আদর্শ বনাম সাম্প্রদায়িকতা
আমরা মুসলিম, এ আমাদের আত্মপরিচয়। এ পরিচয়েই আমরা গর্ববোধ করি এবং আল্লাহ রাববুল আলামীনের শোকরগোযারি করি। এ পরিচয়ের সূত্রে আমরা লাভ করেছি এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার এবং শামিল হয়েছি আল্লাহ রাববুল আলামীনের অনুগত বান্দাদের মিছিলে। এ পরিচয় কোনো সাম্প্রদায়িক পরিচয় নয়, আদর্শিক পরিচয়। প্রথম মানব ও নবী হযরত আদম আ. -এর দ্বারা যে আসমানী শিক্ষার সূচনা হয়েছিল, হযরত নূহ আ. ও পরবর্তী নবীদের সূত্রে মানবজাতি যে আসমানী বিধান প্রাপ্ত হয়েছিল তারই চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গতম রূপ জগদ্বাসীকে দান করা হয়েছে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে। ইসলামের এ পূর্ণতম ও পূর্ণাঙ্গতম রূপটিই কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য অনুসরণীয়।
আখেরী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোটা মানবতার নবী, গোটা জগতের রহমত। তাঁর উপর নাযিলকৃত আসমানী কিতাব কুরআন গোটা মানবতার জন্য আসমানী হিদায়াতের সূত্র। কুরআন-সুন্নাহর দ্বীন ইসলাম গোটা মানবজাতির জন্য আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ও নাজাতের একমাত্র উপায়। এ কারণেই যে কোনো ভূখন্ডের যে কোনো ভাষার বা যে কোনো জাতি-গোষ্ঠির মানুষ ইসলাম গ্রহণ করবে তার নামই মুসলিম। আর যে কোনো ভাষার , ভূখন্ডের বা জাতিগোষ্ঠির মানুষ এ আদর্শ গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে তার নাম অমুসলিম। সুতরাং ইসলাম কোনো সাম্প্রদায়িক পরিচয় নয়, আদর্শিক পরিচয়। এ কারণে কুরআন মজীদ মুসলিমদেরও আদেশ করে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ
হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইসলামে প্রবেশ কর পূর্ণরূপে। শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন। -সূরা বাকারা:(২) ২০৮
তাই ঈমান ও ইসলামের পরিচয়ের কারণে আমরা যখন গর্ববোধ করি তখন নিজেদের জীবন ও কর্ম এবং চেতনা ও বিশ্বাসকে পূর্ণ ‘মুসলিম’ বানানোর চিন্তা করাও কর্তব্য। এই চিন্তা ও প্রয়াস হচ্ছে আল্লাহ তাআলার এ নেয়ামতের শোকরগোযারির অন্যতম উপায়।
ইসলাম যেমন সাম্প্রদায়িক পরিচয় নয় তেমনি এতে সাম্প্রদায়িকতার অবকাশও নেই। কিন্তু বর্তমান যুগের অসত্য-চর্চার এক ভয়াবহ দিক হচ্ছে, আদর্শকে সাম্প্রদায়িকতা আর সাম্প্রদায়িকতাকে আদর্শ সাব্যস্ত করা। এ কারণে বর্তমান ‘মুসলিম’ সমাজেও ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারীদের বিশেষণ জঙ্গি, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক। আর ইসলাম বিদ্বেষী চরম বর্ণবাদী গোষ্ঠীর উপাধি উদার, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক।
সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা ইসলামে সুস্পষ্ট। আর তা হচ্ছে, শুধু নিজ গোত্র বা গোষ্ঠীভুক্ত হওয়ার কারণে কারো অন্যায়কে সমর্থন করা এবং সহযোগিতা করা। এ সুস্পষ্ট মানদন্ড দ্বারা বর্তমান যুগের সাম্প্রদায়িক আচরণ ও উচ্চারণগুলো খুব সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব।
মানব সমাজে ভাষা ও ভূখন্ড এবং বর্ণ ও গোত্রগত যে বিভিন্নতা এ তো মহান আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার নিদর্শন।
وَمِنْ آَيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِلْعَالِمِينَ
এবং তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণবৈচিত্র। নিশ্চয়ই এতে আছে নিদর্শনাবলী জ্ঞানীদের জন্য। -সূরা রূম: (৩০) ২২
তেমনি এসব বিভিন্নতা হচ্ছে পরিচিত হওয়ার উপায়। এগুলোর কোনোটিই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়া এমন এক শব্দ যা ইসলামের সকল করণীয়-বর্জনীয়কে শামিল করে। কুরআন মজীদের সুস্পষ্ট ইরশাদ-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
হে লোকসকল! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে এবং তোমাদের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রের বানিয়েছি যেন পরস্পর পরিচিত হতে পার। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে যে তাকওয়ায় শ্রেষ্ঠ সেই আল্লাহর কাছে মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তো সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত। -সূরা যুমার: (৪৯) ১৩
তাই এ সকল বৈচিত্রকে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি মনে করা এবং এগুলোকেই শত্রুতা ও মিত্রতার মানদন্ড বানানো ইসলামের দৃষ্টিতে জাহেলিয়াত ও সাম্প্রদায়িকতা, যা জ্ঞান ও আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।
ইসলামে পরস্পর সহযোগিতার মানদন্ড হচ্ছে, ‘আল বির্’ ও ‘আততাকওয়া’। ইরশাদ হয়েছে-
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ
নেকী ও পরহেযগারীতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপকাজ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যের সাহায্য করো না। -সূরা মায়িদা:(৫) ২
অমুসলিমদের প্রতিও জুলুম-অবিচার করা ইসলামে নিষেধ-
وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآَنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى
কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদের ইনসাফ ত্যাগে প্ররোচিত না করে। ইনসাফ কর। এ খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। -সূরা মায়িদা:(৫) ৮
এ সুমহান দ্বীন ও সমুচ্চ আদর্শ লাভের পর যারা জাহেলিয়াতের চেতনা লালন করে এবং মুসলিম সমাজে জাহেলিয়াত ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটাতে চায় তারা আল্লাহর কাছে চরম ঘৃণিত ও কৃতঘ্ন।
أبغض الناس إلى الله ثلاثة : ملحد في الحرم، ومبتغ في الإسلام سنة الجاهلية، ومطلب دم امرء بغير حق ليهريق دمه
তিন শ্রেণির মানুষ আল্লাহর নিকট সবচে বেশি ঘৃণিত : যে হরমের সীমায় পাপাচারে লিপ্ত হয়, যে ইসলামে এসে জাহেলিয়াতের রীতি-নীতি অন্বেষণ করে আর যে নিরপরাধ মানুষের রক্তপাতে প্রয়াসী হয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস:৬৮৮২
আল্লাহ তাআলা আমাদের ইসলামের নেয়ামতের শোকরগোযারি করার এবং এই সকল বিচ্ছিন্নতা ও সাম্প্রদায়িকতা থেকে পবিত্র হওয়ার এবং পবিত্র থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন। ষ