মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন একই দিনে ঈদের বিষয় দায়িত্বশীলদের উপর ছাড়ুন-৮
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দূরবর্তী শহর বলতে কী বুঝায়?
আলহামদুলিল্লাহ, বিগত সংখ্যাগুলোয় আমরা সাহাবা-তাবিয়ীযুগের ফুকাহা, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, পরবর্তী ফুকাহা ও সমকালীন উলামা-মাশাইখের বক্তব্য পাঠ করেছি। আমরা দেখেছি যে, তাঁদের অনেক বড় এক জামাতের মাসলাক, দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অবশ্য-অনুসরণীয় নয়।
এখন দেখতে হবে যে, দূর দুরান্তের শহর বলতে কী বুঝায়? কোন্ শহরগুলোকে আমরা দূরবর্তী শহর বলব?
দলিল-প্রমাণ দ্বারা এটুকু তো প্রমাণিত যে, এখানে নিকট ও দূরের বিধান এক নয়, কিন্তু কোনো স্পষ্ট নসে যেহেতু দূরবর্তী এলাকার সুনির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখিত হয়নি তাই এখানে শরীয়তের সাধারণ নির্দেশনা অনুসারে উম্মাহর ফকীহগণ এ মাসআলাকে শরীয়তের নীতিমালার আলোকে ইজতিহাদের দ্বারা সমাধান করেছেন। আর স্বভাবতই এতে তাঁদের মধ্যে মতভেদ হয়েছে :
১. হানাফী ফকীহগণের ‘ইবারত-উদ্ধৃতি আমরা যুলহিজ্জাহ ১৪৩৪ হি. ও মুহাররামুল হারাম ১৪৩৫ হি.-এর দুই সংখ্যায় পাঠ করেছি। আমরা দেখেছি, ইমাম কুদূরী রাহ. এবং তাঁর উস্তায আবু আবদুল্লাহ আল জুরজানী রাহ. থেকে নিয়ে ছাহেবে হিদায়া এবং তাঁর উস্তাযগণসহ আগের পরের হানাফী ফকীহগণের বড় এক জামাত নাদির রেওয়ায়েতের ঐ মাসআলাটির ব্যাখ্যা করেছেন। যাতে বলা হয়েছে, কোনো শহরবাসী যদি চাঁদ দেখে উনত্রিশটি রোযা রেখে ঈদ করে; পরে তাদের কাছে প্রমাণিত হয় যে অপর কোনো শহরবাসী চাঁদ দেখেই ত্রিশটি রোযা রেখেছে। তাহলে যারা উনত্রিশ রোযা রেখেছে তাদেরকে একটি রোযা কাযা করতে হবে। ঐসকল ফকীহ এই মাসআলার ব্যাখ্যায় বলেছেন, এই হুকুম তখন; যখন উভয় শহর কাছাকাছি হবে এবং তাদের উদয়স্থল অভিন্ন হবে। আর যদি উভয় শহরের মাঝে এই পরিমাণ দূরত্ব হয় যে সেগুলোর উদয়স্থল ভিন্ন, তাহলে এ বিধান নয়। কারণ এই ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অবশ্য-অনুসরণীয় নয়। তাদের ঐসকল বক্তব্যের সারকথা এই যে, তাদের নিকট এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলে ধর্তব্য না হওয়ার ভিত্তি হলো ঐ অঞ্চলগুলোর উদয়স্থল ভিন্ন হওয়া।
ফিকহে শাফেয়ীতে ইরাকী ফকীহগণের অধিকাংশের মাসলাকও এ-ই। ইমাম ইবনুস সাববাগ (আবু নসর আবদুস সাইয়েদ ইবনে মুহাম্মাদ (জন্ম : ৪০০ হি.-মৃত্যু : ৪৭৭ হি.) ইরাকী ‘তরীকা’র শায়খ আবু হামেদ আসফারাইনী (৩৪৪-৪০৬ হি.)-এর বরাতে নকল করেছেন-
إن كانا بلدين لا تختلف المطالع لأجلهما، كبغداد والبصرة، لزمهم برؤية بعضهم، وإن كانا بلدين تختلف المطالع فيهما، كالعراق والحجاز، والشام وخراسان، وما أشبه ذلك، لم يلزم أحدهما برؤية الآخر. (قال صاحب البيان : وحكاه ـ يعني ابن الصباغ ـ عن الشيخ أبي حامد).
এ উদ্ধৃতির মর্মার্থ হল, যে দুই শহরের উদয়স্থল আলাদা হয় না যেমন বাগদাদ ও বসরা, এক্ষেত্রে এক জায়গায় চাঁদ দেখা গেলে অন্য জায়গায় রোযা লাযিম হবে। পক্ষান্তরে দুই শহরের উদয়স্থল আলাদা হলে, যেমন ইরাক ও হিজায বা শাম ও খোরাসান, এক অঞ্চলের চাঁদের দ্বারা অন্য অঞ্চলে রোযা লাযিম হবে না।
ইবনুস সাববাগ থেকে এ ইবারত ইমাম আবুল হুসাইন ইয়াহইয়া ইবনে আবুল খায়ের আলইমরানী আশশাফেয়ী (৪৮৯-৫৫৮ হি.) ‘আলবায়ান’’ খন্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ৪৮০-এ বর্ণনা করেছেন।
ইমাম নববী রাহ. ‘‘শারহুল মুহাযযাব’’ কিতাবে লিখেছেন-
أصحها : وبه قطع جمهور العراقيين والصيدلاني وغيرهم، أن التباعد يختلف باختلاف المطالع.
