ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বিপদাপদের বিচার-বিশ্লেষণে (১)
আপনি কেমন আছেন? আমার কোন সন্দেহ নেই প্রিয় পাঠক! আপনি অবশ্যই বলবেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ‘ভালো আছি।’ কিন্তু এ প্রশ্নের এমন সুখশ্রাব্য উত্তর কি আপনি সব সময়ই শুনতে পান? নিশ্চিত করেই বলা যায় পান না; বরং বললে অসত্য হবে না, এ উত্তর এখন আর খুব সহজলভ্য নেই। অনেকে মুখে উচ্চারণ করলেও তাতে যেন ঠিক প্রাণের স্পর্শ মেলে না। ব্যক্ত ‘ভালো আছি’-এর ভেতর দিয়ে অব্যক্ত ‘ভালো নেই’-এর হাহাকারই যেন কানে বাজে।
চৌদিকে শুধু ভালো না থাকার বিলাপ। অভিযোগ বিস্তর। অসুখ-বিসুখ, অভাব-অনটন, বালা-মসিবত, স্বামী-স্ত্রীতে কলহ, সন্তান-সন্ততির অবাধ্যতা, পিতামাতার সাথে দুর্ব্যবহার, প্রতিবেশীর উপদ্রব, প্রতিপক্ষের জুলুম-অত্যাচার, শক্তিমানের দমন-নিপীড়ন, আপনজনের শত্রুতা, খরা-বন্যা-পরিবেশ-প্রতিকূলতা, নেতার ডিগবাজি, দলে ভাঙন, বিদেশী আগ্রাসন, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সর্বগ্রাসী ফ্যাসাদ ও ব্যক্তিক-সামষ্টিক বহুমুখী জ্বালা-যন্ত্রণার অনিঃশেষ ফিরিস্তি। এত রাজ্যের বিপত্তির মধ্যে বাস করে ‘ভালো আছি’ বলা কঠিন বৈ কি!
অভিযোগ অবাস্তব নয়। মানুষ নানারকম জ্বালা-যন্ত্রণার ভেতর দিন গুজরান করছে। আমরা কেউ নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপন করছি না। কমবেশি সমস্যা সকলেরই আছে। অতীতেও ছিল। ভবিষ্যতেও থাকবে। ইহজীবনই সমস্যাসঙ্কুল। এখানে নিষ্কন্টক জীবন অসম্ভব। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي كَبَدٍ
আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট-ক্লেশের ভেতর’ (বালাদ : ৪)। কখনও তার দৈহিক কষ্ট দেখা দেয়, কখনও মানসিক এবং কখনও উভয় রকম। রোগ-ব্যাধি, শোক-তাপ, দুঃখ-দুশ্চিন্তা মানব-জীবনের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অনিবার্যতাকে মানুষ কীভাবে নেবে? বাস্তবে নেওয়া তো হচ্ছে বিভিন্নভাবে। বিশ্বাস যাদের শিথিল, দ্বীন ও ঈমানের কোন চর্চা যারা করে না, দ্বীনদারদের সংশ্রবও এড়িয়ে চলে, তারা অবিশ্বাসীদের মতই এসবকে কেবল প্রাকৃতিক কারণ ঘটিত মনে করে। নিছক পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে বিধায় এর সাথে নিজ ঈমান-আমল জড়ানোকে অহেতুক ঠাওরায়। ইহজাগতিকতার দেয়াল দ্বারা তাদের অন্তরাত্মা এমন কঠিনভাবে বেষ্টিত যে, কোন বালা-মসিবতের তাড়াতেও পারলৌকিক ভাবনা সেখানে পৌঁছুতে পারে না, কোন দুর্বিপাকে তা প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ পায় না। তাদের মন-মস্তিষ্ক কেবলই জাগতিক কারণ খুঁজে বেড়ায়। সকল অনাকাঙ্ক্ষিতের রোধ তারা কেবল জাগতিক ব্যবস্থা দ্বারাই করতে চায়। ‘বান’ রোধে ‘বাঁধ’-ই তাদের শেষ কথা। সুতরাং আইন কর, ব্যবস্থা নাও, শাসন কর, পুলিশ লাগাও, পাহারা বসাও, প্রতিরোধ কর এবং মুকাবিলার সকল উপায় অবলম্বন কর, সেটাই সমাধান এবং তাতেই রক্ষা।
