রবিউল আখির ১৪৩৫   ||   ফেব্রুয়ারি ২০১৪

নোয়াখালীর অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব আল্লামা নূরুল হুদা রাহ. : জীবন ও কর্ম

মাওলানা আবদুল কাদের সরসপুরী

গত ১০ ডিসেম্বর ১৩ বেলা ১১টায় বিদায় নিলেন বাংলাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম ও পীর, নোয়াখালীর গৌরব, চৌমুহনী ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদরাসার ৫৭ বছরের সফল মুহ্তামিম, বড় হুযুর আল্লামা নূরুল হুদা রাহ.!! কয়েক বছরের মধ্যে চলে গেছেন আরো কিছু দেশবরেণ্য উলামায়ে কেরাম।

اللهم اغفر لهم وارحمهم واكرم نزلهم ولا تفتنا بعدهم واخلف لنا خيارا منهم

হে আল্লাহ! তাঁদেরকে ক্ষমা করে দিন, তাঁদের প্রতি রহম করুন, তাঁদের সম্মানজনক মেহমানদারী করুন, তাঁদের মৃত্যুর পর আমাদেরকে কোনো ফিতনা-মুসীবতে আক্রান্ত না করুন এবং আমাদের জন্য তাঁদের উত্তম নায়েব দান করুন। আমীন।

যাঁরা হেদায়েতের নক্ষত্র স্বরূপ এবং যাঁদের অন্তরগুলো হেদায়েতের বাতি। যাঁরা ছিলেন নূরে নূরান্বিত তাঁরা চলে গেলেন আসমানে, তবে কে যমীনে উম্মাহ্কে সিরাতে মুস্তাকীমের দিশা দেবে?

তবে কি এখন নিম্নোক্ত হাদীসগুলোর বাস্তবায়ন ঘটছে?

‘‘সালেহীন বান্দাগণ একের পর এক দুনিয়া হতে চলে যাবে, আর বেঁচে থাকবে নিম্নমানের যব ও খেজুরের মতো নিকৃষ্ট-অধম মানুষগুলো। কোনো আযাব-গযব নাযিল করতে আল্লাহ তাআলা যাদের কোনো পরোয়া করবেন না।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৪৩৪)

‘‘কিয়ামতের আলামতসমূহের মধ্যে একটি এই যে, ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে এবং জাহালাত বেড়ে যাবে।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫২৩১)

‘‘আল্লাহ তাআলা আপন বান্দাদের সীনা হতে ইলমকে ছিনিয়ে নেয়ার মতো সম্পূর্ণ উঠিয়ে নিয়ে যাবেন না; বরং ইলমকে উঠিয়ে নিবেন আহলে ইলমদের রূহগুলোকে কবয করে।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস: ১০০; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৬৭৩)

আল্লামা নূরুল হুদা রাহ. ছিলেন নোয়াখালীর উর্বর মাটির ক্ষণজন্মা মহামনীষী হাদিয়ে বাঙ্গাল মাওলানা ইমামুদ্দীন রাহ., ক্বারী ইবরাহীম উজানী রাহ., মাওলানা আবদুল আযীয (জনাবওয়ালা) রাহ., মাওলানা আবদুস সুবহান (বাড়ির হুযুর) রাহ. মাওলানা নূরুল্লাহ কাসেমী রাহ., মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর সুযোগ্য উত্তরসূরী। এঁদের দাওয়াত, তালীম, ইসলাহ ও ইরশাদভিত্তিক মেহনতের উসিলায় নোয়াখালীতে দ্বীনের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, গড়ে উঠেছে দ্বীনের অসংখ্য দুর্গ, তৈরি হয়েছে বহু দাঈ, হাফেয, আলেম ও সুফী-দরবেশ। ঈমানী চেতনা ও ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছে এ অঞ্চলের মানুষ। দূরীভূত হয়েছে সর্বপ্রকার শিরক-বিদআতের অন্ধকার। সর্বোপরি সারাবিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে নোয়াখালী সানী আরব হিসেবে। শুধু নোয়াখালীতেই নয় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে; বরং বহির্বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় দ্বীন পৌঁছার এবং হাজারো দ্বীনী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পেছনে নোয়াখালীর এ পর্যায়ের আলেমদের অবদান অনস্বীকার্য।

