অনর্থক আলোচনা-মন্তব্য রেখে ইসলাহ ও দুআর প্রতি মনোযোগী হই
আমাদের দেশের পরিস্থিতি তো হরহামেশাই খারাপ থাকে । যে দেশে আল্লাহর বিধান কার্যকর নয়, যে দেশে আল্লাহর বিধান তো মানা হয়-ই না, উল্টো আল্লাহর বিধানের সম্পূর্ণ বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয় এবং একেই উন্নতি-উৎকর্ষের সোপান মনে করা হয়, সে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কখনোই ‘ভালো’ থাকা সম্ভব না। কিন্তু তা অনুভব করা হয় বলে মনে হয় না। সাধারণত যা মনে করা হয় এবং কার্যত যা দেখা যায় তা হল, জনগণের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু যখন ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়ে সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকে এবং দিন দিন তা বাড়তেই থাকে তখন বলতে দেখা যায়, ‘দেশের পরিস্থিতি ক্রম অবনতিশীল’! কিন্তু তখনও পরিস্থিতি বদলের বস্ত্তনিষ্ঠ কোনো তৎপরতা থাকে না। কেবল পরিস্থিতি সম্পর্কে অযথা মন্তব্য আর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যাওয়া হয়। আর মন্তব্য করার ক্ষেত্রেও কোনো বিচার-বিবেচনা থাকে না । আমানতদারি বা ইনসাফের তোয়াক্কা করা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর ভিত্তি হয় স্থহূল ভাবনা, খেয়ানত আর না-হক পক্ষপাত। সরকার বদলের সময়ে পত্র-পত্রিকাগুলো যদি তুলনা করে পড়া হয়, দেখা হয় যে বিগত টার্মে এই সময়ে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে এই পত্রিকা কী মন্তব্য করেছিল, আর এখন ঠিক সে রকম পরিস্থিতিতেই সেই পত্রিকা কী মন্তব্য করছে-তাহলে অবাক হয়ে যেতে হয়, একই পত্রিকার দুই মূল্যায়নে এতো ফারাক হয় কী করে?
মন্তব্য প্রকাশ ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার প্রবণতা আমাদের মাঝে বেশ ব্যাপক। ঘরোয়া বৈঠক, সভা-সম্মেলন, সংবাদ মাধ্যম ইত্যাদি সব জায়গায়-ই লাগামহীনভাবে এর চর্চা হয়। এই মন্তব্য-প্রতিক্রিয়াগুলোতে বাস্তবতা থাকে কতটুকু? আর নিছক ‘মন্তব্যের জন্যে মন্তব্যের’ দরকারই-বা কী? সর্বোপরি এগুলো কি কেবলই মন্তব্য নাকি তার বেশিরভাগ জুড়েই থাকে অন্যায় ধারণা, গীবত, পরনিন্দা আর রুচিবিরুদ্ধ গালাগালি? এগুলো নিয়ে এখন না হয় আলোচনা না-ই করলাম। এগুলোর আলোচনায় না গিয়ে এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে বলতে চাচ্ছি সেটা হল, এ ধরনের সঙ্কটমুহূর্তে আমরা একটি বড় বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে যাই। একটি ধ্রুব সত্যকে বেমালুম ভুলে যাই। সেটা হল, ‘এই প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ খোদ আমাদেরই বদআমল।’ আমরা প্রত্যেকে যদি ভাবতাম, এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পেছনে হয়তো আমার বদ অমলেরও আছর আছে, আমরা গোটা জাতি যদি এই বাস্তবতা স্বীকার করে নিতাম যে, এই বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার মৌলিক কারণ খোদ এ জাতিরই বদআমল তাহলে অন্তত অনর্থক আলোচনা-মন্তব্যে সময় নষ্ট না করে সবাই নিজের ইসলাহের ফিকির করতাম। তওবা-ইস্তিগফার এর ইহতিমাম করতাম। দুআ-মুনাজাতে রত থাকতাম। সমাজের প্রত্যেকটা লোক তখন ভাবত, আমি তো এ সমাজেরই একজন। হতে পারে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পেছনে আমার বদআমলেরও আছর আছে। আমি নিজেকে সংশোধন করব। নিজের উপর তো অন্ততপক্ষে আমার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা আছে। আমি নিজেকে বদলে ফেলব। আমি গুনাহ থেকে বাঁচার দৃঢ় সংকল্প করব। আমি যথাসম্ভব আল্লাহর নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকব। এর জন্য আমি আল্লাহ তাআলার কাছে তাওফিক প্রার্থনা করব।
কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
