একই দিনে ঈদের বিষয় দায়িত্বশীলদের উপর ছেড়ে দিন-৯
মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দলীলের দিক থেকে কোন মাযহাবটি অগ্রগণ্য
ফিকহের বিধানে চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য কি না এ বিষয়ে আলহামদুলিলাহ খাইরুল কুরূনের আইম্মা ও ফুকাহা এবং পরের যুগের ইমাম-ফকীহগণের মাযহাব মোটামুটি বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু কোন মাযহাবের দলীল কী এবং দলীলের বিচারে কোন মাযহাব অগ্রগণ্য এ বিষয়ে আলাদা ও বিস্তারিত আলোচনা এখনো হয়নি। মূলত এর ইচ্ছাও আমার নেই। কারণ যেমনটা বারবার বলা হয়েছে যে, এ মাসআলা ইজতিহাদীও এবং ইখতিলাফীও। একইসাথে মাসআলাটির ধরনও খুব সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল। এ ধরনের বিষয়ে দলীলের পাঠ যেমনই হোক, ওয়াজহে ইসতিদলাল বা দলীল দ্বারা দাবি প্রমাণের প্রসঙ্গটি খুবই সূক্ষ্ম হয়ে থাকে, যা উপলব্ধি করা ইলমুল ফিকহের যে কোনো তালিবে ইলম; বরং যে কোনো মুদাররিসের পক্ষেও সহজ হয় না। অথচ শুধু তরজমা পাঠ করেই অনেক গায়রে আলিম শুধু এ ধরনের বিষয়ই নয়, এর চেয়েও সূক্ষ্ম বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে থাকেন এবং ‘মত প্রকাশ’ করতে থাকেন। এতে আসলে আশ্চর্যের কিছু নেই, এ তো ভিন্ন শাস্ত্রে অনুপ্রবেশের সর্বনিম্ন কুফল।
যাইহোক, দলীল-প্রমাণের বিশ্লেষণ সম্পর্কে বিশদ আলোচনার ইচ্ছা আমার নেই, আমি শুধু দুটি বিষয়ে কিছু কথা আরজ করব। প্রথম বিষয়, আলোচিত মাসআলায় দলীল-প্রমাণের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কোনো কোনো বন্ধু যে ত্বরা-প্রবণতার শিকার হয়েছেন সে সম্পর্কে কিছু নিবেদন, আর দ্বিতীয় বিষয়, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়া আর সওম ও ঈদের ঐক্য জরুরি হওয়া পরস্পর সমার্থক নয়।
দলীল-প্রমাণের বিশ্লেষণে ত্বরা-প্রবণতা মোটেও কাম্য নয়
যে কোনো ইলমী কাজেই চিন্তা-ভাবনা এবং ধৈর্য ও স্থিরতা অতি প্রয়োজন। আর ঐ সকল ইজতিহাদী বিষয়, যাতে খাইরুল কুরূন থেকে মতভেদ চলে আসছে তাতে উভয় দিকের ‘দলীল’ ও ‘ওয়াজহে ইসতিদলাল’ সংক্রান্ত আলোচনা তো এত সূক্ষ্ম হয় যে, এসব ক্ষেত্রে ত্বরা-প্রবণতা অতি মারাত্মক হয়ে থাকে। এ সকল ক্ষেত্রে অনেক কারণেই চূড়ান্ত ধৈর্য ও স্থিরতা এবং চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন।
একটি ছোট কারণ এই যে, কখনো কোনো লেখকের তাসামুহ বা ভুলভ্রান্তি হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। এক্ষেত্রে যথাযথ তাহকীক না করলে এবং ধীরস্থিরভাবে কাজ না করলে প্রবল আশঙ্কা থাকে, পরের লেখকেরা সেই তাসামুহ বা ভ্রমই প্রচার করবেন। আর এ তাসামুহ ভিত্তিক সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করেই সন্তুষ্ট হয়ে ভাববেন, তারা একটি ‘দলীল’ পেশ করেছেন বা কোনো ‘ইসতিদলালে’র চূড়ান্ত জবাব দান করেছেন। যেমন, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য হওয়ার পক্ষে কোনো কোনো ফকীহ এ দলীল দিয়েছেন যে, যখন সময় নির্ধারণকারী ‘মীকাত’ অর্থাৎ সূর্যের ক্ষেত্রে সর্বসম্মতভাবে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য, যে কারণে প্রত্যেকে নিজেদের সুবহে সাদিক অনুযায়ী ফজরের নামায পড়ে, নিজের অঞ্চলে সূর্য ঢলার পর যোহর এবং সূর্যাস্তের পর মাগরিব আদায় করে তাহলে তারিখ নির্ধারণকারী ‘মীকাত’ অর্থাৎ চাঁদের ক্ষেত্রেও উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য হওয়া চাই এবং প্রত্যেক অঞ্চলের অধিবাসীদের নিজ নিজ উদয়স্থল হিসেবে রোযা ও ঈদ করা চাই। কারণ চন্দ্র ও সূর্যের উদয়স্থলের মাঝে এমন সুস্পষ্ট ও যুক্তিসংগত কোনো পার্থক্য নেই যে, একটির বিভিন্নতা অবশ্যই ধর্তব্য হবে আর অন্যটির বিভিন্নতা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য হবে।
আমি বলি না, এ কোনো অকাট্য দলীল। ইজতিহাদী মাসআলায় তা পাওয়াই বা যাবে কোত্থেকে? কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই, একটি ইজতিহাদী দলীল হিসেবে তা অবশ্যই গণ্য হতে পারে। সমপর্যায়ের আরেকটি ইজতিহাদ দ্বারা এর জবাব দেওয়া যায়, কিন্তু একে পত্রপাঠ নাকচ করে দেওয়া যায় না। অথচ আমরা একাধিক ‘গবেষক’কে দেখেছি, তারা যেন এ যুক্তিটি হেসেই উড়িয়ে দিতে চান। আসলে ‘উসূলে ফিকহ’ ও ‘কাওয়াইদে ইসতিদলালে’র ইলম না থাকলে এমন হওয়াই অনিবার্য। আর এ কারণেই বলা হল, ভিন শাস্ত্রে অনুপ্রবেশ অপরাধ। ‘ইলমে ফিকহ’ ও ‘উসূলে ফিকহে’ পারদর্শী লেখকগণ এ দলীলের জবাব দেওয়ার তো চেষ্টা করেছেন, কিন্তু একে নাকচ করে দেননি। যেমন ইবনুল হুমাম রাহ. (৮৬১ হি.) হিদায়ার শরহ ‘‘ফাতহুল কাদীর’’-এ এই মাসআলার আলোচনায় এ দুই উদয়স্থলের ভিন্নতার মাঝে পার্থক্য করার একটি কারণ বর্ণনার চেষ্টা করেছেন। যদিও তা প্রশ্নমুক্ত নয়, কিন্তু তাঁর প্রয়াস থেকে এটুকু তো জানা গেল যে, তাঁর দৃষ্টিতে এ দুয়ের মাঝে পার্থক্যের দলীল পেশ করা জরুরি। বিনা দলীলে এ ‘কিয়াস’কে শুধু হেসে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
ইবনুল হুমাম রাহ. লিখেছেন-
وجه الأول عموم الخطاب في قوله : صوموا معلقا بمطلق الرؤية في قوله لرؤيته، وبرؤية قوم يصدق اسم الرؤية فيثبت ما تعلق به من عموم الحكم، فيعم الوجوب، بخلاف الزوال والغروب، فإنه لم يثبت تعلق عموم الوجوب بمطلق مسماه في خطاب من الشارع، والله أعلم.
