ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকলেই সাম্প্রদায়িকতা!
মাসিক আলকাউসারের ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সংখ্যায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়ক আলোচনাটি উলামায়ে কেরাম, সাধারণ শিক্ষিত সমাজ ও সুধী পাঠকবর্গের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। তারা লেখাটিকে সময়-উপযোগী ও জরুরি বলে মনে করেছেন। কেউ কেউ কিছু বিষয়ে আরো ব্যাখ্যা করার অনুরোধ করেছেন। সে হিসেবে স্বল্প সময়ে মুহতারাম সম্পাদক মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব বিষয় সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রশ্ন নিয়ে কলম ধরেছেন। মূল বিষয়টি আরো বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। তবে প্রশ্ন দুটির উত্তরের জন্য এতটুকু আলোচনাই যথেষ্ট।-তত্ত্বাবধায়ক
প্রশ্ন : আলকাউসারের গত সংখ্যায় আপনার আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো স্থান নেই। এর আগে আমরা সাধারণ শিক্ষিতরা অনেকেই এ বিষয়ে বিভ্রান্তিতে ছিলাম। বিশেষত আমরা মনে করতাম ধর্মনিরপেক্ষতার দ্বারা সাম্প্রদায়িকতার পথ রুদ্ধ হয়, যা ইসলামে কাম্য। এ বিষয়ে যদি আরো কিছু কথা বলতেন।
উত্তর : সাম্প্রদায়িকতা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ আর তা প্রতিরোধ হবে ইসলামের মাধ্যমেই, ধর্মনিরপেক্ষতার দ্বারা নয়। বিষয়টি নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে থাকে মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার গলদ ব্যাখ্যাকারীরা ও ইসলামের শিক্ষায় অজ্ঞ লোকজন এবং যারা সাম্প্রদায়িকতার মতলবি ব্যাখ্যা করে থাকেন তারা।
সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে ইসলামের শিক্ষাগুলোর দিকে নজর দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। প্রথমেই দেখা যাক ইসলাম সাম্প্রদায়িকতাকে কীভাবে চিহ্নিত করেছে। একজন সাহাবী রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আসাবিয়্যাত’ (সাম্প্রদায়িকতা) কী? জবাবে তিনি ইরশাদ করলেন, অন্যায় কাজে স্বগোত্র-স্বজাতির পক্ষে দাঁড়ানো। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫০৭৮)
অর্থাৎ অন্যায় ও জুলুমের কাজে কাউকে শুধু এ জন্য সমর্থন করা যে, সে তার নিজ দল, গোত্র, জাতি ও ধর্মের লোক-এটিই সাম্প্রদায়িকতা। আপনি কুরআনুল কারীমের সূরা নিসার শুরু থেকে পড়ুন, দেখবেন ইসলাম মানবতার বন্ধনকে কীভাবে দৃঢ় করেছে। আল্লাহ তাআলা কীভাবে সকল মানুষকে একই পিতা-মাতার সন্তান ঘোষণা দিয়ে তাদেরকে পরস্পরের আপন বানিয়েছেন।
হযরত হুযাইফা রা. বর্ণনা করেন যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সকল জাতি যেন তাদের বাপ-দাদা তথা বংশ নিয়ে গর্ববোধ থেকে ফিরে আসে অন্যথায় তারা আল্লাহর কাছে নাপাকির পোকামাকড় থেকেও নিকৃষ্ট গণ্য হবে। (মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ২৯৩৮)
সুনানে আবু দাউদের অন্য বর্ণনায় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষকে আসাবিয়্যাত (সাম্প্রদায়িকতা)-এর দিকে আহবান করবে (অর্থাৎ অন্যায় কাজে নিজ দল, গোত্র, জাতিকে সাহায্য করতে বলবে) সে আমাদের (মুসলমানদের) দলভুক্ত নয়। যে এমন সাম্প্রদায়িকতার কারণে মৃত্যুবরণ করবে সেও আমাদের দলভুক্ত নয়। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫০৮০)
এ হাদীস এবং এ বিষয়ে আরো একাধিক সহীহ হাদীসের মর্ম এই যে, যে ব্যক্তি জাতীয়তা বা ভাষার ভিত্তিতে অন্যায় হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর সহযোগিতা করে এবং (কওমিয়্যত) দল, গোত্র, বংশের ভিত্তিতে অন্যকে সাহায্য করতে গিয়ে মারা যায় সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করল। যে উম্মতের বিরুদ্ধে অস্ত্র উঠিয়ে ভালোমন্দ সকলকে হত্যা করতে থাকে সে মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত নয়।
