দরসে তাওহীদ : তাওহীদের চার প্রতিপক্ষ
উলামায়ে হক নবীগণের -আলাইহিমুস সালাম- নায়েব ও প্রতিনিধি। আলিমরা নবীগণের ওয়ারিছ।’ এ নায়েবি ও ওয়ারিছি তখনই যথার্থ হবে যখন নবীগণের জীবনের লক্ষ্য যা ছিল এবং যাকে কেন্দ্র করে তাঁদের সাধনা ও সংগ্রাম আবর্তিত হত তাকেই জীবনের লক্ষ্য ও সংগ্রাম সাধনার ক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করা হবে। তো কী সেই পরম লক্ষ্য? দুই শব্দে বললে তা হচ্ছে দ্বীনে খালেস, আর এক শব্দে বললে তাওহীদ। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার ‘খালিস ইবাদত’ -শিরকের মিশ্রণমুক্ত উপাসনা, এবং ‘কামিল ইতাআত’ -চূড়ান্ত ও নিরঙ্কুশ আনুগত্য, যা একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য। একে নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করা, অন্য সবার জীবনেও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা।
أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِص
স্মরণ রাখুন, খাঁটি ইবাদত একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য। (সূরা যুমার ৩৯ : ৩)
وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ
এবং যেন উপাসনা-আনুগত্য শুধু আল্লাহর হয়। (সূরা আনফাল ৮: ৩৯)
আরো ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
আর আমি আপনার আগে যে রাসূলই প্রেরণ করেছি তাঁর প্রতি এ বিধান নাযিল করেছি যে, আমি ছাড়া আর কারো উপাসনা হতে পারে না। সুতরাং আমারই উপাসনা কর। (সূরা আম্বিয়া ২১: ২৫ ; রুকু : ২)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
তিনি সেই সত্তা, যিনি তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, ঐ দ্বীনকে সকল ‘দ্বীন’ (সর্ব প্রকার বিধি-ব্যবস্থা) এর উপর বিজয়ী করার জন্য। যদিও তা শিরককারীদের কাছে অপ্রীতিকর হয়। (সূরা সফ ৬১ : ৯ ; রুকু : ১ )
সব যুগেই এই দ্বীনে খালিসের কিছু প্রতিপক্ষ ও প্রতিবন্ধক থাকে, যা মৌলিকভাবে চার প্রকার।
এক. শিরক অর্থাৎ গায়রুল্লাহকে উপাস্য বানানো।
আল্লাহ ছাড়া কাউকে বিনা মাধ্যমে কল্যাণ-অকল্যণ সাধানে সক্ষম মনে করা এবং জীবন ও জগতের ঘটনাপ্রবাহে তার ক্রিয়া ও প্রভাব বিশ্বাস করা। অতপর আশা ও ভয় এবং শরণ ও মুখাপেক্ষিতা তো এ বিশ্বাসের স্বাভাবিক ফল আর বিনয় ও সমর্পন এবং প্রার্থনা ও সাহায্য প্রার্থনা (যা ইবাদতের মূল কথা) এ বিশ্বাসের অনিবার্য প্রকাশ।
শিরক এক আলাদা ধর্ম ও শাসন। কোনো দেহে বা হৃদয়ে কিংবা কোনো ভূখন্ডে শিরক ও আল্লাহর দ্বীনের সহাবস্থান সম্ভব নয়। এ গায়রে ইলাহী ধর্ম অন্তর-বাহিরে ঐ পরিমাণ জায়গা দখল করে, যা আল্লাহর দ্বীনের জন্য কমসে কম প্রয়োজন।
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ
অর্থাৎ আর কিছু লোক আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে। তাদেরকে এমনভাবে ভালবাসে যেমন ভালবাসা আল্লাহর সাথে হওয়া আবশ্যক। (সূরা বাকারা ২: ১৬৫)