জাতীয় পর্যায়ের আলেম

আল্লামা নূরুল হুদা রাহ. ছিলেন বাংলাদেশের প্রবীণ ও খ্যাতনামা আলেমগণের মাঝে সুপরিচিত জাতীয় পর্যায়ের একজন বর্ষীয়ান আলেম। সাহাবা-সীরাতের এবং আকাবিরে দেওবন্দের আদর্শের একটি প্রতীক। তিনি নামে যেমন ছিলেন নূর; বাস্তবেও  ছিলেন আলোকিত জীবনের অধিকারী। তিনি বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার চরশাহী ইউনিয়নের রামপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ও দ্বীনী পরিবারে ১৯২৯ ঈ. সালে জন্ম গ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর আববাজান মরহুমের তত্ত্বাবধানে নিজ এলাকাতেই করেন। নোয়াখালী ইসলামিয়া আলিয়া হতে ফাযিল এবং ঢাকা আলিয়া হতে হাদীস ও ফিকহ্ বিভাগে কামিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দারুল উলূম দেওবন্দে গিয়ে প্রথমে মাওকুফ আলাইহি কিতাবগুলো অধ্যয়ন করেন। তারপর কুতুবে সিত্তা (হাদীসের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাব) পড়ে দেশে ফিরে নিজের বাড়ির মাদরাসায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। তারপর ১৯৪৮ ঈ. সনের দিকে তৎকালীন চৌমুহনী মাদরাসার সুপার আল্লামা রশিদ আহমাদ লক্ষ্মবী রাহ. তাঁকে অত্র মাদরাসার সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৯৫৬ ঈ. সনে তিনি এ মাদরাসার সুপারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ ঈ. সনে মাদরাসাটি কওমী মাদরাসা (চৌমুহনী ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদরাসা) হওয়ার পর থেকে মৃত্যু অবধি মুহ্তামিম হিসেবে  দায়িত্ব পালন করেন। এটি নোয়াখালী জেলার প্রথম দাওরায়ে হাদীস মাদরাসা। সুতীক্ষ্ম মেধা, উস্তায ভক্তি ও সুন্দর চরিত্রের কারণে তিনি ছাত্র জীবনেও কৃতি ছাত্র এবং আদর্শ ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আকাবিরে দেওবন্দের অনুসরণে তাঁর খেদমত ও মেহনত ছিল বহুমুখী।

তাঁর শরীরের রং ফর্সা না হলেও চেহারা-সুরত ছিল মায়াবী ও দীপ্তিমান। বিশেষ করে যখন পাগড়ি,লাঠি ও রুমালে সজ্জিত হয়ে বের হতেন তখন মনে হতো নূরুন -আলা নূর। রাস্তায় চলতে নিচের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে ঝুকে ঝুকে চলতেন। আস্তে হেঁটেও দ্রুত এগিয়ে যেতেন। 

বয়সে পঁচাশি বছরের হলেও মানুষ মনে করত একশ বছরের

পূর্বের মানুষ।

বিনম্র, ভদ্র ও নিরহংকার

তাঁর চলার মাঝে ছিল গাম্ভীর্য। যে রাস্তায় তিনি চলতেন সে রাস্তাটা যেন গম্ভীর হয়ে যেত। ছোট আওয়াযে ভদ্রতার সাথে কথা বলতেন। মুচ্কি হেসে সালাম বিনিময় করতেন। প্রকৃত ইকরামের সিফাত তাঁর মাঝে ছিল। খাওয়া-দাওয়ায় ও লেবাস-পোশাকে সাদাসিধা পন্থা অবলম্বন করতেন। তিনি রসিক ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁকে দেখলে রসিক মনে হতো না। অযথা কথা বলতেন না কিন্তু মাঝে মাঝে রসালাপ করতেন। তাঁর বলা ও চলার মাঝে দাম্ভিকতা প্রকাশ পেতো না। অনেক সময় আমাদের মতো অধমদের থেকেও মাসআলা জিজ্ঞাসা করতে এবং হাদীস লিখে নিতে দ্বিধাবোধ করেননি।

তিনি যেমন আহ্লে মাদরাসার সাথে নম্র ও কোমল আচরণ করতেন, তেমনি পরিবার ও পরিজনদের সাথেও। মাদরাসা হতে কোনো দিকে যেতে এবং আবার ফিরে আসতে মাদ্রাসা সম্মুখস্থ আপন কন্যার বাসায় যেতেন। নাতি-নাতনিদের খুব আদর-সোহাগ করতেন। এমন একজন কোমলমনা ও ‘‘মাটির মানুষ’’ আজকের জগতে খুঁজে পাওয়া কঠিন।

দুনিয়াবিমুখ ও সাদাসিধে একজন মানুষ

  তিনি ছিলেন একজন আখেরাতমুখী বান্দা। বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র চৌমুহনী বাজারের উপকণ্ঠে তিনি জীবনের ৬০ বছরেরও বেশী সময় কাটিয়েছেন। বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা তাঁর খেদমতে দুআর জন্য আসত। তাঁর ভক্ত, ছাত্র ও মুরীদদের মধ্যে রয়েছে অনেক বিত্তবান মানুষ। এছাড়া বহু সময় তাঁর হাতের পাশ দিয়ে গিয়েছে অনেক সুযোগ-সুবিধা। ইচ্ছা ও ইঙ্গিত করলেই তাঁর জন্য অনেক কিছু হয়ে যেতে পারত।

এমনকি তাঁর হাতে হাদিয়া স্বরূপ যা আসত তা দিয়ে তিনি অনেক কিছু করতে পারতেন। অথচ বাড়িতে বা চৌমুহনীতে তিনি কিছু করেছেন বা এক টুকরা জমি ক্রয় করেছেন এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যাবে না। এমনকি তাঁর মাদরাসার কামরাটিও ছিল সাধারণ একটি চৌকি ও টেবিল দ্বারা সজ্জিত। নিজের জন্য আলাদা করে বাথরুমসহ একটি কামরাও তৈরি করেননি। ইন্তিকালের কয়দিন পূর্বেও আমি আমার বাড়ির এক অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাঁর হাতে ২০০/- টাকা হাদিয়া স্বরূপ দিতে চাইলে তিনি কেন যেন ‘‘মনে নাই মনে নাই’’ বলে তা গ্রহণ করলেন না। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা দুনিয়ার প্রতি এভাবে নির্লোভ থাকেন।

