আমার চাচাজান : মাওলানা মুফতী নোমান কাসেমী রাহ.
আমি যখন মাদরাসায়ে আরাবিয়া খেড়িহরে (শিক্ষাবর্ষ ১৪০৬-১৪০৭ হি) মেশকাত পড়ি তখন মাওলানা নোমান রাহ. সম্ভবত তাইসীর অথবা মীযান জামাতে পড়েন। তার সাথে আমার গভীর সম্পর্ক ছিল। এর একটা কারণ এটাও যে, তার বড় ভাই আমার উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা ইলিয়াস দামাত বারাকাতুহুম আমাকে অত্যন্ত মহববত করতেন।
মাওলানা নোমান রাহ. হাসিখুশি তবিয়তের মানুষ ছিলেন।
ولو أن تلقى أخاك بوجه طلق
(সবার সাথে সহাস্য বদনে মিলিত হওয়া) - এই সুন্নতের উপর আমল ছিল তার স্বভাবজাত বিষয়। গত বছর মাদরাসায়ে আশরাফিয়া সাইনবোর্ডে হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুল বারী সাহেব দামাত বারাকাতুহুম-এর ইসলাহী জোড়ে তার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। কে জানে সেটাই হবে তার সাথে শেষ সাক্ষাত! আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন এবং তার পরিবারের জিম্মাদার হয়ে যান।
বেরাদারে আযীয উমায়ের সাদী থেকেই আমি তার ইন্তিকালের খবর জানতে পারি। সে তার চাচাজানের জীবনীর উপর লিখেছে। আমি তা সাদরে গ্রহণ করেছি। আল্লাহ তাআলা তাকে ইলমে নাফে ও আমলে ছালেহ দ্বারা পরিপূর্ণ করুন। আমীন।-মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
হযরত মাওলানা মুফতী নোমান কাসেমী। আলেমসমাজে এই নামটি অনেকটাই প্রসিদ্ধ। এই প্রতিভাবান আলেমে দ্বীন গত ১৫ আগস্ট ২০১৩ ইং বৃহস্পতিবার সকাল ৬:৩০ মিনিটে ভূঁইগড় থেকে সাইনবোর্ড যাওয়ার পথে জামেয়া আশরাফিয়ার নিকটস্থ রাস্তার পাশে বেপরোয়া ট্রাকের তীব্র আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন এবং তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে (ইনশাআল্লাহ) জান্নাতের পথের যাত্রী হয়ে যান। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ তাআলা তার দ্বীনী খেদমতগুলোকে কবুল করুন এবং তার জীবনের সমস্ত ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে তাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন।
বড়দের জীবনগাঁথা সংগ্রহে থাকলে পরবর্তীদের জন্য তা মাইলফলক হিসেবে কাজ করে এবং নিজেদের স্বর্ণোজ্জ্বল অতীত সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন হয়। এই উদ্দেশ্যে তার সংক্ষিপ্ত জীবনী উপস্থাপন করছি।
১. ১৯৭৩ সালের ১ আগস্ট নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানাধীন প্রসিদ্ধ গ্রাম দৌলতপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বাবা মৌলভী সাঈদুর রহমান ও মা ওহিদা বেগমের কোল জুড়ে আসে এক অতিথি, যার আগমনে এই সৌভাগ্যশীল ঘরটি পঞ্চম বারের মতো নতুন করে আবার আলোকিত হয়। নাম রাখা হয় নোমান। কিন্তু তারা হয়তো কখনো ভাবেননি যে, পরে আসা এই ছেলেটি পরিবারের অন্য সকল সদস্যের আগেই ওপারের ঠিকানায় চলে যাবে। কিন্তু কপালের লিখন, যাকে বলে তাকদীর। এই সংক্ষিপ্ত জীবনের অবসান ঘটিয়ে তিনি পৌঁছে গেলেন কাঙ্খিত মঞ্জিলে। যেখানে পৌঁছা মহান আল্লাহ তাআলার কাছে তার জন্য সুনির্ধারিত ছিল।
