গুমনাম এক আশেকে মাদানী
সম্ভবত ১৪২৪ হিজরীর কথা। আমি তখন আমার প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার উলূমুল হাদীস তৃতীয় বর্ষে পড়ি। হযরত আমীনুত তালীম মাওলানা আব্দুল মালেক ছাহেব হুজুর একদিন ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, চৌদ্দগ্রামের মাওলানা আব্দুল মালেক হোসাইনী ছাহেবকে চেনো? আমি বললাম, চিনি না। হুজুর একটি চিঠি দেখালেন। প্রেরকের নাম, আব্দুল মালেক আলহোসাইনী আল-কাসেমী। একটি ইলমী বিষয়ে চিঠিটি লেখা। সেজন্য একটু খুশীও হলাম। আশ্চর্যান্বিতও হলাম। আমাদের এলাকায় এমন লোক আছেন! সঙ্গত কারণেই প্রেরকের প্রতি অন্যরকম একটি আগ্রহের জন্ম হল। পরীক্ষার বিরতিতে যখন বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিলাম তখন আরো লজ্জিত হলাম এবং নিজেকে তিরস্কার করতে লাগলাম। কারণ তিনি আমাদের গ্রাম থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরের একটি গ্রামের অধিবাসী। তাছাড়া তাঁর বংশীয় মুরুববীদের সাথে আমাদের বংশীয় মুরুববীদের বেশ উঠাবসা ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। পরে তাঁর সাথে যোগাযোগ করে তার বাড়িতে গেলাম। সালাম-মোসাফাহার পর পরিচয় দিলাম, আমাকে না দেখলেও আমার খোঁজ রাখেন বললেন, আববা চাচাদের হালপুরসি করলেন। মারকাযসহ অন্যান্য মাদরাসা সম্পর্কেও কথা হল। এরপর কথা উঠল কিতাবাদি সম্পর্কে। তিনি বিভিন্ন কিতাব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছেন, কোনটি তাঁর কাছে আছে, কোনটি নেই তাও বলছেন। আমি একপ্রকার অবাকই হচ্ছি যে, এই সাদাসিধে মানুষটির কাছে এইসব কিতাব আছে!! অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে তাঁর কিতাবগুলো দেখার আবেদন করলাম, তিনি সহাস্যে তা মঞ্জুর করলেন এবং আমাকে কিতাবের কামরায় নিয়ে গেলেন। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকলাম এবং পরবর্তীতে আরো বেশি সময় নিয়ে দেখার আগ্রহ বুকে চেপে ফিরে এলাম।
পুরো বিষয়টি পরে আমীনুত তালীম ছাহেব হুজুরকে জানালাম। হুজুরও তাঁর সাথে মুলাকাত এবং তাঁর কিতাবাদি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সে উদ্দেশ্যে পরে হুজুরের একটি সফর হয়েছিল।
গত ৭ই ডিসেম্বর ২০১৩ ইং বিকাল ৪টায় ফোন বেজে উঠল। অপর প্রান্তে এক আত্মীয় বললেন, মাওলানা আব্দুল মালেক হোসাইনী ছাহেব গত রাতে
ইন্তেকাল করেছেন, আজ বাদ যোহর জানাযা ও দাফন হয়েছে। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
জীবিতাবস্থায় যতবারই দেখা হয়েছে, মনে হয়েছে একেবারেই সাদাসিধা একজন মানুষ। ইস্ত্রী-বিহীন জামা, মাথায় লম্বা টুপি, পায়ে স্যান্ডেল, কাঁধে রুমাল। পোশাকের মতোই তাঁর চালচলন কথাবার্তা এবং মৌন প্রকৃতির সাদাসিধা রূপ। সেজন্য পরিচিত লোকজন ছাড়া অন্যদের পক্ষে বুঝাই কষ্ট হত যে, তিনি একজন আলেম। ওদিকে সাধারণ আলেম শ্রেণী তাকে আলেম মনে করলেও ভাবতেন, হয়তো সামান্য পড়াশোনা করেছেন। তিনি নিজের কাজেই নিমগ্ন থাকতেন। মানুষের সাথে অহেতুক মিশতেন না। কারো সাথে সাক্ষাৎ করলে প্রয়োজন সেরেই প্রস্থান করতেন। তাই সবার ধারণা, তিনি একজন শুষ্ক মানুষ। আবেগ-অনুভূতি, অনুরাগ-অভিমান তাঁর মাঝে নেই।
তাঁর ইনতেকালের পর তাঁর কুতুবখানায় আবার গেলাম। একটি একটি করে সবকটি কিতাব দেখার চেষ্টা করলাম। তাঁর ব্যক্তিগত আলমারী, ডায়েরি, কাগজ পত্র দেখতে লাগলাম। আর অবাক হতে লাগলাম এমন সাদাসিধা আত্মভোলা মনীষীর নিকট কীভাবে কোত্থেকে এল এইসব ভান্ডার! এমন শুষ্ক মানুষের মাঝে কীভাবে এই জযবা, এই ইশক!
