তাহকীকের গলদ ব্যবহার
মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার হযরতপুর প্রাঙ্গণের মসজিদে ১৯ যিলকদ ১৪৩৪ হি., জুমাবার, বাদ আসরের বয়ানটি মুসাজজিলা থেকে নকল করেছেন মৌলবী আশেকে এলাহী। ছাহেবে বয়ানের নযরে ছানীর পর তা ছাপা হল।-বি.স
জুমার দিন দরূদ শরীফের আমল করা হয় কি না- জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, কেউ কেউ নিয়মিত করে, কেউ কেউ মাঝেমধ্যে করে। কয়েকজনের কথায় এমনও বুঝা গেল যে, তারা আগে ইহতিমামের সাথে এই আমল করত। এখন আর আগের মতো ইহতিমাম করে না। হুজুর বললেন, এতে তো তানাযযুল হল, তারাক্কী হল না। এই তানাযযুলের কারণ কী? কারণ দুটি-
১. অবহেলা-অলসতা
২. তাহকীকের বদহজম।
‘প্রান্তিকতামুক্ত উলূমুল হাদীসের ব্যবহার’ বিষয়ে ইতিপূর্বে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। উলূমুল হাদীসের গলদ ব্যবহারের একটা দিক এই যে, কোনো রেওয়ায়েতের মান নির্ণয়ের জন্য সনদের তাহকীক করা হয়। কিন্তু তাহকীকটা হজম করা হল না। তাহকীকের বদহজম অনেক বড় ফেতনা। প্রত্যেক ময়দানে যে কোনো বিষয়ের তাহকীকের ক্ষেত্রে বদহজম হতে পারে। তাহকীকের বদহজম হলেই ফেতনা হবে। তাহকীকের বদহজম হয় দুই জিনিসের অভাবে। ১. তাফাক্কুহের অভাব ২. আকলে সালীমের অভাব।
তাফাক্কুহ এবং আকলে সালীম না থাকার কারণে তাহকীককে তার নতীজার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নতীজার বাইরে ব্যবহার করা হয়। এটাই হল তাহকীকের বদহজম। যখনই তাহকীকের বদহজম হবে তখনই ফেতনা হবে।
‘জুমার দিন আসরের পর আশিবার দরূদ শরীফ পড়লে আশি বছরের গুনাহ মাফ হয়।’ ধর, তুমি এ বিষয়ের হাদীসটি তাহকীক করলে। আর তোমার কাছে শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ.-এর বক্তব্যের (হাদীসটি হাসান লিগাইরিহী পর্যায়ের) চেয়ে হাফেয ইবনে হাজার রাহ.-এর তাহকীক বেশি শক্তিশালী মনে হল। তিনি বলেছেন, রেওয়ায়েতটি মুনকার। তুমি খুব দলিল-প্রমাণের আলোকে এটাই সাব্যস্ত করলে। তোমাকে এই তাহকীকের জন্য বহু মোবারকবাদ। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই তাহকীকের নতীজা কী?