দৈনন্দিন আমল

তিনি কত রকম আমল করতেন তা আল্লাহ্ই ভালো জানেন; তবে দেখেছি তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশ্ত, আওয়াবীন ও যাওয়ালের ওয়াক্তের নামাযে তাঁর ইস্তেকামাত। যত গভীর রাতেই ঘুমাতেন যথাসময়ে জেগে তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত, যিকির, রোনাযারী করতেন। চাশ্তের নামায পড়ে প্রয়োজনে বাজারের দিকে গিয়ে জল্দি ফিরে আসতেন। সকালে ও সন্ধায় দরসী কিতাব মুতালাআ করতেন। সব কাজে তাঁর ছিল নিয়মতান্ত্রিকতা। তাঁর জীবন ছিল সুশৃঙ্খল।

অনেকগুণের একজন মানুষ

প্রত্যেক মনীষীই বিশেষ কোনো গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কারণে খ্যাতি লাভ করেন। এজন্যে তিনি দুনিয়া হতে বিদায় নিলে তার মতো আরেকজন পাওয়া যায় না। ‘‘প্রত্যেক ওলীর আলাদা শান থাকে।’’ কিন্তু আল্লাহ তাঁর এ ওলীর মাঝে জামেইয়্যত তথা অসংখ্য শান ও গুণের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তাঁর মত একাধারে একজন কারীম ইবনুল কারীম বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যে সুসজ্জিত  কামেল-মুকাম্মাল,  সচ্চরিত্রবান, তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন, প্রাজ্ঞ সাহিত্যিক, বিজ্ঞ ফকীহ, দক্ষ মুহাদ্দিস, মুজাবিবদ ক্বারী,  বিচক্ষণ পরিচালক, বুদ্ধিমান বিচারক, খাঁটি পীর, সাহসী মুজাহিদ, দরদী দাঈ ও ওয়ায়েয ব্যক্তির দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল।

সারা জীবন যিনি আল্লাহর স্মরণ ও দ্বীনের ফিকিরে কাটিয়েছেন, ইন্তিকালের পূর্বের দিনগুলোও যিনি যিকির, নামায ও মাদরাসার তালীমের পরিবেশে কাটিয়েছেন। এমনকি হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়ও তিনি তাঁর মাওলাকে ভুলেননি। মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও তাঁর জিহবা নড়ছে। আমি স্বীয় কান তাঁর মুখের কাছে নিয়ে শুনলাম, আল্লাহ আল্লাহ যিকির করছেন।

জানাযার নামাযের অপূর্ব দৃশ্য

গোটা দেশ যখন হরতাল-অবরোধের কারণে প্রায় অচল ঠিক সেই মুহূর্তেই আল্লাহর প্রিয় বান্দার ইন্তিকালের সংবাদে শোকের ছায়া নেমে এল। দলমত নির্বিশেষে সবাই নিস্তব্ধ ও শোকে মুহ্যমান হয়ে গেল। যানবাহনের সু-ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও এ মুবারক জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য দুর্গম ও দূরবর্তী পথ অতিক্রম করে মানুষ স্রোতের মতো ছুটে এসেছে তাঁর বাড়ির দিকে।

রাত ৮ টায় তাঁর নিজ বাড়িতেই তাঁর ছোট ভাই, হযরত মাওলানা নূরুল আমীন (দা. বা.) এর ইমামতিতে জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁর আববাজানের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।

যেহেতু দুবার জানাযার নামায শরীয়তসম্মত নয়; তাই চৌমুহনীবাসীর একান্ত আগ্রহ সত্ত্বেও তাদের ষাট বছরের বড় হুযুর তথা সর্বস্তরের মানুষের অনুসরণীয় ব্যক্তির নামাযে জানাযা দুবার পড়তে দেননি মাদরাসার উলামায়ে কিরাম।

জানাযায় কত মানুষের উপস্থিতি ঘটেছে তার সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারবে না; তবে লক্ষাধিক হওয়ার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। সবার একই কথা যে, নোয়াখালীর মাটিতে এত বড় জানাযার জামাত আর কেউ কোনো দিন দেখেনি। বহু আলেম, ছাত্র ও ভক্ত অবরোধের কারণে জানাযায় শরীক হতে না পেরে ভীষণভাবে মর্মাহত হয়েছে।

খাঁটি পীর-এর উত্তম নমুনা

তিনি ছিলেন ফুরফুরা সিলসিলার একজন পীর এবং তাঁর রয়েছে অসংখ্য মুরীদ। তিনি তাঁর আববাজান মরহুম সুফী আবদুল গনি রাহ.-এর খলীফা ছিলেন। আর তাঁর আববা ছিলেন ফুরফুরার হযরত মাওলানা আবু বকর ছিদ্দীকী রাহ.-এর অন্যতম খলীফা। উপরন্তু হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-ও তাঁকে খেলাফত দিয়েছিলেন। আববাজান মরহুমের সোহবতে থেকেই তিনি ইলম ও মারেফতের উঁচু স্তরে পৌঁছেছেন। তরীকতের সিলসিলায় তিনি ফুরফুরার পীর হলেও আদর্শগতভাবে ছিলেন দেওবন্দী। একজন কামেল বা হক্কানী পীরের মধ্যে যেসব গুণ থাকা আবশ্যক, তাঁর মধ্যে খোদার ফযলে তার সবগুলোই ছিল।

