সেই পায়ের একটুখানি ধূলোর জন্য
আল্লাহর অশেষ শোকর, দীর্ঘ পথের অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে; অনেক মরুভূমি ও মরূদ্যান অতিক্রম করে সফলতার কিছু আনন্দ এবং ব্যর্থতার বহু বেদনার তিক্ত-মধুর স্মৃতি বুকে ধারণ করে সম্ভবত এখন আমি আমার শিক্ষক-জীবনের তৃতীয় পর্যায়ে উপনীত হতে চলেছি।
নুরিয়া মাদরাসায় বারবছরের একটি যুগ ছিলো আমার শিক্ষক-জীবনের প্রথম পর্যায়। হায়, কী সবুজ সজীব দিনগুলো ছিলো! যৌবনের উদ্যম ছিলো, উদ্দীপনা ছিলো, আবেগ ছিলো, উচ্ছ্বাস ছিলো, অনেক স্বপ্ন ছিলো, অনেক কল্পনা ও পরিকল্পনা ছিলো; সবকিছুর উপরে ছিলো হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর নূরানি ছোহবত ও তারবিয়াত এবং আমার প্রাণপ্রিয় হযরাতুল উস্তায পাহাড়পুরী হুযূর (দামাত বারাকাতুহুম)-এর সেণহছায়া ও সযত্ন তত্ত্বাবধান, জীবনের-পথের নতুন মুসাফিরের জন্য যার প্রয়োজন ততটা, জীবনের জন্য যতটা প্রয়োজন আলো ও বাতাসের।
আলহামদু লিল্লাহ, আমার নূরিয়ার জীবনের প্রিয় ছাত্ররা সাদা-কালো দাড়ি নিয়ে এখন নিজ নিজ ক্ষেত্রে কর্মমুখর জীবন যাপন করছে। তারা বলতে পারবে, কেমন ছিলো আমার সেই জীবনের সোনালী দিনগুলো।
***
সময় বয়ে যায়, জীবন এগিয়ে যায় এবং জীবন ফুরিয়ে যায়। একদিন হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর দুনিয়ার জীবন শেষ হলো এবং আখেরাতের জীবন শুরু হলো। এদিকে আমাদের জীবনে ঝড় উঠলো, সাজানো বাগান তছনছ হলো। একদিন হযরাতুল উস্তায পাহাড়পুরী হুযূর নুরিয়া থেকে বিদায় নিলেন এবং নূরিয়ার দুয়ারে দাঁড়িয়ে অশ্রুভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘হামারা খূন ভী শামিল হ্যায় তাযয়ীনে গুলিস্তাঁ মেঁ/ হামেঁ ভী ইয়াদ রাখনা চ্যম্যন মেঁ জ্যব বাহার আয়ে।
(আমাদেরও রক্ত আছে মিশে সাজানো বাগানের মাটিতে/ আমাদেরও মনে রেখো, বাগানে যখন আসে বসন্ত।)
তিনি নূরীয়া থেকে বের হলেন, আমাকেও বের হতে হলো।
হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর পক্ষ হতে আমার জন্য ইশারা ছিলো, বাড়ীতে এসে বসার। সেখানে হযরাতুল উস্তাযের আদেশে মাদরাসাতুল মাদীনাহ’র মাধ্যমে শুরু হলো আমার শিক্ষক-জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়। গায়ব থেকে ইশারা ছিলো, আমার এ জীবন হবে পঁচিশ বছরের। এখন চলছে চবিক্ষশতম বছর।
আমার জান্নাতবাসী বাবাকে আল্লাহ উত্তম বিনিময় দান করুন। যে যমীনে তাঁর ‘খুন-পসিনা’ এক হয়েছে সেখান থেকে মাদরাসাতুল মাদীনাহর যাত্রা শুরু হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর এখন এক যুগ পার হতে চলেছে। এই মাটি থেকেই মাদানি নেছাবের ঝরণা প্রবাহিত হয়েছে। অনেক স্বপ্ন এখানে ভেঙ্গেছে, তবে কিছু স্বপ্ন সুন্দর পেখম মেলেছে। এখান থেকে আমি আগামী দিনের পথ পেয়েছি, পাথেয় পেয়েছি। আল্লাহর রহমতের কাছে আশা করি, আমার বাবার কবরকে আল্লাহ জান্নাতের টুকরা বানিয়েছেন। জান্নাতের বাতাস এবং সুবাস তাঁকে শান্তিতে রেখেছে। সেখানে তিনি ঘুমিয়ে আছেন শান্তির ঘুম। এমনই আশা করি, আর আল্লাহর বান্দার সঙ্গে তার আশা ও ধারণার অনুরূপ আচরণ করেন, এটা তিনি নিজে বলেছেন হাদীছে কুদসীতে।
আমি আমার দীর্ঘ শিক্ষক-জীবনে অনেক পেয়েছি। মাথার উপর যেমন আছে উস্তাযের সেণহ-শাফকাতের ছায়া, তেমনি সঙ্গে আছে পেয়ারা তালেবানে ইলমের মায়া, মুহববত।
আল্লাহর রহমতে, তারপর সবার সম্মিলিত মেহনতে মাদানি নেছাবের সেই ছোট্ট চারাটি এখন ধীরে ধীরে সবুজ ছায়া বিস্তার করতে শুরু করেছে। যামানার বে-রহম তুফান থেকে আল্লাহ যেন একে রক্ষা করেন। একদিন এ বৃক্ষ যেন হয়, ‘আছলুহা ছাবিতুন ওয়া ফার‘উহা ফিস্সামা’-এর সুন্দর নমুনা[1]
***
মানুষের জীবনে যা কিছু ‘শুভ ও শুভ্র’ তা আল্লাহরই দয়া ও দান। নিজের শক্তিতে, যোগ্যতা ও প্রতিভার বলে মানুষ কিছু অর্জন করতে পারে না, আল্লাহ দয়া করে দান করেন। আর আল্লাহর দয়া ও দান এত অসংখ্য যে, কেউ যদি গণনা করতে চায়, তা শুমার করতে পারে না। কিন্তু মানুষ তার মূর্খতার হাতে এমনই ‘যিম্মি’ যে, সবকিছুকে সে মনে করে নিজের যোগ্যতা ও প্রতিভার অর্জন। তাই আল্লাহ বলেছেন, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে শোকরগুজার খুবই কম।’
জীবনকে আমরা শুধু ভোগ করি, এমনকি বড় নির্দয়ভাবে জীবনের অপচয় করি। কখনো জীবনের খাতা খুলে জীবনের হিসাব দেখি না। একটু যদি অবসর হতো; একটু যদি হিসাব মেলানো সম্ভব হতো তাহলে নিজেকে জিজ্ঞাসা করার সুযোগ হতো, ‘কোত্থেকে আসে আলো-বাতাস; কীভাবে চলে জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাস?!’
হে আল্লাহ, জীবনের সূর্যোদয় থেকে জীবনের এই পড়ন্ত বেলা পর্যন্ত যা কিছু তুমি দান করেছো সেজন্য তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আর জীবনের বাকি পথটুকুর জন্য হে আল্লাহ, আমি তোমার দয়া ও দানের ভিখারী।
হে আল্লাহ, আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে তোমারই দয়া ও দানরূপে আমার প্রাণপ্রিয় উস্তায আমার অন্ধকার জীবনে এসেছিলেন আলোর প্রদীপ হয়ে। সেই প্রদীপের আলোতে পথচলা শুরু করেছি, এখনো চলছি। হে আল্লাহ, এ আলো যেন চিরউজ্জ্বল থাকে আমার জীবনের চলার পথে।
***
জীবনের স্বপ্ন দেখা আমার যখন শুরু হয়নি তখন একদিন প্রাণপ্রিয় উস্তায একটি আশ্চর্য মধুর স্বপ্ন দেখেছেন। চারদিকে পানি, মাঝখানে একটি সবুজ দ্বীপ। পানি পার হয়ে সেই দ্বীপে গিয়ে দেখেন সবাই আরবী ভাষায় কথা বলে। আর দেখেন, তালেবানে ইলমের বিরাট মজমায় তার প্রিয় শাগিরদ দারস-তাদরীসে মশগুল।
স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছিলেন, ‘এই সবুজ দ্বীপ ইনশা‘আল্লাহ একদিন সত্য হবে। আল্লাহ আপনাকে একটি সবুজ ভূখন্ড দান করবেন। সেখানে ....’