এর নতীজা কি এটা যে, তুমি আগে এই আমলটি করতে এখন তা ছেড়ে দিবে। বা ইহতিমামের সাথে করবে না। বা যারা এই আমল করছে তাদেরকে এই আমল ছেড়ে দিতে বলবে? যদি তুমি এমনটিই মনে কর তবে তা হবে তাহকীকের বদহজমী।
তোমার তাহকীক যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে এর নতীজা শুধু এতটুকু যে, তুমি এই রেওয়ায়েতের ইশাআত করবে না এবং আমলের সময় উপরোক্ত সওয়াবের আকীদা রাখবে না। তবে কোনো সংখ্যা ও সময়ের সাথে এর নির্দিষ্টতাকে মুস্তাহাব মনে করবে না; বরং শুধু মুবাহ মনে করে আমল করবে।
এর নতীজা কখনো এই নয় যে, তুমি আমলটি ছেড়ে দেবে বা অন্যকে করতে নিষেধ করবে। এমনকি কেউ শায়খুল হাদীস রাহ.-এর বক্তব্যের অনুসরণ করে বা সাখাবী রাহ.-এর আলোচনার ভিত্তিতে (যিনি এটিকে একটি যয়ীফ হাদীস মনে করেন) হাদীসটির ইশাআত করে, তাকে বাধা দিতে যাওয়া বা তার সমালোচনা করা এটাও তোমার সেই তাহকীকের নতীজা হতে পারে না।
দরূদ শরীফ প্রতিদিনের আমল এবং জুমার দিন বেশি বেশি দরূদ শরীফ পড়ার কথা সহীহ হাদীসে এসেছে। এবং একটি শক্তিশালী মত হিসেবে জুমার দিন আসরের পরের সময়টুকু হল ‘সাআতুল ইজাবাহ’ বা দুআ কবুলের সেই বিশেষ মুহূর্ত। তাই এ সময়ে দরূদ শরীফের আমল, আশিবার, একশবার করা যে একটি সওয়াবের কাজ তাতে তো কোনো সন্দেহই নেই। অতএব ঐ বিশেষ সওয়াব সম্বলিত বর্ণনাটি মুনকার হলেও এই আমল ছেড়ে দেওয়ার তো কোনো যুক্তি হতে পারে না।
হযরত আওস ইবনে আউস রা. থেকে বর্ণিত, একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إن من أفضل أيامكم يوم الجمعة ... فأكثروا علي من الصلاة فيه، فإن صلاتكم معروضة علي ...
নিশ্চয়ই জুমার দিন শ্রেষ্ঠতম দিনগুলোর অন্যতম। ... সুতরাং সেদিন তোমরা আমার উপর বেশি বেশি দরূদ পড়। নিশ্চয় তোমাদের দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়। ... (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১০৪৭; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৬১৬২; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৯১০, হাদীসটি সহীহ)
অন্য হাদীসে হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أكثروا الصلاة علي يوم الجمعة وليلة الجمعة، فمن صلى علي صلاةً صلى الله عليه عشراً.
তোমরা জুমার রাত ও জুমার দিনে আমার উপর বেশি বেশি দরূদ পাঠ কর। যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তাআলা তার উপর দশবার রহমত নাযিল করেন। (আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ৩/২৪৯; ফাযাইলুল আওকাত, বায়হাকী ২৭৭; আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ, ইবনুস সুন্নী ৩৭৯, এর সনদ হাসান পর্যায়ের।)
অন্য হাদীসে আছে-
أكثروا علي من الصلاة في كل يوم جمعة، فإن صلاة أمتي تعرض علي في كل يوم جمعة، فمن كان أكثرهم علي صلاة كان أقربهم مني منزلة.
প্রত্যেক জুমার দিনে তোমরা আমার উপর অধিক পরিমাণে দরূদ পাঠ কর। কারণ আমার উম্মতের দরূদ প্রতি জুমার দিন আমার কাছে পেশ করা হয়। আর তাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি আমার উপর সবচে বেশি দরূদ পাঠ করে সে অন্যদের তুলায় আমার বেশি নিকটবর্তী। (সুনানে বায়হাকী ৩/২৪৯, এর সনদটি হাসান)
সাখাবী রাহ. বলেন-
رواه البيهقي بسند حسن لا بأس به، إلا أن مكحولا قيل : لم يسمع من أبي أمامة في قول الجمهور.