তিনি ছিলেন তাঁর আববার প্রতিকৃতি। তিনি বলতেন, আমার কাছে যদি কিছু থাকে তবে তা আববাজানের মাধ্যমে অর্জন করা। হ্যাঁ, বাস্তবিকই যুগে যুগে যারা নিজ পিতা-মাতার সান্নিধ্যে ইলমে শরিয়ত বা ইলমে মারেফাত অর্জন করেছেন- তারাই হয়েছেন যুগের সেরা মনীষী।

তাঁর বাড়ির বার্ষিক মাহফিলে ২০/৩০ হাজার লোকের সমাবেশে গেলে তা বুঝা যেত। কিন্তু তিনি ছিলেন আত্মপ্রচারবিমুখ। তাঁর ঘর বাড়ি ও খানকা ছিল শিরক-বিদআতমুক্ত এবং অনাড়ম্বর। তাঁর হাতে হাদিয়া দেওয়ার জন্য মানুষ যখন দলে দলে আসত তখন তিনি গোপন স্থানে পালিয়ে যেতেন।

তাঁর বাড়ির মাহফিলে মানুষের ঢল এবং নিজ এলাকায় তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে বিস্মিত হয়ে খতীবে আযম হযরত মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রাহ. বলেন, ‘‘বাইরের সম্মান ইয্যত পেতে আমি বহু মানুষকে দেখেছি, কিন্তু নিজ এলাকায় এমন শ্রদ্ধেয় ও গ্রহণযোগ্য মানুষ কম দেখেছি।’’

মানুষ যেন অন্তরের অন্তস্তল হতে তাঁকে শ্রদ্ধা করত। বস্ত্ততঃ তিনি ছিলেন অধুনা যথায়-তথায় ব্যবহৃত ‘‘সর্বজন শ্রদ্ধেয়’’ কথাটির যোগ্য পাত্র। এলাকায় বা বাইরে যেখানেই তাঁর যোগ্যতার কিছু বিকাশ ঘটেছে; সেখানেই দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, আলেম-আওয়াম, ব্যবসায়ী-কৃষক, এমনকি বড় বড় সরকারী অফিসার, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ নির্বিশেষে

সর্বস্তরের মানুষের কাছে ছিল তাঁর ঈর্ষণীয় গ্রহণযোগ্যতা। সবখানেই তিনি ছিলেন একান্ত শ্রদ্ধার পাত্র।

তিনি ছিলেন নিম্মোক্ত হাদীসের একটি বাস্তব উপমা- ‘‘যখন আল্লাহপাক কোনো বান্দাকে ভালবাসেন, তখন আসমানে মাকবুলিয়াতের পর যমীনে তার কবুলিয়াত রাখা হয়।’’ (সহীহ বুখারী,হাদীস: ৬০৪০)

কথিত আছে, ‘‘যোগ্য তো অনেক আছে কিন্তু গ্রহণযোগ্য মানুষ খুব কম’’। তাঁর মধ্যে কাবেলিয়াত ও মাকবুলিয়াত দুটোই ছিল। এটা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহপ্রদত্ত খাছ নেয়ামত; যা তিনি আপন খাছ বান্দাদেরকে দান করেন। উম্মতের প্রতি দরদ, খায়েরখাহী, নম্রতা, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি, খোদাভীতি ও খোদার মহববত তাঁকে এ মর্যাদায় উন্নীত করেছে। যেমন বর্ণিত আছে, ‘‘যে আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বন করে আল্লাহ তাঁর মর্যাদা উঁচু করে দেন।’’ (মুসনাদে আহমাদ,হাদীস: ১১৭২৪; সহীহ ইবনে হিববান,হাদীস: ৫৬৭৮) ‘‘মানুষের নিকট যা আছে তা হতে অনাসক্ত হও, তবেই মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে।’’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ৪১০২)

তাঁর এহেন গ্রহণযোগ্যতার বড় আরেকটি কারণ ছিল যে, তিনি মাদ্রাসার তালীম ও তরীকতের লাইনে ইসলাহী মেহনতের পাশাপাশি সার্বজনীন দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতে নিজেও যথাসাধ্য অংশগ্রহণ করতেন এবং আম-খাছ সবাইকে এ কাজে জুড়বার জন্য উৎসাহ দিতেন।

সহজাত আদীব ও ফকীহ

আরবী, উর্দু, ফার্সী এমনকি বাংলা ভাষায়ও তাঁর পান্ডিত্য ছিল। বিশুদ্ধ উচ্চারণ, বচনভঙ্গি, রচনা, বর্ণনা সবকিছুতেই তিনি ছিলেন উস্তায। তাঁর আববাজান মরহুমের পর বিশেষভাবে নোয়াখালীর শ্রেষ্ঠ আদীব, তাঁর সুযোগ্য উস্তায মরহুম মাওলানা নূরুল্লাহ কাসেমীকেই তিনি সর্বক্ষেত্রে বেশী অনুসরণ করতেন। যিনি দেওবন্দ মাদ্রাসার ছাত্র অবস্থায় বহু পরীক্ষায় আরবী কাব্যাকারে উত্তর লিখে পূর্ণ নাম্বার লাভ করেছেন এবং যিনি আমাদের হযরতের কাছে আরবীতে, উর্দুতে কবিতাকারে  চিঠি লিখতেন।

