ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বিবাহে অভিভাবকের ভূমিকায় :
বিবাহের ক্ষেত্রে যেসব মধ্যপন্থার লংঘন ব্যাপক, অভিভাবকের ভূমিকার বিষয়টিও তার অন্যতম। বাড়াবাড়ি দুদিক থেকেই হয়। খোদ অভিভাবকের দিক থেকেও এবং ছেলেমেয়ের দিক থেকেও। দাপুটে অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের মতামতকে গুরুত্ব দেয় না। তাদের কাছে নিজেদের ইচ্ছাই শেষ কথা। ছেলেমেয়ের ইচ্ছা-অভিরুচিকে অবজ্ঞা-অগ্রাহ্য করে নিজেদের খেয়াল-খুশিমত বিবাহ মেনে নিতে তাদেরকে বাধ্য করে। চিন্তা করছে না বিবাহটা তাদের ছেলের বা মেয়ের। একত্রে ঘর-সংসার তারাই করবে। বিবাহের ভালোমন্দ ফল তারাই ভোগ করবে। কাজেই স্ত্রী বা স্বামী নির্বাচনের আসল হক তাদেরই। সে হক থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা নির্ঘাত জুলুম। অভিভাবকত্বের গুমরে সে জুলুম করার কোন অধিকার তাদের নেই। আর অনধিকার হস্তক্ষেপ তথা জুলুমের পরিণাম কখনওই শুভ হয় না। জুলুম হল জুলুমাত বা বহুমাত্রিক অন্ধকারের উৎস। সেই অন্ধকার থেকে নানা অমঙ্গল জন্ম নেয়। প্রথমেই ছেলে মনে করে স্ত্রী হল তার উপর অভিভাবকদের পক্ষ থেকে এক চাপিয়ে দেওয়া বিপত্তি। কিংবা মেয়ে মনে করে তার অভিভাবক তাকে ধরে বেঁধে অজানা অন্ধকারে নিক্ষেপ করল। এহেন ভাবনার সাথে স্বচ্ছন্দ দাম্পত্যের আশা দুরাশামাত্র। শুরু থেকেই তারা একে অন্যকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। ফলে সব কিছুতে কেবল খুঁতই চোখে পড়ে। ভালোটাও যেন ঠিক ভালো মনে হয় না। এভাবে অন্তরে ঘৃণা ও বিদ্বেষ দানা বাঁধতে থাকে। অভিভাবকদের শত চেষ্টাতেও তা দূর করা সম্ভব হয় না। অগত্যা হয় সারাটা জীবন অশান্তির আগুনে জ্বলতে থাক, নয়ত মিছে শান্তির সন্ধানে মরীচিকার পেছনে ছোট আর দ্বীন ও ঈমান সব বরবাদ কর, তা না হলে ছাড়াছাড়ির পথ ধরে নতুন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হও। এই যে, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি তাদের জীবনে দেখা দিল দৃশ্যত এটা তাদের ইচ্ছা-অভিরুচিকে অগ্রাহ্য করারই কুফল। সংগত কারণেই অভিভাবক তার দায়ভার এড়াতে পারে না । ফলে অনুভূতিসম্পন্ন অভিভাবকেরা আপনমনে নিজেদের দুষতে থাকে এবং প্রিয় সন্তানের এহেন দুরাবস্থার ঘটয়িতা হিসেবে মনে মনে দারুণ গ্লানিবোধ করে। আবার বোধ-অনুভবের ঘাটতি যাদের আছে তারা সবটা দায় নিয়তির উপর চাপিয়ে নিজেকে বেকসুর খালাসও দিয়ে ফেলে। তা নিজেরা নিজেদের যতই খালাস দিক না কেন ভুক্তভোগী সন্তানও কি সে রায় সর্বান্তকরণে মেনে নেয়? তাদের মনে কি এর বিরুদ্ধে কোনোই আপত্তি থাকে না? অধিকাংশেরই থাকে এবং সারা জীবনের জন্য সেই অভিভাবক তাদের চোখের-মনের কাঁটায় পরিণত হয়। এভাবে পিতামাতা-সন্তান-কেন্দ্রিক জগতের সর্বাপেক্ষা শক্ত বাঁধনের ও সর্বাপেক্ষা আপনার ভূবনটি ক্ষোভে, অনাস্থায় ও আত্মগ্লানিতে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে বহু ছেলেমেয়েও তাদের বিয়েতে অভিভাবককে মূল্যায়ন করে না। তারা নিজেরাই নিজেদের বিবাহ সেরে ফেলছে। সাম্প্রতিককালে এরকম বিবাহের হিড়িক পড়ে গেছে এটা সহশিক্ষা, পর্দাহীনতা ও অবাধ মেলামেশার কুফল। তরুণ-তরুণীরা পরস্পর কাছাকাছি আসার সুযোগ পাচ্ছে। সেখান থেকে ঘনিষ্ঠতা, পরিশেষে বিবাহ। অভিভাবককে জানানোরও দরকার মনে করছে না বা এই ভয়ে জানাচ্ছে না যে, তারা অমত প্রকাশ করতে পারে এবং বাধা দিতে পারে। কোনভাবে যদি জেনে ফেলে এবং সর্ববিচারে মনঃপুত না