আলকওলুল বাদী, পৃষ্ঠা : ৩২০
এখন লক্ষ্য করে দেখ, দরূদ শরীফের গুরুত্ব, তার সাধারণ ফযীলতসমূহ এবং বিশেষভাবে জুমার দিন বেশি বেশি দরূদ পড়ার গুরুত্ব ও ফযীলত যা সহীহ সনদে প্রমাণিত এবং একটি স্বীকৃত বিষয় তুমি এই সবকিছুই ভুলে গেছ। ব্যস, ঐ প্রসিদ্ধ রেওয়ায়েতটি অমুক মুহাদ্দিসের তাহকীক অনুসারে মুনকার আর এটি তাহকীকী ‘কওল’। এটাকে বাহানা ধরে তুমি দরূদ শরীফের আমল থেকেই বঞ্চিত হয়ে গেলে। এটাই হল তাহকীকের গলদ ব্যবহার। এবং এটাকেই বলা হয় তাহকীককে তার নতীজার বাইরে ব্যবহার করা।
তোমার আশিবার পড়তে আপত্তি অথচ নির্ভরযোগ্য সনদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি তার এক শাগরিদ যায়েদ বিন ওয়াহাবকে নসীহত করেছেন-
يا زيد بن وهب! لا تدع إذا كان يوم الجمعة أن تصلي على النبي صلى الله عليه وسلم ألف مرة تقول : اللهم صل على محمد النبي الأمي.
হে যায়েদ বিন ওয়াহাব! জুমার দিন তুমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি এক হাজার বার দরূদ পড়তে ভুল করো না। এভাবে বলবে-
اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ.
(আততারগীব ওয়াত তারহীব, আবুল কাসেম আততাইমী ১৬৫৪; যিকরু আখবারি আসবাহান, আবু নুয়াইম ২/১৭১)
তো আমরা এক হাজার বার না পারি একশ বারও কি পড়তে পারি না।
اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ.
اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُوْلِكَ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ
اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ وَعَلى آلِهِ وَسَلِّمْ تَسْلِيْمًا.
যাইহোক, তাহকীকের গলদ ব্যবহার এবং তার কারণ ও সমাধান বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার আলোচনা অনেক দীর্ঘ। আজকে শুধু কয়েকটি উদাহরণ দিয়েই শেষ করতে চাচ্ছি।
একটি উদাহরণ হল, শুক্রবারের দরূদ শরীফ। দ্বিতীয় উদাহরণ বাদ মাগরিবের নফল নামায। সাধারণ পরিভাষায় যা আওয়াবীনের নামায হিসেবে প্রসিদ্ধ।
একবার তো কেউ রীতিমতো ঝগড়া বাধিয়ে দিল। তার বক্তব্য, সহীহ মুসলিমের একটি বর্ণনা থেকে তো বোঝা যায় যে, সালাতুদ দুহা (চাশতের নামায) হল আওয়াবীনের নামায। সুতরাং মাগরিবের পরের নফল নামাযকে আওয়াবীনের নামায বলা ভুল। এবং এই নামাযের কোনো ভিত্তি নেই। তিরমিযী শরীফে মাগরিবের পর ছয় রাকাত নফল পড়ার ফযীলত সম্বলিত যে রেওয়ায়েতটি আছে তাতে তো ইমাম তিরমিযী রাহ. নিজেই একথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, এখানে ওমর ইবনে আবী খাছআম নামে একজন রাবী আছেন, যার ব্যাপারে ইমাম বুখারী রাহ. বলেছেন, ‘মুনকারুল হাদীস’। তাছাড়া ইমাম যাহাবী রাহ. ‘মীযানুল ইতিদাল’ কিতাবে সরাসরি এই রেওয়ায়েতটিকেই ‘মুনকার’ বলেছেন।
