রবিউল আখির ১৪৩৫   ||   ফেব্রুয়ারি ২০১৪

ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

 

মেধা ও শ্রমের মূল্যায়ন

দাম্পত্য জীবনে যে সকল ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধের অভাব পরিলক্ষিত হয় পারস্পরিক সেবা ও শ্রমের মূল্যায়ন করার বিষয়টি তার মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ অভাব উভয় পক্ষেই। স্বামী যেমন স্ত্রীর দিনমানের পরিশ্রমকে মর্যাদার চোখে দেখছে না, তেমনি স্ত্রীও স্বামীর খাটা-খাটনি ও তার পক্ষ হতে প্রাপ্তির যথাযথ কদর করছে না। বলা বাহুল্য, কলহমুক্ত  ও মধুর দাম্পত্য রচনার পক্ষে এটা অনেক বড় বাধা। এর অপসারণ জরুরি। সে জন্য দরকার নিজ প্রাপ্য ও অধিকারের সীমারেখা সম্পর্কে সচেতনতা। কতটুকু আমার প্রাপ্য এবং কতটুকু নয়, তা জানা থাকলেই প্রাপ্তির যথার্থ মূল্যায়ন সম্ভব হয়। অন্যথায় সম্পূর্ণটা পাওয়ার পরও অনেক সময় মনে হয় সব বুঝি পেলাম না। কিংবা প্রাপ্যের বেশি পাওয়া সত্ত্বেও ধরে নেওয়া হয় পাওনাটুকুই পেলাম আর তখন সেই বেশিটুকুর জন্য কোন কৃতজ্ঞতার দায় বোধ থাকে না; বরং অধিকারের সীমানায় ফেলে তারও খুঁত-খামতি ধরা হয় আর এভাবে অন্যপক্ষের সৌজন্য চর্চা ও স্বতঃস্ফূর্ত সেবার করা হয় চরম অমর্যাদা।

প্রকাশ থাকে যে, সাম্প্রতিক বিশ্বে অধিকার সচেতনতার বহুমুখী প্রচারণা মানুষের ভেতর নানারকম ক্ষতিকর প্রবণতা সৃষ্টি করছে। দরকার ছিল অধিকারের সীমানা সম্পর্কেও সচেতন করা এবং অবশ্যই দায়িত্বজ্ঞানকে প্রচারণার সর্বশীর্ষে স্থান দেওয়া। কিন্তু সেদিকে বিশেষ নজর না দেওয়ায় অধিকার সচেতনতা যেন দিন দিন এক আগ্রাসী শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। একরোখা অধিকারবোধ প্রাপ্যের সীমানা উপড়ে ফেলে অনধিকার হস্তক্ষেপকেও যেন অধিকার হিসেবেই দেখছে। এর ফলে সমাজের সর্বস্তরে জুলুম-অত্যাচারের ক্রমবিস্তার ঘটছে। মানুষ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং সব রকম সুযোগ-সুবিধা সবলদের একচেটিয়া থাকার জাহিলিয়ত হাওয়া পাচ্ছে।

নিঃসন্দেহে এটা মধ্যপন্থা লংঘনেরই কুফল। লক্ষ করা হচ্ছে কেবল অধিকারের প্রতি। মনে করা হচ্ছে সব সমস্যার সমাধান এরই মধ্যে নিহিত। তাই কেবল অধিকারের বোধকেই উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। অধিকারের পরিমাণবোধ থাকছে উপেক্ষিত এবং সেই সঙ্গে দায়িত্ববোধও। এই একরোখা দৃষ্টিভঙ্গি সক্রিয় রয়েছে দাম্পত্য পরিমন্ডলেও। সুশিক্ষা ও ইসলাম চর্চার আলোবিহীন পরিবারগুলোতে এ যাবৎকাল এমনিতেও তা ছিল। সাথে যুক্ত হয়েছে তথাকথিত আধুনিকতা বা নব্য জাহিলিয়তের প্রচারণা। ফলে সে সব পরিবারে এখন এ দৃষ্টিভঙ্গির বড় বাড়বাড়ন্ত। প্রত্যেকে অধিকার বুঝে পাওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত। সে সংগ্রামে মধুর দাম্পত্য লন্ডভন্ড। তার থেকে মুক্তি পেতে হলে মধ্যপন্থাকেই একমাত্র পথ বানাতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর প্রত্যেককে মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দিতে হবে। বুঝতে হবে অধিকারের পরিমাণ এবং দাম্পত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে করতে হবে সেই বোধের চর্চা।