হওয়ায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, তবে তাদেরকে দুশমন ঠাওরিয়ে তাদের স্বপ্নকে ধূলিস্যাত করে দিয়ে গোপনে বিবাহ সেরে ফেলছে। তা সাক্ষী রেখে বিবাহ করলে বিবাহ বৈধ হল বটে, কিন্তু এক তো গুপ্ত বিবাহ ইসলামে পছন্দনীয় নয়, দ্বিতীয়ত অভিভাবকবিহীন বিবাহও পুরোপুরি ইসলামসম্মত নয়। এরূপ কখনও সুষ্ঠু ও সুন্দর হয় না। এর পরিণাম শুভ হয় না এবং এর অধিকাংশই টেকসই হয় না। হওয়ার কথাও নয়। দুজন তরুণ-তরুণী যখন পরস্পর ঘনিষ্ঠ হয় তখন তাদের দুজনই ঘোরের মধ্যে থাকে তারা একে অন্যের দ্বারা চরম নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কোনও রকম বিবেচনাবোধ তাদের মধ্যে কাজ করে না। একথা ভাবারই অবকাশ হয় না যে, তারা একে অন্যের জন্য উপযুক্ত কি না। পন্থাটাই যেহেতু বদদ্বীনী তাই দ্বীনদারীর ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমতা-সাযুজ্য দেখার তো প্রশ্নই আসে না, এমনকি সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে তারা পরস্পর সমপর্যায়ের কি না সে প্রশ্নও সম্পূর্ণ উপেক্ষিত থাকে। ফলে ঘরে ঘরে আজ অসম বিবাহের হিড়িক। বাড়িওয়ালার মেয়ে তার গাড়ির ড্রাইভারের সাথে চলে যাচ্ছে। কিংবা তার ছেলে কাজের মেয়েকে বিবাহ করছে। ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে পাড়ার কোনো অশিক্ষিত বখাটের সাথে ঘড় ছাড়ছে। অপরিণত বয়সের ছেলে মায়ের বয়সী কারও সাথে ফেঁসে গেছে কিংবা কোনো আনকোড়া কিশোরী পক্ককেশ প্রৌঢ়ের গলায় ঝুলে পড়ছে। এজাতীয় অসম পরিণয় কী পরিণতি বয়ে আনতে পারে তা বলাই বাহুল্য। দু-চার দিন পর মোহ যখন ঘুচে যায়, চোখ আপনিই খুলে যায়। জীবনের কি সর্বনাশ করে ফেলেছে তা চাক্ষুস দেখতে পায়। অমনি পরস্পর ঘৃণা-বিদ্বেষ দানা বাঁধতে শুরু করে। শক্তিমান করে দুর্বলের উপর নির্যাতন। হত্যা বা আত্মহত্যা পর্যন্তও গড়ায়। আহা! অমূল্য জীবনের কি করুণ পরিণতি! জীবন বিসর্জনেও কি সে ভুলের খেসারত শেষ হয়ে যায়? তা যে আরও কতদূর গড়ায় সমাজের খোঁজ-খবর নিয়ে কিংবা পত্রপত্রিকার পাতায় নজর বুলালে তার বড় বেদনাদায়ক তফসীল জানা যায়।
দেখা যাচ্ছে ছেলেমেয়ের অমতে যেমন অভিভাবকের একক সিদ্ধান্তও বিবাহের পক্ষে কল্যাণকর হয় না, তেমনি অভিভাবকবিহীন বিবাহও ছেলেমেয়ের জন্য শুভ হয় না। অনর্থ-অশান্তিই উভয় রকম বিবাহের সাধারণ পরিণতি। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, কিন্তু ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই। নিয়ম হিসেবে তা কখনও বিচার্য হয় না। সাধারণত যা ঘটে নীতি নির্ধারণে তাই লক্ষবস্ত্ত হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যখন বিপত্তিই হয় পরিণতি তখন এজাতীয় বিবাহ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা উচিত। উভয়পক্ষেরই বাড়াবাড়ি পরিহার করে মধ্যপন্থায় চলে আসা উচিত। বলাবাহুল্য শরীয়ত প্রদত্ত নিয়মই মধ্যপন্থা। তাই অভিভাবকেরও কর্তব্য শরীয়ত তাকে যে সীমা পর্যন্ত ক্ষমতা দিয়েছে সেই সীমাকে অতিক্রম না করা এবং ছেলেমেয়েকে দেওয়া শরয়ী অধিকারের বিলকুল খর্ব না করা আর ছেলেমেয়েরও কর্তব্য নিজ অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংযমী হওয়া, অভিভাবকের অভিভাবকত্বের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া সর্বোপরি শভোনতাবোধের পরিচয় দেওয়া।
