প্রতিকূল পরিস্থিতি : সময় তবু চলেই যাচ্ছে
রাত যতই গভীর হয় প্রভাত ততই নিকটে আসে। অতএব ঘন আঁধারের পরিবেশ দেখেই ভেঙ্গে পড়ার কোনো কারণ নেই। রাতদিন তো আল্লাহ তাআলারই সৃষ্টি। আলো আঁধারও তাঁর দান। সুখ দুঃখ তিনিই বিলিয়ে দেন। বিপদ মুসিবতও আসে তাঁরই হুকুমে। তিনি সর্বশক্তিমান। তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতার বাইরে কিছুই নেই। সবকিছু পরিচালনা করেন তিনি। আবর্তন বিবর্তনও সব তাঁর হাতে। সময়ে সময়ে তিনি তাঁর বান্দাদেরকে শুধু পরীক্ষা করেন। যাচাই করেন। বাছাই করেন- কে অনুগত আর আনুগত্যে কে দুর্বল। আবার তাঁর পক্ষ থেকেই ঘোষণা আসে, ‘‘মুমিনের জীবন ভারি আশ্চর্যের! সব হালতই তার জন্যে বয়ে আনে কল্যাণ। ... সুখে আনন্দে মুমিন শোকর আদায় করে। আর দুঃখ শোকে বরণ করে ধৈর্য। ফলে কল্যাণ সে পেয়েই যায় উভয় হালতে।’’
আমরা মুমিন। আমাদের পূর্বেও গত হয়েছে মুমিনদের এক দীর্ঘ জামাত। সময়ের সূত্র ধরে ধরে সেই জামাত মিশেছে শেকড়ে। আকাবির আসলাফ, ইমাম মুজতাহিদ, তাবেয়ী তাবে তাবেয়ী এবং শেকড়ে সাহাবায়ে কেরাম। যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘‘তোমরাও সেরকম ঈমান আনো যেমন ঈমান এনেছে তাঁরা।’’ এই হিসাবে যদি আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, মুমিনের জীবনের লক্ষ্য কী? কী দায়িত্ব তার এই সমাজে? তাহলে এক দন্ডও দেরি না করে আমরা ফিরে তাকাবো অতীতে। আমাদের অনুসরণীয় মুমিনদের কাফেলায়। সুখে দুঃখে আলো আঁধারে কীভাবে তাঁরা জীবন কাটিয়েছেন। কীভাবে পালন করেছেন তাঁদের দায়িত্ব।
ব্যক্তিগত দুঃখ পেরেশানী আমাদের যেমন আছে, তাঁদেরও ছিলো। দুর্যোগ বিপর্যয় এযুগে যেমন আছে, সেযুগেও ছিলো। এমনিভাবে প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক সকল প্রতিকূলতা যুগে যুগে থাকে। থেকেই যায়। সেইসব কাহিনী আমরা আমাদের এসময়ের সংবাদপত্রে যেমন পড়তে পারি, তেমনি পড়তে পারি ইতিহাস গ্রন্থে। অগণন অগুনতি ঘটনা।
সেইসব ঘটনায় মুমিনের অবস্থান দেখে, মুমিনের হিম্মত দেখে, মুমিনের মন ও মননের হালত দেখে অবাক হতে হয়। মুগ্ধ হতে হয়।
ইসলামের শুরু যুগের ঘটনা তো অসংখ্য। কী অত্যাচার! কী নির্যাতন! সাহাবায়ে কেরাম তবু তাঁদের অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্রও নড়েননি। ঈমানের দাওয়াত, ইসলামের দাওয়াত দিয়ে গেছেন সেই সময়ও। জিহাদের ময়দানে তাঁরা সারাদিন কাটিয়েছেন যুদ্ধে। সারারাত কাটিয়েছেন ইবাদাতে; নামাযে, দুআয়, রোনাযারিতে।
উম্মতের প্রতি যে তাঁদের কতো ইহসান, কী দিয়ে হিসাব করা যাবে তার?
