ওলীদের আলোচনায় কলব তাজা হয়
১৯৫৭ সন। আমার বয়স তখন সবেমাত্র নয়। আববাজান মরহুম আমাকে চট্টগ্রাম শহরের একমাত্র কওমী মাদরাসা মাযাহেরে উলূম মাদরাসায় ভর্তি করে দেন। আববাজান রাহ. ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে মেট্রিক পড়ার সময়েই মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রাহ.-এর মুরিদ হন। কিন্তু কর্মজীবনের শেষের দিকে সুদীর্ঘ ২৭ বছর যাবত চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল হাই স্কুলে শিক্ষকতার সুবাদে পটিয়া জমিরিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা, হযরত শাহ মুফতী আজিজুল হক সাহেব রাহ.-এর হয়ে যান। হযরত মুফতী সাহেব হুজুরের সাথে পরামর্শ করে স্বীয় সমস্যাদি সমাধান করতেন।
আমাকে পটিয়ায় ভর্তি করতে চাইলে মুফতী সাহেব হুজুর আববাকে বললেন, ‘ওয়া ...! গুরা ফোয়া, ফটিয়া তার লাই দূর অই যাবো, তারে তুঁই আঁরার উস্তাদ হযরত মাওলানা ইসমাঈল সাব হুজুরর মদরসা মোযাহেরে উলূমত ভর্তি গরি দেও। ফোয়া শ-রত তা-ইলে তুঁইও দেখা-শোনা গরিত ফারিবা’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আববাজান হুজুরের কথামতো আমাকে মাযাহেরে উলূম মাদরাসায় ভর্তি করে দেন। ঐ বছরই আযাদী আন্দোলনের অন্যতম বীরপুরুষ আওলাদে রাসূল হযরত মাওলানা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর
ইন্তেকাল হয়। আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে, মাদরাসার তৎকালীন হলরুমে ছাত্র-শিক্ষকদের এক বিরাট ইজতেমা হয়। সেদিন হযরত মুহতামিম সাহেব হুজুর অর্থাৎ মাওলানা ইসমাইল সাহেব হুজুরের আহাজারিতে মোনাজাতের মধ্যে আমরা শিশুরাও কেঁদেছিলাম।
মাযাহেরে উলূম মাদরাসায় আমার চার বছর কাল অধ্যয়নের ঐ শৈশব ও কৈশরের সময়টাতে পটিয়ার মুফতী সাহেব হুজুরের অনেক ওয়াজ মাহফিলই শহরের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হতো। বিল্লাখাঁর মসজিদ, ইসলাম খাঁর মসজিদ ও ঝাউতলা মসজিদ ইত্যাদিতে তাঁর দরদভরা বয়ানের অনেক মাহফিলেই আমরা ছাত্র-শিক্ষক সকলেই উপস্থিত থাকতাম। ওয়াজের বিষয়-আশয় তো ছোট মানুষ হিসেবে আজ আর মনে করতে পারছি না। তবে হযরতের দুআর মাধ্যমে আমারও চোখের পানি ঝরেছে এ কথা আমার এখনো স্মরণ আছে।
আন্দরকিল্লার উত্তরে মিউনিসিপাল অফিসেরও একটু উত্তর সাইডে চন্দনপুরা রোডে সামান্য গেলেই মুফতী সাহেব হুজুরের খলীফা ডাক্তার ইসমাঈল সাহেবের বাসা ছিল। হযরত মুফতী সাহেব হুজুর শহরে তাশরীফ আনলে ঐ বাসায় যেতেন। আমরা ছাত্ররাও হযরতের সাথে মোলাকাত করার জন্য এবং হযরতকে এক নজর দেখার জন্য ঐ বাসায় ধরণা দিতাম। হযরত মুফতী সাহেব হুজুরের ইন্তেকালের কিছু দিন আগে যে টেপরেকর্ডার কেনা হয়েছিল এবং মাত্র দুটি ওয়াজ রেকর্ড করা হয়েছিল, ডাক্তার সাহেবের বাসায় ঐ টেপের ওয়াজও আমার শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল।