বিয়েটা যেহেতু সন্তানের, স্বামী বা স্ত্রীকে নিয়ে সংসার জীবন সে-ই যাপন করবে এবং উপযুক্ত বিবাহের সুফল ও অনুপযুক্ততার কুফল মূলত সেই ভোগ করবে তাই তার বিবাহে তার নিজের পছন্দ-অপছন্দই মুখ্য এবং তার মতামতই প্রধান। এটাই যুক্তির কথা এবং এ অগ্রাধিকার শরীয়তই তাকে দিয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الأيم أحق بنفسها من وليها
সাবালিকা মেয়ের নিজ বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার অভিভাবক অপেক্ষা তার নিজেরই বেশি। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪২১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২০৯৮; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২০৯৮)
কাজেই তার যদি কোনো পছন্দ থাকে এবং তা তার পক্ষে অসম না হয়, তবে অভিভাবকের কর্তব্য তার পছন্দকে মূল্য দেওয়া ও তাতে বাধার সৃষ্টি না করা। এমনকি কোনো মেয়ে যদি তার তালাকদাতা প্রাক্তন স্বামীকে ফের বিবাহ করতে চায়, তবে তার ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ অভিভাবককে তাতে বাধ সাধতে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ-
فَلَا تَعْضُلُوْهُنَّ اَنْ یَّنْکِحْنَ اَزْوَاجَهُنَّ اِذَا تَرَاضَوْا بَیْنَهُمْ بِالْمَعْرُوْفِ ؕ
তারা যদি ন্যায়সঙ্গতভাবে পরস্পর সম্মত হয়, তবে স্ত্রীগণ নিজেদের (প্রাক্তন) স্বামীদেরকে বিবাহ করতে চাইলে তোমরা তাদের বাধা দিও না। (সূরা বাকারা : ২৩২)
অপরদিকে তাদের যদি কোনো সম্বন্ধ পছন্দ না হয়, তবে তা মেনে নিতে বাধ্য করা যাবে না। বিশেষভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের এ প্রবণতা অতি ব্যাপক। সেই প্রাচীন কাল থেকেই এটা চলে আসছে। এই আধুনিককালেও অভিভাবকদের সে মানসিকতায় খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। অথচ এটা বিলকুল ইসলাম সম্মত নয়। অভিভাবকের যতই পছন্দ হোক না কেন, মেয়ের যদি পছন্দ না হয় তবে সে রকম পাত্রকে মেনে নিতে বাধ্য করার কোনো অধিকার অভিভাবকের নেই। বাস্তবিকপক্ষে যদি অভিভাবকের সিদ্ধান্ত সঠিক হয় এবং মেয়েই অপরিপক্কতার কারণে তা বুঝতে সক্ষম না হয়, তবে সর্বতোপ্রকারে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু চাপ প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। যদি চাপ দিয়ে তার সম্মতি আদায় করা হয় আর এভাবে অপছন্দের পাত্রের সাথে তাকে বিবাহ দেওয়া হয়, তবে পরবর্তীতে সে বিবাহ বলবত রাখা বা নাকচ করার এখতিয়ার পর্যন্ত শরীয়ত তাকে দিয়েছে। হাদীসগ্রন্থসমূহে এরূপ একাধিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যাতে এ জাতীয় বিবাহে মেয়েকে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। যেমন উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, একবার এক তরুণী তাঁর কাছে এসে বলল, আমার বাবা আমাকে তার ভাতিজার সাথে বিবাহ দিয়েছে-উদ্দেশ্য আমার দ্বারা তার হীনাবস্থা ঘুচানো-কিন্তু আমার তাতে সম্মতি ছিল না। উম্মুল মুমিনীন বললেন, তুমি বসো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসুন। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এলে তিনি তাঁকে সে ঘটনা অবগত করলেন। তা শুনে তিনি মেয়েটির বাবাকে ডেকে পাঠালেন। তারপর মেয়েটিকে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার দিলেন। মেয়েটি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাবা যা করেছেন আমি তা অনুমোদন করলাম। আমার উদ্দেশ্য কেবল নারীদেরকে জানানো যে, এ বিষয়ের ক্ষমতা বাবাদের হাতে নয়। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৫৩৯০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৮৭৪; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৫০৮৭)