কথার ভেতর সত্যতা আছে। দুনিয়া দারুল আসবাব। এখানে উপায় অবলম্বনের সাথে ফলাফল সম্পৃক্ত। আসবাব-উপকরণ ছাড়া অভীষ্ট লাভ হয় না। উপায় যদি উপেক্ষিত হয় কিংবা আসবাব-উপকরণ হয় অপর্যাপ্ত, তবে ইষ্টলাভ সুদূর পরাহত কিংবা হবে যৎসামান্য। কাজেই যা কিছু কাঙ্ক্ষিত তার অর্জনার্থে যেমন, তেমনি যা কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত তার প্রতিরোধেও উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় আসবাব-উপকরণ অবশ্যগ্রহণীয়, এটাই ইসলামের শিক্ষা, কিন্তু পর্যবেক্ষণ অপূর্ণ থেকে যায় যদি দৃষ্টি আটকে যায় জড়ত্বের দেয়ালে এবং ভাবনা থেমে যায় বাহ্য উপায়-অবলম্বনের বৃত্তে। অর্থাৎ বাহ্যিক উপায় অবলম্বনে অবহেলার কারণে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় ও পতন-অবক্ষয় ত্বরান্বিত হয়-এ কথা সত্য, কিন্তু এটাকেই একমাত্র কারণ বললে তা হবে অর্ধসত্য, এ দৃষ্টিভঙ্গী একরকম প্রান্তিকতা ও একদেশদর্শিতা।
এমন তো কতই দেখা গেছে যে, সব রকম উপায় অবলম্বন সত্ত্বেও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। পূর্ণ সচেতনতা সত্ত্বেও দুর্বিপাক এড়ানো যায়নি, শতভাগ স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিও কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছে, বিজ্ঞানসম্মত চাষাবাদ সত্ত্বেও ফসল লক্ষমাত্রায় উপনীত হয়নি। এবংবিধ আরও কত ক্ষেত্রে বাহ্যিক উপায়-উপকরণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় সে বাস্তবতা কারও অজানা নয়। বিজ্ঞানের এই চরমোৎকর্ষের যুগে, প্রযুক্তি যখন ঘরে ঘরে, আধুনিক অব্যর্থ (?) উপায়-উপকরণের যখন সয়লাব, তখনও কেন এত ব্যর্থতা?
কেন প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বড় বড় দেশ সুনামি কবলিত হয়? ছাইঝড় ও তুষার ঝড়ে কেন উন্নত বিশ্ব নাকাল-লবেজান হয়? প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক থেকে উন্নত প্রযুক্তির কোন দেশই নিস্তার পাচ্ছে না। তাছাড়া রোগ-বালাই অশান্তি-অস্থিরতা কোথায় না আছে? মানসিক রোগ বিশেষত জীবনের প্রতি হতাশা ও তজ্জনিত আত্মহত্যার প্রবণতা আজ উন্নত বিশ্বের এক অপ্রতিকার্য মহামারি। এসব থেকে মুক্তির জন্য মানুষ তার বিদ্যা-বুদ্ধি ও শক্তি-ক্ষমতার কি বিচিত্র ব্যবহারই না করছে? কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল দূরস্তান। না দুঃখ ও জরা রোধ হয়েছে, না শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। বোঝা গেল এসবের জন্য বাহ্যিক আসবাব-উপকরণই শেষ কথা নয়। বালা-মসিবত ও অশান্তি অস্থিরতা কেবল বাহ্যিক বা বস্ত্তগত ব্যবস্থাপনার ত্রুটি থেকেই দেখা দেয় না; বরং এর এক গূঢ় কারণও আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সেদিকে চোখ ফেরানো না হবে এবং সে ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি পিছু ছাড়ার নয়। সে গূঢ় কারণ আর কিছুই নয়-মানুষের পাপাচার।