অতএব আওয়াবীন পড়া ছেড়ে দাও। এবং অন্যকেও তা থেকে বারণ কর। নাউযুবিল্লাহ। মনে রাখবে, যে লোক বিষয়টিকে এভাবে নিবে নিঃসন্দেহে সে জাহেল। সে ইলমের এবং তাহকীকের কোনো আদবই শিখেনি।
এখানে তো শুধু তাহকীকের গলদ ব্যবহার নয়; বরং এখানে তাহকীকই অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। আর তাহকীক না করার চেয়ে অসম্পূর্ণ তাহকীক করা বেশি খতরনাক, বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
দেখ, চাশতকে আওয়াবীনের নামায বললেই কি একথা জরুরি যে, মাগরিবের পরের নফল নামাযও আওয়াবীনের নামায হবে না? বা সেটাকে আওয়াবীনের নামায বলা ঠিক হবে না? এটা তো ফজর মাগরিবের মতো ওয়াক্তের সাথে সম্পৃক্ত কোনো নাম নয় যে, এক নাম দুই নামাযের জন্য হতে পারবে না। ‘সালাতুল আওয়াবীন’ অর্থ কী? এর অর্থ হল, ‘আওয়াব’ বা যারা খুব বেশি আল্লাহমুখী হয় তাদের নামায। এবং বাস্তবতা হল, ভালো সনদের একটি মুরসাল-মারফূ হাদীসে এবং একাধিক ‘আছারে’ মাগরিবের পরের নফল নামাযকে আওয়াবীনের নামায বলা হয়েছে।
তাছাড়া অনেক সাহাবী-তাবেয়ী থেকে সহীহ সনদে মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময় নফল পড়ার বিষয়টি প্রমাণিত। (এ বিষয়ে দেখা যেতে পরে মুহাম্মাদ ইবনে নসর আলমারওয়াযী রাহ. কৃত ‘কিয়ামুল লাইল’। ইমাম ইবনুল মুবারক রাহ.কৃত ‘কিতাবুয যুহদ ওয়ার রাকাইক’ এবং মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ও মাআরিফুস সুনান।
এখন যদিও ‘মাগরিবের পরের ছয় রাকাত নামায বারো বছরের ইবাদত বরাবর, বিষয়ক হাদীসটি যয়ীফ বা মুনকার হয়ে থাকে [অথচ ইমাম ইবনে খুযাইমা রাহ. তার ‘কিতাবে রেওয়ায়েতটি এনেছেন। সহীহ ইবনে খুযাইমা (১১৯৫)] তাতেই কি একথা বলা যাবে যে, আওয়াবীন নামাযের কোনো ভিত্তি নেই?
এজন্যই যে ব্যক্তি অসম্পূর্ণ তাহকীকের ভিত্তিতে বা তাহকীকের গলদ ব্যবহারের মাধ্যমে আকাবির মাশায়েখের বরকতপূর্ণ আমল থেকে সরে গিয়ে ঐ সময়ের নফল থেকে নিজে বঞ্চিত হয় বা অন্যকে এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে তার এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে ভুল পদক্ষেপ যা থেকে ফিরে আসা অত্যন্ত জরুরি।
আচ্ছা, যদি আওয়াবীনের নামায বিষয়ে কোনো হাদীস আছার নাও থাকতো তবুও তো ঐ সময়ে নফল নামায পড়া মুবাহ এবং সওয়াবের কাজ। কেননা মাকরূহ ওয়াক্ত ছাড়া বাকী যে কোনো সময় যে কেউ একাকী নফল নামায পড়তে পারে। হ্যাঁ, নির্দিষ্ট বা বিশেষ নফল বলতে হলে সেজন্য ভিন্ন দলীলের প্রয়োজন হবে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর আওয়াবীননের জন্য সে রকম দলিল আছে।
