ইলমের সাথে ইলমের আদব শেখাও অপরিহার্য
الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد!
ইলম শেখার আগেই মূলত ইলমের আদব শেখা উচিত। ইমাম ইবনে সিরীন রাহ. (১১০ হি.) বলেন-
كانوا يتعلمون الهدي كما يتعلمون العلم
‘তারা যেমন ইলম শিক্ষা করতেন তেমনি আচার-আচরণও শিক্ষা করতেন। (আলজামি লিআখলাকির রাবী ওয়া আদাবিস সামে, খতীব বাগদাদী ১/৭৯)
আমি একটু কম করেই বলেছি যে, ইলমের আগে না হলেও অন্তত ইলমের সাথে অবশ্যই ইসলামী আদব, বিশেষ করে ইলমের আদব শিখতে থাকা উচিত। কিন্তু এখন বাস্তবতা এই যে, প্রাতিষ্ঠানিক তলবে ইলমের যমানা শেষ হওয়ার পরও আমরা ইলমের গুরুত্বপূর্ণ আদব থেকেই উদাসীন থাকি। ইলম অর্জনের (?) পরও যেন আমরা আদব শেখার প্রতি আগ্রহী নই!
ফরয পর্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ আদব হল ইলম শেখার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করা। ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে নবী-আদর্শের পরিপন্থী কোনো উদ্দেশ্য যেন কখনোই না হয়। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইরশাদ প্রমাণিত-
لا تَتَعَلَّموا العلمَ لتُبَاهُوا به العلماء، ولا تُمَارُوا به السُّفَهَاء، ولا تَخَيَّروا به المجالس، فمن فعل ذلك فالنار فالنار.
অর্থ : এজন্য ইলম অর্জন করো না যে, তা দ্বারা আলেমের সাথে গর্ব করবে বা মূর্খদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হবে কিংবা মজলিসের অধিকর্তা হবে। যে এমন করবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম, তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম।-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৭৭
আমরা লক্ষ্য করি না যে, অনেক সময় আমরা উস্তাযের সাথে যেভাবে ইশকাল ও ইতিরায শুরু করি তা কখনো কখনো মুবাহাত ও মুমারাতের পর্যায়ে চলে যায়। আমরা চিন্তা করি না যে, এটা আমাদের জন্য ধ্বংসের কারণ; দুনিয়াতেও, আখিরাতেও।
বর্তমানে অনেক সময় উস্তাযের নিকট ইশকাল পেশ করার বৈধতার অপব্যবহার করা হয়। ইশকালের পরিবর্তে সরাসরি ইতিরায করা হয়। ইশকাল তো হল লাযিম মাছদার। যেমন বলা হয়ে থাকে-أشكل عليَّ كذا অর্থাৎ আমার কাছে এটি জটিল মনে হচ্ছে। কারো কাছে কোনো কথা বা বিষয় জটিল মনে হলে, কোনো বিষয়ে সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি হলে কিংবা কিতাবের কোনো কথার যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহ হলে তার এই ইশকালটি যথাযথ আদব ও বিনয়ের সাথে উস্তাযের নিকট পেশ করতে পারে। কেননা এটি হল ‘ইস্তিফহাম’, যা ইলম শেখারই অংশ। তবে তা হতে হবে সংশ্লিষ্ট পূর্ণ আলোচনা শেষ হওয়ার পর। কারণ আলোচনার মাঝে থামিয়ে দেওয়াও আদব পরিপন্থী। তাছাড়া এমনও হতে পারে যে, আলোচনার শেষভাগে আপনার ইশকালের উত্তর পাওয়া যাবে। তখন তো আপনি নিজেই লজ্জা ও সংকোচ বোধ করবেন।
আরেকটি আদব হল ইশকাল পেশ করার আগে অনুমতি গ্রহণ করা এবং ইশকাল পেশ করার ক্ষেত্রে কখনো তর্কের ভাব প্রকাশ না পাওয়া। কেননা এটি মারাত্মক বেআদবী। আর তখন তা ‘ইশকাল করা’ থাকে না, ‘ইতিরাযে’ পরিণত হয়। ইশকাল পেশ করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু ইতিরায করা সম্পূর্ণ আদবপরিপন্থী। ইতিরায তো হল আপত্তি করা, উস্তায ও আলোচনার মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে যাওয়া। এটি কীভাবে জায়েয হতে পারে?