মুসলিমমাত্রই বিশ্বাস করে আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন মূলত তাঁর ইবাদত-আনুগত্যের জন্য। যেমন ইরশাদ-
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
আমি জিন ও ইনসানকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে (যারিয়াত : ৫৬)।
পারিভাষিক ইবাদত তো নামায, রোযা, হজ যাকাত ইত্যাদি। কিন্তু ব্যাপকার্থে জীবনের প্রতিটি কাজে আল্লাহ তাআলার প্রতি আবদিয়াত ও দাসত্ব বা নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশকেই ইবাদত বলে। মানুষ দুনিয়ার জীবনে এভাবে চলবে বলেই জগতের সবকিছুকে তার সেবায় নিয়োজিত করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মানুষ যদি তার সে কর্তব্য পালন না করে; বরং আল্লাহ তাআলার অবাধ্যাচরণে লিপ্ত হয়ে পড়ে তবে সৃষ্টিরাজির সেবা লাভ করার কোন অধিকার তার থাকে না। এরূপ ক্ষেত্রে ধ্বংসপ্রাপ্তিই হয়ে যায় তার অবধারিত পরিণাম। কিন্তু আল্লাহ তাআলা পরম দয়ালু। প্রথম যাত্রাতেই তিনি ধ্বংস করেন না। তিনি ধরেন পর্যায়ক্রমে। প্রথমে লঘুশাস্তি দিয়ে সতর্ক করেন। তাতে বোধোদয় না ঘটলে শাস্তির মাত্রা বাড়াতে থাকেন। পরিশেষে ধরেন শক্ত হাতে (আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে তার ধরা হতে আশ্রয় চাই)।
সুতরাং জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, ঝড়-ঝঞ্ঝা, অনাবৃষ্টিসহ দৈহিক, মানসিক এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় যত রকম বালা-মসিবত ও জ্বালা-যন্ত্রণা মানুষকে পোহাতে হয়, সেজন্য মানুষের কর্মপন্থাই মূলত দায়ী। সে আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা করছে বলেই পরিস্থিতি তার অনুকূলে না থেকে প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে। আল্লাহ তাআলা জানান-
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
‘মানুষের কৃর্তকর্মের দরুণ জলে-স্থলে বিপর্যয় দেখা দেয়, যা দ্বারা আল্লাহ তাদেরকে তাদের কিছু কিছু কাজের শাস্তি ভোগ করান, যাতে তারা (সুপথে) ফিরে আসে, (রূম : ৪১)।
অন্যত্র বলেন-
وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَى دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
‘গুরুশাস্তির (অর্থাৎ জাহান্নামের শাস্তির) আগে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘুশাস্তি ভোগ করাব, যাতে তারা ফিরে আসে’ (সাজদা : ২১)। পার্থিব জীবনের বালা-মসিবত ও দুঃখ-কষ্টই হল সেই লঘুশাস্তি, যা আল্লাহ তাআলা মানুষকে তাদের অবাধ্যাচরণ ও পাপকর্মের কারণে দিয়ে থাকেন। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