প্রসঙ্গত, এখানে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করে দেওয়া জরুরি। তা হল, কারো কারো ধারণা, আওয়াবীনের নামায নির্দিষ্টভাবে ছয় রাকাত। অতএব যদি কেউ আওয়াবীন পড়তে চায় তাহলে তাকে ছয় রাকাতই পড়তে হবে। অন্যথায় পড়বে না। এমন ধারণা অবশ্যই পরিহারযোগ্য। এখানে বরং বাদ মাগরিবের দুই রাকাত সুন্নতের পর দুই রাকাত, চার রাকাত, ছয় রাকাত যত রাকাত ইচ্ছা কেউ পড়তে পারে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে এমন কোনো রাকাত সংখ্যা নেই যার খেলাফ করাটা গুনাহ বা মাকরূহ! এক হাদীসে তো এসেছে, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিবের পর থেকে ইশা পর্যন্ত নামায পড়েছেন।-সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ১১৯৪
তবে এ কথা স্বীকৃত যে, নফল নামায সর্বাবস্থায়ই নফল। শরীয়ত যাকে মানুষের ইখতিয়ারাধীন করেছে। সেজন্য তাতে বাধ্যবাধকতা চলে না। হ্যাঁ, যদি কোনো শায়খ, মুসলিহ মুরববী বা মুরববী উস্তায অথবা মুরববী অভিভাবক তাঁর অধীনস্তদেরকে কোনো নফলে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য কখনো কোনো কড়াকড়ি করেন তাহলে সেটা ইনতিযামী মাসআলা। তার হুকুম ভিন্ন।
আরেকটি উদাহরণ হল, ফরয নামাযের পর দুআ। এই দুআর প্রচলিত পদ্ধতিকে আমার জানামতে আকাবিরের কেউ সুন্নতে রাতেবা অথবা ফরয নামাযের পরের কোনো স্বতন্ত্র সুন্নত মনে করেন না; বরং তাদের কেউ কেউ সেটাকে সর্বোচ্চ মুস্তাহাব বলতেন। সাথে সাথে এ কথাও স্পষ্ট করে বলে দিতেন যে, কেউ যদি একে স্বতন্ত্র সুন্নত মনে করে সবসময়ই আমল করে এবং অন্য কেউ এই আমল ছেড়ে দিলে তার সমালোচনা করে তাহলে সেটা বিদআত বলে গণ্য হবে। (অর্থাৎ বিদআতে ওয়াসফিয়্যা বা ইযাফিয়্যা হিসেবে গণ্য হবে)। এর বিপরীতে আকাবিরের কেউ কেউ সেটাকে (প্রচলিত মোনাজাতকে) মুস্তাহাব বলতেও অস্বীকার করেছেন। যেমন মুফতী ফয়জুল্লাহ রাহ. লিখেছেন-
بعد مكتوبہ دعاہا آمدہ
ليكن رفع واجتماع داں نامدہ
দলীল-প্রমাণের আলোকে এ ব্যাপারে শক্তিশালী বক্তব্য কোনটি এখন আর সেদিকে যেতে চাচ্ছি না। তবে কেউ কেউ মুফতী সাহেব রাহ.-এর এই তাহকীককে বিভিন্নভাবে গলদ ব্যবহার করে। যেমন কেউ অন্য আকাবিরের তাহকীককে এর বিপরীতে তুচ্ছ সাব্যস্ত করে। অথবা কেউ মুফতী সাহেব রাহ.-এর এই তাহকীকের এই নতীজা বের করে যে, ফরয নামাযের পর তার কাছে আর কোনো দুআ যিকিরের গুরুত্বই থাকে না। ইজতিমায়ী বা সম্মিলিত দুআ ছেড়ে দেয় তো আর ইনফিরাদী বা একাকীও দুআ করে না। অথবা মুদাওয়ামাত বা সবসময় দুআ করাকে বন্ধ করে দেয় এরপর সব সময় দুআ না করার উপর আমল করতে থাকে। এমনিভাবে হাত উঠিয়ে দুআ করাকে ছেড়ে দেয় তো হাত উঠানো ছাড়া মাসূর ও মাসনূন দুআ যিকিরগুলোর উপরও আমল করে না।
এভাবে এক সময় উদাসীনতা এই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে, কোনো বালা মুসিবত না এলে তার আর কোনো দুআই করা হয় না।
আমি জানি না তারা ঐ হাদীসের উপর কীভাবে আমল করেন, যে হাদীসে বলা হয়েছে, রাতের শেষ প্রহরের দুআ ও ফরয নামাযের পরের দুআ অধিক কবুল হয়ে থাকে।