ইশকালের মর্ম বোঝার পর এ কথা বুঝতে অসুবিধা হবে না যে, তালিবে ইলম উস্তাযের কাছে শুধু এমন বিষয় জিজ্ঞাসা করবে, যে বিষয়ে বাস্তবেই তার কোনো প্রশ্ন বা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। যে বিষয়টি তার জানা আছে, অন্য কোনো উস্তায বা আলেমের কাছে শুনেছে, কোনো শরহ বা হাশিয়ায় পেয়েছে কিংবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কোনো কিতাব বা ইলমী সাময়িকীতে পড়েছে তা তো অজানা নয়। তবে কেন তা উস্তাযকে জিজ্ঞাসা করবে? তাও আবার দরসের মধ্যে?!
মুতালাআর প্রতি তাকিদ দেওয়ার একটি বড় হেকমত এটাও, যেন সব বিষয় উস্তাযের নিকট জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন না হয়। তাই যে বিষয়টি জানা আছে, যে বিষয়ে কোনো ইশকাল বা সন্দেহ সৃষ্টি হয়নি তা উস্তাযের নিকট জিজ্ঞাসা করার পিছনে কী রহস্য থাকতে পারে? সাথীদের অবগতি উদ্দেশ্য হলে তাকরারের সময় বলে দেওয়া যায়। তবে কি নিজের ইলম প্রকাশ করা উদ্দেশ্য? নাকি উস্তাযকে পরীক্ষা করা, উস্তাযকে পেরেশান করা উদ্দেশ্য? এগুলো কি ভালো কাজ? এগুলো ছাড়া আর কী হেকমত হতে পারে?
আমাদের তলবে ইলমের যামানা (আলহামদুলিল্লাহ, বান্দা এখনও তালিবে ইলম। যদিও তলবের হক ও আদবগুলোর পরিপালন যথাযথভাবে হয়ে উঠে না। আমি সকল সাথীর নিকট দুআর আবেদন করছি) এখনও নিকটঅতীত। আমি বা-আদব ও সমঝদার তালাবাকে দেখেছি, বিভিন্ন শরহ ও হাশিয়া থেকে যা তাদের বোঝা সম্ভব ছিল তা দরসে জিজ্ঞাসাই করতেন না। মুতালাআর আগেও করতেন না, পরেও না। মোটকথা, নিজের ইলম প্রকাশের জন্য বা জিজ্ঞাসিত ব্যক্তিকে পেরেশান করার জন্য কিংবা উদ্দেশ্যহীনভাবে দরসে অযথা কোনো কথা জিজ্ঞাসা করা ইলম ও উস্তাযের আদবের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আর এমন আচরণ তালিবে ইলমের বরবাদির কারণও হয়ে যেতে পারে।
ইশকাল পেশ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ আদব এই যে, নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো উস্তায বা নিজ উস্তাযের কোনো সমবয়সী আলেম কিংবা তাঁর কোনো উস্তাযের কোনো কথাকে দলিল বানিয়ে ইশকাল পেশ না করা। এটাও উস্তাযকে পেরেশান ও অপ্রস্ত্তত করার শামিল। তেমনিভাবে উস্তাযের চেয়ে পদ-স্তর বা বয়সে ছোট কোনো আলেমের উদ্ধৃতি দিয়ে অথবা যাদের সাথে তাঁর তবিয়তের অমিল আছে তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করা-সব কিছুই পরিত্যাজ্য।
শায়খুল হাদীস যাকারিয়া কান্ধলভী রাহ.-এর ‘আপবীতী’ কিতাবটি আমাদের মুতালাআ করা উচিত। এটি অনেক উপকারী একটি কিতাব। আকলে আম ও ফিকহুল হায়াত-এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। আমাদের হযরত খতীব ছাহেব (মাওলানা ওবায়দুল হক) রাহ. কিতাবটি মুতালাআর জন্য খুব তারগীব দিতেন।
