বাঙালী সংস্কৃতি : শেকড়ে ফেরা, না শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া?
আল্লাহ তাআলার পরম করুণা, তিনি আমাদের দান করেছেন ঈমানের আলো এবং রক্ষা করেছেন কুফরের অন্ধকার থেকে। তাই অন্তরের অন্তস্তল থেকে তাঁর শোকরগোযারি করছি-আলহামদুলিল্লাহ!
আল্লাহ তাআলার অশেষ দয়ায় আমরা মুসলমান। আমাদের আদর্শ ইসলাম। ইসলাম এক পূর্ণাঙ্গ দ্বীন, যার দৃষ্টান্ত ঐ বরকতময় বৃক্ষ, যার শেকড় মাটির গভীরে আর শাখা-প্রশাখা আকাশে। ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস সত্য ও যথার্থ, যা অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত এবং যাতে কল্পনা-কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই। ইসলামের বিধান ও নির্দেশনা কল্যাণপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ, যা আসমানী ওহী দ্বারা প্রমাণিত এবং যা মানবের সীমাবদ্ধতা, স্বার্থবাদ ও প্রবৃত্তিবাদের কলুষমুক্ত। এই ইসলামই আমাদের শেকড়। এর সঙ্গেই আমাদের কর্ম ও বিশ্বাস সংযুক্ত।
ইসলাম-নেয়ামতের শোকরগোযারি হচ্ছে এর মূল্য উপলব্ধি করা আর না-শোকরি হচ্ছে এর বিপরীতে জাহালাত ও জাহেলিয়াত তথা অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের আহবানে সাড়া দেওয়া।
প্রশ্ন হতে পারে, কোনো মুসলিম কি কুফর ও জাহেলিয়াতের ডাকে সাড়া দিতে পারে? ঠিক। কোনো ঈমানদার জাহেলিয়াতের ডাকে সাড়া দিতে পারে না যদি তাকে সরাসরি সেদিকে ডাকা হয়। কিন্তু এ ডাক যখন আসে ভিন্নরূপে এবং আবেগকে বাহন করে, ধর্ম, দেশ, ভাষা ইত্যাদি যা কিছুর প্রতি একজন মানুষের সাধারণ দুর্বলতা সেসবের নাম করে, তখন সে ভীত হয় এবং আবেগগ্রস্ত হয়। ফলে এ আহবানকে সমালোচকের দৃষ্টিতে পরখ করার সাহস বা সতর্কতা তার চেতনায় জাগ্রত হয় না। এভাবে নিজের অজান্তেই একজন মুসলিম ইসলাম-বিরোধী ডাকের শিকার হয়ে পড়ে। এর অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়।
এদেশের সাধারণ মুসলিম ধর্মপ্রাণ। তাই ধর্ম তার দুর্বলতার জায়গা। একারণে কুফরীর দিকে আহবানের জন্যও ধর্মকেই ব্যবহার করা হয়। সচেতন মহলের জানা আছে, আজ বাংলাদেশে খ্রিস্টবাদের দিকে আহবান করা হচ্ছে কুরআনের আয়াত পড়ে পড়ে। কুরআন মাজীদে ঈসা আ. সম্পর্কে যে আয়াতগুলো আছে সেগুলোর অনুবাদ সম্বলিত বহু পুস্তিকা প্রস্ত্তত হয়েছে এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেই শুধু নয়, রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতেও তা বিতরণ করা হচ্ছে। কুরআন মাজীদের কোন কোন আয়াত এ প্রসঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং কী কী অপব্যাখ্যা সেগুলোর করা হচ্ছে তা এখানে আলোচ্য নয়। এখানে শুধু এটুকু দেখানো উদ্দেশ্য যে, ইসলাম ও কুরআন একজন মুসলিমের পরম আস্থা ও আবেগের বিষয় হওয়ায় একেই ব্যবহার করা হচ্ছে খ্রিস্টবাদের দিকে আহবান করার জন্য। খ্রিস্টবাদ যে ইসলাম নয় তা কি বুঝিয়ে বলতে হবে?