সেই সবুজ দ্বীপের সন্ধানে এখানে সেখানে কতখানে গিয়েছি! কত দীর্ঘ পথ হেঁটেছি! কত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি এবং কত মানুষের ‘কথা শুনেছি’![2]
হযরাতুল উস্তায নিজেও আমাকে সঙ্গে করে পূবে পশ্চিমে বহুখানে গিয়েছেন। একদিনের কথা মনে আছে, সবুজ ফসলের একটি জমি তাঁর খুব পছন্দ হলো, আর মনে হলো হয়ত এটাই স্বপ্নের সেই সবুজ দ্বীপ। সেই জমির পাশে দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটি রুমাল আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা আপনার কাছে রাখেন।’
এমন আপ্লুত হলাম, হৃদয় এমন উদ্বেলিত হলো যে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা হারিয়ে ফেললাম! চোখদু’টো শুধু ছলছল করে উঠলো, আর সেই রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছলাম।
তারপরই ঘটলো দুঃখজনক ঘটনা। মনে পড়লে এখনো লজ্জায় এতটুকুন হয়ে যাই! কিছু দূর এসে হুযূর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মাওলানা, রুমালটা কোথায়?’
আমি একেবারে স্তব্ধ! রুমালটা হাতে নেই! কোথায় পড়ে গেছে অজান্তে অসতর্কতায়! মুখ থেকে শুধু বের হলো, ‘ইন্না লিল্লাহ!’
নিজেকে মনে হলো সব হারিয়ে পথের ফকির! পিছনের দিকে ফিরে তাকাই, কিন্তু শূন্য পথ, শূন্য দৃষ্টি! আমার অবস্থা দেখে হুযুরের মায়া হলো, তিনি আর বিলম্ব না করে বললেন, ‘চিন্তার কারণ নেই। পথে পড়ে গিয়েছিলো, আমি কুড়িয়ে নিয়েছি। এই নিন।’
ইচ্ছে হলো পায়ে পড়ে ক্ষমা চাই, আর কৃতজ্ঞতা নিবেদন করি। হয়ত সে যোগ্যতা ছিলো না, তাই তা করা হলো না। রুমালটা আবার নিলাম আর শুধু বললাম, ‘জাযাকাল্লাহু খায়রান’!
আমার জীবনে এমনই বটবৃক্ষ তিনি! আমার জীবনে এমনই শীতল ছায়া তিনি!!
সাতরাজার ধনরূপে সেই রুমাল এখনো আমি আগলে রেখেছি, আল্লাহর শোকর, আগলে রাখতে পেরেছি। আসলে আমার স্ত্রী সেটি আগলে রেখেছেন। সেদিনই সেটি তার হাতে দিয়ে আমার অপদার্থতার কথা বলেছিলাম, আর বলেছিলাম, আমার হয়ে এটি তুমি আগলে রেখো। এ পর্যন্ত লিখে স্ত্রীকে বললাম, দয়া করে রুমালটি একবার দেখাও। তিনি দেখালেন। চোখ জুড়িয়ে রুমালটি দেখলাম। কতকিছু যেন দেখলাম! হাতে রুমালটির স্পর্শ নিলাম। কতকিছুর স্পর্শ যেন পেলাম! অবশেষে রুমালটির ঘ্রাণ নিলাম। আহ, কতকিছুর সুবাস যেন পেলাম!
তখনো বুঝতে পারিনি, এখনো বুঝতে পারি না, আমার প্রাণপ্রিয় উস্তায সেদিন ঐ সবুজভূমির পাশে দাঁড়িয়ে কেন রুমালটি আমাকে দিলেন? কেন তা আমার হাত থেকে পড়ে গেলো? আবার কেন তা তাঁর হাত থেকেই ফিরে পেলাম। এটি কি নিছক ঘটনা, না গায়বের কোন ইশারা? হয়ত কিছু না, আবার হতে পারে অনেক কিছু। পর্দার আড়ালের রহস্য তো আমরা কিছুই জানি না!
***
সেই প্রাচীন কাল থেকে সময়ের গতিকে উপমা দেয়া হয় নদীর স্রোতের সঙ্গে। এর চেয়ে সুন্দর, এর চেয়ে অর্থপূর্ণ কোন উপমা আজো তৈরী হয়নি। তাই যদিও ঢাকার চারপাশের নদীতে এখন কোন স্রোত নেই তবু বলতে হয়, নদীর স্রোতের মতই বয়ে চলেছিলো সময়ের স্রোত। বালু নদী, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, তুরাগ ও বুড়ীগঙ্গা, সব নদীর তীরে ঘুরে ঘুরে অবশেষে সেই সবুজ ভূমির দেখা পেলাম, আমাদের বাড়ী থেকে সাতাশ কিলোমিটার দূরে ঢাকার কেরাণীগঞ্জের শেষ প্রান্তে, সরকারী মানচিত্রে যার নাম ‘হযরতপুর’, আলহামদু লিল্লাহ।
এখনো আমার প্রিয় মাওলানা আব্দুল মালিক ছাহেবের কথা বলা হয়নি। এই সবুজ ভূমির সন্ধানে তাঁর এবং তাঁর বড় ভাই মাওলানা আব্দুল্লাহ ছাহেবের বড় অবদান ছিলো। আল্লাহ সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন।
মাওলানা আব্দুল মালিক ছাহেবেরই কল্যাণে সম্ভব হয়েছিলো হযরাতুল উস্তায পাহাড়পুরী হুযূরকে হযরতপুরের জমিতে নিয়ে যাওয়ার। আহ, কী পরম তৃপ্তি ও পরিতৃপ্তির সময় ছিলো সেটি! কী অপূর্ব শান্তি ও প্রশান্তির মুহূর্ত ছিলো সেটি! হযরত দু‘আ করেছেন, আর মনে হয়েছে, প্রতিটি শব্দ যেন আসমান থেকে নেমে আসছে এবং আসমানে ফিরে যাচ্ছে! সব দু‘আ যেন কবুলিয়াতের সঙ্গে ‘হামকিনার’[3] হয়েছে!
মন সেদিন সাক্ষ্য দিয়েছে, এ ভূমিতে হযরতের পায়ের ধূলো পড়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে তিনি দু‘আ করেছেন। এখানে তাঁর চোখ থেকে অশ্রু ঝরেছে। ইনশাআল্লাহ এখান থেকে আমার শিক্ষক-জীবনের তৃতীয় পর্যায়ের যাত্রা বরকতপূর্ণ হবে।
সেদিন মাওলানা আব্দুল মালিক ছাহেবের ওছিলায় আমার প্রিয় হযরতের ছোহবতে সামান্য হলেও যে নূরানি সময়গুলো যাপন করেছিলাম তার সফরনামা লেখা হয়েছে এবং ‘এখনো আছে একটি প্রদীপ’ নামে আলকাউসারে প্রকাশিত হয়েছে।
***
কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার কুদরত বড় ‘নিরালা’![4] হযরতপুরে যখন মাদরাসার জন্য তিনবিঘা জায়গার ব্যবস্থা হলো এবং হুযূর সেখানে হাযির হয়ে দু‘আ করলেন, তার কিছুদিন পর ঢাকা থেকে মোমেনশাহী যাওয়ার পথে ভালুকা- নামক স্থানে আরো বড় আয়তনে জায়গার ইনতেযাম হলো। কীভাবে হলো, সে এক দীর্ঘ কাহিনী, যার পরতে পরতে রয়েছে গায়বি মদদের ‘জালওয়া’ ও উদ্ভাস।
শুধু বোঝা গেলো, আল্লাহ যখন দান করেন তখন বান্দার চাওয়াকে ছাড়িয়েই দান করেন। হুযুরকে যখন বিষয়টি জানালাম, তিনি বললেন, ইস্তিখারা করুন, যদি মন আগে বাড়ে তাহলে আগে বাড়ুন। ইস্তিখারা করলাম, মন আগে বাড়লো, জমিরও বায়না হয়ে গেলো।
আল্লাহ যদি চান, এই বুড়ো বয়সে দু‘জায়গায় তিনি আমাকে দিয়ে দ্বীনের কাজ করাবেন তাহলে আমি ‘নারায’ হওয়ার কে? আমার তো খুশী হওয়ার এবং কৃতার্থ হওয়ার কথা! কাজ তো মানুষ করে না, কাজ তো মানুষকে দিয়ে করানো হয়!