২. আলেম পরিবার বলে কথা। মক্তব তার ঘরেই। তথাপি স্থানীয় ফোরকানিয়া নূরানী মক্তব ও দৌলতপুর প্রাইমারী স্কুলের পর ১৯৮৬ সালে তের বছর বয়সে চাঁদপুর শাহরাস্তী থানাধীন খেড়িহর গ্রামে নানার বাড়ির নিকটস্থ জামেয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদরাসায় ইবতেদায়ী জামাতে ভর্তি হন। সেখানে নাহবেমীর জামাত পর্যন্ত পড়েন। ১৯৮৯ সালে চৌমুহনী ফালিকাপুর ইমদাদিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং সেখানে হেদায়াতুন্নাহু হতে শরহে জামী পর্যন্ত পড়েন। তারপর ১৯৯২ সালে ঢাকা মুহাম্মাদপুর জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ায় ভর্তি হন। যেখানে ইলমী অভিভাবক হিসেবে পেয়েছিলেন শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রাহ.-কে এবং হযরতের ছায়াতলে থেকে ১৯৯৫ সালে সেখান থেকেই দাওরায়ে হাদীস শেষ করেন। তারপর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ভারতে চলে যান। সেখানে গাঙ্গুহে এক বছর ইফতা পড়েন এবং পরবর্তীতে উম্মুল মাদারেস দারুল উলূম দেওবন্দে পুনরায় দাওরা হাদীস ও ইফতা পড়েন। তিনি দাওরার সমাপনী পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ২য় স্থান অধিকার করেছিলেন।
৩. ১৯৯৮ সালে দেওবন্দ থেকে ফেরার পর নিজ গ্রাম দৌলতপুরে হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মেসবাহ রাহ. -এর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা জামেয়া জিন্নূরাইনে শিক্ষকতায় যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবনের শুভ সূচনা হয়। সেখানে তিনি ফতোয়া বিভাগের প্রধান মুফতী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালে ঢাকা গেন্ডারিয়া জামালুল কুরআন মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীসের উস্তায হিসেবে যোগদান করেন। সে সময় নারিন্দায় এক মসজিদে ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে তিনি জামেয়া আশরাফিয়া সাইনবোর্ডে দাওরায়ে হাদীসের উস্তায হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে উক্ত জামেয়ায় ফতোয়া বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি ওই এলাকায় একটি মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ওই মাদরাসায় থাকাকালীন মাইজদী ধন্যপুর মিফতাহুল উলুম মাদারাসায় সহীহ বুখারীর (আংশিক) তাদরীসের খেদমতও আঞ্জাম দিতেন। তাছাড়া তিনি বাংলাদেশ কওমী শিক্ষাবোর্ড বেফাকের নিরীক্ষক পদে নিযুক্ত ছিলেন।
কর্মক্ষেত্রের আরেকটি মুখ সবেমাত্র দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করার সুযোগটুকু আর পাননি। ভূঁইগড়ে নিজ আবাসস্থলের কাছে দারুল উলুম মারকাযুস্সুন্নাহ নামে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ছিল নূরানী হতে শরহে বেকায়া পর্যন্ত এবং পৃথকভাবে ইফতা বিভাগ। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার মাদরাসার আগে তাকেই কবুল করে নিলেন।
৪. হযরত মাওলানা মুফতী নোমান কাসেমী রাহ. দেওবন্দ থেকে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফেরার পর কর্মজীবনের প্রথম দিকে ২০০০ সালে মাইজদীর প্রখ্যাত আলেম মিফতাহুল উলুম মাদরাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা আনসারুদ্দিন দা.বা. -এর বড় মেয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। কিন্তু মাত্র ১৪ বছর সাংসারিক জীবন পার করে তিনি পরলোক গমন করলেন। রেখে গেছেন তার প্রিয়তমা স্ত্রীসহ তিনটি সন্তান। ১৩ বছর বয়সের একটি কন্যা এবং ৭ ও দেড় বছর বয়সের দুটি ছেলে। বড় ছেলে আব্দুর রহমান তাশফীন সবেমাত্র কুরআনে কারীমের হিফজ নিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা যেন এর শেষ ছবকটুকু আদায় করিয়ে তার বাবার পবিত্র আশা পূরণ করেন এবং তাকে হক্কানী আলেম বানান।
