জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৫   ||   এপ্রিল ২০১৪

বাংলা ভাষায় পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ

অধ্যাপক মুরতাহিন বিলাহ জাসির

আমাদের নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতি আজ নানামুখী হামলার সম্মুখীন। যেসব অঙ্গনে হামলা হচ্ছে তার  অন্যতম হচ্ছে আমাদের ভাষা। পাকিস্তানিদের ভাষা মনে করে শত শত বছর থেকে বাংলায় প্রচলিত আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দকে উৎখাত করে পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার, দেশ প্রভৃতির অনুকরণে সংস্কৃত প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা ছোটবেলা থেকে দেখেছি, বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে তোরণে মেহমানদের জন্য লেখা হতো খোশ-আমদেদ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরই এ শব্দটির বদলে লেখা হচ্ছে স্বাগতমস্বাগতম শব্দটি বাংলা হলে কোনো কথা ছিল না, কিন্তু স্মরণাতীত কাল থেকে সমাজে ব্যবহৃত  খোশ-আমদেদ-কে হঠাৎ বাদ দিয়ে দুর্বোধ্য সংস্কৃত শব্দটি চালু করার যৌক্তিকতা কোথায়? শুধু তাই নয়, আমাদের প্রতিবেশী পৌত্তলিক সম্প্রদায় থেকে ধার করে এনে আমাদের সাহিত্যে এমন সব শব্দ চালু করা হচ্ছে যেগুলো অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ঈমান-আকিদা ও ধ্যান-ধারণার সাথেও সাংঘর্ষিক। সেজন্য সেসব শব্দের স্বরূপ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা কর্তব্য। ভাষার প্রবহমানতা ও স্বাভাবিকত্ব বজায় রাখতে উৎসের পরিবর্তে শব্দের ব্যবহৃত ও প্রচলিত অর্থকে গুরুত্ব দেওয়ার একটি দৃষ্টিভঙ্গি অনেকেই লালন করেন। আমরা সে দৃষ্টিভঙ্গিকে সঙ্গে নিয়েই মনে করি,

অন্তত এ জাতীয় শব্দগুলোর উৎস ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগতি থাকা দরকার। শব্দের ব্যবহারকারী হিসেবে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সহায়ক হবে। নিচে এধরনেরই কতিপয় শব্দের পরিচয় এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা তুলে ধরা হল, তবে বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন আছে। কোনো সচেতন গবেষক এ ব্যাপারে উদ্যোগী হলে সমাজ বিশেষভাবে উপকৃত হবে।

বেদী 

বেদী শব্দটি হিন্দু ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত। শব্দটির অর্থ হিন্দুদের যজ্ঞ বা পূজার জন্য প্রস্ত্তত উচ্চভূমি (বাংলা একাডেমী, সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান)। অথচ যেসব মুসলমান ছাত্র-যুবক ভাষার জন্য চরম আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত শহীদ মিনারের চত্বরকে বলা হয় বেদী। শব্দগতভাবে মিনার ও বেদী সাংঘর্ষিক। বেদী হচ্ছে পৌত্তলিকতার একটি নিদর্শন এবং মিনার হচ্ছে এমন একটি স্থান যেখান থেকে তাওহীদ বা আলাহর একত্বের বাণী প্রচার করা হয়। মসজিদের মিনার থেকে আযানের ভেতর দিয়ে তাওহীদের বাণী উচ্চারণ করা হয় কিন্তু বেদীতে পৌত্তলিকদের দেবতাদের মূর্তি স্থাপন করা হয়, তাদের পূজা করা হয়। এ অবস্থায় শহীদ মিনারের চত্বরকে বেদী বলার কোনো যুক্তি নেই। যারা এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেন তারা কি শহীদ মিনারের চত্বরকে বেদী বলে সচেতনভাবে এটাই বোঝাতে চান যে, মিনারগুলো প্রতীমার সমতুল্য আর একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান হিন্দু পূজা-পার্বণের মতো একটি কাজ?