তাঁর মাকতাবা আয়তনে সুবিশাল না হলেও যা জমা করেছেন তার সবই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐ বিষয়ে
বুনিয়াদি অথবা দুর্লভ কিতাব। তাঁর এই সুন্দর নির্বাচন থেকে তার ইলমী ও ফিকরী রুচির স্বচ্ছতা ভেসে উঠে। আকাবিরে হিন্দ-এর জীবনী, তাঁদের মালফুযাত-মাকতুবাত, তাঁদের তাফসীর বা অন্য কোনো তাসনীফ, রদ্দে ফেরাকে বাতেলা, তারীখে তাকসীমে হিন্দ, তারীখে দারুল উলূম দেওবন্দ, তারীখে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, বিভিন্ন লাইব্রেরীর কিতাবের তালিকা ইত্যাদি বিষয়ে অনেক বুনিয়াদি ও দুর্লভ কিতাব তিনি জমা করেছেন।
শুধু তাই নয়, বরং ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ সাপ্তাহিক, পাক্ষিক পত্রিকাগুলোও তিনি নিয়মিত সংগ্রহ করতেন। মাসিক আল কাসিম, মাসিক আলখায়ের (মুলতান), মাসিক আখবারে মদীনা (বিজনৌর), মাসিক আনওয়ারে মদীনা (লাহোর), মাসিক তরজুমানে ইসলাম (লাহোর), মাসিক আল ফিকাহ, মাসিক আনওয়ারে মদীনা, মাসিক আর রশীদ (পাকিস্তান), মাসিক নেদায়ে শাহী, মাসিক ইনসানিয়াত (কলকাতা), মাসিক দারুল উলূম দেওবন্দ, পাক্ষিক আয়েনায়ে দারুল উলূম, দেওবন্দ টাইম্স, নেদায়ে দারুল উলূম, আদ দায়ী, চেরাগে হরম, সাপ্তাহিক পায়ামে মাশরিক, আল জমিয়ত ইত্যাদি বহু পত্রিকা যতদিন আর্থিক সংগতি ছিল তিনি সংগ্রহ করেছেন।
এসব কিছু সংগ্রহের ক্ষেত্রে তাঁর ভিতর যে তাড়নাটি কাজ করত, তা হল ভালো কিছুর সন্ধান ও তা পড়ার আগ্রহ। জীবিত অবস্থায় তাঁর কিতাবাদি সংগ্রহের বিষয়ে কোনো কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারিনি। সে জন্যে এখন আফসোস হচ্ছে। কিন্তু তার রেখে যাওয়া নোট-ডায়েরি সে বিষয়ে অনেক তথ্য দেয় আমাদেরকে।
মাওলানা মনযুর নোমানী রাহ. শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাহ. সম্পর্কে মাসিক আল ফুরকানের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। এ সংখ্যাটি তিনি কীভাবে সংগ্রহ করেছেন তার বর্ণনা মলাটের গায়ে উর্দূতে লিখে রেখেছেন। যার সারমর্ম হল ১৯৪০ সনে মাওলানা মনযুর নোমানী কুরআন হাদীসের মাহির কিছু সাহিত্যিকদের প্রবন্ধ একত্র করে শাহওয়ালী উল্লাহর উপর আল ফুরকানের একটি বিশেষ সংখ্যা তৈরী করেন। দেওবন্দে পড়াশোনাকালীন সময়ে তার সন্ধানে ছিলাম।
বড় বড় উলামায়ে কেরামের নিকট আমার এ আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে চিঠি পাঠাতে লাগলাম। তখন মাওলানা নসীম আহমদ রাহ. মেহেরবানী করে ডাক মাধ্যমে আমার ঠিকানায় পত্রিকাটি পাঠিয়ে দেন। আল্লাহ তাঁকে উত্তম বিনিময় দান করুন। জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন।’
উল্লেখ্য, জনাব নসীম আহমদ ছাহেব হযরত মাদানীর ছাত্র। ঐ সংখ্যায় তাঁরও লেখা রয়েছে। সম্ভবত এসব চিন্তাভাবনা করেই তাঁর নিকট পত্র লিখেছেন। তাঁর লেখাটিতে স্পষ্ট যে, তিনি এ সংখ্যাটির জন্য কত ব্যকুল ছিলেন, এবং তা অর্জনের জন্য কত চেষ্টা করেছিলেন। আমি পুরো লেখাটি উদ্ধৃত করিনি। লেখাটির শেষে পুনরায় মাওলানা নসীম আহমদ ছাহেবের জন্য দুআ করেছেন। ঐ সংখ্যায় মাওলানার লেখা যেখানে, সেখানের টিকাতেও তাঁর ইহসানের কথা পুনরায় উল্লেখ করেছেন। এসব কিছুই তাঁর অন্তরে যে প্রাপ্তির আনন্দ ছিল তার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