পরবর্তীতে তাবেয়ী তাবে তাবেয়ী যুগেও যুদ্ধ হয়েছে। বিপর্যয় এসেছে। দুর্যোগ দুর্দশা এসেছে এবং সবকিছু মোকাবেলা করেও তাঁরা দ্বীনের খেদমত করে গেছেন। তালীম তারবিয়তে মগ্ন থেকেছেন।
মুসলিম উম্মাহর বিরাট এক বিপর্যয় গিয়েছে হিজরী সপ্তম শতকে। তাতারীদের হামলায়। সে সময় কতো কিছু হারিয়েছে মুসলমান। কতো অন্যায় নির্যাতনের শিকার হয়েছে মুমিনদের এই জামাত। কতো আলেমদেরকে, ইমামদেরকে শহীদ করা হয়েছে। ইলমের কতো খাযানাকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিয়ারু আলামিন নুবালা, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, শাযারাতুয যাহাবসহ অনেক কিতাবে বিবৃত হয়েছে সেই কাহিনী। মুসলিম উম্মাহর করুণ জীবনেতিহাস।
সেই শতকের একজন প্রসিদ্ধ ইমাম হলেন ফযলুল্লাহ তূরিবিশতী রাহ. [মৃত্যু ৬৬১ হি.] যিনি তাতারী হামলার পরও পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি ইমাম বাগাভী রাহ. [মৃত্যু ৫১৬হি.] কর্তৃক সংকলিত হাদীসের কিতাব ‘মাসাবীহুস সুন্নাহ’ এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন ‘কিতাবুল মুয়াস্সার ফী শারহি মাসাবীহুস সুন্নাহ’ নামে। সেই কিতাবের ভূমিকায় তিনি কিতাবটি লেখার প্রেক্ষাপটে বলেছেন, (যেহেতু মূল কিতাবে অর্থাৎ ‘মাসাবীহুস সুন্নাহ’য় হাদীস জমা করা হয়েছিলো সনদ ছাড়া। তাই পরবর্তীতে সেই হাদীসগুলোর সনদে অনেকেই ভুল করেছে। রাবীদের নাম ও ব্যক্তি নির্ধারণে উলট পালট করেছে) যদি আমি সেইসব আলোচনা শুরু করি, এবং শাস্ত্রীয় ব্যক্তিদের ধারা অবলম্বন করি তাহলে আমার কাজ ও আমার মাঝে ইলম ও উপকরণ প্রতিবন্ধক হয়ে যাবে। কারণ, সেই শাস্ত্রের ঔজ্জ্বল্যে এখন পরিবর্তন এসে গেছে, প্রভা হয়ে গেছে ম্লান। বরং সবকিছু ছিনতাই হয়ে গেছে। গুটিয়ে ফেলা হয়েছে চাদর। যেহেতু সেই ইলমের বড় খাযানাই ছিলো ইরাক আর খোরাসানে। যাকে বেষ্টন করে নিয়েছে ফেতনা। শত্রুদের তরবারি বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে অধিবাসীদের। শহরগুলো তাদেরকে নিক্ষেপ করেছে দূর দূরান্তে। জনপদগুলো দেখিয়েছে মলিন বিষণ্ণ চেহারা। ফলে ইলমের ধারক বাহক আর বাকী নেই এখানে। তাঁদের প্রস্থানে প্রস্থান করেছে সব পান্ডুলিপি। শহরের ধ্বংসে ধ্বংস হয়েছে রচনা ভান্ডার।