ব্রহ্মান্ড

ব্রহ্মান্ড (ব্রহ্মা+অন্ড) শব্দটির অর্থ ব্রহ্মার ডিম। বিশ্বব্রহ্মান্ড শব্দটি বাংলাতে বিশ্বজগৎ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ব্রহ্মান্ড শব্দটি পৌত্তলিক হিন্দুদের একটি বিশ্বাসগত ধারণা। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র পুরাণে বলা হয়েছে, মহাপ্রলয়ের পর এই জগৎ অন্ধকারময় ছিল। তখন পরমব্রহ্ম অন্ধকার দূর করে জলের সৃষ্টি করেন। সেই জলে সৃষ্টির বীজ নিক্ষিপ্ত হয়। তখন ঐ বীজ অন্ডে পরিণত হয়। অন্ডের মধ্যে স্বয়ং ব্রহ্মা অবস্থান করতে থাকেন। তারপর এ অন্ড দুভাগে বিভক্ত হলে এক ভাগ আকাশ ও অন্য ভাগ ভূমন্ডলে পরিণত হয় (পৌরাণিক অভিধান, পৃ. ৩৭৮)।

দেখা যাচ্ছে, ব্রহ্মান্ড শব্দটি পৌত্তলিক হিন্দুদের একটি বিশ্বাসগত ধারণা। নিখিল বিশ্বকে একটি ডিম মনে করা যার ভেতর ব্রহ্মা রয়েছেন, পরে ডিমটি দুভাগে বিভক্ত হয়ে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি হওয়া, এসব হচ্ছে হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস। এসব বিশ্বাস মুসলমানদের আকিদা-বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। কোনো মুসলমান হিন্দু দেবতা ব্রহ্মায় যেমন বিশ্বাস করে না, পৌত্তলিক কোনো ধ্যান-ধারণায়ও বিশ্বাস করতে পারে না। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, কেবল আলাহ তাআলাই সমুদয় সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা এবং প্রতিপালক প্রভু।

লক্ষ্মী

লক্ষ্মী হলেন হিন্দুদের দেবতা, ‘‘বিষ্ণুর পত্নী, সম্পদের দেবী, ইন্দিরা, কমলা, পদ্মা, পদ্মালয়া, রমা, শ্রী।’’ (চলন্তিকা)। সাধারণ মুসলমান সমাজে এটা জানা কথা যে, লক্ষ্মী হিন্দুদের এক দেবতার নাম। তা সত্ত্বেও দেখা যায়, অনেকেই বিনা দ্বিধায় বলছে,  লক্ষ্মী মেয়ে, লক্ষ্মী ছেলে। অসাবধান বা নিজের স্বার্থের প্রতি অমনোযোগী লোককে বলা হয় লক্ষ্মীছাড়া। এভাবে মুশরিকদের অনুসরণ  আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তা একটু ভেবে দেখা দরকার। বাংলার শব্দভান্ডারে কি এমন কোনো শব্দ নেই যা লক্ষ্মীর বদলে ব্যবহার করা যায়? 

রাহু

রাহু শব্দটির অর্থ ‘‘গ্রহণকালে চন্দ্রের উপর পতিত পৃথিবীর ছায়া অথবা চন্দ্র কর্তৃক সূর্যমন্ডল আবরণ।’’ (চলন্তিকা)। হিন্দুদের বিশ্বাস, রাহু একটি দৈত্য, যার মাথাকে বিষ্ণু দ্বিখন্ডিত করেছিলেন। ঘটনাটি ছিল এরূপ : একসময় বিষ্ণু দেবতাদেরকে সুধা বিতরণ করছিলেন। তখন দৈত্য রাহু দেবতাদের মাঝে গিয়ে সুধা পান করার চেষ্টা করে। সূর্য দেবতা এবং চন্দ্র দেবতা তখন রাহুকে চিনে ফেলেন এবং বিষ্ণুকে বলেন যে, রাহু সুধা পানের চেষ্টা করছে। সাথে সাথে বিষ্ণু রাহুর মস্তক ছিন্ন করে ফেলেন। সুধা পান করার কারণে রাহুর মস্তক কিন্তু অমর হয়ে যায়। সূর্য এবং চন্দ্র রাহুর প্রতি যে শত্রুতা করেছিল, তার প্রতিশোধ হিসেবেই রাহূ সূর্য এবং চন্দ্রকে গ্রাস করে থাকে (হরিচরণ, ২য়, খন্ড, পৃ. ১৯১৯)। 