একইভাবে বাংলাভাষায় রচিত ও অনূদিত কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বই-পুস্তক সম্পর্কে যাদের কিছুমাত্রও জানাশোনা আছে কিংবা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে কাদিয়ানী ধর্ম-প্রচারকদের আলাপ-আলোচনা শোনার যাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে তারা ভালোভাবেই জানেন যে, এই কুফরীর দিকে ডাকার জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে ইসলাম ও কুরআনের নাম। কুরআন মাজীদের ‘খাতামুন্নাবিয়িন’ শব্দের সম্পূর্ণ আলাদা অর্থ করে (যা এই অকাট্য-আকীদা অস্বীকার করারই নামান্তর) এবং কুরআনের অনেক আয়াতের তাহরীফ ও অপব্যাখ্যা করে এই কুফরীর দিকে আহবান জারি রয়েছে। এখানেও সেই একই পন্থা কার্যকর। কুফরীর দিকে ডাকার জন্য মুসলিমের আস্থা ও আবেগের স্থল ধর্ম ও তার পবিত্র গ্রন্থ অর্থাৎ ইসলাম ও আলকুরআনের নাম ব্যবহার।
ধর্মের মতো বর্তমান যুগের মানুষের আবেগ ও ভালবাসার আরেক ক্ষেত্র ভাষা ও ভূখন্ড। দেশের প্রতি ভালবাসা এবং দেশজ নানা অনুষঙ্গের সাথে আপনত্বের অনুভব দোষণীয় নয়, যদি তা হয় স্বাভাবিক মাত্রায় এবং থাকে নীতি ও আদর্শের অধীন। কারণ মানবমাত্রেরই স্বভাব-প্রবণতা, যে দেশে তার জন্ম, যেখানের আলো-বাতাসে তার দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি এবং যে ভাষা ও জীবন-ধারায় সে অভ্যস্ত তাতেই তো সে বোধ করবে স্বস্তি ও আপনত্ব। মানব ও প্রকৃতির যিনি স্রষ্টা, ইসলাম যেহেতু তাঁরই প্রেরিত দ্বীন ও জীবন-ব্যবস্থা তাই মানবের এ স্বাভাবিক প্রবণতার সাথে এর কোনো সংঘাত হয় না। বরং সকল অঞ্চলের সুস্থ ও স্বাভাবিক অনুষঙ্গগুলো ইসলামে গণ্য ‘মোবাহ’ ও অনুমোদিত বলে। একারণে দেশে দেশে মুসলিম-সংস্কৃতি গঠিত হয়েছে ইসলামী আদর্শ এবং কিছু আঞ্চলিক অনুষঙ্গের সমন্বয়ে।
এ বিষয়টি দু’ভাবে আলোচনা করা যায় : এক. ইসলামের নীতি ও বিধান থেকে। দুই. মুসলিম উম্মাহর জীবন ও অনুশীলন থেকে।
জীবনের মৌলিক অংশ দু’টি : এক. নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ। অন্যান্য ধর্মে যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা নেই, শুধু ইসলামেই তা আছে একারণে ইসলামের নীতি-আদর্শ জীবনের সকল অঙ্গনে পরিব্যাপ্ত। আকীদা বিশ্বাস থেকে শুরু করে ইবাদত-বন্দেগী, লেনদেন, দাম্পত্য, সামাজিকতা, চরিত্র, আচরণ, আইন, বিচার, শাসন সব ক্ষেত্রেই আছে ইসলামের সুস্পষ্ট নীতি ও বিধান।
