রবিউল আখির ১৪৩৫   ||   ফেব্রুয়ারি ২০১৪

মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন : একই দিনে ঈদের বিষয় দায়িত্বশীলদের উপর ছাড়ুন-৭

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আহলে হাদীস আলিমগণের মাযহাব

এই উপমহাদেশে কিছু আলেম এমনও আছেন, যারা ইলমে ফিকহ মূলত চার মাযহাবের ফকীহগণের নিকট থেকেই গ্রহণ করেন এবং হাদীস ও শরহে হাদীস (ব্যাখ্যা)ও সাধারণত ঐ সকল মুহাদ্দিসীনের নিকট থেকে নিয়ে থাকেন, যারা ফিকহের ক্ষেত্রে কোনো না কোনো ফকীহ ইমামের অনুসারী। কিন্তু কোনো বিভ্রান্তিবশত তারা নিজেদেরকে চার মাযহাবের কোনো একটির সাথে সম্বন্ধ করা থেকে বিরত থাকেন এবং নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে পরিচয় দেন।

তাদের হাদীস অনুযায়ী আমলের পন্থা কতদূর সুন্নাহসম্মত বা সালাফের মাসলাকের সাথে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ সে প্রসঙ্গে আপাতত না গিয়ে তাদের কিছু অনুসরণীয় আলিমের সিদ্ধান্ত নকল করা মুনাসিব মনে করা হয়েছে।

1.    মাওলানা ছানাউল্লাহ আমরতসরী (১২৮৭-১৩৬৭ হি.)

তাঁর ফতোয়া-সংকলন মাওলানা মুহাম্মাদ দাউদ দারাযের তত্ত্বাবধানে দুই খন্ডে ফতোয়ায়ে ছানাইয়্যাহ’’ নামে প্রকাশিত হয়েছে, যার নজরে ছানী (নিরীক্ষণ) করেছেন মাওলানা আবু সায়ীদ শরফুদ্দীন। এ সংকলনে আলোচিত মাসআলাটিও আছে। এক প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা আমরতসরী রাহ. লেখেন, ‘‘যদি কাছাকাছি এলাকা থেকে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য পাওয়া যায় যে, চাঁদ দেখা গেছে তাহলে আপনি সে অনুযায়ী হিসাব রাখবেন, পরে একটি রোযা কাযা করবেন। আর দূরের সাক্ষ্য আপনার জন্য দলীল নয়। (ফতোয়ায়ে ছানাইয়্যাহ ১/৬৫৭)

তিনি এ-ও লিখেছেন যে, ‘‘আহলে হাদীসের কাছে দূর-দূরান্তের চাঁদ দেখা দলীল নয়। এ ফয়সালা সাহাবা-যুগেই সম্পন্ন হয়েছে।

তার ভাষায়-

اہل حديث كے نزديك دور دراز كى رويت ہلال حجت نہيں، يہ فيصلہ صحابۂ كرام كے زمانہ ميں ہو چكا ہے.

 (ফতোয়ায়ে ছানাইয়্যাহ ১/৬৬৩)

আরেক আহলে হাদীস আলেম মাওলানা আবু সায়ীদ মুহাম্মাদ শরফুদ্দীন দেহলভী লেখেন, ‘‘অন্য শহরের চাঁদ দেখা ধর্তব্য হওয়ার ক্ষেত্রে দূরত্ব অর্থাৎ মাইল নির্ধারণে কিতাব ও সুন্নাহর কোনো স্পষ্ট নস নেই। এ কারণে উলামায়ে কেরামের ইজতিহাদী সিদ্ধান্ত ও মাযহাবও এ বিষয়ে বিভিন্ন। এক্ষেত্রে ইখতিলাফে মাতালির ভিত্তিতে ফয়সালা করা ছাড়া অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নির্ভরযোগ্য নয়। ...

আলাদা উদয়স্থল এই যে, এক শহর বা স্থানে দিন আর অন্যত্র রাত। বা এক জায়গায় জোহরের সময় অন্যত্র আসর বা মাগরিবের সময়। এমন যদি হয় তাহলে ওখানের চাঁদ দেখা অন্যদের জন্য যথেষ্ট হবে না যে পর্যন্ত না তারা বা এক উদয়স্থলের অধিবাসীরা চাঁদ দেখবে। ...

সুতরাং যেখানে দুই শহরের উদয়াস্তের মাঝে তিন ঘণ্টার পার্থক্য হয় তা আলাদা উদয়স্থল বলে গণ্য হবে। আর যেখানে এর চেয়ে কম তা এ থেকে আলাদা হবে।

(ফতোয়ায়ে ছানাইয়্যাহ ১/৬৫৭, ৬৫৯, ৬৬৩-৬৬৪)

তৃতীয় আলিম মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আল আজমীর বক্তব্যও ‘‘ফাতাওয়ায়ে ছানাইয়্যাহ’’য় আছে। তিনি লিখেছেন-আহলে হাদীস আলিমগণের আমল এই যে, উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য।’’

(ফতোয়ায়ে ছানাইয়্যাহ ১/৬৭৩, মাকতাবায়ে ছানাইয়্যাহ, সরগুধা)

2.   মাওলানা আবদুল্লাহ রৌপড়ী রাহ. (আনুমানিক ১২৯৯-১৩৮৪ হিজরী)

তাঁর ফতোয়ার সংকলন প্রস্ত্তত করেছেন শায়খ আবুস সালাম মুহাম্মাদ সিদ্দীক এবং ‘‘ফাতাওয়া আহলে হাদীস’’ নামে প্রকাশ করেছেন। এ সংকলনে মাওলানা আবদুল্লাহ রৌপড়ীর বিস্তারিত ফতোয়া আছে। তিনি কুরাইবের হাদীস উল্লেখ করে লেখেন, ইমাম নববী রাহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ঐ লোকদের বক্তব্য রদ করছেন যারা বলেন, ইবনে আববাস রা. কুরাইবের বর্ণনার উপর এজন্য আমল করেননি যে, তাঁর কাছে এক সাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন-

لكن ظاهر حديثه أنه لم يرده لهذا، وإنما رده لأن الرؤية لا يثبت حكمها في حق البعيد.

অর্থাৎ ইবনে আববাস রা.-এর হাদীসের জাহিরের দাবি এই যে, সাক্ষী একজন হওয়ার কারণে নয়; বরং এ কারণে রদ করেছেন যে, দূরের লোকদের ক্ষেত্রে চাঁদ দেখার বিধান প্রযোজ্য হয় না।

ইমাম নববী যা বলেছেন ঠিক বলেছেন।

(আরো আলোচনার পর মাওলানা রৌপড়ী লেখেন) এ থেকে পরিষ্কার জানা গেল যে, সাক্ষী একজন হওয়ায় ইবনে আববাস রা. তা রদ করেননি; বরং দূরের সাক্ষ্য হওয়ায় তা রদ করেছেন। সুতরাং এ মাসআলা মজবুত হয়ে গেল যে, দূরের চাঁদ দেখা যথেষ্ট নয়। (ফতোয়ায়ে আহলে হাদীস ২/২০৯-২১১, প্রকাশক : ইদারায়ে ইহইয়াউস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যা, সরগুধা, পাকিস্তান)

সামনে রৌপড়ী ছাহেব দূরত্বের পরিমাণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন; যা তাঁর কিতাবে দেখা যেতে পারে।

3.  শায়খ আবদুর রহমান কীলানী রাহ. (১৯২৩-১৯৯৫ ঈ.)