‘‘যখন জাতীয় সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করা হবে, আমানতের খেয়ানত করা হবে, যাকাতকে অর্থদন্ড মনে (করে তা আদায়ে গড়িমসি) করা হবে, দ্বীন ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে শিক্ষালাভ করা হবে, লোকে স্ত্রীর বশ্যতা ও মায়ের অবাধ্যতা করবে, বন্ধুকে কাছে টেনে পিতাকে দূরে সরিয়ে দেবে, মসজিদে হইচই করা হবে, গোত্রপতি হবে তাদের মধ্যকার পাপীজন, জাতির নেতা হবে তাদের মধ্যকার নিকৃষ্টতম ব্যক্তি, ব্যক্তিকে সম্মান করা হবে তার অনিষ্টের ভয়ে, গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের ছড়াছড়ি হবে, ব্যাপকভাবে মদপান করা হবে এবং জাতির শেষদিকের লোকেরা প্রথমদিকের লোকদেরকে গালমন্দ করবে, তখন যেন তারা অপেক্ষায় থাকে অগ্নিবায়ু (টর্নেডো), ভূমিকম্প, ভূমিধস, বিকার-বিকৃতি ও শিলাবর্ষণের। সেই সংগে (কিয়ামতের) আরও বহু নিদর্শন (স্বরূপ শাস্তি)-এর, যা উপর্যুপরি আপতিত হতে থাকবে, যেমন পুরনো মালার সুতা ছিঁড়ে গেলে তার দানাগুলো ক্রমাগত গড়িয়ে পড়ে’’ (জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৩৫৮)।
এ হাদীসে আসমানী-যমিনী বালা-মসিবতের কারণ হিসেবে যে সব ‘পাপকর্ম’-এর উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমান সমাজে তার কোনটি না আছে? অত্যন্ত ভয়াবহরূপেই আছে। সুতরাং বিপদাপদ রোধে কেবল বস্ত্তগত ব্যবস্থা গ্রহণই যথেষ্ট নয়। তা গ্রহণের সাথে সাথে এসব পাপের দিকেও নজর দেওয়া দরকার। পাপ তো এমনিতেও বর্জনীয় ছিল, যেহেতু মনুষ্যত্বের সাথে তা যায় না। মানুষকে সৃষ্টি ইবাদতের জন্যেই করা হয়েছে। এজন্য নয় যে, সে পাপ করবে, আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হবে। তদুপরি পাপ যখন মানুষের নিরাপত্তায় বিঘ্ন-ঘটায় এবং তার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তখন তো আরও বেশি গুরুত্বের সাথে এর থেকে দূরে থাকা উচিত। তা ছাড়া বাহ্যিক ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠুতার সাথেও পাপ-পরিহারের নিবিড় সম্পর্ক আছে। কেননা পাপী ব্যক্তি যে ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাতে আল্লাহভীতির চেতনা ও আখিরাতে জবাবদিহিতার তাড়না না থাকার কারণে সর্বদা ব্যক্তিস্বার্থকেই বড় করে দেখে। ফলে তার গৃহীত প্রতিটি ব্যবস্থা উপস্থিত তার স্বার্থ রক্ষা করলেও অন্যদের স্বার্থকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং পরিণামে সে ব্যবস্থা তার নিজের জন্যও বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। অতিমাত্রায় যন্ত্রনির্ভরতা ও অবিবেচনাপ্রসূত যান্ত্রিক প্রতিযোগিতাপ্রসূত যে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন আজকের মানব-সভ্যতা, যথা পরিবেশদূষণ, শব্দদূষণ, বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধি, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতাবৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্যে বিপর্যয়, নিত্যনতুন রোগের সৃষ্টি, তেজষ্ক্রীয় আবর্জনার ছোবলে জলবায়ুতে বিষক্রিয়াসহ এন্তার দূষণযন্ত্রণায় আধুনিক মানুষের খাবি খাওয়া কি সেই বুমেরাংয়ের জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত নয়? পাপবোধহীন জড়সভ্যতা এভাবেই একদেশদর্শী বস্ত্তব্যবস্থা