দুই. উপায়-উপকরণের ব্যবহার এবং বিভিন্ন বিষয়ের ব্যবস্থাপনা। এটি ইসলামের ‘মোবাহ’ বা ‘বৈধ’ শব্দের এক বিস্তৃত ক্ষেত্র। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ইসলামী নীতি ও বিধানের অধীনে থেকে যুগ ও সমাজ এবং পরিবেশ পরিস্থিতি অনুসারে যে কোনো ফলপ্রসূ উপায় ব্যবহার এবং যে কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অবকাশ ইসলামে আছে। প্রত্যেক ভূখন্ডের ভাষা, পোশাক, খাদ্য, পেশা, উৎপাদন-ব্যবস্থা, ঘর-বাড়ি ও গৃহস্থালি সামগ্রী ইত্যাদি এ বিস্তৃত অবকাশের অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম কোনো বিশেষ ভাষাকে সব দেশের ভাষা, কোনো বিশেষ পোশাককে সব দেশের পোশাক, কোনো বিশেষ খাদ্যকে সব দেশের খাদ্য, কোনো বিশেষ পেশাকে সবার পেশা, বা ঘর-বাড়ির কোনো বিশেষ রীতি ও ধরনকে সব দেশের জন্য নির্ধারণ করেনি; বরং এসব ক্ষেত্রে ইসলামের কিছু মৌলনীতি আছে, যার ভিতরে থেকে প্রত্যেক দেশের মানুষ স্ব স্ব ভাষায় কথা বলতে পারে, স্বদেশে উৎপাদিত বা বাইরে থেকে আমদানীকৃত খাদ্য-বস্ত্র ব্যবহার করতে পারে এবং নিজ নিজ অঞ্চলের সহজলভ্য উপকরণ দ্বারা নিজেদের জলবায়ুর উপযোগী গৃহ নির্মাণ করতে পারে। এ কারণে ইসলামী আদর্শ আর আঞ্চলিক সাধারণ অনুষঙ্গের মাঝে কোনো সংঘাত নেই। আর কেনইবা হবে সংঘাত, সবই তো আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহরই দান।
একইভাবে যুগে যুগে জীবন-ধারণ ও জীবনযাত্রাকে সহজ ও গতিশীল করার লক্ষ্যে যত কল্যাণকর আবিষ্কার ও উন্নত ব্যবস্থা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, সমর, উৎপাদন এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবন, ইসলামের হালাল-হারামের নীতি ও বিধানের মধ্যে থেকে এসবের ব্যবহারে কোনো নিষেধ নেই; বরং অনেক ক্ষেত্রে নানা পরিপার্শ্বিক কারণে তা উত্তম, জরুরি ও অতি জরুরি পর্যায়ে উন্নীত হয়। একারণে ‘সময়’ যতই এগিয়ে যাক এবং ‘সমাজ’ যতই উন্নত হোক ইসলামের সাথে এর কোনো বিরোধ হবে না। ইসলামের বিরোধ তো শিরক ও পৌত্তলিকতার সাথে, মূর্খতা ও কু-সংস্কারের সাথে, মিথ্যাচার ও কপটতার সাথে, বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সাথে, অনাচার ও অশ্লীলতার সাথে, দুর্নীতি ও পরস্ব হরণের সাথে, অন্যায় ও অবিচারের সাথে - এককথায়; আল্লাহর হক ও বান্দার হক নষ্ট করার সাথে।
এ তো গেল ইসলামের নীতি ও বিধানের দিক থেকে চিন্তা। এরপর যদি মুসলিম উম্মাহর জীবন ও অনুশীলনের আলোকে চিন্তা করি তাহলেও দেখা যাবে, প্রত্যেক ভূখন্ডে মুসলিম-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে দুটি উপাদানের সমন্বয়ে এবং উপাদান দুটি তাদের জীবনে এমনভাবে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে, যেন দুধ ও চিনি। দু’টোকে আলাদা করে কল্পনা তো করা যায়, কিন্তু বাস্তব জীবনে আলাদা করে দেখানো যায় না। উপাদান দু’টি হচ্ছে ইসলামী আদর্শ এবং আঞ্চলিক অনুষঙ্গ।
বাংলাদেশের মুসলমানও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলামী আদর্শ ও কিছু আঞ্চলিক রীতিনীতির সংমিশ্রনে গড়ে ওঠেছে বাঙালী মুসলমানের সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির আঞ্চলিক উপাদানগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ভাষা, খাদ্য, লেবাস-পোশাক ইত্যাদি।