মাযাহেরে উলূম মাদরাসায় পড়ার সময় আমার উস্তাজে মরহুম হযরত মাওলানা আবদুল বারী সাহেব (ফতেহপুরী হুজুর)-এর সাথে জিরি মাদরাসার জলসা ও পটিয়া মাদরাসার সভায়ও আমার যাতায়াত নসীব হয়। এসব মাহফিলের মধ্যমণি ছিলেন পটিয়ার মুফতী সাহেব হুজুর রাহ.। সেখানেও হযরতের বয়ান শোনার সৌভাগ্য হয়। ফতেহপুরী হুজুর তখন মাযাহেরে উলূম মাদরাসার তরুণ উস্তাজ ছিলেন এবং পটিয়ার মুফতী সাহেব হুজুরের কাছে বাইআত ছিলেন। অধিকাংশ সময় তিনি গম্ভীরভাব ও পেরেশান-হাল থাকতেন এবং মাঝেমধ্যে চিৎকার করে উঠতেন ও আল্লাহ আল্লাহ বলতেন। মাযাহেরে উলূম মাদরাসায় এ অধম তার কামরায় থাকার সৌভাগ্যও লাভ করেছিল। হুজুরের মৃত্যুর কয়েক বছর আগে আমার একবার নানুপুরের সভায় যাওয়ার সৌভাগ্য হলে আমি সর্বক্ষণ হুজুরের খেদমতে থাকতে চেষ্টা করেছিলাম।
ফতেহপুরী হুজুর হযরত সুলতান
নানুপুরী রাহ.-এর আজাল্লে খলীফা ছিলেন।
পটিয়া মাদরাসা যে সময় বিদআতীরা জ্বালিয়ে দিয়েছিল সে সময়টাতে আমি মাযাহেরে উলূম মাদরাসাতেই ছিলাম। মুফতী সাহেব হুজুরের ইন্তেকালের পরের বছর আববাজান আমাকে পটিয়া মাদরাসায় ভর্তি করে দেন। সেখানে পড়ার সময়ই মুফতী সাহেব হুজুরের অন্যতম খলীফা হযরত মাওলানা শাহ সুলতান আহমদ নানুপুরী রাহ.-কে প্রথম দেখতে পাই। মুফতী সাহেব হুজুরের খলীফা হিসেবে হযরত তখন প্রায় পটিয়া মাদরাসায় তাশরিফ আনতেন। মাদরাসার মাহফিল ছাড়াও তিনি কখনো শায়খের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আবার কখনো পটিয়ার আশেপাশের কোনো ওয়াজের মাহফিলে তাশরিফ নিতেন। যখনই হযরত যেতেন, তখন মাদরাসার মসজিদে অথবা ঐ সমস্ত ওয়াজ মাহফিলে আমরা ছাত্ররাও থাকতাম। আশপাশের ওয়াজগুলো তখন রাতের বেলা এশার পর হত। আমরা ছাত্ররা মাদরাসায় এশার নামায পড়ে হযরত নানুপুরী হুজুরের বয়ানে শরিক হতাম। হযরত মুফতী সাহেব হুজুর যেহেতু তখন ইহধামে নেই, তাই তাঁর বড় বড় খলীফারা প্রায় সময়ই পটিয়া তাশরিফ আনতেন। হযরতের খলীফা হযরত মাওলানা হারুন সাহেব (বাবুনগরী হুজুর) এবং কারী ওবায়দুল্লাহ সাহেবের বাবা হযরত মাওলানা মেহরুজ্জামান সাহেব হুজুরও পটিয়ায় যেতেন। তবে প্রায়ই খাছভাবে ছাত্র-
উস্তাজের মজলিসে হযরত নানুপুরী হুজুর ও বাবুনগরী হুজুরের বয়ান হত মাদরাসার মসজিদে। বাবুনগরী হুজুরের এক বয়ানে তো এক ছাত্র বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল সে ঘটনা স্পষ্টভাবে আমার মনে আছে। পটিয়া মাদরাসাকে তখন দিনের বেলায় ইলমী মারকায মনে হত আর রাতের শেষ ভাগে মনে হত তা একটি যিকরুল্লাহর খানকাহ। তাহাজ্জুদের সময় কামরায় কামরায় ইল্লাল্লাহর জরব চলতে থাকত, আর মসজিদে চলত সমস্বরে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর যিকরের গুমগুম গুঞ্জরণ। ফজরের আযান পর্যন্ত এই গুমগুম আওয়াজ ও গুঞ্জরণের শব্দ মৃত সব কলবকে যিন্দা ও বেদার করে ছাড়ত।