৫. ইলমী কিতাবাদির অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তিনি বাংলাভাষায়ও বেশ দক্ষ ছিলেন। দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ফিরে সর্বপ্রথম তিনি ‘জান্নাত লাভের উপায়’ নামে হযরত উমর পালনপুরী রাহ. -এর একটি বইয়ের অনুবাদ করেন। আরবী সাহিত্যের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ মাকামাতে হারীরীর বাংলা অনুবাদ করেন এবং মেশকাত জামাতের নিসাবভুক্ত বিষয় ‘ফিরাকে বাতেলা’ প্রশ্ন- উত্তরে সাজিয়ে একটি গ্রন্থ তৈরি করেন।
৬. মুফতী নোমান কাসেমী রাহ. মোট ৬বার পবিত্র বাইতুল্লাহ যিয়ারতের সুযোগ লাভ করেন। ২০০৪ সালে তিনি সর্বপ্রথম হজ্ব করেন। ২০১২ সালে তিনি জীবনের শেষ বারের মতো বাইতুল্লাহকে বিদায় জানান। আর ২০১৩ তে স্বীয় স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে হজ্বে যাওয়ার জন্যে পূর্ণ প্রস্ত্তত ছিলেন। কিন্তু কী হবে। মহান রাববুল আলামীনের ফায়সালাই যে শিরোধার্য।
৭. একজন মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ববোধ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য যতগুলো সৎগুণ থাকার প্রয়োজন, প্রায় সবগুলোই তার মাঝে উদ্ভাসিত ছিল। মানুষ হিসেবে যেমন তেমনি ইলমের ময়দানে একজন যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন।
আমার বাবা বলেন, ছোট বেলায় ওর যেহেন ও প্রতিভা দেখে আমার মনে খুব ইচ্ছা জাগত যে, ওকে ঢাকার বড় মাদরাসাগুলোতে লেখাপড়া করাব এবং উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য দেওবন্দ পাঠাব। আল্লাহ তাআলা আমার বাবার সেই ইচ্ছা পূরণ করেছেন। আরো শুনেছি, চাচা যখন দেওবন্দ থেকে দেশে ফিরলেন, তখন হযরত হাবীবুল্লাহ মেসবাহ রাহ. তাকে স্টেশন হতে এগিয়ে আনেন এবং বলেন, তুমি আমার মাদরাসায় মুদাররিসি করবে। অন্য কোথাও যাবে না। চাচার প্রতি তাঁর আন্তরিকতা ছিল অনেক। ছাত্রজীবনে তার তালিমী মুরুববী ছিলেন তার মামা হযরত আব্দুল হাফিজ রাহ., যিনি দীর্ঘকাল ফরিদাবাদ মাদরাসার মুহাদ্দিস ছিলেন। চাচা ইলমের প্রতি এত আগ্রহী ছিলেন যে, তার একটি অনন্য অভ্যাসের কথা আজও মনে পড়ে। আমি তখন হিফজ পড়তাম। ভোরে যখন ঘুম থেকে উঠতাম তখন প্রায় সময়ই দেখতাম তিনি দাওরা হাদীসের দরস দিচ্ছেন। পরনে সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামা এবং মাথায় পাগড়ী। প্রায় দিনই দাওরা হাদীসের দরজায় আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কী বলতেন কিছুই বুঝতাম না, কিন্তু শুনতে খুব ভাল লাগতো। তাই মন দিয়ে শুনতাম। চাচার আরেকটি চমৎকার বৈশিষ্ট্য হল, যখনই তার সাথে দেখা হতো, তিনি চমৎকার করে মুচকি হাসতেন। হয়তো আল্লাহ তাআলার নিকট তার এই হাসি পছন্দনীয় ছিল। শেষবার যখন কফিন খুলে কাপড় সরিয়ে তার পবিত্র মুখখানা দেখলাম, অবিকল সেই চেনা হাসিটি চোখে ভেসে উঠল এবং কাফন মিলে যাবার পূর্ব পর্যন্ত তার এই হাসি সবার চোখে পড়ছিল।
৮. একজন শাসক চলে গেলে তার রেখে যাওয়া পদ পূর্ণ হয়, কিন্তু একজন আলেম চলে গেলে তার জায়গা পূর্ণ হয় না। আজ আমার চাচা হযরত মাওলানা মুফতী নোমান কাসেমী রাহ. চলে গেলেন। কিন্তু তার রেখে যাওয়া আদর্শ ও স্বপ্ন রয়ে গেছে। সুতরাং তার স্বপণকে যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে তার আত্মার প্রশান্তি হবে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।