দেখা যাচ্ছে, রাহু শব্দটি পৌত্তলিক ধারণার সাথে সম্পৃক্ত। এ বিষয়ে জ্ঞান না থাকার ফলে আমাদের অনেকেই কারো কোনো অনিষ্ট দেখলেই বলেন, সে রাহুগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তারা নিশ্চয়ই পৌত্তলিক অর্থে বলেন না, কিন্তু শব্দটি যেহেতু পৌত্তলিক সংস্কৃতির শব্দ তাই তা বর্জন করা কর্তব্য।

শনি

আমরা জানি, শনি একটি গ্রহের নাম কিন্তু হিন্দুদের বিশ্বাস, শনিগ্রহ সব অবস্থায় অমঙ্গল ডেকে আনে, শনিগ্রহের কোপদৃষ্টি বা শুভদৃষ্টি (উভয়ই অনিষ্টকর) (হরিচরণ, ২য় খন্ড, পৃ. ১৯৮৯)।

বাংলা ভাষায় শনি শব্দটির বেশ প্রচলন দেখা যায়। হিন্দু-মুসলিম সবাই অনিষ্টকর কিছু দেখলেই বলে থাকেন, শনি লেগেছে, শনির দৃষ্টি পড়েছে, শনির দশা। মনে রাখা দরকার, ইসলামে কোনো ধরনের কুসংস্কারের স্থান নেই। পৌত্তলিকদের ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাস করা ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক। কারো অনিষ্ট করার  ক্ষমতা শনি বা অন্য কোনো গ্রহের নেই।   

সূর্যসন্তান

জনৈক ঋষির অভিশাপে মহাভারতের পান্ডু সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে যান। তখন তিনি তাঁর স্ত্রী কুন্তীকে নির্দেশ দেন, কোনো পুরুষের সাথে সহবাস করে পুত্র সন্তান জন্ম দিতে। কুন্তী তখন ধর্ম, বায়ু ও ইন্দ্র এ তিন দেবতার সাথে সহবাস করে যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুন নামে তিনটি পুত্র সন্তান জন্ম দেন। কুন্তীর আরও একটি পুত্র ছিল। সূর্যদেবের সঙ্গে মিলিত হয়ে কুমারী অবস্থায় তিনি এ পুত্রকে জন্ম দিয়েছিলেন, তবে সমাজের ভয়ে জন্মলগ্নেই তিনি পুত্রটিকে পরিত্যাগ করেছিলেন। কুন্তীর এ পুত্রটি এক সুতারের ঘরে মানুষ হয়েছিল। সে স্বীয় প্রতিভাবলে অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে মহাবীর কর্ণ হিসেবে মহাভারতে খ্যাতি লাভ করেছিল। কর্ণ সূর্যদেবের ঔরসে জন্মগ্রহণ করে মহাবীর হয়েছিল, এ কারণে কিছু লোক কর্ণের বীরত্বগাথা স্মরণ করে বীর যোদ্ধাদের সূর্যসন্তান বলে আখ্যায়িত করে থাকে।’’ (আরিফুল হক, পৃ. ২৫)।

দেখা যাচ্ছে, সূর্যসন্তান হচ্ছে হিন্দুশাস্ত্র মহাভারতের একটি চরিত্র, যে ছিল একজন জারজ সন্তান। কোনো মুসলমান বীর পুরুষের জন্য এমন শব্দ ব্যবহার করা কেবল যে অপমানজনক তা নয়, আমাদের ঈমান-আকিদার সাথে সাংঘর্ষিকও বটে। কাজেই, বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বা অন্য কারো জন্য অবমাননাকর

সূর্যসন্তান শব্দটির ব্যবহার অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