মাকতাবাতুস সালাম তাঁর ‘‘ইসলাম কা নেযামে ফালাকিয়্যাত’’ প্রকাশ করেছে, যাতে এ বিষয়ে ইলমুল ফালাক ও ইলমুল ফিকহ উভয় দিক থেকে আলোচনা করা হয়েছে। এতে তিনি লেখেন, ‘‘পরবর্তী সময়ের কেউ কেউ উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয় মনে করেন, কিন্তু সহীহ হাদীস ও প্রথম যুগসমূহের আছার এত নির্ভরযোগ্য যে, সেগুলোর মোকাবেলায় এই ব্যক্তিদের সিদ্ধান্তের কোনো মূল্য থাকে না।

(প্রবন্ধকারের নিবেদন, এমন বলা ঠিক নয়, ইজতিহাদী বিষয়ে দলীলের আলোকে আপনি একটি সিদ্ধান্তকে অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করতে পারেন, কিন্তু দ্বিতীয় সিদ্ধান্তও যেহেতু দলীলের উপরই প্রতিষ্ঠিত এবং ইজতিহাদের গন্ডির অন্তর্ভুক্ত তাই একে মূল্যহীন বলার অধিকার রাখেন না।)

যাইহোক, মাওলানা কীলানী সামনে উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য হওয়ার দলীলসমূহের জন্য বরাত দিয়ে বলেন-

‘‘দেখুন : তিবয়ানুল আদিল্লাহ ফী ইছবাতিল আহিল্লা, শায়খ আবদুল্লাহ বিন হুমাইদ, আররঈসুল আম লিলইশরাফিদ দীনী মক্কা মুকাররমা।

এ পুস্তকের উর্দূ তরজমা করেছেন মুহাম্মাদ রফীক ছাহেব আছারী, যা আলইতিসামে ধারাবাহিকভাবে এবং মুহাদ্দিস-এ (মুহাররম-সফর ১৩৯৫ হি.) একত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এ পুস্তিকায় লেখক এ বিষয়ের সকল দিকের উপর আকলী-নকলী দলীল (যুক্তি ও বর্ণনা) দ্বারা প্রশান্তিদায়ক আলোচনা করেছেন। এ পুস্তিকা আলাদাও প্রকাশিত হয়েছে।’’

সামনে গিয়ে মাওলানা কীলানী ‘‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা গ্রহণযোগ্য হওয়ার শরয়ী দলীলসমূহ’’ শিরোনামে আলোচনা করেছেন এবং তৃতীয় নম্বরে কুরাইবের সূত্রে ইবনে আববাস রা.-এর হাদীস বর্ণনা করেছেন। এরপর চতুর্থ দলীল এ উল্লেখ করেছেন-

উদয়স্থলের বিভিন্নতা সম্পর্কে ইমাম ইবনে আবী শাইবা ‘‘আলমুসান্নাফ’’ গ্রন্থে এ আছার উল্লেখ করেছেন-

حدثنا ابن إدريس عن عبد الله بن سعيد، قال : ذكروا بالمدينة رؤية الهلال، وقالوا : أهل إستارة قد رأوه، فقال  القاسم والسالم : ما لنا ولأهل إستارة.

আবদুল্লাহ ইবনে সায়ীদ বলেন, মদীনায় চাঁদ দেখার কথা উঠল। কিছু লোক বললেন, ইস্তারাবাসী চাঁদ দেখেছে, তখন কাসিম ও সালিম উভয়ে বললেন, ইস্তারাবাসীর সাথে আমাদের কী সম্পর্ক? (আলমুসান্নাফ ৬/২৮০)

(ইস্তারা মদীনা থেকে বেশ দূরে মক্কা মুকাররমার নিকটবর্তী একটি গ্রাম। এখন তা ওয়াদী সিতারা’’ নামে পরিচিত। মক্কা থেকে এর দূরত্ব ১৮০ কিলোমিটার। টীকা, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা)

মাওলানা কীলানী বলেন, এ হাদীসগুলো থেকে পরিষ্কার জানা যায়, সাহাবায়ে কেরাম (ও তাবেয়ীন) নিজেদের অঞ্চলের সাক্ষ্যকে নির্ভরযোগ্য মনে করতেন। অন্য অঞ্চলের সাক্ষ্যের বিষয়ে তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। (ইসলাম কা নেযামে ফালাকিয়্যাত, মাওলানা আবদুর রহমান কীলানী, পৃষ্ঠা : ৭৩-৭৫)

আরো দেখা যায় : হাফেয মুহাম্মাদ সালাহুদ্দীন ইউসুফের কিতাব ‘‘মাসআলায়ে রুয়াতে হিলাল আওর বারাহ ইসালামী মাহিনে’’, পৃষ্ঠা : ১১৭-১৫৫, প্রকাশনায় : ইদারায়ে দারুস সালাম

4.    বাংলাদেশে মাওলানা আবু মুহাম্মদ আলীমুদ্দীন রাহ. (২০০১ ঈ.)-এর রিসালা-নতুন চাঁদ আল্লামা আলীমুদ্দীন একাডেমী থেকে প্রকাশিত বিদ্যমান আছে। এতে (পৃষ্ঠা : ১০-১৬) এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। এবং দূর-দূরান্তের শহর-নগরে এক জায়গার চাঁদ দেখা অন্য জায়গায় ধর্তব্য না হওয়ার সিদ্ধান্তকেই তিনি হাদীসসম্মত বলেছেন।

5.   তেমনি মাদরাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া উত্তর যাত্রাবাড়ির মাওলানা মোস্তফা ইবনে বাহরুদ্দীন-এর তত্ত্বাবধানে এ বিষয়ে একটি রিসালা প্রস্ত্তত হয়েছে, যার নাম আলকুরআন, সহীহ হাদীস, সালাফে সালেহীনের বিশ্লেষণ ও বিজ্ঞানের আলোকে পৃথিবীব্যাপী একই দিবসে সিয়াম ও ঈদ পালন প্রসঙ্গ’’। এটি তাওহীদ পাবলিকেশন্স বংশাল থেকে প্রকাশিত। এটি সংকলন করেছেন জনাব আবদুর রশীদ ইবনু আলফায।

এতে ঐ সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা হয়েছে, যা অন্যান্য আহলে হাদীস আলিমের মাসলাক।

একই মত গ্রহণ করা হয়েছে তাওহীদ পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত সৌদি আরবে চাঁদ দেখার ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী রোযা শুরু ও ঈদ উদযাপন শরীয়তসম্মত নয় পুস্তিকায়। লেখক : আবু আবদুল্লাহ আবদুর রাযযাক। এতেও শায়খ মোস্তফা কাসেমীর অভিমত রয়েছে। তেমনিভাবে আহলে হাদীস ঘরানার প্রসিদ্ধ মাসিক পত্রিকা আত-তাহরীক, আগস্ট ২০১৩ ঈ. সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ প্রসঙ্গ : সারাবিশ্বে একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ-এও একই মত গ্রহণ করা হয়েছে।