تَاللَّهِ إِنْ كُنَّا لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ إِذْ نُسَوِّيكُمْ بِرَبِّ الْعَالَمِينَ
)মুশরিকরা বলবে) কসম আল্লাহর! আমরা তো স্পষ্ট ভ্রষ্টতায় ছিলাম; যখন তোমাদেরকে (মিথ্যা উপাস্যদেরকে) সারা জাহানের পালনকর্তার সমকক্ষ সাব্যস্ত করতাম। (সূরা শুআরা ২৬ : ৯৭-৯৮ রুকু : ২০)
তাই যে পর্যন্ত না ভূমি থেকে শিরকের সকল তন্তু ও শিকড় উৎপাটিত হবে আল্লাহর দ্বীনের চারা সেখানে উৎপন্ন হবে না। কারণ এ চারা শুধু ঐ ভূমিতে শিকড় বিস্তার করে যেখানে অন্য বৃক্ষের বীজ বা শিকড় নেই এবং এর শাখা প্রশাখা শুধু তখনই আকাশের উচ্চতায় উড্ডয়ন করে এবং ফুলে-ফলে সুশোভিত হয় যখন এর শিকড় মাটির গভীরে পৌঁছায়।
ইরশাদ হয়েছে-
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ تُؤْتِي أُكُلَهَا كُلَّ حِينٍ بِإِذْنِ رَبِّهَا
তুমি কি দেখনি, আল্লাহ তাআলা পবিত্র বাণীর (কালেমা তাইয়েবা ও অন্যান্য) কেমন দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন- তা এক পবিত্র বৃক্ষের ন্যায়, যার শিকড় দৃঢ় ও শাখা-প্রশাখা আকাশে। তা আল্লাহর আদেশে প্রত্যেক মওসুমে নিজ ফল দান করে।(সূরা ইবরাহীম ১৪ : ২৪-২৫; রুকু : ৪)
এ বৃক্ষ অন্য কোনো বৃক্ষের ছায়ায় বাড়তে পারে না। যেখানে সে থাকবে একা থাকবে। তার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য চাই অসীম শূন্যতা।
أَ لَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِص
মনে রাখুন, (অবিমিশ্র উপাসনা ও নিরঙ্কুশ) আনুগত্য শুধু আল্লাহর। ( সূরা যুমার ৩৯ : ৩; রুকু : ১)
সুতরাং যাঁরা আল্লাহর দ্বীনের স্বভাব-প্রকৃতির সাথে পরিচিত তাঁরা এ পবিত্র বৃক্ষের চারা রোপনের জন্য ভূমিকে উত্তমরূপে কর্ষণ করেন ও সম্পূর্ণ আগাছামুক্ত করেন। শিরক ও জাহিলিয়্যাতের বীজ ও তন্তু খুঁজে খুঁজে বের করেন এবং ভূমিকে সম্পূর্ণ ওলটপালট করে দেন। এতে তাদের যত কষ্টই হোক, যত সময়ই লাগুক তার কোনো পরোয়া তারা করেন না। তাদের দিন-রাতের অবিরাম পরিশ্রম ও জীবনব্যাপী চেষ্টা-সাধনার ফল যদি হয় হযরত নূহ আলাইহিস সালামের মতো মাত্র কয়েকজন কিংবা কোনো কোনো নবীর মতো শুধু একজন তবুও তারা এ সাফল্যের উপরই সন্তুষ্ট ও আনন্দিত থাকেন। ফলাফলের জন্য কোনো ত্বরা বা ধৈর্যহীনতা তাদের কাছে প্রশ্রয় পায় না।
দুই. কুফর অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন ও তাঁর শরীয়তকে অস্বীকার করা।
এ অস্বীকার তাঁর প্রভুত্বের প্রতি বিদ্রোহ এবং তাঁর শাসন ও বিধানের বিরোধিতা , তা যে রূপে বা উপায়েই প্রকাশিত হোক।
এতে ঐসকল লোকও শামিল, যাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কোনো একটি অকাট্য ও সুস্পষ্ট বিধানকেও-আল্লাহ ও রাসূলের বিধান জানার পরও, অস্বীকার করে, অথবা মুখে অস্বীকার না করলেও জেনে বুঝে তার বিরোধিতা করে। এরা অন্যান্য বিধানের অনুগত হলেও কুফরের আওতামুক্ত নয়। ইহুদীদের সম্বোধন করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَفْعَلُ ذَلِكَ مِنْكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدِّ الْعَذَابِ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ
আল্লাহর কিতাবের এক অংশকে স্বীকার কর আর অন্য অংশকে স্বীকার কর না? তাহলে তোমাদের যে এ কাজ করে তার কী শাস্তি হতে পারে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া? আর কিয়ামত দিবসে তাকে নিক্ষেপ করা হবে ভীষণ আযাবে। আল্লাহ তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে বেখবর নন। (সূরা বাকারা ২ : ৮৫; রুকু : ১০)
আল্লাহকেই একমাত্র প্রভু ও বিধানদাতা বলে স্বীকার করলেই শাসন ও প্রভুত্বের অন্যসকল দাবিদারদের অস্বীকার করা হয়। কিন্তু যারা দ্ব্যর্থহীনভাবে মিথ্যা প্রভুদের অস্বীকার করতে প্রস্ত্তত হয় না, অন্যভাবে বললে, যারা এ কিবলার অভিমুখী হয়েও ঐ কিবলার দিকে পিঠ ফেরাতে পারে না, দুনিয়াতে আল্লাহর দ্বীন ও আসমানী শরীয়তের বিপরীতে যে শাসন-ব্যবস্থা ও আইন কানুন প্রচলিত তা থেকে বিমুখ হতে পারে না- মাঝে মাঝে সে সবেরও আনুগত্য করে এবং কোনো প্রয়োজনের মুহূর্তে সেসবের দিকেও রুজু করে, এরা প্রকৃতপক্ষে ইসলামে প্রবেশ করেনি।‘ঈমান বিল্লাহ’র (আল্লাহর উপর ঈমানের) জন্য ‘কুফর বিত তগূত’ *(তাগুতকে অস্বীকার করা) জরুরি।
[টীকা : * আল্লাহর বিপরীতে যার উপাসনা বা নিঃশর্ত আনুগত্য করা হয় এমন সবকিছুকে তাগূত বলে।
الطاغوت عبارة عن كل معتد وكل معبود من دون الله
সে হতে পারে শয়তান, বা শাসক কিংবা সাধারণ ইনসান বা অন্য কোনো কিছু)।]
আল্লাহ তাআলা কুফর বিত তাগূতকে ঈমানের আগে উল্লেখ করেছেন-
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى
অনন্তর যে দুর্বৃত্তকে প্রত্যাখ্যান করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে সে তো ধারণ করল সুদৃঢ় হাতল। (সূরা বাকারা ২ : ২৫৬; রুকু : ৩৪)
এ কারণে যারা গায়রুল্লাহর আইন, তার কেন্দ্র ও প্রতিনিধিদের শারণাপন্ন হয় এবং তাদেরকে নিজেদের সালিশ ও মীমাংসাকারী সাব্যস্ত করে কুরআন তাদের মুমিন হওয়ার দাবি না-মঞ্জুর করেছে-
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا
আপনি কি ওদের দেখেননি, যারা আপনার প্রতি নাযিলকৃত কিতাব ও আপনার আগে নাযিলকৃত কিতাবের উপর ঈমান রাখার দাবি করে অথচ তারা নিজেদের মোকদ্দমাগুলো দুর্বৃত্তের কাছে নিয়ে যেতে চায় এ অবস্থায় যে, তাদের আদেশ করা হয়েছে তাকে প্রত্যাখ্যান করার। আর শয়তান চায় এদেরকে পথভ্রষ্ট করে বহু দূরে নিয়ে যেতে। (সূরা নিসা ৪: ৬০; রুকু : ৯)
(টীকা: তিরমিযীর রেওয়ায়েত অনুসারে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে একজন মুনাফিক সম্পকে,র্ যে তার এক মোকদ্দমার ফয়সালার জন্য, যাতে দ্বিতীয় পক্ষ ছিল একজন ইহুদি, প্রসিদ্ধ ইহুদী নেতা ও পন্ডিত কা’ব ইবনুল আশরাফকে বিচারক বানিয়েছিল)