শিক্ষা-দীক্ষায় তাঁর অনুসরণীয়-অন্যান্য উস্তাযগণের মধ্যে মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ., মাওলানা এযায আলী রাহ., মাওলানা আবদুর রহমান কাশগরী রাহ. উল্লেখযোগ্য।

হাতের লেখা সুন্দর-এর পাশাপাশি তিনি নাহু-ছরফ ফাসাহাত বালাগাত তথা আদবিয়াতের খুব দক্ষ ছিলেন। যে কোন জটিল শব্দের বা জটিল ইবারতের তাহকীকী সমাধান তাঁর কাছে পাওয়া যেত। তিনি কঠিনকে সহজে বুঝিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর বুখারী, জালালাইন, ছাবয়ে মুআল্লাকাত, মুখতাছার ইত্যাদি কিতাবের দরস ছিল আকর্ষণীয়। তিনি দরসে প্রথমে উর্দুতে তাকরীর করতেন; পরে মাতৃভাষায় বুঝিয়ে দিতেন।

উর্দুভাষীরা তাঁর উর্দু কথা শুনলে তাঁকে বাংলাদেশী বলে বিশ্বাস করতেন  না। বাংলা ভাষায় তাঁর প্রাঞ্জল ও সারগর্ভ আলোচনা শুনলে আধুনিক শিক্ষিত ও সুধী সমাজ মুগ্ধ হয়ে যেত।

মাদ্রাসায় যে কোনো মাসআলা বা ইস্তেফতার জওয়াব তিনি হাওয়ালাসহ বলতে পারতেন। এজন্য মাদ্রাসার বিজ্ঞ মুফতিগণও তাঁর দিকে রুজু হয়ে তাসহীহ করাতেন। তাঁর ফিক্হী যোগ্যতা ছিল খোদা-দাদ ও সহজাত।

তিনি ছিলেন মুস্তাজাবুদ্দাওয়াত

তিনি ছিলেন আম, খাছ সবার দুআর কেন্দ্রস্থল। যে কোনো বিপদে-আপদে যখন মানুষ নিরুপায় হয়ে যেত, তখন বড় হুযুরের কাছে দুআর জন্য হাজির হত। বহু দূর থেকে মানুষ দুআর জন্য তাঁর কাছে আসত। অনেক দূরে দূরে বড় বড় মাহ্ফিলে তাঁকে  দুআর জন্য অনুরোধ করে নেওয়া হত। বহু ইস্তেসক্বার নামাযে তাঁর হাত উঠিয়ে দুআর পর বৃষ্টি বর্ষণের ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে। স্বয়ং আমি নিজেও বিভিন্ন মুসিবতের সময় তাঁর দুআ নিয়ে উপকৃত হয়েছি। তিনি নিয়মিত কোনো খোনকার বা তদবিরকারী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর সামান্য পানি পড়া, তেল পড়া নিয়ে উপকৃত হবার বহু ঘটনা আছে। অমুসলিমরাও তার কাছে এসে অনেক দুনিয়াবী সমস্যার তদবীর নিত।

দায়িত্বসচেতন পরিচালক

তিনি ছিলেন বিচক্ষণ, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, মানুষ চিনে এবং মানুষের মন-মেযাজ বুঝে চলার ও চালাবার যোগ্যতাসম্পন্ন পরিচালক। এ দায়িত্বকে তিনি একটা ক্ষমতা বা শাসনভার মনে না করে খালেস দ্বীনী খিদমত মনে করতেন। হুকুম দিয়ে বা মনে কষ্ট দিয়ে কাজ না নিয়ে তারগীব বা উৎসাহের মাধ্যমে নিতেন। উৎসাহের জন্য আকাবিরগণের কুরবানী ও দায়িত্ববোধের কথা শোনাতেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এবং আল্লাহর দরবারে জবাবদিহিতার ভয়ে কাজ করার জন্যে শিক্ষকগণকে উপদেশ দিতেন। প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও উস্তাযগণের পারস্পরিক হৃদ্যতার জন্য যা করার দরকার সে বুদ্ধি-বিবেচনা তাঁর ছিল। মাদরাসার অভ্যন্তরে কোনো ফিতনা দলাদলি বা প্রতিহিংসা সৃষ্টি না হতে পারে এদিকে দৃষ্টি রাখতেন। ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি করা বা লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে এমন কোনো কাজে জড়িত হওয়াকে পছন্দ করতেন না। মাদরাসার কালেকশনেও যেন তাদের সময় বেশি নষ্ট না হয়, এদিকেও খেয়াল রাখতেন। তাঁর মধ্যে যেমন ছিল শেখার আগ্রহ  তেমন শেখানোরও আগ্রহ ছিল।

