযূর উভয়ের জন্য দু‘আ করলেন। রাতের পরিবেশটা খুব আনন্দদায়ক ছিলো। প্রশান্তিপূর্ণ নীরবতা ছিলো, আর ঝিরঝির বাতাস ছিলো। অল্পক্ষণেই দেহমন জুড়িয়ে গেলো। হুযূর কিছুক্ষণ ধ্যান-মগ্ন হলেন। আমরা তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকলাম, আর মনে মনে রহমত ও কবূলিয়াতের ছুয়াল করলাম। এবার হুযূর একটু এগিয়ে জমিতে পা রাখলেন। গাড়ীর ‘হেড লাইট’-এর আলোতে যদ্দুর সম্ভব জমি দেখলেন। তারপর মুনাজাতের জন্য হাত তুললেন এবং অত্যন্ত মর্মস্পর্শী মুনাজাত করলেন। রাতের নির্জনতায় খোলা আকাশের নীচে হুযূরের সঙ্গে হাত তুলেছি, আর আমীন আমীন বলছি। সারা অন্তর জুড়ে এক অপার্থিব প্রশান্তি। মনে হচ্ছে, এ কণ্ঠস্বর, এ মুনাজাত হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর। তিনিও এমনই মিনতিপূর্ণ মুনাজাত করতেন। যেন মাওলার কাছ থেকে কবুল করিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবেন, তবেই শান্ত হবেন। আমার হুযূর যেন সেই মুনাজাতের ‘মীরাছ’ পেয়েছেন। আমার বাবার মুনাজাতও ছিলো এরকম। আজ বাবা কাছে নেই, তবু মনে হলো, বাবার মুনাজাতটাও যেন পেলাম এই এক মুনাজাতের মধ্যে। হায়, আমীন বলতে বলতে এমন মুনাজাত যদি আমাদেরও জীবনে নছীব হয়ে যায়!
অবশেষে শেষ হলো তাঁর অশ্রুঝরা মুনাজাত। পাশেই ছিলাম, আমার বুকে হাত রাখলেন, মনে মনে কিছু দু‘আ করলেন। তারপর বললেন, চলেন ফিরে যাই।
***
রাত তখন বারটার কাছাকাছি। ঢাকার পথে রওয়ানা হলাম। যাওয়ার সময় হুযূর তেমন কোন কথা বলেননি। আশ্চর্য রকম এক নৈশব্দের মাঝে আত্মসমাহিত ছিলেন। যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন, কিন্তু কাছে থেকে দেখলে বোঝা যায়, ঘুম নয়, এ আত্মনিমগ্নতা। এখন ফেরার পথে কিছু কথা বলছেন, কিছু জিজ্ঞাসা করছেন, আবার সাহস করে কিছু জিজ্ঞাসা করলে সন্তুষ্ট চিত্তে উত্তর দিচ্ছেন।
হযরতপুরে কাজ কতদূর হয়েছে জানতে চাইলেন এবং শুনে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বললেন। আমার ভাই হাছান মিছবাহ-এর খবর নিলেন। তার হজ্বের ইনতিযাম হয়েছে কি না জানতে চাইলেন। বললেন, আমি দিল দিয়ে দু‘আ করি, আপনার সব ভাই যেন আপনার জন্য মযবূত দস্ত-বাযূ হয়ে যায়। আমি বললাম, আমীন।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর বললেন, মুহাম্মদ ঘুমাইতেছো? ছেলে সম্ভবত ‘তন্দ্রামুক্ত’ হয়ে বললো, ‘জ্বি না হুযূর!’