এক মাওলানা সাহেবের ব্যাপারে শুনেছি, তিনি মেখল হাটহাজারী থেকে এসে নিজের এলাকার মসজিদে হেকমত-নসীহতের মাধ্যমে নয়; বরং রীতিমত লড়াই-ঝগড়ার পর ফরয নামাযের পর দুআ করার প্রচলন বন্ধ করেছেন। পরবর্তীতে ঢাকার একজন বুযুর্গ আলেমের সাথে তার সম্পর্ক হয়। যিনি ফরয নামাযের পর দুআ করাকে মুস্তাহাব মনে করেন। অতএব সেই মসজিদেই তিনি দ্বিতীয়বার জোর জবরদস্তি করে আগের রেওয়াজকে ফিরিয়ে আনেন।
একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, তিনি মেখল হাটহাজারীর আকাবিরের উদ্দেশ্যও বুঝতে পারেননি এবং তার পরবর্তী শায়খের উদ্দেশ্যও বুঝতে পারেননি। কেউ তো তাকে বাড়াবাড়ি করার পরামর্শ দিতেন না। প্রথমেই তো তার উচিত ছিল, মানুষকে এই মাসআলার হাকীকত বুঝিয়ে দেওয়া এবং প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্তে দুআ করা জরুরি হওয়ার ধারণা থেকে মানুষকে মুক্ত করা। আবার একেবারে দুআ-মুনাজাত ছেড়ে দেওয়া থেকেও মানুষকে বিরত রাখবে। যদি তিনি এমনটি করতেন তাহলে পরবর্তী শায়খের সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর তাকে আর নতুন করে মেহনত করতে হত না।
বাড়াবাড়ি এবং প্রান্তিকতা খুবই মন্দ। যারা ফরয নামাযের পর হাত উঠিয়ে দুআ করে তাদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ তো শুধু নামকে ওয়াস্তে রসম পুরা করার জন্য দুআ করে এটা অনুচিত। মাসবুক মুসল্লি থাকা অবস্থায় উচ্চস্বরে দুআ করা, সেটাও পরিহারযোগ্য। এমনিভাবে এই দুআ মুনাজাতকে সুন্নতে রাতেবা মনে করাও ভুল।
এরপর কেবল সংক্ষিপ্ত একটি মুনাজাতকেই যথেষ্ট মনে করে অন্যান্য মাসনূন ও মাছুর দুআ থেকে গাফেল হওয়া এবং মানুষকে সেইসব দুআর প্রতি উৎসাহিত না করাও ভুল। যে সকল বুযর্গানে দ্বীন ফরয নামাযের পর প্রচলিত দুআকে মুস্তাহাব বলেন তাদের এই বক্তব্য তাহকীককে যদি কেউ এজাতীয় অর্থে ব্যবহার করে তাহলে সেটাও তাহকীকের গলদ ব্যবহার। যা ঐ সকল বুযুর্গানে কেরামের উদ্দেশ্য পরিপন্থী।
আসল কথা হল, ‘আকলে আম’ এবং ‘ফিকহে আম’ এর অভাবে মানুষ অনেক সময় তাহকীকের সীমা, তাহকীকের নতীজা, তাহকীকের ব্যবহারের ক্ষেত্র ও ব্যবহার পদ্ধতিকে বুঝতে পারে না।
এমনিভাবে অসম্পূর্ণ তাহকীক বা তাহকীকের ভুল ব্যবহারের কারণে মানুষ নিজেও প্রান্তিকতার শিকার হয় অন্যকেও প্রান্তিকতায় টেনে নিয়ে যায়।
তাখাসসুসের একটি অতি গুরুত্বপুর্ণ কাজ হল এজাতীয় প্রান্তিকতার চিকিৎসা করা এবং তা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে সতর্ক সচেতন হওয়া। কিন্তু আমার তাখাসসুসই যদি এমন হয় যে, তা আমার ভেতর প্রান্তিকতার জন্ম দেয় তাহলে?
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রতি রহম করুন, আমাদেরকে আকলে সালীম এবং তাফাক্কুহ ফিদ্দীনের নেয়ামত দান করুন। আমীন।