শুধু একটা বিষয় বারবার খটকা হয়ে মনে বিঁধতে লাগলো যে, হুযূর তো হযরতপুরে গিয়ে দু‘আ করেছেন, কিন্তু ভালুকায়! তাঁর একটু পায়ের ধূলো কীভাবে সেখানে নেয়া যায়? ভালুকার ভূমিও তো সবুজ ভূমি! তাঁর চোখের পানিতে সেই সবুজ ভূমি কীভাবে সিক্ত করা যায়! কীভাবে অন্তত একবার একটু দু‘আর সুযোগ করা যায়?
ভালুকায় জমির যাবতীয় ইনতিযামের দায়িত্ব আমার প্রিয় মাওলানা সালমানের। নিজের সমস্ত পেরেশানির ভিতর দিয়েও সে তার দায়িত্ব মোটামুটি আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। সে বারবার আব্দার করছে হুযূরকে ভালুকায় নেয়ার। কিন্তু আমার কিছুতেই সাহস হয় না। হযরতপুরে মাওলানা আব্দুল মালিক ছাহেব ওছীলা হয়েছিলেন। এখানে!
যদিও হুযূর এই গুরুতর অসুস্থতা ও নাযুক স্বাস্থ্য নিয়েই বিভিন্ন সফর করছেন, কিন্তু আমার সাহস হয় না, মনও চায় না, হুযূরকে এভাবে কষ্ট দিতে।
আমার প্রিয় হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী রহ. একবার যখন ঢাকা তশরীফ আনলেন, আমার পরম শ্রদ্ধেয় উস্তায হযরত সুলতান যওক ছাহেব বললেন, ‘তুমি চাইলে ‘মাওলানাকে’ মাদরাসাতুল মাদীনায় নেয়ার ব্যবস্থা করতে পারি।’
আমি জানতাম তিনি তা করতে পারেন, আরো জানতাম হযরত আলী মিয়াঁ ...।
কিন্তু আমি আরয করলাম, ‘হুযূর, এতে হযরত মাওলানার কষ্ট হবে। তাঁকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ! এখান থেকেই তিনি দু‘আ করুন, সেটাই আমার জন্য বরকতের বিষয় হবে।’
যওক ছাহেব হুযূর আমার চিন্তার এই ‘আন্দায’[5] পসন্দ করেছিলেন এবং দু‘আ দিয়েছিলেন। সম্ভবত হযরত আলী মিয়াঁ রহ.-এর খিদমতেও আমার এ বিষয়টি তিনি পেশ করেছিলেন। তিনি খুশী হয়ে দু‘আ দিয়েছিলেন এবং ‘সালামাতে ফিক্র’- এর সনদ দিয়েছিলেন।[6]
তো এই হলো আমার চিন্তা। আমি কীভাবে আমার প্রিয় হযরতকে কষ্ট দিতে পারি!
কিন্তু দিন যত যায়, মন তত অস্থির হয়ে ওঠে। ভিতর থেকে কে যেন বলতে থাকে, ‘ওখানে হুযূরের পায়ের একটুখানি ধূলো পড়া তোমার জন্য হতে পারে বড় সৌভাগ্যের কারণ, আর তা থেকে বঞ্চিত হওয়া....!
অবশেষে কীভাবে যেন সাহস করে এই সেদিন আব্দারটা করেই ফেললাম। তবে সরাসরি নয়, হুযূরের বড় ছাহেবযাদা আমাদের প্রিয় মাওলানা আশরাফুয্যামানের মাধ্যমে।
তাকে বললাম, আমার নিজের সাহস হয় না, কারণ কষ্ট হলেও আমার আব্দার রক্ষার জন্য হুযূর হয়ত রাজি হয়ে যাবেন। তুমি সব অবস্থা বুঝে হুযূরকে বলা মুনাসিব মনে করলে বলো।
এটা ছিলো ২০১২ সালের মার্চ মাসের প্রথম শুক্রবারের কথা। দ্বিতীয় শুক্রবারে মাওলানা আশরাফুয্যামান খোশখবর জানাল, আববা খুশির সঙ্গে কবুল করেছেন। আগামীকাল বাদমাগরিব বাইতুস্- সালাম মাদরাসার দস্তারবন্দি মজলিসে আববার যাওয়ার কথা আছে। আববার ইচ্ছা ওখান থেকে এশার নামায পড়ে ভালুকায় যাবেন।
শুনে তো দিল থেকেই খুশী হলাম, আবার কিছুটা পেরেশানও হলাম। আমার ইচ্ছা ছিলো, যাওয়া যদি হয়, ফজরের সময় যেন হয়, যাতে যানজটের কষ্টে না পড়তে হয়। এখন তো দ্বিগুণ কষ্ট হবে! প্রথমত যানজটের কষ্ট। কারণ যানজটের জন্য এ রাস্তাটার আগে থেকেই যথেষ্ট ‘সুনাম’ আছে। দ্বিতীয়ত ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।
মাওলানা আশরাফ ভরসা দিলো, সমস্যা হবে না, আববার জন্য বরং রাত্রেই ভালো হবে, কারণ রোদ তাঁর চোখের জন্য কষ্টের কারণ হয়।
আমি বললাম, ঠিক আছে, আল্লাহ ভরসা।
জুমার পর ছেলেকে নিয়ে হুযূরের সঙ্গে দেখা করলাম। হুযূর নিজেই খুশি প্রকাশ করে ভালুকায় যাওয়ার কথা বললেন, আর বললেন, ইনশাআল্লাহ আগামীকাল ঠিক সাড়ে চারটায় ঘরে বা-জমাত আছর পড়ে সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা হবো, যাতে বাইতুস্সালাম গিয়ে মাগরিব পড়া যায়।
আরয করলাম, ইনশাআল্লাহ সাড়ে চারটার আগেই হাযির হয়ে যাবো। আর বললাম, হুযূরের ছোহবত হাছিল করার জন্য ছেলেকে সঙ্গে নিতে চাই।
হুযূর সেণহের হাসি হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘অবশ্যই। মুহম্মদকে না নিয়ে তো আমিই যাবো না।’
ফেরার পথে ছেলেকে বললাম, দেখো বাবা, মুরুবিবর এমন সেণহ-শফকত যেমন আশা ও আনন্দের বিষয় তেমনি ভয় ও আশঙ্কারও বিষয়। কোনভাবেই যেন এর বে-কদরি না হয়। তাহলেই ইনশাআল্লাহ যিন্দেগিতে অনেক ফায়দা হবে।
***
কিছুটা ভয় ও উৎকণ্ঠার মধ্যেই রাতটা পার হলো। কে জানে এত বড় সৌভাগ্য হাতের কাছে এসে আমার কোন ত্রুটির কারণে না হাতছাড়া হয়ে যায়! ভবিষ্যত তো আমাদের এমনই অনিশ্চিত যে, একমিনিট পরে কী হবে, কেউ জানে না।
আমাদের প্রিয় ছাত্র মাওলানা যায়েদুল কবীর খবর পেয়ে আব্দার করলো, এই সফরে সেও থাকতে চায় হুযূরের ছোহবতে। না করি কিভাবে! বললাম, আচ্ছা চলো।
কিন্তু যা চিন্তা করিনি তাই ঘটে গেলো। দুপুরের পরে হঠাৎ করেই শুরু হলো আমার অসুস্থতা এবং তা এমন পর্যায়ে পৌঁছলো যে, রীতিমত শয্যাশায়ী হতে হলো। স্বাভাবিকভাবেই মনের অস্থিরতা অনেক বেড়ে গেলো। আশঙ্কা ছিলো হুযূরের সুস্থতা সম্পর্কে, এখন আমি নিজেই অসুস্থ। আল্লাহ তুমি আসান করে দাও।
ছেলেকে বললাম, একটু ঘুমুতে চেষ্টা করি, ঠিক পৌনে চারটায় দরস শেষ করে নীচে এসে তুমি আমাকে জাগাবে, যাতে প্রস্ত্তত হয়ে চারটার মধ্যে বের হতে পারি।
জাগাতে হলো না, এমনিই চোখ খুলে গেলো। ঘড়িতে তখন চারটা বাজে! ছেলে কোথায়! একে অসুস্থ, তার উপর অস্থিরতা বেড়ে গিয়ে আরো গুরুতর অবস্থা। কম্পিত শরীরে উপরে গিয়ে দেখি, নিশ্চিন্ত মনে ‘তিনি দরস করিতেছেন!’ অন্যসময় হলে এই নিমগ্নতা প্রশংসার বিষয় হতো; এখন শুনতে হলো হালকা তিরস্কার।
চারটা পনেরতে মাওলানা আশরাফুয্যামানের ফোন; হুযূর জানতে চেয়েছেন, রওয়ানা হয়েছি কি না। ছেলে তখনো প্রস্ত্তত হচ্ছে। কী আর বলবো! বললাম, এখনি বের হচ্ছি।
বের হতে হতে চারটা তেইশ। আমার তখন বের হওয়ার মত অবস্থা নয় কিছুতেই, কিন্তু বের না হওয়ার কথা চিন্তা করাও তো পাপ। সুতরাং আল্লাহ হাফিয বলে বের হলাম। নূরিয়া মাদরাসায় যাওয়ার পথে ডান দিকের শেষ যে গলিটা, তার কিছু ভিতরে হুযূরের বাসা।
ছয় সাত মিনিটের মধ্যে পৌঁছতে পারলেই হয়।
সালমান তার ব্যক্তিগত গাড়ী পাঠিয়েছে। হুযূরের আরামের কথা চিন্তা করে, আমিই বলেছিলাম। গাড়ীর চালক ভাই হানীফ চালক হিসাবেও ভালো, মানুষ হিসাবেও ভালো।
উচিত হয়নি, তবু ছেলেকে বলে ফেললাম, তোমার কারণে হুযূরের কাছে আমাকে লজ্জিত হতে হবে। ছেলে কিছুটা কুণ্ঠিত স্বরে বললো, ইনশাআল্লাহ পৌঁছে যাবো। খুব বেশী হলে এক মিনিট বিলম্ব হবে। আমি বললাম, সমস্যাটা তো এখানেই। হুযূরের ঘড়িতে সাড়ে চারটা মানে চারটা ত্রিশ মিনিট!