6.   উপমহাদেশের আহলে হাদীস আলেমদের সাধারণ ফতোয়ার বিপরীতে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এমন আহলে হাদীস আলেমও আছেন। যেমন হিন্দুস্তানে নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান রাহ. (১২৪৮-১৩০৭ হি.) এবং বাংলাদেশে নিকট অতীতের একজন আলেম, মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফী আলকুরাইশী (১৯০০-১৯৬০ ঈ.)।

নওয়াব সিদ্দীক হাসান রাহ.-এর লিখিত কিতাব আররওযাতুন নাদিয়্যাহয় (১/৫৩৭-৫৩৮) তিনি আল্লামা শাওকানীর অনুসরণে ইখতিলাফে মাতালের ধর্তব্য নয়-এই মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

আর মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফী-এর নামে বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস কর্তৃক প্রকাশিত ফাতাওয়া ও মাসাইল গ্রন্থে (পৃ. ১৭৬-১৮০) এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ ফতোয়া ছাপা হয়েছে, যাতে ইখতিলাফে মাতালে ধর্তব্য নয় এবং এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য-এই মতটি গ্রহণ করা হয়েছে। অবশ্য জনাব আবদুর রকীব ইবনে আলফাযের মতে এই ফতোয়াটি আবদুল্লাহিল কাফী রাহ.-এর নয়; বরং তা মূলত মাওলানা লুৎফল আলম ও মুহাম্মাদ ইসহাক আলী সরকারের। এ ব্যাপারে আমার মতামত সংরক্ষিত থাকল।

আরবের উলামা ও বিভিন্ন ফিকহ-ফতোয়া বোর্ডের ফয়সালা

অধিকাংশ আরব আলিম কোনো না কোনো মাযহাবেরই অনুসারী। কোনো আলেম সরাসরি কোনো মাযহাবের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত বা সম্বন্ধ না করলেও ফিকহ-ফতোয়া, ফিকহের কিতাব ও মাযহাব সম্পর্কে ইতিবাচক মানসিকতা পোষণ করেন। চার ইমামের প্রতি তাঁদের রয়েছে অনেক শ্রদ্ধা। আর সাধারণ মানুষের জন্য তাঁরা তাকলীদকে জরুরি মনে করেন। আলিমদের অনুসরণ ও তাদের সাথে যুক্ত থাকার জন্য উৎসাহিত করেন। তাবলীগী জামাত, আকাবিরে দেওবন্দকে গোমরাহ বলার আর মাযহাব ও তাকলীদকে গোমরাহী আখ্যা দেওয়ার যে প্রবণতা, তা সেখানের কোনো দায়িত্বশীল আলিম বা অনুসরণীয় মাশাইখের নয়। এটা মূলত কিছু অপরিপক্ক ইলমের অধিকারী আবেগপ্রবণ লোকের কাজ।

আলোচিত বিষয়ে আরবের কয়েকজন প্রসিদ্ধ শায়খের সিদ্ধান্ত উল্লেখ  করাও   মুনাসিব  মনে  হচ্ছে, ওখানে যাঁদের বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

1.       শায়খ আবদুল আযীয বিন আবদুল্লাহ বিন বায রাহ. (যুলহিজ্জাহ ১৩৩০-২৭.১.১৪২০ হিজরী)

শায়খ ইবনে বায রাহ. উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মাযহাবই গ্রহণ করেছেন। তিনি বলতেন, এ কওলই সঠিক। ‘‘মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে বায’’ (১৫/৭৪, ৮৩)-এ এ বিষয়ে তাঁর একাধিক ফতোয়া রয়েছে।

এ সত্ত্বেও শায়খ পরিষ্কার বলেছেন, এ মাসআলা ইজতিহাদী ও ইখতিলাফী। হাইআতু কিবারিল উলামার ঐ সিদ্ধান্তেও তিনি স্বাক্ষর করেছেন, যার উদ্ধৃতি এ প্রবন্ধের প্রথম কিস্তিতে দেওয়া হয়েছে। বরং তিনি এ-ও বলেছেন-

وقد ذهب جمع من أهل العلم إلى أن لكل بلد رؤيته إذا اختلفت المطالع ...، وهذا قول له حظه من القوة، وقد رأى القول به أعضاء مجلس هيئة كبار العلماء في المملكة العربية السعودية، جمعا بين الأدلة، والله ولي التوفيق.

অর্থ : এক জামাত আহলে ইলম এ দিকে গিয়েছেন যে, উদয়স্থল আলাদা হলে প্রত্যেক শহরের অধিবাসীদের জন্য নিজেদের চাঁদ দেখাই ধর্তব্য এবং এ সিদ্ধান্তেরও (দলীলের দিক থেকে) শক্তি আছে। সৌদি আরবের হাইআতু কিবারিল উলামার সদস্যগণ এ কওলই গ্রহণ করেছেন, যেন উভয় ধরনের দলীলের উপর আমল হয়। আল্লাহই তাওফীকদাতা। (মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে বায ১৫/৮৩)

যারা এ বিষয়ে প্রান্তিকতার শিকার তাদের জন্য শায়খের এ বক্তব্যে অনেক বড় শিক্ষা আছে; বরং শায়খ ইবনে বায রাহ. আরেক প্রশ্নের উত্তরে আরো স্পষ্টভাবে বলেছেন। তাঁকে কেউ জিজ্ঞাসা করেছেন, প্রতি বছর রমযানের শুরু ও শেষে বেশ অস্থিরতা দেখা যায়। মুসলিম দেশগুলোতে মতভেদ হয়-কেউ আগে ঈদ করে, কেউ পরে। এ সমস্যার সমাধান কী?

শায়খ জবাবে লেখেন-

الأمر واسع بحمد لله، ولكل أهل بلد رؤيتهم، كما ثبت عن ابن عباس رضي الله عنهما

 ‘‘আলহামদুল্লিাহ! বিষয়টিতে প্রশস্ততা আছে (এতে কোনো সংকট নেই যে, অস্থির হতে হবে) আর যেমনটা আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে প্রমাণিত যে, প্রত্যেক শহরের অধিবাসীদের জন্য আলাদা চাঁদ দেখা ধর্তব্য।’’

সামনে শায়খ বলেন, এক জামাত আহলে ইলম এ অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। সুতরাং উদাহরণস্বরূপ যদি সৌদিতে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হয় আর শাম ও মিসরের অধিবাসীরাও রোযা রাখেন তাহলে তা ভালো। কারণ হাদীসসমূহ আম ও সাধারণ। আর যদি রোযা না রাখেন বরং নিজেদের এলাকার চাঁদ অন্বেষণ করেন ও নিজেদের চাঁদ দেখা অনুসারে রোযা রাখেন তাহলেও কোনো অসুবিধা নেই। সৌদিয়ার হাইআতু কিবারিল উলামা থেকে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, ইবনে আববাস রা.-এর উপরোক্ত হাদীস এবং এর সমার্থক বর্ণনাসমূহের ভিত্তিতে প্রত্যেক শহরের অধিবাসীদের জন্য নিজেদের চাঁদ দেখা ধর্তব্য।

শায়খের আরবী ইবারতের মূল অংশ নিম্নরূপ-

فإذا ثبتت في المملكة العربية السعودية مثلاً، وصام برؤيته أهل الشام ومصر وغيرهم فحسن، لعموم الأحاديث، وإن لم يصوموا وتراءوا الهلال وصاموا برؤيتهم فلا بأس ...