আর বিদায় হজ্বের বিখ্যাত ভাষণের কথা তো সকলেরই জানা। যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন, ভাষা, বর্ণ ও গোত্রের ভিত্তিতে কারো উপর কারো প্রাধান্য নেই। তিনি বলেছেন, কোনো আরব অনারবের উপর (শুধু ভাষার কারণে) প্রাধান্য পাবে না। কোনো সাদা (তার বর্ণের কারণে) কালোর উপর প্রাধান্য দাবি করতে পারবে না। প্রাধান্যের একমাত্র ভিত্তি হবে তাকওয়া।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৩৪৮৭
উপরোক্ত হাদীসগুলো এবং কুরআন-সুন্নাহর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আয়াত ও হাদীস-আসারগুলো অধ্যয়ন করলে যে কোনো বিবেকবান মানুষ সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাবে ইসলামের ব্যাখ্যায় সাম্প্রদায়িকতার আওতা কত বিস্তৃত এবং কত কঠোরভাবে ইসলাম এর নিন্দা ও বিরোধিতা করে। ইসলামপূর্ব জাহিলিয়াত-যুগে মানুষ বিভিন্ন গোত্রে তাদের জাতীয়তাকে বিভক্ত করে ফেলেছিল। শুধু জাত-গোষ্ঠির নামে কথায় কথায় যুদ্ধ হত। হত্যা-লুণ্ঠন হত। ধনাঢ্য লোকজন, নেতা-সর্দারগণ থাকত সকল বিচারের ঊর্ধ্বে। বিচারের সম্মুখীন হত কেবল সাধারণ অসহায় মানুষ। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুরু থেকেই এসবের মূলে আঘাত করেছেন।
কিন্তু আধুনিক ইউরোপ মানুষকে দেশ, বর্ণ, দল ও ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত করে প্রকারান্তরে পুনরায় জাহিলিয়াত-যুগেই নিয়ে গেছে। এখন দলের লোক, গোত্রের লোক, সম্প্রদায়ের লোক, নিজ পেশার বা গ্রুপের লোক কিংবা দেশের লোক যত অন্যায়ই করুক তার সম্প্রদায়ের লোকেরা তার পক্ষই অবলম্বন করবে। অন্য পক্ষ যতই মজলুম, অসহায়, নির্যাতিত হোক তার প্রতি সদয় হবে না ওরা। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, ছাত্রসংগঠনগুলো, বিভিন্ন পেশাজীবী সম্প্রদায় এবং তাদের কর্মকান্ড দেখলেই আপনার কাছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তাদের দলের সর্বোচ্চ ব্যক্তি যত বড় মিথ্যা বক্তব্যই দিক তারা সেটা প্রচার করতে থাকবে। তাদের দলের-গ্রুপের পরিচয়ে কোনো নেতাকর্মী যত অপকর্মই করুক তারা সেটিকে কোনো দোষই মনে করবে না এবং বেশি চাপে পড়ে গেলে তা অস্বীকার করে দিবে। এমনিভাবে তাদের কোনো লোক কোনো সংখ্যালঘুর উপর আক্রমণ করলে বা তার জানমালের ক্ষতি করলেও তারা আক্রমণকারীর পক্ষেই যাবে এবং তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে যদিও তারা ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম প্রবক্তা।
উপরের যে কয়টি উদাহরণ পেশ করা হল তার সবই ইসলামের দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িকতা এবং কঠোর নিন্দনীয় এবং ইহ ও পরকালীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ বর্তমান সময়ের প্রচারমাধ্যমগুলো এখন এগুলোকে সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে দেখতেই চায় না।
আর ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম সংখ্যালঘুদের জানমাল তো মুসলমানদের মতোই। বিশ্বজিৎ নামক যুবককে সরকারী দলের ছাত্ররা নির্মমভাবে হত্যার পর আলকাউসারে আমি সে সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনার কথা লিখেছিলাম। কোনো মুসলমানের জন্য যেমন তার দেশের আইন মেনে বসবাসকারী অমুসলিমের উপর কোনো ধরনের নির্যাতনের সুযোগ নেই তেমনি অন্য কোনো মুসলিমকে এমনটি করতে দেখলে সাধ্যানুযায়ী এ অন্যায় কাজ থেকে তাকে নিবৃত্ত রাখার চেষ্টা করাও তার দায়িত্ব। তা না করে উল্টো জালেমকে সমর্থন করলে সেটি হবে চরম সাম্প্রদায়িকতা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে বলার মতো অনেক কথাই আছে। আজ আমি শুধু এ কথা বলতে চাই এবং চ্যালেঞ্জ দিয়ে নিবেদন করতে চাই যে, কোনো দেশে ইসলামী বিধিবিধান চালু থাকলে সেখানে সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা শুধু নিষিদ্ধই থাকবে না; বরং কেউ এমন অপকর্মে লিপ্ত হলে সে শুধু আখিরাতেই পাকড়াও হবে না; বরং ইসলামী আইন দুনিয়াতেই তাকে কঠোরভাবে পাকড়াও করবে। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতা দমনের একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে ইসলামী আদর্শে জাতিকে গড়ে তোলা, কুরআন-সুন্নাহ তথা শরীয়াহ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা, সেক্যুলার রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো সাম্প্রদায়িকতা-মুক্ত মানব জাতি উপহার দিতে পারে না। বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের সময়ে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ (আক্রান্তদের অনেকেই বলেছে সরকারদলীয় লোকেরাই এতে জড়িত ছিল।) তারই প্রমাণ বহন করে।