তাই হলো। চারটা বত্রিশে তেতালায় হুযুরের কামরার সামনে পৌঁছে দেখি, জামাত শুরু হয়ে গেছে। দরজাটা ইমামের প্রায় সামনে। ভিতরে যাওয়াটা মুশকিল। কী করবো ভাবতে ভাবতেই ইমাম ছাহেব রুকু থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। কোনমতে ভিতরে গিয়ে জামাতে শরীক হলাম। দু’রাকাতের মাসবূক।
নামায শেষ করে হুযূর লাঠি হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে রওয়ানা হলেন। পরিষ্কার বোঝা যায়, পাদু’টো কাঁপছে। আশ্চর্য, এ অবস্থায়ও এত দূরের সফরে বের হলেন এবং ঠিক সময়ে, একমিনিটেরও বিলম্ব ছাড়া।
আমি হুযূরের ছাত্র, দু’মিনিট বিলম্ব। আমার ছাত্র মাওলানা যায়েদুল কবীর, পাঁচমিনিট বিলম্ব এবং জামাত ফওত!
সঙ্গী ছিলো, সুতরাং তাড়াতাড়ি জামাতে দাঁড়িয়ে গেলো।
হুযূর তিনতালা থেকে নেমে গাড়ীতে বসেছেন। মাওলানা আশরাফুয্যামান এবং যায়েদুল কবীর তখনো নামেনি। ভাই হানিফের নামায নিয়ে পেরেশান ছিলাম। সুযোগ দেখে বললাম, তাড়াতাড়ি নামাযটা পড়ে ফেলতে। তারও নামায পড়া হলো, অন্যরাও নেমে এলো।
মাওলানা আশরাফুয্যামান সামনে চালকের পাশের আসনে। পিছনে হুযুর ডানপাশে, মাঝখানে আমি, বামপাশে আমার ছেলে। একবার ভেবেছিলাম, ওকে হুযুরের পাশে বসতে বলি, কিন্তু বলা হলো না। পরে দেখা গেলো, সেটা বললেই ভালো ছিলো।
হুযূরের বড় গাড়ীতে মাওলানা যায়েদুল কবীর ও অন্যরা। গাড়ী রওয়ানা হলো। হুযূর দু‘আ পড়লেন। তারপর প্রথমেই যে প্রশ্নটা করলেন (আরবীতে) সেটা হলো, চালক কি নামায পড়েছে?
আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় সাধারণ বিষয়, কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে এখানে রয়েছে অনেক বড় শিক্ষা। এ প্রশ্নের উৎস আসলে ঐ হাদীস যাতে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকে শাসক, আর তোমাদের প্রত্যেকে জিজ্ঞাসিত হবে তার শাসিত সম্পর্কে।’
হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-কে দেখেছি, গাড়ীর চালক নামাযী কি না এবং নামায পড়েছে কি না খোঁজ নিতেন।
একাশির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়। সম্ভবত সিলেটের সফরে; একটি নির্বাচনী জনসভার উদ্দেশ্যে হযরত রওয়ানা হবেন, গাড়ীতে ওঠার সময় চালককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নামায পড়ছেন নি?’
কী কারণে যেন চালক ভেবেছিলেন, হযরতকে সভাস্থলে পৌঁছে দিয়ে নামায পড়বেন। কিন্তু হযরতের এককথা, ‘আগে নামায পড়ি লন!’
এই মানুষটি যদি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হতেন, কেমন হতো, কিংবা কেমন হতো না?!
***
কামরাঙ্গীরচরে আমি রাস্তা চিনি শুধু একটা; নূরিয়া ও মাদরাসাতুল মদীনাহর সামনে দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমের রাস্তাটা। ভেবেছিলাম, গাড়ী পিছনের দিকে এসে গলি থেকে বের হবে এবং পূর্বদিকের পথ ধরে মাদরাসাতুল মাদীনাহ অতিক্রম করে লোহার পোল পার হয়ে ভেরিবাঁধে ওঠবে। মাওলানা আশরাফুয্যামান চালককে বললো, সামনে উত্তর দিকে যেতে। ওদিক দিয়ে নাকি সহজে বেরিবাঁধে ওঠা যাবে ‘সেকশন’ এলাকা দিয়ে। ছেলে দেখলাম, এ রাস্তাও চেনে, সেকশনও চেনে। ভালো। চল্লিশ বছর হলো, কামরাঙ্গীর চরের বাসিন্দা, কিন্তু পথ চিনি ঐ একটা। সবাই যদি আমার মত হয় তাহলে সংসার চলবে না, এটাও ঠিক। মাদরাসা নূরীয়ার পিছনে পশ্চিমে উত্তর-দক্ষিণ বড় রাস্তাটা একসময় ছিলো বড় একটা খাল। চরের উত্তর দিকে বুড়ীগঙ্গার একটি শাখা ছিলো, যা চারশ বছর আগে ছিলো মূল বুড়ীগঙ্গা, চর পড়ে বুড়ি গঙ্গা সরে গেছে চরের দক্ষিণে। পঞ্চাশ বছর আগে, আমাদের শৈশবে, এমনকি ত্রিশ বছর আগে, বরং বিশ বছর আগেও তা নদী হিসাবে টিকে ছিলো; এখন সেটাকে গলা টিপে মেরে ফেলা হয়েছে। মৃতদেহটা নর্দমার আকারে পড়ে আছে এবং দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তো উত্তরের বুড়ি গঙ্গা থেকে বড় একটা খাল বের হয়ে দক্ষিণের বুড়ি গঙ্গায় এসে পড়েছিলো। সেই খালে কত রকম মাছ ধরা হতো! আমিও ধরেছি! বড় বড় বোয়ালগুলো এখনো যেন চোখের সামনে লাফায়! এই খাল দিয়ে নিজে নৌকা বেয়ে হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-কে কিল্লার মোড়-নূরীয়ায় আনা নেয়া করেছি অনেক বার। নূরীয়ার কবরস্তানটি ছিলো মাদরাসা থেকে কিছু উত্তরে খালের পশ্চিম পাড়ে। নৌকায় করে যেতে হতো সেখানে। হযরত পাহাড়পুরী হুযুরের বড় মেয়ে নাফীসাকে, যে পানিতে পড়ে মর্মান্তিভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলো, এখানেই দাফন করা হয়েছে। মনে পড়ে, আমাদের ‘দুই নম্বর’ হুযূর, হযরত মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ ছাহেব রহ. যিনি হযরত মুহাদ্দিছ ছাহেব নামে পরিচিত, তাঁর স্ত্রীকে এখানে দাফন করা হয়েছিলো। কবর যিয়ারত করার জন্য নৌকায় করে একবার এসেছিলেন। আমারও সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো।
আমার জীবনের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই খালের সঙ্গে, তার টলটলে পানির সঙ্গে! কোথায় সেই খাল! খালের পানি! এখন তো উত্তরের বুড়ীগঙ্গা হলো এক নর্দমা, এমনকি দক্ষিণের বুড়ীগঙ্গাও নর্দমা হতে আর বিশেষ বাকি নেই!