অর্থাৎ (চাঁদের হুকুমের বিষয়ে) উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার কারণ صوموا لرؤيته শীর্ষক হাদীসের সাধারণ সম্বোধন। এ হাদীসে চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সাথে সওমকে সংযুক্ত করে সকল মুসলমানকে রোযা রাখার আদেশ করা হয়েছে। এখন যে অঞ্চলের অধিবাসীরাই চাঁদ দেখুক চাঁদ দেখা প্রমাণিত হল। সুতরাং চাঁদ দেখার সাথে সংযুক্ত বিধানও সাধারণভাবে প্রত্যেকের জন্য প্রযোজ্য হবে।
কিন্তু সূর্য ঢলা বা সূর্যাস্তের সময় (ইত্যাদি) এরূপ নয়। কারণ, এ সময়গুলোর নামের সাথে যুক্ত করে কুরআন-হাদীসে সালাতের কোনো ব্যাপক হুকুম করা হয়নি। (এ কারণে যে কোনো জায়গায় সূর্য ঢললে সব জায়গার অধিবাসীদের উপর যোহর, কিংবা যে কোনো জায়গায় সূর্যাস্ত হলে সব জায়গায় মাগরিবের নামায ফরয হবে না; বরং প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষ নিজ নিজ এলাকায় সূর্য ঢলা ও সূর্যাস্তের হিসাবে নামায আদায় করবে।)-ফাতহুল কাদীর ২/৩১৩-৩১৪, দারুল ফিকর বৈরুত, فصل في رؤية الهلال
ইবনুল হুমামের উদ্দেশ্য সম্ভবত এই যে, কুরআন-হাদীসে নামাযের সময়গুলোর বর্ণনা আছে এবং সময়মতো নামায পড়ার হুকুমও আছে, যার অর্থ, প্রত্যেক অঞ্চলের অধিবাসী নিজেদের সময় অনুসারে নামায আদায় করবে। নিজেদের অঞ্চলে সূর্য ঢললে যোহর পড়বে, নিজেদের অঞ্চলে সূর্যাস্ত হলে মাগরিব পড়বে ... এভাবে। কিন্তু কোনো আয়াত বা হাদীসে কোনো বিশেষ সময়ের নামোল্লেখ করে সাধারণ সম্বোধনের শব্দে মুসলমানদের নামায পড়ার আদেশ করা হয়নি। তা করা হলে সওমের মতো সালাতও কোনো এক জায়গার সূর্য ঢলা বা সূর্যাস্তের সাথে যুক্ত হত।
এ-ই যদি ইবনুল হুমামের উদ্দেশ্য হয় তাহলে পরিষ্কার যে, কুরআন-হাদীসে যেমন সালাতের সময়ের বিবরণ আছে তেমনি বিশেষ বিশেষ সময়ের নাম উল্লেখ করে তাতে সালাত আদায়ের বা সালাত থেকে বিরত থাকারও স্পষ্ট ও সাধারণ আদেশ আছে। যেমন কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ
অর্থাৎ জুমার দিন নামাযের ডাক এলে আল্লাহর যিকরের দিকে (খুতবা ও সালাতের দিকে) ধাবিত হও এবং বেচাকেনা ত্যাগ কর। (আলজুমুআ ৬২ : ৯)
আরো ইরশাদ :
فَسُبْحَانَ اللَّهِ حِينَ تُمْسُونَ وَحِينَ تُصْبِحُونَl وَلَهُ الْحَمْدُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَعَشِيًّا وَحِينَ تُظْهِرُونَ
অর্থ : সুতরাং আল্লাহর তাসবীহ কর ঐ সময় যখন তোমাদের ওপর সন্ধ্যা নামে এবং ঐ সময়ও যখন তোমাদের উপর ‘সুবহ’ উদিত হয়। আর তাঁর প্রশংসা হয় আসমানসমূহেও এবং যমীনেও। (তাঁর তাসবীহ কর) তৃতীয় প্রহরে এবং যখন তোমরা ‘যুহরে’ প্রবেশ কর। (আররূম ৩০ : ১৭-১৮)
হযরত আবদুলাহ ইবনে আববাস রা.-এর তাফসীর অনুযায়ী এ আয়াতে পাঁচ নামাযের হুকুম দেওয়া হয়েছে। এতে সময়ের নামোলেখ করে সকল মুমিনকে সালাতের মাধ্যমে হামদ ও তাসবীহের হুকুম করা হয়েছে। অর্থাৎ সন্ধ্যায় ও রাতে মাগরিব-ইশার নামায আদায় কর, সকালে ফজরের নামায, দুপুরে যোহরের নামায আর অপরাহ্নে আসরের নামায।
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
صلوا المغرب حين تغيب الشمس
যখন সূর্য ডুবে যায় তখন তোমরা মাগরিবের নামায পড়। (আলমুসান্নাফ, আবদুর রাযযাক ১/৫৫৩, হাদীস : ২০৯৪)
অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
لا يتحرى أحدكم فيصلي عند طلوع الشمس، ولا عند غروبها
এ হাদীসেও সাধারণ হুকুম, সূর্যোদয়ের সময় এবং সূর্যাস্তের সময় তোমাদের কেউ যেন নামায না পড়ে। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৮৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৮২৮; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ১৫৪৮)
এখন যদি উল্লেখিত আয়াত থেকে এ অর্থ নেওয়া ভুল হয় যে, যে কোনো জায়গায় জুমার আযান হলে প্রত্যেক অঞ্চলের মুমিনদের উপর খুতবা ও সালাতের জন্য ধাবিত হওয়া ফরয, কোথাও সূর্য ডুবলেই সবার ওপর মাগরিবের নামায আদায় করা ফরয হয়, এবং কোথাও সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত হতে থাকলেই এ সময় সব জায়গার মুমিনদের জন্য নামায পড়া নিষিদ্ধ হয় এবং এর সঠিক মর্ম এ-ই হয় যে, (নিজ নিজ) জুমার আযানের সময় জুমা আদায় কর (নিজ নিজ) সূর্যাস্তের সময় মাগরিব আদায় কর এবং (নিজ নিজ) সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় সালাত থেকে বিরত থাক তাহলে صوموا لرؤيته (চাঁদ দেখলে রোযা রেখো) এবং لا تصوموا حتى تروه (যতক্ষণ চাঁদ না দেখবে রোযা রাখবে না)-এই নির্দেশনাবলীর এ অর্থ কেন হতে পারবে না যে, ‘(নিজ নিজ) চাঁদ দেখা অনুসারে রোযা রাখ’ এবং ‘যে পর্যন্ত (নিজ এলাকায়) চাঁদ দেখা না যায় রোযা রাখা থেকে বিরত থাক।
আপনি যদি চিন্তা করে থাকেন তাহলে হয়তো বুঝতে পেরেছেন যে, ইবনুল হুমাম রাহ. যে দলীলের ভিত্তিতে সূর্য ও চন্দ্রের উদয়স্থলের মাঝে পার্থক্য করেছিলেন সে দলীল দ্বারাই এ দুয়ের মাঝে পার্থক্য না হওয়া প্রমাণিত হচ্ছে। ফতোয়া শামীর টীকায় শায়খ ফরফূরও এদিকে ইশারা করেছেন। এ সত্ত্বেও দেখা যায়, কিছু মানুষ এ তাসামুহ (ভ্রান্তি) ভিত্তিক বর্ণনাকে বুনিয়াদ বানিয়ে একাধিক বড় বড় ফকীহর পক্ষ হতে উপস্থাপিত ঐ দলীলকে সম্পূর্ণ অসার সাব্যস্ত করতে চান।
অথচ সামনে গিয়ে ইবনুল হুমাম রাহ.ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর এ হাদীস উল্লেখ করে লেখেন-
ولا شك أن هذا أولى، لأنه نص، وذلك محتمل لكون المراد أمر كل أهل مطلع بالصوم لرؤيتهم.