আরেক জায়গায় তিনি লেখেন, ‘নুযহাতুল বাসাতীন’ কিতাবটি দিল্লির বেশ কয়েকটি কুতুবখানায় তালাশ করেছি। পাইনি। পরে কানপুরে এক লাইব্রেরীর পুরাতন ছেঁড়া কিতাব-কাগজ সংগ্রহ করে তালাশের সময় একদিন স্বপ্নে দেখি, ‘দেওবন্দ জামে মসজিদের ফটকে রাস্তার দক্ষিণে মুফতিয়ে আ’যম কেফায়াতুল্লাহ রাহ. উপস্থিত, অত্যন্ত সাধারণ খদ্দর পরিহিত। মুসাফাহার পর জিজ্ঞেস করলাম, হযরত! নুযহাতুল বাসাতীন আপনার লাইব্রেরীতে আছে? তিনি বললেন, নেই। অতপর দিল্লির মাকতাবায়ে রহীমিয়াতে যোগাযোগ করে জানা গেল, তাদের কাছে কিতাবটি আগে ছিল, এখন নেই’।
একটি কিতাব সংগ্রহের জন্য লাইব্রেরীগুলোতে খোঁজ নেয়া, পরবর্তীতে বুদ্ধি করে পুরাতন ছেড়া বইপত্র সংগ্রহ করা, এরপর এমনভাবে ধ্যানমগ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া যে স্বপ্নযোগেও তার তালাশ! এসব ঘটনা তাঁর কিতাবের প্রতি শুধু মহববত নয়, ইশকেরই প্রমাণ।
এসব তথ্য পাওয়ার পর ভাবি, একজন হতদরিদ্র মানুষ। তাঁর মধ্যে এ হালত কীভাবে সৃষ্টি হল। আমরা আজকের ছাত্ররা আজ আরো কত ভালো অবস্থায় আছি, কত টাকা পয়সা ব্যয় করি। তারপরও কিতাবের প্রতি আমাদের ইশক তো দূরের কথা, সামান্য টান আছে কি না সন্দেহ। হাঁ, টান বা ইশক আমাদের দিলে থাকে বটে, তবে তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জামা-কাপড় ও জুতার প্রতি।
ওই কিতাবটি যখন খোঁজেন সম্ভবত তিনি তখন দারুল উলূমের ছাত্র। আজ আমাদের শুধু ছাত্রজীবন নয় শিক্ষকতা জীবনের শেষেও কিতাবের প্রতি তেমন কোনো ঝোঁক সৃষ্টি হয় না। আসলে আমরা তালিবুল ইলম হলেও প্রকৃত তলবুল ইলম আমাদের মাঝে নেই। তিনি শুধু কিতাব সংগ্রহই করতেন না, তা পড়তেনও। তাঁর মাকতাবার খুব কম কিতাবই পাওয়া যাবে যেগুলোতে তাঁর টিকা, মন্তব্য, বা গুরুত্বপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা নেই। অনেক কিতাবের মলাটের গায়ে ভিতরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ইঙ্গিত আছে।
তাঁর পরিবার থেকে জানতে পারলাম সারাদিন মাদরাসার ব্যস্ততা সেরে রাতে এসে কিতাব নিয়ে বসে যেতেন। চারদিকে কিতাব আর কিতাব। এভাবে রাত একটা-দুইটা পর্যন্ত মুতালাআ করে ওভাবেই কিতাবের মাঝে ঘুমিয়ে যেতেন। অনেক সময় চশমাটা পর্যন্ত চোখে থেকে যেত। আবার দিনের বেলায় একটু সময় পেলে তখনো কিতাব নিয়ে বসে যেতেন। তাঁর মেয়েরা বললেন, ঘর ছোট হওয়াতে অনেক সময় এজন্য আমাদের কষ্টও হতো।
কোনো কিতাব মুতালাআর সময় তাঁর কোনো তথ্য বা ঘটনা অন্য কিতাবে থাকলে কিতাবের টিকায় সেগুলোও লিখে দিতেন। কোনো কিতাব বা কোনো মনীষীর নাম আসলে বিশেষভাবে
হিন্দুস্তানী মনীষী হলে তাঁর পরিচয়ও টিকায় তুলে ধরতেন। তার বহু কিতাবে আমি এসব দেখেছি।
কিতাবের কোনো তথ্য বুঝে না আসলে তার জন্য বড়দের নিকট চিঠিপত্র লেখা শুরু করতেন। হিন্দুস্তানের আলেম উলামা, কিতাবাদি ও ইতিহাস মোটামুটি তার কাছে পরিষ্কার ছিল।