তখন পটিয়াতেও হযরত মুফতী সাহেব হুজুরের খাছ খাছ কয়েকজন খলীফা ছিলেন। যেমন হযরতের খাছ খলীফা হযরত মাওলানা আলী আহমদ (বোয়ালভী সাহেব হুজুর) রাহ., আমার সুনসীব যে, আমি হুজুরের কাছে পাঞ্জেগঞ্জ কিতাবটি পড়েছি। আরো সুনসীব যে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হযরত আমাকে নামে চিনতেন। এছাড়াও হযরত মাওলানা আমীর হুসাইন সাহেব (মীর সাহেব হুজুর), হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ সাহেব (নোয়া মৌলভী সাহেব হুজুর), হযরত মাওলানা নুরুল ইসলাম সাহেব (কদীম সাহেব হুজুর) এঁরা সবাই আমার উস্তাজ ছিলেন।
আমার আববাজান রাহ. পটিয়ার মুফতী সাহেব হুজুরের এতটা আশেক ছিলেন যে, চট্টগ্রাম শহরে হযরতের কোনো মাহফিলই আববা বাদ দিতেন না। আববা হযরতের ভাষণ-বয়ানকে বাংলায় নোট করতেন এবং পরে তা সাধু ভাষায় স্কুলের ম্যাগাজিনে প্রকাশ করতেন। প্রতি শুক্রবারে হযরতের বয়ান শোনার জন্য সকাল দশটার ট্রেনে করে আববা পটিয়ায় চলে যেতেন। হযরতের বয়ান হত জুমার নামাযের পর। আর দূর দূরান্ত থেকে অনেক ভক্ত-মুরীদ আসত হযরতের বয়ান শোনার জন্য। তখন ট্রেন ছাড়া পটিয়া যাওয়ার আর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কালুরঘাট ব্রীজ তখন বাস চলাচলের জন্য প্রস্ত্তত করা হয়নি। কালুরঘাট পর্যন্ত দু’ একটি মুড়ির টিন বাস চকবাজার থেকে যাতায়াত করত মাত্র। আববাজান আমাকে বলেছেন, এক শুক্রবারে দশটার ট্রেন তিনি মিস করে বসেন, বিকেল বেলা ছাড়া আর কোনো ট্রেন না থাকায় দুঃখে-কষ্টে তিনি মর্মাহত হয়ে শেষমেষ রেল লাইন দিয়ে হাঁটা আরম্ভ করে দেন। ১৯ মাইল পথের মধ্যে কালুরঘাটের পর গুমডন্ডি স্টেশন যাওয়ার পর জুমার আযান হয়ে যায়। আববা যেহেতু ইংরেজি শিক্ষিত লোক ছিলেন, তাই মাসআলার পুরোপুরি জ্ঞান না থাকায়
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
আয়াতের অর্থ মোতাবেক সেখানেই জুমআর নামায পড়ার জন্য থেকে গেলেন এবং এই ভেবে তাঁর চোখে পানি এসে গেল যে, হায়রে ... আরো ৭ মাইল রয়ে গেছে, অথচ আমাকে তো এখানে জুমা পড়তে হবে, কেননা জুমার আযানের পর আর চলা যাবে না। শেষ পর্যন্ত জুমা সেখানে পড়েই আবার রেল লাইন ধরে হাঁটা আরম্ভ করলেন। তিনি যখন পৌঁছলেন তখন বয়ান শেষ হয়ে গেছে বটে; তবে মোনাজাতে শরীক হতে পেরেছেন।