অর্থাৎ নিঃসন্দেহে এ দলীলই (অগ্রগণ্য সাব্যস্ত হওয়ার) অধিক উপযোগী। কারণ এ (হাদীস তো) স্পষ্ট। আর ঐ হাদীসে (অর্থাৎ صوموا لرؤيته চাঁদ দেখে রোযা রাখ) এ অর্থেরও সম্ভাবনা আছে যে, প্রত্যেক উদয়স্থলের অধিবাসীদেরকে নিজ নিজ চাঁদ দেখা অনুসারেই রোযা রাখার আদেশ করা হয়েছে।(১) -ফাতহুল কাদীর ২/৩১৪
[একাধিক লেখক ঐ ব্যাখ্যার যুক্তিসঙ্গত জবাব দিয়েছেন, প্রবন্ধের প্রথম কিস্তিতে একটি জবাবের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর ‘যাহিরুর রিওয়ায়াহ’ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা তো আলহামদুলিল্লাহ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে।]
ইবনুল হুমাম যে অর্থকে এ হাদীসের অন্যতম সম্ভাব্য অর্থ বলেছেন সালাফের কর্মপরম্পরার দ্বারা এ অর্থই প্রতিষ্ঠিত। খাইরুল কুরূনের কোনো ফকীহ থেকে এ হাদীসের অন্য কোনো অর্থ বর্ণিত হয়নি।
যাইহোক, এ কথাগুলো উদাহরণস্বরূপ বলা হল। দলীল-প্রমাণের বিশ্লেষণের উপর বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে আমার নেই। তবে কেউ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখতে চাইলে এবং উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার দলীলসমূহ দেখতে চাইলে ‘‘আহকামুল কুরআন’’ জাসসাস, ‘‘আলমুগনী’’ ইবনে কুদামা, ‘‘নায়লুল আওতার’’ শাওকানী, ‘‘তাওজীহুল আনযার লি তাওহীদিল মুসলিমীনা ফিস সাওমি ওয়াল ইফতার’’ আহমদ গুমারী, ‘‘কিফায়াতুল মুফতী’’, ইনআমুল বারী (হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম-এর দরসে বুখারী) এবং তাঁর কিতাব ‘বুহুসুন ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআসিরাহ’ দেখতে পারেন।
আর কেউ বিপরীত বক্তব্যের দলীলসমূহ দেখতে চাইলে ‘‘আততামহীদ’’ ইবনে আবদুল বার, ‘‘আলইসতিযকার’’ ইবনে আবদুল বার, ‘‘তাবয়ীনুল হাকাইক’’ যায়লায়ী, ‘‘ইরশাদু আহলিল মিল্লাহ ইলা ইছবাতিল আহিল্লাহ’’ মুহাম্মাদ বাখীত মুতীয়ী, ‘‘মাআরিফুস সুনান শরহে জামেউত তিরমিযী ও ‘‘আলআযবুয যুলাল ফী মাবাহিছি রুইয়াতিল হিলাল’’ পাঠ করতে পারেন।
কিছু জরুরি কথা
আমি শুধু নীচের কিছু বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই :
1. এ কথা মনে রাখা চাই যে, এ মাসআলা যেমন ইজতিহাদী তেমন ইখতিলাফীও। এ কারণে দলীলের উপর যতই চিন্তাভাবনা করা হোক এবং যতই আলোচনা করা হোক, শেষের ফল এ-ই হবে যে, এখানে উভয় দিকে দলীল-প্রমাণ আছে এবং কোনো একটি দিককে সম্পূর্ণ নাকচ করে দেওয়ার উপায় নেই। হাঁ, কেউ যদি ন্যায়সঙ্গত আলোচনার পরিবর্তে অন্যায় ও প্রান্তিকতার পথ অবলম্বন করে তাহলে আলাদা কথা। এ কারণে প্রত্যেক ইজতিহাদী মাসআলার মতো এখানেও ইনসাফ ও ইতিদাল রক্ষা করা খুব জরুরি এবং বিবাদ-বিসংবাদ থেকে বেঁচে থাকা তো সর্বাবস্থায় ফরয।
2. দলীলের বিচারে কোন মাযহাব অগ্রগণ্য এ বিষয়ে নিজ থেকে কিছু লেখার পরিবর্তে মুনাসিব মনে হচ্ছে, ইমাম তকীউদ্দীন সুবকী (৬৮৩ হি.-৭৫৬ হি.) রাহ.-এর আলোচনার সারসংক্ষেপ তুলে দেই। তিনি লেখেন-
‘‘এক শহরের অধিবাসী অন্য শহরের চাঁদ দেখা অনুযায়ী আমল করবে না, তা নিকটবর্তী হলেও’’-এ সিদ্ধান্ত দুর্বল। কারণ ‘‘সুনানে সায়ীদ ইবনে মানসূরে’’ সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার ২৯ রমযানের সূর্যাস্তের পর শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেল না, ফলে সকলে ৩০ রমযান হিসেবে রোযা রেখেছিলেন। ঘটনাক্রমে সেদিন সন্ধ্যায় এক কাফেলা সফর থেকে ফিরল এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে সাক্ষ্য দিল যে, তারা গত রাতে চাঁদ দেখেছে।
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে রোযা ভাঙ্গার আদেশ দেন এবং পরের দিন ঈদে যাওয়ার।’
(এ হাদীস থেকে জানা গেল, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা শহরের বাইরের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। এ কারণে একথা বলা ভুল যে, ‘কাছাকাছি এলাকাগুলোতেও অন্য এলাকার সাক্ষ্য অনুসরণীয় নয়।’’ আর যেমনটি ইতিপূর্বে আরজ করা হয়েছে যে, বাস্তবে এমন সিদ্ধান্ত কোনো ইমামের নেই। এ তো শুধু কোনো কোনো কিতাবের আলোচনার শুধু শব্দগত ব্যাপকতা থেকে ধারণা হয়। আর কিছু নয়।)
সুবকী রাহ. বলেন, নিকট ও দূরের পার্থক্যের জন্য সফরের দূরত্বের মাপকাঠি বানানোও দুর্বল সিদ্ধান্ত। তবুও এটিও একটি শরয়ী মাপকাঠি। নিকট ও দূরের পার্থক্যের জন্য সারাখসী শাফেয়ী উল্লেখিত মাপকাঠিটি উত্তম। (২)
[বিগত মার্চ সংখ্যায় ইমাম নববী রাহ.-এর আলমাজমূ শরহুল মুহাযযাবের বরাতে উল্লেখিত হয়েছে।]
ইকলীম আলাদা হলে দূরের-‘এটিও দুর্বল সিদ্ধান্ত (এ সিদ্ধান্ত আবুল হাসান আলমাওয়ারদী (মৃত্যু : ৪৫০ হি.) আলহাভীতে (খন্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ১৮০) কোনো কোনো শাফেয়ী ফকীহের বরাতে উল্লেখ করেছেন।)
সামনে ইমাম সুবকী রাহ. বলেন-
وإلزام جميع البلاد إذا رؤي في بلد ضعيف جدا، لأن عمر بن الخطاب وسائر الخلفاء الراشدين لم ينقل أنهم كانوا إذا رأوا الهلال يكتبون إلى الآفاق، ولو كان لازما لهم لكتبوا إليهم لعنايتهم بأمور الدين، ولأنا نقطع بأنه قد يرى في بعض البلاد في وقت لا يمكن رؤيته في بلد آخر، كما نقطع بأن الشمس تغرب في مكان قبل أن تغرب في غيره، وكذا الطلوع والزوال والفجر وغياب الشفق، وما من حركة تتحركها الشمس إلا وهي فجر عند قوم وزوال عند قوم وغروب عند قوم وليل عند قوم.
وأجمع العلماء في أوقات الصلوات على أن المعتبر عند كل قوم فجرهم وزوالهم وغروبهم ولا يلزمهم حكم غيرهم، فكذلك الهلالُ بالقياس عليه، وبأن الله ما يخاطب قوما إلا بما يعرفونه مما هو عندهم.