এ কুফরের দুর্গন্ধ ঐসকল লোক থেকে পুরাপুরি দূর হয়নি যারা মুসলমানের সীমানায় আসার পরও জাহিলিয়াত থেকে বিমুখ হতে পারেনি এবং জাহিলিয়াতের রীতি ও বিশ্বাস পুরাপুরি ত্যাগ করতে পারেনি। যাদের অন্তর থেকে এখনো ঐসকল বিষয়ের ঘৃণা বা অবজ্ঞা দূর হয়নি জাহেলিয়্যাত যেগুলোকে ঘৃণা বা অবজ্ঞা করে, যদিও তা আল্লাহর দ্বীনে প্রিয় ও পছন্দনীয় এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সুন্নত।
যাদের অন্তরে এখনো ঐসকল কাজকর্ম ও রীতি-অভ্যাসের প্রতি আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা আছে সেগুলো জাহেলিয়াতের ধারক-বাহক-অনুসারীদের কাছে প্রীতি ও শ্রদ্ধার বিষয়, যদিও তা আল্লাহর দ্বীনে তুচ্ছ ও ঘৃণিত।
তদ্রূপ যাদের অন্তর থেকে এখনো জাহেলী অভিমান ও পক্ষপাত দূর হয়নি। আরব জাহেলিয়াত (এবং প্রকৃতপক্ষে) সকল জাহিলিয়াতের এই নীতিই তাদের কাছে অনুসরণীয় যে ‘জালিম হলেও নিজ গোত্রের সাহায্য কর।’ এর চেয়েও মারত্মক বিষয় এই যে, ইসলাম গ্রহণের পর বা মুসলিম নামধারণের পরও তাদের কাছে ভালো-মন্দের মাপকাঠি সেটাই যা জাহিলিয়াত কতৃক নির্ধারিত। বস্ত্তর মূল্য তা-ই যা জাহিলিয়াত নির্ধারণ করে, জীবনের ঐসকল মূল্যবোধ ও মাপকাঠিই মর্যাদাপূর্ণ যা জাহিলিয়াত স্বীকার করে।
সঠিক মুসলমান হওয়ার চিহ্ন এই যে, কুফর ও তার গোটা পরিবেশ, তার সকল অঙ্গ-অনুষঙ্গ ও তার সকল নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি ঘৃণা জন্মাবে। সেদিকে ফিরে যাওয়া এবং সেগুলোর শিকার হওয়ার কল্পনাও কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। আর পরিপক্ক মুমিন হওয়ার নিদর্শন এই যে, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র কুফরের চেয়েও মৃত্যুই হবে তার কাছে অধিক প্রিয়। সহীহ বুখারীর হাদীসে আছে-
ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ: أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبَّ المَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ
অর্থ: তিনটি বৈশিষ্ট্য যার মাঝে থাকবে সে ঈমানের মিষ্টতা অনুভব করবে : এক. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার কাছে অন্য সব কিছু থেকে বেশি প্রিয় হবে। দুই. মানুষকে সে ভালবাসবে শুধু আল্লাহর জন্য। তিন. কুফরে ফিরে যাওয়া তার কাছে তেমনি অবাঞ্ছনীয় হবে যেমন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া।
সাহাবায়ে কেরাম এমনই ছিলেন। প্রথম জীবনের প্রতি তাঁদের মনে সৃষ্টি হয়েছিল প্রচন্ড ঘৃণা। তাঁদের কাছে জাহেলিয়াতের চেয়ে বড় কোনো অপমান আর ছিল না। তাঁরা যখন তাদের ইসলামপূর্ব জীবনের কথা আলোচনা করতেন তখন অতি লজ্জা ও ঘৃণার সাথে করতেন। ঐ সময়ের সকল বিষয়, কর্ম ও আচরণ এবং কুফরি, ফাসেকী ও নাফরমানীর প্রতি তাদের ঘৃণা শুধু বুদ্ধিগত ও শরীয়তের বিধানগত পরিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা হয়ে গিয়েছিল তাদের স্বভাবগত। তাদের এ গুণ আল্লাহ তাআলা এভাবে বর্ণনা করছেন-
وَلَكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ
অর্থ: কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে ঈমানের অনুরাগী বানিয়েছেন এবং একে প্রীতিকর করে তোমাদের মনে বসিয়ে দিয়েছেন। আর কুফর, গোনাহ ও নাফরমানী তোমাদের কাছে ঘৃণিত বানিয়েছেন। (সূরা হুজুরাত ৪৯ : ৭; রুকু : ১)
জাহেলিয়াতের এক আলামত এই যে, আল্লাহ ও রাসূলের কোনো বিধান যখন শোনানো হয় তখন আগের বিধি-ব্যবস্থা ও বাপ দাদার রীতি-নীতির কথা তোলা হয় এবং আল্লাহ ও রাসূলের মোকাবেলায় আগের যুগের পুরানো নিয়মকানুনের অজুহাত দেখানো হয়।
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ
অর্থ: যখন তাদেরকে বলা হয়, আলস্নাহর প্রেরিত নির্দেশ অনুযায়ী চল, তারা বলে, আমরা তো ঐ পথেই চলব যে পথে আমাদের বাপ-দাদাকে পেয়েছি। (আল্লাহর দ্বীনের পরিবর্তে এরা বাপ-দাদার পথেই চলবে) তাদের বাপ-দাদা জ্ঞান-বুদ্ধিহীন ও সুপথের দিশাহীন হলেও?! (সূরা বাকারা ২ : ১৭০; রুকু: ২১)
بَلْ قَالُوا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُهْتَدُونَ
বরং বলে, আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে একটি পথে পেয়েছি তাদেরই পদাঙ্ক আমরা অনুসরণ করছি। (সূরা যুখরুফ, ৪৩ : ২২ ; রুকু : ২)
আল্লাহর হুকুম ও ওহীর মোকাবিলায় বাপ-দাদার রীতি ও নিজের পছন্দ ও অপছন্দের অনুসরণ করা একান্তই জাহেলী ধর্ম।
قَالُوا يَا شُعَيْبُ أَصَلَاتُكَ تَأْمُرُكَ أَنْ نَتْرُكَ مَا يَعْبُدُ آبَاؤُنَا أَوْ أَنْ نَفْعَلَ فِي أَمْوَالِنَا مَا نَشَاءُ إِنَّكَ لَأَنْتَ الْحَلِيمُ الرَّشِيدُ
অর্থ: তারা বলল, হে শুআইব! তোমার নামায কি তোমাকে এই শিক্ষা দেয় যে, আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের উপাস্যকে বর্জন করি বা নিজেদের সম্পদে নিজেদের ইচ্ছানুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ ত্যাগ করি? (সূরা হূদ ১১ : ৮৭; রুকু : ৮)
যারা আল্লাহর বিপরীতে সবকিছু থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারেনি এবং নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর কাছে সমর্পিত করতে পারেনি তাদের এখনো জাহেলিয়াত থেকে বের হওয়ার ও পুরোপুরি ইসলামে দাখিল হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।
পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদ ও পূর্ণ সমর্পনই হচ্ছে ‘ইসলাম’, যা গ্রহণের আদেশ করা হয়েছিল হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে, আর তিনি তা কবুল করেছিলেন-
إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ
যখন তাকে (ইবরাহীমকে)তার রব বললেন, (আপন প্রভুর সামনে ) সমর্পিত হও (ও তাঁর পূর্ণ আনুগত্য গ্রহণ কর) সে বলল, আমি নিজেকে বিশ্বজগতের পালনকর্তার সোপর্দ করলাম। (সূরা বাকারা ২ : ১৩১ ; রুকু : ১৬)
এবং একই আদেশ করা হয়েছে সকল মুসলমানকে -
فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ
অর্থাৎ তোমাদের ইলাহ (মাবুদ ও হাকিম) তো এক অদ্বিতীয় ইলাহ। সুতরাং নিজেকে তাঁর কাছেই সোপর্দ কর ও তাঁর পূর্ণ তাবেদারি কর। (সূরা হজ্জ ২২ : ৩৪; রুকু : ৫)
এ যদি না হয় তাহলে যেন আল্লাহর সাথে যুদ্ধাবস্থা। এ কারণে এই পূর্ণ ইসলামকে এক জায়গায় আল্লাহ তাআলাسلم বলেছেন। অর্থাৎ এ আল্লাহর সাথে সন্ধি-
يا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ
অর্থ: হে ঈমানদারগণ! দাখিল হও ‘শান্তি ও সন্ধি’তে (ইসলামে)পূর্ণরূপে, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন। (সূরা বাকারা ২ : ২০৮; রুকু : ২৫)*
মনে রাখতে হবে, জাহেলিয়াত অর্থ শুধু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব-পূর্ব আরবীয় জীবন-ধারাই নয়, জাহেলিয়াত অর্থ এমন সব অনৈসলামিক জীবনধারা ও জীবনব্যবস্থা, যার সূত্র ওহী ও নবুওত এবং আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নত নয় এবং যা ইসলামের নীতি ও বিধানের অনুকূল নয়। তা হতে পারে আরবের জাহেলিয়াত, ইরানের মযদকিয়াত, ভারতের ব্রাক্ষণ্যবাদ, মিসরের ফারাও‘সভ্যতা’ তুর্কিস্তানের তুরানী‘সভ্যতা’ কিংবা বর্তমানের পাশ্চিমা সভ্যতা কিংবা মুসলমানদের অনৈসলামিক জীবনযাত্রা ও শরীয়তবিরোধী রীতি-নীতি, আচার -আচরণ, চিন্তা-চেতনা, তা নতুন হোক বা পুরানো, অতীত হোক বা বর্তমান।
[*টীকা: মুফাসসিরীন এ আয়াতের শানে নুযুল এই বর্ণনা করেছেন যে, কিছু মুসলমানের এমন কিছু খাদ্য গ্রহণে দ্বিধা হল যা তাদের পূর্বের ধর্মে তাদের জন্য জায়েয ছিল না এবং যা খেতে তারা অভ্যস্থ ছিল না। তাফসীর-নীতি অনুসারে যদিও এ আয়াত এ প্রেক্ষাপটেই সীমাবদ্ধ নয় এবং অত্যন্ত গভীর ও বিস্তৃত অর্থের ধারক, যা ইসলামের সকল বিধানকেই শামিল করে, কিন্তু এর দ্বারা ঐ দিকেও আলোকপাত হয় যা আমরা বলেছি।]
কুফর শুধু আল্লাহর দ্বীন অস্বীকারের নাম নয়; এ এক ধর্মীয় ও নৈতিক ব্যবস্থা এবং আলাদা একটি ‘ধর্ম’, যার আছে নিজস্ব ‘ফরয -ওয়াজিব’ ও ‘হারাম-মাকরূহ’। এ কারণে এক জায়গায় এদুই ধর্মের সহাবস্থান সম্ভব নয় এবং এক ব্যক্তি একই সময়ে এ দুয়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারে না।
আম্বিয়ায়ে কেরাম কুফরের পরিপূর্ণ মূলোৎপাটন করেন। তাঁরা কুফরের বিষয়ে উদারতা বা কুফরের সাথে সন্ধির মতো শান্তিপ্রিয়তা দেখাতে পারেন না। কুফর চিনে ফেলার ও চিহ্নিত করারও তাঁদের বড় যোগ্যতা থাকে এবং এ বিষয়ে তাঁদের দৃষ্টি অতি সূক্ষ্মদর্শী ও দূরদর্শী হয়ে থাকে। এ বিষয়ে আল্লাহ তাঁদেরকে দান করেন পূর্ণ প্রজ্ঞা ও মনোবল। তাঁদের আল্লাহপ্রদত্ত প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার উপর নির্ভর না করে কোনো উপায় নেই। কুফর ও ইসলামের যে সীমানা তাঁরা বর্ণনা করেছেন তার সংরক্ষণ ছাড়া দ্বীন রক্ষার কোনো উপায় নেই। এক্ষেত্রে সামান্য শিথীলতাও দ্বীনকে এমন বিকৃতির শিকার করে যেমন ঈসাইয়ত, ইহুদিয়ত ও ভারতের ধর্মসমূহের ক্ষেত্রে ঘটেছে। নবীগণের