ঈমান বিল আখিরাহ
কুরআন মজীদ নূর ও আলোর উৎস। কুরআনের প্রতিটি আয়াতের আছে নূর ও আলো। ঈমানের নূর এবং ইলমের আলো। আল্লাহ তাআলা আমাদের সে আলো গ্রহণের তাওফীক দান করুন এবং আমাদের কর্ম ও বিশ্বাসকে আলোকিত করুন।
আজকের মজলিসে সূরা সাবার কয়েকটি আয়াত তিলাওয়াত করছি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَأْتِينَا السَّاعَةُ قُلْ بَلَى وَرَبِّي لَتَأْتِيَنَّكُمْ عَالِمِ الْغَيْبِ لَا يَعْزُبُ عَنْهُ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَلَا أَصْغَرُ مِنْ ذَلِكَ وَلَا أَكْبَرُ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ لِيَجْزِيَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ وَالَّذِينَ سَعَوْا فِي آَيَاتِنَا مُعَاجِزِينَ أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مِنْ رِجْزٍ أَلِيمٌ
এ আয়াতগুলো ইরশাদ হয়েছে ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঈমান বিল আখিরাহ সম্পর্কে। ইলমে ওহীর আলোক-বঞ্চিত ও চরম ইহজাগতিকতার শিকার মানব-শ্রেণির জন্য আখিরাত হচ্ছে সবচেয়ে বড় অবিশ্বাসের বিষয়। সব যুগের ও সব সমাজের অবিশ্বাসীদের মাঝে, যুগ ও সমাজের বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও, এ বিষয়ে রয়েছে চূড়ান্ত ঐক্য। তো বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও প্রভু আল্লাহ রাববুল আলামীনের পক্ষ হতে অবতীর্ণ সর্বশেষ আসমানী কিতাবে সর্বশেষ নবীর যবানীতে এ অবিশ্বাস খন্ডন করা হয়েছে। এরই সাথে আরেকটি বাস্তবতার সংবাদও এ আয়াতগুলোতে দেয়া হয়েছে। আর তা হচ্ছে কাযা ও কদর। তো এ দুই আকীদা-আখিরাত ও তাকদীর সম্পর্কে কিছু কথা আরজ করব ইনশাআল্লাহ।
প্রথমে আয়াতগুলোর সরল অনুবাদ :
‘‘কাফিররা বলে, আমাদের কাছে কিয়ামত আসবে না।’’ কিয়ামত আসবে না অর্থ, কিয়ামতের পরে যা কিছু ঘটার তা-ও ঘটবে না- পুনরুত্থান হবে না, হিসাব-নিকাশ হবে না, জান্নাত-জাহান্নাম কিছুই আসবে না। (নাউযুবিল্লাহ!)
‘‘আপনি বলুন, ‘অবশ্যই আসবে, আমার মালিক ও পরওয়ারদেগারের কসম! যিনি সকল গায়ব সম্পর্কে অবগত, অবশ্যই কিয়ামত তোমাদের নিকট আসবে। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর কণা পরিমাণ কিছু তাঁর অবগতির বাইরে নয় এবং তার চেয়েও ছোট বা বড় কিছু নেই, যা না আছে সুস্পষ্ট কিতাবে।’’
কাফেররা মৃত্যুর পরের জীবনকে অস্বীকার করে এবং অসম্ভব মনে করে। আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ করেছেন, আপনি বলুন, অবশ্যই কিয়ামত আসবে। কীভাবে বলবেন? আপনার রবের কসম করে বলুন।
আল্লামা ইবনে কাছীর রাহ. বলেন, এটি ঐ তিন কসমের একটি, যেখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে আখিরাতের পুনরুত্থান সম্পর্কে কসম করতে বলেছেন। সে তিন কসমের প্রথমটি সূরা ইউনুসে। (১০ : ৫৩)
وَيَسْتَنْبِئُونَكَ أَحَقٌّ هُوَ قُلْ إِي وَرَبِّي إِنَّهُ لَحَقٌّ وَمَا أَنْتُمْ بِمُعْجِزِينَ
‘‘তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘এ (কিয়ামত) কি সত্য?’ আপনি বলুন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই, কসম আমার রবের! অবশ্যই তা সত্য। আর তোমরা তা ব্যর্থ করতে পারবে না’।’’