এখানে ইমাম তকীউদ্দীন সুবকী রাহ. বলেছেন, কোনো এক জায়গায় চাঁদ দেখা গেলে সকল অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য একে লাযিম ও অনুসরণীয় সাব্যস্ত করার মতটি খুবই দুর্বল। প্রথমত এ কারণে যে, ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. ও অন্যান্য খুলাফায়ে রাশেদীনের কারো থেকেই বর্ণিত হয়নি যে, তারা চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর সে সংবাদ মুসলিম জাহানের বিভিন্ন দিগন্তের অধিবাসীদের লিখে পাঠাতেন। এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য সব অঞ্চলের জন্য লাযিম ও জরুরি হলে খুলাফায়ে রাশেদীন অবশ্যই তাদের লিখে পাঠাতেন। কারণ দ্বীনী বিষয়ে তাঁদের মাঝে যত্ন ও গুরুত্ব ছিল। (আলআলামুল মানশূর, পৃষ্ঠা : ১৪-১৫)
এরপর সুবকী রাহ. আরো দুটি দলীল উল্লেখ করেছেন, যা তাঁর উদ্ধৃত বক্তব্যে আছে।
3. খুলাফায়ে রাশেদীন ও সালাফে সালেহীনের যে তাআমুল ও কর্ম ধারার দিকে তকীউদ্দীন সুবকী রাহ. দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, কুরআন হাকীমের আয়াত فمن شهد منكم الشهر فليصمه এবং হাদীস صوموا لرؤيته -এর স্বাভাবিক ও সরল অর্থে দূরবর্তী শহর-নগরের চাঁদ দেখার ভিত্তিতে সওম ফরয হওয়ার বিধান শামিলই নয়। এ কারণে এ মুতাওয়ারাছ মর্ম ও উপলব্ধিকে নাকচ করে দিয়ে শুধু ঐ সকল নসের শব্দগত ব্যাপকতার ফায়েদা গ্রহণ করা এবং এ দাবি করা যে, ঐ সকল নসের একমাত্র অর্থ, যে কোনো স্থানে চাঁদ দেখা গেলেই ‘মাসের উপস্থিতি’ প্রমাণিত হবে এবং যেকোনো অঞ্চলে চাঁদ দেখা গেলেই সওম ফরয হবে, এটা খুবই আপত্তিকর। (৩)
4. এ থেকে আরো জানা গেল যে, দূর-দূরান্তের শহর-নগরের চাঁদ দেখা লাযিম না হওয়ার কারণ, তা লাযিম বা অবশ্য অনুসরণীয় হওয়ার কোনো শরয়ী দলীল না থাকা; সেজন্য মূল মাসআলাই হলো এমন যে, প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষ তাদের নিজেদের চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করবে। অন্য অঞ্চলের চাঁদ দেখা তাদের জন্য অবশ্য অনুসরণীয় হবে না। এ ধারণা ঠিক নয় যে, মূলত তা লাযিম বা অবশ্য-অনুসরণীয় ছিল, কিন্তু খাইরুল কুরূনে যেহেতু দূর-দূরান্তের শহর-নগরের সংবাদ ও সাক্ষ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা ছিল না তাই তারা ওজরের কারণে এ বিধান পালন করতে পারেননি। বিষয়টি এমন হলে তো তাঁরা নিজ নিজ যুগে তাদের সামর্থ্যের আওতা পর্যন্ত ব্যবস্থা নিতেন। অথচ এর সামান্য ব্যবস্থাও তাঁরা নিয়েছেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রবন্ধের প্রথম কিস্তিতেই এর উপর সংক্ষিপ্ত কথা হয়েছে। হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. তাঁর পুস্তিকা ‘রুয়াতে হিলালে’ এর উপর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
5. আরো জানা গেল যে, কোনো কোনো ফকীহের ইবারতে দূর-দূরান্তের শহর-নগরের চাঁদ দেখা অবশ্য-অনুসরণীয় না হওয়ার বিষয়ে এই যে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকে তার অবগতি অনুসারে কর্মভার প্রাপ্ত হয়। সুতরাং যে অঞ্চলের চাঁদ দেখা তার অবগতির বাইরে তার ভিত্তিতে তার উপর কর্তব্য অর্পিত হয় কীভাবে’?-এ কথাটি উপরোক্ত বিধানের ইল্লত বা কারণ নয়; বরং একটি ‘হিকমত’ বা যৌক্তিকতা বর্ণনার একটি দিক, যা মূলত ঐ যুগের অবস্থা হিসেবে বলা হয়েছে। এখন যদি যৌক্তিকতার ঐ দিকটি না থাকে তাহলে সে কারণে বিধানই বদলে যেতে পারে না। কারণ হিকমতের পরিবর্তনে হুকুমের পরিবর্তন হয় না। এটি একটি স্বীকৃত ও সর্ববাদীসম্মত নীতি। তলাবায়ে কেরাম এর বিস্তারিত বর্ণনা উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুমের অতিসাম্প্রতিক রচনা-‘‘উসূলুল ইফতা’’য় (পৃষ্ঠা : ২৪০-২৪৫) পাঠ করতে পারেন।
এ কারণে যারা এ হিকমতকে মাসআলার বুনিয়াদ বানিয়ে বলেন, ‘এখন অবস্থা বদলে গেছে, এখন পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকে চাঁদের খবর সংগ্রহ করা এবং তা প্রমাণিত হওয়ার ইলম হাসিল করা খুবই সহজ, এসব এখন প্রত্যক্ষ বাস্তবতা। সুতরাং এ যুগে ঐ বিধান বলবৎ থাকবে না; এখন দূর-দূরান্তের শহর-নগরের চাঁদ দেখাও অবশ্য-অনুসরণীয় হবে।’
যারা এ কথা বলেন তারা মূলত হুকুমের একটি হিকমতকে হুকুমের ভিত্তি মনে করছেন, যা ভুল। এ হুকুমের ভিত্তি এই হিকমত নয় বরং এর ভিত্তি হচ্ছে শরীয়তের দলীল। আর এতে একটি নয়, বহু হিকমত থাকতে পারে। সুতরাং একটি হিকমত বাহ্যত বর্তমান যুগের উপযোগী মনে হচ্ছে না বলে মেনে নিলেও বিধানের ক্ষেত্রে তা কোনো প্রভাব ফেলবে না।
6. আমি স্বীকার করি যে, এ মাসআলা ইজতিহাদী। এ কারণে যে ফকীহগণ দূর-দূরান্তের চাঁদ দেখা অবশ্য-অনুসরণীয় বলেন তাঁদের কাছেও অন্তত এটুকু দলীল থাকবে, যার দ্বারা তাঁদের সিদ্ধান্তও ইজতিহাদের আওতায় থাকার দাবি রাখে, কিন্তু যেমনটা আমি ইতিপূর্বে সংক্ষেপে আরজ করেছি যে, এই মাযহাব থেকে, যার প্রসিদ্ধ শিরোনাম لا عبرة لاختلاف المطالع (উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়), আমাদের এ যুগের ‘গবেষক’দের ফায়দা নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ এ মাযহাব যদি দলীলের দিক থেকে অগ্রগণ্যও হয় তবুও তা এদের দাবি ও কর্মের জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ তাঁদের কর্ম ও দাবি নিম্নরূপ :
ক. সারা বিশ্বে একই দিন সওম শুরু করা ও একই দিনে ঈদ করা ফরয।
খ. এর জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের (উলামা ও উমারা) সিদ্ধান্তের প্রয়োজন নেই। কোথাও রোযা বা ঈদের খবর টেলিভিশনে দেখা গেল বা রেডিওতে শোনা হল বা ফোনে জানা গেল; ব্যস সে অনুযায়ী আমল করা ফরয।
গ. নিজ দেশের উলামা, উমারা ও সাধারণ জনগণের বিরোধিতা হলেও তা ফরয। নতুবা মাখলুকের আনুগত্য করে খালিকের অবাধ্যতার শিকার হতে হবে, যা হারাম।