হুযূর তাকে খাছ একটা দরদের আওয়াযে কিছু কথা বললেন। শেষে বললেন; আগেও বলেছেন, আজ আবার বললেন, তোমার জন্য আমি খুব দু‘আ করি। আমরা তো চলে যাবো। এসব কাজ তো তোমাকে করতে হবে। তুমি হইলা আমাদের নায়েব। এখন থেকেই নিজেকে তৈয়ার করতে থাকো।
***
উত্তরা থেকে ভালুকা পর্যন্ত একবারও হুযূর জিজ্ঞাসা করেননি, এটা কোন্ জায়গা? আমি নিজ থেকে একবার বলেছিলাম, ‘হুযূর, এটা হলো শালনা। এই যে মসজিদ, এর নাম মাওলানাবাড়ী জামে মসজিদ।’
কিন্তু হুযূর নীরব ছিলেন। তাই আর কিছু বলার সাহস হয়নি।
ফেরার পথে এই প্রথম জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কোন্ জায়গা? কিছুটা অবাক হয়ে চালক হানীফের শরণাপন্ন হলাম। তিনি নাম বললেন, আমি চমকে উঠলাম। ঠিক এখানে এসে কেন নাম জিজ্ঞাসা করা?! কাকতালীয়! গায়বের ইশারা!!
এখান থেকে একটু ভিতরে (ছিলো) আমার দেশ-সম্পাদক মাহমূদুর-রহমানের সিরামিক কারখানা, যা মেধা দিয়ে, ঘাম দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু কারাগারে গিয়ে ‘আমার দেশ’ বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত তা বিক্রি করতে বাধ্য হলেন। অন্যান্য পত্রিকা করে ‘ব্যবসা’, আর তিনি বিক্রি করেন ‘উপার্জনের পথ’; স্রোতের বিপরীতে চলার এবং সত্য বলার উপযুক্ত মাশুল বটে! কেন জানি একরোখা মানুষটার জন্য মনের ভিতরে ব্যথা জাগে। কখনো দেখিনি, হয়ত কখনো দেখা হবে না, তবু দরদ লাগে। সেই দরদ-ব্যথারই টানে যেন নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, হুযূর মাহমূদুর-রহমানের জন্য দু‘আ করেন। বেচারা বড় মযলূম। হুযূর জিজ্ঞাসা করলেন, মাহমূদুর-রহমান কে? এ প্রশ্ন স্বাভাবিক, তিনি তো অন্য জগতের বাসিন্দা, যেখানে ‘নীতি আছে, রাজনীতি নেই’। ছোট্ট করে তার পরিচয় তুলে ধরলাম। হুযূর মনে হলো খুব দিল দিয়ে দু‘আ করলেন।[8]
***
টঙ্গীর কাছাকাছি এসে হুযূরের হাম্মামের প্রয়োজন হলো। আমাদের চালক ভাই হানিফ একটি ‘ফিলিং স্টেশনে গাড়ী থামালেন। ভদ্রলোকের নামটি জানা হলো না। অত্যন্ত আন্তরিক আচরণ করলেন। হাম্মামে বাতি ছিলো না, ছোটাছুটি করে বাতি লাগিয়ে দিলেন। হুযূরের আরাম হলো। দিল থেকে ভদ্রলোকের জন্য দু‘আ এলো।
গাড়ী আবার রওয়ানা হলো, কিন্তু কিছু দূর গিয়ে থামতে হলো। কারণ আর কিছু না। বিএনপির মহাসমাবেশ প্রতিরোধ করার জন্য সরকার নিজেই রাজধানী ঢাকা অবরোধ করে ফেলেছে। গাড়ীতে গাড়ীতে কঠিন তল্লাশী হচ্ছে। যাত্রীসহ অনেক গাড়ী ফিরিয়ে