খালটি ভরাট হয়ে এখন বিরাট রাস্তা, যার উপর দিয়ে চলে রিকশা, গাড়ী, ট্রাক! যখনই এ রাস্তা অতিক্রম করি, আমি কেমন যেন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি।
রাস্তার পাশে হঠাৎ নজরে পড়লো হাজী সেলিমের পোস্টার। ঢাকা এখন উত্তরে দক্ষিণে দু’টোকরো। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, টাকা থাকলে ঢাকাকে তিনি চারটুকরো করতেন।
অনেক কৌশল ও গড়িমসির পর হঠাৎ সরকার শোরগোল তুলেছে ঢাকা মেয়র নির্বাচনের। অন্তত আমাদের দেশে গণতন্ত্রের সবচে’ নষ্ট জিনিসটা হলো এই নির্বাচন। কথাটা সবাই জানে, কিন্তু কিসের ভয়ে, কিংবা কিসের গরযে যেন বলে না।[7]
হাজী সেলিম সম্ভবত দক্ষিণ ঢাকার মেয়র হওয়ার আশা পোষণ করেন। পোস্টারে অবশ্য সেকথা নেই, আছে তার একটি মূল্যবান উপদেশ, ‘একবার যে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে, তাকে দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করো না’। কামনা করি, দক্ষিণ ঢাকার অধিবাসীরা যেন উপদেশটি মনে রাখে।
কিছু দূর গিয়ে পেলাম আরেকটি পোস্টার, হানীফ পুত্র, মাজেদসরদারের দৌহিত্র সাঈদ খোকন, তিনিও দক্ষিণ ঢাকার মেয়র হওয়ার প্রত্যাশী। তার উপদেশ অন্যধাঁচের, হয়ত বয়সের কারণে, কিংবা একারণে যে, তার পিতা মরহূম হানিফ একসময় ঢাকার মেয়র ছিলেন। সেই সুবাদে আবর্জনা পরিষ্কার করার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিলো। তিনি বলেছেন, ‘শহরের আবর্জনা এবং রাজনীতির আবর্জনা ডাস্টবিনে ফেলুন।’
এবারও মনে মনে কামনা করলাম, অন্তত এবার যেন ঢাকাবাসী এ কাজটি পূর্ণ সাহসিকতার সঙ্গে করতে পারে।
ছি, এখন কি এসব ভাবনার সময়?! হুযূরের কথায় হুঁশ হলো, বললেন, মুহম্মদ, তুমি সূরাতুল মুলক শোনাতে পারবে? আমাকে বললেন, ওকে মাঝখানে বসতে দেন। ছেলে তিলাওয়াত শুরু করলো। আশ্চর্য!
الذي خلق الموت والحياة ليبلوكم أيكم أحسن عملا
(যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমাদের পরীক্ষা করেন, আমলের দিক থেকে তোমাদের কে সবচে’ উত্তম!)
কত বার তিলাওয়াত করেছি, কত বার তিলাওয়াত শুনেছি। আর কখনো এমন করে তো মনকে নাড়া দেয়নি! যেন এই প্রথম শ্রবণ! কানের পথে হৃদয়ের গভীরে এই প্রথম প্রবেশ! আল্লাহ বলেননি, তিনি দেখতে চান, তোমরা কে কেমন আমল করো। আল্লাহ বলেছেন, তিনি দেখতে চান, তোমরা কে কত সুন্দর আমল করো। কত মায়া বান্দার প্রতি আল্লাহর! কত কোমলভাবে বান্দাকে তিনি উদ্বুদ্ধ করছেন উত্তম আমলের প্রতি!
শুরু হলো জাহান্নামের বয়ান-
الذي خلق الموت والحياة ليبلوكم أيكم أحسن عملا
(আর যারা তাদের রবের সঙ্গে কুফুরি করেছে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব, আর তা অতি নিকৃষ্ট ঠিকানা।)
وللذين كفروا بربهم عذاب جهنم, وبئس المصير
(যখন তাদের তাতে নিক্ষেপ করা হবে, তারা তার গর্জন শুনতে পাবে, আর তা টগবগ করতে থাকবে।)
إذا ألقوا فيها سمعوا لها شهيقا و هي تفور
হুযূরের চোখ থেকে তখন ঝরঝর করে অশ্রু ঝরছে, জাহান্নামের ভয়াবহতা যেন চোখের সামনে!
تكاد تميز من الغيظ
জাহান্নাম ক্রোধে যেন ফেটে পড়ছে।
كلما ألقي فيها فوج سألهم خزنتها ألم يأتكم نذير
(যখনই তাতে কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে, তার প্রহরীরা তাদের জিজ্ঞাসা করবে, তোমাদের কাছে কি আসেনি কোন সতর্ককারী?
قالوا بلى قد جاءنا نذير
(বলবে তারা, অবশ্যই এসেছিলো আমাদের কাছে সতর্ককারী।)
فكذبنا وقلنا ما نزل الله من شيء, إن أنتم إلا في ضلال كبير
(কিন্তু আমরা ঝুটলিয়েছি, আর বলেছি, আল্লাহ কোন কিছুই নাযিল করেননি। আসলে তোমরা বড় ভ্রান্তিতে রয়েছো।)
وقالوا لو كنا نسمع أو نعقل ما كنا في أصحب السعير
(আর তারা বলবে, যদি শুনতাম, বা বুঝতাম তাহলে [আজ] হতাম না জাহান্নামীদের মধ্যে।)
فاعترفوا بذنبهم, فسحقا لأصحب السعير
(এভাবে তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করবে, সুতরাং অভিশাপ জাহান্নামীদের জন্য।)
হুযূর এসময় বড় দীর্ঘ ও গভীর করে একটি নিঃশ্বাস ফেললেন; যেন ভীত কম্পিত হয়ে আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে পানাহ চাইলেন। আমারও ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো! হে আল্লাহ, তোমার দয়া ও করুণা ছাড়া জাহান্নাম থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। তুমি রহম করো হে আল্লাহ!
আল্লাহরও যেন বান্দার প্রতি দয়া হলো। জাহান্নামের আযাব-গযবের কথা শুনে বিশ্বাসী বান্দা তো ভয়ে কম্পমান হবে, আচ্ছা তাকে একটু মাগফেরাতের খোশখবর শুনিয়ে শান্ত করি!-
إن الذين يخشون ربهم بالغيب لهم مغفرة وأجر كبير
(যারা তাদের রবকে গায়েবানা ভয় করবে, তাদের জন্য রয়েছে মাগফেরাত এবং বিরাট আজর।)
অস্পষ্টভাবে যেন শুনলাম, হুযূর বলছেন, اللهم اجعلنا منهم (হে আল্লাহ, আমাদেরকে তাদের দলভুক্ত করো।)
আমি বললাম, আল্লাহুম্মা আমীন,
মনে বড় শান্তি লাগলো, তিলাওয়াতে ছেলের কণ্ঠে কম্পন অনুভব করে। মনে হলো, বুঝে এবং অনুভব করে তিলাওয়াত করছে। একজন বাবার জন্য এর চেয়ে শান্তি ও সান্ত্বনার বিষয় আর কী হতে পারে যে, তার সন্তান আল্লাহর কালাম হিফয করেছে, আর হৃদয়ঙ্গম করে তিলাওয়াত করতে পারছে। শোকর, আলহামদু লিল্লাহ!