স্বীকার করতে হবে, তরুণী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ছিলেন। একদিকে তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে নালিশ করে জেনে নিলেন এবং নারী সমাজকে সচেতন করে দিলেন যে, নিজ বিবাহের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অগ্রাধিকার বিবাহ যে করবে তারই এবং সে অধিকার কেবল ছেলের জন্য সংরক্ষিত নয়; বরং মেয়ের জন্যও অবারিত। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ হতে তিনি যখন বিবাহ বহাল রাখা-না রাখার এখতিয়ার লাভ করলেন তখন যে পত্রপাঠ বিবাহ ডিসমিস করলেন তা নয়; বরং সদ্বিবেচনার পরিচয় দিলেন। তিনি পিতার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানালেন। জীবনসঙ্গী ও সুখ-দুঃখের সাথী হিসেবে একদম পছন্দ নয়, কিন্তু তারপরও অভিভাবক হিসেবে পিতাই যেহেতু তাঁকে স্বামী হিসেবে মনোনীত করেছেন, তাই সে মনোনয়নকে খারিজ করে পিতার মর্যাদাকে খাটো করলেন না। তাঁর এ কর্মপন্থা দ্বারাও আমরা ভারসাম্য ও পরিমিতিবোধের শিক্ষা পাই। অর্থাৎ দৃষ্টি একরোখা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। লক্ষ দুদিকেই রাখা চাই। নিজ পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটা যেমন আছে, তেমনি অভিভাবকেরও মর্যাদা আছে। আছে সন্তানকে নিয়ে তার স্বপ্ন। তার প্রতি শুভেচ্ছা ও কল্যাণকামিতা এবং সর্বাপেক্ষা বেশি কল্যাণকামিতা। নিজ পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে এসব অগ্রাহ্য করলে নিঃসন্দেহে তা চরম একদেশদর্শিতার পরিচায়ক হবে। সন্তান যাতে এ রকম একদেশদর্শী কর্মপন্থা অবলম্বন করে নিজ জীবনে দুর্ভোগ বয়ে না আনে সেজন্য ইসলাম অভিভাবকের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়েছে।
একথা অনস্বীকার্য যে, সন্তানের জন্য স্বামী বা স্ত্রী নির্বাচনে সন্তানের নিজের অপেক্ষা অভিভাবকের বাছাই বেশি সঠিক হয়ে থাকে। কেননা বিয়েটা সন্তানের একান্ত নিজের হলেও সাধারণত তার দৃষ্টি যেহেতু থাকে নেশাচ্ছন্ন এবং কেবল নিজ জীবনের পরিমন্ডলে আর তাও দিক-বিশেষের মধ্যে সীমিত। তাই উপযুক্ত বাছাই তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তা সম্ভব হয় অভিভাবকের পক্ষেই। সন্তানের প্রতি অমিত কল্যাণকামিতার সাথে তার যেহেতু থাকে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও বয়সজনিত বিচক্ষণতা, জানা থাকে সন্তানের স্বভাব-চরিত্র ও রুচি-অভিরুচি, সেই সাথে দৃষ্টিতে থাকে প্রসারতা-সন্তানের, নিজের ও পরিবার-খান্দানের পরিমন্ডল ছাড়িয়েও আঞ্চলিক ও কালিক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে তা ব্যাপ্ত থাকে তাই তার নির্বাচনও তুলনামূলক বেশি নিখুঁত ও সুষ্ঠু হয়ে থাকে। সুতরাং সন্তানেরই কল্যাণার্থে তার বিবাহের দায়িত্বও ইসলাম অভিভাবকের উপর ন্যস্ত করেছে।
আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-
وَ اَنْکِحُوا الْاَیَامٰی مِنْكُمْ
তোমাদের মধ্যে যারা আয়্যিম (অর্থাৎ যে পুরুষের স্ত্রী ও যে নারীর স্বামী নেই-বিবাহিত, বিপত্নীক, বিধবা যাই হোক না কেন) তাদের বিবাহ সম্পন্ন কর। (সূরা নূর : ৩২)