অর্থাৎ অধিক বিশুদ্ধ ‘ওয়াজহ’ এই যে, দূরবর্তী হওয়ার সিদ্ধান্ত উদয়স্থলের ভিন্নতার বিচারে হবে। ইরাকী ফকীহগণের অধিকাংশ এবং সয়দলানী ও অন্যরা দ্ব্যর্থহীনভাবে এ কথাই বলেছেন। (আলমাজমূ ৭/৪২৭)
‘সয়দালানী’ বলে আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে দাউদ সয়দালানীকে নির্দেশ করা হয়েছে। যিনি আবু বকর আদদাউদী নামেও প্রসিদ্ধ। ইনি খোরাসানী ‘তরীকা’র শায়খ কাফফাল মারওয়াযীর শাগরিদ। ‘‘মুখতাসারুল মুযানী’’র উপর তাঁর ভাষ্যগ্রন্থ ‘‘আততরীকাতুস সয়দালানিয়্যাহ’’ নামে প্রসিদ্ধ। তাজুদ্দীন আসসুবকীর ‘‘তবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা’’য় (খন্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ১৪৮-১৮৯; এবং খন্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ৩৬৪) তাঁর ‘তরজমা’ (পরিচিতিমূলক আলোচনা) রয়েছে।
দুই অঞ্চলের মাঝে পার্থক্যের এ মাপকাঠির উপর ইনশাআল্লাহ আরো কিছু আলোচনার ইচ্ছা আছে। এর আগে দ্বিতীয় মতটি উল্লেখ করছি।
২. দূরবর্তী শহর-নগরের সংজ্ঞায় শাফেয়ী ফকীহগণের দ্বিতীয় মাসলাক এই যে, চাঁদের শহর (যে শহরে চাঁদ দেখা গেছে) থেকে যে শহর কসরের দূরত্বে অবস্থিত, একে দূরবর্তী ধরা হবে আর যা এর চেয়ে কম দূরত্বে অবস্থিত তাকে ‘নিকটের’ বলা হবে।
খোরাসানী ‘তরীকা’র শায়খ কাফফাল মারওয়াযী (৩২৭-৪১৭ হি.)-এর শাগরিদ আবুল কাসেম আলফূরানী (৪৬১হি.), ইমামুল হারামাইন আবদুল মালিক ইবনুল জুয়াইনী (৪১৯-৪৭৮ হি.), তাঁর শাগরিদ ইমাম গাযালী (৫০৫ হি.) ও মুহিউস সুন্নাহ বগভী (৫১৬ হি.)সহ অনেক খোরাসানী ফকীহ এ মাসলাকেরই প্রবক্তা।
ভারতবর্ষের বড় আলিমগণের মাঝে হযরত শাহ ওলিউলাহ রাহ. ‘‘আলমুসাফফা শরহুল মুয়াত্তা’’য় (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ২৩৭) এ মাসলাকই সমর্থন করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর ফার্সী ইবারত মুহাররম ১৪৩৫ হি. সংখ্যায় আমরা দেখেছি। তাতে তিনি আপন ইজতিহাদ অনুযায়ী এ মাসলাকের ব্যাখ্যা পেশ করারও চেষ্টা করেছেন। আহলে ইলম পাঠক তাঁর ঐ ইবারত আবার দেখে নিতে পারেন।
উল্লেখ্য, ফিকহে শাফেয়ীতে কসরের দূরত্ব বর্তমান পরিভাষা অনুসারে ৮৯.৪০০ কিলোমিটার।
সহীহ মুসলিম এর ভাষ্যগ্রন্থে (খন্ড : ৭, পৃষ্ঠা : ১৯৭) باب بيان أن لكل بلد رؤيتهم শিরোনামের আলোচনায় ইমাম নববী রাহ. যদিও এ মাসলাককে প্রাধান্য দিয়েছেন অর্থাৎ কসরের দূরত্বকে মানদন্ড সাব্যস্ত করেছেন, কিন্তু ‘শরহুল মুহাযযাব’ গ্রন্থে- যেমনটা আমরা দেখেছি-প্রথম মাসলাককে ‘আসাহ’ (অধিক শুদ্ধ) বলেছেন তেমনি ‘‘আলমিনহাজে’’ও; বরং শরহুল মুহাযযাবে দ্বিতীয় মাসলাককে স্পষ্ট ভাষায় ‘জয়ীফ’ও বলেছেন। তিনি লেখেন-
وهذا ضعيف، لأن أمر الهلال لا تعلق له بمسافة القصر، فالصحيح اعتبار المطالع كما سبق.
অর্থাৎ কসরের দূরত্বকে মাপকাঠি বানানো দুর্বল। কারণ কসরের দূরত্বের সাথে চাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে সঠিক হচ্ছে উদয়স্থলের ভিন্নতাকে মাপকাঠি বানানো। (আলমাজমূ খন্ড : ৭, পৃষ্ঠা : ৪২৮)
উদয়স্থলের অভিন্নতা ও ভিন্নতার অর্থ কী?
দুই এলাকার উদয়স্থল এক বা আলাদা হওয়ার এক অর্থ তো এই যে, জ্যোতির্বিদ্যার হিসাবের ভিত্তিতে নির্ণয় করা হবে যে, কোন কোন এলাকা নতুন চাঁদ দর্শনযোগ্য হওয়ার আওতার মধ্যে আর কোন কোন অঞ্চল এর বাইরে। ভিতরের অঞ্চলগুলোর মধ্যে কোন অঞ্চল থেকে চাঁদ খুব সহজেই দৃষ্টিগোচর হতে পারে আর কোন অঞ্চল থেকে চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়া সহজ নয়, বরং শুধু প্রখর দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন এবং চাঁদের অবস্থান সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত ও চাঁদ দেখার বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিই দেখতে পারে। তেমনি কোথা থেকে খোলা চোখে চাঁদ দেখা যাবে আর কোথা থেকে শুধু টেলিস্কোপের মাধ্যমে দেখা যাবে। তো যে যে অঞ্চল নতুন চাঁদ দর্শনযোগ্য হওয়ার আওতাভূক্ত হবে সেগুলোর উদয়স্থল এক, আর যেগুলো এর আওতার বাইরে; সেগুলোর উদয়স্থল ভিন্ন। এ আওতার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত হাজার হাজার মাইলের ব্যবধান থাকতে পারে। আবার আওতার শেষ প্রান্তের সাথে মিলিত পরবর্তী জায়গাটি নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও আওতার বাইরে হওয়ার কারণে তার উদয়স্থল ভিন্ন। এভাবে সূক্ষ্ম ও সুনির্দিষ্টভাবে দুই অঞ্চলের মাঝে এ ফয়সালা করা যে, এদের উদয়স্থল এক নাকি আলাদা। সেজন্যে জ্যোতির্বিদ্যায় যথেষ্ট পারদর্শিতার প্রয়োজন। বিশেষ করে এজন্য যে, নতুন চাঁদের বয়স অবস্থা অবস্থান ও অন্যান্য কারণে পৃথিবী থেকে তার দর্শনযোগ্য হওয়ার আওতা পরিবর্তন হতে থাকে। যে অঞ্চলগুলো কোনো এক মাসে অভিন্ন উদয়স্থলে ছিল তা সব মাসেই অভিন্ন উদয়স্থলে থাকবে তা অপরিহার্য নয়; বরং এ খুবই সম্ভব, আর তা ঘটতেও থাকে যে, ঐ সকল অঞ্চলের কোনো কোনোটা কোনো কোনো মাসে আওতার বাইরে থেকে যাবে।