এই কিতাবে শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রাহ. একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন-
‘‘একই সময়ের মুদাররিসগণের কোনো কথা বর্ণনা করতে চাইলে আগ্রহভরেই করা যায়, তবে মুদাররিসের নাম উল্লেখ না করে। এ বিষয়টির প্রতি আমি নিজেও অনেক গুরুত্ব দিতাম এবং তালিবে ইলমদেরকেও শুরু থেকেই এ ব্যাপারে তাম্বীহ করতাম। হযরত মাওলানা আবদুর রাহমান ছাহেব (কামিলপুরী) নাওয়ারাল্লাহু মারকাদাহু-এর কাছে যেহেতু তিরমিযী শরীফের সবক ছিল আর এই অধমের কাছে সবসময় ছিল আবু দাউদ শরীফ। তখনকার তালিবে ইলম কিছুটা সমঝদারও ছিল। আমার ও মাওলানা মারহুমের আলোচনায় কোনো অমিল পেলে তারা জোরালোভাবে আমার কাছে কিংবা মাওলানার কাছে ইতিরায করত। (ইশকাল পেশ করত।)
আমার জানা ছিল যে, মাওলানা মারহুমও তাঁর সবকে বলতেন, তোমরা শায়খের নাম উল্লেখ করে আমাকে প্রভাবিত করতে চাও। কোনো ইতিরায করতে হলে শায়খের নাম উল্লেখ ছাড়াই করবে। আর আমিও একাধিকবার তলাবাদের বলেছি, তোমরা মাওলানার নাম উল্লেখ করে কখনো ইতিরায করবে না। কেননা তাঁর নাম শোনার পর তার কথা খন্ডন করা বে-আদবী। আর এক্ষেত্রে চুপ থাকা নিজের বিরুদ্ধমতকে গ্রহণ করার নামান্তর।’’-আপবীতী, আদদ ৬, ২/৩৩, প্রথম পরিচ্ছেদ, আকাবির কা তরযে তালীম
মোটকথা, ইলমের জন্যও অনেক আকল-বুদ্ধির প্রয়োজন। সহনশীলতা ও আদব থাকা দরকার। কোন্ কথা উস্তাযকে কখনোই জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়, কোন্ কথা নির্জনে বা খাস মজলিসে জিজ্ঞাসা করা উচিত আর কোন্ কথা দরস বা আম মজমায় জিজ্ঞাসা করা যায় আবার কোন্ কথা শুধু এমন উস্তাযকেই জিজ্ঞাসা করা উচিত, যার সাথে দুই দিক থেকেই (অবশ্যই আদব ও ভাব-গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে) বে-তাকাল্লুফির সম্পর্ক রয়েছে-এসব বিষয়ের বিবেচনা ও পার্থক্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কিতাব ও ফনের সাধারণ জ্ঞান, পাঠ্যভুক্ত কিতাবের আলোচনার বাইরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অতিরিক্ত আলোচনা সবকিছু তালিবে ইলমের দায়িত্বে। তারা মুতালাআ করে এসব অর্জন করবে। এ বিভাগে হাওয়ালার প্রতি যে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং বিভিন্ন বিষয়ের উপর একাধিক কিতাবের নাম উল্লেখ করা হয় এর বড় উদ্দেশ্য তো এটাই যে, তালিবুল ইলম তা নিজেই মুতালাআ করবে এবং এসব বিষয়ের জন্য আসাতিযায়ে কেরামকে তাকলিফ দিবে না। কোনো বিষয় না বুঝলে নির্জনে অনুমতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মাওয়াদ উস্তাযের সামনে পেশ করে ইশকাল হল করার চেষ্টা করবে। এর জন্য উস্তাযকে কষ্ট দেওয়া (যেমন, জবাব দেওয়ার কষ্ট বা খুঁজে বের করার কষ্ট ইত্যাদি) কখনো সমীচীন নয়। আলকাউসারের বিগত এক সংখ্যায় (মুহাররম ১৪৩৫ হি., নভেম্বর ২০১৩ ঈ.) শিক্ষার্থীদের পাতায়ও বান্দা এদিকে ইঙ্গিত করেছে।