এমন সময়, যখন হারিয়ে গেছে সহযোগিরাও। বিলুপ্ত হয়ে গেছে উপায় উপকরণ। ভাবলাম, ইলম অন্বেষী আগামীর জন্যে যতোটুকু না হলেই নয়; তাতেই সীমাবদ্ধ রাখি এই কিতাব। আর শব্দ অর্থ স্পষ্ট করার মতো ব্যাখ্যাটুকু লিখে দিই। যা কেবল প্রয়োজন মাফিক অলোচনা আর মর্ম বিশ্লেষণে সহায়ক হবে ...।-মুকাদ্দিমাতু কিতাবুল মুয়াস্সার, ১/৩১
হিজরী সপ্তম শতকের এই ইমাম তাঁর এই কিতাবটি কখন লেখা শুরু করেছেন জানা যায় না। তবে ভূমিকার আলোচনা থেকে বুঝা যায় তাতারী হামলার সময় বা তার পরপরই শুরু করেছেন। আর শেষ করেছেন- কিতাবটির শেষের বক্তব্য অনুযায়ী- ৬৬০ হিজরীর ৬ সফর, জুমার দিনের শেষ বেলায়। ইন্তিকালের আগের বছর।
যুগে যুগে উম্মাহর শ্রেষ্ঠ মনীষীগণ কীভাবে কী অবস্থায় দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন ইলমের মীরাস রক্ষা করেছেন- তার পক্ষে এটি কেবল একটি ক্ষুদ্র ঘটনা। পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় সময়ের দুর্যোগে তাঁরা যদি ভেঙ্গে পড়তেন, ঘাবড়ে যেতেন, থেমে যেতেন তাহলে পরবর্তী উম্মতের কী হাল দশা হতো!!
যে মুমিন দিনরাতের পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে বারবার এই ঘোষণা দেয় ‘‘তোমারই ইবাদত করি হে আল্লাহ! তোমার কাছেই সাহায্য চাই’’। তাকে ভেঙ্গে পড়া মানায় না। ঘাবড়ে যাওয়াও তাকে সাজে না। এরপর কীভাবে নিরাশ হবে মুমিন?! শত ঝঞ্ঝা ঝড়েও মুমিন তো তার অভীষ্ট লক্ষ্যেই কাজ করে যাবে। একমুখী হয়ে পড়বে না সে।
তার সকল দায়িত্বে সে থাকবে সম্পূর্ণ সচেতন।
নিকট অতীতে মুসলিম উম্মাহর আরেকটি বিপর্যয় গেলো ১৪২৪ হিজরীতে। সেই ইরাকেই। বাগদাদে বসরায়। তখন দজলার পানিতে ভেসে গিয়েছিলো ইলমী খাযানা। এখন ভস্ম হয়ে গেলো গোলার আগুনে। অগ্নিকুন্ডে। বিস্ফোরণে। কিন্তু মুমিন তখনো নিরাশ হয়নি। এখনো না। তখনো সে তার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলো। এখনো। তখনো যেমন সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মুমিনদের একটি কাফেলা আগত প্রজন্মের জন্য নতুন ইতিহাস তৈরী করেছে, কিতাব রচনা করেছে, দরস তাদরীসে মশগুল থেকেছে- ঠিক এখনো তেমনি অক্ষুণ্ণ থেকেছে মুমিনের লক্ষ্য কর্ম-উদ্যোগ ইতিহাস। আর যারা যুগে যুগে মুজাহিদ, আল্লাহর পথের সৈনিক, সেইসব মুমিনের কাফেলা তো চির অমর। দুনিয়াতে এবং আখেরাতে।