তিনি যেসব বিষয়ে উৎসাহ দিতেন সেগুলো হচ্ছে, পারস্পরিক জোড় মহববতের খাতিরেই অপরের দোষ না দেখা, দেখলেও না দেখার ভান করা, দোষ গোপন করা, ক্ষমা করা, সামান্য গুণের উপরও প্রশংসা করা, মান-সম্মান ও কদর-কীমত বজায় রেখে কথা বলা, সালাম দেয়া, হাদিয়া দেয়া, কর্জ দেয়া, মেহমানদারী করা, বাড়াবাড়ি না করা ইত্যাদি।

সর্বোপরি সহনশীলতা, উদারতা, মহৎ গুণগুলো প্রদর্শন করে সবার সাথে চলতেন। রহমদিল ও সাদাদিলের এই মানুষটি প্রত্যেকের সাথে একান্ত আপন লোকের মত আচরণ করতেন। আর সম্ভবত এজন্যই সবাই ভাবত যে, হুযুর আমাকেই বেশি ভালবাসেন। এমন স্বভাবের লোক আরেকজন দেখেছি মাওলানা হাবীবুল্লাহ্ মিসবাহ রাহ.-কে। শিক্ষকদের কোনো দোষ বা ভুল হয়ে গেলে গোপনে ডেকে বুঝিয়ে সংশোধন করে দিতেন, সবার সামনে বলতে হলে দোষীর নাম উল্লেখ না করে বলতেন

مضى ما مضى

‘‘যা হবার হয়ে গেছে, সামনে আর যেন না হয়, খেয়াল রাখি’’

কখনো কখনো নিজে উস্তাযগণের কামরায় গিয়ে মাসিক সম্মানী দিয়ে আসতেন। প্রয়োজনে অগ্রিমও দিতেন। মনে পড়ে মাদরাসার মরহুম মুহাদ্দিস হযরত আবদুস সাত্তার রাহ.-এর কথা। তাঁর ইন্তিকালের দিন ভোরে যখন তিনি ঢাকা রওয়ানা হচ্ছিলেন, হযরত তার কামরায় গিয়ে ৮,০০০/- টাকা তাঁর হাতে দেন। মুহাদ্দিস সাহেব বললেন, এত টাকা! হযরত বললেন, নিয়ে যান প্রয়োজন হতে পারে। সে মুহাদ্দিস মরহুমের ইন্তিকালের পর তিনি বলেছিলেন, মানুষটা কত উঁচু মানের ছিলেন; এ খবর কিন্তু তাঁর নিজের ছিল না।

সমবেদনা, মহানুভবতা ও মাতৃসুলভ আচরণের কারণেই সুযোগ-সুবিধা কম হওয়া সত্ত্বেও চৌমুহনী মাদরাসার উস্তাযগণ তাঁর সোহবত ছাড়তে চাইতেন না। কষ্ট করে হলেও থাকতেন। মাদরাসার গরীব ছাত্র ও খাদিমদেরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন। তিনি ছিলেন একজন শাফীক উস্তায।

তিনি মাদরাসার ইহতিমাম ও তালীমের যিম্মাদারীকে খুব বড় আমানত মনে করতেন। মাদরাসার দায়িত্বের খাতিরে তিনি দূরে কোথাও সফরে বা মাহফিলে যেতেন না। গেলে গভীর রাতে হলেও ফিরে আসতেন। দায়িত্ববোধের কারণেই নিজ বাড়িতেও খুব কম যেতেন, গেলেও বাড়ির মাসিক হালকায়ে যিকির-এর তারিখে যেতেন। ছাত্রদের পড়ালেখার খুব তদারকি করতেন। অনুপস্থিত উস্তাযগণের কাছে হয়ত নিজে যেতেন নতুবা কাউকে পাঠিয়ে দিতেন। ছাত্র শিক্ষকগণের নিয়মিত উপস্থিতি এবং পড়ায় মাশগুলিয়াত দেখলে খুশী প্রকাশ করতেন, তা না হয় পেরেশান হতেন এবং উৎসাহ-তাগিদ দিতেন। মৃত্যুর পূর্বে খুব অসুস্থ অবস্থায়ও মাদরাসায় গিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখতেন।

মাদরাসার আয়-ব্যয় এর ব্যাপারে তাঁর ছিল খুবই আমানতদারী ও হুশিয়ারী। আর তাঁর হিসাব-নিকাশে ছিল স্বচ্ছতা। শিক্ষকদের ওযীফা সময়মত হাতে পৌঁছানোকে কর্তব্য মনে করতেন। সময়মত কাজ করা বা কাজ নেয়ার প্রতি তিনি খুব লক্ষ্য রাখতেন।

সরকারি মাদরাসাকে কওমীতে রূপান্তরিত করার বিরল দৃষ্টান্ত

তাঁর দূরদর্শিতামূলক পরিচালনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল তিনি যখন দেখলেন সরকারি মাদরাসাগুলোর পাঠ্যসূচিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে, ভবিষ্যতে আরো পরিবর্তন ও বিকৃতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তদুপরি পাঠ্যসূচির প্রভাবে তালীমের সাথে সাথে তারবিয়াতের মাঝেও অধঃপতন নেমে আসছে, তখন এ দূরদর্শী পরিচালক সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা উপেক্ষা করে মাদরাসাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে আলাদা করে ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও তাহযীব-তামাদ্দুনে হেফাযতের লক্ষ্যে আল্লাহর উপর ভরসা করে সরকারি মাদরাসাকে কওমীতে রূপান্তরিত করেন, যার দৃষ্টান্ত আজকের সময়ে বিরল।

