রবিউল আউয়াল ১৪৩৫   ||   জানুয়ারি ২০১৪

প্র তি বে শী : কাদিয়ানীর অন্যমুখ

ওয়ারিস রব্বানী

 

তখন খবরটা ছোট ছিল। ঘটনাটিও বড় ছিল না। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকা সফরে এসেছিলেন। সফরের এক ফাঁকে তিনি গেলেন বকশিবাজারে। ঢাকায় কাদিয়ানীদের হেডকোয়ার্টারে। খবরটি তখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। কী ছিল সেই পররাষ্ট্র সচিবের নাম? সালমান খুরশিদ। প্রায় একযুগ আগের ঘটনা। অনেকেরই মনে ছিল না।

সেই পররাষ্ট্র সচিব এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ভারতের কংগ্রেস সরকার তাকে মন্ত্রী বানিয়েছে। ঝানু কূটনীতিক থেকে দুঁদে মন্ত্রী। প্রথম দিকে তার নামটা গণমাধ্যমে দেখে কিছুটা পুলক জেগেছে। অনেকেই ভেবেছি, ভারতের মতো দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়েছে একজন মুসলিমকে (!) বিরাট ব্যাপার! কিন্তু কিছুদিন পরেই জানা গেছে, এই নামধারী মুসলিম মূলত একজন কাদিয়ানী। পেছনের কথা মনে পড়ে গেল। আর তারপর থেকেই লক্ষ করে দেখা গেল, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা রকম বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলার চিত্র। একদিকে আমাদের নতজানু সরকারের অন্ধ আনুগত্য আর অপরদিকে ভারতের পক্ষে এই কাদিয়ানী মন্ত্রীর কারসাজির নিচে চাপা পড়ে গেল তিস্তা ও সীমান্তইস্যু। আর টিপাইমুখ, ট্রানজিটের পাশাপাশি সন্ত্রাস দমনে পারষ্পরিক গোয়েন্দা সহযোগিতার মতো বহু নতুন ফ্রন্ট খুলে গেল। ভারত সরকারের সব প্রয়োজনীয় রিসোর্সের পাশাপাশি এই কাদিয়ানী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ কৃতিত্বে বাংলাদেশকে ভারতের প্রায় করদরাজ্য বানানোর কাজ সম্পন্নই হয়ে গেল। এখন বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অবস্থান গ্রহণে তারা মোটেই বিব্রত হন না।  

এই ডিসেম্বরে তার মন্ত্রণালয়ের এক মহিলা সচিব ঢাকায় এসেছিলেন। সরাসরি রাজনৈতিক পক্ষ নিয়ে তিনি বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলেছেন। কোন্ দলের কেন নির্বাচনে যাওয়া উচিত -এ নিয়ে প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণ করে ঢাকায় কথাবার্তা বলেছেন বলে গণমাধ্যমে এসেছে। পেশায় তিনি কূটনীতিক এবং বিদেশি হলেও ঢাকায় তার আচরণ ছিল এ দেশীয় দলবাজ সাম্প্রদায়িক হিন্দুবাদী সুশীলের মতো। চারদিকে ধিক্কার কুড়ানো সেই ভূমিকার পরও ওই সচিব ও তার মন্ত্রীর অবস্থানের কোনো হেরফের হয়েছে বলে মনেই হচ্ছে না। আসলে তেমন কোনো সম্ভাবনাই হয়তো নেই। প্রধান কারণ, ভারতের মতো নিপীড়ক দেশের কোনো পলিসি-প্রয়োগকারীর চরিত্র কলুষমুক্ত হওয়ার কোনো গুঞ্জায়েশই থাকতে পারে না। দ্বিতীয়ত, ভারতের কাদিয়ানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও হিন্দুবাদী পররাষ্ট্র সচিবের স্বত:স্ফূর্ত প্রবণতাই হচ্ছে কাছের-দূরের যে কোনো মুসলিম সমাজকে খুঁচিয়ে-নাচিয়ে সুখ পাওয়া। সম্প্রতি এ প্রবণতার আরো বড় বড় প্রমাণ হাতে চলে আসছে।  

৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হবে -এ লেখা তৈরি করা পর্যন্ত আমরা জানি না। কিন্তু এ নির্বাচনের ঝড়ে এখন দেশের বাইরে প্রধান দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। ভারত ও আমেরিকা। একবাক্যে বলা যায়, এদের কেউ-ই মুসলিম প্রধান এ দেশটির নিঃস্বার্থ বন্ধু নয়। তারপরও ভারতের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ভূমিকা রাখা হচ্ছে তুলনামূলক খোলামেলা ও প্রকট আঙ্গিকে। তার সমর্থিত সেকুলার ও হিন্দুবাদী পক্ষকে জিতিয়ে আনার জন্য সে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে ভারত ও আমেরিকাও এখন লঘু দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। এর জের ধরেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমেরিকা সফর শেষে দেশে এসে গত ৩০ ডিসেম্বর বলেছেন-বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের আমাদের চোখে দেখা উচিত। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহায়ক হবে। তিনি খোলাখুলি দ্য হিন্দু পত্রিকাকে আরো বলেছেন -ভৌগোলিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভারত বাংলাদেশের বেশি কাছে। সুতরাং এ অঞ্চল ও মানুষের অনুভূতি সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

এসব কথায় প্রকারান্তরে তিনি বলতে চেয়েছেন ন্যয্য ও সঙ্গত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নয় ভারতের পলিসির বাইরে গিয়ে বাংলাদেশে এমন কিছু করা, যাতে সেখানকার ভারত সমর্থিতরা শংকিত বোধ করে। বরং ভারতের পাশে থেকেই বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে ভূমিকা রাখা যুক্তরাষ্ট্রের কর্তব্য। বলাই বাহুল্য, এর মধ্যে রয়েছে ভারতের নগদ ও দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসায়িক, ধর্মীয় ও প্রতিরক্ষা-স্বার্থ। এ জন্যই নাক-কান কেটে বাংলাদেশ বিষয়ে তারা এতটা উগ্র মরিয়া চেহারা ধারণ করেছে। বাকি, এসব করে শেষ পর্যন্ত তাদের কোনো লাভ হবে বলে তারাও নিশ্চিত হতে পারছেন না। কারণ, ভারতের মন্ত্রী ওই বক্তব্যেই হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন -বাংলাদেশ সরকারের কর্মকান্ড বিচার-বিশ্লেষণে তাদের (ওয়াশিংটনের) দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিতভাবেই আমাদের (দিল্লির) থেকে ভিন্ন। ওয়াশিংটন থাকার সময় আমি এটা লক্ষ করেছিলাম। অপরদিকে এর একদিন পর দ্য হিন্দু পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে - বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব দিনদিন আরো চাঙ্গা হচ্ছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ সামনের দিনগুলোতে খুবই ব্যস্ত সময় কাটাবেন। প্রথমত সাম্প্রদায়িক ও উৎপীড়ক ভারত নামক রাষ্ট্রের একজন আদ্যান্ত বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হিসেবে। দ্বিতীয়ত চরম মুসলিম বিদ্বেষী একজন কাদিয়ানী হিসেবে। একজন কাদিয়ানী ভারতীয় নেতার এটা বড় কৃতিত্ব যে, প্রতিবেশী মুসলিম দেশের প্রতি নির্মম ও ভয়ংকর বৈরিতার সূক্ষ্ম পথগুলো তিনি সহজে উন্মুক্ত করতে সক্ষম হন, যেটা অন্য অমুসলিমদের জন্য সহজসাধ্য নয়। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখা যায় যে, দেখতে শুনতে মুসলমান কেউ যখন ভারতের মতো কোনো দেশের নেতৃত্বের চেয়ারে বসেন তখন বুঝতে হবে, এই ডালের মধ্যে নিশ্চিত কিছু কালা আছে। সালমান খুরশিদ ডালের সেই কালা। ভারতের কাদিয়ানী মন্ত্রী মানে সেরের উপর সোয়া সের। ভারতের ভিতরের ও বাইরের মুসলমানদের জন্য বিভীষণ। সামনের দিনগুলোতে সেটা হয়তো আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে।

 

 

 

advertisement