হযরত মুফতী সাহেব হুজুরকে যেমন তাঁর পীর ও শায়েখ হযরত শাহ জমিরুদ্দীন সাহেব হুজুর পটিয়ায় বসতে হুকুম করেছিলেন ঠিক তেমনি হযরত নানুপুরী রাহ.-কেও মুফতী সাহেব হুজুর নানুপুর বসার জন্য হুকুম করেছিলেন। তাই তিনি নানুপুরেই তাঁর পরবর্তী সারাটা জীবন কাটিয়ে দেন। আর ঐ নানুপুর থেকেই দেশ-বিদেশের অগণিত মানুষকে হেদায়েতের আলো বিতরণ করেন।
নানুপুরী হুজুর রাহ. চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিলার আনাচে-কানাচে ভ্রমণ ছাড়াও ঢাকাসহ দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের প্রায় প্রতিটি এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। কত তৃষ্ণার্ত মানুষ যে হযরতের হাতে বাইআতের সুধা পান করে সায়রাব হন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এর মধ্যে অনেক বুযুর্গ আলেমে দ্বীন হযরতের খলীফা হয়ে হযরতের কায়েম মকাম হন। তাঁর কোনো কোনো সফরে তাঁর সাথে অধমের মোলাকাত নসীব হলে তিনি অত্যন্ত স্নেহের আচরণ করতেন। আববাজানের কারণে হযরত আমাকেও অনেক শফকত ও মহববত করতেন। ৮১ সনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর প্রেস সেক্রেটারি থাকার কারণেও হযরত আমাকে শফকতের নজরে দেখতেন।
হযরত নানুপুরী হুজুর ছিলেন শায়খুল আরব ওয়াল আজম হযরত সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর খাছ শাগরিদ। এমনকি রাজনৈতিক মতাদর্শেও হযরত মাদানীর মাসলাককে শুধু সমর্থনই করতেন না; বরং তাতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করেছিলেন। পরে হযরত মুফতী সাহেব হুজুরের হাতে বাইআত হন।
৮১-এর পর হযরত হাফেজ্জী হুজুরের পক্ষ থেকে একবার আরবী ‘ইকরা’ নামক পত্রিকার গ্রাহক সৃষ্টি করার জন্য আমার নানুপুর সফর হয়। হযরত আমার কাছ থেকে শুনে মসজিদে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের মজলিসে এক আকর্ষণীয় বয়ান দেন এবং সব ছাত্রকে ইকরা’র গ্রাহক হয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
আরেকবার হযরত মাওলানা
হাবীবুলাহ মেসবাহ মরহুমসহ আমরা সাগর পথে চকরিয়ার এক মাহফিলে যাচ্ছিলাম। ফিরিঙ্গি বাজার ঘাট থেকে আমরা ইঞ্জিনের বড় নৌকায় করে যাচ্ছিলাম। নৌকায় হযরতের অনেক মূল্যবান কথাবার্তা শোনার সৌভাগ্য হয়। একপর্যায়ে হযরত আমার দিকে চার পাতা বিশিষ্ট সাপ্তাহিক পত্রিকার মতো একটি বাংলা পত্রিকা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওয়া আঁরা ‘‘আররসিদ’’ নামে একখান বাংলা ফত্রিকা বাইর গরগি, ছাও তো।’ আমি তা হাতে নিয়ে এই ভেবে অবাক হয়ে গেলাম যে, একজন এত বড় বুযুর্গ কদীম আলেমে দ্বীন আবার চট্টগ্রামের সন্তান হয়েও কী করে এই বাংলা পত্রিকার প্রতি মনোনিবেশ করলেন? এই যমানায় এটা তো একটা তাজদীদি কাজ বলে মনে হচ্ছে। হযরত নানুপুরী রাহ. একদিকে যেমন রূহানী চিকিৎসক ছিলেন তেমনি যুগের যাবতীয় চাহিদার প্রতিও সমান নজর রাখতেন। সময়ের প্রয়োজন মেটানোর মতো আলেম তৈরি করা যেন তাঁর জীবনের একটা মিশন ছিল। আলেমরা যেন কলব এবং কলমের সৈনিক হিসেবে সমানভাবে গড়ে উঠতে সক্ষম হন এই ব্রতই তাঁর দিল-দেমাগে সব সময় তুফান সৃষ্টি করত।