বলা বাহুল্য, দাম্পত্য সফরের আমীর হিসেবে এ ব্যাপারেও অগ্রণী ভূমিকা স্বামীকেই পালন করতে হবে। প্রথমে তাকেই লক্ষ রাখতে হবে স্ত্রীর প্রতি তার অধিকারের সীমানা। বা তার অধিকার ঠিক কতখানি? এর উত্তর পাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসে। তিনি ইরশাদ করেন

ألا واستوصوا بالنساء خيرا، فإنما هن عوان عندكم ليس تملكون منهن شيئا غير ذلك

শোন হে! তোমরা আমার পক্ষ হতে নারীদের প্রতি সদাচরণের উপদেশ গ্রহণ কর। তারা তো তোমাদের কাছে আটকে আছে। তোমরা তাদের কাছ থেকে এছাড়া আর কিছুর অধিকার রাখো না। (জামে তিরমিযী, হাদীস: ১০৮৩)

এটা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায় হজ্বে প্রদত্ত ভাষণের অংশবিশেষ। এতে স্বামীর অধিকার মৌলিক একটা বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তা হচ্ছে স্বামী-গৃহে স্ত্রীর অবস্থিতি। অর্থাৎ স্ত্রী তার স্বামীর কাছে থাকতে বাধ্য থাকবে। এটা স্বামীর অধিকার। কাজেই স্বামীর অনুমতি ছাড়া সে কোথাও যাবে না ও কোথাও থাকবে না। স্বামীগৃহকেই সে নিজ গৃহ মনে করবে। একেই সে আপনার ভূবন বানিয়ে নেবে এবং সুখের সংসার রচনায় স্বামীকে সহযোগিতা দান করবে।

এই মৌল অধিকারের অধীনে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আরও কিছু অধিকার জন্মায়। সে সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

والمرأة راعية في بيت زوجها وهي مسؤلة عن رعتيها

স্ত্রী তার স্বামী-গৃহের দায়িত্বশীল এবং তাকে তার এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ২৫৫৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪৮২৮) অর্থাৎ স্বামীগৃহের হেফাজত করা, মালামালের প্রতি দৃষ্টি রাখা ও সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণ করা তার দায়িত্ব। এটা কুরআন মাজীদের আয়াতেরই ব্যাখ্যা। তাতে ইরশাদ হয়েছে

حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ

অর্থাৎ আল্লাহ স্বামীদের উপর তাদের অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থানের দায়িত্ব অর্পণ করে তাদের যে হেফাজতের ব্যবস্থা করেছেন তজ্জন্য তারাও স্বামীদের অনুপস্থিতিতে ঘর-সংসার, সন্তান-সন্তুতি ও নিজ সতিত্বের হেফাজতকারিনী হবে। (নিসা : ৩৪)

অন্য এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

لا يحل لامرأة أن تصوم وزوجها شاهد إلا بإذنه، ولا تأذن في بيته إلا بإذنه

কোন নারীর জন্য তার স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ছাড়া নফল রোযা রাখা বৈধ নয় এবং স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার ঘরে কাউকে থাকতে দেওয়াও বৈধ নয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস  : ১৫৯৫)

আরেক হাদীসে আছে,

إذا دعا الرجل زوجته لحاجته فالتأته، وإن  كانت على التنور

স্বামী যখন নিজ প্রয়োজনে স্ত্রীকে ডাকবে তখন সে যেন তাতে সাড়া দেয়, যদিও সে চুলায় (রান্নার কাজে) থাকে (জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৬০; সুনানে নাসাঈ, হাদীস : ৮৯৭১)।

