আ দ র্শ : উভয়েই সত্যবাদী!
বাস্তবে তারা একই দলের। একই পক্ষের। কিন্তু ৫ জানুয়ারির অদ্ভুত নির্বাচনে একজনের কাগুজে ঠিকানা বদলে গেছে। তিনি এখন জাতীয় সংসদে ঢাকার একটি আসনের স্বতন্ত্র সংসদসদস্য। তবে তিনি দলের ঢাকা মহানগর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদটি অবশ্য এখনও ছাড়েননি। আর অপর অংশ হল বহুল আলোচিত একটি ছাত্রসংগঠন। এই দুটি অংশ হঠাৎ করেই যেন দুটি পক্ষ হয়ে গেল গত ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে। তখন থেকেই শুরু হয়েছে পরস্পরের বিরুদ্ধে তাদের বিষোদগার। প্রকাশ্য তেতো সত্যকথন। একপক্ষ আরেকপক্ষের প্রকৃত চেহারা ও চরিত্রের বর্ণনা তুলে ধরছে। প্রশ্ন দাঁড়িয়ে গেছে, এখন কাকে বিশ্বাস করবে সাধারণ মানুষ আর কাকে অবিশ্বাস করবে? কার কথা সত্য কিংবা কে মিথ্যা বলছে?
সন্ত্রাস ও সশস্ত্র তৎপরতার কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি অর্জন করেছে ছাত্রসংগঠনটি। আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রের যৌথ ব্যবহার, পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে অস্ত্র তাক ও বোমাবাজি, রাজনৈতিক বিরোধী ও নিরীহ ছাত্র নির্বিশেষে সব ছাত্রছাত্রীর ওপর হামলায় তাদের কোনো তুলনা হয় না। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতেও তারা পিছিয়ে নেই। সংবাদপত্রে তাদের সশস্ত্র নেতাকর্মীদের অ্যাকশনমুখর ছবি ছাপা হয় প্রায়ই। এরই জের ধরে ১০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিয়ে বসেন পুরান ঢাকার সেই সদস্য। তার বক্তব্যে এমপি সাহেব বৃহৎ ছাত্রসংগঠনটিকে মাথাকাটা বা কল্লাকাটা হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের থামাতে সরকারের উদ্যোগ নেয়ার আহবান জানান। কিন্তু তার বক্তব্যে ছাত্রসংগঠনের লোকেরা চুপ থাকতে পারেননি। দুদিনের মাথায় তারাও মুখ খুলেছেন এবং দাঁতে-জিহবায় কিছুটা মাঞ্জা দিয়েই খুলেছেন। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ওই এমপি সম্পর্কে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘অশিক্ষিত, টোকাই, মূর্খলোক ও খুনি এরশাদ শিকদারের বন্ধু।’ তারা ওই সংসদসদস্যের ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য’ জাতীয় সংসদে এক্সপাঞ্জ করার অনুরোধ এবং তাকে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহবান জানান।
চরিত্রের পর্দা উন্মোচনের এই হচ্ছে ঘটনা। যতদূর দেখা যাচ্ছে, এ ঘটনার জের এখনও চলছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিববত হল উদ্ধার নিয়ে চলছে মিছিল-মিটিং। বিশেষ কোনো লেনদেন না হলে হয়তো এর জের সহজে বন্ধ হবে না। এই জের চলুক বা বন্ধ হোক, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু পর্দা উন্মোচনের এই পর্বটাকেও লোকে কম তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছে না। এই তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক বিশ্লেষক বলেন, জেদে হোক আর রাগে হোক-তাদের উভয় পক্ষই অপরপক্ষের প্রকৃত চেহারা পরিষ্কার করতে কোনো কৃপণতা করেনি। আর তারা একই রাজনৈতিক দলের হওয়ায় সেটা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যও হয়েছে। রাখঢাক না করে একরকম সত্যটাই তারা তুলে ধরেছেন। ‘অশিক্ষিত, টোকাই, মূর্খলোক’ আর ‘খুনি এরশাদ শিকদারের বন্ধু’ কথাটার মর্ম অনেকেই জানেন। ফাঁসির আগে খুলনার এরশাদ শিকদারের ঢাকায় যাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলে তথ্য প্রকাশ হয়েছিল তাদের মধ্যে এই সংসদসদস্যের নামও ছিল। অবশ্য সে তালিকায় ঢাকার আরও একজন সংসদসদস্যের নামও ছিল, যিনি এক সময় ক্রিকেটের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। তবে প্রকাশ্যে বিষয়টি নিয়ে কোনো পক্ষ কোনো কথা আগে বলেনি। এবার বিষয়টি নিয়ে ছাত্রসংগঠনটি স্পষ্টভাষায় মুখ খুলল।
বাকি একটি ব্যাপার নিয়ে এখন কেউ কেউ অস্পষ্টতায় ভুগছেন। সেটি হচ্ছে, ওই সংসদসদস্য কি দলের মহানগর কমিটির পদপদবি ছেড়ে দিয়েছেন? কিংবা ছাত্রসংগঠনটি কি তাকে দল থেকে বের করে দিয়েছে? কিংবা ছাত্রসংগঠনটির মাথাকাটা রূপ সম্পর্কে কি এমপি সাহেব আগে কিছুই জানতেন না? অথবা এমপি সাহেবের ‘মূর্খ, টোকাই, খুনি এরশাদ শিকদারের বন্ধ’ু রূপটি ইতিপূর্বে ছাত্রসংগঠনটির কাছে একদমই অপরিচিত ছিল? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তরই হ্যাঁ বাচক নয়। এখানে অস্পষ্টতার আসলে কোনো সুযোগই নেই। সবকিছু আগের মতোই আছে। কেবল সংসদে তিনি মৌখিকভাবে একটু ভিন্ন অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ব্যস এতেই এখন পরস্পরের সতর খোলা শুরু হয়ে গেছে। এ ঘটনায় আমাদের মনে এ ভাবনা জাগতে পারে যে, ওই দলটির ভেতরে এমন বহু ‘কৃতি’ ব্যক্তিত্ব ও গ্রুপ রয়েছে, যাদের ব্যাপারে কেউ মুখ খুললে ঘটনা এমনটিই ঘটবে। দেখা যাচ্ছে, নিজদলে নিজ পক্ষে নিজেদের মতো থাকলে সে রূপটি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু কোনো রকম বিরুদ্ধতার গন্ধ পেলেই আর রক্ষা নেই। তখন সব বেটাই দিগম্বর। তবে দুপক্ষের এসব সত্যকথন কিংবা চরিত্র-উন্মোচনপর্ব থেকে আমাদের মতো আম মানুষের করণীয় কী-সেটিই হচ্ছে বড় কথা। এসব ক্ষেত্রে আমরা তো আর কারো পক্ষে কিংবা বিপক্ষে গিয়ে বিপদে পড়তে পারি না। যারা মাথা কেটে লাশ গায়েব করে ফেলে কোন সাহসে আমরা তাদের অবিশ্বাস করব? কিংবা যিনি খুনি এরশাদ শিকদারের বন্ধু, তার কথায় পাত্তা না দিয়ে তাকে কীভাবে শত্রু বানাতে পারি? সুতরাং কল্লাকাটা ছাত্রসংগঠন এবং খুনি এরশাদ শিকদারের বন্ধু পুরান ঢাকার এমপি সাহেব উভয়কেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই। আমরা ধরে নিয়েছি, তারা উভয় পক্ষই সত্য বলেছেন। তাদের মতো লোকজনের ক্ষেত্রে এটাই আমাদের নিরাপদ অবস্থান।