প দ্ম ভূ ষ ণ : পদকের পটভূমি অপরিষ্কার নয়
জীবনের শেষবেলায় এসে তিনি পেলেন। আমলনামা মোটেই বৃথা যায়নি। ভারত সরকার তার মন ভরে দিয়েছে। এদেশের ক্ষেত্রে অবশ্য এটা প্রথম নজির। এর আগে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এত বড় সাইজের পিঠচাপড়ানি কোনো বাংলাদেশি পেয়েছে বলে শোনা যায়নি। কিন্তু তিনি পেলেন এবং পেয়ে খুবই সম্মানিত বোধ করলেন। জীবনটা বোধ হয় এ রকমই। লাজ-লজ্জা, দ্বিধা-সংশয় থাকতে নেই। থাকলে অনেক কিছু পাওয়া যায় না, পেলেও আবার মন ভরে নেওয়া যায় না। দ্বিধা-সংকোচে দিলটা তখন ছোট হয়ে যায়। তার অবশ্য হয়নি; তিনি বরং কিছুটা ফুলেই উঠেছেন। খবরটি বোরোনের পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বেশ তৃপ্তির সুরেই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আগে এ বিষয়ে আমি কিছু জানতাম না। তাই এটি আমার কাছে অপ্রত্যাশিত আনন্দের সংবাদ। আমি খুব সম্মানিত বোধ করছি। ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।’
তিনি পেয়েছেন পদ্মভূষণ। ভারতের তৃতীয় বেসামরিক সর্বোচ্চ সম্মাননা। ২৫ জানুয়ারি টাইমস অব ইন্ডিয়া খবরটি জানিয়েছে। ঢাকার পত্রিকাগুলোতে প্রকাশ হয়েছে পরদিন। বেশিরভাগ পত্রিকাতেই সিঙ্গেল কলামে ভেতরের পাতায়। শুধু তার প্রতি বিশেষ যত্নবান দৈনিক পত্রিকাটিতে খবরটি ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়। তবে তারাও সিঙ্গেল কলাম অতিক্রম করেনি। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কোনো বুদ্ধিজীবী-অধ্যাপক একটি সম্মাননা পাচ্ছেন আর সে খবরটি ছাপা হচ্ছে এত কৃপণভাবে! একদমই ঠিক হয়নি।
টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, এ বছর ভারত সরকারের সম্মাননা পদ্মবিভূষণ পেয়েছেন দুজন, পদ্মভূষণ ২৪ জন, পদ্মশ্রী ১০১ জন। প্রথম দুজনের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি নেই। মাঝের ২৪ জনের মধ্যেই আমাদের একজন বুদ্ধিজীবীর জায়গা হয়ে গেছে। পরের ১০১ জনেও বাংলাদেশি কেউ নেই। সম্ভবত ১৯৭১-এর পর থেকেই এ জাতীয় কোনো সম্মাননা কোনো বাংলাদেশি পাননি। অন্য বাংলাদেশীরা যা পেয়েছেন তা হচ্ছে ভারতের বেসামরিক বিভিন্ন সম্মাননা ও পদক। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের একটি পত্রিকা ও প্রকাশনীর পক্ষ থেকে বিতরণ করা ‘আনন্দ পুরস্কার’ পেয়েই জীবনের জন্য বর্তে গেছেন অনেক ভারত-অন্তপ্রাণ এদেশীয় সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী। পদ্মভূষণ পাওয়া বুদ্ধিজীবী সাহেবও ওই পদকটি পেয়েছিলেন। তবে বাংলাদেশের প্রথম যিনি আনন্দ পুরস্কারটি পেয়েছেন তিনি ছিলেন একজন নারী। তাকে এবং তার পদকটিকে নিয়ে অনেক মুখরোচক গল্প তখন বাজারে চালু হয়ে গিয়েছিল। প্রয়াত নাস্তিক বুদ্ধিজীবী আহমদ শরীফকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তাদের মতো পন্ডিতেরা থাকতে ওই অল্প বয়সী নারীকে কেন পদকটি দেওয়া হলো?’ তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই তাদেরকে দেওয়ার মতো তার কাছে এমন কিছু রয়েছে, যা আমাদের নেই।’ আহমদ শরীফের ওই কথার কোনো প্রতি-উত্তর তখন শোনা যায়নি। তবে যারাই ওই পুরস্কারের ‘আনন্দ’ পেয়েছেন তাদের সবারই ব্যক্তিগত ও প্রতিভাগত রেকর্ড হচ্ছে মুসলিম জীবনাচার, মুসলিম চেতনা ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখা। ভারত ও হিন্দুসমাজের প্রতি আনুগত্যের নজির স্থাপন করা। নাস্তিক্যবাদের পোশাক গায়ে চড়িয়ে উন্মূল, হীনম্মন্যতাগ্রস্ত ও অকৃতজ্ঞ মুসলিমের মহড়া দেওয়া। একাজগুলো তারা অকপটেই করেছেন এবং সম্মানের তগমা ও তোহফা বাগিয়ে বিকৃত সুখের ডোবায় অবগাহন করেছেন।
আমাদের আলোচিত অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবী সাহেবকে নিয়ে ঠোঁটকাটা কোনো পন্ডিত মুখ খুলবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। এবারের পদ্মভূষণ দেওয়াটা যদি বাংলাদেশি সুশীলদের প্রতি ধারাবাহিক কোনো উপঢৌকন প্রক্রিয়ার অংশ হয় তাহলে সম্ভাব্য কেউ মুখ খুলবে বলে মনে হয় না। কেউ চান্স খুয়াতে চাইবে না। উল্টো পদ্মভূষণ-বুদ্ধিজীবীর পদচিহ্ন অনুসরণ করে ‘ভারতবন্ধু’ হওয়ার একটা সরব প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতে পারে। এর ফলে অচিরেই বাংলাদেশে পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রীর মহামারি শুরু হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে একথা মিথ্যা নয় যে, ভারত সরকার কোনোভাবেই অপাত্রে একটি পদ্মভূষণ ছুঁড়ে দেয়নি। সম্প্রতি ‘রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’ থেকে নিয়ে পক্ককেশি শাহবাগীদের ফোরাম-সভাপতির দায়িত্ব পালন করে তিনি যথেষ্ট নজর কেড়েছেন। সংখ্যালঘু, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি ইস্যুতে এপয়েন্টেড কর্মী ও এক্টিভিস্টের মতো কাজ করে অনেক বুড়ো ভারতপ্রেমী-বামপন্থীর মনে ঈর্ষা জাগিয়ে তুলেছেন। তিনি অনলস ও অব্যাহত কর্মকান্ড করে সম্মাননা পাওয়ার মতো আমলনামা হাজির করেছেন। সেজন্যই ভারত খুশি হয়ে তাকে মোটা একটা পিঠচাপড়ানি দিয়েছে।
ভারত হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী দেশ। ৭১-এর বন্ধু। অপরদিকে নদীহত্যা, সীমান্তহত্যা ও স্বদেশবিরোধী বহু আধিপত্যের নায়ক। ভারত বললেই শুকনো নদীর ধূ ধূ বালুর চর বুকে জেগে উঠে। ভারত বললেই কাঁটাতারে ঝুলানো ফেলানির লাশের ছবি চোখে পড়ে। আর এখন তো ভারত মানে আমার দেশে ক্ষমতা ও শক্তির কারিগর, গণতন্ত্র ও দেশ শাসনের নতুন নিয়ম উপহারদাতা। ভারত মানে ‘৪৭-এর পর থেকে মুসলিম নিধনের পরিশীলিত এক বধ্যভূমি, সাম্প্রদায়িকতার হাজার মাইলব্যাপি বিষাক্ত পোস্টার। সেই ভারতেরই পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার বসিরহাট থেকে তাড়া খাওয়া মুসলিম পরিবারের এক উত্তরপুরুষ আজ ভারতেরই ‘পদ্মভূষণ’ পাচ্ছেন। এটা কি কম বড় সাফল্য! নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি দায়হীন বিষোদগার, আত্মবিস্মৃতি, অকৃতজ্ঞতা আর দালালির অঙ্গনে এমন সাফল্যের ঘটনা অবশ্যই নজির হয়ে থাকবে।