সুনিপুণ রাজনীতিবিদ ও প্রকৃত

চিন্তাবিদ

তাঁকে একজন নিপুণ ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদও বলা যায়। আজকের যত্রতত্র ব্যবহৃত চিন্তাবিদ-এর মতো মূল্যবান শব্দটি আসলে তাঁর জন্যই মানায়। হযরত হাফেজ্জী হুযূর রাহ. যখন তাওবার ডাক দিয়ে রাজনীতির ময়দানে পদার্পণ করেছিলেন, তখন তিনি তাঁর অন্যতম পরামর্শদাতা ছিলেন। হাফেজ্জী হুযূর রাহ. তাঁর রায়কে খুব মূল্যায়ন করতেন। তিনি এক সময় খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। তিনি বলতেন, দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে এ সময়ে সর্বপ্রথম উলামায়ে কেরামের ঐক্য অপরিহার্য; কিন্তু বিষয়টি কঠিন।

হযরত হাফেজ্জী হুজুরের পরেও অনেক কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক রাহ. তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখতেন, পরামর্শ নিতেন। কোনো এক সময় আমি শাইখুল হাদীস রাহ.-এর সাথে তাঁর ঢাকাস্থ কোনো এক দফতরে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি খেলাফত আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের অতীত ও চলমান বিভিন্ন দিক নিয়ে এবং আমাদের বড় হুযুরের অতুলনীয় যোগ্যতা ও রাজনীতির ময়দানে তাঁর অবদানের কথা দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন। এ মহান ব্যক্তির মুখে হযরতের ব্যক্তিত্ব ও বহুবিধ যোগ্যতার কথা শুনে তখন আমি আমাদের হযরতকে আরো ভালোভাবে জানতে পেরেছি। তিনি ছিলেন খুব পরিণামদর্শী। যে কোনো কাজ করতেন খুব চিন্তা-ফিকির করে, যার কারণে কাজ নির্ভুল হত এবং পরিণামও ভালো হত। তাঁর চিন্তা ও দর্শন ছিল উন্নত। তাঁকে সব সময় ফিকিরমান্দ দেখা যেত।

মুখলিস ও অনলবর্ষী ওয়ায়েয

তিনি কুরআন ও হাদীস থেকে ইখলাস ও দরদের সাথে বয়ান করতেন। তিনি পেশাদার কোনো বক্তা ছিলেন না। কিন্তু যাহিরী-বাতিনী কামালাতের কারণে সবাই তাঁকে বড় বড় সম্মেলন ও তাফসীর মাহফিলের প্রধান মেহমান হিসেবে নিতে চাইত, কিন্তু তিনি এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করতেন। তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ; যাদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন। যেমন হাদীসে বর্ণিত ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পুণ্যবান খোদাভীরু ও আত্মপ্রচারবিমুখদেরকে ভালবাসেন।’’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ৩৯৮৯; মুসতাদরাকে হাকেম,হাদীস: ৪)

তবুও আগ্রহীদের পীড়াপীড়িতে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় দূরে নিকটে এমনকি চরাঞ্চলেও যেতেন; বরং শহরের বড় বড় মাহফিলের চাইতে পল্লীগ্রামের মাদরাসা-মসজিদের ছোট ছোট মাহফিলকে প্রাধান্য দিতেন এবং সেগুলোতে ২/৩ ঘণ্টাও বয়ান করতেন। একান্ত অসুস্থ অবস্থায়ও অনুরোধ করে একবার স্টেজে নিয়ে বসাতে পারলে মজলিস কাঁপানো বয়ান করতেন। বাহ্যিকভাবে কখনো দুর্বল দেখা গেলেও তিনি ছিলেন সর্বদা আধ্যাত্মিক বলে বলীয়ান মুমিন। তিনি বয়ান করতেন কখনো দারস-তাদরীসের পর্যায়ে, কখনো ইসলাহী আন্দাযে, আবার কখনো শত্রু বাহিনীর আক্রমণের ভীতি প্রদর্শন করার ভঙ্গিতে। বয়ানে কখনো তাঁর মুখ হতে যেন খোদার মারিফাতের নূর বিচ্ছুরিত হত। কখনো মাওলার ইশকের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, কখনো দরদমাখা আহ। আহলে মজলিস কী? তিনি নিজেই বেক্বারার-বেহাল হয়ে যেতেন। কোনো শ্রোতার তাঁর মজলিসে গাফিল থাকার সুযোগ ছিল না। তাঁর বয়ান ছিল-‘‘কোনো কোনো বয়ানে রয়েছে যাদুময়তা।’’ এই হাদীসের বাস্তব উদাহরণ।

তাঁর বয়ানে ছিল সামঞ্জস্য, ভাবগাম্ভীর্য, সাবলীলতা। একান্ত পাষাণদিলও তাঁর মর্মস্পর্শী বয়ানে গলে যেত এবং উপকৃত হতেন সর্বস্তরের আলেমগণ। সমালোচনামূলক আলোচনা তিনি করতেন না; কিন্তু হক কথা বলতে দ্বিধাবোধ করতেন না। মাওলানা রূমী, আল্লামা ইকবাল, আল্লামা হালী, হাফেয সিরাজী প্রমুখদের কবিতা কখনো কখনো আশেকী আন্দাযে নকল করতেন। দুঃখের বিষয় যে, তাঁর মূল্যবান বয়ানগুলো সংগ্রহ করার প্রতি কেউ কখনো লক্ষ্য করেনি। অবশ্য জীবনের শেষ সময়ের ক্যাসেটকৃত কিছু বয়ান তাঁর নাতি মাওলানা মিসবাহুদ্দীন ফাহীম-এর প্রচেষ্টায় সংগৃহীত হয়েছে এবং তাঁর ও আমাদের দুআ ও স্নেহধন্য শাগরিদে রশীদ মাওলানা সাইফুদ্দীন গাযী কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে বায়ানাতে হুদা নামে পুস্তিকাকারে ছাপানো হয়েছে। (জাযাহুমুল্লাহু খাইরান)

দাওয়াতের কাজে নিবেদিতপ্রাণ

তিনি দাওয়াতের কাজের খুব গুরুত্ব দিতেন। বিশেষ করে প্রচলিত তাবলীগের মেহনতকে একটি খালেস দ্বীনী মেহনত এবং সময়ের দাবি আখ্যা দিতেন। একসময় তিনি ৭/৮ মাস যাবত হিন্দুস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন মারকায ও এলাকায় সময় লাগিয়ে বড়দের সোহবতে থেকে এ কাজের গভীরতা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সফর থেকে ফিরে এসে তিনি দীর্ঘদিন যাবত কাকরাইলের মাদরাসায়ে দ্বীনীয়ায় শিক্ষকতা করেন। কাকরাইলের তাঁর ছাত্রগণের মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মুরুববী- আহলে শূরা হাফেয মাওলানা যুবায়ের দা. বা. অন্যতম। যিনি মরহুমের ইন্তিকালে শোকাহত হয়ে এ মর্মে দুআ করেন, আল্লাহ আমাদেরকে সবরে জামীল দান করুন এবং উম্মতের জন্যে ‘‘উত্তম স্থলাভিষিক্ত’’ দান করুন।

তিনি বলতেন, ‘‘আমি তো সবখানেই বলি, তিনটি লাইন আছে বলেই ইসলাম ও মুসলমান এখনো আছে। এক. কওমী মাদরাসা দুই. দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনত তিন. হক্কানী পীর-মুরশিদদের ইসলাহী তরীকা।’’

তিনি আরও বলতেন, ‘‘আপনারা বলেন, তাবলিগ জামাত কী করবে? এদের দ্বারা কিছু হবে না। শুনে রাখুন, ইনশাআল্লাহ! যদি কোনো ইসলামী ইনকিলাব হয়, যদি দুনিয়াতে কোনো ভালো পরিবর্তন আসে, সেটা দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে আসবে।’’

তিনি বলতেন, ‘‘দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতের বরকতে সারা বিশ্বে আজ ইসলাম নড়াচড়া দিয়ে উঠেছে। ইসলামের পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে, সে খবর আজ আমাদের নেই; কিন্তু কাফিরদের আছে। তাই তারা ষড়যন্ত্র শুরু করেছে বিভিন্নভাবে।’’

দেওবন্দের মুহ্তামিম ক্বারী তায়্যিব রাহ., শাইখুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমাদ মাদানী রাহ. প্রমুখদের মতো তিনি অধিকাংশ মজলিসে দাওয়াতের কাজের গুরুত্বের উপর কিছু না কিছু আলোচনা করতেন এবং ভক্ত, মুরীদ, ছাত্র সকলকে এ কাজে অংশগ্রহণের দাওয়াত দিতেন। তাঁর বাড়ির বার্ষিক মাহফিলে প্রতিদিন ফাযায়েলে আমালের তালীম হয় এবং লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলা মারকাযের মুরুববীদেরকে দাওয়াত দিয়ে বয়ান ও তাশকিল করানো হয়। অথচ তিনি ছিলেন একজন পীর। অন্য কোনো পীরের মাহফিলে এমন হয় কি না আমার জানা নেই। তিনি মাদরাসার ব্যস্ততার কারণে নিজে বের হতে না পারলেও মাদরাসার উস্তায-ছাত্রদেরকে ২৪ ঘণ্টার জামাতে এবং বিভিন্ন ছুটিতে কমবেশ সময় লাগানোর জন্য উৎসাহ দিতেন। এ রাস্তায় সফরের জন্য উস্তাযগণকে পূর্ণ বেতনসহ ছুটি মনযুর করতেন।

আল্লাহ্ ! তাঁকে উত্তম জাযা দান করুন এবং জান্নাতের আলা মাকাম নসীব করুন। আমীন।

نور علم ونور عرفاں ہے عجب نور الھدی * نام جیسا کام ویساکیا کرشمہ ہوگئے۔

هو النور نور الهدى أهل التقوى * لقد صدق الذي سمي بهذا.

ذکر مولی فکر امت میں گذاری زندگی * کرتے کرتے ذکر اللہ روح تن سے اڑگئی۔

 

[লেখক : মুহাদ্দিস, চৌমুহনী ইসলামিয়া মাদরাসা ও খতীব, চৌমুহনী বড় মসজিদ]

 

 

advertisement