আমার জীবনের একটি বড় স্বপ্ন, এদেশে ঘরে ঘরে প্রতিটি ছেলে মেয়ে এই পরিমাণ আরবী ভাষা শিখুক, যাতে আল্লাহর কালাম বুঝে তিলাওয়াত করতে পারে। অন্তত এটুকু হলেই আমাদের সবার দিলের জাহান আবাদ হয়ে যাবে।
এমন একটি পবিত্র পরিবেশ দেখিয়ে তবে আমাকে তুমি দুনিয়া থেকে নিয়ো হে আল্লাহ!
রাস্তার বাম পাশে মহিলা মেডিক্যাল কলেজটা পার হওয়ার সময় তিলাওয়াত সমাপ্ত হলো।
قل أريتم إن أصبح ماؤكم غورا فمن يأتيكم بماء معين
(বলে দিন, আচ্ছা বলো তো, যদি তোমাদের পানি অতলে নেমে যায়, তাহলে কে তোমাদের এনে দেবে ‘প্রস্রবিত’ জলধারা?)
সূরার শেষ অংশে এমন একটি বিষয়ে এমন একটি প্রশ্ন আল্লাহ বান্দার সামনে তুলে ধরেছেন যার উত্তরে আজকের সর্বোচ্চ প্রযুক্তির অধিকারী মানুষকেও বলতে হবে-
الله يأتينا به (আল্লাহই আমাদের জন্য তা আনবেন।)
সমর্পণ ও আত্মসমর্পনের আবেগে উদ্বেলিত কণ্ঠে হুযূর বললেন-
الله يأتينا به, وهو على كل شيء قدير
ছেলেকে হুযূর অন্তর থেকে দু‘আ দিলেন, ইলম ও আমলের দু‘আ এবং আখলাক ও ফিকিরের দু‘আ।
তিলাওয়াত সমাপ্ত হলো, কিন্তু গাড়ীর ভিতরে তিলাওয়াতের আশ্চর্য এক ভাবগম্ভীর পরিবেশ বিরাজ করতে লাগলো। শীতাতোপ- নিয়ন্ত্রিত ছোট্ট গাড়ীটির ভিতরে বাইরের ধূলোবালি যেমন নেই তেমনি নেই বাইরের কোন কোলাহল। কাঁচের ভিতর থেকে শুধু দেখা যায়, মানুষ ছুটছে, আর ছুটছে। এত ব্যস্ত, এত ব্যতিবস্ত যে, কোন দিকে ফিরে তাকাবারও যেন ফুরসত নেই। আমাদের গাড়ীও চলছে গন্তব্যের দিকে, কিন্তু আল্লাহর শোকর, ভিতরে অন্য জগতের আবহ নিয়ে। মনে হচ্ছিলো, এই মুহূর্তে যদি মৃত্যুর ডাক আসে, ইনশাআল্লাহ প্রশান্ত মনে সমর্পিত চিত্তে মৃতুর ডাকে সাড়া দিতে পারবো।
আমার এই মৃত্যুভাবনার বিভোরতার মধ্যে হুযূর যেন অন্তর চিরে বের হয়ে আসা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আহ, কার মউত কখন কীভাবে আসবে কেউ বলতে পারে না।
আবার অখন্ড এক নীরবতা। কেন জানি ইচ্ছে হচ্ছিলো, জানালার কাঁচটা নামিয়ে বাইরের শোরগোলটা একটু শুনি!
আমাদের গাড়ী তখন বেড়ীবাঁধ থেকে মুহম্মদপুরের ঢালের দিকে নামছে। আমার আশঙ্কা হলো, শহরের ভিতরে যানজট হতে পারে, তার চেয়ে গাবতলি, মিরপুর ও আশুলিয়া হয়ে গেলে সহজ হবে, কিন্তু চালক হানিফ বললেন, শনিবার তো, আশা করি তেমন যানজট হবে না। তাছাড়া আশুলিয়া দিয়ে গেলে সমস্যা হতে পারে।
‘সমস্যা’ শব্দটি যে আজ নতুন একটি অর্থ ধারণ করছে, তা তখন বুঝতে পারিনি, পরে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি।
এই যে, ডানপাশে কয়েকটি টিনশেডের মধ্যে অবস্থিত জামেয়া রাহমানিয়া! আমাদের অনেক ছেলে এখানে এসে মেশকাত-দাওরা পড়ে। এখানকার মুহতামিম মাওলানা হিফযুর রহমান ছাহেব আমার সহপাঠী। তিনি উস্তাযুল আসাতিযা হযরত মাওলানা হিদায়াতুল্লাহ ছাহেব রহ.-এর পুত্র। হযরত মারহূম জীবনের প্রথম দিকে বড় কাটারা মাদরাসায় দুই নম্বর কামরায় অবস্থান করতেন; সেই সুবাদে আমাদের সময় পর্যন্ত তিনি দুই নম্বর হুযূর নামে পরিচিত ছিলেন, পরে তিনি হযরত মুহাদ্দিছ ছাহেব নামে পরিচিত হন। তিনি ছিলেন হযরত ছদর ছাহেব রহ.-এর সুনির্বাচিত ও সুপ্রিয় ব্যক্তি। আমাদের আসাতেযায়ে কেরাম বলেন, ‘তাকে দেখলে অন্তর সাক্ষ্য দিতো, ইনশাআল্লাহ তিনি জান্নাতী।’ আমরা যেখানে ‘মানুষ’ হয়েছি, জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া, হযরত ছদরছাহেবের পর তিনি শুধু তার পরিচালক ছিলেন না, প্রাণপুরুষ ছিলেন। একাত্তরের কঠিন দুর্যোগকালে তিনি একা এক অতন্দ্র প্রহরীর মত লালবাগ মাদরাসায় অবস্থান করেছেন। কথাটার গুরুত্ব এখনকার প্রজন্ম হয়ত বোঝবে না। এই ‘প্রায় নিষ্পাপ’ মানুষটি জীবনের শেষ দিকে ...
থাক, কলম এখানে থেমে যাক। কারণ এরপর হয়ত কলমের কালিতে নোনা অশ্রুর মিশ্রণ ঘটবে।
***
সামনের মোড় থেকে বাঁয়ে গেলে ঐতিহাসিক সাতগম্ভুজ মসজিদ। মসজিদের সামনে সুন্দর বাগান এবং পিছনে বিশাল পাঁচতালা ভবনে অবস্থিত জামেয়া রাহমানিয়া। উভয় রহমানিয়াকে আল্লাহ রহম করুন, কবুল করুন, আমীন।
এখান দিয়ে যখনই যাই, একটা অব্যক্ত বেদনায় একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাই। নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়, আর মনে হয়, বড় কিছু এবং মহৎ কিছুর যোগ্যতা হয়ত আমাদের নেই। আমাদের কাছে পরবর্তী প্রজন্মের শিখবারও কিছু নেই। আল্লাহ আমাদের মাফ করুন।
কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। মনেই ছিলো না, চলমান গাড়ীতে আমি আমার হুযূরের ছোহবতে রয়েছি এবং একটি মর্মান্তিক মৃত্যুর সংবাদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
হুযূর জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কোন জায়গা? মাওলানা আশরাফুয্যামান বললেন, বাম দিকে হলো জামেয়া রাহমানিয়া ও জামেয়া মুহাম্মাদিয়ার রাস্তা। আমরা ডান দিকে আসাদগেটের পথে যাবো।
হুযূর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, জামেয়া মুহাম্মাদিয়ার সামনে পূবে পশ্চিমে যে রাস্তাটা সেই রাস্তা ধরে পশ্চিমে কিছু দূর গেলেই ‘আশরাফুল মাদারিস’। তার মুহতামিম ছিলেন ক্কারী রূহুল আমীন ছাহেব, আপনি তাকে চিনতেন?
‘ছিলেন’ শব্দটি শুনে মনটা যেন কেমন করে উঠলো!
বললাম, জ্বি খুব ভালো করে চিনি। তার ছেলে লোকমান তো মাদরাসাতুল মদীনাহর ছাত্র! নিরীহ, শান্তশিষ্ট!