একথাগুলো এমনি তো জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা যাদের আছে তাদের কাছে স্পষ্ট। এরপরও জ্যোতির্বিদ্যার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেগুলো চাঁদের জন্ম ও ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তা দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্য সময় নির্দেশ করে থাকে তাদের সাইটসমূহ দেখলেও এসব বিষয় আরো স্পষ্ট হয়ে যায়, যেগুলোতে বিগত অনেক বছর ও ভবিষ্যতেরও বিবরণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ দেখুন :
1. http://moonsighting.com
2. http://www.icoproject.org
3. http://www.hilalsighting.org
4.http://drive.google.com/folderview?id=0B8RzOGVdiUMBSXR4eWtnZWdxN3M&usp=sharing
তালিবুল ইলম ভাইয়েরা ‘ইখতিলাফে মাতালি’র এই শাস্ত্রীয় বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝার জন্য মুতালাআ করতে পারেন উস্তাযে মুহতারাম হযরত শাইখুল ইসলাম তকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম-এর সহীহ বুখারীর দরসে তাকরীরের সংকলন ‘ইনআমুল বারী’ খন্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ৪৯২-৪৯৪
এমনিভাবে হযরতের কিতাব ‘বুহুস ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআছিরাহ’ খন্ড:২, পৃষ্ঠা:২৫৩-২৫৫
যাহোক, বিভিন্ন অঞ্চলের উদয়স্থল এক বা আলাদা হওয়ার এক অর্থ তো এই দাঁড়াল যে, জ্যোতির্বিদ্যার হিসাব অনুসারে এক বা আলাদা হওয়া। দ্বিতীয় অর্থ এই যে, সাধারণ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দুই শহরকে এক উদয়স্থলের বা আলাদা উদয়স্থলের মনে করা। এ হিসাবে এমন প্রত্যেক অঞ্চলকে এক উদয়স্থলের গণ্য করা হবে, যেগুলো পরস্পর কাছাকাছি এবং সেগুলোতে চাঁদের তারিখও এক থাকে। আর যেখানে সাধারণত এমন হয় যে, চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার ক্ষেত্রে এক এলাকা অন্য এলাকা থেকে আগে বা পিছে থাকে এবং সেসকল অঞ্চলের লোকেরা নিজেদের চাঁদ দেখার ভিত্তিতে আমল করলে দেখা যায় তাদের চান্দ্র তারিখে একদিনের পার্থক্য থাকে, তাহলে সেগুলোকে আলাদা উদয়স্থলের ধরা হবে।
نبه على أصل هذه النكتة في "تحفة الألمعي شرح سنن الترمذي" ج ٣ ص٦٥ وستعرف مأخذه من الفقه و الدليل إن شاء الله
উদয়স্থলের ভিন্নতা-অভিন্নতার এই সরল মাপকাঠি যা কোনো অংক বা যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই ব্যবহারযোগ্য। এর আলোকে পরস্পর কাছাকাছি শহরগুলোকে অভিন্ন উদয়স্থলের মনে করা হয়, যদিও জ্যোতির্বিদ্যার হিসাব অনুসারে এগুলোর কোনোটি নতুন চাঁদ দর্শনের আওতার বাইরে থাকে। তদ্রূপ কোনো বড় শহর যদি এমন হয় যে, ঘটনাচক্রে কোনো মাসে তার কোনো অংশ ঐ আওতার বাইরে থেকে যায় তাহলে জ্যোতির্বিদ্যার হিসাব অনুসারে ঐ অংশের উদয়স্থল আলাদা হলেও সাধারণ পরিভাষায় গোটা শহরের উদয়স্থল অভিন্ন বলা হবে। অতএব উদয়স্থলের ভিন্নতা-অভিন্নতার দ্বিতীয় অর্থ এই হল যে, সাধারণ ধারণা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে দুই অঞ্চলের উদয়স্থল এক বা আলাদা হওয়া।
এখন দেখার বিষয় এই যে, হানাফী ও শাফেয়ী ফকীহগণের যারা কাছের শহর ও দূরের শহরের মাঝে পার্থক্য করেছেন উদয়স্থলের ভিন্নতা বা অভিন্নতার ভিত্তিতে তারা উদয়স্থল বিভিন্ন হওয়ার কী অর্থ গ্রহণ করেছেন-জ্যোতির্বিদ্যার হিসাব ভিত্তিক ভিন্নতা না সাধারণ ধারণা ও অভিজ্ঞতার ভিন্নতা। তাকীউদ্দীন সুবকী রাহ., ইবনে হাজার মক্কী রাহ. এবং সমকালীন দু একজন আলিমের কথা থেকে যদিও অনুমিত হয় যে, তাঁরা উদয়স্থলের ভিন্নতা-অভিন্নতার জ্যোতির্শাস্ত্রীয় অর্থ বুঝেছেন। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহর বক্তব্য ও তার পূর্বাপর মনোযোগ সহকারে পড়লে জানা যায় যে তারা এ অর্থ নয় বরং দ্বিতীয় অর্থ হিসাবে এ শব্দ ব্যবহার করেছেন। জ্যোতির্শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে উদয়স্থলের যে ভিন্নতা-অভিন্নতা সেটা তাদের উদ্দেশ্য নয়।
এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে যদি নীচের বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করা যায় :
১. প্রথম কথা এই যে, কোনো কোনো ফকীহ তো একদম পরিষ্কার ভাষায় উদয়স্থলের ভিন্নতার এ সাধারণ অর্থই বর্ণনা করেছেন যেমন আল্লামা জামালুদ্দীন ইউসুফ ইবনে ইবরাহীম আরদাবীলী শাফেয়ী রাহ. (৭৭৯ হি.আনুমানিক) লেখেন-
وإذا رؤي الهلال في بلدة ولم ير في أخرى فإن تقاربا فحكمهما واحد، وإن تباعدا فلا، والضبط بمسافة القصر، وقيل باختلاف المطالع، وهو أن يتباعد البلدان بحيث لو رؤي في أحدهما لم ير في الآخر غالبا.