কিতাবের প্রতি যত্ন-আত্তিও ছিল দেখার মতো। প্রত্যেকটি কিতাব নিজেই মলাট লাগিয়েছেন। যেগুলো বাঁধাইয়ের প্রয়োজন সেগুলো নিজেই বাঁধাই করতেন। পাতা ছিঁড়ে গেলে কাগজ ও আঠা দিয়ে তা ঠিক করে নিতেন। সবকটি কিতাবের মলাটের ভিতরে এক দুইটি সাদা পাতা সংযুক্ত করে দিয়েছেন। যেন কিতাবের কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এখানে টুকে রাখা যায় বা তার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে দেওয়া যায়। এক বাঁধাইতে কয়েকটি কিতাব হলে মলাটের গায়ে সবগুলির তালিকা দিয়ে দিয়েছেন। পত্রিকাগুলোও সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করে বাঁধাই করে সাজিয়ে রেখেছেন। আরো বিস্ময়ের বিষয়, তিনি হিন্দুস্তানের তৎকালীন বড় বড় লাইব্রেরীগুলোর ক্যাটালগ বা কিতাব-তালিকার বইগুলোও সংগ্রহ করেছেন এবং সেগুলোও বাঁধাই করে রেখেছেন। সেগুলো এত পরিমাণ যে, কয়েক খন্ডে সেগুলো বাঁধাই করতে হয়েছে। একজন ইলম পিপাসুর জন্য এগুলো কত গুরুত্বপূর্ণ তা বলার প্রয়োজন নেই।
এ থেকেও তাঁর কিতাব সংগ্রহের নেশা ও রুচি সহজে বুঝা যায়, আল্লাহ আমাদেরকে তাদের মতো ইহতিরাক লিল ইলম দান করুন। আমীন।
তাঁর রেখে যাওয়া কাগজ-পত্র ও কিতাবাদির টিকা-নোট থেকে বোঝা যায়, দেওবন্দ পড়ার সময় থেকে বড়দের সাথে তাঁর চিঠিপত্রের ধারা অব্যাহত ছিল। আলফুরকান শাহওয়ালী উল্লাহ -সংখ্যায় মাওলানা গীলানী রাহ.-এর প্রবন্ধের শুরুতে টিকায় লেখেন, ‘তিনি আল্লামা গীলানীর নিকট বিভিন্ন বিষয়ে পত্র দিয়েছেন এবং আল্লামা গিলানী অত্যন্ত বার্ধক্য সত্ত্বেও তাঁর পত্রগুলোর উত্তর দিয়েছেন।
ঐ সংখ্যার আরেকটি তথ্যের বিষয়ে লেখেন যে, এ বিষয়ে বড়দের অনেকের সাথে চিঠিপত্র দেওয়ার সুযোগ হয়েছে এবং সবগুলো চিঠি সংরক্ষিতও আছে। সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ মিয়াঁ রাহ. সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী, আসজাদ মাদানী, আরশাদ মাদানী, মাওলানা রশীদ আলওহীদীসহ অনেকের সাথে তাঁর চিঠি পত্র আদান-প্রদানের তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু আমি অনেক তালাশ করে তাঁর চিঠি পত্রের সামান্য কিছু পেলেও বড় অংশ উদ্ধার করতে পারিনি। আল্লাহ হয়তো কোনো সময় মিলিয়ে দিবেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী রাহ.-এর ‘আশেকে যার’ ছিলেন। হযরত মাদানী রাহ.-এর ওফাতের বছর তিনি দেওবন্দে দাওরা হাদীস পড়েন। শ্রেণীকক্ষে তাঁর বসার স্থান দূরে পড়ে গিয়েছিল। তাই তিনি হযরত মাদানী-এর কাছে বসার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। বিস্তারিত তিনি সাইয়্যেদ মিয়া রাহ.-এর একটি কিতাবের শুরুতে লিখেছেন। যার সারমর্ম এই- ‘সাইয়েদ মুহাম্মাদ মিয়াঁ সাহেবকে আমি সর্বপ্রথম দেখি ১৯৪৫ সনে হাটহাজারী মাদরাসায় এক জলসায় তিনি আরবীতে ভাষণ দিলেন। আমি তখন জামাতে নাহমে পড়ি, তখনই তাঁর প্রতি মহববত হয়ে গেল। ফতেহপুর মাদরাসার উস্তায মুফতি ইউসুফ ছাহেব হাটহাজারীতে যার বেশ আসা যাওয়া ছিল তাঁর নিকট সাইয়েদ মুহাম্মাদ মিয়া ছাহেবের প্রসিদ্ধ কিতাব ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী-এর নাম শুনি। ধীরে ধীরে মুহাববাত পুরো জমে গেল। ১৯৫৩ সনে যখন দেওবন্দ যাই এবং কানযুদ দাকাইক জামাতে ভর্তি হই তখন সাইয়েদ সাহেবের সাথে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান অব্যাহত ছিল। তার সাথে কিতাবাদির আদান- প্রদান হতো। একদিন তিনি আমার দাওয়াতে আমার কামরায়ও গিয়েছিলেন। সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী-এর দরসে নিকটে বসার জন্য সুপারিশ নিতে গিয়ে দুবার দিল্লিতে তাঁর সাথে সাক্ষাত করি। তিনি সুপারিশনামা লিখে দিলেন, যার সুবাদে আমি হযরত মাদানীর একদম বাহুর কাছে স্থান পেয়ে যাই। হযরত আমাকে তাঁর ঘর ‘মাদানী মনযিল’ থেকে আসা যাওয়ার সময় হারিকেন বহনের খেদমত অর্পণ করেন।