দিচ্ছে। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। ভিতরে চরম পেরেশানি শুরু হলো, হুযূরকে নিয়ে যদি বিপদ হয়। হয়ত আবার ফিরে যেতে হবে সালমানের কারখানায়। কিন্তু আলহামদু লিল্লাহ আসলে হুযূরের উপস্থিতিরই বরকতে আমরা অল্পতে পার পেয়ে গেলাম। পুলিশ এলো। তল্লাশী হলো এবং পেয়ে গেলো! কী? না, জর্দার কৌটা। শোরগোল শুনে অফিসার ছুটে এলেন, হুযূরকে একনযর দেখেই বললেন, যান। তিনি বললেন, যান, আমারও ভিতরে ফিরে এলো ‘জান’।
ফোনে জানা গেলো, আল্লাহর রহমতে সালমানদের গাড়ী, বাইতুস্-সালামের শিক্ষকদের গাড়ী এবং হুযূরের গাড়ীও সামান্য ঝামেলার পরই ছাড়া পেয়েছে। অথচ চোখের সামনে দেখতে পেলাম কত যাত্রীসহ কত গাড়ী ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমাদের তো কিছুই করার ছিলো না যদি আটকে দিতো। আল্লাহ যখন সহজ করেন, এভাবেই সহজ হয়ে যায়। আমি যতই পেরেশান ছিলাম, হুযূর ছিলেন একেবারে শান্ত। তিনি শুধু পড়ছিলেন-
اللهم لا سهل إلا ما جعلته سهلا وأنت تجعل الحزن إذا شئت سهلا
হে আল্লাহ, সেটাই সহজ হবে যেটাকে তুমি সহজ করবে। আর তুমি কঠিনকে যখন চাও সহজ করে দাও।
আবার কখনো পড়ছেন-
اللهم واقية كواقية الوليد
হে আল্লাহ, রক্ষা করো; সদ্যপ্রসূত শিশুকে যেমন রক্ষা করো।
***
মহাখালী পার হয়ে অল্পসময়ে গাড়ী পৌঁছে গেলো শাহাবাগ মোড়ে। রাত তখন দেড়টা। প্রায় নির্জন। একজন দু’জন মানুষ; একটা দু’টো গাড়ী। মাঝে মধ্যে আমি শাহাবাগ থেকে ফুল নিই; কখনো নিজে, কখনো কাউকে পাঠিয়ে। ফুলের দোকানগুলো এখন বন্ধ। ফুলের জন্য ‘দোকান’ লিখতে কষ্ট হলো, কিন্তু উপায় কী?! ফুল তো এখন পণ্য! ফুল এখন বাগানে ফোটে কম, জমিতে উৎপন্ন হয় বেশী! তবু ফুল অন্যকিছু নয়, শুধু ফুল! এখনো ফুলের সৌন্দর্য আছে, সুবাস আছে এবং থাকবে চিরকাল।
***
ফেরার পথে হুযূর দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কোন জায়গা? বললাম, শাহাবাগ। প্রশ্নটা শুনে কিছু মনে হয়নি। কারণ শাহাবাগ তখন শুধুই শাহাবাগ ছিলো। কিন্তু আজ দু’বছর পর যখন এ সফরনামা লিখছি তখন কলজে পোড়া গন্ধ নিয়ে লিখতে হচ্ছে, শাহাবাগ এখন অন্য কিছু! শাহাবাগ এখন অনেক কিছু!! শাহাবাগের জন্য প্রাণ কেঁদেছে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। শাহাবাগের জন্য মন কেমন করেছে ভারতের বাঙ্গালী রাষ্ট্রপতির। শাহাবাগের মঞ্চে একাত্ম হয়েছেন একজন ‘অনন্য’ মানুষ, যিনি এখন শুধু ‘অন্য’ মানুষ। দোষ বলি, গুণ বলি; এ জাতির বড় দুর্বলতা, সবকিছু ভুলে যায়, খুব দ্রুত; সময়ের চেয়েও দ্রুত। কিন্তু শাহাবাগ, তুমি কি ভুলে যাবে? মনে থাকবে না তোমার, এখানে কারা ছিলো, কী করেছিলো? এখানে কারা এসেছিলো, কী বলেছিলো? তোমার রবব যদি ‘সেদিন’ জিজ্ঞাসা করেন, বলতে পারবে না সব ঠিক ঠিক?!