এখানে তিনি পরিষ্কার বলেছেন, উদয়স্থল আলাদা হওয়ার অর্থ, দুই শহর পরস্পর এত দূরের হওয়া যে, এক শহরে নতুন চাঁদ দেখা গেলে দ্বিতীয় শহরে সাধারণত দেখা যায় না। (দেখুন : আল্লামা আরদাবীলীর কিতাব ‘‘আলআনওয়ার লি আমালিল আবরার’’ খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৩০৬, দারুযযিয়া, কুয়েত ১৪২৭ হি.)
এ শুধু আরদাবীলীর কথা নয়, এর কাছাকাছি কথা তার অনেক আগে লিখেছেন আবুল ফারাজ আবদুর রহমান ইবনে আহমদ আসসারাখসী (৪৯৪ হি.), যিনি আবুল ফারাজ আযযায নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। এই সারাখসী ছিলেন ফিকহে শাফেয়ীর হাফিয।
শাফেয়ী মাযহাবের শীর্ষস্থানীয় ইমামদের মধ্যে তিনি গণ্য। সামআনী রাহ. লিখেছেন যে, তাঁর ‘আমালী’ খুবই সমাদৃত (মুতালাক্কা বিল কবুল) গ্রন্থ। (তবাকাতুশ শাফিয়িয়্যাতিল কুবরা, তাজুদ্দীন সুবকী খন্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ১০১-১০৪; তাহযীবুল আসমা, নববী খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৭৬৬; সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী খন্ড : ১৪, পৃষ্ঠা : ২০৫)
ইমাম নববী রাহ. ‘‘শরহুল মুহাযযাব’’ গ্রন্থে তার প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কখনো শুধু ‘‘আসসারাখসী’’ বলে, কখনো তাঁর কিতাব ‘‘আলআমালী’’র উল্লেখ সহকারে। উদয়স্থলের ভিন্নতা প্রসঙ্গে নববী রাহ. তাঁর বরাতে লিখেছেন-
"قال السرخسي : إذا رآه أهل ناحية دون ناحية، فإن قربت المسافة لزمهم كلهم.
وضابط القرب أن يكون الغالب أنه إذا أبصره هؤلاء لا يخفى عليهم إلا لعارض، سواء في ذلك مسافة القصر أو غيرها.
قال : فإن بعدت المسافة فثلاثة أوجه :
أحدها : يلزم الجميع، واختاره أبو علي السِّنْجِيْ.
والثاني : لا يلزمهم
والثالث : إن كانت المسافة بينهما بحيث لا يتصور أن يرى ويخفى على أولئك بلا عارض، لزمهم، وإن كانت بحيث يتصور أن يخفى عليهم فلا".
(আলমাজমূ খন্ড : ৭, পৃষ্ঠা : ৪২৮-৪২৯)
এ বর্ণনায় আবুল ফারাজ সারাখসী রাহ. কাছের শহরের মাপকাঠি বর্ণনা করে বলেছেন, যেখানে দূরত্ব এ পরিমাণ হয় যে, এক জায়গায় চাঁদ দেখা গেলে সাধারণত অন্য জায়গায়ও দেখা যায় তা কাছের। আর যেখানে দূরত্ব এ পরিমাণ যে, এক জায়গায় চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার দ্বারা অন্য জায়গায় দৃষ্টিগোচর হওয়া জরুরি নয়; বরং চাঁদ ঐ শহরের অধিবাসীদের দৃষ্টির আড়ালে থাকার সম্ভাবনা আছে, তা দূরের শহর গণ্য করা হবে।
২. শায়খ আবু হামেদ আসফারাইনী ও ইবনুস সাববাগসহ অনেক ফকীহ অভিন্ন উদয়স্থলের ও আলাদা উদয়স্থলের শহর-নগরের কিছু উদাহরণও উল্লেখ করেছেন। যেমন তাঁরা কূফা ও বাগদাদ বা বসরা ও বাগদাদকে এক উদয়স্থলের আর হিজায ও ইরাক এবং শাম ও খোরাসানকে আলাদা উদয়স্থলের ধরেছেন। তাঁদের চিন্তায় যদি উদয়স্থলের জ্যোতির্বিদ্যার হিসাবভিত্তিক অভিন্নতা ও ভিন্নতা থাকত তাহলে প্রথমত সুনির্দিষ্টভাবে সবসময়ের জন্য কিছু অঞ্চলকে এক উদয়স্থলের আর কিছু অঞ্চলকে আলাদা উদয়স্থলের সাব্যস্ত করতেন না। দ্বিতীয়ত ইরাক ও হিজায এবং শাম ও খোরাসানকে তারা পরস্পর ভিন্ন উদয়স্থলের হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। অথচ জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকে দেখা যায় প্রায় সময় এগুলোর উদয়স্থল একই থাকে। কোনো মাসে হয়তো উভয় শহর থেকেই চাঁদ দেখা সম্ভব নয়। আবার কোনো মাসে উভয় শহর থেকেই দেখা সম্ভব। কখনো ব্যতিক্রমও হয়। পিছনে যে লিংকগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলোতে পরিবেশিত বিভিন্ন মাসের চাঁদ দেখার নকশাগুলো দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।
তাহলে জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবের দিক থেকে যখন এই শহরগুলো সাধারণত একই উদয়স্থলের হয়ে থাকে ফকীহগণ এগুলোকে ভিন্ন উদয়স্থলের বললেন কীভাবে? বুঝা গেলো, উদয়স্থলের ভিন্নতা বলতে তারা শাস্ত্রীয় ভিন্নতা বুঝান না।
এই ধারণা ঠিক নয় যে, আগের যুগের আলিমগণ জ্যোতির্শাস্ত্রীয় ভিন্নতা-অভিন্নতা সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন। তাই তাঁরা এসব উদাহরণ দিয়েছেন। এ ধারণা এজন্য ঠিক নয় যে, আমাদের পূর্ববর্তী ফকীহগণ ‘ইলমে হাইয়াত’ ও ‘ফালাকিয়াত’ (প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা) সম্বন্ধে মোটেও বেখবর ছিলেন না। কারো কারো নিশ্চয়ই এ শাস্ত্র জানা ছিল না, কিন্তু অনেকেই ছিলেন ফালাকিয়াত-এর আলিম।