 (মাজমূউ ফাতাওয়া ১৫/৮৪-৮৫)

এ বিষয়ে শায়খ ইবনে বায রাহ.-এর আরো কিছু ফতোয়া সামনে অন্য কোনো প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ।

2.      শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আলউছাইমীন রাহ. (২৭.০৯.১৩৪৭-১৫.১০.১৪২১ হিজরী)

শায়খের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, রোযা ও ঈদে যেন গোটা উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এজন্য কিছু লোক মনে করেন, শুধু মক্কা মুকাররমার মাতলা উদয়স্থলকেই বুনিয়াদ বানানো হোক। এ বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্ত কী?

তিনি যে জবাব দিয়েছেন তার সারকথা এই যে, যখন এটা স্বীকৃত যে, উদয়স্থল আলাদা হয়ে থাকে তাহলে দলীলের দাবি প্রত্যেক এলাকার হুকুম আলাদা হওয়া, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ

অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যে (রমযান) মাস পাবে সে যেন তার রোযা রাখে। (সূরা বাকারা ২ : ১৮৫)

তো এখন যদি মক্কায় চাঁদ উদিত হওয়ার কারণে মক্কাবাসীরা এ মাসে উপনীত হল আর অন্যরা তাদের অঞ্চলে চাঁদ না উঠায় উপনীত হল না তাহলে আয়াতের হুকুম তাদের জন্য কীভাবে প্রযোজ্য হবে? হাদীসে আছে, তোমরা চাঁদ দেখলে রোযা রাখবে, চাঁদ দেখলে রোযা শেষ করবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৯০৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৬৭)

তো মক্কাবাসীদের চাঁদ দেখার কারণে পাকিস্তান ও তারও পূবের লোকদের কীভাবে রোযা রাখতে বাধ্য করব? অথচ আমরা জানি যে, তাদের দিগন্তে চাঁদ ওঠেনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো রোযাকে চাঁদ দেখার সাথেই যুক্ত করেছেন।

আরো আলোচনার পর শায়খ পুনরায় বলেন, দলীলের দাবি এটাই যে, প্রত্যেক জায়গার জন্য আলাদা বিধান হবে। (মক্কার মাতলা (উদয়স্থল)-কে সব অঞ্চলের জন্য বুনিয়াদ বানানো ঠিক নয়) তাঁর আরবী ইবারতের শেষ অনুচ্ছেদ এই-

فمقتضى الدليل الأثري والنظري أن نجعل لكل مكان حكما خاصا به فيما يتعلق بالصوم والفطر، ويربط ذلك بالعلامة الحسية التي جعلها الله في كتابه وجعلها نبيه محمد صلى الله عليه وسلم في سنته، ألا وهو شهود القمر (الهلال)، وشهود الشمس أو الفجر.

 (ফাতাওয়া আরকানিল ইসলাম, শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আলউছাইমীন পৃষ্ঠা : ৪৫১, মাসআলা : ৩৯৩)

এ বিষয়ে শায়খের কিতাব ‘‘আশশরহুল মুমতি’’ লিযাদিল মুসতাকনি’’  (৬/৩০৯-৩১০) এবং ‘‘ফিকহুল ইবাদাত-এও আলোচনা আছে, যার সারকথা এই যে, তিনি ভিন্নতা ধর্তব্য হওয়ার সিদ্ধান্তকেই অগ্রগণ্য মনে করতেন। যদিও বিপরীত মতটিও তাঁর কাছে ছিল একটি দলীলভিত্তিক ইজতিহাদী মত।

ঢাকার সৌদি দূতাবাসের আলমালহাকুদ দ্বীনীর একজন কর্মকর্তার পক্ষ থেকেও শায়খের কাছে একটি প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল, তাতে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, আমাদের সঙ্গীরা তিন দলে বিভক্ত হয়েছেন : কেউ বলেন, আমরা রোযা-ঈদ সৌদিয়ার সাথে করব। কেউ বলেন, বাংলাদেশের সাথে করব। আর কারো মত হচ্ছে, (রমযানের) রোযা বাংলাদেশের সাথে রাখা হবে তবে আরাফার রোযা সৌদিয়ার সাথে। (প্রশ্নকারী : আহমদ ইবনে আলী আররূমী)

শায়খ ২৮/৮/১৪২০ হি. তারিখে এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি লেখেন, এ বিষয়ে আলিমদের ইখতিলাফ আছে যে, ঐ লোকদের জন্য, যারা অভিন্ন উদয়স্থল বা অভিন্ন শাসনের অধীনে বসবাসকারী। এ প্রসঙ্গে একাধিক মত আছে।

এরপর শায়খ তার নিজের কাছে অগ্রগণ্য মতটি উল্লেখ করার পর লেখেন-

ولكن إذا كان البلدان تحت حكم واحد وأمر حاكم البلاد بالصوم أو الفطر وجب امتثال أمره، لأن المسألة خلافية، وحكم الحاكم يرفع الخلاف، وبناء على هذا صوموا وأفطروا كما يصوم ويفطر أهل البلد الذي أنتم فيه سواء وافق بلادكم الأصلي أو خالفه، وكذلك يوم عرفة اتبعوا البلد الذي أنتم فيه.

অর্থ : কিন্তু যদি উভয় শহর (যেখানে চাঁদ দেখা গেছে আর যেখানে চাঁদ দেখা যায়নি) একই শাসনের অধীনে থাকে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে রোযা বা ঈদের হুকুম দেওয়া হয় তাহলে সে হুকুমের অনুসরণ করা জরুরি। কারণ এ মাসআলা ইখতিলাফী। আর শাসকের ফয়সালা (সংশ্লিষ্ট বিষয়ে) ইখতিলাফ (এর কার্যকারিতা) রহিত করে দেয়। (অর্থাৎ এ ধরনের ইখতিলাফী বিষয়ে শাসক কোনো এক মাসলাক অনুসারে ফয়সালা করলে অন্য মাসলাকের অনুসারীদেরও সে ফয়সালা অনুসারে আমল করা জরুরি হয়ে যায়) সুতরাং তোমরা যে দেশে থাক সেখানের অধিবাসীরা যেদিন রোযা শুরু করে তোমরাও ঐদিন শুরু করবে। আর যেদিন তারা রোযা শেষ করে তোমরাও ঐদিন শেষ করবে তা তোমাদের নিজ দেশের অনুযায়ী হোক বা না হোক। একইভাবে আরাফার দিনের ক্ষেত্রেও ঐ দেশের অনুসরণ করবে যেখানে তোমরা থাক। (মাজমূউ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল ১৯/৪০-৪১; আলইজায ফী বাযি মাখতালাফা ফীহিল আলবানী ওয়াবনু উছাইমীন ওয়াবনু বায ২/৫০১-৫০২)

