রবিউল আউয়াল ১৪৩৫   ||   জানুয়ারি ২০১৪

দুআয়ে মাগফিরাতের আবেদন

খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের বেশ কয়েকজন আকাবির ও মুসলিম ভাই ইন্তিকাল করেছেন। পাঠকবৃন্দের কাছে আমরা তাঁদের জন্য এবং সকল মারহুমের জন্য মাগফিরাত ও রহমতের দুআর আবেদন করছি।

এক.

গত ৮ শাওয়াল ১৪৩৪ হিজরী জুমার দিন চট্টগ্রামের মাওলানা দলীলুর রহমান ইবনে সূফী অবদুল কাদের ইন্তিকাল করেছেন। তিনি ফটিকছড়ির নিকটবর্তী রাউজান থানার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।

প্রথমে সুলতানপুর মাদরাসায়, তারপর জিরি মাদরাসায় পড়েন। দাওরা ও ইফতা সম্পন্ন করেন পটিয়া মাদরাসায়। রংপুরের এক মাদরাসায় ১২ বছর, তারপর মাদরাসায়ে উবাইদিয়া নানুপুরে ২৩ বছর অধ্যাপনার খেদমত আঞ্জাম দেন। নানুপুরে তিনি মেশকাত, জালালাইন, শরহে জামী ইত্যাদি কিতাবের দরস দিতেন। ১৮ বছর ওমানে ছিলেন। সেখানে ইমামতি ও খুসূসি তাদরীসের খেদমত করতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজ গ্রাম আব্দুল্লাহপুরে মারকাযুল হিদায়াহ-এর দেখাশোনা ও সেখানেই সামান্য অধ্যাপনার খেদমত অঞ্জাম দিয়ে গেছেন। ইন্তিকালের সময় তাঁর বয়স ছিল ৮৩ বছর।

নানুপুর মসজিদে ইতিকাফের সময় কয়েকবার তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। বড় মহববতের আচরণ করতেন। একবার নিজের উস্তাযগণের আলোচনা করলেন। খতীবে আযম হযরত মাওলানা সিদ্দীক আহমাদ রাহ. তাঁর উস্তায ছিলেন। হযরত মাওলানা মুফতী আবদুর রহমান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের কথাও আলোচনা করলেন, তাঁর কাছে তিনি পড়েছেন।

তিনি আলকাউসারকে খুব মহববত করতেন এবং নিয়মিত পড়তেন। আলকাউসারের জন্য অনেক দুআ করতেন। যখন আলকাউসারের একটি সংখ্যা তাঁর ঠিকানায় গিয়ে প্রাপকের ইন্তিকাল হওয়ায় ফেরত নোটসহ ফেরত আসল  তখনই তাঁর ইন্তিকালের খবর জানলাম। আল্লাহ তাআলা মারহুমকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে সবরে জামীল ইখতিয়ার করার তাওফিক দিন। আমীন

আমার অনুরোধে তাঁর বিষয়ে আমাকে উপরোক্ত তথ্যগুলো দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আমাদের তালিবুল ইলম মওলবী ইউনুস নানুপুরী। আল্লাহ তাআলা তাকে উত্তম প্রতিদান দিন।

দুই.

গত ৯ মুহাররম ১৪৩৫ হিজরী মোতাবেক ১৪ নভেম্বর (২০১৩) মধ্যরাতে মাওলানা আনিসুল হক ইন্তিকাল করেছেন। ইন্তিকালের সময় ঢাকার পূর্ব কাজীপাড়ায় তাঁর বড় ছাহেবযাদার বাসায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন। তিনি মোমেনশাহীর গফরগাঁও-সান্দিয়াইনের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। অত্যন্ত যহীন এই আলেমে দ্বীন ছিলেন মোমেনশাহী বড় মসজিদের সাবেক পেশ ইমাম হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান রাহ.-এর ছোট মেয়ের জামাতা। গফরগাঁও সান্দিয়াইনের উঁচু দ্বীনদার এক খান্দানে তাঁর জন্ম। তাঁর দাদা মশহুর আলেম হাজ্বী সূফী উমেদ আলী রাহ. ছিলেন হাজ্বী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রাহ.-এর বাইআত এবং মক্কার সওলাতিয়া মাদরাসার ছাত্র। আর তাঁর আববাজান মাওলানা আবদুল হাই রাহ. ছিলেন শায়খুল হিন্দ রাহ.-এর শাগরিদ এবং হাকীমুল উম্মত থানবী রাহ.-এর বাইআত। মরহুম জীবনের শেষ দিকে বাড়ির  মাদরাসা জামিআ ইসলামিয়া হাজী সূফী উমেদ আলী রাহ. মাদরাসা পরিচালনা করতেন। একজন বুযুর্গ, দ্বীনী রাহনুমা হিসেবে স্থানীয়ভাবে সব মহলের মানুষ তাঁকে মান্য করত। তাঁর শশুর হযরত ইমাম ছাহেব রাহ.-এর পক্ষ থেকে তিনি বাইআতের ইজাযত পেয়েছিলেন। রাববুল আলামীন তাঁর এই প্রিয় বান্দাকে গরীকে রহমত করুন। মাগফিরাতের নেয়ামতে মালামাল করুন। আমীন

এই তথ্যগুলো আমাকে দিয়েছেন মুহতারাম মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ। জাযাহুল্লাহু খাইরান।

 

তিন.