এই সাইয়্যেদ সাহেবের কিতাব
صحابہ كرام كا عہد زريں
একবার ঢাকার সদরঘাটে দেখলাম এবং ক্রয় করলাম। মন ভরে মুতালাআ করলাম। আল্লাহ তাঁকে লাখো রহমত দান করুন।
আরেক স্থানে লেখেন, মৃত্যুর এক সপ্তাহ পূর্বে আমি হযরত মাদানী রাহ.কে কিছু হাদিয়া দিয়ে তার ব্যবহারিত একটি জামার আবেদন করি, তখন তিনি তাঁর ঘরের বারান্দায়। আসাতেযায়ে কেরাম ও বেশ ক’জন ছাত্র সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিল ধারণের ঠাঁই নেই। হযরত কিছু বললেন না। ঠিক এক সপ্তাহ পর আমি পুনরায় আবেদন করি। হযরত বললেন,بهول گيا ‘ভুলে গিয়েছি’। এর এক সপ্তাহ পর হযরতের ওফাত হয়ে গেল। পরবর্তীতে হযরতের আহলিয়া আমাকে জামা দিলেন।’
এ জামার কথা তার পরিবারের লোকজনও আমাকে বলেছেন। সেই জামাখানি কোথায় আছে তা আমার জানা নেই। শুধু জামা-ই নয় তাঁর নিকট হযরত মাদানীর একটি জায়নামায ও অজুর বদনাও ছিল। এ জিনিসদুটি এখনো সংরক্ষিত আছে। হযরত আসআদ মাদানী রাহ. তাঁর এখানে আসলে এগুলোর খোঁজ নিতেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী একজন আলেম আমাকে জানিয়েছেন।
হযরত মাদানী রাহ.-এর দাফনের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি লেখেন, ‘হযরতকে মাওলানা আসআদ মাদানী, মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা আব্দুর রশীদ ও মাওলানা রাশেদ কবরে রাখেন। আমি অধম কবরের পূর্ব পাশে দাঁড়ানো ছিলাম। সেখানে সাইয়েদ মুহাম্মাদ মিয়াঁ ছাহেব এবং মাওলানা হিফযুর রহমান সিউহারুভী রাহ.-ও ছিলেন। তাঁরা কেঁদে জার জার হয়ে যাচ্ছিলেন।’ স্বাভাবিক কথা, হযরত মাদানীর জানাযায় মানুষের ঢল নেমেছিল। বড় বড় উলামায়ে কেরামের উপস্থিতি ছিল। একজন সাধারণ ছাত্র তখন কবরের পাশে দাঁড়াতে পারা কত বড় হিম্মত ও ইশকের প্রমাণ বহন করে তা সহজেই অনুমেয়।
হযরত মাদানীর প্রতি তাঁর কেমন ভালবাসা ছিল তা আরেকটি ঘটনা থেকে বুঝা যায়। মাওলানা হুসাইন আহমদ নামে দারুল উলূম দেওবন্দে একজন উস্তায আছেন। তিনি একটি কিতাব লিখেছেন, নাম
مشكل تركيبوں كا حل مع قواعد ونكات
এ কিতাবের মলাটে লেখেন যার সারমর্ম এই -‘এই কিতাবের লেখকের নাম দেখে সর্ব প্রথম আমি ভয় পেয়ে যাই আমার উস্তাযের নামে তার নাম, অতপর আমি তা আবেগ নিয়ে পড়া শুরু করি এবং কিতাবটি আমার দিলে গেঁথে যায়। ফলে কিতাবটি সংগ্রহ করা ছাড়া আমার মন কোনোভাবেই মানছে না। তাই আমি কিতাবটি ক্রয় করলাম। কেবল লেখকের নামের মহববতের কারণে।’ হযরত মাদানী রাহ.-এর প্রতি কেমন ইশক ছিল তার চিঠিপত্র ইত্যাদি থেকেও স্পষ্ট বুঝা যায়। কোনো কিতাবে হযরতের নাম এলে, অথবা কোনো বিষয় এলে এর উপর কত টিকা যে লেখেন, কতভাবে লেখেন তা অবাক হওয়ার মতো। এগুলোর সামান্যও উল্লেখ করলে লেখা দীর্ঘ হয়ে যাবে। স্বপ্নযোগে হযরত মাদানীর সাক্ষাতের ঘটনাও বেশ কয়েকবার লিখেছেন, সেগুলো উদ্ধৃত করছি না।