ফতোয়াটি (পূর্ণ আরবী মতনসহ) শায়খ মুস্তাফা ইবনে বাহরুদ্দীনের তত্ত্বাবধানে প্রস্ত্ততকৃত কিতাবেও ছাপা হয়েছে। পৃথিবীব্যাপী একই দিবসে সিয়াম ও ঈদ পালন প্রসঙ্গ। (দ্র. পৃষ্ঠা : ৭৯-৮১)

3.     শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে জিবরীন (১৩৫৩ হি.-২০ রজব ১৪৩০ হিজরী)

লোকেরা কি সৌদিয়ার চাঁদ অনুসারে রোযা ও ঈদ করবে, না নিজেদের ভূ-খন্ডের চাঁদ দেখা অনুসরণ করবে-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন-

هذه المسألة خلافية ...، الراجح القول الثاني : وهو أن لكل أهل بلد رؤيتهم إذا كان هناك مسافة بين البلدتين يمكن أن لا يرى في البلدة الأخرى، وهذا ما عليه العمل، وبالله التوفيق.

এ বিষয়ে ইখতিলাফ আছে। অগ্রগণ্য সিদ্ধান্ত এই যে, প্রত্যেক অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য নিজেদের চাঁদ দেখাই অনুসরণীয় যদি দুই অঞ্চলের মাঝে এ পরিমাণ দূরত্ব হয় যে, (এক জায়গায় চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়া সত্ত্বেও) অন্য জায়গায় দৃষ্টিগোচর না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ সিদ্ধান্ত অনুসারেই আমল চলছে। (ফাতাওয়াস সিয়াম, ইবনে জিবরীন, পৃষ্ঠা : ২৬-২৭; ফাতাওয়া রমাদান ফিস সিয়াম ওয়াল কিয়াম ..., সংকলন : আবু মুহাম্মাদ আশরাফ ইবনে আবদুল মাকসূদ ১/১০৬)

4.    শায়খ সালেহ আলফাওযান, হাফিযাহুল্লাহু ওয়া রাআহু

আরবের শায়খগণের মাঝে তাঁর অবস্থানও উল্লেখযোগ্য। হাইআতু কিবারিল উলামার সদস্য। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল : সৌদিয়ায় শনিবারে রোযা শুরু হল আর আলজাযাইরে রবিবারে। এখন আলজাযাইরের কোনো অধিবাসী যদি সৌদিয়ার সাথে রোযা শুরু করে তাহলে তা জায়েয হবে কি না? অতপর তিনি ঈদ করবেন কাদের সাথে? সৌদিয়ার সাথে করলে সমস্যা এই যে, তার দেশে ঐদিন রোযা চলছে্ আর সেদিন রোযা রাখলে সমস্যা এই যে, যাদের সাথে তিনি রোযা শুরু করেছিলেন তারা এদিন ঈদ করছে!

শায়খ সালেহ উত্তরে বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته

এ হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা ফরয হওয়াকে চাঁদ দেখার সাথে যুক্ত করেছেন। আর আলিমদের দুই কওলের মাঝে সহীহ কওল অনুসারে উদয়স্থলের ভিন্নতার কারণে চাঁদের বিধান ভিন্ন হয়। যেহেতু আলজাযাইরের উদয়স্থল নিঃসন্দেহে সৌদিয়ার উদয়স্থল থেকে আলাদা তাই প্রত্যেক ব্যক্তি যে ইকলীম ও যে শহরে অবস্থান করছে সেখানের লোকেরা যখন চাঁদ দেখবে তখন তাদের সাথে রোযা রাখবে এবং তাদের সাথেই ঈদ করবে। এ কারণে আপনার হুকুম ঐ সকল মুসলমানের মতোই, যেখানে আপনি অবস্থান করছেন। আলজাযাইর হোক বা অন্য কোনো শহর। আপনি তাদের সাথেই রোযা রাখবেন এবং তাদের সাথেই ঈদ করবেন।

আরবী ইবারতের মূল অংশ এই-

فعلق صلى الله عليه وسلم وجوب الصيام برؤية الهلال، وذلك يختلف باختلاف المطالع على الصحيح من قولي العلماء ...، فكل إنسان يصوم مع أهل الإقليم وأهل البلد الذي هو فيه إذا رأوا الهلال ويفطر معهم، فأنت حكمك حكم المسلمين الذين تسكن معهم ... .

 (মাজমূউ ফাতাওয়াশ শায়খ সালিহ আলফাওযান ১/৩৮৭)

আরো দেখুন : আলমুনতাকা মিন ফাতাওয়াশ শায়খ সালেহ আলফাওযান ৩/১২৪; মিন ফাতাওয়াল উলামা ফিস সিয়ামি ওয়াল কিয়াম, ইশরাফ, মুসা ইউনুস, পৃষ্ঠা : ৬০

5.      সৌদি আরবের হাইআতু কিবারিল উলামার সিদ্ধান্ত প্রবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। শায়খ ইবনে বায রাহ.ও নিজ ফতোয়ায় এর বরাত দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, (দলীলের দিক থেকে) এই সিদ্ধান্তে গৃহীত মাসলাকেও শক্তি আছে; বরং এ কওলের উপর আমল করা হলে এ মাসআলার সাথে সংশ্লিষ্ট উভয় মাসলাকের দলীলের উপর আমল হবে।

6.      সৌদি আরবের মানুষের দ্বীনী প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য একটি জাতীয় ফতোয়া বোর্ড আছে, যার নাম আললাজনাতুদ দাইমা লিল বুহুছিল ইলমিয়্যাতি ওয়াল ইফতা। ফিকহ-হাদীস ও অন্যান্য ইলমের মাহির ব্যক্তিবর্গ এ বোর্ডের সদস্য হয়ে থাকেন, যারা গ্রান্ড মুফতীর অধীনে কাজ করেন। এ বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়াসমূহের একটি বড় সংকলন মুদ্রিতও আছে। ওখান থেকে একটি ফতোয়ার সারসংক্ষেপ উল্লেখ করছি।

বোর্ডকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমরা রেডিওতে সৌদিয়ায় রোযা শুরু হওয়ার সংবাদ শুনি অথচ আমাদের এখানে আইভরি কোস্ট, গিনি, মালি ও সেনেগালে খুব গুরুত্বের সাথে চাঁদ খোঁজার পরও কোথাও চাঁদ দেখা যায়নি। এ কারণে আমাদের মাঝে মতভেদ হয়ে যায় : কিছু লোক তো সৌদিয়ায় রোযা শুরু হওয়ার সংবাদ শুনে রোযা শুরু করেন। আর অধিকাংশ লোক আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-

فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ

এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী-

صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته

এর উপর আমল করে নিজেদের এলাকায় চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার অপেক্ষা করেন। এখন দুই দলের মাঝে খুব বিবাদ হচ্ছে। অনুগ্রহ করে আমাদের ফতোয়া দিবেন।

বোর্ডের পক্ষ হতে যে ফতোয়া দেয়া হয়েছে তার সারসংক্ষেপ এই :

এটি একটি ইজতিহাদী বিষয়। এ কারণে আলিমদের মধ্যে ইখতিলাফ হয়েছে : প্রত্যেক দল কিতাবুল্লাহ, সুন্নাহ ও কিয়াস দ্বারা দলীল দিয়েছেন; বরং এমনও হয়েছে যে, উভয় দল একই নস দলীল হিসেবে উল্লেখ করেছে। যেমন নিম্নোক্ত নসগুলো-

  فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْه يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ ও অন্যান্য।

صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته

 (এই নসগুলো উভয় দলই দলীল হিসেবে পেশ করেছে।)

এটা এ কারণে যে, ইজতিহাদী মাসআলাসমূহে নস বোঝা ও তা থেকে হুকুম বের করার মাঝেও মতভেদ হয়। তবে এ মতভেদ মন্দ প্রভাব থেকে মুক্ত। কারণ প্রত্যেকের উদ্দেশ্য ভালো ছিল (কর্মপন্থা সঠিক ছিল) এবং প্রত্যেক মুজতাহিদ অন্য মুজতাহিদের ইজতিহাদকে মূল্য দিতেন।

সুতরাং যখন ফিকহের পূর্বের ইমামদের মাঝে এ বিষয়ে ইখতিলাফ হয়েছে এবং প্রত্যেকের কাছে দলীল আছে এ কারণে আপনাদের কর্তব্য, যখন আপনাদের কাছে অন্য উদয়স্থলে চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়া প্রমাণিত হবে তখন আপনারা নিজে এতে হস্তক্ষেপ করবেন না; বরং একে আপনাদের রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলের উপর ছেড়ে দিবেন। তারা রোযার ফয়সালা করুন বা সেদিন রোযা শুরু না করার সিদ্ধান্ত নিন উভয় অবস্থায় আপনার জন্য তাদের আনুগত্য করা ফরয। কারণ এ ধরনের মাসআলায় শাসকের ফয়সালা ইখতিলাফের সমাপ্তি ঘটায়।

এ পদ্ধতি অনুসরণ করলে আপনাদের পরস্পর কোনো বিবাদ থাকবে না। বরং ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন এবং নবী পাক ও তার আল ও আসহাবের উপর রহমত নাযিল করুন।

আবদুর রাযযাক আফীফী, নায়েবে রঈস

আবদুল্লাহ ইবনে মানী, সদস্য

আবদুল্লাহ ইবনে গাদায়ান, সদস্য।-ফাতাওয়াল লাজনাতিত দায়িমা ১০/৯৬ 

7.      রাবেতাতুল আলামিল ইসলামীর অধীনে নতুন-পুরাতন মাসাইলের তাহকীকে নিয়োজিত মজলিস, যার নাম আলমাজমাউল ফিকহিল ইসলামী মক্কা মুকাররমা এবং সংক্ষেপে যাকে মাজমাউ মক্কা বলা হয়, এর চতুর্থ দাওরায় (ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ ঈ.) চাঁদের ঐক্য বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, যার মূল অংশ আলকাউসারের শাওয়াল ১৪৩৪ হি. সংখ্যায় উদ্ধৃত হয়েছে সেই সিদ্ধান্তেই ইখতিলাফুল মাতালি উদয়স্থলের বিভিন্নতার প্রসঙ্গটিও আলোচনায় এসেছে এবং ঐ সিদ্ধান্তে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, মাজমা উদয়স্থলের বিভিন্নতার প্রসঙ্গটির উপর দিরাসাহ (গবেষণা) করেছে এবং উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য হওয়ার মাসলাকটিই তাঁরা গ্রহণ করেছেন। তাদের বক্তব্য, এতে মুকাল্লাফদের জন্য সহজতাও আছে। আর কিয়াসের দাবিও তা-ই। আর এর পক্ষে শরয়ী দলীলও রয়েছে।

لقد درس المجمع الفقهي الإسلامي مسألة اختلاف المطالع، ...، ففي مسألة الأهلة ذهب إلى إثباتها بالرؤية البصرية ...، كما ذهب إلى اعتبار اختلاف المطالع، لما في ذلك من التخفيف على المكلفين، مع كونه هو الذي يقتضيه النظر الصحيح، فما يدعيه القائلون من وجوب الاتحاد في يومي الصوم والإفطار مخالف لما جاء شرعا وعقلا ...

وكثير من كتب أهل المذاهب الأربعة طافحة بذكر اعتبار اختلاف المطالع، للأدلة القائمة من الشريعة بذلك، وتطالعك الكتب الفقهية بما يشفي العليل ...

 (কারারাতুল মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী, মক্কা মুকাররমা, পৃষ্ঠা : ৮৭-৮৮)

শাওয়ালের সংখ্যায় গোটা মুসলিম জাহানের ঐ সকল আকাবির ও মাশাইখের নামও উল্লেখ করা হয়েছে, যারা এ সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করেছেন।

8.      এদিকে মিসরের কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার ফতোয়া-সংকলনে বলা হয়েছে যে, অগ্রগণ্য মত এই যে, উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়। এ-ও বলা হয়েছে যে, ১৩৮৬ হি. মোতাবেক ১৯৬৬ ঈ. তে আলআযহারের মাজমাউল বুহূসিল ইসলামীর পক্ষ হতে যে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে এ ফয়সালাই হয়েছে।

একারণে ঐ ফতোয়ায় লেখা হয়েছে-

متى تحققت رؤية هلال رمضان في بلد من البلاد الإسلامية فإنه يجب الصوم على جميع المسلمين الذين تشترك بلادهم مع البلد الإسلامي الذي ثبتت فيه الرؤية في جزء من الليل، ما لم يقم ما يناهض هذه الرؤية ويشكك في صحتها، امتثالا لقوله تعالى : فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ، والحديث الشريف : صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته.