***
একটু এগিয়ে ডানে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ, যার পাশে সুন্দর একটি সমাধিতে চিরনিদ্রায় শায়িত আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। শৈশবে কবির সঙ্গে প্রথম পরিচয় ‘ভোর হলো দোর খোলো’ এবং ‘আমি হবো সকাল বেলার পাখী’ দিয়ে। শৈশবে আরো অনেক কবির সঙ্গে প্রথম পরিচয়টি আমার বেশ মনে পড়ে। সেসব স্মৃতি এখনো আমাকে উদ্বেলিত করে। যেমন কবি গোলাম মোস্তফার ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সবশিশুরই অন্তরে’। পল্লী কবি জসীমুদ্দীনের ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুলতুলিতে যাই’, তারপর ‘আসমানিরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও’। উদাহরণ আরো আছে।
নজরুল চেয়েছিলেন তার কবর যেন হয় মসজিদের পাশে। আল্লাহ তার আশা পূর্ণ করেছেন। এমনই হয়, উল্টোটারও নযির আছে এবং আমাদের এই ঢাকা শহরেই।
***
আশরাফাবাদের যখন পোল পার হচ্ছি তখন মনকাঁদানো একটি দৃশ্য দেখতে পেলাম। এখনো মনে হলে মনটা কেঁদে ওঠে। কিন্তু এমন দৃশ্যের তো আর অভাব নেই প্রতি রাতে সারা বাংলাদেশের পথে ফুটপাতে।
হুযূরের বাসার সামনে যখন পৌঁছলাম ঘড়িতে তখন বাজে ঠিক রাত দু’টো। অনেক কষ্ট হয়েছে, এটা তো জানা কথা, কিন্তু হুযূরের চেহারায় ক্লান্তির কোন ছাপ ছিলো না। আলহামদু লিল্লাহ বলে গাড়ী থেকে নামলেন। চাইলাম, তেতালায় কামরা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি, কিন্তু কিছুতেই রাজী হলেন না। তাই ঘরের দুয়ার থেকেই ফিরতে হলো। গাড়ীর চালককে শুকরিয়া জানাতে হুযূরের ভুল হলো না। বললেন, অনেক কষ্ট করেছেন, আললাহ তা‘আলা ঈমানের মযবূতি দান করুন, ফী আমানিল্লাহ।
***
বাসায় যখন পৌঁছলাম ঘড়িতে তখন দু’টো বিশ। চালক হানিফ বললেন, ভালুকা থেকে পাহাড়পুরী হুযূরের বাসা পর্যন্ত দূরত্ব হলো ঊনাশী কিলোমিটার। বুদ্ধি করে তিনি হিসাব রেখেছেন, খুশী হলাম। অনেক অনেক জাযাকাল্লাহ বলে বিদায় জানালাম।
ছেলেকে নিয়ে ঘরে এলাম, ঘুমে তখন সে ঢুলে ঢুলে পড়ে। বড় করুণা হয় সময়ের তরুণদের প্রতি। উম্মে মুহাম্মাদ তার মায়ের বাড়ীতে। সাফফানা হুযূরের জন্য কিছু খাবার দিয়েছিলো। তিনি সেটা আমাকে হাদিয়া করেছেন। ক্ষুুধা পেয়েছিলো। বাপ-বেটা শোকর আলহামদু লিল্লাহ বলে খেলাম।
বাকি সময়টা জেগেই কাটালাম। এমনিতেও ঘুম আসছিলো না, তার উপর ভয় হলো যদি ফজরে সমস্যা হয়ে যায়, তাহলে তো সব খাসারা; আল্লাহ হেফাযত করুন।
মনের ভিতরে কিসের একটা অস্বস্তি যেন থেকে থেকে বোধ হচ্ছিলো। শেষ হয়েও যেন শেষ হয়নি, এমন কিছু। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না, কোথায় এ অস্বস্তির উৎস! এর মধ্যে ফজরের আযান হলো, আর হঠাৎ মনে হলো, নূরিয়াতে গিয়ে নামায পড়ি। হুযূরের সঙ্গে দেখা করে খোঁজ নিই, কেমন আছেন!