অত্যন্ত সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন পীরে কামেল হিসেবে মুরীদদের প্রতি তাঁর বসীরতের নজর সুদূর প্রসারী ছিল। তাঁর হাজার হাজার মুরিদের মধ্য থেকে যার মধ্যে বিকশিত হওয়ার যোগ্যতা আছে তা তিনি তাঁর বসীরতের মাধ্যমেই দেখতে পেতেন। এমনি এক ছাত্র-মুরীদের প্রতি তাঁর বসীরতের দৃষ্টি পড়ে এবং তাকে তিনি সেভাবেই ছাত্র জীবন থেকে গড়ে তোলেন। ছাত্র-মুরীদটিও তাঁর আশেক ছিল এবং ফেদায়ী ছিল। এই ছাত্র-মুরীদ যখন হাটহাজারীতে দাওরা পড়ছিল তখন দক্ষিণ চট্টগ্রামের কোনো এক মাদরাসায় তাকে মুহাদ্দিস বা শায়খুল হাদীস বানানোর জন্য অনেকে মুহতামিম সাহেবকে অনুরোধ করেছেন। ছাত্র-মুরীদটির কাছে প্রস্তাব দিলে সে বলল, আমার ব্যাপারে তো আমি কিছুই বলতে পারব না, ফারেগ হওয়ার পর আমার শায়খ হযরত নানুপুরী দামাত বারাকাতুহুম আমাকে যা হুকুম করবেন আমি তাই করতে বাধ্য। দেখা গেল, ফারেগ হওয়ার পর হযরত তাকে শায়খুল হাদীস পদে বরিত না করে নাহবেমীর পর্যন্ত এক মাদরাসায় মাত্র ৭০/- টাকা অজিফায় নিয়োগ দেন। ছাত্রটি এতেই মহাখুশি। ৫০০/- টাকা বেতনের শায়খুল হাদীসের পদ থেকেও তার কাছে শায়খের নিয়োগ দেওয়া ৭০/- টাকার খেদমতটি বেশি মূল্যবান ও বেশি প্রিয় অনুভব হল।
নিয়োগের সময় হযরত তাকে ডেকে বললেন, দেখ, মুহতামিম সাহেব খুব বদ মেজাজি, তবে তাঁর মতো যাকের-শাগেলও আরেকজন নেই। তোমাকে খারাপ কিছু বললেও ধৈর্যের সাথে পড়ে থাকবে। মেশকাত খোলা পর্যন্ত তুমি সেখানে থাকবে, তারপর তোমার ছুটি। ছাগলনাইয়া আজিজিয়া মাদরাসায় সেই নাহবেমীর থেকে আরম্ভ করে প্রতি বছর একেক জামাত বৃদ্ধি করে শেষ পর্যন্ত মেশকাত বা উলা খোলার পর হযরত নানুপুরী রাহ. এই মুরীদকে নিজের কাছে নিজের মাদরাসায় নিয়ে যান। মাদরাসার নাযেমে তালিমাত বা শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব তাঁকে অর্পণ করেন এবং মুফতী হিসেবে ফতোয়ার দায়িত্বও তাঁর স্কন্ধেই তুলে দেন। বড় বড় আসাতিযায়ে কেরামের মধ্য থেকে কেউ কেউ এই বাচ্চা মৌলভীর কেয়াদত ও ইফতার সক্ষমতা নিয়ে হযরতের খেদমতে এশকালও করেছিলেন, কিন্তু হযরত নানুপুরী রাহ. এ ব্যাপারে পাহাড়ের মতো অটল ও অনড় থাকেন এবং বলেন, তোমাদের পছন্দ না হলে সে তোমাদের মুফতী নয়, আমার মুফতী। কেননা আমার অনেক বিষয়ে ইস্তেফতা বা জানার প্রয়োজন হয় তাই সে আমার মুফতী। এভাবে তাঁকে নিজের সোহবত-সান্নিধ্যে রেখে তালিম ও তারবিয়তীভাবে তথা যাহেরী ও বাতেনী কামালাতের সমাহার তার মধ্যে সৃষ্টি করেন।