অর্থ : কোনো ইসলামী শহরে রমযানের চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে যত শহর ঐ শহরের সাথে রাতের কোনো অংশে শরিক ঐসকল শহরে অবস্থানরত মুসলমানদের উপর রোযা ফরয হয়ে যাবে। যদি না এমন কোনো বিষয় সামনে আসে, যা এই চাঁদ দেখার বিশুদ্ধতাকে সংশয়যুক্ত করে দেয়। এ বিধান আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-

فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ

ও হাদীসের হুকুম-

صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته

-এর কারণে। (আলফাতাওয়াল ইসলামিয়া ২০/৭৪৪৬-৭৪৫০, আওকাফ মন্ত্রণালয়, মিসর)

তো মিসরের কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার সিদ্ধান্ত এই যে, যে সকল শহর চাঁদের শহরের সাথে (যে শহরে চাঁদ দেখা গেছে) রাতে শরিক নয় এখানে চাঁদের ফয়সালা হল আর ওখানে সুবহে সাদিক, তো তাদের জন্য এ চাঁদ দেখা প্রযোজ্য নয়। এর অর্থ, যে এলাকায় চাঁদ দেখা গেল সেখানে চাঁদের ফয়সালা হতে হতে যেসব এলাকায় সুবহে সাদিক হয়ে যায় সেখানে এ চাঁদ দেখা ধর্তব্য হবে না; বরং এর দাবি তো এ-ও যে, ঐ অঞ্চলে চাঁদের ফয়সালা হওয়ার পর যেসব অঞ্চলের অধিবাসী সহজভাবে সাহরী ও নিয়ত করার সময় পাবেন না তাদের জন্যও এ চাঁদ দেখা প্রযোজ্য হবে না। যেমনটা কুয়েতের দারুল ইফতার ফতোয়ায় স্পষ্ট বলা আছে।

এখান থেকে বোঝা গেল, যে আলিমগণ উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয় মনে করেন তাদের কাছেও এ হুকুম এত ব্যাপক নয় যে, চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার সময় যে সকল অঞ্চলে সুবহে সাদিক হচ্ছে বা হয়েছে তাদের জন্যও তা প্রযোজ্য হবে। সামনে এ বিষয়ে আরো আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।

9.    কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা, কুয়েত

এই দারুল ইফতার ফতোয়ার সংকলনও মুদ্রিত ও প্রকাশিত। তা থেকে দুটি ফতোয়ার সারসংক্ষেপ তুলে ধরছি :

প্রথম ফতোয়াটি লেখা হয়েছে উত্তর আমেরিকার কোনো এক এলাকার মুসলিম অধিবাসীদের প্রশ্নের উত্তরে। ওখানে একটি মুসলিম সংগঠন আছে এবং সে সংগঠনের একটি হেলাল কমিটিও আছে। কোনো রমযানে আরব দেশগুলোতে চাঁদ দেখার ভিত্তিতে মঙ্গলবারে ঈদের ঘোষণা হয়। কিন্তু আমেরিকার ঐ এলাকার কমিটি সেখানে চাঁদ দৃষ্টিগোচর না হওয়ার কারণে মঙ্গলবার ত্রিশ রমযান ঘোষণা করে। এখন ঐ শহরের অধিবাসী কিছু আরব আরবের চাঁদ দেখা অনুযায়ী মঙ্গলবার ঈদ করেন। অন্যরা করেন ঐ শহরের অধিবাসীদের সাথে। এ প্রেক্ষাপটে যে প্রশ্ন কুয়েত ফতোয়া বোর্ডের সামনে উত্থাপিত হয় এর জওয়াবে তাঁরা লেখেন-

এ বিষয়ে আলিমদের দুটি সিদ্ধান্ত আছে :

ক. উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য এবং এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকায় অবশ্যঅনুসরণীয় নয়।

খ. যে কোনো ইসলামী শহরে চাঁদ দেখা গেলে সে অনুযায়ী সকল মুসলিমের আমল করা জরুরি যদি চাঁদ দেখার ইলম (সংশয়হীন অবগতি) লাভ হয়।

উভয় মতের পক্ষেই দলীল আছে। কুয়েতের ফতোয়া বোর্ড (‘‘আলহাইআতুল আম্মাহ লিলফাতাওয়া’’) দ্বিতীয় মতটিকে প্রাধান্য দেয় যেন রোযা ও ঈদে ঐক্য সম্ভব হয়। বোর্ড মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে আশা রাখে যে, তাঁরা এ মতের উপর আমল করার জন্য সংশ্লিষ্ট স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

وتأمل الهيئة العامة للفتوى بالكويت من زعماء المسلمين اتخاذ الإجراءات اللازمة للعمل بهذا الرأي مع ملاحظة ما لا بد منه من الضوابط العلمية المسلمة.

কুয়েত কেন্দ্রীয় ফতোয়া বোর্ড উপরের ফতোয়ায় তাদের সিদ্ধান্ত বর্ণনার পর তৎক্ষণাৎ নিম্নোক্ত নোট লেখেন-

ولكن لما كان العمل في البلاد الإسلامية جاريا على الرأي الأول وهو اختلاف المطالع، وأن لكل بلد رؤيته، فترى الهيئة العامة للفتوى بالكويت أنه ينبغي على المسلمين في أمريكا الشمالية اتباع اللجنة المشكلة من جماعة المسلمين هناك، وأنه ينبغي طاعتها في هذا الأمر وسائر ما فيه مصلحة المسلمين، لأنه تقوم بالنسبة لمسلمي أمريكا مقام الهيئات الدينية الرسمية في البلاد الإسلامية، والله أعلم.

এই নোটের সারকথা এই যে, যেহেতু এখন পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলোতে প্রথম মাসলাকের উপরই আমল চলছে, অর্থাৎ উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য হওয়া এবং প্রত্যেক অঞ্চলে নিজ নিজ চাঁদ দেখা অনুসরণ করা, এ কারণে কুয়েত ফতোয়া বোর্ডের সিদ্ধান্ত এই যে, উত্তর আমেরিকার মুসলিমদের উপর এখন মুসলিম সংগঠনের পক্ষ হতে নির্ধারিত কমিটির আনুগত্য করা জরুরি।

(মাজমূআতুল ফাতাওয়াশ শরইয়্যাহ, কুয়েত, ওযারাতুল আওকাফ ৩/৬৫-৬৬)

দ্বিতীয় ফতোয়াটি লেখা হয়েছে আর্জেন্টিনা থেকে প্রাপ্ত একটি প্রশ্নের উত্তরে। এতে বলা হয়েছে, যে শহরে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হয়েছে তার ইকলীমে যত শহর আছে এবং যে সকল শহর-নগর দ্রাঘিমা রেখায় শরিক এবং যেসব শহর এর পশ্চিমে অবস্থিত তাদের উপর এ চাঁদ দেখা অনুযায়ী আমলা করা জরুরি। আর যেসকল শহর চাঁদের শহরের পূর্ব দিকে অবস্থিত তাদের হেলাল কমিটির জন্যও ঐ চাঁদ দেখা অনুসারে ফয়সালা করার অবকাশ আছে, যদি এ শহর চাঁদের শহরের সাথে (অর্থাৎ যে শহরে চাঁদ দেখা গেছে) রাতের কোনো অংশে শরিক হয়। তবে ঈদের চাঁদের ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, তাদের ২৯ রোযা পুরা হতে হবে। আর রমযানের চাঁদের ক্ষেত্রে শর্ত এই যে, তাদের এলাকায় যখন পশ্চিমের ঐ শহরের চাঁদ প্রমাণিত হচ্ছে তখন রাতের এ পরিমাণ সময় অবশিষ্ট থাকতে হবে যে, বিনা সংকটে সাহরী করার ও সুবহে সাদিকের আগে নিয়ত করার সুযোগ থাকে।

আরবী পাঠের একটি অংশ এই-

...، وأما البلاد التي تقع على جهة الشرق من ذلك الإقليم وتشترك مع إقليم الرؤية في جزء من الليل، فإن لهيئة الرؤية في ذلك الإقليم أن تأخذ بتلك الرؤية في الإفطار من رمضان مطلقا إذا أتموا تسعة وعشرين يوما ...، وكذلك في دخول شهر رمضان إذا علموا بالرؤية وقد بقي من الليل عندهم ما يكفي لتبييت النية مع السحور دون ضيق.