গত ২১-০১-১৪৩৫ হিজরী,  মোতাবেক ০২-১১-২০১৩ ঈসায়ী,  মঙ্গলবার হাজ্বীপাড়া কাশিপুর থেকে আমার জাওয়ালে রিসালা এল যে, ওখানকার  ইফতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের তালিবুল ইলম জাফর ইবনে ফজলে ইলাহী (ইবনে মুবারক করীম ইবনে শামসুল হক ইবনে কারী ইবরাহীম উজানী) -এর ইন্তিকাল হয়েছে। আসরের নামায আদায় করছিলেন, হঠাৎ ঢলে পড়েন এবং সামান্য সময়ের মধ্যেই আখেরাতের মুসাফির হয়ে যান। 

 

চার.

গত ০২-০২-১৪৩৫হি. মোতাবেক ০৬-১২-২০১৩ঈ. জুমার দিন মারকাযুদ দাওয়াহ্র তালিবুল ইলম মওলবী আলী আকবরের পিতার ইন্তিকাল হয়েছে। তাঁর বয়স প্রায়  ৫০ বছর হয়েছিল। বড় নেক ও সাদা মানুষ ছিলেন। মিরপুর কালশী কবরস্থানে তাঁর দাফন হয়েছে। আল্লাহ তাআলা মারহুমকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে সবরে জামীল ইখতিয়ার করার তাওফিক দিন। মওলবী আলী আকবর খুব অল্প সময়ের মধ্যে তার পিতার দাফনের কাজ সম্পন্ন করেছে। এজন্য সে মোবারকবাদ পাওয়ার হকদার। আসরের পর ইন্তিকাল হয়েছে এবং এশার পর জানাযা ও দাফন হয়েছে। আজকাল অকারণে বা যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াই এ সুন্নত (অর্থাৎ দাফনে বিলম্ব না করা ) তরক করা হয়!

 

পাঁচ.

এই জুমার দিন শেষ হয়ে শনিবারের রাতের শুরুতে রাত সাড়ে বারটায় আমাদের মুহতারাম বুযুর্গ মাওলানা আবদুল মালেক হুসাইনী ইন্তিকাল করেন। কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি শাইখুল ইসলাম মাদানী রাহ.-এর শাগরিদ ছিলেন। সম্ভবত তিনি ১৩৭৭ হিজরীতে হযরত মাদানী রাহ.-এর সর্বশেষ দাওরায় শরিক ছিলেন। বড় সাদাসিধা নেক মানুষ ছিলেন। জীবনের শেষদিকে নিজ বাড়ির নিকটবর্তী কালিকাপুরে মাহমুদিয়া হুসাইনিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের ব্যক্তিগত মাকতাবা (লাইব্রেরী) যেখানে অনেক নাওয়াদের (বিরল সংগ্রহ) কিতাব ছিল-তা উক্ত মাদরাসায় স্থানান্তরিত করেন। বেরাদরে আযীয মাওলানা ইমদাদুল হক (কুমিল্লা,চৌদ্দগ্রাম) আমাকে তাঁর ইন্তিকালের খবর দেন। আল্লাহ তাআলা মারহুমকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। দারাজাত বুলন্দ করুন। তাঁর মাদরাসার হেফাজত করুন এবং মাদরাসাকে তাঁর জন্য সদকায়ে জারিয়া বানান।

একবার মাওলানা এমদাদ আমাকে এবং মাওলানা সাইদ বিন গিয়াসকে তাঁর খেদমতে নিয়ে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ সময় তাঁর থেকে এবং তাঁর নাদের কুতুবখানা থেকে আমরা উপকৃত হয়েছি। কিছু কিতাবের ফটোকপির অনুমতিও তিনি দিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে উত্তম প্রতিদান দিন। আশা করি মাওলানা ইমদাদুল হক তাঁর জীবনীর উপর এবং তাঁর কুতুবখানার উপর কোনো প্রবন্ধ লিখবেন। আল্লাহ তাওফিক দান করুন।

ছয়.