হুযূর বললেন, দু’দিন হলো ক্কারী রূহুল আমীন ছাহেব দেশের বাড়ীতে খুব মর্মান্তিক অবস্থায় ইন্তিকাল করেছেন।
আমি তো স্তব্ধ! মৃত্যু যে কারো কাছে যে কোন সময় আসতে পারে, কিন্তু যখনই মৃত্যুর সঙ্গে ‘মর্মান্তিক’ শব্দটি যুক্ত হয় বরদাশত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
জামেয়া মুহাম্মাদিয়া থেকে উত্তর দিকে যে রাস্তাটা গেছে তার ডানপাশে জাপানসিটি নামে পাশাপাশি অনেকগুলো বহুতল ভবন আছে। বছর দুয়েক আগে রাত দশটার দিকে হঠাৎ অগ্নিকান্ড ঘটেছিলো। তাতে ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছিলো। আমার মুহববতের মানুষ শফীকুর-রহমান, তার পরিবারের সাতজন একই সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছিলো। আল্লাহ সবাইকে জান্নাত নছীব করুন।
‘মর্মান্তিক মৃত্যু’ শব্দটি শুনে সেই শোকাবহ স্মৃতি মনের পর্দায় আবার ভেসে উঠলো এবং আবার রক্তক্ষরণ হলো।
কী হয়েছিলো ক্বারী রূহুল আমীন ছাহেবের, জিজ্ঞাসা করতে সাহস হলো না। কেন জানি, মর্মান্তিক কিছু শোনবার মত মনের শক্তি এখন আমার নেই। মাওলানা আশরাফুয্যামান নিজে থেকেই বললো, তিনি দেশের বাড়ীতে গিয়েছিলেন। কিছু জমি ছিলো, সেগুলোর দেখাশোনার জন্য বের হয়েছিলেন। গ্রামে এখনো এশার পরেই রাত গভীর হয়ে যায়। রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাঁর স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়লেন। এসে যখন দরজায় আওয়ায দেবেন, জেগে উঠে দরজা খুলে দেবেন, এই ছিলো ভাবনা।
দরজা তিনি খুললেন, তবে ফজরের আযান শুনে। খুললেন, আর দেখলেন! এবং চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালেন। দরজার সামনে পড়ে আছে ক্বারী রূহুল আমীন ছাহেবের মৃতদেহ!
কী হয়েছিলো? কখন তিনি এসেছিলেন? কীভাবে এসেছিলেন? কীভাবে দরজার সামনে পড়ে গেলেন? দরজায় আওয়ায দিতে পেরেছিলেন কি না? কিছুই জানা গেলো না।
নির্মম সত্য এটাই, তিনি এখন দুনিয়াতে নেই। বড় ভালো মানুষ ছিলেন। তখনই ফাতেহা-ইখলাছ পড়ে ঈছালে ছাওয়াব করলাম। চোখ দু’টো নিজের অজান্তেই ভিজে উঠলো। মনে মনে আল্লাহর কাছে আসান মাউত কামনা করলাম, নিজের জন্য, মুহববতের সব মানুষের জন্য, সাধারণ মুমিনীন-মুমিনাত সবার জন্য।
***
রাস্তায় যানজট ছিলো না। অল্পসময়ের মধ্যেই গাড়ী আসাদগেটে পৌঁছে গেলো। এই আসাদগেট, ঊনিশশ’ ঊনসত্তরে যখন ছিলো আইয়ূবগেট, তখনকার সেই মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতি আমার মনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। কারণ এখানে তখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলেছিল। গুলি খেয়ে অনেক মানুষ রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিলো শুনেছিলাম। কী কারণে যেন লালাবাগ মাদরাসার একজন বড় ছাত্রের সঙ্গে আমি তখন সেখানে ছিলাম। আগুন-মৃত্যুর এমন বীভৎস খেলা জীবনে সেই প্রথম দেখা। কেন এই দাউ দাউ আগুন, কেন এই মৃত্যু, এই মৃতদেহ, বুঝতে পারিনি। শুধু ভয় পেয়েছি, আর কেঁদে উঠেছি। এখনো এখানে যখন আসি, সেই দাউ দাউ আগুন মনের পর্দায় দেখতে পাই। আগুন জ্বালানো কত সহজ, নেভানো কত কঠিন!
যাদের তাড়াতে চেয়েছিলাম, খুন-আগুনের দরিয়া পাড়ি দিয়ে তাদের তাড়িয়েছি। কিন্তু খুন ঝরা তো বন্ধ হলো না! দাউ দাউ আগুন তো নিভলো না! ঝরছে আর ঝরছে! জ্বলছে আর জ্বলছে!
তখন রাজপথে একদু’টো মৃতদেহে সারা দেশ জ্বলে উঠতো। আইয়ূব খান পদত্যাগ করেছিলেন ক’টি লাশ কাঁধে নিয়ে?! এখন একদিনে ক’জন গুলিবিদ্ধ হয় এবং গুম হয়?! তখন কেন হতো, এখন কেন হয়?!
হে আল্লাহ, বড় অভাগা এ দেশ, তুমি রক্ষা করো। বড় দুর্ভাগা এ জাতি, তুমি রহম করো।
***
হুযূরের একটা বিষয় চমৎকৃত হওয়ার মত। ঠিক জায়াগায় এসে জিজ্ঞাসা করেন, এটা কোন জায়গা! আসাদগেট, শুনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হায়, একসময় প্রতিসন্ধ্যায় এখানে এসে বাস থেকে নেমেছি, আবার রাত দশটায় এখানে এসে বাসে উঠেছি। এখন তো লাঠিতে ভর করেও হাঁটতে পারি না, পা কাঁপে। এখন শুধু মউতের ইন্তিযার! আম্মাজান তো দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, আববাজান হাসপাতালে পড়ে আছেন। শেষ সময় পাশে থাকবো, খিদমত করবো, সে তাওফীকও নাই।
আবার নীরবতা, তবে বুঝতে কষ্ট হয় না, এটা শুধু বাইরে, ভিতরে কত ঝড় বইছে, কত ঢেউ উঠছে তা দেখা যায় না, কিন্তু চেহারার আয়নায় বোঝা যায়।
হুযূর যখন তাঁর আবক্ষা-আম্মা সম্পর্কে বলেন, আমার মনে হয়, শুধু এখন নয়, যখন আমি ছোট তখনো মনে হতো, জীবন কত সুন্দর! জীবন কত কষ্টের! জীবনের পথে চলে কত মানুষ; চলার পথে পায়ের ছাপ রেখে যেতে পারে ক’জন!
***
গাড়ী এখন সংসদভবন অতিক্রম করছে। এখানে এলে নিজের অজান্তেই দৃষ্টি চলে যায় আধুনিক স্থাপত্যের অনুপম দৃষ্টান্ত এই ভবনটির দিকে, যা গড়ে উঠেছে বিদেশী কোন স্থপতির নকশায়, লুই ক্যান না কী যেন নাম। আশ্চর্য হলেও সত্য, আমাদের দেশের স্থপতি এফ আর খান (মরহূম ফযলুর রহমান খান)-এর নকশায় তৈরী হয়েছে আমেরিকার তখনকার সর্বোচ্চ ভবন! এমনই হয়!
বলা হয়, এখানে যারা বসেন তারা দেশের ও জনগণের ভবিষ্যত নির্ধারণ করেন। তাহলে তো বলতে হয়, এঁরা হলেন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, আচরণে উচ্চারণে এবং চিন্তায় চেতনায়। প্রশ্ন হলো, বাস্তবে আমরা কী দেখি এবং কী শুনি? ঠিক মনে পড়ছে না, কে যেন ‘মাছের বাজার’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন, খুব লজ্জাকর একটি শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে অতি সম্প্রতি। এখানে কারো কারো মুখে এমন শব্দও নাকি উচ্চারিত হয় যা ...! নাহ, শব্দটা আর লেখা গেলো না। মনে হলো কলম আমাকে মিনতি করলো, এমন শব্দ লেখার কালিমা থেকে আমাকে রক্ষা করো!