মানুষ নিজ হাতে যা কামায়, তার ফলে স্থলে ও জলে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে, আল্লাহ তাদেরকে তাদের কতক কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ করাবেন; হয়ত (এর ফলে) তারা ফিরে আসবে।-সূরা রূম (৩০), আয়াত : ৪১
মানুষের মন্দ কর্মের কারণে কী ধরণের ফ্যাসাদ দেখা দেয়, এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কত ধরনের শাস্তি দেওয়া হয় তাও বলা হয়েছে কুরআনে কারীমে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ هُوَ الْقَادِرُ عَلَى أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِنْ فَوْقِكُمْ أَوْ مِنْ تَحْتِ أَرْجُلِكُمْ أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا وَيُذِيقَ بَعْضَكُمْ بَأْسَ بَعْضٍ انْظُرْ كَيْفَ نُصَرِّفُ الْآَيَاتِ لَعَلَّهُمْ يَفْقَهُونَ
(তরজমা) বল, তিনি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সক্ষম যে, তোমাদের প্রতি শাস্তি পাঠাবেন তোমাদের উপর দিক থেকে অথবা পদতল থেকে। অথবা তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে একদলকে অন্যদলের শক্তির স্বাদ গ্রহণ করাবেন। দেখ, আমি কীভাবে বিভিন্ন পন্থায় স্বীয় নিদর্শনাবলী বিবৃত করছি, যতে তারা বুঝতে সক্ষম হয়।-সূরা আনআম (৬), আয়াত : ৬৫
এখন গোটা উম্মাহর জন্যে সবচেয়ে বড় আযাব তো এই-ই যে, নানা ক্ষেত্রে কেবল পক্ষসমর্থনের কারণে আজ তারা বিভেদ-বিচ্ছেদের শিকার। কোথাও তাদের উপর শত্রুদের চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোথাও তারা নিজেদের হাতেই মার খাচ্ছে। সূরা আনআমের একটি অয়াতে এও ইরশাদ হয়েছে,
وَكَذَلِكَ نُوَلِّي بَعْضَ الظَّالِمِينَ بَعْضًا بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
এভাবেই আমি জালেমদের কতককে কতকের উপর তাদের কৃতকর্মের কারণে আধিপত্য দান করে থাকি।-সূরা আনআম (৬), আয়াত : ১২৯
ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর উস্তায, প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ইমাম সুলায়মান আ’মাশ রাহ.-কে মানসুর ইবনে আবিল অসওয়াদ জিজ্ঞাসা করেছিল, উক্ত আয়াত সম্পর্কে তিনি তাঁর বড়দের কাছ থেকে কিছু শুনেছেন কি না? তিনি বললেন-
سمعتهم يقولون: إذا فسد الناس أمر عليهم شرارهم
আমি তাঁদের বলতে শুনেছি, যখন মানুষ খারাপ হয়ে যাবে তখন তাদের মন্দ লোকদের হাতে শাসনভার অর্পণ করা হবে। -হিলইয়াতুল আউলিয়া, আবু নুয়াইম ইস্পাহানী : ৫ : ৫০-৫১, দারুল ফিকর, বৈরুত (ইমাম আ’মাশের জীবনী); আদ দুররুল মানছুর : ৬ : ২০৩ আবুশ শায়খ ইস্পাহানী-এর বরাতে (তাহকীক : আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুহসিন আত তুরকী)
ইমাম আবু ইউসুফ রাহ. আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা যখন কোনো জাতির কল্যাণ চান তখন নেককার ও সমঝদার লোকদের হাতে শাসনভার প্রদান করেন, দানশীল লোকদেরকে ধন-সম্পদ দান করেন। আর যখন তাদেরকে শাস্তি প্রদান করতে চান তখন বদকার ও বদমেযাজি লোকদের হাতে শাসনভার ন্যাস্ত করেন, কৃপণ লোকদের ধন-সম্পদ দান করেন।
حدثنا هشام بن سعد ، عن الضحاك بن مزاحم، عن عبد الله بن عباس قال:قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : " إِذَا اراد الله بقوم خيرا استعمل عليهم الحلماء , وجعل أموالهم فِي أيدي السمحاء . وإذا أراد الله بقوم بلاء استعمل عليهم السفهاء , وجعل أموالهم فِي أيدي البخلاء
-কিতাবুল খারাজ, ইমাম আবু ইউসুফ, বর্ণনা : ১৬
কোনো জাতির জন্যে কল্যাণের ফায়সালা তো আল্লাহ তাআলা তখনই করেন যখন তারা দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। দ্বীনের মৌলিক ও প্রতীকী বিধানাবলির সম্মান করে। আল্লাহর বিধান-বিরুদ্ধ কোনো ফায়সালা না করে। আর পরিস্থিতি বদলের ইলাহী সুন্নাত তো কুরআনে কারীমে সূরা রা’দে (১৩:১১) আল্লাহ তাআলা বলেছেন। যার সারকথা হল, ‘কোনো কারণ ছাড়া এমনি এমনি আল্লাহ তাআলা কোনো জাতির অবস্থা বিগড়ে দেন না। যখন তারা আল্লাহর নাফরমানি করা শুরু করে এবং ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে তখন শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তাদের আবস্থা পাল্টে দেন।’