ধোয়া তুলসীপাতা

তুলসী হিন্দুদের নিকট একটি অতি পবিত্র গাছ। গাছটি পবিত্র হওয়ায় তার পাতাকেও পবিত্র মনে করা হয়। এ গাছটির পবিত্র হওয়ার বিশেষ কারণ আছে। যেসব গোপীর সাথে শ্রীকৃষ্ণের বিশেষ সম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যে তুলসী নামক নারী ছিলেন তাঁর অতি প্রিয়। শ্রীকৃষ্ণের মামী রাধা যখন বিষয়টি  জানতে পারলেন তখন তিনি তুলসীকে অভিশাপ দিলেন। এ অভিশাপের ফলে তুলসী মানবযোনী এবং সুদামা গোপ দানবযোনী প্রাপ্ত হন। সুদামা হলেন শঙ্খচূড় দানব আর তুলসী হলেন তাঁহার পত্নী। পত্নীর সতীত্বনাশে পতির মৃত্যু হইবে ব্রহ্মার এই বর হেতু নারায়ণ শঙ্খচূড়-বেশে তুলসীর সতীত্ব নাশ করেন। তুলসী তাহা জানিয়া তুমি পাষাণ হও এবং জন্মান্তরে তোমার আত্মবিস্মৃতি হইবে নারায়ণকে এই শাপ দেন। নারায়ণ তুলসীকে অভিশাপ দিয়ে বলেন, তুমি রমাসদৃশী হও, তোমার দেহ গন্ডকী নদী ও কেশরাশি পুণ্যবৃক্ষ তুলসী হউক (ব্রহ্মবৈবর্ত, প্রকৃতিখন্ড)।’’ (বঙ্গীয় শব্দকোষ, ১ম খন্ড, পৃ. ১০৫১)।

বাংলা ভাষায় অমলিন কলঙ্কহীন চরিত্রকে তুলসী পাতার সাথে তুলনা করা হয়। বলা হয় ধোয়া তুলসী পাতা। হিন্দু লেখকদের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্যে ও মুখের ভাষায় শব্দটি ঢুকেছে বলে মনে হয়।

এছাড়াও আচার্য-উপাচার্য, পীট, আপামর, জয়ন্তি, তিলোত্তমা, সতি, সতীর্থ, স্নাতক, শতরূপা প্রভৃতি শব্দাবলি আমাদের সমাজে বেশ ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ এগুলোর সাথে কোন না কোনভাবে হিন্দু ধর্মের আচার-আচরণ বা ধর্মীয় কোন ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে।

এ লেখা বিশিষ্ট নাট্যকার আরিফুল হকের ভাষায়ই শেষ করছি। ‘‘বড় বেশী দেরি হয়ে গেছে। আজও যদি আমরা ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সতর্ক না হই, তাহলে আমাদের ব্যক্তিত্ব, স্বকীয়তা ও আত্মা, বিজাতীয় ধর্ম, কালচারের হাতে বাঁধা পড়ে জাতীয় স্বকীয়তা খুইয়ে ফেলবে।

পশ্চিমবংগের আনন্দবাজার, দেশ পত্রিকার ভাষা যদি আমাদের আদর্শ হয়, তাদের বিকৃতি, শ্রুতিকটুতা, অশীল পৌরাণিক উপমা, অপভ্রংশ যদি আমাদের কাছে ভাষার সৌন্দর্য অলংকার জ্ঞানে বরণীয় হয়, পক্ষান্তরে আমাদের জনগণের ভাষা-উপমা যদি অভদ্র, গেয়োঁ, সাম্প্রদায়িক জ্ঞানে বর্জিত হয়, তাহলে স্বাধীন জাতিসত্তা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সব চেষ্টা, সব আস্ফালন বৃথায় পর্যবসিত হবে।’’

তথ্যসূত্র :

১। সুধীরচন্দ্র সরকার, পৌরাণিক অভিধান

২। হরিচরণ বন্দোপধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ

৩। ঐ, ঋগ্বেদ-সংহিতা ১ম খন্ড

৪। রাজশেখর বসু, চলন্তিকা

৫। বাংলা একাডেমী, সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান

৬। আরিফুল হক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও প্রতিরোধ

৭। জহুরী, শব্দ সংস্কৃতির ছোবল

৮। আবুল মনসুর আহমদ, বাংলাদেশের কালচার

৯। ফজলুর রহমান খান, ইসলামে শিক্ষা ব্যবস্থা ষ

 

 

advertisement