দরস গ্রহণের এক গুরুত্বপূর্ণ আদব এটাও যে, কোনো মর্ম ও ব্যাখ্যা বর্ণনার ক্ষেত্রে কিংবা সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে উস্তাযের কোনো ভুল হয়ে গেলে (যা হওয়া খুবই সম্ভব) আর তালিবে ইলমের এ সম্পর্কে অবগতি থাকলে দরস বা আম মজমায় উস্তাযের নিকট তা পেশ করবে না; বরং নির্জনে গিয়ে পূর্ণ আদব বজায় রেখে উস্তাযের নিকট তা ব্যক্ত করবে। পরামর্শ প্রার্থনা বা মতামত প্রকাশের পদ্ধতিতে তাকে অবহিত করবে। আর সংশ্লিষ্ট মাওয়াদ বিদ্যমান থাকলে তা উস্তাযের সামনে পেশ করে দেওয়াই যথেষ্ট।
তালিবে ইলম, উস্তায ও মজলিসের অবস্থার বিবেচনায় কখনো মজলিসেও আদবের সাথে ভুলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। সালাফের মাঝে এ ধরনের ঘটনাও রয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো তালিবে ইলমদের জন্য ঐ পন্থাই সবচেয়ে নিরাপদ, যা দারাকুতনী রাহ. তাঁর উস্তাযের ক্ষেত্রে অবলম্বন করেছেন।
ইমাম আবু বকর ইবনুল আনবারী (মুহাম্মাদ ইবনে কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ, ২৭১-৩২৮ হি.), যিনি নাহু-লুগাতসহ কয়েকটি শাস্ত্রের ইমাম ও হাফেয ছিলেন প্রতি জুমাবারে তাঁর মজলিস হত। কোনো মজলিসে একটি হাদীস ইমলা করানোর সময় সনদের এক রাবীর নামে ভুল করে ফেলেন। (‘হিববান’কে ‘হাইয়ান’ বলেছেন বা এ জাতীয় কোনো ভুল।) দারাকুতনী রাহ. (৩০৬-৩৮৫ হি.) সেই মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, আমি চিন্তা করলাম, তিনি এত বড় মানুষ, তাঁর সূত্রে লোকেরা এই ওহাম লিখে নিবে, এটা কেমন কথা? কিন্তু তাঁকে এই ভরা মজলিসে কী করে বলি? দারাকুতনী বলেন, মজলিস শেষ হলে আমি তাঁর মুসতামলীকে বললাম যে, অমুক নামের ব্যাপারে শায়খের ওহাম হয়ে গিয়েছে। সঠিক হল এই।
দারাকুতনী বলেন, পরবর্তী জুমায় আমি মজলিসে উপস্থিত হলে শুরুতেই ইবনুল আনবারী রাহ. মুসতামলীকে বললেন, লোকদেরকে বলে দাও যে, গত জুমায় অমুক হাদীস ইমলা করার সময় সনদের অমুক নাম উচ্চারণে আমি ভুল করে ফেলেছি। সঠিক নাম এই। আর এ কথাও বল যে, ওই নওজোয়ান (দারাকুতনীর দিকে ইঙ্গিত করে) আমাকে তা সংশোধন করে দিয়েছিল।
قال أبو الحسن (الدارقطني) : فأعظمتُ أن يُحْمَل عن مثله في فضله وجلالته وَهَم، وهِبْتهُ أن أُوقِفَه على ذلك، فلما انقضى الإملاء، تقدَّمتُ إلى المستملي، وذكرت له وَهَمه، وعَرَّفتُه صوابَ القول فيه.
ثم حضرتُ الجمعةَ الثانيةَ مجلسَه، فقال أبو بكر للمستملي : عَرِّف جماعةَ الحاضرين أنا صحَّفنا الاسمَ الفلاني، لما أملينا حديث كذا في الجمعة الماضية، ونَبَّهَنا ذلك الشابُّ على الصواب، وهو كذا، وعَرِّف ذلك الشابَّ أَنَّا رَجَعنا إلى الأصل فوجدناه كما قال.
শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর কিতাব ‘সাফাহাত মিন ছাবরিল উলামা’য় (পৃষ্ঠা : ২৯৯) ঘটনাটির উল্লেখ আছে।
শায়খ রাহ. এতে তিনটি কিতাব থেকে সংক্ষেপ করে ইবনুল আনবারী রাহ.-এর জীবনী উল্লেখ করেছেন। কিতাব তিনটি হল : ১. তারীখে বাগদাদ, খতীবে বাগদাদী রাহ. (৩/১৮১-১৮৬) ২. ইনবাহুর রুয়াত আলা আনবাহিন নুহাত, জামালুদ্দীন কিফতী (৩/২০২-২০৭) ও ৩. ওফায়াতুল আইয়ান, ইবনে খাল্লিকান (১/৫০৩)।
আগের যমানায় প্রায় প্রত্যেক ইলম ও শাস্ত্রের ইমামগণের ইমলার মজলিস অনুষ্ঠিত হত, যেখানে তাঁরা সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের উলূম (জ্ঞান-বিদ্যা) নিজের স্মৃতি থেকে লেখাতেন। হুফফাযে হাদীসের ইমলার মজলিসগুলোর অনেক ঘটনা তারীখের কিতাবসমূহে সংরক্ষিত আছে। ইমলার মজলিসে এক বা একাধিক লোক থাকেন, যারা শায়খের নিকট ইমলার আবেদন করেন। মজলিসের আয়োজন ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় থাকেন। মজমা বড় হলে শায়খের কথা পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাৎ উঁচু স্বরে পুনরাবৃত্তি করে দূর পর্যন্ত পৌঁছে দেন। যে ব্যক্তি এসব দায়িত্ব পালন করেন তাকে বলা হয় মুসতামলী।
হযরত মাওলানা আবদুর রশীদ নুমানী রাহ.-এর ‘ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস’ কিতাবেও ইমলার মজলিসগুলোর কয়েকটি মজার ঘটনা উল্লেখ আছে। আগ্রহী পাঠক মুতালাআ করে নিতে পারেন। ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আলমাবসূত’ও শামসুল আইম্মা সারাখসী রাহ.-এর ইমলাকৃত।
কথাগুলো প্রসঙ্গক্রমেই এসে গেছে। আমার মূল আলোচনা ছিল দরসে উস্তাযের ঘটনাক্রমে কোনো ভুল হয়ে গেলে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার আদব সম্পর্কে। এ প্রসঙ্গে দারাকুতনী রাহ.-এর ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
হযরত নানুতুবী রাহ. (১২৪৮-১২৯৭ হি.)-এর একটি ঘটনা প্রসিদ্ধ। হযরত হাজ্বী ছাহেব রাহ. (১২৩৩-১৩১৭ হি.) তাকে একটি খসড়া লেখা স্পষ্ট করে লিখে দেওয়ার জন্য দিলেন। ঘটনাক্রমে তাতে একটি শব্দ ভুল লেখা ছিল। তিনি ভাবলেন, নিজে থেকে সঠিক শব্দ লিখলে তা বে-আদবী হবে। আবার ভুলইবা কীভাবে লিখবেন? তাই সে জায়গা তিনি খালি রেখে দিলেন এবং হযরত হাজ্বী ছাহেব রাহ.-এর নিকট আরয করলেন, হযরত! এই শব্দটি বুঝতে পারছি না। হযরত তা দেখে নিজেই শুধরিয়ে দিলেন।-কামালাতে আশরাফিয়া, পৃষ্ঠা : ১৬৪
আলোচনা যেন অসম্পূর্ণ না হয়ে যায় তাই এ কথাও উল্লেখ করছি যে, ফার্সী ভাষায় একটি প্রসিদ্ধ উক্তি আছে-
طالب علمے كہ چوں چرا نكند ومريدے كہ چوں چرا كند ہر يكے را ببيابان فرستادن بايد
অর্থাৎ যে তালিবে ইলম ‘কেন-কীভাবে’ প্রশ্ন করে না আর যে মুরীদ ‘কেন-কীভাবে’ প্রশ্ন করে উভয়কেই জঙ্গলে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।
এই উক্তির অর্থ এই নয় যে, অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করতে হবে। এর উদ্দেশ্য হল বুঝেশুনে পড়া। আর তাহকীকের প্রয়োজনে যথাযথ আদব ও ভদ্রতার সাথে উস্তাযের কাছে নিজের ইশকাল ব্যক্ত করা এবং হাকীকত পর্যন্ত পৌঁছতে চেষ্টা করা। অবশ্য তালিবে ইলমীর একটি স্তর ও মারহালা হল, কোনো ফনের বিশেষত্ব অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট ফনের তাফাক্কুহ অর্জিনকারী কোনো আহলে দিল ও আহলে যওক আলেমের সাহচর্য গ্রহণ করা। তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকা। এক্ষেত্রে অবশ্য মামুন আববাসীর কথাই প্রযোজ্য হতে পারে। তিনি বলেছেন-
العلم على المناقشة أثبت منه على المتابعة.
-মিন আদাবিল ইসলাম, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.
আর ইবনুল হুমাম রাহ.-এর উস্তায কারিউল হেদায়ার সাথে তাঁর আচরণ এরই অন্তর্ভুক্ত। এ সম্পর্কে সাখাভী রাহ. الضوء اللامع কিতাবে ইবনুল হুমাম রাহ.-এর জীবনীতে লিখেছেন-
وأخذ الفقه عن السراج قاريء الهداية، قرأها بتمامها عليه في سنتي ثماني عشرة والتي تليها وبه انتفع وكان يحاققه ويضايقه بحيث كان يحرج منه مع وصف الكمال له بالتحقيق في كل فن.
আর ওলিউদ্দীন ইরাকী রাহ. ও ইবনুল হুমাম রাহ.-এর মাঝে যা হয়েছিল তা এরই অন্তর্ভুক্ত। ইমাম সাখাভী রাহ. বলেন-
وأخذ غالب "شرح ألفية العراقي" عن ولد مؤلفه الولي ورام أولا التدقيق في البحث بحيث يشكك في الاصطلاح فلم يوافقه الولي على الخصوص في ذلك.
এতে বোঝা গেল, বহস ও মুনাকাশা (যুক্তিতর্ক ও গবেষণা-অনুসন্ধান)-এর সাথে পড়তে চাইলে আগে থেকেই অনুমতি নেওয়া শর্ত। তবে এটা জরুরি নয় যে, উস্তাযের তবিয়ত সবসময় এর জন্য প্রস্ত্তত থাকবে। আর শাগরিদের মধ্যে এর যোগ্যতা ও রুচি থাকা তো সর্বাবস্থায় শর্ত।
সালাফের যুগে ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর সাথে তার বেশ কয়েকজন শাগরিদের আচরণ, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ.-এর সাথে তার শাগরিদ মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীস শাফেয়ী রাহ.-এর আচরণ এ ধরনেরই ছিল।
ইবনে আবী হাতেম রাহ. হুমায়দী রাহ. (২১৯ হি.)-এর সূত্রে শাফেয়ী রাহ.-এরই যবানীতে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসানের সোহবতের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তাতে এ কথাও আছে-
فلزمته وكتبت عنه، وعرفت أقاويلهم، وكان إذا قام ناظرت أصحابه، فقال لي : بلغني أنك تناظر أصحابي، فناظرني في الشاهد واليمين، فامتنعت فألح علي، فتكلمت معه، فرفع هو ذلك إلى الرشيد فأعجبه ووصلني.
-বুলুগুল আমানী, যাহেদ কাওছারী (১৩৭১ হি.), পৃষ্ঠা : ২২; তাওয়ালিত তাসীস, ইবনে হাজার আসকালানী, পৃষ্ঠা : ১২৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া বৈরুত
আলোচনা দীর্ঘ হয়ে গেল। আমি আমার তালিবে ইলম ভাইদের খেদমতে আদবে ইলম সম্পর্কে কিছু কথা পেশ করছিলাম। আমি আরয করেছি যে, আমরা বোঝার জন্য উস্তাযগণের কাছে অবশ্যই আদবের সাথে প্রশ্ন করব। হল না হলে নিজের ইশকাল পেশ করব। কিন্তু ইতিরায, বিরোধিতা ও বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি নিজের ইস্তিফহাম (বোঝার জন্য কোনো প্রশ্ন করা) দ্বারা যেন বিরোধিতা ও বিতর্কের ভাবও প্রকাশ না পায়। অন্যথায় এটি আপনার জন্য ধ্বংসের কারণ হয়ে যেতে পারে।
সালাফ ও আকাবিরের এই কথা সবসময় মনে রাখবেন-
ما وَصَل مَنْ وَصَل إلا بالحرمة، وما سَقَط من سَقَط إلا بترك الحرمة.
-তালীমুল মুতাআল্লিম, পৃষ্ঠা : ৪৬
এর ভাবার্থকে কোনো কোনো আকাবির এভাবে ব্যক্ত করেছেন-
ما فاز من فاز إلا بالأدب، وما سقط من سقط إلا بسوء الأدب.
-মাআলিমু ইরশাদিয়াহ লিছিনাআতি তালিবিল ইলম, শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা, পৃষ্ঠা : ২৪৫-২৪৬
মাসিক আলকাউসারের শিক্ষার্থীদের পাতা মূলত তালিবে ইলম ভাইদের ইলমী সফরে সহযাত্রার বরকত ও সাআদত লাভের জন্যই প্রস্ত্তত ও প্রকাশিত হয়ে থাকে। এই বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল, তালিবে ইলম ভাইদেরকে ইলমী বিষয়ে সালাফের আদর্শে আদর্শবান করে তোলা। তাদেরকে নিজ উস্তাযের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া। নিজ প্রতিষ্ঠান ও উস্তাযের প্রতি সম্মানবোধ সৃষ্টি করা। তালীমী ও ইসলাহী মুরববীর প্রয়োজনীয়তা এবং তাঁদের দেওয়া হেদায়াত, ইসলাহ ও তারবিয়তের গুরুত্ব অনুধাবন করানো।
তালিবে ইলমদের ইলমী ইশকালগুলোর সমাধান তুলে ধরা এ বিভাগের দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্দেশ্য। বারবার তাম্বীহ করা হয় যে, তালিবে ইলম যেন ইশকালগুলো নিজে নিজেই হল করার চেষ্টা করেন। ইলমের সাধারণ মালূমাত নিজেই খুঁজে বের করেন। আর তালীমী পরামর্শের বিষয়ে তো সব সময় নিজের তালীমী মুরববীর শরণাপন্ন হওয়ার জন্যই বলা হয়।
বান্দা তার তালিবে ইলম ভাইদের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সকাতর দরখাস্ত করছে, কোনো আল্লাহর বান্দা যেন কখনো বিভাগটিকে তার উদ্দেশ্যের খেলাফ ব্যবহার না করেন। যে হাদীস দ্বারা এই প্রবন্ধের সূচনা করা হয়েছে তা যেন মুখস্থ করে নেন, এর অর্থ ও মর্ম অন্তরে বদ্ধমূল করে নেন এবং অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এর দাবি অনুযায়ী আমল করেন। আর আমাদের জন্য দুআ করেন যেন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও আমল করার তাওফীক দান করেন। আমীন।