এমনিভাবে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সহিংস কর্মকান্ড এবং তাদের দল ও মুরবিবগণ কর্তৃক অন্যায়কারী জালিমদের সহযোগিতা ও সমর্থন এই ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের সময়ে হতে পারার মানেই হল এ ধর্মহীন তথাকথিত নীতি সাম্প্রদায়িকতা দমনের জন্য যথেষ্ট নয়। শুধু আমাদের দেশেই নয় প্রতিবেশী দুটি দেশের রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক ঘটনা এবং পশ্চিমের দেশগুলোর স্কুল ও বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে অস্ত্রধারীদের গুলির ঘটনা ও আক্রমণকারীর বক্তব্যই আপনাকে জানান দিবে রাষ্ট্র সেক্যুলার নামধারী হলেও জাতি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত হয় না। সুতরাং সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তির জন্য চাই ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতা নয়।
প্রশ্ন : অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে মুসলমানরা ধর্মনিরপেক্ষতাকেই তাদের রক্ষাকবচ মনে করে থাকে। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
উত্তর : যেসব দেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেখানে তো তারা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী বিধিবিধান পালন করানোর সুযোগ পান না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলিম পরিচয় নিয়ে বসবাস করাও কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে কোটি কোটি মুসলমান বসবাস করার পরও সেখানকার মুসলিম সংখ্যালঘু রাজ্যগুলোতে মুসলমানদের মাঝে মাঝে যে করুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তা তো সকলেরই জানা। তাই মুসলিম সংখ্যালঘু রাষ্ট্রগুলোতে মুসলমানরা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে থাকে কৌশল হিসেবে। সেখানে যেহেতু কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক এমন একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা অসম্ভব, যাতে ইসলামী বিধিবিধান এবং ইসলামের দেওয়া সকল শ্রেণীর মানুষের অধিকারসহ সংখ্যালঘুদের অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হবে, তাই সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্রীয় নীতিই তাদের জন্য মন্দের ভালোর কাজ দেয়। এ সকল দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলার মানে এই নয় যে, তা শরীয়তসম্মত কোনো নীতি; বরং তা বলা হয়ে থাকে ঐ দেশের রাষ্ট্রীয় নীতিমালার আওতায়, যা ঐ এলাকার প্রেক্ষাপটে মুসলমানদের জন্য আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা, যেন তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন না করতে পারলেও কমপক্ষে নির্বিঘ্নে ইবাদত-বন্দেগী করতে পারে এবং তাদের পার্সনাল-লতে হস্তক্ষেপ না করা হয়। কিন্তু মুসলমানদের রাষ্ট্রে ইসলামী শিক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকলে সংখ্যালঘুরা এমনিতেই নিরাপদে থাকবে। সেখানে ইসলামী আইন
বাস্তবায়ন না করে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলার মানেই হল ইসলামী বিধিবিধানের বদলে ভিন্ন কিছু মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। যার নযীর আমরা তুরস্ক, মিসর, সিরিয়া প্রভৃতি দেশে দেখছি এবং আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতেও ইতিমধ্যে দেখা শুরু করেছি। ষ