ইমাম গাযালীর উস্তায ইমামুল হারামাইন আবদুল মালিক ইবনুল জুয়াইনী (৪১৯-৪৭৮ হি.) ‘‘নিহায়াতুল মাতলাব’’ গ্রন্থে পরিষ্কার লিখেছেন যে, ‘‘সফরের দূরত্বের কম দূরত্বেও উদয়স্থল আলাদা হতে পারে এবং উদয়স্থলের প্রকৃত ভিন্নতা সম্পর্কে অবগতি খুবই সূক্ষ্ম বিষয়, যা শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞরাই বুঝতে পারে। বলাবাহুল্য, এ জাতীয় বিষয়ের উপর শরীয়তের বিধান নির্ভরশীল হয় না। এ কারণে নিকট ও দূরের পার্থক্যের ক্ষেত্রে (শাস্ত্রীয়) ভিন্নতা মানদন্ড হতে পারে না। আর কেউ একে মানদন্ড বলেনওনি’’।
তাঁর আরবী বক্তব্য এই-
وذكر الأصحاب : أن البعد الذي ذكرناه هو مسافة القصر، ولو اعتبر مسافة يظهر في مثلها تفاوت المناظر في الاستهلال لكان متجها في المعنى، ولكن لا قائل به. (১)
فإن درك هذا يتعلق بالأرصاد والنموذارات الخفية، وقد تختلف المناظر في المسافة القاصرة عن مسافة القصر، للارتفاع والانخفاض، والشرع لم يُبنَ على التزام أمثال هذا، ولا ضبط عندنا وراء مسافة القصر للبعد. (نهاية المطلب في دراية المذهب ج ٤ ص ١٧)
তো জানা গেল যে, অতীতের ফকীহগণ উদয়স্থলের জ্যোতির্শাস্ত্রীয় ভিন্নতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। এরপর তাদের আলোচনা ও উদাহরণ যখন এর সাথে মেলে না তখন কি প্রমাণ হয় না যে, তাদের উদ্দেশ্য সাধারণ অভিজ্ঞতার ভিন্নতা?
৩. হানাফী ফকীহগণের আলোচনাতেও বেশ স্পষ্টভাবেই বলা আছে যে, তাদের উদ্দেশ্য উদয়স্থলের জ্যোতির্শাস্ত্রীয় ভিন্নতা নয়।
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আবদুর রশীদ আলকিরমানী (৫৬৫ হি.) ‘‘জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া’’য় যখন এ মাসআলা উল্লেখ করেন যে, ৩০ ওয়ালাদের চাঁদ দেখার ইতিবার করে ২৯ ওয়ালাদেরকে যে এক রোযা কাযা করার কথা বলা হয়েছে এটা ঐ সময় যখন উভয় অঞ্চলের উদয়স্থল এক হবে। উদয়স্থল আলাদা হলে একের বিধান অন্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
এ মাসআলা উল্লেখ করার পরই তিনি তাঁর উস্তায ইমাম জামালুদ্দীন ইয়াযদী থেকে একটি নোট নকল করেছেন-
قال شيخنا وسيدنا جمال الدين : لم يذكروا في ذلك حدا، بل أطلقوا، وأنا أقول : يجوز أن يعتبر فيه ما يعتبر في الغيبة المنقطعة في حق الولي.
قلت له : تحديدك في الغيبة المنقطعة لا يوجب زيادة في البيان، فإنهم اختلفوا فيها.
قال : ما لا يصل القوافل في السنة غالبا إلا مرة، وأقله مسيرة شهر، ألا يرى إلى قصة سليمان بن داود : "ولسليمان الريح غدوها شهر ورواحها شهر".
وكان انتقاله من إقليم إلى إقليم، وقدره بشهر، فعرف أن بين الإقليمين لا يكون أقل من شهر. ولا يمكن الاعتماد على ما يقول المنجمة من زيادة الدرجة في العرض والطول، فلا يعتبر.
ইমাম জামালুদ্দীন ইয়াযদী হানাফী রাহ. এখানে পরিষ্কার বলেছেন যে, উদয়স্থল এক বা আলাদা হওয়ার ক্ষেত্রে (শরয়ী হুকুমের জন্য) অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ এর হিসাব গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, তাহলে উদয়স্থলের অভিন্নতা বা ভিন্নতার মাপকাঠি কী? তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের ফকীহগণ বিশেষ কোনো সীমারেখা উল্লেখ করেননি। তবে তার মতে কিছু আলামতের ভিত্তিতে বলা যায় যে, এক মাসের দূরত্ব হলে তা আলাদা উদয়স্থলের শহর। (দ্রষ্টব্য : ‘‘জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া’’ (মাখতূতাত) কিতাবুস সওম, আলবাবুছ ছানী।)
তিনি উদয়স্থলের ভিন্নতার যে সীমা উল্লেখ করেছেন তা স্পষ্টতঃ একটি আনুমানিক সীমা। তবে তাঁর বর্ণনা থেকে দু’টো বিষয় স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে :
ক. যে হানাফী ফকীহগণ ভিন্নতাকে মাপকাঠি সাব্যস্ত করেছেন তাঁদের উদ্দেশ্য জোতির্বিদ্যার হিসাবভিত্তিক সূক্ষ্ম ও সুনির্দিষ্ট ভিন্নতা নয়। এ কারণে পরের ফকীহগণকে এর কোনো আনুমানিক মাপকাঠি খুঁজতে হয়েছে।
খ. আলোচনার শেষের দিকে ইমাম জামালুদ্দীন ইয়াযদী রাহ. পরিষ্কার বলেছেন যে, ফিকহ শাস্ত্রের পরিভাষায় উদয়স্থলের যে ভিন্নতা তা জ্যোতির্শাস্ত্রীয় ভিন্নতা নয়। ইমাম রুকনুদ্দীন আলকিরমানী তা বর্ণনা করে মৌনতা অবলম্বন করেছেন।(২)
তো আমাদের ফকীহগণের কাছেও উদয়স্থলের ভিন্নতা অর্থ জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবভিত্তিক ভিন্নতা নয়; বরং সাধারণ অভিজ্ঞতাভিত্তিক ভিন্নতাই উদ্দেশ্য, যার আনুমানিক পরিমাণ ঐ যুগের বিচারে বিভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করা হয়েছে।