দ্বিতীয়টি সূরা সাবার এ আয়াত, যা এখন তিলাওয়াত করা হল।
আর তৃতীয়টি হচ্ছে সূরা তাগাবুনের সপ্তম আয়াত। (৬৪ : ৭)
زَعَمَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنْ لَنْ يُبْعَثُوا قُلْ بَلَى وَرَبِّي لَتُبْعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلْتُمْ وَذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ
‘‘কাফেররা মনে করেছে, ওরা কখনো পুনরুত্থিত হবে না। আপনি বলুন, ‘অবশ্যই, কসম আমার রবের! অবশ্যই তোমরা পুনরুত্থিত হবে। এরপর তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করা হবে। আর এ আল্লাহর পক্ষে-সহজ’।’’
আখিরাতে বিশ্বাসই সকল অন্যায়-অনাচারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এ বিশ্বাস জাগ্রত থাকলে নির্দ্বিধায় পাপাচারে লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। তাই পাপাসক্ত মানুষ আখিরাতকে ভুলে থাকতে চায়। আর কাফিররা সরাসরি অস্বীকার করে নিজ সত্তার ব্যাকুলতা দমন করতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, মানবের যিনি স্রষ্টা তাঁর কাছে মানবকে ফিরে যেতেই হবে। বিশ্বাস করলেও যেতে হবে, বিশ্বাস না করলেও যেতে হবে। অস্বীকার করলেই কি বাস্তবতা টলে যায়? মাটির ঢিবিতে মুখ গুঁজলেই কি প্রলয় থেমে যায়?
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে শপথ করে বলার আদেশ। আল্লাহ তাঁর এ বাস্তবতা মানবজাতিকে জানাতে বলেছেন। আর তা জানাতে বলেছেন তাঁর পবিত্র নামের কসম সহকারে। অর্থাৎ এ এমনই অমোঘ বাস্তবতা, যা কোনোভাবেই টলার নয়।
কুরআন মজীদে যেসব জায়গায় আল্লাহ তাআলা শপথ করে কিছু বলেছেন সেখানে সেই শপথের ভাষার মাঝেই নিহিত থাকে ঐ বিষয়ের দলীল ও সমাধান। এখানে শপথ করে বলা হয়েছে, কিয়ামত আসবে। আর এ শপথের সাথে উল্লেখিত হয়েছে তাঁর ‘রব’ গুণ ও ‘আলিমুল গাইব’ গুণ। বলা হয়েছে, তিনি সকল গায়ব সম্পর্কে জ্ঞাত। আসমান-যমীনে কণা পরিমাণ কিছু নেই, যা তাঁর অজানা। এ তাঁর অসীম জ্ঞানের বিবরণ। আরো বলা হয়েছে, ‘জগতের ছোট-বড় সব কিছু লওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ আছে’। এ তাঁর সীমাহীন ও বাধাহীন কুদরতের বর্ণনা। কিয়ামত-প্রসঙ্গে এ দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখের তাৎপর্য হচ্ছে, মৃত্যুর পর মানুষের দেহ যখন মাটির সাথে মিশে যায় তখন মানবের দৃষ্টি থেকে এ দেহ-সত্তা হারিয়ে যায়। ‘দৃষ্টিহীন’ মানুষ একেই মনে করে মানবের বিলুপ্তি। আর এ কারণেই মানবের কাছে পুরুত্থান অসম্ভব মনে হয়। কিন্তু যাঁর সামনে সৃষ্টি জগতের প্রতিটি অণু-পরমাণু উপস্থিত, তাঁর দৃষ্টি থেকে এ ‘বিলুপ্ত’ মানবও হারিয়ে যায় না। তার রূহ বা আত্মা আল্লাহর আদেশের অধীন। আর তার দেহের প্রতিটি কণা তাঁর জ্ঞান-দৃষ্টির সম্মুখে উপস্থিত। সেই মহাজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইচ্ছায় জগতের ছোট বড় সবকিছু যেমন লওহে মাহফূযে ‘উপস্থিত’ হয়েছে তেমনি মানবদেহের এ অদৃশ্য কণাগুলোও আল্লাহর আদেশমাত্র সপ্রাণ ও পুনর্গঠিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে।