ঘ. যারা এ ফরয বিধান তরক করেন তাদেরকে শুরু রমযানে এক দুই রোযা ত্যাগের কারণে কাফফারা হিসেবে ষাটটি করে রোযা রাখতে হবে। আর ফরয তরকের গুনাহ তো আলাদা আছেই। আর রমযান শেষে ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম। তারা এ হারামে লিপ্ত।
তাদের অধিকাংশের দাবি এ-ও যে,
ঙ. রোযা ও ঈদের ঐক্যের জন্য সৌদিয়ার চাঁদ দেখাকে ভিত্তি বানানো জরুরি।
বলাবাহুল্য, এ সকল দাবি ও কর্মের কোনোটিই উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মাযহাব দ্বারা প্রমাণিত হতে পারে না। এ কারণে এ সকল গবেষকের এই মাযহাবের বরাত দেওয়া সম্পূর্ণ প্রতারণা। সামনে এটিই বিস্তারিত আলোচনায় আসছে।
অনেক বেশি দূরের হলে হুকুম ইজমায়ী
যে ইমামগণ বলেছেন, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয় তাদের কথার এ অর্থ করা যে, ভূপৃষ্ঠের কোনো প্রান্তেও যদি চাঁদ প্রমাণিত হয় তাহলে তা সকল অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য অবশ্য-অনুসরণীয় হবে, চাই এ চাঁদ অনুসারে সহজে আমল করা যাক বা না যাক। এ ব্যাখ্যা যেমন অযৌক্তিক তেমনি ইজমারও বিরোধী। কারো বক্তব্যকে এত ব্যাপক অর্থে নেওয়া, যা স্বয়ং বক্তার চিন্তাতেও আসেনি ব্যাখ্যা ও মর্ম-গ্রহণ নীতির বিরোধী। আল্লামা বানূরী রাহ. ‘‘মাআরিফুস সুনান’’ কিতাবে (খন্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ৩৩৮-৩৪০, ৩৫২) এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। এ মূলনীতির জন্য আরো দেখুন : বাওয়াদিরুন নাওয়াদির পৃষ্ঠা : ৬; বয়ানুল কুরআন ৪/৬২; মাবাদিউ ইলমিল হাদীস ওয়া উসূলুহু, পৃষ্ঠা : ১৯৪
এদিকে ইমাম ইবনে আবদিল বার, আল্লামা ইবনে রুশদ, ফকীহ ইবনে জুযাই-এর মতো বড় বড় ফকীহ ইজমা নকল করেছেন যে, অনেক বেশি দূরের হলে, যেমন খোরাসান ও আন্দালুস বা হিজায ও আন্দালুস, এক জায়গার চাঁদ দেখা অন্য জায়গার জন্য সর্বসম্মতভাবে লাযিম তথা অবশ্য-অনুসরণীয় নয়। পাঠকবৃন্দ তাঁদের ইবারত/উদ্ধৃতি ইতিপূর্বে পাঠ করেছেন।
মুহাদ্দিস আবুল হাসান ইবনুল কাত্তানও (৬২৮ হি.) ইজমায়ী মাসাইলের উপর লিখিত তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব - الاقناع في مسائل الإجماع (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ২৯২)-এ ইজমার উল্লেখ করেছেন এবং মুহাদ্দিস আবুল আববাস কুরতুবীও ‘শরহু সহীহি মুসলিম’ কিতাবে এ বিষয়ে ইবনু আবদিল বার-এর সমর্থন করেছেন। পিছনে পাঠকবৃন্দ তাদের ইবারত পাঠ করেছেন।
এই বড় বড় ফকীহ যে বিষয়ে ইজমা নকল করেছেন সেখানে কোনো লেখকের ব্যাখ্যাসাপেক্ষ এ বক্তব্য-‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ এমন ব্যাপক অর্থ গ্রহণ করা, যার দ্বারা তা ইজমা-বিরোধী হয়ে যায়, নিঃসন্দেহে আপত্তিকর।
ইনশাআল্লাহ এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত ও প্রমাণভিত্তিক আলোচনা সামনে আসছে। এ মুহূর্তে শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ করা উদ্দেশ্য যে, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মাযহাব এত ব্যাপক নয় যতটা এ গবেষকগণ মনে করছেন। আর না এত ব্যাপকতার সাথে বাস্তবে এর উপর আমল করা সম্ভব। সামনে ইনশাআল্লাহ বিস্তারিত আলোচনা হবে।
এ মাযহাবের ব্যক্তিবর্গ সংবাদ ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করাকে ফরয বলেননি
দ্বিতীয় কথা এই যে, যে ইমামগণ বলেছেন, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয় তাঁরা যদিও বলেছেন যে, দূর-দূরান্তের শহর থেকেও যদি ‘তরীকে মুজিবে’র মাধ্যমে সাক্ষ্য সংগৃহীত হয় তখন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের তা গ্রহণ করা এবং সে অনুযায়ী ফয়সালা করা জরুরি। কিন্তু তাঁদের কেউ এ কথা বলেননি যে, পৃথিবীর দিগ-দিগন্ত থেকে চাঁদের সংবাদ ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করে সেগুলো পরীক্ষা করা এবং সে অনুযায়ী ফয়সালা করা ফরয।
তাঁদের কেউই একথা বলেননি আর না দলীলের ভিত্তিতে কেউ তা বলতে পারেন। শুধু তা-ই নয় তাঁদের একাধিক ব্যক্তি জিজ্ঞাসিত হওয়ার পর স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, এমন পদক্ষেপ নেওয়া কক্ষনো জরুরি নয়।
হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর বক্তব্য
যেমন আমাদের এ গবেষকবৃন্দ হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. (১২৮২ হি.-১৩৬২ হি.) কে খুব বেশি উদ্ধৃত করে বলেন, তিনিও উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার কথা বলেছেন। উদ্ধৃতিতে ‘‘বেহেশতী গওহর’’-এর ইবারত নকল করা হয়। অথচ হাকীমুল উম্মত রাহ. নিজেই বলেছেন-‘‘এক জায়গার চাঁদ দেখা অন্যান্য জায়গায় এমনভাবে প্রচার করা, যাতে বাড়াবাড়ির ও অতিশয়তা এবং ভুল-ত্রুটি ও জটিলতা থাকে, যার কারণে আকছার অস্থিরতা ও বিরোধিতা বেড়ে যায়-আমি এর বিরোধী।
(কামালাতে আশরাফিয়্যা, সংকলনে মাওলানা ঈসা ইলাহ আবাদী, খলীফায়ে মুজায হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. পৃষ্ঠা : ৭২, মালফুয ২৭৬)
শুধু এ-ই নয়, বরং হযরত থানভী রাহ. এ মাসআলা আরো স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল : ‘‘যে শহরে মেঘ বা ধুলোবালির কারণে বা আকাশ পরিষ্কার থাকার ক্ষেত্রে ২৯ শাবান বা রমযানে চাঁদ দেখা যায়নি সে শহরের অধিবাসীদের উপর কি এ বিধান আছে যে, চেষ্টা করে অন্যান্য শহর থেকে সংবাদ সংগ্রহ করবে?
হযরত হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. এ প্রশ্নের জবাবে লেখেন-
যেহেতু দলীল ছাড়া কোনো বিধান সাব্যস্ত হয় না আর প্রশ্নোক্ত কাজ ওয়াজিব হওয়ার কোনো দলীল নেই তাই তা ওয়াজিব নয়।
প্রশ্নের অবশিষ্ট অংশ :
যদি বিধান থাকে তাহলে কোন সূত্রে খবর সংগ্রহ করলে তা নির্ভরযোগ্য হবে। আর যখন নির্ভরযোগ্য সূত্রের সংবাদ অন্যান্য শহরে এসে যাবে তখন ঐ শহরের কাযী বা মুফতীর তা মানা জরুরি কি না। কাযি যদি না মানেন এবং আমল না করেন তাহলে গোনাহগার হবেন কি না?