৪. সবচেয়ে বড় কথা এই যে, চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার বিষয়ে শরীয়ত গোড়া থেকেই জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবকে মানদন্ড বানায়নি; বরং উম্মতের সহজতার জন্য চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার জন্য এমন মানদন্ড নির্ধারণ করেছে, যা সবযুগে সব অঞ্চলে সহজে অনুসরণযোগ্য। আর তা হচ্ছে চাঁদ দেখা বা চাঁদ দেখার সাক্ষ্য। আর কোনো কারণে চাঁদ না দেখা গেলে ৩০ দিন পূর্ণ করার আদেশ দিয়েছে। অনেক সহীহ হাদীস দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত এবং খাইরুল কুরূন (সাহাবা-যুগ, তাবিয়ীন-যুগ ও তাবে-তাবিয়ীন যুগ)-এর উলামা-ফুকাহার এ বিষয়ে ইজমাও রয়েছে যে, চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার বিষয়ে জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাব ধর্তব্য নয়। যদিও খাইরুল কুরূন অতিবাহিত হওয়ার পর দু-চারজন আলিম বিশেষ অবস্থায় বিশেষ শর্ত-শারায়েতের সাথে জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবের দিক থেকে চাঁদ দর্শনযোগ্য হওয়াকেও যথেষ্ট মনে করেছেন, কিন্তু তাদের এ মতভিন্নতা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও অগ্রহণযোগ্য মতভিন্নতা। সহীহ হাদীসসমূহের স্পষ্ট বক্তব্য ও খাইরুল কুরূনের ইজমার বিপরীতে এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই।
তো যখন চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার বিষয়ে গোড়া থেকেই জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবকে মানদন্ড বানানো হয়নি তখন নিকট ও দূরের পার্থক্যের ক্ষেত্রে জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবভিত্তিক নির্ধারিত ‘ইখতিলাফে মাতালি’ (উদয়স্থলের বিভিন্নতা)কে কীভাবে মানদন্ড বানানো যায়?
কোনো অঞ্চলের চাঁদ দেখা ঐ অঞ্চল থেকে দূর-দূরান্তের শহর-নগরে অবশ্য-অনুসরণীয় হবে কি না-এ বিষয়ে মতভিন্নতা খাইরুল কুরূন থেকে চলে আসছে এবং প্রত্যেক অঞ্চল ও প্রত্যেক মাযহাবে তা স্বীকারকারী ও অস্বীকারকারী ফকীহবৃন্দ আগেও ছিলেন, এখনো আছেন। তো এ বিষয়ে যদি জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবের বিচারেই নিকট দূরের পার্থক্য করার হুকুম হত তাহলে খাইরুল কুরূন থেকেই এর উপর আমল থাকত এবং বিচারকদেরকে, যারা চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার ফয়সালা কার্যকর করেন, এ বিষয়ে জ্যোতির্শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়ার আদেশ করা হত। অথচ আমাদের জানা মতে উম্মাহর ইতিহাস ও হাজার বছরের কর্ম-ধারায় এর কোনো প্রমাণ নেই।
মোটকথা, বিভিন্ন দিক থেকে পরিষ্কার যে, ফকীহগণের যে বড় জামাত, উদয়স্থলের ভিন্নতাকে মানদন্ড বানিয়েছেন, এর দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য সাধারণ অভিজ্ঞতার ভিন্নতা। জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবভিত্তিক সূক্ষ্ম ভিন্নতা নয়।(৩)
এটা এজন্যও উদ্দেশ্য না হওয়া উচিত যে, জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবে উদয়স্থলের অভিন্নতার ভিত্তি চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাবনাকে বানানো হয় এবং যত অঞ্চলে চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাবনা আছে গোটা অঞ্চলকে অভিন্ন উদয়স্থলের গণ্য করা হয়। অথচ দৃষ্টিগোচর হওয়ার ‘সম্ভাবনা’ দৃষ্টিগোচর হওয়াকে অনিবার্য করে না। আর বলাই বাহুল্য, ফিকহী হুকুমের সম্পর্ক চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সাথে, দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাবনার সাথে নয়।
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
নিকট ও দূরের পার্থক্যের বিষয়ে কাউকে কাউকে এ আপত্তি করতে শোনা যায় যে, নিকট ও দূরের মাঝে পার্থক্য করার কোনো মানদন্ড যখন কোনো স্পষ্ট আয়াত বা স্পষ্ট হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয় এবং ইজতিহাদের ভিত্তিতে ফকীহগণ যে মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন তাতেও তাঁদের মধ্যে মতভেদ হয়েছে এ থেকে বোঝা যায়, বাস্তবে নিকট ও দূরের মাঝে কোনো পার্থক্যই নেই। যে কোনো জায়গায় চাঁদ দেখা গেলেই তা সব জায়গার জন্য অবশ্য-অনুসরণীয় হবে। নিকট ও দূরের বিধান যদি বাস্তবেই আলাদা হত তাহলে এর কোনো মানদন্ড শরীয়তের স্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হত।
প্রশ্নটি অমূলক। কারণ শরয়ী দলিল দ্বারা প্রমাণিত কোনো বিষয়কে শুধু এজন্য অস্বীকার করা যে, এর বিস্তারিত বিবরণ স্পষ্ট নসে উল্লেখ নেই, সঠিক নয়। এর দ্বারা একদিকে যেমন শরয়ী দলিলকে রদ করা হয় অন্যদিকে অনেক স্বীকৃত ফিকহী বিধানকেও অস্বীকার অনিবার্য হয়, যেগুলোতে পরিমাণের ভিন্নতার কারণে বিধানের ভিন্নতা এসেছে অথচ পরিমাণটি ‘মানসূস আলাইহি’ (স্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত) নয়; বরং ইজতিহাদী ও ইখতিলাফী। যেমন :
১. পানিতে নাপাকি পড়লে পানি নাপাক হবে কি না?