তো কসমের মাঝেই আছে কসমকৃত বিষয়ের সমাধান।
কিয়ামত কখন হবে -এটিও গায়বের বিষয়। আল্লাহ তাআলা তা সুস্পষ্টভাবে জানেন। ‘তিনি কিয়ামত সম্পর্কে জানেন’ -এ কথার অর্থ এই নয় যে, অন্য কেউ তা ঘটাবে আর তিনি তা জানেন (নাউযুবিল্লাহ); বরং তিনিই তা ঘটাবেন। সুতরাং কখন ঘটাবেন সে সম্পর্কে তিনিই সম্যক অবগত।
এ তাঁর ফয়সালা। আর বলাই বাহুল্য, তিনি তাঁর ফায়সালা সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। তাঁর এ জানার, এ সিদ্ধান্তের ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভবই নয়। তো কিয়ামত প্রসঙ্গে ‘আলিমুল গাইব’ গুণটির উল্লেখ খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ।
আল্লাহ তাআলার জ্ঞানের এক প্রকাশস্থল হচ্ছে লওহে মাহফূয। প্রত্যেক মানবের কল্যাণ-অকল্যাণ, জাতি-সমাজ-রাষ্ট্র ও গোটা সৃষ্টিজগতের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত এতে লিপিবদ্ধ।
وَذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ
আর এ আল্লাহর জন্য সহজ। দুনিয়ার ছোট-বড় সব কিছু সম্পর্কে অবগত থাকা, অতপর তা লওহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ করা আল্লাহর জন্য মোটেই কঠিন নয়, সহজ।
আল্লাহ তাআলা কেন বলেছেন, এ তাঁর জন্য সহজ? কারণ, মানবের কাছে এ এক অচিন্তনীয় ব্যাপার। ওহীর আলোকবঞ্চিত মানুষের কাছে তা অসম্ভব মনে হয়। আসলে আল্লাহর সিফাত ও গুণাবলীকে মানুষ যখন নিজের গুণ ও বৈশিষ্ট্যের দ্বারা পরিমাপ করার চেষ্টা করে তখনই সে বিভ্রান্ত হয় এবং আল্লাহ তাআলার বাণী ও কর্ম তার কাছে অসম্ভব মনে হয়। নিজ জ্ঞান ও ক্ষমতার দুর্বলতা আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার উপর আরোপ করে মানুষ গোমরাহ হয়ে যায়। অথচ খুব সহজ কথা যে, স্রষ্টা ও সৃষ্টির গুণাবলী কখনো একরকম হতে পারে না। যিনি এ গ্রহ-নক্ষত্র, এই জগত-মহাজগতের স্রষ্টা, যাঁর ইচ্ছায় সৃষ্টিজগত তার অচিন্তনীয় ব্যাপ্তি ও অকল্পনীয় সূক্ষ্মতা সহকারে চলমান তাঁর জ্ঞান ও সক্ষমতা ক্ষুদ্র মানব কীভাবে পরিমাপ করবে?
তো এই শপথের সাথে আল্লাহ তাআলার যে গুণ ও বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ হয়েছে তা উপলব্ধি করার পর শপথের বিষয়বস্ত্ত, অর্থাৎ কিয়ামতের আগমন ও কিয়ামতের পরে মানবের পুনর্জীবন, হিসাব-নিকাশ, জান্নাত-জাহান্নাম কোনো কিছুকে অসম্ভব মনে করার উপায় থাকে না।
এরপর বলা হয়েছে, কেন কিয়ামত হবে এবং কেন কিয়ামতের পর পুনরুত্থান হবে।
لِيَجْزِيَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ وَالَّذِينَ سَعَوْا فِي آَيَاتِنَا مُعَاجِزِينَ أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مِنْ رِجْزٍ أَلِيمٌ
আল্লাহ পাক মানুষকে তার কৃতকর্মের বিনিময় দান করবেন। যারা ঈমান এনেছে ও ভালো কাজ করেছে তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। আর যারা অবিশ্বাস করেছে এবং অবাধ্যতায় লিপ্ত থেকেছে তাদেরকে শাস্তি দিবেন।
কুরআন কারীমের অন্য জায়গায় ইরশাদ হয়েছে-
أَفَنَجْعَلُ الْمُسْلِمِينَ كَالْمُجْرِمِينَ
আমি কি বাধ্য ও অবাধ্যদের সমান করে দেব?