বাংলাদেশের মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা। এ ভাষাতেই তারা তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ করেন এবং এ ভাষার সেবাকে তারা নিছক দেশপ্রেম নয়, ধর্মীয় দায়িত্বও মনে করেন। বাঙালী মুসলমানের প্রধান খাদ্য ভাত-মাছ-ডাল। আর তাদের রসনা তৃপ্ত হয় আম-জাম-কাঠালে। এ খাদ্য তারা গ্রহণ করেন, ‘বিসমিল্লাহ’ বলে এবং খাবার শেষে বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। পোশাক-পরিচ্ছদ ও বাড়ি-ঘর নির্মাণের তাদের রয়েছে নিজস্ব ধরন, যা এমনকি আরবেরও রীতি ও ধরন থেকে বেশ আলাদা। এ বস্ত্র ও আবাসকেও তারা গণ্য করেন আল্লাহর নেয়ামত বলে এবং এর জন্য তাঁর শোকরগোযারি করেন।
বাঙালী মুসলিম সংস্কৃতির আদর্শিক উপাদানগুলোকে যদি আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়, যা তাদের
চিন্তা-চেতনা ও গোটা জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে তবে তা হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, তাওহীদ ও সুন্নাহ, অসাধারণ রাসূল-প্রেম, উলামা-মাশায়েখ ও পীর-আউলিয়ার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা এবং জাত-পাতের ব্যবধানহীন মানবীয় সাম্য, যা বাংলাদেশী মুসলিম সমাজে ধমনীর রক্ত-প্রবাহের মতো প্রবহমান। প্রাত্যহিক জীবন-যাত্রায় তা এতই স্বাভাবিক যে, সাধারণত তা চিন্তারও অগোচর।
আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দুআ-ইবাদত, ওয়াজ-নসীহত ও জীবনের নানা ক্ষেত্রে তা প্রকাশিত। একটি মুসলিম শিশুর জন্মের পর প্রথমেই তার কানে অনুচ্চস্বরে আযান দেওয়া হয় এবং নিজের নামেরও আগে আল্লাহর নাম তার শ্রুতিগোচর হয়। সপ্তম দিন সুন্নত মোতাবেক আকীকা করা হয় এবং ‘ইসলামী’ নাম রাখা হয়, যে নাম তাকে আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরিচিত করে। এরপর সময় এলে আল্লাহর নামে তার শিক্ষার সূচনা হয়। ‘বিসমিল্লাহ’-এর শব্দ ও মর্ম এ অঞ্চলের মুসলমানদের কর্মে, বিশ্বাসে ও উচ্চারণে ছড়িয়ে আছে সূর্যের আলোর মতো। বিয়ের বয়স হলে ইসলামী নিয়মে বিবাহ দেওয়া হয়। মৃত্যুর সময় কালেমার তালকীন করা হয় এবং শেষ উচ্চারণ কালেমা হওয়াকে পরম সৌভাগ্যের বিষয় মনে করা হয়। মৃত্যুর পর ইসলামী নিয়মে জানাযা ও কাফন-দাফন হয়। এগুলো হচ্ছে জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য পর্ব। এছাড়া প্রাত্যহিক জীবন-যাত্রার ছোট-বড় নানা অনুষঙ্গে ছড়িয়ে থাকে আল্লাহর পবিত্র নাম। এক তরুণ কবির ভাষায় : ‘এ দেশে আল্লাহু আকবারের সুরে সূর্য ওঠে, এদেশে আল্লাহু আকবারের সুরে সূর্য ডোবে।’ এখানে আযানের কথাই বলা হয়েছে, যা তাওহীদের ঘোষণা ও সালাতের আহবান এবং যা মুসলিম-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শিরক ও পৌত্তলিকতা বর্জনীয় হওয়ায় মূর্তি ও ভাস্কর্য থেকে আকসার মুসলিমের ঘর-বাড়ি ও কর্মস্থল মুক্ত ও পবিত্র।