ও বাহ্যিক উপায় অবলম্বনের আদিখ্যেতায় সর্বগ্রাসী ধ্বংসের জোগাড়যন্ত্র চূড়ান্ত করছে। এর থেকে মুক্তির উপায় একটাই-সভ্যতার মর্মমূলে পাপভীতির উজ্জীবন। মহল বিশেষের মধ্যে এ বোধের লালন যথেষ্ট নয়; বরং দরকার এর সার্বজনীন চর্চা। সর্বমহলের মানুষ পাপ-পরিহারে অভ্যস্ত হতে পারলেই মানবসভ্যতার হেফাযত সম্ভব হতে পারে। তাতে প্রথমত মনুষ্যত্বের মহিমা অক্ষুণ্ণ থাকবে, দ্বিতীয়ত বিপদ-আপদ থেকে আত্মরক্ষার গূঢ়ব্যবস্থা সম্পন্ন হবে এবং তৃতীয়ত এর ফলে বস্ত্তগত ব্যবস্থাসমূহও সুষ্ঠু ও নিখুঁত হবে।
বলা যেতে পারে সর্বস্তরের মানুষ পাপ পরিহার করবে-এটা এক অসম্ভব কল্পনা নয় কি? অসম্ভব কল্পনাই বটে। কিন্তু তবু প্রচার ও প্রচেষ্টার ক্রমবিস্তার জরুরি। শুরুটা হবে নিজের থেকে। তারপর পরিবার-প্রতিবেশী-আত্মীয়-স্বজন-সমাজ এবং এভাবে নিজ ক্ষমতার বিস্তার অনুযায়ী যতদূর সম্ভব। একজন মুমিনের চোখে তো সারাজাহানই আপন ভূম। যত বেশি সংখ্যক সাড়া দেবে সুফল তত বেশি হবে। কে সাড়া দেবে, কে দেবে না তা তো জানা নেই। কাছের-দূরের যে কেউই প্রস্ত্তত হয়ে যেতে পারে। সুতরাং ডাক ও চেষ্টা হোক দূরবিস্তৃত। আর কিছু না হোক অন্ততপক্ষে আপনরক্ষার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। তাই ডাক শুনে কেউ না আসলেও একলা চল ওরে! ইরশাদ হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لَا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
‘হে মুমিনগণ! তোমাদের কর্তব্য আপনাকে শোধরানো। তোমরা নিজেরা যদি সৎপথে চলো, তবে যে বিপথগামিতা অবলম্বন করেছে সে তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না, আল্লাহরই কাছে তোমাদেরকে ফিরে যেতে হবে, তখন তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন-যা কিছু তোমরা ইহজীবনে করতে’ (মায়িদা : ১০৫)।
মোটকথা পাপ পরিহার জরুরি। এটা বিপদাপদের অন্যতম প্রধান কারণ। বস্ত্তগত ব্যবস্থাপনার ত্রুটিই একমাত্র কারণ নয়। কেবল সেটাকেই কারণ মনে করা চরম একদেশদর্শিতা। তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
এর বিপরীত প্রান্তিকতা হল বস্ত্তগত ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাহ্য করা। যারা পাপ-পুণ্যের ব্যাপারে সচেতন, আখিরাতের জবাবদিহিতায় যাদের দৃষ্টি আছে, চেতনা শানিত ও দৃষ্টি প্রসারিত না হওয়ার কারণে তাদের অনেকে এ জাতীয় প্রান্তিকতার স্বীকার হয়। ফলে বিপদাপদে তারা মুষড়ে পড়ে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। অনেককেই হতাশাব্যঞ্জক কথা বলতে দেখা যায়। কেউ তো বিভিন্ন রকমের অভিযোগ-আপত্তিও উত্থাপন করে।
তারা মনে করে আমি তো মাশাআল্লাহ দ্বীনের উপর আছি, অন্যদের তুলনায় পাপকাজও কম করি, তারপরও আমার এই বিপদ, আমার এত ঝামেলা, অথচ যারা দ্বীন মানে না বা দ্বীনের উপর চলে না, তারা দিব্যি সুখে। তাদের এত বিপদাপদ নেই এবং নেই অভাব-অভিযোগ।