হযরত মাদানী যে বছর ইনতেকাল করেন সে বছরের কিতাবগুলোর স্থানে স্থানে তিনি যে ব্যথা পেরেশানী বিভিন্ন পদ্যে-গদ্যে প্রকাশ করেছেন তা সত্যিই অবাক করার বিষয়। এসব দেখে ভাবি এতসব ব্যথা ও জ্বলন বহন করে কীভাবে একজন মানুষ গুমনাম হয়ে থাকতে পারে।
আমার সামনে হযরত মাদানী রাহ. সম্পর্কে তাঁর যে উক্তিগুলো আছে সত্যিই কলমকে তা থেকে সংবরণ করা মুশকিল। উস্তাযের প্রতি এমন ভালবাসা কীভাবে সৃষ্টি হয়! আসলে এটাই হল মূল পুঁজি এবং এখানেই মূল পার্থক্য। আজ আমরা ধীর গতিতে বস্ত্তবাদের দিকে ধাবিত হয়ে দিন দিন যান্ত্রিক মানুষে ও যান্ত্রিক ছাত্রে পরিণত হচ্ছি। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।
বিষয়টির শেষ প্রান্তে আমি তাঁর একটি উক্তি উদ্ধৃত করেই ইতি টানছি। এক কিতাবের গায়ে লেখেন
تمہارا ذكر تم سے كم نہيں وجہ سكون دل
তাঁর এ ভালবাসা শুধু হযরত মাদানী পর্যন্তই সীমিত ছিল না; বরং হযরতের পুরো পরিবারের সাথে ছিল। ছাত্র সময়ের হযরতের তিন পুত্রের বেশ কিছু চিঠিপত্র তার নিকট মাহফুজ আছে। পরিবার-সূত্রে জানলাম তাঁরা নাকি অনেক হাদিয়া তোহফা পাঠাতেন। আসআদ মাদানী রাহ. ও আরশাদ মাদানী তার বাড়ি ও মাদরাসায় এসেছেন-এটা আমারও জানা। দেওবন্দে পড়ার সময় যে কোনো প্রেক্ষাপটে হযরত আসআদ মাদানী ও হযরত আরশাদ মাদানী দুটি এক রুপির নোট তাকে দিয়েছিলেন। সেগুলো তিনি বরকত হিসেবে রেখে দিয়েছেন এবং আমৃত্যু হেফাজত করেছেন। সেগুলোও আমি নিজে দেখে এসেছি। তিনি তার পরিবারের সদস্যদের বলতেন, এঁরা আওলাদে রাসূল, এঁদের তাযীম করলে জান্নাত পাওয়া যাবে। পরিবারের সদস্যরাও আমাকে এ ধরনের অনেক আবেগ-বিশ্বাসের কথা শুনিয়েছেন।
হযরত মাদানী রাহ. ও তাঁর পরিবারের প্রতি তার এ আসক্তি হিন্দুস্থানেও জানা শোনা ছিল। প্রসিদ্ধ আলেম, সাহিত্যিক লেখক মাওলানা রশীদ আল ওহীদী-যিনি মাদানী রাহ.-এর ভাই সাইয়েদ আহমদ-এর পুত্র ওহীদ আহমদ-এর পুত্র; তিনি মরহুমের ঘনিষ্ঠ সহপাঠি ছিলেন। এক চিঠিতে লেখেন যার অর্থ হল, ‘নিশ্চয় হযরত মাদানী, হযরত আসআদ মাদানী হযরত আরশাদ মাদানী বরং পুরো খান্দানে শায়খুল ইসলামের প্রতি আপনার ইশক আছে, তড়প আছে। বে-পানাহ মহববত আছে। এ মহববত আপনার জন্য আপনার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সকলের জন্য আখেরাতের পুঁজি হবে। শায়খুল ইসলামের রূহ আপনার প্রতি খুশী হবে।’
আমাদের প্রত্যাশা, আল্লাহ তাআলা মাওলানা রশীদ সাহেবের কথা কবুল করেছেন। উস্তায শাগরিদের সহাবস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
মরহুম আব্দুল মালেক হোসাইনী ছাহেব ১৯৩৩ সনে এক সম্ভ্রান্ত ভুঁইয়া পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মৌলভী সুজাআত আলী, দাদা জনাব আকবর ভুঁইয়া। গ্রাম সারপটি, পো: চিওড়া, থানা: চৌদ্দগ্রাম, জেলা: কুমিল্লা। পিতা একজন বিজ্ঞ আলেম, দক্ষ শিক্ষক, রাজনীতিবিদ ও প্রতাপশালী প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন। ফেনী তথা দেশের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান দত্তসার মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতাদের মাঝে তিনিও একজন ছিলেন। গুনবতীর এলাকার পাশে তিনি একটি দীর্ঘ রাস্তা তৈরী করেন যা এখনো তাঁর নামে পরিচিত।