এসব হাদীস দ্বারা স্বামীর যে অধিকার সাব্যস্ত হয় সংক্ষেপে তা হচ্ছে (ক) স্ত্রী ঘরের মালপত্র ও সন্তান-সন্তুতির রক্ষণাবেক্ষণ করবে; (খ) স্বামীর অনুমতি ছাড়া কাউকে ঘরে থাকার অনুমতি দিবে না; (গ) বিশেষ দাম্পত্য প্রয়োজনে স্বামী যখনই ডাকবে শরঈ ওযর না থাকলে তাতে অবশ্যই সাড়া দেবে এবং (ঘ) স্বামীগৃহেই অবস্থান করবে। তার অনুমতি ছাড়া কখনও কোথাও যাবে না। ব্যস এগুলোই স্ত্রীর কাছে স্বামীর প্রাপ্য অধিকার। হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী স্ত্রীর কাছে সে এর অতিরিক্ত অন্য কিছুর অধিকার রাখে না। সুতরাং স্ত্রীর কাছে সে এর বেশি কিছুর দাবি করতে পারে না এবং এর অতিরিক্ত কিছুর জন্য তার উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে না। তার দাবিকে এরই মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। বেশি কিছু করলে সেটা স্ত্রীর এখতিয়ার। তাকে অতিরিক্ত সেবা হিসেবেই গণ্য করতে হবে। স্বামীগণ যদি তা গণ্য করত এবং স্ত্রীর বাধ্যতামূলক কাজ ও তার স্বতঃস্ফূর্ত সেবার মধ্যে পার্থক্য বিবেচনা করত তাবে দাম্পত্য জীবন অনেক বেশি মধুর হতে পারত।

আমাদের দেশে সকাল থেকে সন্ধ্যা, বরং ঘুম থেকে জাগা হতে আবার রাতের ঘুম পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময় স্ত্রীরা সাংসারিক যত কাজকর্ম করে তার কত অংশ স্বামীর অধিকারভুক্ত কাজ এবং কত অংশ তার অতিরিক্ত সে বিচার কি আদৌ করা হয় এবং করলেও শতকরা হারে তাদের সংখ্যা কতজন? অধিকাংশ পরিবারেই স্ত্রীগণ যা কিছু করে সবটাই তার দায়িত্ব ও বাধ্যতামূলক কাজ গণ্য করা হয়। ঘুম  থেকে জেগেই ঘর-দোর পরিষ্কার করা, সকালের নাস্তা-খাবারের জোগাড়-যন্ত্র করা, বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার জন্য সব রকম প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করা, তারপর সকলের কাপড়-চোপড় ধোয়া ও সব কিছু গোছগাছ করা। দুপুরের রান্নাবান্না, সকলকে খাওয়ানো, থালাবাসন পরিষ্কার করা, সন্ধ্যাকালীন চা-নাস্তা, রাতের খাবারের আয়োজন ও সব কিছু গুছিয়ে-গাছিয়ে শেষ করার পর সবশেষে শয্যা গ্রহণ। আবার এর মাঝখানে পুরোটা সময়ই স্বামী ও ছেলে-মেয়ের ফুট-ফরমাশ খাটা। শ্বশুর-শাশুড়ি থাকলে তাদের সেবা-যত্ন করা, কেউ অসুস্থ হলে তার পরিচর্যা করা এবং সকলের সব রকম নির্ভরশীলতাকে শিরোধার্য করে নিয়ে নিরন্তর তা পূরণ করে যাওয়া। মোটকথা স্ত্রী হওয়ার সুবাদে হরেক ঝক্কি-ঝকমারি নির্বিবাদে বরদাশত করে যাওয়া যেন তার অলংঘনীয় দায়িত্ব। সমাজ বাস্তবতার কারণে স্ত্রী নিজেও তাই মনে করছে এবং স্বামীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের মানসিকতা সেরকমই।

কিন্তু এসব কাজের একটিও স্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিনা তা কেউ ভেবে দেখছে না। সকলের তিন বেলার খাবার প্রস্ত্তত ও রান্নাবান্নার দায়িত্ব কি তার? এ ব্যাপারে শরীআত কী বলে? ইসলামী শরীআত তো পূর্ণাঙ্গ! এ সম্পর্কেও নিশ্চয়ই শরীআতের কোন নির্দেশনা আছে। কিন্তু সে নির্দেশনার প্রচার ও চর্চার প্রয়োজন কতটুকু বোধ করা হচ্ছে। ‘‘তোমরা ইসলামে প্রবেশ কর পরিপূর্ণভাবে।’’ (বাকারা : ২০৮) কুরআন মাজীদের এ নির্দেশ কি গোটা পরিবার-ব্যবস্থাকেও শামিল করে না? নিশ্চয়ই তা করে এবং সে নির্দেশ পালনার্থে খুঁজে দেখতে হবে এ ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা কী? এ ক্ষেত্রে তার নির্দেশনা হল