এ ব্যাপারে কথা অনেক। সর্বপ্রথম নিজের দ্বীন ও ঈমানকে খতিয়ে দেখা দরকার। কেননা এ জাতীয় অভিযোগ-আপত্তি বিশুদ্ধ ঈমানের সাথে যায় না। ঈমানের দাবিই হল সর্বাবস্থায় আল্লাহতে সমর্পিত থাকা, তিনি যখন যে হালতে রাখেন তাতে সন্তুষ্ট থাকা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে শুকর ও দুঃখ-কষ্টে সবর করা। এর নাম রিযা বিল কাযা। এটা ফরয। এই গুণ যে মুমিনের অর্জিত হয়ে যায়, তার পক্ষে সবটা হালই মঙ্গল। নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মুমিনের ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক। তার পক্ষে তার সবকিছুই মঙ্গল। মুমিন ছাড়া অন্য কারও অবস্থা সেরকম নয়। তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেখা দিলে শুকর আদায় করে যা তার পক্ষে মঙ্গল আবার যদি দুঃখ-কষ্ট দেখা দেয়, সবর করে, এটাও তার পক্ষে মঙ্গল (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৯৯৯)।
সুতরাং প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি কোনও অবস্থায়ই অভিযোগ প্রকাশ করতে পারে না, যেহেতু অবস্থা কোনওটাই তার পক্ষে ক্ষতিকর নয়। হাঁ, আমরা দুর্বল বিধায় দুঃখ-কষ্ট চেয়ে নেব না, শান্তি ও নিরাপত্তাই চাব এবং দুঃখ-কষ্ট দেখা দিলে আল্লাহ তাআলার কাছেই তা থেকে মুক্তির জন্য দুআ করব, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার কোন সুযোগ নেই।
তা সত্ত্বেও মনে কোন খটকা জাগতে পারে, শয়তান ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করতে পারে কিংবা মানুষ-শয়তান পারে উসকানি দিতে। এরূপ ক্ষেত্রে প্রয়োজন তওবা-ইসতিগফারের সাথে নিজের দ্বীন ও ঈমানকে খতিয়ে দেখা। এটাই এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় কথা। বস্ত্তত আমরা নিজেদের ব্যাপারে বড় সুধারণার শিকার। দ্বীনদারীর লেবেল আছে, লোকেও দ্বীনদার মনে করে, মসজিদে যাতায়াত আছে, সেই সঙ্গে দ্বীনী কোন মেহনতের সাথেও যদি সম্পর্ক থাকে, তাইলে তো ষোল কলায় পূর্ণ এক পাক্কা মুসলিম।
দ্বীন ও ঈমানে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ ভাবা হয় বলেই খটকা লাগে আমার কেন দুঃখ-কষ্ট থাকবে? শয়তানের ওয়াসওয়াসা ও অন্যের উসকানিতে কাবু হয়ে ভাবি-ঠিকই তো আমার কেন এ অবস্থা? অথচ পূর্ণাঙ্গ ভাবটিই নিজের অপূর্ণতার বড় দলীল। দ্বীনদারীতে যে যত পূর্ণাঙ্গ সে নিজেকে ততটাই অপূর্ণ মনে করে। আল্লাহ তাআলার গৌরব-মহিমার সামনে নিজ ক্ষুদ্রতা ও হীনতা ছাড়া আর কিছুই তার চোখে পড়ে না। মহাগরিয়ান, সর্বাধিপতি সত্তার বিপরীতে নিজ ‘ইবাদত-আনুগত্যকে বড় তুচ্ছ মনে হয়। হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত জিন ও ইনসান আছে, সকলেই যদি তোমাদের মধ্যকার শ্রেষ্ঠতম আল্লাহভীরু হৃদয়ওয়ালার মত হয়ে যায়, তাতে আমার রাজত্বে কণামাত্র বাড়বে না। হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত জিন ও ইনসান আছে সকলেই যদি তোমাদের মধ্যকার সর্বাপেক্ষা ঘোর পাপিষ্ঠমনা ব্যক্তির মত হয়ে যায়, তাতেও আমার রাজত্বে কণামাত্র কমবে না’’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৭৭)। এহেন বেনিয়ায মালিকের সামনে আপন কৃতিত্বের বড়াই করতে পারে কোন গোলাম? তাই প্রকৃত কৃতীপুরুষেরা সর্বকালে নিজেদেরকে ত্রুটিপূর্ণই মনে করে আসছে। এটাই নবী-রাসূল-সাহাবা-আওলিয়ার চরিত্র।