দজলার পানিতে ভেসে যাচ্ছে ইলমী খাযানা- এমন সময় কতো মুমিন রচনা করছে নতুন খাযানা। ইমাম তূরিবিশতী তাঁদের একজন।
এই সময়ের বিস্ফোরণে জ্বলে যাচ্ছে মীরাছুল উলামা- তখনো অনেক মুমিন উদ্ধার করছে নতুন মীরাস। তার দুইটি নজির এখানে উল্লেখ করা হলো।
১.সহীহ মুসলিম শরীফের সংকলক ইমাম আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ রহ.[২৬১হি.] এর গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা হলো ‘কিতাবুত তাময়ীয’। জামিয়া ইসলামিয়া বাগদাদের একজন উস্তায ড.আবদুল কাদির মুসতাফা কিতাবটির তাহকীকের কাজ করছিলেন। ভূমিকায় তিনি লিখেন-
‘এই কিতাবটির তাহকীকের কাজ করছিলাম এমন এক সময়ে, যখন আমরা ছিলাম আমাদের শহরে কাফের ক্রুসেডার আর হিংসুকদের জবরদখলের মাঝে। খুবই কঠিন সময়ে। এখনো তেমনি আছি। এরই মধ্যে কিতাবটির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেটা এক বছর বা তারচেয়েও বেশি আগের কথা। এরপর যখন কিতাবটি বাগদাদের আযমিয়া শহরে অবস্থিত আমাদের গবেষণা কেন্দ্র থেকে ছাপানোর প্রস্ত্ততি চলছিলো, তখন জবরদখলকারী এই ক্রুসেডার বাহিনী সেই কেন্দ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং সবকিছু ছিনতাই করে ভবনটি ধংস করে দিলো। যেই কম্পিউটারে আমাদের কাজ করা এই কিতাবটি ছিলো সেটাও নিয়ে গেলো। এরপর মূল পান্ডুলিপিটিও রক্ষা পেলো না তাদের হাত থেকে। যেটুকু রক্ষা পেয়েছে তা খুবই সামান্য। আমরা সেগুলোই জমা করলাম। এবং নতুন করে আবার কাজ শুরু করলাম। এবং এই বিশাল পরীক্ষা আর দীর্ঘ কাজের ব্যস্ততাকে সামনে নিয়ে কেবলই আল্লাহ তাআলার কাছে সাহায্য চাইলাম।’ মুহাক্কিকের ভূমিকা পৃ. : ৫৫
২. ইমাম গাযালী রাহ. এর উস্তায হিজরী পঞ্চম শতকের প্রসিদ্ধ ইমাম ইমামুল হারামাইন আবদুল মালিক ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে ইউসূফ আল জুয়াইনী রাহ. [৪১৯-৪৭৮হি.] এর লিখিত শাফিয়ী মাযহাবের মৌলিক এবং প্রামাণ্য একটি কিতাব হলো ‘নিহায়াতুল মাতলাব ফী দিরায়াতিল মাযহাব’। যে কিতাবকে সামনে রেখেই ইমাম গাযালী রাহ.[৫০৫হি.] ফিকহে শাফিয়ীর সুবিশাল গ্রন্থ লিখেছেন ‘আল বাসীত’ নামে এবং পরবর্তীতে তিনি নিজেই ‘আল বাসীত’কে সংক্ষেপ করে লিখেছেন ‘আল ওয়াজীয’।