এতক্ষণ আমরা যে মুরীদটির কথা বলছিলাম তিনি হলেন বর্তমানে পীরে কামিল হযরত মাওলানা মুফতী সাঈদ আহমদ সাহেব দামাত বারাকাতুহুম। ৮১ সনের পরে ঢাকা বা কোথাও হযরত নানুপুরী রাহ.-এর সাথে তাঁর কোনো মজলিসে মোলাকাত করতে গেলে কথোপকথনের মাঝে হযরতের সাথে আগত একজন খাদেমও মোলাকাত করতেন। মোলাকাতের সময় তাঁর বিনয় ও অভিব্যক্তির কারণে আমি তখন মনে করতাম, তিনি হয়ত মাদরাসারই একজন সাধারণ উস্তাজ হবেন, যিনি হযরতের খাদেম হিসেবে সাথে এসেছেন। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম এবং জানতে পারলাম যে, তিনি নানুপুর মাদরাসার প্রধান মুফতী ও নাযেমে তালীমাত এবং হযরতের একজন আজালে খলীফা।
আমার তো ইলম-কালাম বা আমল-আখলাক কোনোটাই নেই, কিন্তু মনে হয় ৮১-এর নির্বাচনে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর প্রেস সেক্রেটারি থাকার কারণে পত্র-পত্রিকায় আমার নাম-ধাম একটু প্রচারিত হয়ে পড়ায় আমার সাথে মোলাকাতের সময় তাঁর এতটা বিনয়। পরে দেখলাম যে, তা-ও নয়, তাঁর আখলাকই বিনয়ের আখলাক। তাঁর স্বভাবই নিজেকে ফানা করার স্বভাব। না হয় এত বড় উস্তাজ হয়েও শায়খের এ ধরনের গোলামী করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হল কি করে? এই গোলামীর কারণেই তিনি আজ এতটা চমকিত এক ব্যক্তিত্ব হতে পেরেছেন। আর আমরা গোলামী না করার কারণেই সমাজ বা মানুষের কাছে আমাদের দু’ পয়সার মূল্যও নেই। গোলামী মানুষকে মনিব বানিয়ে ছাড়ে। ফানাইয়ত মানুষকে বাকাইয়্যাতের স্তরে উন্নীত করে।
অনেক বছর আগে ফেনীর এক আলেম কথাপ্রসঙ্গে আমাকে বললেন, মুফতী সাঈদ সাহেব লালপোল মাদরাসাকে জমাতে পারবেন না। আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, আপনার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ফেনীতে দেখবেন লালপোল মাদরাসাই সবচেয়ে বেশি চমকে উঠবে ইনশাআলাহ। কেননা এই মাদরাসা তো তিনি করেননি, তাঁকে দিয়ে করানো হয়েছে। হযরত মুফতী সাহেব হুজুরের নিজ যবানেই শুনেছি, মুফতী সাহেব হুজুর নানুপুর থাকাকালে হযরত নানুপুরী হুজুর রাহ.-এর সাথে কোনো এক সফরে নোয়াখালী এসেছিলেন। তখন চট্টগ্রাম ফিরে যাওয়ার পথে লালপোলের কাছে গিয়ে হযরত বললেন, ‘ওয়া .. এর আসেফাশে খদ্দুর জাগা ছও তো’’। মুফতী সাহেব হুজুর আমাকে বললেন, আমি পেরেশান হয়ে গেলাম। জায়গা কেনার জন্য। কিন্তু টাকা কোথায় পাব? আববাকে বললাম, আববাজান ব্যবসায়ী ব্যক্তি ছিলেন বলে তিনি আমাকে কিছু টাকা ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি সেই টাকা দিয়ে বর্তমান মাদরাসার জায়গায় এক খন্ড জমি খরিদ করলাম। হযরতকে যমিন খরিদ করার কথা বললে হযরত বললেন, ‘এডে এককান ঘর গর।’ আমি আবার পেরেশান হয়ে গেলাম। টাকা কোথায় পাব? আবার আববাকে বললাম। আববাজান রাহ. আবারো আমাকে কিছু টাকা দিলেন। আমি একটা ঘর করলাম। হযরতকে ঘর বানানোর খবর দেওয়াতে হযরত বললেন, ‘এ-ডে এককান মক্তব ছালু গরি দেও।’’ আমি তখন তাই করলাম। একবার দক্ষিণ চট্টগ্রামে হযরত নানুপুরী রাহ.-এর সাথে সফর করে নানুপুর ফেরার পথে চট্টগ্রাম শহরে এসে হযরত আমাকে বললেন, ‘ওয়া-! তুঁই লালফোলর মক্তবখান ছা-ই আইয়োগোই।’ আমি এভাবে হযরতের নির্দেশে এখানে নব প্রতিষ্ঠিত মক্তব বা এই নূরানী মাদরাসাখানা দেখভাল করছিলাম। এমতাবস্থায় একদিন হযরত বললেন, ‘ওয়া-! আঁই যতোদিন আছি ততোদিন তুঁই এড নানুফুর থা-ইবানি, আর আঁর মৃত্যুর ফর তুঁই লালফোল যাইবাগোই’’। তাই দেখা যায়, মুফতী সাহেব হুজুর হযরত নানুপুরী হুজুরের ইন্তেকালের পর নানুপুরে তাঁর বিশেষ প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তিনি সেখানে আর বেশি দিন থাকেননি। হযরত মাওলানা জমিরুদ্দীন সাহেব হুজুরের বহু এসরার ও অনুরোধের পর মুফতী সাহেব হুজুর শুধু বলেছিলেন, আমি আমার শায়খের কথা রাখব, না আপনাদের কথা রাখব? আমাকে মুফতী সাহেব হুজুর আরো বলেছেন যে, হযরতের মৃত্যুর পর স্বপ্নযোগেও হযরত আমাকে লালপোল যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তাই আমি কালবিলম্ব না করে লালপোল মাদরাসায় চলে আসি।
এই সমস্ত ঘটনাবলি বলার পর আমি ফেনীর ঐ আলেম সাহেবকে বললাম, ভাই! এই মাদরাসা তো মুফতী সাহেব করেননি, এই মাদরাসা তাঁকে দিয়ে হযরত সুলতান নানুপুরী রাহ. করিয়েছেন। তাই ইনশাআলাহ এই মাদরাসার উত্তর-উত্তর তরক্কী ঘটতেই থাকবে।
আজ এত বছর পর একটি পূর্ণাঙ্গ দাওরা হাদীস মাদরাসা হিসেবে দশ বছর পর্যন্ত দাওরার ফারেগীনদের দশসালা দস্তারবন্দি হতে যাওয়াটা তারই আলামত। আলহামদুলিলাহ। হযরত মুফতী সাঈদ সাহেব হুজুর তাঁর পীরের মতো সমগ্র দেশেই আম মকবুলিয়ত লাভ করেছেন এবং চট্টগ্রাম-নোয়াখালি ছাড়াও দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের অনেক সফর তাঁকে করতে হয়েছে এবং সারা দেশে অগণিত ভক্ত-মুরীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছিল। এমতাবস্থায় হঠাৎ কুদরতের কোনো হেকমতে তিনি দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ঘরবসা হয়ে যান। তাঁর সার্বিক ইফাদিয়তে বাহ্যিকভাবে আমরা কিছু বাধা অনুভব করলেও কুদরতের কাছে হয়ত এর ভিন্ন মূল্যায়ন থাকতে পারে। আমরা শুধু মহান আলাহ তাআলার মহান দরবারে তাঁর আফিয়ত ও ইফাদিয়তের জন্য দরদভরা দুআ ও মোনাজাত করতে পারি।
আলাহ তাআলা তাঁকে সিহহতে কামেলা ও আফিয়তে আজেলা নসীব করুন। আমীন। ষ
[এই লেখাটা যেন অধমের জন্য নাজাতের উসিলা হয় এই দুআটুকু চেয়ে শেষ করছি।]