নাপাকির কারণে যদি পানির বৈশিষ্ট্যগুলোর (বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ) কোনোটি পরিবর্তিত হয় তখন তা সর্বসম্মতিক্রমে নাপাক, কিন্তু যদি এ পরিমাণ নাপাকি না পড়ে তাহলে কী হুকুম? এ বিষয়ে অধিকাংশ ফকীহের মাসলাক এই যে, ‘অল্প’ পানি নাপাক হয়ে যাবে, কিন্তু ‘বেশি’ পানি নাপাক হবে না। এখন প্রশ্ন হল, কী পরিমান পানি ‘অল্প’ পানি আর কী পরিমাণ পানি ‘বেশি’ পানি। যেহেতু এর মাপকাঠি কোনো সর্বসম্মত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয় এ কারণে মুজতাহিদ ইমামগণের মাঝে এ বিষয়ে মতভেদ হয়েছে এবং এ বিষয়ে স্বয়ং ফিকহে হানাফীর ফকীহগণেরও বিভিন্ন মত আছে। মুতাআখখিরীন হানাফী ফকীহদের মাঝে ‘দহ দর দহ’ শীর্ষক মতটি অধিক প্রসিদ্ধ।
২. মুসাফিরকে চার রাকাত বিশিষ্ট নামাযে কসর করতে হয় এবং রোযা না রেখে পরে কাযা আদায়ের অবকাশ আছে, কিন্তু শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘সফরে’র সংজ্ঞা কী-এ বিষয়ে ইমামগণের মাঝে মতভেদ আছে। ফিকহে হানাফীতে এর যে ফয়সালা দেওয়া হয়েছে, আধুনিক পরিভাষায় তা হলো- ৭৭.২৪৮৫১২ কিলোমিটার।
তবে অন্যান্য মাযহাবের ফয়সালা এ থেকে আলাদা।
৩. মুসাফির কোথাও ইকামতের নিয়ত করলে তার উপর মুকীমের হুকুম প্রযোজ্য হয়। কিন্তু কতদিনের ইকামতের (অবস্থানের) নিয়ত করার দ্বারা মুকীম হয়-এ বিষয়ে মতভেদ আছে, ফিকহে হানাফীর ‘মুফতাবিহী’ সিদ্ধান্ত (ফতোয়া) এই যে, পনেরো দিন বা তার বেশি ইকামতের নিয়ত করলে মুকীম হবে।
৪. নামাযে ‘আমলে কলীল’ মাফ। অর্থাৎ এর কারণে নামায নষ্ট হয় না। পক্ষান্তরে ‘আমলে কাছীর’ এর কারণে নামায নষ্ট হয়ে যায়। এখন কোন কাজ ‘আমলে কলীল’ আর কোন কাজ ‘আমলে কাছীর’-এর কোনো নির্ধারিত মাপকাঠি কোনো সুস্পষ্ট নস দ্বারা প্রমাণিত নয়। ফলে এ বিষয়ে ফকীহগণের সিদ্ধান্তও বিভিন্ন। ফিকহে হানাফীতে অগ্রগণ্য সিদ্ধান্ত এই যে, যে কাজে লিপ্ত ব্যক্তিকে দেখলে কেউ নামাযীই মনে করবে না; বরং নামাযের বাইরেই মনে করবে তা-ই ‘আমলে কাছীর’ যার দ্বারা নামায ফাসিদ হয়ে যাবে।(৪)
মোটকথা, শরয়ী দলিল দ্বারা প্রমাণিত কোনো বিষয়কে শুধু এজন্য অস্বীকার করা যে, এর বিস্তারিত প্রায়োগিক রূপ কোনো স্পষ্ট নসে নেই, মোটেও ঠিক নয়। কারণ স্পষ্ট নসে বিস্তারিত বিবরণ না থাকার অর্থ, বিষয়টিকে শরীয়ত ফকীহগণের ইজতিহাদের উপর ন্যস্ত করেছে। অতএব এর সমাধান খুঁজতে হবে মুজতাহিদগণের কাছে। এ বিষয়ে যদি তাদের সিদ্ধান্ত বিভিন্ন হয় তাহলে শরীয়তের নীতিমালার আলোকে আসহাবুত তারজীহ (অগ্রগণ্য নির্ধারণকারী) ফকীহগণ যে সিদ্ধান্তকে রাজিহ ও অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করবেন তা-ই অনুসরণ করা হবে। মাসআলাটি ইজতিহাদী বা ইখতিলাফী হওয়ার কারণে নিজের পক্ষ হতে মতামত দেওয়ার বা মুজতাহিদগণের সিদ্ধান্ত অস্বীকার করার অধিকার থাকবে না। আল্লাহ তাআলা যদি চাইতেন তাহলে প্রত্যেক বিষয়ের বিধান স্পষ্ট নসের দ্বারাও দিতে পারতেন, কিন্তু এ তার দয়া ও প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ যে, অনেক বিষয়কে মুজতাহিদ ইমামগণের ইজতিহাদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। জ্ঞানীরা জানেন, এটি ইসলামী শরীয়তের ‘মাহাসিন’ সৌন্দর্যের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত।
আলোচ্য বিষয়ে ‘আসহাবুত তারজীহ’ ফকীহগণের বরাতে বলা হয়েছে যে, রাজিহ ও অগ্রগণ্য মত অনুসারে উদয়স্থলের ভিন্নতাই হচ্ছে মাপকাঠি এবং বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য উদ্ধৃতির মাধ্যমে এ-ও বলা হয়েছে যে, ‘‘ইখতিলাফুল মাতালি’’ (উদয়স্থলের ভিন্নতা) অর্থ, সাধারণ অভিজ্ঞতার ভিন্নতা, জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবভিত্তিক সূক্ষ্ম বিভিন্নতা নয়।
নোট :
উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য মনে করার মাসলাকের উপর এক প্রশ্ন, যা বেশ প্রসিদ্ধ তবে অগভীর চিন্তাপ্রসূত-এই যে, যে ইমামগণ উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য বলেছেন তাঁরা তো এ কথা বলেননি যে, রাষ্ট্রসমূহের সীমান্তের ভিত্তিতে উদয়স্থল আলাদা হয়- না তারা এ বলেছেন আর না তা বাস্তবতা। তাহলে দেশে দেশে বিভিন্ন দিনে রোযা-ঈদ পালনের সাথে এ মাসলাকের কী সম্পর্ক?