সব শ্রেণী পেশার মানুষ মসজিদে এককাতারে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে এবং একসাথে বসে পানাহার করে। কখনো জাত-পাতের চিন্তাও তাদের মনে জাগ্রত হয় না। এই যে ঈমান ও তাওহীদ, এই যে কালেমা-নামায, এই যে জাত-পাতের ব্যবধানহীন ইসলামী ভ্রাতৃত্ব এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশী মুসলমানের সংস্কৃতির ঐ আদর্শিক দিক, যা তারা লাভ করেছে ইসলামের মহান শিক্ষা থেকে। আর এরই সূত্রে স্থাপিত হয়েছে বিশ্বের মুসলমানদের সাথে তার বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। এই আদর্শ থেকে এদেশের মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করার অর্থ শুধু তার বৈশ্বিক পরিবার থেকেই বিচ্ছিন্ন করা নয়; বরং তার ঐ কুসংস্কারমুক্ত বিশ্বাস, ঐ নির্মল জীবনধারা থেকেও বিচ্ছিন্ন করা, যা তার গোটা জীবন-যাত্রায় সাম্য ও ভারসাম্যের প্রাণরস সরবরাহ করছিল।
এভাবে চিন্তা করলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, উপকারী ও উপযুক্ত আঞ্চলিক অনুষঙ্গগুলোর সাথে ইসলামী আদর্শের কোনো বিরোধ নেই এবং এদেশের মুসলিম তা থেকে বিচ্ছিন্নও নয়। তাহলে এখানে তথাকথিত ‘আঞ্চলিক সংস্কৃতি’র দিকে আহবানের অর্থ কী? উদ্দেশ্যই বা কী? এ কি আদর্শের দিকে আহবান? বর্তমান জীবন ও সমাজের সংকট ও সমস্যা থেকে উত্তরণের আহবান? না এ-ও মুসলিম সমাজকে আদর্শচ্যুত করার এক অপপ্রয়াস? দেশ ও সংস্কৃতির নাম শুধু মুসলিম মানসকে বিচলিত ও প্রতারিত করবার জন্য?
এ আহবানের ক্ষেত্রে দু’টো প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক. যে ‘সংস্কৃতির’ দিকে মুসলমানদের আহবান করা হচ্ছে তাতে কি আছে তাদের বর্তমান সামাজিক সমস্যা তথা দুর্নীতি, সন্ত্রাস, রিপুপরায়ণতা, সম্পদ-লিপ্সা, ও নারী-নির্যাতন থেকে নিষ্কৃতি লাভের কোনো যথার্থ উপায় ও রূপরেখা? সত্যিই কি ইসলামের আগমনের আগে এ অঞ্চলে ছিল এমন কোনো শক্তিশালী আদর্শ, যা এ সকল সমস্যার সমাধান দানে সক্ষম? বছরের একটি দিন নাচ-গানের মধ্যে কাটানো এক কথা আর জীবন ও সমাজের সংকট থেকে উত্তরণের প্রয়াস সম্পূর্ণ আলাদা কথা।
দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, ইসলাম-পূর্ব যুগে এ অঞ্চলে কোন ‘সংস্কৃতি’ প্রচলিত ছিল? ঐ ‘সংস্কৃতির’ দিকে ফিরে যাওয়া কি কোনো সুস্থ সমাজের পক্ষে আদৌ সম্ভব? কে না জানে, ঐ সংস্কৃতির প্রধান অনুষঙ্গ ছিল পৌত্তলিকতা, শুধু পৌত্তলিকতাই নয়, এ ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের যে বিশিষ্টতা ছিল তা হচ্ছে দেব-দেবীর অকল্পনীয় সংখ্যাস্ফীতি। বেদে দেবতার সংখ্যা ছিল তেত্রিশ। ষষ্ঠ শতকে এসে তা বেড়ে দাড়াল তেত্রিশ কোটিতে!!