০৪-০২-১৪৩৫হি. মোতাবেক ০৮-১২-২০১৩ঈ. শনিবার দিবাগত রাতে সুবহে সাদিকের পূর্বে আমার খালুজান জনাব তাজুল ইসলাম ছাহেবের ইন্তিকাল হয়েছে। কুমিল্লা,মনোহরগঞ্জ, জিনারাগ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। বাড়ির নিকটেই হাসনাবাদ বাজারে কাসবে হালালের জন্য একটি দোকানে বসতেন। কিন্তু তাঁর আসল শেআর ছিল মসজিদের খেদমত। বাজার মসজিদের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে আযান, সাফায়ী সব ধরণের খেদমত করতেন। কখনো কখনো ইমামতিও করতেন। নিজের বাড়ি-সংলগ্ন মসজিদেরও সাফায়ী করতেন। আমার ধারণা কখনো তাঁর তাহাজ্জুদ কাযা হতো না।

সন্তানদেরকে ইলমে দ্বীন শিক্ষা দিয়েছেন।

বড় শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমার মনে হয় তাঁর দ্বারা জীবনে কেউ কোনো কষ্ট পায়নি।

أحسبه، والله حسيبه، ولا نزكي على الله أحدا

আল্লাহ তাঁকে পূর্ণ মাগফিরাত করুন। জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমার খালা এবং তাঁর সন্তান ও আত্নীয়-স্বজনকে সবরে জামীল এখতিয়ার করার তাওফিক দান করুন। আমীন

সাত.

গত ০৬-০২-১৪৩৫ হি. মোতাবেক ১০-১২-২০১৩ঈ. মঙ্গলবার সকাল ১১টার পর দেশের প্রবীণ বুযুর্গ আলেম হযরত মাওলানা নূরুল হুদা ছাহেবের ইন্তিকাল হয়েছে। নোয়াখালীর প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান চৌমুহনী ইসলামিয়া মাদরাসা। এটি আগে আলিয়া ছিল। তিনি অনেক কষ্ট মোজাহাদা করে সেটাকে কওমী মাদরাসায় রূপান্তর করেছেন। এই মাদরাসার উসতাযুল হাদীস ওয়াল ফিক্হ জনাব মাওলানা বেলালুদ্দীন ছাহেব আমাকে বলেছেন যে, হযরত রাহ. ঢাকা আলিয়ায় হযরত মাওলানা যফর আহমদ উসমানী রাহ. এবং মাওলানা আমীমুল ইহসান রাহ.-এর কাছে পড়ার পর দারুল উলূম দেওবন্দেও গিয়েছিলেন এবং ঐ সময়ের আকাবিরদের থেকে ইলম হাসিল করেছেন।

একাধিকবার হযরত রাহ.-এর সাথে আমার সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছে। একবার হযরত মাওলানা মুমিনুল্লাহ ছাহেবের ছোহবতে মাওলানা শরীফ মুহাম্মদসহ কয়েক সাথী তাঁর খেদমতে উপস্থিত হয়েছিলেন। বান্দাও পিছে পিছে ছিলাম।

হযরত মাওলানা মুমিনুল্লাহ ছাহেব ছাড়াও হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর আরো কোনো খলীফায়ে মুজায থেকেও শুনেছি যে, হাফেজ্জী হুজুর রাহ. আলেম তবাকার মধ্যে হযরত খতীব ছাহেব রাহ. ও হযরত মাওলানা নূরুল হুদা রাহ.-এর আকল ও তায়াক্কুয-বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার প্রশংসা করতেন এবং তাঁদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়ার কথা বলতেন।  

আশা করি চৌমুহনী ইসলামিয়া মাদরাসা থেকে তাঁর জীবন ও কর্মের উপর ব্যাপক আকারে কোনো

কাজ হবে।

আট.

এই দুআয়ে মাগফিরাতের আবেদন লিখছিলাম, এমন সময় এক ভাই খবর দিলেন যে, সিলেটের হযরত মাওলানা কুতবুদ্দীন ছাহেবের  ইন্তিকাল হয়ে গেছে। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন। অনেকদিন যাবত হযরত রাহ. অসুস্থ ছিলেন। এ কারণে আশা করা যায় বাতেনী তারাক্কীও অনেক হয়ে থাকবে। অবশেষে ১০ সফর ১৪৩৫ হিজরী, শনিবার দিবাগত রাতে আনুমানিক সাড়ে আটটায় আখেরাতের মুসাফির হয়ে গেছেন। ১১ সফর রবিবার তাঁর সেজ ছেলে মাওলানা মাকসুদ বিশাল জামাতে তাঁর জানাযার ইমামতি করেন।

اَللهُمَّ أَكْرِمْ نُزُلَهُ وَوَسِّعْ مَدْخَلَه وَلا تَفْتِنَّا بَعْدَهُ

জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ এবং ঢাকার বিভিন্ন মাদরাসায় তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণকারী উলামায়ে কেরাম সারা দেশে ছড়িয়ে আছেন। যাঁদের মধ্যে অনেকেই বর্তমানে আকাবির পর্যায়ের। তাঁদের খেদমতে আমার সবিনয় নিবেদন, বিস্তৃত আকারে হযরত রাহ.-এর জীবনী প্রস্ত্তত করে  যেন আগামী প্রজন্মের তালিবুল ইলমদের জন্য আদর্শ গ্রহণের

নমুনা উপহার দেন।

বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক

১১.০২.১৪৩৫ হিজরী

 

 

advertisement