হযরত থানভী রাহ.-এর জবাব
তা করার বিধান তো নেই। তবে যদি অন্য জায়গা থেকে খবর এসে যায় তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য শর্ত, ‘তরীকে মুজিবে’র দ্বারা পৌঁছা। আর তরীকে মুজিব এই, এক. চাঁদ দেখার সাক্ষ্য, দুই. চাঁদ দেখার সাক্ষ্যের সাক্ষ্য তিন. শাসকের ফয়সালার সাক্ষ্য, চার. ইস্তিফাযা (চারদিক থেকে ব্যাপকভাবে সংবাদ আসা) যা শাসকের ফয়সালার মতো।
এ সকল সূত্রে সংবাদ এলে সে অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব। আর বলাইবাহুল্য, ওয়াজিব তরক করা গুনাহ, কিন্তু যদি কারো ইজতিহাদে তা ‘তরীকে মুজিব’ না হয় তবে সে মাযূর ...। (যাওয়ালুস সিনাহ আন আমালিস সানাহ, হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ., পৃষ্ঠা : ২৬; ইমদাদুল ফাতাওয়া খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১২৯-১৩০)
থানভী রাহ. উদয়স্থলের বিভিন্নতাকে ধর্তব্য নয় মনে করেন; বরং তিনি এ কওলকেই ফতোয়ায়ে শামীর অনুসরণে ফিকহে হানাফীর ‘মুফতাবিহী’ কওল মনে করেন। এ সত্ত্বেও তিনি স্পষ্ট বলেছেন যে, অন্য জায়গা থেকে খবর ও শাহাদত সংগ্রহ করা ওয়াজিব নয়। আর না তা লোকদের কর্তব্য। কথা শুধু এ-ই নয় যে, তা ওয়াজিব হওয়ার দলীল নেই; বরং তা ওয়াজিব না হওয়ার দলীল আছে।
আর হযরত থানভী রাহ. এই যে লিখেছেন, ‘যখন ঐ সকল সূত্র থেকে সংবাদ আসবে তখন এর উপর আমল ওয়াজিব হবে’ এখানে নিকট ও দূরের শহর-নগরের পার্থক্য এজন্য করেননি যে, হযরত রাহ. উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয় মনে করেন, কিন্তু অধিকাংশ ফকীহ এখানে নিকট ও দূরের মাঝে পার্থক্যের প্রবক্তা। তো তাদের কাছে দূর-দূরান্তের শহর-নগর থেকে তরীকে মুজিবের সূত্রে শাহাদত এসে গেলেও এর উপর আমল ওয়াজিব হবে না এবং আমল না করা গুনাহও হবে না।
যাহোক, আমি শুধু দেখাতে চাচ্ছিলাম, উদয়স্থলের বিভিন্নতা অগ্রাহ্য করার অর্থ এই নয় যে, ঐ ফকীহগণের কাছে দূরের উদয়স্থল থেকে শাহাদত সংগ্রহ করাও জরুরি। তা হযরত থানভী রাহ.-এর বক্তব্যে পরিষ্কার ভাষায় পাওয়া গেল। আর এ শুধু একা হযরত থানভী রাহ.-এর কথা নয়, উদয়স্থলের ভিন্নতা অগ্রাহ্যকারী যে কোনো ফকীহকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি এ জবাবই দেবেন; বরং আমাদের জানামতে উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রাহ্যকারী বা অগ্রাহ্যকারী কোনো ইমাম বা ফকীহ পাওয়া যাবে না, যিনি দূরের শহর-নগর থেকে বা অন্যান্য দেশ থেকে চাঁদের খবর সংগ্রহ করাকে ফরয বলেছেন।
আরো দু-একটি উদ্ধৃতি দেখে নিলে মন্দ হয় না :
আমাদের দেশে যারা একই দিনে সওম-ঈদ উদযাপন ফরয বলেন তারা দারুল উলূম দেওবন্দের আকাবির ও ‘ফতোয়া দারুল উলূম দেওবন্দে’র খুব বরাত দিয়ে থাকেন। অথচ সকল আকাবিরে দেওবন্দ এ বিষয়ে একমত যে, সওম ও ঈদের ঐক্য ফরয-ওয়াজিব হওয়া তো দূরের কথা, সুন্নত-মুস্তাহাবও নয় এবং একাধিক আকাবিরে দেওবন্দ তো দূরের শহর-নগরে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্যই মনে করেন। তবে ‘‘ফতোয়ায়ে দারুল উলূম দেওবন্দ’’-এ উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার বিষয়ে একাধিক ফতোয়া আছে। একেই ঐ ভাইয়েরা তাদের উদ্দেশ্যের অনুকূল বানিয়ে নিয়েছেন। অথচ যেমনটা বারবার বলা হয়েছে, শুধু উদয়স্থলের ভিন্নতা অগ্রাহ্য করার ভিত্তিতে ঈদ ও সওমের ঐক্য প্রমাণের চেষ্টা সঠিক নয়।
হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. আকাবিরে দারুল উলূম দেওবন্দের দ্বিতীয় সাড়ির অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ও অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর বক্তব্য এইমাত্র উল্লেখ করা হয়েছে।
মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. জন্মভূমি, ছাত্রজীবন ও শিক্ষকতা-জীবন সব দিক থেকেই দেওবন্দী ছিলেন। ১৩৪৯ হি. থেকে ১৩৬২ হি. পর্যন্ত তো দারুল উলূম দেওবন্দের সদর মুফতী ছিলেন। এরপর পাকিস্তানে উলামায়ে দেওবন্দের মুখপাত্র ও মুফতী আযম পাকিস্তান হিসেবে তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল অবিসংবাদিত। তাঁর পুস্তিকা ‘রুয়াতে হেলাল’ ছাপা আছে এবং এর বাংলা অনুবাদও হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট আলোচনা পাঠ করলে আলোচিত বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে ইনশাআল্লাহ।
মুফতী নেযামুদ্দীন আযমী রাহ. (১৩২৮ হি. -১৪২০ হি.) ১৩৮৫ হিজরী থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দারুল উলূম দেওবন্দের সদর মুফতী ছিলেন। তাঁর ফতোয়াসমূহের এক সংকলন ‘‘মুনতাখাবাতে নেযামুল ফাতাওয়া’’ আরেকটি ‘‘ফাতাওয়ায়ে নেযামিয়্যাহ’’ এবং তৃতীয়টি ‘‘নেযামুল ফাতাওয়া’’ নামে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। এ মাসআলায় মুফতী নেযামুদ্দীন রাহ.-এর কাছে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার সিদ্ধান্তই অগ্রগণ্য। তিনি এর সমর্থনে ‘‘মুনতাখাবাত’’ (খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১১৫) ও ‘‘নেযামিয়্যা’য় (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ১৪৫) বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ সত্ত্বেও তিনি লেখেন,
‘মূল বিধান এই যে, প্রত্যেক জনপদের লোকদের কর্তব্য, ২৯ শাবান সন্ধ্যায় নিজ জনপদের হিসাবে বসতির আশেপাশে চাঁদ খুঁজবে এবং চাঁদ দেখলে সাক্ষ্য দেওয়ার স্থানে গিয়ে সাক্ষী দেবে। দায়িত্বশীলরা শরীয়তের নীতিমালা অনুযায়ী সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হওয়া না হওয়ার ঘোষণা করবে। আর অন্যরা এ ঘোষণা অনুসারে আমল করবে ...
এবং الدين يسر (দ্বীন সহজ) ও الدين الفطرة (দ্বীন স্বাভাবিক)-এর দাবি অনুসারে না (তারা) দূর-দূরান্তের শহর-নগরে চাঁদ খুঁজতে যেতেন আর না (সেখান থেকে) খবর আসার চিন্তা করতেন; বরং আশেপাশে চাঁদ দেখা গেলে বা আশপাশ থেকে চাঁদের খবর শরয়ী শাহাদতের ভিত্তিতে পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী রোযা রাখতেন বা রাখতেন না। আর এটাই হচ্ছে এ শরয়ী নীতির মর্ম-
لأهل كل بلد رؤيتهم
প্রত্যেক জনপদের অধিবাসীদের জন্য তাদের চাঁদ দেখাই ধর্তব্য। হাঁ, যদি কোনো প্রয়াস-প্রচেষ্টা ছাড়া ‘তরীকে মুজিব’-এর সূত্রে উদয়স্থলের ভিন্নতা লেহাজ ছাড়া খবর পাওয়া যেত তাহলে গ্রহণ করতেন এবং সে অনুযায়ী আমলও করতেন। এটুকুই।
(ফাতাওয়া নেযামিয়্যাহ খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ১৪৯, ১৭২, নেযামী বুক ডিপো, দেওবন্দ, ১৪১৫ হি.)
তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেন, চাঁদের ঐক্য শরীয়তের কাম্য নয় এবং এর পাবন্দীও প্রশংসার বিষয় নয়; বরং তা শরীয়তের ইচ্ছা-বিরোধী। তিনি আরো বলেছেন, এ বিষয়ে তিনি তাঁর পুস্তিকা ‘‘তাওহীদুল আহিল্লা’য় বিস্তারিত লিখেছেন। (দ্র. ‘‘মুনতাখাবাতে নেযামুল ফাতাওয়া’’, খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১২২)
মুফতী নেযামুদ্দীন রাহ.-এর পরে দারুল উলূম দেওবন্দের সদর মুফতী হয়েছেন হযরত মাওলানা মুফতী হাবীবুর রহমান খাইরাবাদী। তিনি ১৪২৮ হিজরীতে আমার এক ইসতিফতার জবাবে শুরুতেই বলেন-
‘‘রুয়তে হেলালের বিষয়ে শরীয়তে স্পষ্ট ও সোজা বিধান-
صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته، فإن غم عليكم فأكملوا ثلاثين
অর্থাৎ চাঁদ দেখে রোযা রাখা শুরু কর এবং চাঁদ দেখেই রোযা শেষ কর। অর্থাৎ ঈদ কর। এখন যদি চাঁদ তোমাদের দৃষ্টিগোচর না হয় তাহলে মাস ত্রিশ দিন পুরা কর।
‘‘এ হাদীসের উপর আমল করা হলে কোনো বিশৃঙ্খলা হবে না। শরীয়ত আমাদের উপর এদিক সেদিক খোঁজ করার দায়িত্ব আরোপ করেনি এবং সকল মুসলমানকে একই দিন ঈদ করারও বিধান দেয়নি। আমরা টেলিফোন, ইন্টারনেট, টিভি-রেডিও ব্যবহার করে এদিক সেদিকের চাঁদের খবর অনুসন্ধান করতে শুরু করি বা একই দিন ঈদ পালনের রাজনৈতিক চিন্তা নিজেদের বিষয়ে কায়েম করে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার শিকার হয়ে পড়ি।’’
এ ফতোয়ার উপর মুফতী ছাহেবের দস্তখতের সাথে তারিখ দেওয়া আছে ১৯ রবীউল আওয়াল ১৪২৮ হি. এবং এর উপর মুফতী মাহমূদ হাসান বুলন্দশহরী ও মুফতী মুহাম্মাদ যফীরুদ্দীন (যিনি ফতোয়া দারুল উলূমে’র সংকলক ও টীকাকার) এর সমর্থনমূলক স্বাক্ষর আছে।
এ বিষয়ে দারুল উলূম দেওবন্দের অতি সাম্প্রতিক ফতোয়াও ইনশাআল্লাহ পাঠকবৃন্দের সামনে পেশ করা হবে।
যাহোক, এ ধারা অনেক লম্বা। যদি ভারত উপমহাদেশের সকল দেশের বড় বড় উলামায়ে দেওবন্দ ও তাঁদের ফতোয়া-সংকলন থেকে এ ধরনের উদ্ধৃতি পেশ করতে থাকি তাহলে প্রবন্ধ আরো দীর্ঘ হয়ে পড়বে। এ কারণে আপাতত এ কয়েকটি বরাত উল্লেখ করেই প্রসঙ্গের ইতি টানছি।
বর্তমান আলোচনায় উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রাহ্যকারী ফকীহগণের বক্তব্য তুলে ধরার যদিও প্রয়োজন নেই তবুও প্রাসঙ্গিক হিসেবে একজন ফকীহের বক্তব্য উল্লেখ করা হচ্ছে।
উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রাহ্যকারী একজন ফকীহ ইমাম ইবনে হাজার মক্কী হাইতামী শাফেয়ী রাহ. (৯৭৫ হি.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে,
‘যদি কোনো শহরে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, অমুক শহরে চাঁদ দেখা গেছে, কিন্তু সংবাদটি যথাযথ পন্থায় না পৌঁছায় তাহলে কি এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কর্তব্য হবে ঐ শহর থেকে খবরের সত্যতা যাচাই করা, যাতে বিষয়টির যথার্থতা প্রমাণিত হলে সে অনুযায়ী করণীয় সম্পন্ন করা যায় কিংবা যেহেতু যথার্থ উপায়ে খবর আসেনি তাই সেটিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কতর্ব্য নির্ধারণ করবে, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি লেখেন-
الظاهر أن ولي الأمر لا يلزمه في الصورة المذكورة إرسال من يحقق الخبر، أخذا من قولهم أن تحصيل سبب الوجوب لا يجب ...، فلا يجب الإرسال هنا جزما لأنه ليس سببا محققا للوجوب، سواء أقربت المسافة أم بعدت، نعم لو قيل يندب له ذلك لم يكن بعيدا، لأن فيه احتياطا للصوم، وهو إذا لم يجب يكون مندوبا ... .
এ জবাবের সারকথা এই যে, প্রশ্নোক্ত চাঁদের ফয়সালাকারী দায়িত্বশীলদের অন্যান্য শহরের চাঁদের খবর যাচাই করা জরুরি নয়। বেশি থেকে বেশি এ বলা যেতে পারে যে, যাচাই করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ যাচাই করার পর যদি তা নির্ভরযোগ্য মনে হয় এবং উভয় শহর অভিন্ন উদয়স্থলের বলে জানা যায় তাহলে সে খবর অনুযায়ী আমল করবে।
(আলফাতাওয়াল ফিকহিয়্যাহ, ইবনে হাজার মক্কী হাইতামী খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৬০-৬১, মুআসসাসাতুত তারীখিল আরাবী, বৈরুত)
এ কারণে প্রথমেই বলেছি, যে ফকীহগণ দূরের শহর-নগরেও এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অবশ্য-অনুসরণীয় বলেন তাদের উদ্দেশ্য এই যে, নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কাছে খবর এসে গেলে এবং সূত্রটি ‘তরীকে মুজিব’ হওয়ার বিষয়ে তারা আশ্বস্ত হলে সে অনুযায়ী ফয়সালা করা তাদের অবশ্য কর্তব্য। তাদের উদ্দেশ্য কখনো এই নয় যে, দায়িত্বশীলদের দূর-দূরান্তের শহর-নগর থেকে চাঁদ দেখার সংবাদ যাচাই এবং সন্দেহযুক্ত পন্থায় পৌঁছা সংবাদ যাচাই করা ফরয। এ কথা যদি ঐ ফকীহগণ বলতেন তাহলে সওম ও ঈদের ঐক্য ফরয দাবিকারীগণ ঐ মতামতকে নিজেদের প্রমাণ হিসেবে পেশ করার কিছু সুযোগ পেতেন।
তারা যখন সুস্পষ্টভাবে তা জরুরি না হওয়ার ফতোয়া দিচ্ছেন তখন সওম ও ঈদের ঐক্য ফরয হওয়ার উপর তাদের সিদ্ধান্তকে কীভাবে প্রমাণ হিসেবে আনা যায়?
উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার তাঁদের এ ফতোয়া থেকে তো খুব বেশি হলে এটুকু প্রমাণ হয় যে, সওম ও ঈদের ঐক্যের ক্ষেত্রে উদয়স্থলের ভিন্নতা বাধা নয়। এখন অন্য কোনো বাধা না থাকলে তাদের দৃষ্টিতে এ কাজ (যদি যথাযথ পন্থায় হয় এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে হয়) খুব বেশি হলে মোবাহ হবে। এরপর দেখতে হবে, কোনো মোবাহ কাজের উপর বাধ্য করা বৈধ কি না এবং একে বৈশ্বিক রূপ দেওয়ার শরয়ী বিধান কী। এর প্রত্যাশিত সুফল কী এবং কুফলগুলো কী কী?
আফসোস! এ সকল বিষয়ে ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করার পরিবর্তে উল্টো এক মতভেদপূর্ণ মোবাহ কাজকে ফরয মনে করা হয়েছে এবং এর উপর আমলও করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দায়িশীলদের প্রতি বিদ্রোহ করে এবং শরীয়তসম্মত পন্থা ছাড়া উচ্ছৃঙ্খলভাবে।
টিকা :
টীকা : ১
এরপর ইবনুল হুমাম রাহ. ইবনে আববাস রা.-এর হাদীসের এক প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন, যা তাঁর আগে জাসসাস ও ইবনে কুদামা প্রমুখও উল্লেখ করেছেন এবং শেষ কথা এ বলেছেন যে, ‘যাহিরুর রিওয়ায়াহ’ অনুযায়ী আমল করাই অধিক সতর্কতাপূর্ণ।
টীকা : ২
وعبارة السبكي : واعتبار كل بلد لا يتصور خفاؤه عنهم جيد.