যথার্থ উত্তরসূরীরা এক্ষেত্রে তাঁদের নায়েব হয়ে থাকেন। তাঁরা কুফরের চিহ্ন এক একটি করে দূর করেন। জাহেলিয়াতের দাগ একটি একটি করে পরিষ্কার করেন। কুফর চিহ্নিত করার বিষয়ে তাঁদের উপলদ্ধি সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ হয়ে থাকে। কুফর যে রূপে ও যে পোশাকেই আত্মপ্রকাশ করুক তাঁরা তাকে চিনে ফেলেন এবং এর প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেন।
তারা ভারতের মতো দেশে বিধবা বিবাহকে ঘৃণ্য ও গর্হিত মনে করার মাঝে কুফরের দুর্গন্ধ পান এবং একে চালু করা ও এই সুন্নতকে যিন্দা করার জন্য প্রস্ত্তত হয়ে যান, এমনকি কখনো কখনো এর জন্য জীবনের বাজি লাগাতেও দ্বিধা করেন না।
শরীয়তের বিধানের উপর সমাজের
প্রচলনকে প্রাধান্য দেওয়া আর বোনদেরকে মীরাছ থেকে বঞ্চিত করার জিদ তাদের কাছে কুফর বোধ হয় আর এমন লোকদের বয়কট ও বিরোধিতা তারা ফরয মনে করেন।
আল্লাহ ও রাসূলের দ্ব্যর্থহীন বিধান জানার পরও তা না মানা এবং গায়রুল্লাহর আইন-আদালতের রায় প্রার্থনা ও সে গায়র-ইলাহী আইন-কানুনের প্রয়োগ তাদের কাছে ইসলাম ত্যাগের সমার্থক মনে হয়, আপারগ অবস্থায় তাঁরা ঐ ভূখন্ড থেকে হিজরত করেন।
কোনো নওমুসলিমের বা অমুসলিমদের সঙ্গে বসবাসকারী ও তাদের রীতি-নীতির দ্বারা প্রভাবিত মুসলমানদের মাঝে বিশেষ কোনো প্রাণীর গোশত খাওয়া থেকে বিরত থাকা বা ঘৃণা করার প্রবণতা, তাদের কাছে ঈমানের দুর্বলতা বা তাদের পূর্বের ধর্মের বা অমুসলিমদের সাথে বসবাসের প্রভাব বলে প্রতীয়মান হয়।
কখনো বিশেষ ক্ষেত্রে বা পরিস্থিতিতে একটি সুন্নত বা জায়েয-মুস্তাহাব বিষয়কে ওয়াজিব বা ইসলামের শিআর ও নিদর্শন মনে করতে থাকেন।
কখনো তারা অমুসলিমদের রীতি-নীতি তাদের সংস্কৃতি, বেশ-ভূষা ও সাদৃশ্য গ্রহণের কঠিন বিরোধিতা করেন। আবার কখনো তাদের ধর্মীয় পর্ব উৎসবে অংশ-গ্রহণ নিষিদ্ধ করেন। মোটকথা, জাহেলিয়াতের প্রীতি বা সহযোগিতা যে বেশই ধারণ করুক এবং এর প্রাণসত্তা যে রূপেই আত্মপ্রকাশ করুক তাঁরা মুহূর্তের মাঝে তা বুঝে ফেলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো বিভ্রান্তি হয় না এবং এর বিরেধিতায় কোনো উপযোগিতা তাদের প্রতিবন্ধক হয় না।
তাদের যুগের স্থুল দৃষ্টির বা পৌত্তলিক মানসিকতার লোকেরা তাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে এবং তাচ্ছিল্যের সাথে নানা উপাধিতে ভূষিত করে কিন্তু তারা নিজেদের কাজ পূর্ণ আস্থা ও অবিচলতার সাথে করতে থাকেন। নিঃসন্দেহে এঁরাই প্রতি যুগে নবীগণের দ্বীনের হেফাযত করেছেন এবং আজ ইসলাম যে ইহুদি ধর্ম, খৃষ্টধর্ম ও ব্রাক্ষণ্যবাদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা দেখা যাচ্ছে তা এঁদেরই প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার ফল।
(নদভী রাহ. এর পুস্তিকা ‘‘দ্বীনে হক আওর উলামায়ে রাববানী শিরক ও বিদআত কে খিলাফ কিউঁ’’- এর অনুবাদ।আগামী সংখ্যায় পড়ুন: ‘বিদআত’ ও ‘গাফলত’)