স ং খ্যা ল ঘু : করাতের নিচে সম্প্রীতি
যশোরের মনিরামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওসিকে ২৬ জানুয়ারি প্রত্যাহার করা হয়েছে। পরে তাকে যশোর পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। খবর বেরিয়েছে ২৭ জানুয়ারির পত্রিকায়।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী? অভিযোগ হচ্ছে তিনি বর্ণবিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। হাজরাইল গ্রামের ঋষিপল্লির দুই নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ কিংবা ঘটনা নিয়ে তিনি একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন ‘ওরা বাড়াইয়া বলে, ঋষি সম্প্রদায় যেখানে যে ঘটনা ঘটে সেটাকেই তিল থেকে তাল করে বলে।’ এই মন্তব্যের কারণেই তাকে প্রত্যাহার করেছেন যশোরের পুলিশ সুপার জয়দেব ভদ্র।
প্রত্যাহারের আগের দিন ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় খবর বের হয়, ‘ধর্ষণের অভিযোগ স্বীকার করেছেন গ্রেফতার পাঁচ আসামির দুজন।’ অপরদিকে এরও সপ্তাহখানেক আগে ঢাকার আরেকটি পত্রিকায় খবর বের হয়, ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। এতে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতা তৈরি হয়। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে প্রশাসন, গণমাধ্যম, মানবাধিকার কমিশন, বিচারবিভাগ, সুশীলসমাজ ও কূটনীতিকরা তো এক পায়ে খাড়া! সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে তাই সংশয়মূলক কোনো কথা আকার- ইঙ্গিতেও বলা যাবে না। কিন্তু মনিরামপুরের ওই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এই স্পর্শকাতরতা বুঝতে পারেননি। তিনি সংশয় ব্যক্ত করে মুখে কিছু কথা বলে ফেলেছেন। ব্যস এরপরই তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং কাজটি করেছেন তার ওপরে থাকা আরেক সংখ্যালঘু পুলিশ কর্মকর্তা। প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে, তার উপরের জন তার সঙ্গে যা করেছেন সেখানে কি বর্ণবিদ্বেষ বা সাম্প্রদায়িকতার কিছু নেই? এটা কি পুরোপুরি প্রশ্নাতীত ও ন্যায়ানুগ একটি সিদ্ধান্ত? যদি তা-ই হয়, তাহলে সাম্প্রতিক কয়েকটি বছরে যেভাবে যত্রতত্র ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ‘জঙ্গি’ হিসেবে কটাক্ষ করে অপ্রস্ত্তত ও বিব্রত করা হচ্ছে, যেভাবে যেখানে সেখানে তাদের সন্দেহভাজন ও অভিযুক্ত বানানো হচ্ছে, এতে কি বর্ণবিদ্বেষপূর্ণ কোনো আচরণ সংঘটিত হচ্ছে না? এগুলোর জন্য কি কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে?
পত্র পত্রিকায় দেখা যায়, এ ধরনের আচরণ ও অভিযানে অনেক সময়ই সংখ্যালঘু পুলিশ কর্মকর্তারা যুক্ত থাকেন। কখনো কখনো তাদের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ওপর অতি উৎসাহী হয়ে নিপীড়নমূলক আচরণের অভিযোগও শোনা যায়। এসব কিছুই কি বিচার, পর্যবেক্ষণ ও নজরদারির বাইরেই থাকবে? সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ মানেই কি তার সম্মান ও অধিকারের কোনো মূল্য থাকবে না? নাগরিক হিসেবে যে কোনো অভিযোগ ও ভোগান্তিতে সংখ্যালঘুরা থাকবে আকাশছোঁয়া প্রাধান্যে, আর নানা পর্যায়ে বিপন্ন ও ভুক্তভোগী প্রান্তিক সংখ্যাগুরুদের বিবেচনা মাটিতেও হবে না? এটা কীভাবে হতে পারে!
বিতর্কিত একটি অভিযোগের ভিত্তিতে ‘বর্ণবিদ্বেষপূর্ণ’ মন্তব্যের কারণে একটি থানার একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তার উপরস্থ ভিন্ন সম্প্রদায়ের একজন কর্তৃক তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার করার ঘটনায় সঙ্গত কারণেই প্রশ্নগুলো সামনে এসেছে। দৃশ্যপট দেখে মনে হচ্ছে, একটি ‘বর্ণবিদ্বেষ’ শোধরানোর প্রক্রিয়ায় অনেক বড় ‘বর্ণসংঘাতের’ পটভূমি তৈরি করা হচ্ছে। সংখ্যালঘু ইস্যুর ধারালো ও স্পর্শকাতর করাতে বার বার কেটে দেওয়া হচ্ছে সংখ্যাগুরুর নিরীহ সম্প্রীতিবোধ। স্থিতি, শান্তি ও সম্প্রীতির প্রতি সংখ্যাগুরুর সযত্ন সুস্থতাকে খোঁচা দিয়ে, উস্কানি দিয়ে ও ঘা দিয়ে বিক্ষত করা হচ্ছে । এসবের সুদূরপ্রসারী পরিণতি কি ভালো হতে পারে? অবশ্য একইসঙ্গে একথা তো পরিষ্কার যে, হিন্দু কিংবা মুসলিম - যে কোনো দিক থেকেই বর্ণবিদ্বেষমূলক বক্তব্য বা আচরণ অগ্রহণযোগ্য একটি বিষয়। তা ছাড়া যে কোনো সম্প্রদায়ের যে কোনো পর্যায়ে কোনো নারী বা পুরুষ যদি ভয়াবহ উৎপীড়নের শিকার হন তবে তাকে সুরক্ষা দেয়া আইনের লোকদের বড় দায়িত্ব। শান্তি ও শৃঙ্খলার এই প্রশ্নাতীত চেতনা নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ এখানে নেই।
দেখা যাচ্ছে, থানার ওই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রত্যাহার হয়েও রক্ষা পাচ্ছেন না; তার বিরুদ্ধে ঢাকার অতি সংখ্যালঘু-সচেতন পত্রপত্রিকায় কড়া ভাষায় লেখালেখিও চলছে। এমনকি তার
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ২৬ জানুয়ারি যশোরের দড়াটানা মোড়ের ভৈরব চত্বরে মানববন্ধন করেছে ‘বাংলাদেশের দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী আন্দোলন’। ওখানে বিভূতোষ রায় বলেছেন, ‘ওসিকে শুধু প্রত্যাহার করলে চলবে না, আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’ বাংলাদেশ দলিত পরিষদের উদয় দাস ও অশোক দাস বিবৃতি দিয়ে ওই ওসির অতীত কর্মকান্ডের শাস্তিও দাবি করেছেন।
আহা বেচারা! সংখ্যালঘু ইস্যুর করাতের নিচে পড়ে গেছেন। ওসি বা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হলে কী হবে! এখন তার বারোটা বাজতে থাকবে ভোর সকালেই! এদেশে সংখ্যালঘুদের নাগরিক অবস্থান যে এখন কতটা সুউচ্চ ও সুরক্ষিত, প্রাধান্যপ্রাপ্ত ও বিশেষায়িত - তা তিনি জানতেন না! কী আর করা! কিছুদিন ভুগতেই হবে তাকে।