নামাযের কিছু আগে পৌঁছলাম। হযরত হাফেজ্জী হুযূর এবং আববাজানের কবর যিয়ারত রলাম। মন কিছুটা শান্ত হলো। মসজিদে দাখেল হলাম। হুযূর তখনো আসেননি। নামাযের একটু আগে এলেন। দূর থেকে সুস্থ-সজীবই মনে হলো, দেখে মনটা খুশী হলো। নামাযের পর দেখা করলাম। প্রথম যে কথাটি হুযূর বললেন তা হলো, ‘ভালুকা আমার খুব ভালো লেগেছে, কবুলিয়াতের আলামত দেখতে পেয়েছি।’ ভিতরের সেই অস্বস্তিটা মুহূর্তে দূর হয়ে গেলো। সারা অন্তরে আশ্চর্য এক প্রশান্তি যেন ছড়িয়ে পড়লো, আর মনে হলো, সেই বরকতপূর্ণ সফর এখন যেন শেষ হলো। শোকর আলহামদু লিল্লাহ!
[1] মা‘ইয়্যাত মানে, সঙ্গ, সান্নিধ্য।
[2] ইয়াদগার, মানে স্মৃতি, স্মারক
[3] হুসনে যান, মানে সুধারণা
[4] নাহ্জ, মানে তরীকা, পন্থা, পদ্ধতি
[5] শাদাব (উচ্চারণে উভয় আকারে একটু টান হবে), তরুতাজা, সজীব।
[6] তবে এটাও তিক্ত সত্য যে, বর্তমান ‘কমিটিব্যবস্থা’ আমাদেরই কর্মফলের কারণে আল্লাহর পক্ষ হতে ‘মুসাল্লাত’ হয়েছে। তা দূর করতে হবে মূলত নিজেদেরই ইছলাহের মাধ্যমে। তাছাড়া যতদিন আমরা এ ব্যবস্থার অধীনে আছি, পূর্ণ নিয়ম রক্ষা করেই থাকা কর্তব্য। সংশোধনের নামে গোলযোগ করার কোন বৈধতা নেই।
[7] নেক ফাল মানে, সুলক্ষণ। কোন কিছু থেকে ভালো লক্ষণ গ্রহণ করা যাতে শরী‘আতের কোন উছূলের সংঘর্ষ নেই, এটাকে ফাল গ্রহণ করা বলে। শরী‘আতে এর বৈধতা রয়েছে।
[8] ঠিক দু’বছর পর এ সফরনামা যখন লিখছি তখন ‘পানি না থাকলেও’ পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। শাপলা চত্বরে হেফাযতের ডাকে স্মরণকালের বৃহত্তম ও সুশৃঙ্খল ঐতিহাসিক মহাসমাবেশ শুধু দেশ নয়, সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
মাহমূদুর-রহমান শাহাবাগী ব্লগারদের আল্লাহ-রাসূল বিরোধী ঘৃণ্যতৎপরতার মুখোশ খুলে দিয়েছেন। সেই অপরাধে কয়েক মাস পত্রিকা-অফিসে অবরুদ্ধ ছিরেন। তারপর আবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। এখনো কারাগারে। আমার দেশও বন্ধ। এবার বোধহয় তাকে কঠিন মাশুলই দিতে হবে। একমাস পর শাপলাচত্বরে হেফাযতে ইসলামের অবরোধ-উত্তর সমাবেশে ঘটে গেলো নিরীহ আলেম-ওলামাদের উপর বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। তুমি রক্ষা করো হে আল্লাহ!
সত্যের অনুরোধে বলতে হয়, হেফাযতের দুই সমাবেশের মাঝে শাপলাচত্বরে পুলিশের ‘হেফাযতে’ শত শত লোকের আরেকটি ‘মহাসমাবেশ’ হয়েছিলো, বিবিসির ভাষায় যা ছিলো ‘জনসমুদ্র’, যদিও বিবিসি পরে দুঃখ প্রকাশ করেছে।
কানে এলো, কলমের দু’টি সত্য শব্দের জন্য আমিও কিছু ‘সন্দেশ’ পেয়েছি।
দূর অতীতের আরব কবির ভাষায় শুধু বলা যায়-فمضيت وقلت لا يعنيني