মরহুম আব্দুল মালেক ছাহেব গুনবতী জুনিয়র মাদরাসায় পড়াশোনা সমাপ্ত করার পর ১৯৪৫ সনে দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে ভর্তি হন। সেখানে ১৯৫১ সন পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। অতপর ১৯৫২ সনে দারুল উলূম দেওবন্দ ভর্তি হয়ে ১৯৫৭ সনে দাওরায়ে হাদীস ও ১৯৫৮ তে দাওরায়ে তাফসীর সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি ভাইদের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে আসাম গমন করেন। ছাত্র হিসেবে তিনি মেধাবী ছিলেন। হাটহাজারীতে হযরত মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম ছাহেবের হাতে এবং দারুল উলূম দেওবন্দে হযরত মাদানীর হাতে প্রথম স্থান অধিকারী হওয়ার জন্য পুরস্কারও পেয়েছেন।
আসাম যাওয়ার পর সেখানে ১৯৬৭ সন পর্যন্ত থেকে যান। এ সময় তিনি আসামের কামরুপ জেলার বঙ্গিয়া শহরের বিভিন্ন কলেজে দ্বীনিয়াত বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। একই প্রদেশের গোপালপুর জেলার বালাজানী মাদরাসায় দুই বছর দাওরায়ে হাদীসের কিতাবাদি পড়ান। এসময় তিনি আসামের প্রত্যন্ত অঞ্চল দ্বারকুই গ্রামে দারুল উলূম দারকুচি নামে একটি মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৬৫ সনে যখন পাকভারত যুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি আসামের লোকদের সাথে মুয়াল্লিম হিসেবে হজ্বে গমন করেন। ১৯৬৭ সনে প্রথম স্বদেশে আগমন করেন। এসে প্রথমে টাঙ্গাইল জেলার বরুরিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল পদে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে ময়মনসিংহের জামেয়া আশরাফিয়াতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরই মধ্যে তিনি ফুলপুর থানার গোদারিয়া গ্রামে দুশতক জমি নিয়ে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যা এখন দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত উত্তীর্ণ। ময়মনসিংহে দীর্ঘ দশ বছর কাটিয়েছেন অতপর নিজের এলাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। এখানে তিনি তিনটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনটিই স্বগতিতে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। এ তথ্যগুলি মরহুম নিজেই লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।
এতগুলো মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা কম পরিশ্রমের কথা নয়। তাই তাকে সব সময় ব্যস্ত দেখা যেতো। বিভিন্ন মানুষের কাছে যেতে হতো। এতে তিনি মোটেই সংকোচ করতেন না। কখনো কেউ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলে তার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করতেন না। বলতেন, সবসময়ই আলেম উলামা এসবের শিকার হয়েছেন। চালচলন কথাবার্তায় নিজেকে পূর্ণ মিটিয়ে দিতেন। তিনি যে হযরত মাদানীর ছোহবতপ্রাপ্ত এবং একজন সাবেক মুহাদ্দিস এসব বোঝার কোনো উপায় ছিল না।
মাদরাসায় যতক্ষণ থাকতেন ততক্ষণ কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকতেন। হয়ত পড়ানো, না হয় নিজস্ব মুতালাআ অথবা তেলাওয়াত কিংবা কিতাব বাঁধাই, গাছ লাগানো অথবা কোনো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা।