যদি আমরা অনুকূল পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে চাই তো তার পথ ও পন্থা একটিই। আর তা হল, নাফরমানি ত্যাগ করে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য করা। হঠকারিতা ও ঔদ্ধত্য বাদ দিয়ে আল্লাহর দাসত্ব ও তাঁর ইবাদাতের পথ অবলম্বন করা।
এখন আমাদের সবার কর্তব্য, অনর্থক আলোচনা-মন্তব্য, নিন্দা-অভিশাপ, গীবত-দোষচর্চা, গালিগালাজ ইত্যাদি বাদ দিয়ে নিজের আমল সংশোধনে মনোযোগী হওয়া। সবধরণের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। বিশেষ করে সুদ, ঘুষ, জুয়া, আমানতের খেয়ানত, লেনদেনে ধোঁকাবাজি, ওজনে কম দেওয়া, যাকাত প্রদান না করা, অন্যের হক মেরে খাওয়া, আল্লাহওয়ালাদের সাথে শত্রুতা রাখা, আল্লাহর বান্দাদের জান-মাল, ইজ্জত-আবরুর উপর হামলা করা, আল্লাহর বিধান-বিরোধী ফায়সালা করা, কিংবা আল্লাহর বিধান-বিরুদ্ধ আইন প্রণয়ন করা, ওয়াদা খেলাফ করা, চুক্তি ভঙ্গ করা, মিথ্যা বলা, ধোকাবাজি ও ষড়যন্ত্র করা, সবধরণের অশ্লীলতা- ইত্যাদি অনৈতিক কাজগুলো সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা। এগুলো এমন ধংসাত্নক ব্যাধি যা সমাজের স্থিতি নষ্ট করে দেয়। এককভাবে ও সমষ্টিগতভাবে সকলের কর্তব্য, এ ধরণের কাজ থেকে দূরে থাকা। এবং আল্লাহ তাআলার কাছে তওবা করা।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি মানুষ খুন হওয়ার পর প্রত্যেক দল অন্য দলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেকে ‘দোষমুক্ত’ ভেবে নিলেই আমরা অন্যায় খুনের ‘অভিশাপ’ থেকে নিস্তার পেয়ে যাবো। আল্লাহ তাআলা সবকিছু দেখছেন, শুনছেন। তিনি গায়েব জানেন। দিলের খবরও জানেন। আল্লাহ তাআলার কাছে গোটা পৃথিবীর চেয়েও একজন মানুষের জানের মূল্য বেশি। শুধু একটি অন্যায় খুনের অপরাধে তিনি গোটা পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে পারেন। তাঁর আদালতে একটি অন্যায় খুনের অপরাধ এর চেয়েও জঘন্য। জুলুম করে মানুষের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে কেউ যদি ভাবতে থাকে যে, সে আল্লাহর কাছ থেকেও রেহাই পেয়ে গেছে তাহলে সে ভুল ধারণার সাগরে ডুবে আছে। জালিম কিছুতেই বাঁচতে পারবে না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সমগ্র জাতির কর্তব্য, খালেস দিলে আল্লাহর কাছে তওবা করা। যদি তা না হয়, তো অমত্মত যার দিলে ঈমান আছে এবং আখেরাতে আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতার ভয় আছে তার উচিত এককভাবে হলেও আল্লাহ তাআলার কাছে তওবা- ইস্তেগফার করা, নিজের নফস ও আমল সংশোধনের চেষ্টা করা। বেশি বেশি দরূদ শরীফ পড়া, কুরআন শেখা, কুরআন-পড়া শুদ্ধ করা, কুরআন তেলাওয়াতের ইহতিমাম করা। অর্থের দিকে লক্ষ্য করে মনোযোগের সাথে নিমেণাক্ত দুআগুলো বেশি বেশি পড়া
لَا إِلهَ إِلا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّيْ كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِيْنَ.
حَسْبُنَا اللهُ وَ نِعْمَ الْوَكِيْلُ.
لَا حَوْلَ وَ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ، لَا مَلْجَأَ وَلَا مَنْجَأَ مِنَ اللهِ إِلا إِلَيْهِ.
মানুষের মধ্যে দ্বীন শেখার আগ্রহ, কুরআন শেখার আগ্রহ, উলামায়ে কেরামের শরণাপন্ন হওয়ার আগ্রহ তৈরির জন্যও মেহনত করা উচিত।
হে আল্লাহ! হে রহমান! হে গাফফার! হে কারীম! তুমি আমাদের রহম করো। তোমার রহমতই আমাদের একমাত্র আশ্রয়। তুমিই দয়া করো। তোমার দয়াই আমাদের শেষ ঠিকানা।