أن تطعهما إذا طعمت وتكسوها إذا اكتسيت

 তুমি যখন খাবে তাকেও খাওয়াবে এবং তুমি যখন পরবে তাকেও পরাবে (আবূ দাউদ, হাদীস ২১৪২; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৮৫০১)

এ হাদীস বলছে, স্ত্রীর খাওয়া-পরার দায়িত্ব সম্পূর্ণই স্বামীর দায়িত্বে। তার মানে এ নয় যে, খাদ্যের উপকরণ কিনে দিয়েই স্বামী খালাস হয়ে যাবে, বাকি রান্নাবান্না করে তাকে খাওয়ার উপযোগী বানানো স্ত্রীর দায়িত্ব; বরং লোকমা দিয়ে মুখে নেওয়ার উপযুক্ত খাদ্য সরবরাহ করাই স্বামীর দায়িত্ব। যেমন পোশাকের ক্ষেত্রে আমরা এ কথা বুঝি না যে, স্বামী সুতা কিনে দেবে আর স্ত্রী তা দ্বারা কাপড় বুনে পরিধানের ব্যবস্থা করে নেবে; বরং স্বামীর কর্তব্য এটাই বুঝে থাকি যে, স্ত্রীর পরিধান উপযোগী জামাকাপড়ই সে সরবরাহ করবে। বস্ত্তত খাদ্যের ব্যাপারটাও এরকমই। হাঁ এক্ষেত্রে শরীআত এই ব্যাখ্যা অবশ্য প্রকাশ করেছে যে, স্ত্রীর পিতৃ-পরিবারে মহিলাদের রান্নাবান্নার রেওয়াজ থাকলে স্বামী-গৃহে এসে রান্নাবান্না করা তার নৈতিক দায়িত্ব হয়ে যায়। কিন্তু সেটা নৈতিকতারই ব্যাপার। ইসলামী আইন-আদালত তাকে এ কাজের জন্য বাধ্য করে না আদৌ।

অবশ্য ইসলামে নৈতিকতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম মানুষকে আইনের উর্ধ্বে উঠে নৈতিকতার উপর চলতেই তার অনুসারীদেরকে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং নবী-প্রতিষ্ঠিত সমাজে রান্নাবান্নার কাজ নারীগণই আঞ্জাম দিত। আদরের কন্যা হযরত ফাতিমা রা.-কে স্বামীগৃহে পাঠানোর পর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এভাবে কাজ ভাগ করে দিয়েছিলেন যে, ঘরের ভেতরের কাজ স্ত্রী করবে আর বাইরের কাজ স্বামী। সুতরাং বর্ণনায় আছে, আটা পেষাই করতে করতে হযরত ফাতিমা রা.-এর হাতে ফোষ্কা পড়ে গিয়েছিল এবং সেজন্য হযরত আলী রা.-এর বড় আফসোস ছিল। তাই এ ব্যাপারে একজন খাদেমা পাওয়া যায় কি না, সে ব্যাপারে প্রিয়তমা স্ত্রীকে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান পিতা সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পাঠিয়েছিলেনও। সে বড় শিক্ষণীয় ঘটনা। নববী শিক্ষায় উদ্ভাসিত প্রিয় কন্যা সে লক্ষ্যে পিতার কাছে গেলেও মুখ ফুটে তা ব্যক্ত করতে পারেননি। পরে মহান পিতা জানতে পেরে নিজেই মেয়ে-জামাতার কাছে এলেন। তা কী নিয়ে আসলেন তিনি? খাদেমা নিয়ে কি? মোটেই তা নয়; বরং নিয়ে এলেন জান্নাতী সওগাত! তিনি তাদেরকে কৃচ্ছতা ধরে রাখতেই উৎসাহ দিলেন। আর শিক্ষা দিলেন, প্রতি রাতে শয্যাগ্রহণের আগে তেত্রিশবার সুবহানাল্লাহ, তেত্রিশবার আলহামদুলিল্লাহ, চৌত্রিশবার আল্লাহু আকবার পড়বে।

এটা হল ইসলামী আদর্শ ও নৈতিকতার ব্যাপার এবং এটাই ইসলামী শিক্ষার মৌল মেযাজ। আর বলা বাহুল্য, এ মেযাজের অনুসরণ সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক ব্যাপার। এর জন্য কাউকে বাধ্য করার অনুমতি শরীআত কাউকে দেয় না। কিন্তু প্রচলিত সমাজ তো বাধ্যই করছে। যদি বাধ্য না করা হত, বিষয়টাকে সম্পূর্ণরূপে স্ত্রীর এখতিয়ারের উপর ছেড়ে দেওয়া হত, সেইসঙ্গে পরিবারের সকলে মিলে ইসলামী আদর্শের চর্চা অব্যাহত রাখা হত, তবে একই রকম সেবা স্ত্রীদের নিকট থেকে পাওয়া যেত আর তা হত অত্যন্ত মাধুর্যপূর্ণ।