ছাত্রদেরকে খুব মহববত করতেন। বিশেষভাবে এতিমদেরকে। এমনকি কোনো এতিম যদি তাঁর মাদরাসার ছাত্র না-ও হয় তবুও তার প্রতি থাকতো তাঁর সীমাহীন সহানুভূতি। এ বিষয়ে তাকে বিভিন্ন অভিযোগেরও সম্মুখীন হতে হয়েছে। মৃত্যুর পূর্বেও তিনি ওসিয়ত করে এতিমকে কিছু টাকা দিতে বলে গিয়েছেন।
তার সাংসারিক জীবন ছিল খুবই কষ্টের। তার মেয়ে এক লেখাতে এভাবে লিখেছেন,
‘বাবা দ্বীনের প্রতি এতই অনুরাগী ছিলেন যে, সংসারের প্রতি বাবা ছিলেন উদাসীন। আমার মামা আমাদের সংসারটাকে কোনো রকম চালিয়ে নিতেন। অভাব অনটন ছিল নিত্য সঙ্গী। এই সংসারে মাকে কত কষ্ট, কত দুঃখ, কত যাতনা ভোগ করতে হয়েছে তার হিসেব নেই। কিন্তু এতকিছুর পরও বাবার প্রতি মায়ের অভিযোগ দেখিনি।
কত সময় যে উপোস ছিলাম তার হিসেব নেই। অনাহারে অর্ধাহারে জীবনের এতটুকু পথ পেরিয়ে এসেছি। তারপরও কখনো আমরা তিন ভাইবোন বাবা- মায়ের উপর অভিযোগ তুলিনি। কেন আমাদের এ বিচিত্র জীবন? বাবা তার নিজের সম্পদ এবং আমার মায়ের সম্পদ বিক্রি করেও দ্বীনের খেদমত করেছেন। সেজন্য মা কখনো আফসোস করেননি।’
মরহুম স্বয়ং তাঁর জীবন বৃত্তান্তের শেষে লেখেন,
‘আমার জীবনে মেহনতই মেহনত, সুখের মুখ দেখি নাই। ’
মৃত্যুর সময় তিনি এক ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে যান। স্ত্রী ২০০৪ সনে দীর্ঘ ৭বছর প্যারালাইসিসে ভুগে ইনতেকাল করেন। ১৯৭১ সনে তার প্রথম সন্তান আব্দুল্লাহর জন্মের সপ্তাহ খানেক পর তাঁকে ‘যুদ্ধাপরাধীর’ অপবাদ দিয়ে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁর বুকে গুলি করবে -এমন সময় তাঁকে শেষ ইচ্ছার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ৮ বছর পর একটা পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। তার চেহারা পর্যন্ত দেখিনি। আমার সন্তানটা এতীম হয়ে যাবে। মানুষ ও দেশের বিরুদ্ধে আমি কিছুই করিনি। আমাকে দেশের সেবা করার সুযোগ দিন। তখন তারা তাকে ছেড়ে দেয়।
কিছুদিন পূর্বে তাঁর একমাত্র ছেলের ফুসফুসে ক্যন্সার ধরা পড়ে। এতে তিনি খুব ভেঙ্গে পড়েন। ৪ ডিসেম্বর তার জন্য খতমে ইউনুস-এর এন্তেযাম করেন এবং ৭ ডিসেম্বর রাত সাড়ে বারোটায় ইহকাল ত্যাগ করেন। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পূর্বে ওসিয়ত নামা লেখেন। তাতে কয়েকজন আলেমকে নিজ আলমারী হতে কিছু হাদিয়া দিতে বলেন এবং একজন এতীমকে নিজের বেতনের সব টাকা দিতে বললেন। শেষে লেখেন ‘এটা বোধ হয় আমার শেষ লেখা, আমার অপরাধকে মাফ করবেন। কত ছাত্রকে মেরেছি গাল দিয়েছি খোদার ওয়াস্তে মাফ করবেন’ অতপর কে জানাযা পড়াবেন তার নাম লেখেন। নিজের নোটবুক খুলে ঘনিষ্ঠদের নিকট ফোন করে দুআ ও ক্ষমা চেয়েছেন। অতপর উপস্থিত সকলকে নিয়ে দুআ করে কালিমা পড়তে পড়তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তার জীবনের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত আরো অনেক দিক আছে যা বাস্তবেই ঈর্ষণীয় ও অনুসরণীয়। সময় ও স্থানের আয়তন চিন্তায় সেদিকে যাওয়া যাচ্ছে না। আল্লাহ আমাদেরকে সাদেকীন ও ছালেহীনের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমীন।
পাঠকদের নিকট তাঁর পরিবারিক শান্তি-স্বাচ্ছন্দ ও বিশেষভাবে অসুস্থ ছেলেটির জন্য দুআর অনুরোধ রইল।