অর্থাৎ যদি কিয়ামত না আসে, হিসাব নিকাশের পর্ব না থাকে তাহলে এর অর্থ হয়, বিশ্বাস-অবিশ্বাস সমান, ন্যায়-অন্যায় সমান, ভালো ও মন্দ সমান। যে ভালো কাজ করছে আর যে মন্দ কাজ করছে, যে আল্লাহর আনুগত্য করছে আর যে আনুগত্য পরিহার করছে তাদের সবার পরিণাম এক। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সবারই বিলুপ্তি ঘটবে। এটা কীভাবে সম্ভব? আল্লাহ পাকের আদল ও ইনসাফের কাছে এটা সম্ভবই নয়। আল্লাহ পাকের ন্যায়বিচার, তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর কুদরতের সাথে এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ হতেই পারে না।
সেজন্যই বললেন,
مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ
কি হল তোমাদের? তোমাদের জ্ঞান-বুদ্ধির এই বিপর্যয় কেন? তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে মনে করেছ যে, তিনি তাঁর অনুগত বান্দা আর বিদ্রোহী বান্দাদের সমান করে দেবেন! তাদের পরিণাম এক করে দেবেন! কক্ষনো না।
সেকথাই এখানে বলেছেন অন্যভাবে, অবশ্যই কিয়ামত হবে। কারণ আমি আমার বিশ্বাসী ও নেককার বান্দাদের উত্তম প্রতিদান দিব। আর আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে সচেষ্ট অবাধ্য অবিশ্বাসীদের যন্ত্রণাদায়ক ও লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তির মুখোমুখি করব।
এই হল কিয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা। এটি এ আয়াতগুলোর মূল বিষয়। এখানে পরোক্ষভাবে আরেকটি বিষয় এসেছে। আর তা হচ্ছে কাযা ও কদর। অর্থাৎ আমাদের জীবনের সবকিছু আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে স্থিরকৃত। আমাদের জীবনে যা কিছু ঘটবে, আমাদের হায়াত-মওত, রিযিক-জীবিকা, উন্নতি-অবনতি, সুখ-দুঃখ, সবকিছু আগে থেকেই আল্লাহ পাকের জানা আছে। অর্থাৎ তাঁর পক্ষ থেকে স্থিরকৃত ও নির্ধারিত।
আমাদের সকল বিষয় যে নির্ধারিত এ কথা আল্লাহ তাআলা আমাদের না জানালে তা জানার উপায় আমাদের ছিল না। তিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদের তা জানিয়েছেন। এটা তাঁর অনেক বড় অনুগ্রহ।
তাকদীরে যার বিশ্বাস আছে, তার কোনো দুঃখ নেই। যত বড় মুসিবত তার সামনে আসুক, যত বড় বিপদ তার ওপর নামুক সে জানে, এটা তার জন্যে নির্ধারিত ছিল। তার বিশ্বাস, এটা আমার জন্য আমার রবের, আমার পালনকর্তার ফয়সালা। তাই তা হয়েছে। এটা তার সবচে’ বড় অবলম্বন। সবচে বড় সান্ত্বনা। এ সান্ত্বনা যার আছে তার কোনো ভয় নেই। সে হয়তো কষ্ট পাবে, দুঃখ পাবে। মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট আসেই। তা সে মেনে নেবে। ধৈর্য্য ধরবে। সে ভেঙ্গে পড়বে না। বিপর্যস্ত হবে না। পক্ষান্তরে যাদের তাকদীরে বিশ্বাস নেই, তাকদীরে বিশ্বাসের অবলম্বন নেই তারা একটু বড় বিপদে পড়লেই বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। বিপদের চেয়েও বড় বিপদ হচ্ছে বিপদকে মেনে নিতে না পারা। এজন্যই দেখা যায়, মুসলিম সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক কম। অমুসলিম সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি। মুসলমানদের মধ্যে