অনুরূপ শ্বশুর-শাশুড়ির সেবাও স্ত্রীর একটি অতিরিক্ত কাজ। এটা তার দায়িত্ব নয়। কিন্তু সমাজ বিষয়টাকে কীভাবে দেখছে? মনে করা হয় এটা তার অপরিহার্য দায়িত্ব; বরং এটিই যেন তার প্রধান দায়িত্ব। ছেলের জন্য বউ আনাই হয় শ্বশুর-শাশুড়ির সেবার জন্য। আরও সত্যি করে বললে, সমাজের বৃহত্তর অংশের ভাবনায় ঘরে পুত্রবধু আনা হয় কাজের লোক হিসেবে। এসবই পরিমিতিবোধের চরম লংঘন। বাবা মায়ের সেবা করা সন্তানের দায়িত্ব। পুত্রবধুর নয়। বধু একান্তই পুত্রের, পিতামাতার সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। হাঁ এটা ভিন্নি কথা যে, এক আদর্শস্থানীয়া বধু স্বামীর পিতামাতাকে নিজ পিতামাতার মত সম্মান ও সমীহের চোখে দেখবে। তাদেরকে মনেপ্রাণে ভালোবাসবে এবং তাদের সেবা করতে পারাকে নিজের জন্য পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার মনে করবে। বাস্তবিকপক্ষে তারা তা করেও। বিশেষত তথাকথিত আধুনিকতার অন্ধকারে যাদের মন-মানসিকতা এখনও পর্যন্ত আচ্ছন্ন হয়নি। কিন্তু সেই করাটা কতই না মধুর হত, যদি বিষয়টাকে স্ত্রীর এখতিয়ারের সীমারেখার মধ্যে রেখে দেওয়া হত এবং এটাকে তার বাধ্যতামূলক ডিউটি না বানানো হত।

এই অনুচিত বাধ্যবাধকতা কি স্ত্রীত্বের মহিমাকে ক্ষুণ্ণ করে না? আল্লাহ তাআলা যাকে পুরুষের জীবন-পরিক্রমার দোসর বানিয়েছেন অংশতঃ হলেও তাকে কেন গোটা পরিবারের সেবাদাসী করে রাখা হবে এবং কেন সে তার সেবাশ্রমের যথাযথ মর্যাদাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থাকবে? এ বঞ্চনা কি তার একার? এর দ্বারা প্রকারান্তরে স্বামী নিজেও কি বঞ্চিত হচ্ছে না? এরকম নিরবকাশ শ্রমক্লিষ্ট স্ত্রীকে স্বামী ঠিক কতখানি পায়? তার তো স্বামীকে সঙ্গ দেওয়ার কোন অবকাশ নেই। তার কোন ছুটি আছে কি? স্বামীর ঠিকই ছুটি আছে। সে কৃষক হলেও তার ছুটি আছে। তার কাজের মওসুম আছে। মওসুম শেষে তার যথেষ্ট বিরতি থাকে। শ্রমিক স্বামীদেরও সাপ্তাহিক ছুটি আছে, আছে জাতীয় ছুটি এবং আরও বিভিন্ন উপলক্ষে প্রাপ্ত অবকাশ। তা ছাড়া যারা অফিস-আদালতে কাজ করে তারাও নানারকম ছুটি ভোগ করে। কিন্তু স্ত্রীদের ছুটি কোথায়? তাদের তো বছরের তিনশ পয়ষট্টি দিনই সমান ডিউটি, নিরবচ্ছিন্ন কর্মব্যস্ততা। স্বামীদের ডিউটির দিনগুলোতেও ব্যস্ততা থাকে অফিসযাত্রা থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত। অন্যদেরও কমবেশি এরকমই, কিন্তু স্ত্রীদের কাজ শুরুও হয় আগে এবং শেষও হয় পরে। অথচ কুরআন মাজীদের ভাষ্য অনুযায়ী বিবাহের অন্যতম প্রধান লক্ষ হল

لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا

যাতে তোমরা স্ত্রীদের সান্নিধ্যে পৌঁছে (দেহমনের) প্রশান্তি লাভ করতে পার (রূম : ২১)। কিন্তু সারাদিনের কর্মক্লান্ত স্ত্রীর পক্ষে স্বামীকে প্রশান্তি যোগানো কতটুকু সম্ভব? এভাবে তাদেরকে অপরিমিত খাটানোর ফলে বিবাহের এক প্রধান লক্ষই কি ভেস্তে যায় না? তা যায় বলেই তো বহু অসংযমী স্বামী ভিন্ন পথে প্রশান্তি খুঁজে বেড়ায় আর এভাবে কেবল নিজ চরিত্রই হনন করে না, পরিবারকেও বিপর্যস্ত করে এবং সমাজকেও করে ক্লেদাক্ত।

দাম্পত্যের আরও এক প্রধান লক্ষ স্বামীর পিতৃত্ব ও স্ত্রীর মাতৃত্ব চাহিদা পূরণের মাধ্যমে মানব প্রজন্মের সুষ্ঠু সুরক্ষা। কিন্তু মধ্যপন্থা লংঘনের কারণে সেই লক্ষ্যও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা তো অনঃস্বীকার্য সত্য যে, এ লক্ষ্য পূরণে স্বামী অপেক্ষা স্ত্রীর ভূমিকা অনেক-অনেক বেশি। টানা নয় মাস তাকে গর্ভভার বহন করতে হয়। তারপর সন্তানের ভূমিষ্ঠ হওয়া থেকে শুরু হয় তার দুগ্ধদানসহ সার্বিক পরিচর্যার নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস। মানবসন্তান জগতের আর সব ছানা-বাচ্চার মত নয় যে, অতিদ্রুত সে আপন পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে; বরং সে-ই জগতের সর্বাপেক্ষা দুর্বল সৃষ্টি। দুধপানের দুই-আড়াই বছর পরও আরও কয়েক বছরের সেবাযত্নের পরই তার পক্ষে নিজে-নিজে চলা সম্ভব হয়। তার সে সযত্ন সেবার গুরুভার একা মাকেই বহন করতে হয়। সৃষ্টিগত মমতার সংশ্লেষে এ দায়িত্ব যাতে সুচারুরূপে আঞ্জাম দিতে পারে সে লক্ষ্যে তার দরকার দৈহিক ও মানসিক স্বস্তি। একটু বিরাম-একটু স্ফূর্তি। কিন্তু এত রাজ্যের ঝঞ্ঝাটের ভেতর সেই অবকাশ তার কোথায়? অধিকাংশ গৃহবধুর পক্ষে এটা আকাশ-কুসুম কল্পনা। আর স্বপ্নের সোনার হরিণের পেছনে ছুটিয়ে কর্মজীবী নারীদেরকে তো মা-শিশুর আপনার ভূবন থেকে অনেকটা অপসারণই করা হয়েছে। এসকল মায়েদের সন্তানেরা মানব শিশুর প্রাপ্য পরিচর্যা ঠিক কতটুকু পাচ্ছে? তাদের বঞ্চনা তো ভ্রুণাবস্থা থেকেই শুরু হয়ে যায়। এর ফলে তার দেহ ও মননের যে ক্ষতি হয়ে যায় তা পোষানোর কোন উপায় থাকে কি? নিঃসন্দেহে এটা কেবল সেই শিশুর নয়, গোটা প্রজন্মেরই ক্ষতি। এ ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় কেবল এই যে, মাকে তার আপন জগতে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। সেখানে তাকে স্বচ্ছন্দ বিচরণের সুযোগ দেওয়া হোক এবং তার প্রতি পরিমিতিবোধের পরিচয় দেওয়া হোক।

