প্র তি রো ধ : মাইরের উপরে ওষুধ নাই
হ্যাঁ, সেটি একটি ঘটনাই ছিল। সব দিক থেকেই ঘটনাটির সংবাদমূল্য ছিল প্রশ্নাতীত। মান ও চরিত্রের দিক থেকেও তাতে ছিল প্রচুর ইতিবাচক লক্ষণ ও উপাদান। সেজন্যই হয়তো ঘটনাটি খবর হয়ে এসেছে ঢাকার একটি পত্রিকায়। গত ২৪ ডিসেম্বর ৩-এর পাতায়। শিরোনামটিই বেশ মজাদার। ‘টেন্ডারবাজের নাকে প্রধান প্রকৌশলীর ঘুষি।’
হোক না একদম শেষ বেলা। তারপরও তো অন্যায়ের জোরালো প্রতিরোধ। একটা অচেনা অসহজাত আচরণ। কিন্তু অভাবিত, অভূতপূর্ব! টেন্ডারবাজদের দৌরাত্মে দেশটি কেঁপেছে গত পাঁচ বছর। এ দৌরাত্ম আগেও ছিল; হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু গত পাঁচটি বছর ছিল টেন্ডারবাজদের পোয়া বারো-আমল। পিস্তল-বন্দুক, চাপাতি আর রামদায়ের উৎসব শুরু হতো টেন্ডার জমা দেওয়ার সময়। আর বলাই বাহুল্য, সে সব বীর পুঙ্গব সশস্ত্র টেন্ডারবাজের প্রায় সবাই হচ্ছে সরকারি দলের ‘চেতনাধারী’ বিশেষ শ্রেণী। তাদের ভাব আর ফাঁপড়ের চোটে নুয়ে পড়তো প্রশাসনের কর্তারা। সরকারি দলের টেন্ডারবাজ মানেই ছিল প্রশাসনের ‘নমস্য’।
কিন্তু সেদিন ঘটনা উল্টে গেল। ঘুরে গেল -বলা যায়। একেই হয়তো বলে পালাবদল। সশস্ত্র টেন্ডারবাজ ঘুষি খেয়ে শুধু জব্দই হলো না, তারপর নাকে খত দিয়ে সে উদ্ধার পেল। খবরের প্রথম প্যারাটি দেখুন। -‘টেন্ডারবাজের নাকে সোজা ঘুষি চালিয়ে দিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান প্রকৌশলী আবুল খায়ের। এরপর ধরে নিয়ে আটকালেন নিজের কক্ষে। খবর দিলেন র্যাব-পুলিশকে। পরে পা ধরে ক্ষমা চেয়ে মুক্তি পেল সেই টেন্ডারবাজ। যাওয়ার আগে ওয়াদা করে গেল, ভবিষ্যতে আর এ ধরণের কাজ করবে না।’
এবার খবরের শেষ প্যারাটি দেখলে বোঝা যাবে, প্রতিরোধ করতে পারলে ক্ষমতাসীন সন্ত্রাসীদের মেকি বীরত্ব দ্রুতই ঝরে পড়ে যায়। একই সঙ্গে এ-ও বোঝা যাবে, একজন সরকারি কর্মকর্তা কতটা বিব্রত ও বিরক্ত হলে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। দেখুন ওই খবরের শেষ প্যারাটি। -‘একাধিক ঠিকাদার জানান, ওই টেন্ডারবাজ সিটি করপোরেশনের কোনো পেশাদার ঠিকাদার নয়। নগর ভবনের কেউ তাকে চেনেও না। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। হয়তো কোনো ঠিকাদারের হয়ে টেন্ডারবাজি করতে গিয়েছিল। এভাবে প্রতিরোধ করলে টেন্ডারবাজদের দৌরাত্ম্য কমবে। এ ব্যাপারে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম এনামুল হকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এ ধরণের একটি ঘটনার কথা শুনেছেন বলে জানান। প্রধান প্রকৌশলী আবুল খায়েরকেই প্রশ্ন করা হলে তিনি রাগী গলায় কালের কণ্ঠের প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আপনি কি টেন্ডারবাজদের পক্ষে কথা বলতে এসেছেন? তাহলে আপনিও একটা কালপ্রিট।’
