মমতা ও বিচক্ষণতা
ইবনে নসীব
তালীম ও তারবিয়তের অর্থ সঠিকভাবে অনুধাবন করার পর উপরোক্ত দুই বৈশিষ্ট্যের অপরিহার্যতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তরবিয়তকারী প্রথমেই যে বিষয়টির মুখোমুখি হয় তা হল তরবিয়তগ্রহণকারীকে অনুধাবন করা। তার মন-মানস, চাহিদা ও প্রবণতা এবং যোগ্যতা ও সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করা ছাড়া সফল তরবিয়ত সম্ভব নয়। পদে পদে এর প্রয়োজন পড়ে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উপযুক্ত আচরণ এবং তার ত্রুটি-বিচ্যুতির সংশোধনের পাশাপাশি তার যোগ্যতা ও প্রতিভাগুলো বিকশিত করার জন্য গভীর বিচক্ষণতার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রেও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সীরাত আমাদের জন্য আদর্শ। তরবিয়তকারীগণ যদি এই দৃষ্টিকোণ থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাতে মুবারাকা অধ্যয়ন করেন তবে তা অনেক সুফল প্রদান করবে ইনশাআল্লাহ। একটি দৃষ্টান্ত :
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে উপদেশ দানের জন্য দিবসের উপযুক্ত সময় অন্বেষণ করতেন যাতে আমাদের মাঝে বিরক্তি সৃষ্টি না হয়।’ -সহীহ বুখারী ১/৪২, হাদীস : ৬৮
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. নিজেও এই আদর্শ অনুসরণ করতেন এবং অত্যধিক ওয়াজ-নসীহত থেকে বিরত থাকতেন।
এখান থেকে বোঝা যায় যে, তরবিয়তগ্রহণকারীর মানসিক অবস্থার প্রতি লক্ষ রাখা আদর্শ উস্তাদের বৈশিষ্ট্য।
তদ্রূপ মমতা ও ভালবাসা তরবিয়তকে অনেক সহজ ও ফলপ্রসূ করে তোলে। একজন আরব কবি বলেছেন, ‘কারো মনে তোমার সম্পর্কে কী অনুভূতি রয়েছে তা তাকে জিজ্ঞাসা করো না; বরং তোমার মনের অনুভূতি থেকেই তুমি তা অনুমান করতে পার।
‘তার অন্তরে যদি বিদ্বেষ থাকে তবে তোমার অন্তরেও তা দেখতে পাবে আর যদি ভালবাসা থাকে তবে তোমার ভালবাসাও তার প্রাপ্তি হবে।’ কারণ স্নেহ ও ভালবাসা এমন একটি সংক্রামক বিষয়, যা কখনো এক পক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। অন্য পক্ষের মধ্যেও তা সঞ্চারিত হয়ে যায়।
তরবিয়তকারী যদি তরবিয়তগ্রহণকারীর প্রতি স্নেহ, ভালবাসা ও কল্যাণকামিতা পোষণ করেন তবে অবশ্যই এর সুফল প্রকাশ পাবে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সীরাত এর উত্তম দৃষ্টান্ত। সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে কেমন ভালবাসতেন তার বিবরণ হাদীসের কিতাবসমূহে সংরক্ষিত রয়েছে। এক কথায় বলা যায় যে, পৃথিবীর ইতিহাসে এর কোনো নজির নেই, কিন্তু এই ভালবাসা কীভাবে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হল তার উৎস সন্ধান করলে দেখা যাবে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাদের গভীরভাবে ভালবাসতেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) ‘অবশ্যই তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের নিকট একজন রাসূল আগমন করেছেন, তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।’-সূরা তাওবা : ১২৮
এই কুরআনী বিবরণের অসংখ্য দৃষ্টান্ত নবীজীর পবিত্র সীরাতে মুক্তার মতো ছড়িয়ে আছে। একটি দৃষ্টান্ত দেখুন :
হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাকে বললেন, হে মুয়ায, আমি অবশ্যই তোমাকে ভালবাসি। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমিও আপনাকে ভালবাসি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, তাহলে কোনো নামাযে যেন এই দুআ না ছোটে-
‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে আপনার যিকরের, শোকরের এবং উত্তম ইবাদতের তাওফীক দিন।’
প্রশ্ন এই যে, এই মমতাপূর্ণ ভাষায় শিক্ষাদানের পর শীষ্য কি কখনো এই দুআ পড়তে ভুল করবে?
উল্লেখ্য, পরবর্তীতে হযরত মুয়ায রা. ‘আ’লামুহুম বিলহালালি ওয়াল হারাম’ অর্থাৎ হালাল-হারামের সবচেয়ে বড় আলিম উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।