হিজরী সপ্তম শতকের শাফিয়ী ইমাম আবদুল কারীম রাফিয়ী [৬২৩হি.] রাহ. ইমাম গাযালীর ‘আল বাসীত’কে সংক্ষেপ করেই কিতাব তৈরী করেছেন ‘আল মুহাররার’ নামে এবং এই আল ‘মুহাররার’কেই ইমাম নববী রাহ. সংক্ষেপ ও পরিমার্জন করে লিখেছেন ‘আল মিনহাজ’। যে ‘আল মিনহাজে’রই ব্যাখ্যা হলো বর্তমানের ফিকহে শাফিয়ীর নির্ভরযোগ্য ও ফতোয়াসিদ্ধ দুই কিতাব ‘নিহায়াতুল মুহতাজ’ ও ‘তুহফাতুল মুহতাজ’। উল্লেখ্য- নিহায়াতুল মুহতাজের লেখক হলেন শামসুদ্দীন আর রমলী [১০০৪হি.]রাহ.। আর তুহফাতুল মুহতাজের লেখক হলেন ইবনে হাজার আল হাইতামী [৯৭৪হি.] রাহ.।
এমনিভাবে অন্যদিক থেকে নিহায়াতুল মুহতাজ ও তুহফাতুল মুহতাজ কিতাবদুটির গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র হলো ইমাম নববী রহ. এর ‘রওযাতুত তালিবীন’। যেটি আবদুল কারীম আর রাফিয়ী রাহ. এর ‘ফাতহুল আযীয আলা কিতাবিল ওয়াজীয’ বা প্রসিদ্ধ নাম হিসাবে ‘আশশারহুল কাবীর’ এর সংক্ষেপ ও পরিমার্জন। আর আশ শারহুল কাবীর হলো ইমাম গাযালীর আল ওয়াজীয এর ব্যাখ্যা। আল ওয়াজীয নেওয়া হয়েছে আল বাসীত থেকে। আর ইমাম গাযালী রাহ. তাঁর দুটি কিতাবই লিখেছেন ‘নিহায়াতুল মাতলাব’কে অবলম্বন করে।
ইমামুল হারামাইন রাহ.-এর এই ‘নিহায়াতুল মাতলাব ফী দিরায়াতিল মাযহাব’ কিতাবটির তাহকীকের কাজ করছিলেন শায়খ আবদুল আযীম মাহমূদ -রাহিমাহুল্লাহু তাআলা রাহমাতান ওয়াসিয়া- কাতারের রাজধানী ‘দোহা’য়। বিশ বছরেরও কিছু বেশি সময়ে মূল কিতাবের কাজ করার পর তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটি মুকাদ্দিমা ও ফাহারিসের কাজ শুরু করেন ১৪২৩ হিজরী মুতাবেক ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে। শেষ করেন ১৪২৮ হিজরী মুতাবেক ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে। প্রায় সাড়ে চার বছর যাবৎ চলছিলো এই কাজ। আর সে সময়েই শুরু হয়েছিলো ইরাকে আমেরিকার হামলা। পরে ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে কিতাবটি জিদ্দার দারুল মিনহাজ থেকে প্রকাশিত হয়েছে । মূল কিতাব ১৯ খন্ড। সঙ্গে মুকাদ্দিমা ও ফাহারিস এর দুই খন্ড মিলে মোট ২১ খন্ড।
কিতাবটির একেবারে শেষে (ফাহারিসের খন্ডে) ‘খাতিমা’ বা ‘সমাপ্তি’ শিরোনামে দেড় পৃষ্ঠায় মুহাক্কিক রাহ. কয়েকটি কথা লিখেছেন-‘‘একটানা দীর্ঘ চার বছরের মেহনত পরিশ্রমের পর এবার কলম রেখে দিচ্ছি .....