যারা নেককার, দ্বীনদার তাদের মধ্যে তো এ বিপদ নেই বললেই চলে। অথচ এরাই তো বাহ্যিকভাবে বেশি দুঃখ-কষ্টে থাকে। বাহ্যিকভাবে তারাই তো দুর্বল। তাদের সম্পদ কম। সক্ষমতা কম। দুনিয়ার যে সব প্রাপ্তি তা তাদের খুবই কম। এরপরও শান্তি এদেরই বেশি। এরাই শান্তিতে থাকে। বড় রকমের বিপর্যস্ত অবস্থা এদের হয় না। এর মূল কারণ, তদের আছে ঈমানের অবলম্বন। তাকদীরের অবলম্বন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-কে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু নসীহত করেছিলেন। তার মধ্যে একটি নসীহত ছিল-জেনে রেখো, যে বিপদের শিকার তুমি হও কিংবা যে কল্যাণ তুমি লাভ কর তা তোমার জন্য নির্ধারিত ছিল। এর ব্যতিক্রম হওয়ার ছিল না। অর্থাৎ যা ঘটার ছিল তা-ই ঘটেছে। যে বিপদ থেকে বেঁচে গেছ তা থেকে বাঁচবে বলেই বেঁচে গেছ। তেমনি যে কাঙ্ক্ষিত বস্ত্ত তুমি পাওনি তা পাবে না বলেই পাওনি। কখনো কখনো বিপদ এত কাছ দিয়ে চলে যায় যে, মানুষ আঁৎকে উঠে বলে, ‘আহ! অল্পের জন্যে বেঁচে গেলাম।’ তেমনি কখনো কখনো প্রাপ্তি এত কাছে এসে ছুটে যায় যে, মানুষ আফসোস করে বলে ওঠে, ‘হায়! একটুর জন্যে ফস্কে গেল!’ তো যে বিপদ আল্লাহর ফয়সালা না হলে এত কাছে এসেও বিদ্ধ করে না, যে প্রাপ্তি আল্লাহর ফয়সালা ছাড়া হাতের নাগালে এসেও ধরা দেয় না সেই বিপদের ভয়ে, সেই প্রাপ্তির আশায় কীভাবে আল্লাহর হুকুম বরবাদ করা যায়?
তো যে মুমিনের তাকদীরে বিশ্বাস আছে সে সুখে-দুঃখে, সুস্থতায়-অসুস্থতায়, শান্তিতে-সংকটে সর্বাবস্থায় শান্ত-সমাহিত থাকে-না প্রাপ্তির আনন্দ তাকে আত্মহারা করে, না অপ্রাপ্তির বেদনা বিপর্যস্ত করে। সকল অবস্থায় সে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং বলে, আল্লাহ আমার জন্য যে ফয়সালা করেছেন তা-ই হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তা-ই হবে যা তাঁর ফয়সালা। সুতরাং তার কল্যাণ-অন্বেষণ এবং অকল্যাণ থেকে আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা সবই হয় সহজ, স্বাভাবিক এবং আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেক। এই যে শান্তি ও প্রশান্তি, এই যে সহজতা ও স্বাভাবিকতা এ হচ্ছে তাকদীরে বিশ্বাসের সুফল। একদিক থেকে একে বলা যায় পার্থিব সুফল। আর আখিরাতের সুফল হচ্ছে, তাকদীরে বিশ্বাস ছাড়া কেউ আল্লাহর দরবারে মুমিন গণ্য হবে না। ঈমানের জন্য এ এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
তো এ আয়াতগুলোতে দু’ টো বিষয় পাওয়া গেল : এক. আখিরাতের অমোঘ ঘোষণা। আখিরাত আসবে, পুনরুত্থান হবে, হিসাব-নিকাশ হবে, মানব-জীবনের ঐ পর্বকে ভুলে থাকার বা উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই।
দুই. তাকদীরের খবর। আমাদের কল্যাণ-অকল্যাণ সব আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত। সেভাবেই সব ঘটছে এবং ঘটবে যেভাবে আল্লাহর জ্ঞান ও ফয়সালায় আছে। এ বিশ্বাসের পার্থিব ও পরকালীন সুফল সম্পর্কেও কিছু কথা বলা হল।
আল্লাহ তাআলা কবুল করুন এবং আমাদের সকলকে ঈমানের মজবুতি দান করুন। আমীন।
[সাপ্তাহিক দরসে তাফসীর থেকে ধারণ ও লিখনে : তাওহীদুল ইসলাম তাইয়্যিব]