সুতরাং দৃষ্টি চলে যাক নিজ ত্রুটির দিকে। আল্লাহ তাআলার হুকুম হল-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً
তোমরা ইসলামে প্রবেশ কর পূর্ণাঙ্গরূপে (বাকারা : ২০৮)। কুরআন মাজীদ পূর্ণাঙ্গ ইসলামের রূপরেখা। হাদীস শরীফ তার ব্যাখ্যা। সামনে পবিত্র কুরআন ও হাদীস রেখে নিজ জীবনকে তার সাথে মিলিয়ে দেখা হোক। কুরআন-হাদীসের পাতার সাথে জীবন-পাতার মিল ঠিক কতখানি? সন্তোষবোধ করার মত কী? শয়তানী অভিযোগকে আমলে নেওয়ার আগে এই হিসাবটুকুই করা হোক না! খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর বিখ্যাত উক্তি-
حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا
হিসাব তো একদিন তোমাদের নেওয়াই হবে, তার আগে নিজেরাই নিজেদের হিসাব নিয়ে নাও (জামে তিরমিযী, ২৪৫৯)। হিসাব নিলে দেখা যাবে গরমিল বড় বেশি। ঈমান-আকায়েদ, ইবাদত, আখলাক সবকিছুই হিসাবের আওতায় চলে আসুক। আল্লাহ তাআলার হকসমূহ ঠিক কী পরিমাণ আদায় করা হচ্ছে। বান্দার হক তো বিপুল। বলা যায় ইসলামের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই বান্দার হক সম্পর্কিত। সে হক আদায় না করা জুলুম। আছে পিতামাতার হক, সন্তানের হক, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক হক, ভাই-বোনের হক, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর হক, আরও আছে বন্ধু, সংগী-সাথী, সহপাঠী, সহযাত্রী, পথিক-মুসাফির, ভক্ত-অনুরক্ত, সহকর্মী, অধীনস্থ এবং সম্পর্কের বিস্তার অনুযায়ী হকের বহুদূর বিস্তার। এমনকি পশুপাখী ও পরিবেশেরও হক। যার যতটুকু হক অনাদায় থাকবে, তার প্রতি ঠিক ততটুকু জুলুম হয়ে যাবে। লক্ষ করলে দেখা যাবে আমাদের জুলুমের থাবা বহুদূর প্রসারিত। নিজেকে বেশ নিরীহ মনে হয়, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে যে কত বড় জালিম তা অনুভব করি না। ঘরে-বাইরে সর্বত্র হরহামেশাই আমাদের দ্বারা অন্যের হক নষ্ট-অধিকার খর্ব হচ্ছে, অথচ সে চেতনাই নাই। তাই তৃপ্তির ঢেকুর তুলাই যে, আমি একজন মুসলিম। অথচ প্রকৃত মুসলিমের চির পরিচিত সংজ্ঞা -
المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده
মুসলিম তো সেই, যার হাত ও মুখ (অর্থাৎ সর্বতোভাবে তার পক্ষ) হতে অন্য মুসলিম নিরাপদে থাকে আর মুমিন সেই, যার অনিষ্ট থেকে সমস্ত মানুষ নিরাপদ থাকে। কিন্তু আমার পক্ষ হতে সেই নিরাপত্তা মানুষ পাচ্ছে কি? আমরা অনেকেই হয়ত সরাসরি অন্যের রক্তপাত ঘটাই না, কিন্তু কোনও না কোনওভাবে আমার দ্বারা অন্যের দৈহিক ক্ষতি হয়ে যায়, আর সেদিকে লক্ষ নেই। আর অন্যের মাল ও ইজ্জতের ক্ষতি সাধনে তো আমরা একদম বেপরোয়া। এভাবে আমরা একে অন্যের উপর অবলীলায় জুলুম করে যাচ্ছি। হাদীসে কুদসীতে ইরশাদ-