টীকা : ৩
صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته এর সরল স্বাভাবিক অর্থে এ কথা শামিল হয় না যে, ভূপৃষ্ঠের যে কোনো জায়গায় চাঁদ দেখা গেলেই তোমাদের উপর রোযা ফরয হবে, তেমনি ভূপৃষ্ঠের যে কোনো জায়গায় চাঁদ দেখা গেলেই তোমাদের রোযা ছেড়ে ঈদ করা ফরয হবে।
এ হাদীসের স্বাভাবিক অর্থে এ কথা না আসা বিভিন্ন কারণে আমার কাছে স্পষ্ট ও নির্ধারিত বিশেষ বলে মনে হয়। নীচের বিষয়গুলিতে একটু চিন্তা করুন :
ক. প্রত্যেক ‘নসে’র স্বাভাবিক অর্থ তা-ই যা ঐ সব মানুষের উপলব্ধিতে স্বাভাবিকভাবে এসেছে যারা এ নস সরাসরি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছেন এবং তাঁর সামনে এ নস মোতাবেক আমল করেছেন।
খুলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের তাআমুল ও কর্মধারা প্রমাণ করে, তাঁরা এ নসের এ অর্থই বুঝেছেন যে, প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষ নিজ নিজ চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করবে। এ কারণে কখনোও তারা অন্যান্য অঞ্চলের চাঁদের অনুসন্ধান সংক্রান্ত কোনো পদক্ষেপ নেননি।
খ. হাদীসের শেষ বাক্য
فإن غم عليكم فأكملوا العدة ثلاثين
(চাঁদ তোমাদের দৃষ্টির আড়ালে থাকলে মাসকে ত্রিশ দিনের গণ্য করবে) এটিও এক বড় আলামত যে, হাদীসের প্রথম দুই বাক্যে প্রত্যেক অঞ্চলের লোকদের নিজ নিজ চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করতে বলা হয়েছে; কারণ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সারা বিশ্বে একসাথে মেঘ কুয়াশা, বা ধুলোবালির কারণে চাঁদ দৃষ্টিগোচর না হওয়া এক রকম অসম্ভবই বলা যায়। সুতরাং যদি হাদীসের প্রথমাংশের অর্থ এ-ই হত যে, কোনো জায়গায় চাঁদ দেখা গেলেই তোমাদের উপর রোযা ফরয হবে তাহলে হাদীসের শেষ অংশ এমন হওয়া স্বাভাবিক ছিল যে, ‘চাঁদ যদি অদৃশ্য থাকে তাহলে অন্যান্য অঞ্চলে চাঁদ দেখা গেছে কিনা অনুসন্ধান কর কিংবা অন্তত কোনো জায়গা থেকে কোনো খবর আসে কিনা অপেক্ষা কর।’ অথচ হাদীসে এমনটা বলা হয়নি; বরং মেঘ বা ধুলোবালির কারণে চাঁদ দেখা না গেলে মাসকে ত্রিশ দিনের গণ্য করতে বলা হয়েছে।
গ. যদি হাদীসের স্বাভাবিক অর্থ এই হত যে, ‘কোথাও চাঁদ দেখা গেলেই রোযা রাখবে’ তাহলে সতর্কতার দাবি হত, ৩০ শাবানের রাতে (২৯ শাবান দিবাগত রাতে) আকাশ পরিষ্কার থাকা সত্ত্বেও যদি নিজ এলাকায় চাঁদ দেখা না যায় তাহলেও সতর্কতামূলকভাবে তারাবীহ পড়ে নেওয়া হবে, সাহরী খেয়ে নেওয়া হবে এবং সতর্কতামূলকভাবে ত্রিশ শাবানের রোযা রাখা হবে। অথচ না এ সালাফের কর্মধারা ছিল, না তা ফিকহে ইসলামীর হুকুম; বরং মাসআলা এই যে, চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার আগে তারাবীও পড়া হবে না এবং সাহরীও খাওয়া হবে না এবং সন্দেহের ভিত্তিতে ত্রিশ শাবানের রোযাও রাখা হবে না।
একইভাবে أفطروا لرؤيته -এর স্বাভাবিক অর্থ যদি এ হত যে, যেখানেই চাঁদ দেখা যাক তোমরা রোযা ত্যাগ করবে এবং ঈদ করবে তাহলে তো বিধান এ হওয়া দরকার ছিল যে, ২৯ রমযানের রাতে নিজ এলাকায় চাঁদ না দেখা গেলে ঐ রাতে তারাবী পড়বে না। কারণ হতে পারে কোনো জায়গা থেকে চাঁদের প্রমাণ এসে যাবে। তেমনি ত্রিশ রমযানের রোযার নিয়ত শেষ সময় পর্যন্ত বিলম্বিত করা হবে, যাতে শাওয়ালের চাঁদ প্রমাণিত হলে শুধু শুধু রোযা ভাঙতে না হয়। অথচ এমন করা না সালাফের কর্মধারা ছিল, আর না এ ফিকহে ইসলামীর হুকুম। মাসআলা এই যে, নিজ এলাকায় চাঁদ দেখা না গেলে অপেক্ষায় থাকবে না। তারাবীর সময় হয়ে গেলে তারাবী পড়বে, সাহরীর সময় হয়ে গেলে সাহরী কর এবং রোযা রাখবে। কারণ এ মাস তোমাদের জন্য ত্রিশ দিনের।
মোটকথা, উপরোক্ত হাদীসে চাঁদ দেখাকে ব্যাপক অর্থে নেওয়া নিছক একটি শব্দগত সম্ভাবনা, এটি হাদীসের স্বাভাবিক অর্থ কখনো নয়। এ কারণেই সালাফের চিন্তায় এ অর্থ আসেনি এবং এ কারণেই আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেছিলেন-
لا، هكذا أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم
ঙ. এখন প্রশ্ন এই যে, তাহলে এ মাসআলা (দূর-দূরান্তের চাঁদ দেখা অবশ্য অনুসরণীয় হওয়া না হওয়া) ইজতিহাদী কীভাবে থাকল? এর জবাব এই যে, এ হাদীসের স্বাভাবিক অর্থ তো সেটাই যা উপরে বলা হয়েছে এবং সে অর্থ অনুসারেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানায়, খুলাফায়ে রাশেদীন ও খাইরুল কুরূনের যুগে আমল জারি ছিল। কিন্তু এরই সাথে কিছু হাদীস ও আছার দ্বারা এ কথাও প্রমাণিত যে, লোকেরা এ হাদীসের উপর আমল করে শাবান মাসকে ত্রিশ দিনের গণ্য করেছেন, রোযা রাখা থেকে বিরত থেকেছেন কিন্তু দিনের বেলায় নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য যখন এসেছে তখন তা গ্রহণ করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকার আদেশ করা হয়েছে। একইভাবে লোকেরা এ হাদীসের উপর আমল করে রমযানের ত্রিশ তারিখে রোযা অবস্থায় ছিলেন, হঠাৎ নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য এসেছে এবং তা গ্রহণ করে রোযা ভাংগার আদেশ করা হয়েছে।
সাক্ষ্য কবুল করার এ হাদীসগুলোর প্রেক্ষাপট এই যে, নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহ থেকে সাক্ষ্য এসেছিল এবং তা গ্রহণ করা হয়েছিল। এখন দূর দূরান্তের সাক্ষ্যের বিষয়টি অস্পষ্ট। হতে পারে, ঐ যুগে যদি এর কোনো সম্ভাবনা থাকত এবং দূর থেকে সাক্ষ্য আসত, তাহলে তা গ্রহণ করা হত। আবার এ সম্ভাবনাও আছে যে, গ্রহণ করা হত না, তবে আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর ঐ হাদীসে, যাতে শামবাসীদের চাঁদ দেখার ইতিবার করা হয়নি, এটাই প্রমাণিত হয় যে, দূর-দূরান্তের সাক্ষ্য জানার ব্যবস্থা হলেও তা কবুল করা হত না। যাইহোক, যেহেতু দূর-দূরান্তের সাক্ষ্যের বিষয়টি স্পষ্ট মারফু হাদীসে আসেনি তাই এ বিষয়ে ফকীহগণ ইজতিহাদ করেছেন এবং তাতে মতভিন্নতা হয়েছে। তো এই ইজতিহাদ ও মতভেদ অন্য এলাকার চাঁদের সাক্ষ্য গ্রহণ সংক্রান্ত হাদীস ও তার মর্মের সাথে সম্পৃক্ত, صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته -এর সাথে নয়। এ হাদীসের স্বাভাবিক অর্থ সেটিই যা সালাফের তাআমুল ও কর্মধারার দ্বারা প্রমাণিত।
والله تعالى أعلم بالصواب
দ্রষ্টব্য : তলাবায়ে কেরাম, হাদীসের কিতাবসমূহের দরসদানে নিয়োজিত এবং ফিকহ-ফতোয়ার খেদমতে মশগুল উলামায়ে কেরামের খেদমতে দরখাস্ত এই যে, এ টীকায় উল্লেখিত আলোচনায় বান্দার কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে তা জানিয়ে শোকরগোযারির সুযোগ দান করবেন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)