আসলে অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে গিয়ে জোর ও ক্ষমতা খাটানোর জায়গা শুধু টেন্ডার বা ঠিকাদারি নয়। জায়গা-জমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-চিকিৎসা-সব জায়গায় অসুস্থ এক জোর-জবরদস্তির রাজত্ব চলছে। পাঁচটি বছর জুড়েই এ রাজত্ব দিন দিন প্রকট ও ভয়ংকর হয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধীরা ছাড়া কেউ কোনো প্রতিবাদ করে নি। ঘুরে দাঁড়ানোর কথা যেন ভুলেই গেছে। বিশেষত যে বিভাগ বা অঙ্গনে এসব জোর জবরদস্তির ঘটনা ঘটে থাকে, সে অঙ্গনের লোকেরা চোখ-মুখ সেলাই করে রাখেন। কিছু দেখেনও না কিছু শোনেনও না। সিটি কর্পোরেশনের এই প্রধান প্রকৌশলী একটি ঘুষি দিয়ে অবশ্যই বন্ধ সেই চোখ-মুখের সেলাই ছিঁড়ে দিলেন। সরকারি চাকুরি ও প্রশাসনের ভেতরে থেকেও তার এই সাহসী ভূমিকা অনুকরণীয় ও দৃষ্টান্তমূলক। এ দেশের ক্ষমতা, তদ্বির ও অসততার শক্ত চেইনের সার্বিক বিবেচনায় ওই প্রকৌশলীকে আমরা অভিনন্দন জানাতেই পারি।
কেউ কেউ এখানে দুটি প্রশ্নের অবতারণা করে বিষয়টিকে হাল্কা একটা সরলিকরণে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করতে পারেন। প্রথমত তারা বলতে পারেন, সরকারি কর্মকর্তা হয়ে এভাবে মারধর করাটা তো ঠিক হয়নি। নিজে কিছু না করে তিনি অভিযোগ করতে পারতেন। আমরা বলবো, অস্ত্রের ভাষা ছাড়া যারা অন্য কিছু বুঝে না এবং যাদের উপর-নিচ সবার মধ্যেই অনৈতিকতা ও জিঘাংসার মাত্রা একরকম, ক্ষেত্র বিশেষে তাদের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন নগদ প্রতিরোধ। তাৎক্ষণিক এন্টিবায়োটিকের মতো। তাদের জন্য দেওয়ানি মামলা অচল। প্রচলিত আছে -‘মাইরের উপরে ওষুধ নাই’। সব ক্ষেত্রে না হলেও কথাটি এজাতীয় লোকের ক্ষেত্রে বেশ প্রযোজ্য। দ্বিতীয়ত, কেউ কেউ বলতে পারেন, একটা সরকারের শেষ বেলায় এসে সরকারি দল সমর্থিত গুন্ডাপান্ডার বিরুদ্ধে মারমুখি হওয়ায় বিশেষ কৃতিত্ব নেই। কিছু করার থাকলে আগেই করা উচিত ছিল। এ প্রসঙ্গে আমরা বলব, শেষ বেলার চিকিৎসারও গুরুত্ব আছে। জীবনঘাতি ভাইরাসগুলোকে শেষ সময়ে দমন করতে পারলেও মুমূর্ষু রোগীর আরোগ্য লাভের পথ খুলে যায়। অস্ত্রের ঝনঝনানি আর ক্ষমতার নানামাত্রিক অমানুষিক দাপট দেখিয়ে সমাজকে এরা যে জায়গায় নামিয়ে নিয়েছে, তাতে শেষ মুহূর্তে হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ও সর্বাত্মক প্রতিরোধ-আয়োজন সক্রিয় করে তোলা উচিত। এর কোনো কিছুই গুরুত্বহীন নয়।
নিরীহ প্রকৌশলীর ইমেজ ভেঙ্গে একজন জেগে ওঠে প্রমাণ করলেন, কাপুরুষদের নাকে ঘুষি চালিযে দেওয়া মোটেই কঠিন কোনো কাজ নয়। তিনি সবাইকে জানিয়ে দিলেন, এটা করা যায় এবং এমনটিই সবার করা উচিত। তবে, অনুকরণীয় নজির স্থাপনের জন্য আমরা তাকে অভিনন্দন জানিয়েও বলব-ভবিষ্যতে এসব ক্ষেত্রে ঘুষি মারার সঙ্গে সঙ্গে হুশিয়ারিও বজায় রাখা সবার কর্তব্য।