يا عبادي إني حرمت الظلم على نفسي وجعلت بينكم محرما فلا تظالموا
হে আমার বান্দাগণ! আমি জুলুম করাকে নিজের প্রতি হারাম করেছি এবং তাকে তোমাদের মধ্যেও হারাম করে দিয়েছি। সুতরাং পরস্পরে একে অন্যের প্রতি জুলুম করো না। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৪৯২)।
শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবনের জন্য ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত থাকা শর্ত। যে ব্যক্তি অন্যের প্রতি জুলুম করে সে কেবল অন্যেরই ক্ষতি করে না, নিজ জীবনের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। আর সমাজের অধিকাংশ লোকেরই যখন চরিত্র হয়ে যায় জুলুমবাজী অর্থাৎ যারা পারস্পরিক হক আদায়ের কোন তোয়াক্কা করে না, সেই সমাজ দুর্যোগ কবলিত হবেই। হাদীসে ইরশাদ (অর্থ) তোমরা আমার কথা শোন, তা হলে বেঁচে থাকতে পারবে-সাবধান, তোমরা জুলুম করো না। সাবধান তোমরা জুলুম করো না। সাবধান তোমরা জুলুম করো না! (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ২০৬৯৫)।
অর্থাৎ যেমন প্রাণরক্ষার জন্য, তেমনি সম্মানজনক ও নিরাপদ জীবনের জন্য জুলুম না করা শর্ত। সেই জুলুম যখন আমরা ব্যাপকভাবেই করছি তখন নিরাপদ জীবনের আশা কীভাবে করতে পারি? এবং তখন কেন আসমানী-যমীনী বালা-মসিবত আমাদেরকে ঘিরে ধরবে না? জুলুম এমনই এক অপরাধ যার শাস্তি আল্লাহ তাআলা নগদ ইহজগতেও দিয়ে দেন, সেই সংগে আখিরাতের আযাব তো রয়েছেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) এমনই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি! তিনি জনপদসমূহকে শাস্তি দান করে থাকেন, যখন তারা জুলুমে রত থাকে। নিশ্চয়ই তাঁর শাস্তি মর্মন্তুদ, কঠিন (হূদ : ১০২)। নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إن الله ليملي الظالم حتى إذا أخذه لم يفلته
আল্লাহ তাআলা জালেমকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। পরিশেষে যখন ধরেন তখন আর ছাড়েন না (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪৬৮৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৮৩)।
মোটকথা নিজ আমলের পর্যবেক্ষণ দরকার। একজন মুসলিমের যেমন হওয়া দরকার, আমি ঠিক তা হতে পেরেছি কি না। তা যদি না হতে পারি, আমার নীতি-নৈতিকতা ও আচার-আচরণ যদি মুসলিমসুলভ না হয়, তবে বিপদাপদ ও যে কোন অশুভতার জন্য অন্যকে দোষারোপ না করে, বরং তিরস্কার নিজেকেই করা উচিত। আল্লাহ তাআলা হাদীসে কুদসীতে বলেন, হে আমার বান্দাগণ! আমি তোমাদের কর্মকান্ড তোমাদের জন্য পরিপূর্ণভাবে হিসাব করে রাখি। অতপর আমি তোমাদেরকে তার বদলা দান করি। কাজেই যে কেউ শুভফল পায়, সে যেন আল্লাহর শুকর আদায় করে, আর যে কেউ তার বিপরীত পায়, সে যেন তার নিজেকেই দোষারোপ করে (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৭৭)।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)