এ প্রশ্ন শুনতে যতই চটকদার মনে হোক, এখানে তা অপ্রাসঙ্গিক এবং নিতান্তই অগভীর চিন্তাপ্রসূত। পাঠকবৃন্দের হয়তো মনে থাকবে এ প্রবন্ধের প্রথম কিস্তিতেই সংক্ষেপে এ প্রশ্নের উত্তরের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সামনে গিয়ে এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ। l
وبالله التوفيق، ولا حول ولا قوة إلا بالله، عليه توكلت وإليه أنيب
টিকা :
টীকা : ১
اعترض عليه الرافعي في "الشرح الكبير" (٣⁄١٨٠) بأن العراقيين قالوا بذلك، ويقول الراقم : إن كتب العراقيين أمام الإمام، فكيف يغفل عن قولهم، والذي أراه أن المراد من قوله : لا قائل به، أي باختلاف المطالع الذي لا يدركه إلا أهل العلم بالفلك والهيئة، وأما قول العراقيين فمحمول عنده على اختلاف المطالع العرفي المبني على بادئ الرأي. ولعله لم يذكر قولهم، لأنه لم يختره. والله تعالى أعلم.
টিকা : ২
قال الراقم: وليعلم الطلاب أن عبارة جواهر الفتاوى المذكورة نقلها القهستاني في "جامع الرموز" باختصار مخل، ونقلها عنه ابن عابدين الشامي رحمه الله تعالى في "رد المحتار" (٣/٢٦٤-٢٦٥) : و"مجموع رسائله" (١/٢٥٠) (رسالة "تنبيه الغافل والوسنان على أحكام هلال رمضان")، فوقع كذلك مبتورا، وقد عقب ابن عابدين على القدر الذي نقله بما أورده عن التاج التبريزي الشافعي أن اختلاف المطالع لا يمكن في أقل من أربعة وعشرين فرسخا، قال ابن عابدين : الظاهر من قول التبريزي : لا يمكن الخ أنه قدره بالقواعد الفلكية، ولا مانع من اعتبارها هنا كاعتبارها في أوقات الصلاة"، ذكره في "تنبيه الغافل".
ولو أنه رحمه الله تعالى وقف على عبارة "جواهر الفتاوى" بتمامها لما قال ما قال، ودعواه أن تحديد التاج التبريزي مبني على القواعد الفلكية، خطأ محض ترفضه قواعدُ علم الفلك القديم وعلم الفلك الحديث في آن واحد، كما أخبرني بذلك عالم من أصحاب الخبرة بعلم الهيئة وعلم الفلك، وهو رئيس قسم التحقيق لمركز الفلكيات في جامعة الرشيد كراتشي, وراجع "أحسن الفتاوي" ج٤ ص٥٠٣-٥٠٤ و"بحوث في قضايا فقهية معاصرة" لشيخنا الأستاذ العلامة محمد تقي العثماني حفظه الله تعالى ورعاه
ج٢ ص٢٥٤-٢٥٥ , فقد نبها على خطأ أمثال هذه التحديدات, واستدلا بذلك على ضعف القول بكون اختلاف المطالع معتبرا, والذي يبدو للراقم عفا الله عنه أن ذلك دليل على أن مراد جل الفقهاء القائلين باختلاف المطالع هو الذي يدرك ببادئ النظر دون الذي يدرك بالحساب, والله تعالى أعلم.
وبالنسبة لخطأ التحديدات المذكورة ففيما أشرت إليه من جداول رجال علم الفلك المعاصرين غنية, وانظر ما سيأتي في التعليقة الثالثة, وقوله رحمه الله تعالى : ولا مانع من اعتبارها هنا, مخالف لكلام الفقهاء قبله, منهم جمال الدين اليزدي و صاحبه الكرماني, ومخالف لمقتضى حديث: نحن أمة أمية, كما سيأتي... انتهي قول الراقم.
টিকা : ৩
قال الراقم : وبهذا وبما تقدم يتبين الخلل في قول ابن حجر المكي رحمه الله تعالى في الفتاوى الفقهية ج٢ ص٨٩ إذ قال : "...، ولا يضر ما يلزم على ذلك من الرجوع لقول الحاسب والمنجم، لأنه في أمر تابع وخاص، والتوابع والأمور الخاصة يغتفر فيهما ما لا يغتفر في الأصول والأمور العامة ... ".
هكذا أطلق، ولم يبين كيف يلزم في ذلك الرجوع إلى الحاسب، وإنما يلزم الرجوع إذا ثبت أن المدار على اختلاف المطالع من حيث الحساب، ولم يبين ابن حجر ذلك ولا استَدَلَّ له بشيء. ولا أدري أنه كيف عَدَّ أمر افتراض الصوم وثبوت الرمضانية وعدمه من الأمور التابعة والخاصة!
هذا، مع أنه قال في الفتوى نفسها : "قال التاج التبريزي : ورؤيته في بلد توجب ثبوت حكمها إلى أربعة وعشرين فرسخا، لأنها في أقل من ذلك لا تختلف.
قال أبو شكيل : وعدن وزبيد وما والاهما من برعجم متحدة المطالع، وعدن وصنعاء وما والاهما من الجبال وتعز مختلفة اه." انتهى كلام ابن حجر المكي. فليتأمل القارئ الكريم فيما نقله عن التاج ومن طريقه عن أبي شكيل، هل ينطبق شيء من ذلك على قواعد علم الفلك أم لا؟ وإذا لم ينطبق عليها فهذا دليل آخر على وجود الخلل والتسامح في كلامه في هذا البحث.
টিকা : ৪
قال الراقم : ويعلم طلاب الفقه وأصوله وطلاب الحديث وأصوله أن هذا باب واسع جدا، فأقل مقدار الجماعة التي شرطت للجمعة والعيدين، وأقل مقدار الخطبة فيهما، وأقل مقدار القراءة المفترضة في الصلاة، وأقل المهر المشروط في النكاح، ومقدار المتاع الواجب للمطلقة، ... ، إلى مسائل كثيرة في الفقه وأصول الحديث، كلها مجتهد فيها ومختلف فيها، فإنكار أصل لأجل وقوع الخلاف في تفصيله وعدم النص فيه لا ينبغي أن يصدر من متفقه، بل الشأن البحث عن الراجح من الخلافيات المجتهد فيها. والله الموفق، انتهى
قول الراقم.