স্ব দে শ : সন্দেহভাজন নামাযীদের কথা!
গত আট-দশ বছর ধরে ব্যাপারটা শুনছি। আমেরিকা, বৃটেন ও পশ্চিমা কোনো কোনো দেশের মসজিদগুলোতে নাকি গোয়েন্দা নজরদারি চলে। প্রথম প্রথম এসব কথা শুন২২লও বিশ্বাস হতো না। মনে হতো, স্বভাবগত কারণে কেউ কেউ বাড়িয়ে বলতে বলতে এরকম একটা প্রচারণা দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর বুঝতে পেরেছি, ঘটনা মিথ্যা নয় এবং তাতে অস্পষ্টতারও কিছু নেই। সত্য সত্যই ওইসব মসজিদে মুসলমানদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়। তল্লাশি হয়, আড়িপাতা হয়, রেকর্ড হয়, তালিকা তৈরি হয়। ব্যাপকভাবে মুসলমানদের বিব্রত করা হয়। এসব দেখে-শুনে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
পরে শুনেছি, এরকম নজরদারি পাশের দেশ ভারতেও হয়। সেখানেও মসজিদ-মাদরাসায় গোপন নজরদারি চলে। কখনো কখনো তল্লাশি, এমনকি ধরপাকড়ও চলে। বিভিন্ন খবরেও এজাতীয় ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। মনটা বিষণ্ণ হয়েছে। মনকে নানা প্রবোধ দিয়েছি। কী করা যাবে! অমুসলিমদের দেশে এসব তো ঘটতেই পারে। তাদের শত্রুতার বিষদৃষ্টি মুসলমানদের ধর্মপ্রাণতার প্রতিটি কেন্দ্রেই ধাবিত হবে। যদিও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে অমুসলিমদের উপাসনালয়গুলোকে কোনো রকম গোপন নজরদারি ও তল্লাশির আওতায় অতীতে কখনো আনা হয়নি এবং এখনো হয় না। কিন্তু তারপরও অমুসলিমরা তাদের দেশে আমাদের
শান্তিপূর্ণ ও নিরাপত্তাময় ইবাদতের কেন্দ্রগুলোর প্রতিও শ্যানদৃষ্টি দিতে ছাড়ে না। অমুসলিম দেশে এই ধর্মীয় অবমাননার বিষয়টিকে নীরবেই হজম করে নিয়েছি।
কিন্তু এই নভেম্বরে ঢাকার সংবাদপত্রে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি বিজ্ঞাপন দেখে হতবাক হয়ে গেছি। কেন হতবাক হয়েছি, একটু শোনা যাক। ‘হরতালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নিরাপত্তা পরামর্শ’ শিরোনামে প্রায় আধাপৃষ্ঠাব্যাপি বিজ্ঞাপনটি বেশ কয়েকদিন বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এতে ৬টি উপ-শিরোনামে ৩৩টি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ২৯ নম্বর পরামর্শটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
‘হরতালের পূর্বের দিন আপনার এলাকায় বাসাবাড়ি, মেস, ধর্মীয় উপাসনাস্থলে সন্দেহজনক নতুন লোকজনের আনাগোনা দেখলে নিকটবর্তী থানাকে অবহিত করুন।’
বিজ্ঞাপনে ধর্মীয় উপাসনাস্থলে সন্দেহজনক নতুন লোকজনের আনাগোনা দেখলে থানাকে অবহিত করতে বলা হয়েছে। এখানে ‘ধর্মীয় উপাসনাস্থল’ কথাটার মানে কী? ডিএমপি কি এ শব্দে মন্দির, গির্জা, প্যাগোডার কথা বুঝিয়েছে? নাকি কেবল মসজিদ বুঝানোই তাদের উদ্দেশ্য? দেশের যে কোনো মসজিদে যে কোনো এলাকার মুসল্লি নামায পড়তে পারেন। নিকটবর্তী মহল্লায় কোনো কাজে (পারিবারিক/ব্যবসায়িক/সামাজিক) গিয়ে নামাযের সময় ওই এলাকার মসজিদে যে কোনো মুসল্লি একা অথবা কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবসহ উপস্থিত হতে পারেন। যাদেরকে স্থানীয় বেশিরভাগ মুসল্লি অথবা ইমাম সাহেব হয়তো আগে দেখেন নি। এতে কি ওই নবাগত মুসল্লিরা সন্দেহভাজন হয়ে গেলেন? স্থানীয়রা তাদের ব্যাপারে থানায় খবর দেওয়া শুরু করবে? কেউ অন্য মসজিদে তাবলীগ জামাতের কাজে গেল। দাওয়াত ও তালীমের কাজে গেল। স্থানীয়রা প্রথমেই তাদের চিনল না। তাহলেই কি তারা থানায় জানানো শুরু করবে? ডিএমপি কি এটাই চাচ্ছে? প্রকাশ্য বিজ্ঞাপনে মসজিদকেও সন্দেহের জায়গা বানানোর আগে ডিএমপির কি আরেকটু চিন্তা করা দরকার ছিল না?
১০ নভেম্বরের প্রথম আলোয় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনটি আমার সামনে আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাছাকাছি তারিখে ডিএমপির এই বিজ্ঞাপন আরো কিছু পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো লুকোছাপা করা হয় নি। কোনো দ্বিধা-সংশয়ের ব্যাপারও কাজ করেনি। তার মানে কি? বাংলাদেশেও কি তাহলে মসজিদ-মাদরাসা ও মুসলমানদের উপাসনালয়গুলো প্রকাশ্য নজরদারির আওতায় চলে এল? বাংলাদেশের রাজধানীর পুলিশ পত্রিকার পাতায় বিজ্ঞাপন দিয়ে মসজিদে মসজিদে সন্দেহভাজন লোকজনের আনাগোনা নিয়ে নাগরিকদের সতর্ক করার কাজটি করলো। ঢাকার মুসলমানরা কি তাহলে দিল্লী, ওয়াশিংটন ও লন্ডনের চেয়েও বেশি সন্দেহভাজন?
হতবাক মনে এটা বেদনার প্রশ্ন। এটা ক্ষোভের প্রশ্ন। এটা দুঃখ, অন্তঃর্জবালা ও হতাশার প্রশ্ন। এ প্রশ্নে নাগরিক হিসেবে সীমাহীন কষ্ট পেলাম। সীমাহীন অসহায় বোধ করছি এখন। আমাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে-এটা কি ডিএমপির অসতর্কতা? নাকি কোনো নাস্তিক্যবাদী চিন্তাকর্মীর উদ্ভাবিত ধৃষ্টতা? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো সহসাই আমরা পাব না। কিন্তু আমরা এ কথা বলতেই পারি যে, বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন সময়ে হরতাল কেন্দ্রিক রাজনীতির নানা রূপ আমরা দেখেছি। সে রাজনীতিতে ধর্মপন্থী, সেকুলার, নাস্তিক ও সংখ্যালঘুদের বহু উত্তেজনা ও তান্ডবও বহুবার দেখেছি। কিন্তু এজন্য কোনো ‘ধর্মীয় উপাসনাস্থলে সন্দেহজনক নতুন লোকজনের আনাগোনা’ নিয়ে প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে পরামর্শ দিতে দেখিনি। এমন অতি উৎসাহী ধর্ম-বৈরিতার নজির কোনো ভালো পরিণতি বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। সব ক্ষমতারই ক্ষয় আছে। সব জেদ, অন্ধ পক্ষপাত ও ধর্মবিরুদ্ধতারই শেষ আছে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের হেফাযত করুন।