কত ভালো হতো, এখানে যদি সাধারণ একটি ভবন হতো, দেশের সাধারণ কোন স্থপতির হাতে, কিন্তু এখানকার মানুষগুলো হতেন অসাধারণ, আচার আচরণে এবং জনকল্যাণভাবনায়! তবে স্বীকার করতে হবে এখানে ভদ্রমানুষও আছেন। এখানে ‘মুখে যা আসে তাই বলে’ শ্রেণীর মানুষ যেমন আছে, তেমনি ‘উত্তর দিতে রুচিতে বাধে’ এমন মানুষও আছেন। তবে কষ্টের বিষয় হলো, ‘সুশীল সমাজের’ লোকেরাও পার্থক্যটা আমলে আনেন না। ঢালাও ভাবে বলে দেন ‘চুলোচুলি’। সংসদভবনকে পিছনে রেখে একদিন এখানে একমহাসমাবেশে জাতিকে সাবধান করে হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.বলেছিলেন, ‘আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচতে হলে, অতীতের সমস্ত গোনাহ থেকে আমাদের তাওবা করতে হবে, যিকির করতে হবে, যবানের হিফাযত করতে হবে (যদ্দুর মনে পড়ে, আরো বলেছিলেন) পর্দা করতে হবে, নযরের হিফাযত করতে হবে।
তিনি আরো বলেছিলেন, যেমন গোনাহ তেমন তাওবা। আমরা ফাসেক ফাজেরকে ভোট দিয়ে আমানতের খেয়ানত করেছি। সুতরাং সামনে নেক ও সৎ মানুষকে ভোট দিয়ে গোনাহের কাফফারা করতে হবে। সেটাই হবে হাকীকী তাওবা।
স্পষ্ট মনে পড়ে। এরশাদ সাহেবের সামরিক শাসনের সবচে’ প্রতাপের সময় হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর ডাকে এখানে বিশাল মহাসমাবেশ হয়েছিলো। মরহূম মেজর জলীল ঐ মহাসমাবেশের মঞ্চে দাঁড়িয়েই হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর হাত ধরে জিহাদ ও শাহাদাতের বাই‘আত গ্রহণ করেছিলেন। এখানেই আমি প্রথম দেখেছিলাম, ফটো সাংবাদিকের দল হযরতের ছবি তোলার জন্য কত কৌশল কসরত করছে, আর হযরত রুমাল দিয়ে চেহারা ঢেকে ফেলছেন। তালিবানে ইলমের বর্তমান প্রজন্ম কি এটা বিশ্বাস করতে চাইবে? তারা এখন কী দেখে?
ধারণা ছিলো এখন হুযূর হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. সম্পর্কে কিছু না কিছু বলবেন। কারণ এখানে সেই সব স্মৃতি তাঁরও মনে পড়ার কথা। আমার ধারণা সত্য হলো। হুযূর বললেন, আপনার কি মনে আছে, হযরত একবার বলেছিলেন, হজ্বে রওয়ানা হওয়ার আগে এক মজলিসে, ‘আপনারা পেরেশান কেন? আমি তো এখনো মউতের ইরাদা করি নাই।’ আপনার মনে আছে সেই কথা?
অবাক হলাম এবং লজ্জিত হলাম। আমি আবদ্ধ হয়ে আছি স্মৃতির বহিরাবরণের মধ্যে, আর আমার হুযূর পৌঁছে গেছেন স্মৃতির অন্তর্প্রদেশে!
বললাম, জ্বি হুযূর, স্পষ্ট মনে আছে।
তিনি বললেন, এমন কথা কে বলতে পারে, কখন বলতে পারে? এমন কথা বলার জন্য মাওলার সঙ্গে বান্দার কেমন তা‘আল্লুক হওয়া চাই?! আসলে এটাই হলো শেষ কথা-اما تو چيزے ديگری
(তুমি ছিলে অন্যজগতের অন্য কিছু)
কিছুক্ষণ নীরব থেকে হুযূর বললেন, ওয়াফাতের কিছু দিন আগে কিন্তু একপত্রে হযরত লিখেছিলেন, ‘মা‘লুম হোতা হ্যয় কে, মউত কা ওয়াক্ত আব ক্যরীব আ গ্যায়া হ্যয়।’ (মনে হচ্ছে মৃত্যুর সময় এখন ঘনিয়ে এসেছে।)
আসলে জীবন যারা যাপন করে মৃত্যুকে স্মরণ করে করে, মৃত্যুর সঙ্গে তাদের কী রকম যেন একটা অন্তরঙ্গতা হয়ে যায়। মৃত্যু তাদের কাছে আসে ‘আগমনের সকল সৌজন্য’ রক্ষা করে।
গাড়ী এখন সংসদভবনের পূব দিকে উত্তরমুখী সড়কে খেজুরবাগান এলাকায়। ভাবতে ভালো লাগে, একসময় এখানে দালান-কোঠা ছিলো না, মানুষের কোলাহল ছিলো না, ছিলো বড় বড় খেজুরবাগান, সারি সারি খেজুর গাছ, ঠিক যেমন এখনো আছে পেয়ারা হাবীবের মদীনায়। কল্পনার চোখে সেই খেজুর বাগানের ছায়াঘেরা দৃশ্য এবং পাকা পাকা খেজুর অবলোকন করার চেষ্টা করলাম। কল্পনা মানুষকে কিছুটা হলেও শান্তি দেয়।
ফারমগেট হয়ে তেজগাঁ, সেখান থেকে মহাখালি ওভারব্রিজ এবং দেখতে দেখতে বনানী। উড়াল সেতুর কাজ বেশ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। প্রত্যাশিত পর্যায়ে না হলেও জীবনের সকল ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু উন্নতি হচ্ছে, নীতি, নৈতিকতা ও মানবিকতার ক্ষেত্রটি ছাড়া । এখানে শুধু অবক্ষয় আর ধক্ষস।
***
আল্লাহর রহমতে কোথাও তেমন যানজটের মুখে পড়তে হয়নি। আশা করা যায় আযানের আগেই বাইতুস্সালামে পৌঁছা যাবে। বিমানবন্দর অতিক্রম করার সময় হুযূরের সেই প্রশ্ন, এটা কোন্ জায়গা? বড় ‘দিলকাশ’ হুযূরের এই ‘আন্দাযে সুয়াল’![8]
এখানে এসে আমারই তো দিল কেমন কেমন হয়ে যায়! এই তো সেদিনের কথা! রামাযানের প্রথম ভাগে হুযূর ওমরায় রওয়ানা হয়েছেন। আমি বিদায় জানাতে এসেছি। দোতালায় যেখানে গাড়ীগুলো থামে। হুযূর গাড়ী থেকে নামলেন। ইহরামের লিবাসে কী যে নূরানিয়াত ছিলো! ইহরামের লেবাসেই আমি হুযূরের আলিঙ্গন লাভ করেছিলাম। হুযূর যখন দৃষ্টির আড়াল হলেন মনটা কেমন কেঁদে উঠলো। এখনো মনটা কেঁদে ওঠে যখনই বিমানবন্দর অতিক্রম করি।
হুযূর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন, চশমা খুলে চোখ মুছলেন। ছেলেকে কাছে টানলেন, আদর করলেন, কিছু বললেন না। কী ছিলো তখন তাঁর মনের কাইফিয়াত, কে জানে!
বাইতুস্সালামের দরজা দিয়ে গাড়ী যখন প্রবেশ করলো। মাগরিবের আযানের তখনো দু’তিন মিটি বাকী। তালেবানে ইলমের উপচে পড়া সমাগমের মধ্যেই হুযূরকে ধরে ধরে উপরে দোতালায় ওঠানো হলো।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
১। কোরআনের আয়াত, مثل كلمة طيبة كشجرة طيبة أصلها ثابت وفرعها في السماء উত্তম কালিমার উদাহরণ হলো উত্তম বৃক্ষের মত যার মূল (মাটির গভীরে) সুদৃঢ়, আর তার শাখা-প্রশাখা আকাশমুখী।
২। আমার প্রিয় মাওলানা আব্দুল মালিকও অনেক সফরে আমার সঙ্গে ছিলেন, আরো সঠিকভাবে বললে, আমি ছিলাম তাঁর সঙ্গে। ইচ্ছে আছে, ‘এক টুকরো মাটির সন্ধানে’ শিরোনামে এ বিষয়ে কিছু লেখার, আল্লাহ যদি তাওফীক দান করেন।
৪। বাংলায় নিরালা শব্দটির অর্থ হলো, নিরিবিলি ও নির্জন; উর্দূতে অর্থ হলো, অপূর্ব, অনন্য, অতুলনীয়। বাংলায়ও এ অর্থে শব্দটির ব্যবহার হতে পারে।