ঐ ‘সংস্কৃতি’র আরেক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল জাতিভেদ। মানবগোষ্ঠিকে ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র -এ চার ভাগ করে ব্রাক্ষ্মণ্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক মনু যে ‘জীবন-ব্যবস্থা’ প্রণয়ন করলেন তাতে শুধু ব্রাক্ষ্মণের ঘরে জন্মানোই ছিল সকল ন্যায্য ও অন্যায্য অধিকার লাভের উপায় আর বৈশ্য ও শূদ্রের ঘরে জন্মানোই ছিল ঐ আজন্ম পাপ যা এক মানবসন্তানকে জন্ম থেকে জন্মান্তরে দাসের জীবন যাপনে বাধ্য করে। এভাবে অন্যান্য অনুষঙ্গগুলোও স্মরণ করা যায়।
এ তো মানবতার প্রতি আল্লাহ তাআলার পরম করুণা যে, তিনি এ সকল অনাচার বিলুপ্ত করেছেন। একে পুনর্জীবিত করার অপচেষ্টা কোনো বিচারেই তো দেশ ও জাতির কল্যাণকামিতা হতে পারে না। তাই একথা দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলা যায় যে, এ সকল আহবানের মূল প্রেরণা হচ্ছে ইসলামের সাথে এ অঞ্চলের মানুষের সম্পর্ক দুর্বল করা, ইসলামী আদর্শকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে দেশ ও জাতির প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথ উন্মুক্ত করা এবং দেশ-প্রেমের ছুতায় সহজ-সরল জনগণকে কুফর ও শিরকের দিকে ধাবিত করা।
এ ঈমানী পরীক্ষার পরিস্থিতিতে এই সকল কপট আহবানের স্বরূপ বোঝার পাশাপাশি কুরআনের এ বাণী থেকেও আলো ও শিক্ষা গ্রহণ করা কর্তব্য, যা আল্লাহ তাআলা আমাদের মহান পূর্বসূরী সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং একে তাঁর মহা অনুগ্রহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
وَلَكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ أُولَئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ l فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَنِعْمَةً وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
‘‘...কিন্তু আল্লাহ তোমাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং তা তোমাদের হৃদয়গ্রাহী করেছেন। আর কুফরী, পাপাচার ও (আল্লাহর) অবাধ্যতাকে করেছেন তোমাদের কাছে অপ্রিয় করেছেন। তারাই হেদায়েতপ্রাপ্ত। আল্লাহর দান ও অনুগ্রহস্বরূপ; আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। -সূরা হুযুরাত (৪৯): ৭-৮
এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ হাদীস থেকেও
ثلاث من كن فيه وجد حلاوة الإيمان : أن يكون الله ورسوله أحب إليه مما سواهما وأن يحب المرأ لا يحبه إلا لله، وأن يكره أن يعود في الكفر كما يكره أن يقذف في النار.
‘‘যার মাঝে তিনটি বিষয় থাকবে সে ঈমানের স্বাদ পাবে। ১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সবচেয়ে প্রিয় হওয়া।
২. কাউকে ভালবাসলে, শুধু আল্লাহর জন্য ভালবাসা। ৩. (হেদায়েতপ্রাপ্ত হওয়ার পর) কুফরে ফিরে যাওয়াকে এমন অপসন্দ করবে যেমন অপসন্দ করে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে।-সহীহ বুখারী, হাদীস ১৬