মোটকথা মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের দাবি হল স্ত্রীর উপর যতটুকু হক আছে স্বামীর কর্তব্য তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। এর অতিরিক্ত ব্যাপারগুলো তার উপর চাপানো ঠিক নয়। হাঁ সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা করলে ভিন্ন কথা। সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর কর্তব্য নৈতিকতাবোধ দ্বারা চালিত হওয়া। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের কাছেই পরিষ্কার থাকতে হবে কার দায়িত্ব ঠিক কতটুকু এবং তার বেশি নৈতিকতার চাহিদা কী? স্ত্রী তার নৈতিকতার ভিত্তিতে যা করবে তা রান্নাবান্না হোক, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা হোক বা অন্যকিছু, তা সে যতটুকুই করবে তাকে স্বতন্ত্র মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতে হবে এবং তাতে তার খুঁত না ধরে বরং তা কৃতজ্ঞতার সাথে নিতে হবে ও সেজন্য তাকে প্রশংসার দাবিদার মনে করতে হবে। এমনিতে প্রশংসার দাবি তো তার দায়িত্বভুক্ত কাজসমূহেও রাখে। যেহেতু তার অবস্থানটাই পুরুষ জীবনের স্বস্থি ও স্থিতির জন্য অনেক কিছু। বিশেষত পুরুষের পিতৃত্ব-তৃষ্ণা নিবারণ ও অপত্যসুখ আস্বাদনে স্ত্রীর যে ভূমিকা ও তার যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, কোন বাটখারা দিয়ে কি তার মাপজোখ সম্ভব? সুতরাং তারপরও সংসার রচনায় সে যে নিরলস ও নিরন্তর সেবা বিলিয়ে যায়, তা কতটা প্রশংসার দাবি রাখে সে কথা বলাই বাহুল্য। কাজেই সে প্রশংসাটুকু তাকে দিতে হবে। এটা ঔদার্যের ব্যাপার নয়; বরং অবশ্যকর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। বিরসমুখে কারও ইহসান-করুণা গ্রহণকে কিছুতেই মানবিক আচরণ বলা যায় না।

অতিরিক্ত সেবার জন্য প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জানালে ঘুরে ফিরে সে লাভও স্বামীর পাতেই যাবে। কেননা তাতে স্ত্রী মনে আনন্দ পাবে। তার কাজকর্মে প্রাণ আসবে। স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা বাড়তে থাকবে এবং দাম্পত্য যাত্রার যে কোন কষ্ট-ক্লেশকে হাসিমুখে বরণ করে নেওয়ার শক্তি পাবে। সংসার ভূবনে এরকম প্রাণোচ্ছল সঙ্গীনীর বিরাজ-বিচরণ কতই না সুখকর।

এটাও পরিমিতিবোধের দাবি যে, স্বামী নিজ অধিকারের সীমানা ডিঙ্গাবে না। স্ত্রীত্বের বাইরে নারীর নিজস্ব একটা বলয় আছে। মানুষ হিসেবে সে স্বাধীন। তার পৃথক ব্যক্তিত্ব আছে। তার স্বতন্ত্র বোধ-অনুভব ও রুচি-অভিরুচি আছে। তার নিজস্ব মালিকানা আছে। মাহ্রের অর্থ একান্তই তার, মীরাছী সম্পদে তার অধিকার একচ্ছত্র। সে শরীআতের গন্ডিতে থেকে জ্ঞানচর্চা করতে পারে। আয়-রোজগারেও বাধা নেই। স্বামীর অধিকার খর্ব না করে সে রোজগার ও জ্ঞানচর্চাসহ যে-কোন কাজে তার নিজস্ব সময়কে খরচ করতে পারে। এসবে স্বামীর অনুপ্রবেশ সংগত নয়। এসবই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এতে হস্তক্ষেপ তার ব্যক্তিসত্ত্বার মহিমা ক্ষুণ্ণ করে। একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষের পক্ষে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সংগীনীই মানানসই। কলের পুতুল দ্বারা আর যাই হোক সুন্দর ও সুষ্ঠু দাম্পত্য কিছুতেই রচিত হতে পারে না। কাজেই স্ত্রীর ব্যক্তিত্ব নির্মাণ ও তার বিকাশের সুযোগ থাকা চাই। স্ত্রীর সাথে তাতে স্বামীরও মঙ্গল। কেননা সত্যিকার অর্থে ব্যক্তিত্বসম্পন্না, বুদ্ধিমতি ও বিদূষী স্ত্রীই পুরুষের মানবিক সত্ত্বার সম্পূরক হতে পারে। এরকম সংগীনীর পক্ষেই সম্ভব স্বামীকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দান করা এবং দৈহিক ও মানসিক প্রশান্তিতে তাকে প্লাবিত করা। নারীর এ রূপেরই সন্ধান পাই পবিত্র হাদীছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন।

النساء شقائق الرجال

নারীগণ পুরুষদের অংশ, তাদের দোসর (জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৩)।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

 

 

 

 

 

 

advertisement