আর কীভাবে আমি কান্না থামিয়ে কলম রেখে দেবো! (কলম রেখে দিচ্ছি কিন্তু কান্না তো রেখে দিতে পারছি না, কলম বন্ধ করে দিচ্ছি কিন্তু কান্না বন্ধ করতে পারছি না।) আমার সামনে বাগদাদ!!! খলীফা মনসূরের বাগদাদ! খলীফা হারুনুর রশীদের বাগদাদ! মামূনুর রশীদের বাগদাদ! মুতাসিমের বাগদাদ! ইমাম আবু হানীফার দেশ, ইমাম আবু ইউসুফ মুহাম্মদের দেশ, ইমাম আহমদের দেশ, ইসহাক ইবনে রাহূয়ার দেশ। বাগদাদ! পৃথিবীর রাজধানী। সুখ সমৃদ্ধির পুণ্যভূমি বাগদাদ! আজ চার চারটি বছর ধরে এই বাগদাদ নব্য তাতারীদের হাতে বন্দী। অথচ এখনো বিলম্ব করছে নতুন যমানার সাইফুদ্দীন কুতয। উম্মতের সম্ভ্রমহানীর প্রতিশোধ নিতে, উম্মতের অপমান ও পরিতাপকে ধুয়ে মুছে দিতে এখনো সে আসছে না। অথচ মুসলিম উম্মাহকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে, নিশ্চিহ্ন করে দিতে একটি ফেতনার অপছায়া চরম ধূর্ততার সাথে মাথা উঁচু করছে ।
অনন্যোপায় আমরা একমাত্র আল্লাহ তাআলার কাছেই অভিযোগ পেশ করছি। তাঁর কাছেইতো আমাদের আশ্রয়। সকল বিপদ বিপর্যয়ে তিনিই আমাদের সাহায্যকারী।
আমরা তাঁর কাছে প্রার্থনা করছি, হে পাঠক! তুমিও কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা কর, প্রর্থনাকারীদের কাফেলায় নিশ্চয় এমন কেউ থাকবে যে আল্লাহর নামে শপথ করে ফেললে আল্লাহ তার শপথকে বাস্তবে পরিণত করে দেবেন। ফলে তার প্রর্থনায় আমাদের দুঃখ দুর্দশা ঘুচবে। বিপদ বিপর্যয় কেটে যাবে...’’ নিহায়াতুল মাতলাব, ফাহারিস খন্ড, ৩৯৫-৯৬ পৃ.
তিনি মুকাদ্দিমার কাজ যখন শুরু করেন তখনো আমেরিকা হামলা শুরু করেনি। তিনি তার ভূমিকার শেষে একটি টীকায় সে সময়ের অবস্থা বর্ণনা করেন এভাবে-‘এই ভূমিকা যে পড়ছো হে পাঠক! তুমি হয়তো জানো, কখনো কোনো বক্তব্য তার পূর্ণ ভাব প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়, উপস্থাপনা হয়ে উঠেনা সুবিন্যস্ত। এখানে যদি তেমন কিছু তোমার নজরে পড়ে, সাথে সাথেই আমাকে নিন্দা করতে শুরু করো না। আমাকে ওজর পেশ করার সুযোগ দিও। কারণ এই ভূমিকা যখন আমি লিখছি তখন বড়ই বিপন্ন অবস্থায় কাটছে আমার দিন।
ভীষণ অসুস্থতা। ডাক্তারের আদেশ, যেনো পারতপক্ষে বিছানা থেকে না উঠি। আর কোনো রকমের কষ্টের কোনো কাজ করতে চেষ্টা না করি। ওদিকে বয়সও অনেক হয়ে গেছে। শরীর দুর্বল। ফলে এক ভাবনায় কাজ করা যায় না, চিন্তা ভাবনা কেবলই বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।
এই অবস্থার উপর নতুন করে যুক্ত হয়েছে এক মহা ভীতি। আমেরিকার হানাদাররা যুদ্ধের ডংকা বাজিয়ে তুলছে। সে যুদ্ধ নাকি দারুস সালাম বাগদাদকে ধংস করে এই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরতরে মিটিয়ে দেবে। বাগদাদ খলীফা মানসূরের শহর। হারুনুর রশীদ, মামূনুর রশীদ, খলীফা মুতাসিমের শহর। দারুল হিকমার প্রধান কেন্দ্র। ইমাম আবু হানীফার দেশ, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের দেশ। এই বাগদাদ মুসলিম উম্মাহর প্রধান নগরী। বরং যুগ যুগ ধরে সারা পৃথিবীর ‘সভ্যতার নগরী’ এটা। আগামী কাল কিংবা পরশুই নাকি তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে মার্কিনীরা। আজকের মুসলিম শাসকেরা এখানে সেই সময়ের শাসকের মতোই হয়ে গেছে। ৬৫৬ হিজরীতে যখন এই বাগদাদে হামলা করেছিলো হালাকু(বাহিনী)। কিন্তু সেসময় মাত্র দুই বছরেই ৬৫৮ হিজরীতে তাকদীর সাহায্য করেছিলো সাইফুদ্দীন কুতযের মাধ্যমে। যে বাগদাদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে জেগে উঠলো। আর অগ্রগামী তাতারীকে পশ্চাৎপদ করে ফেরৎ পাঠালো। তাহলে কি আবারো আমরা নতুন কোনো সাইফুদ্দীনের স্বপ্ন দেখবো? তোমরা বল, আমীন। মুকাদ্দিমা পৃ.৩৩
পূর্বসূরিদের জীবনীতে এমন ঘটনা আরো অনেক আছে। হিন্দুস্তানের ইতিহাসে, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময়কার কতো ঘটনা আমরা পড়ি- একদিকে জিহাদের নেতৃত্ব অন্যদিকে মাদরাসার সবক, দুটোই সমান তালে চলছে। একটির কারণে অপরটিতে তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না। আর সেজন্যেই তাঁরা আকাবির। পূর্বসূরির মহান জামাত। তাঁরা স্মরণীয়, তাঁরা বরণীয়, তাঁরাই আমাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। বিপরীতে এমন মানুষও আছে যারা সময়ের প্রতিকূলতাকে আড়াল করে নিজের অযোগ্যতাকে ঢাকতে চায়। কিংবা যারা প্রতিকূলতার দোহাই দিয়ে লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে ভুলে যায়। তারাও পৃথিবীর ইতিহাস। তবে দুই ইতিহাসে অনেক পার্থক্য।
একজন মানুষ কতো বছরই বা বাঁচে? তার মধ্য থেকে নিজেকে গড়ে তোলার মতো সময়ই বা পায় কতটুকু? এই জীবনে এই সময়ে বাধা বিপত্তি, দুঃখ দুর্দশা, বিপর্যয় আর প্রতিকূলতা সবই থাকে। এটা পৃথিবীর নিয়ম। নিজেকে গড়তে হলে, সফল জীবনের অধিকারী হতে চাইলে এসব উপেক্ষা করে হলেও ছুটে যেতে হবে লক্ষ্যাভিমুখে, গন্তব্য পানে।
‘যে বছর দেশে যুদ্ধ ছিলো, সে বছরটি ছিলো দুর্ভিক্ষের, বন্যার বছর ছিলো সেটি; এজন্য আমার আর হয়ে উঠেনি এই কাজ, এই যোগ্যতা।’ এটা বলবার মতো একটি কথা এবং গ্রহণ করার মতো একটি অনুযোগ। কিন্তু ফলাফল যা, তা ভুক্তভোগীরই প্রাপ্য। পৃথিবীর কাছে সেই ফলাফলের তেমন কোনো মূল্য নেই। কারণ পৃথিবী বুঝে শুধু কর্মের ভাষা কীর্তির ভাষা যোগ্যতার ভাষা। ওজর আপত্তি অভিযোগ অনুযোগ সে শুধু শুনে। বুঝেও কখনো । তবে গ্রহণ করে না কখনো। আর তাই ওজর আপত্তির জোরে কোনো অযোগ্যকেই পৃথিবী যোগ্য হিসাবে বরণ করেনি। যোগ্যদের তালিকায় উল্লেখও করেনি তার নাম। এটা বাস্তবতা এবং এই বাস্তবতার উর্ধ্বে উঠার শক্তি নেই কারো।
অতএব হোকনা প্রতিকূল পরিস্থিতি। সময় কিন্তু চলেই যাচ্ছে। নিজের ভবিষ্যত দেখতে হবে কর্মের আয়নায়। যোগ্যতার আয়নায়। কেবল সম্ভাবনার আয়নায় ভবিষ্যত দেখে সফল হওয়া যায় না। সম্ভাবনাকে বাস্তবে এনে দিতে হয় সফলতার প্রার্থীকে।