 (মাজমূআতুল ফাতাওয়াশ শরইয়্যাহ কুয়েত, ওযারাতুল আওকাফ ৪/৮৫-৮৯)

দ্বিতীয় ফতোয়া থেকে দুটি বিষয় সামনে এল :

 ক) কোনো শহর যদি চাঁদের শহর থেকে এত দূরবর্তী হয় যে, ওখানে যখন চাঁদের ইলম হচ্ছে তখন এখানে হয়তো সুবহে সাদিক হয়ে গেছে বা রাতের এত সামান্য অংশ বাকি আছে যে, এ সময়ের মধ্যে শান্তভাবে সাহরী করা যায় না। তাহলে এ শহরের অধিবাসীদের নিজেদের চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করা উচিত। কুয়েত ফতোয়া বোর্ড সাধারণত উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয় ঘোষণা করলেও উপরোক্ত ক্ষেত্রে তারাও উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য মনে করেন।

খ) যে ফকীহগণ এ কথা বলেন যে, এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য ধর্তব্য তাদের উদ্দেশ্য এই নয় যে, কেউ কোনো শহরে চাঁদের খবর দেখল বা শুনল অমনি সে তার সঙ্গীদের নিয়ে রোযা ও ঈদ করবে; বরং উদ্দেশ্য এই যে, সংশ্লিষ্ট অথরিটি অর্থাৎ সরকার বা সরকারের পক্ষ হতে নির্ধারিত হেলাল কমিটি এই চাঁদ দেখার ইতিবার করে চাঁদের ফয়সালা করবে। এটি জনসাধারণের কাজ নয়, দায়িত্বশীলদের কাজ। সাধারণ জনগণের কর্তব্য দায়িত্বশীলদের আনুগত্য করা।

কুয়েত ফতোয়া বোর্ডসহ অন্যান্য বোর্ড এবং অন্যান্য ফকীহ ও মুহাদ্দিসের এই ফয়সালা আলাদা শিরোনামে আরো কিছু স্পষ্ট বরাতসহ সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ।

10. মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী (জিদ্দা ফিকহ একাডেমী)

সফর ১৪০৭ হিজরী (মোতাবেক অক্টোবর, ১৯৮৬ ঈ.)-এর ওমানে অনুষ্ঠিত মাজমাউল ফিকহিল ইসলামীর মজলিসে এ মাসআলা আলোচিত হয়েছে। তাতে যে ফয়সালা হয় তা মাজমার মাজাল্লার বর্ণনা অনুযায়ী নিম্নরূপ :

إذا ثبتت الرؤية في بلد وجب على المسلمين الالتزام بها ولا عبرة لاختلاف المطالع، لعموم الخطاب بالأمر بالصوم والإفطار.

অর্থ, যে কোনো শহরে চাঁদ প্রমাণিত হলে সে অনুযায়ী সকল মুসলিমের আমল করা জরুরি। উদয়স্থলের ভিন্নতার কোনো ইতিবার নেই। কারণ (চাঁদ দেখা গেলে) রোযা রাখা এবং (চাঁদ দেখে) রোযা শেষ করার বিষয়ে যে বিধান (হাদীসে এসেছে) তা আম বা সাধারণ। (মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী, তৃতীয় দাওরা, তৃতীয় সংখ্যা, ২/১০৮৫, মুদ্রণ ১৪০৮-১৯৮৭)

মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী এখানে ঐ ফকীহগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যাদের মাসলাক, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়। এটি বিস্তারিত দিকনির্দেশনাহীন এক সংক্ষিপ্ত সিদ্ধান্ত। এতে এ ফয়সালা অনুসারে আমলের উপায় ও নীতিমালা সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। তেমনি উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার ভিত্তিতে রোযা ও ঈদে একতাবদ্ধতাকে ফরযও বলা হয়নি। অথচ আমাদের এখানের কিছু গায়রে আলিম লেখক মাজমাউল ফিকহিল ইসলামীর এ সংক্ষিপ্ত ফয়সালাকে এ কথার সমার্থক মনে করেছেন যে, মাজমা এখন সকল মুসলিমের উপর রোযা ও ঈদের একতাকে ফরয হওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। আর তারা একে শুধু মাজমার ফয়সালা নয়; বরং সরাসরি মুনাযযামাতুত তাআউনিল ইসলামী (পুরোনো নাম মুনাযযামাতুল মুতামারিল ইসলামী) ওআইসির সিদ্ধান্ত সাব্যস্ত করেছেন। তাদের উভয় কথাই ভুল। সামনে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।

সারসংক্ষেপ

উপরোক্ত সকল আলোচনার সারসংক্ষেপ এই দাঁড়াচ্ছে যে, এ বিষয়টি যেমন আগের যুগের চার মাযহাবের ফকীহদের মাঝে মতভেদপূর্ণ ছিল তেমনি এ যুগের ফকীহদের মাঝেও মতভেদপূর্ণ। এমন নয় যে, বর্তমান যুগে এসে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার বিষয়ে আলিমগণের ইজমা হয়েছে।

উপরের আলোচনা মনোযোগের সাথে পড়া হলে সম্ভবত আরো স্পষ্ট হয়েছে যে, পূর্ববর্তী-পরবর্তী ও সমসাময়িক ফকীহগণের অনেক বড় জামাত বরং বলতে গেলে তাদের অধিকাংশই দূর-দূরান্তের শহর-নগরে এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলে অবশ্য-অনুসরণীয় না হওয়ার দিকেই রয়েছেন। আরব উলামা ও আহলে হাদীস আলিমগণেরও অধিকাংশই দলীলের দিক থেকে এ কওলকেই অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করেছেন।

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, উপরের নিবেদনসমূহ থেকে স্পষ্টভাবে সামনে আসে। তা হচ্ছে এ ধারণা করা যে, যে ফকীহই উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয় মনে করেন তিনিই সারা বিশ্বে রোযা ও ঈদ এক করার প্রবক্তা-একান্তই ভুল। এ দুই বিষয় পরস্পর সংযুক্ত নয়। উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়া আর ঈদ ও রমযানের ঐক্য জরুরি হওয়া দুটো এক কথা নয়। তদ্রূপ উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার অর্থ এই নয় যে, যে কেউ নিজের তরফ থেকে ঈদ ও রমযানের ফয়সালা করতে পারে। বরং এ ফয়সালার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের। আর অন্যদের কর্তব্য তাদের আনুগত্য করা। সামনে এইবাস্তবতাগুলো আরো বিস্তারিত পেশ করার চেষ্টা করা হবে। l

وبالله التوفيق، ولا حول ولا قوة إلا بالله، عليه توكلت وإليه أنيب.

 (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement