দ্রব্যমূল্য: গলাকাটা ব্যবসার সুযোগ দিলে প্রশ্ন উঠবে
আবু তাশরীফ
মসুরের ডালের দাম এখন সবচেয়ে চড়া। কিছুদিন আগে চিনির দামের যে অবস্থা হয়েছিল। ঠিক তেমনি হয়েছে ডালের দাম। তখন চিনি প্রতি কেজির দাম চল্লিশ থেকে বাড়তে বাড়তে সত্তর টাকা ছুঁয়েছিল। চিনির দাম বাড়তে থাকার সময় একেক পর্যায়ে সরকারের উঁচু মহল থেকে একেক রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল। টিসিবির পক্ষ থেকে চিনি কিনে তুলনামূলক কম মূল্যে বাজারে ছাড়ার উদ্যোগের কথা বলা হলেও সে রকম কিছু ঘটতে আর দেখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত দেশের কোনো এক অঞ্চলের পাইকারী চিনি ব্যবসায়ীদের ডি-ও লেটার বাণিজ্যের কথা মিডিয়াতে এসেছিল। তাদের বিচার ও শাস্তির মুখোমুখি করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা তখন জোরে শোরে বলেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ কী নেওয়া হয়েছিল তা তো সবার সামনেই রয়েছে। এবারও দফায় দফায় ডালের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারি পর্যায় থেকে নানা ব্যাখ্যা পেশ করা হচ্ছে, কিন্তু ডালের মূল্য কিছুতেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকছে না।
গত ২২ ডিসেম্বরের একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে-মসুরের ডালের দাম কমানোর সরকারি হস্তক্ষেপের অংশ হিসেবে প্রায় তিন মাস আগে ডাল আমদানির যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেই ডাল এখনও আসেনি। ... এক মাস আগে যে মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১০৮ থেকে ১১৫ টাকা কেজি দরে, সেই ডালেরই গতকাল রোববার খুচরা বাজারদর ছিল ১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা। সূত্র জানিয়েছে, সরকারি বিক্রয়কারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে ১৫ হাজার টন ডাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। যে দেশ থেকে ডাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেই নেপাল ডাল রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। ফলে চিনির মতো এক্ষেত্রেও টিসিবি ব্যর্থ হতে পারে বলে আশংকা দেখা দিয়েছে। চিনি নিয়েও প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছিল টিসিবি। ঘোষণা দিয়েও আমদানি করতে না পারায় ৪০ টাকা কেজির চিনি এক পর্যায়ে ৭০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।’
এই প্রতিবেদন তৈরির দু-একদিন আগে প্রায় সব সংবাদপত্রে বাজারমূল্য নিয়ে দীর্ঘ দিন নীরব থাকা বাণিজ্যমন্ত্রীর একটি বক্তব্য শিরোনাম হয়েছে। তিনি বলেছেন, টিভি রিপোর্টিংয়ের কারণেই নাকি ডালের দাম বেড়েছে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সেটা কমে আসবে।’
দপ্তর পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত একামাত্র ডিম ছাড়া বাজারমূল্য নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর দেওয়া কোনো ধারণা কিংবা আশ্বাস বাস্তবায়িত হতে দেখা গেছে এমন বলা যাবে না; বরং তার দেওয়া আশ্বাসের ভিত্তিতে যেসব নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ কিছুদিন পর পণ্যটি কিনবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন তারাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলেন বেশি; বরং কাঁচা বাজারে পাঁচ-দশ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করা ক্ষুদে ব্যবসায়ীর বাজারদর-ধারণা অনেকাংশে সঠিক হয়েছে।
বড় জায়গা থেকে সরবরাহ করা ধারণা নিয়ে মার খাওয়া গরিব মানুষ
এখন মুনাফাখোর গুদামজাতকারীদের মুনাফার রেস আর অনুগ্রহের
আংটার উপর বাজারের ব্যাগ ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছেন। সেই শূন্য ব্যাগ বাতাসে দোল খাচ্ছে। কিন্তু দরিদ্র- মধ্যবিত্তের বাজারের ব্যাগ কবে পূর্ণ হবে তা কেউ বলতে পারে না।
হাজার কোটি টাকার মন্ত্রণালয়, মন্ত্রীর হুমকি-ধমকি আর টিসিবির সময় ক্ষেপন করা ব্যবসার ব্যর্থতা দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে যাওয়া মানুষ এ বিষয়ে উপরস্থ কারো কোনো আশ্বাস শুনতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। পাঁচ-দশ হাজার টাকার ক্ষুদে ব্যবসায়ীর কাছ থেকেই তো তারা সঠিক ধারণাটি পাচ্ছেন। একই সঙ্গে পাচ্ছেন তাদের এবং সরকারের অসহায়ত্বের বিচিত্র নমুনা। পরিস্থিতি দাড়িয়েছে এখন এ রকম যে, আদার ব্যাপারীরাই এখন জাহাযের খবর ভালো দিচ্ছেন। জাহাজের সওদাগরেরা ঘুমাচ্ছেন এবং ঘুম ভেঙ্গে হঠাৎ হাঁক ডাক দিলেও আদার কোনো খবর তারা দিতে পারছেন না।
জরুরি দ্রব্যের দাম কম দেখতে চায় দেশবাসী। অন্তত খামখেয়ালি কিংবা নজরদারির অভাবে অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি কেউ দেখতে চায় না। এজন্যই যেসব দ্রব্য বা পণ্য অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে আগে থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে এবং সে কারণে সাধারণ মানুষকে ভুগতে হলে দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব পালনে দক্ষতা ও আন্তরিকতা নিয়ে বড় রকম প্রশ্ন উঠবে বলে ধারণা করাই যেতে পারে। বিশেষত যেসব ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনার ত্রুটি বা বিলম্বের ফাঁকগুলো এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীকে গলাকাটা ব্যবসা করার সুযোগ করে দেয়, সেসব ক্ষেত্রে প্রশ্নটি মারাত্মকভাবেই উঠবে। এজন্য জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে
দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে ক্ষিপ্র গতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।