কুরআন-হাদীসের এ নির্দেশ সন্তানের বিবাহদানকে অভিভাবকের এক অবশ্যপালনীয় দায়িত্বই সাব্যস্ত করছে না, সেই সঙ্গে অভিভাবকত্বের ব্যাপারটা যে বিবাহের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ তারও জানান দিচ্ছে। কাজেই এ গুরুত্বকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। অভিভাবকের প্রতি অর্পিত দায়িত্বকে যদি সন্তান নিজের হাতে নিয়ে নেয় এবং নিজেই নিজের বিবাহ সম্পন্ন করে ফেলে তবে সে গুরুত্বকে খাটো করা হয় না কি? এবং তাতে কি খর্ব করা হয় না অভিভাবকের শরীয়ত-প্রদত্ত মর্যাদা? তাই তো অভিভাবকবিহীন বিবাহ যেন সত্যিকারের শরীয়তী বিবাহই নয়। হাদীস সতর্ক করছে, অভিভাবক ছাড়া বিবাহ নেই। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২০৮৫; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১০১)
অর্থাৎ ইসলাম যে বিবাহের ব্যবস্থা দিয়েছে তাতে অভিভাবকেরও একটা ভূমিকা আছে। সে ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করে যে বিবাহ হবে তা বৈধতার বিচারে উত্তীর্ণ হলেও একটা অনুষঙ্গ বাদ পড়ায় ত্রুটিযুক্ত বিবাহ হবে এবং অভিভাবকের জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতের সংশ্লিষ্টতা না থাকার ফলে তা বহুবিধ কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত থাকবে। যে কোনও কাজে বড়দের সংশ্লিষ্টতা বরকতপূর্ণ হয়ে থাকে। হাদীসে আছে, বরকত তোমাদের বড়দেরই সাথে। (মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ২১০; মুজামে আওসাত, তবারানী, হাদীস : ৮৯৯১; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস : ১১০০৪)
অপর বর্ণনায় আছে, কল্যাণ রয়েছে তোমাদের বড়দের সাথে। (মুসনাদে বাযযার) বিবাহ যেহেতু জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় এবং কেবল নিজের ভবিষ্যত জীবনই নয়, পরিবার, খান্দান ও পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থও এর সাথে জড়িত থাকে তাই এক্ষেত্রে কল্যাণ ও বরকতকে ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই। কল্যাণ-বরকতহীন বিবাহ সংশ্লিষ্ট সকলের পক্ষেই মসিবতের কারণ। তাই তো বিবাহের পর বরকতের জন্য দুআ করা হয়-
بَارَكَ اللهُ لَكَ وَبَارَكَ اللهُ عَلَيْكَ وَجَمَعَ بَيْنَكُمَا بِخَيْرٍ
আল্লাহ তাআলা তোমাকে এ বিয়েতে বরকত দান করুন, বরকত দিন তোমার সত্ত্বায় এবং তোমাদের দাম্পত্যকে কল্যাণময় করুন। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ১০৯১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২১৩০)
তো কল্যাণ ও বরকতের স্বার্থেই বিবাহে অভিভাবকের সংশ্লিষ্টতা জরুরি। অভিভাবকবিহীন বিবাহ যে কল্যাণময় হয় না তা কেবল যুক্তিতর্কের বিষয় নয়; বরং এমনই এক বাস্তবতা, যা চারদিকে নজর দিলে যে কারও চোখে পড়বে। এমনকি এজাতীয় বিবাহ টেকসইও হয় না। ক্রমবর্ধমান বিবাহবিচ্ছেদের এটাও একটা বড় কারণ। কাঁচাবুদ্ধির বন্ধন তো পরিপক্ক হওয়ারও কথা নয়। বিশেষত যে সকল মেয়ে অভিভাবককে এড়িয়ে এ পথে ঝাঁপ দেয়-যে কি না স্বভাবতই আবেগপ্রবণ ও কোমলমতি, জীবন ও জগতের ঘোরপ্যাচ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, তাদের আবেগতাড়িত বন্ধন যেন বালির বাঁধ। আকছারই টেকে না। সেই সতর্কবাণীই হাদীসে উচ্চারিত হয়েছে, যে কোনো নারী তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ করে, তার বিবাহ বাতিল বাতিল বাতিল। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২০৮৩; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১০২)
অর্থাৎ অসম বিবাহ হলে তো অভিভাবক আদালতের মাধ্যমে তা নগদই বাতিল করাতে পারে আর যদি অসম নাও হয় তবু তা অতি ক্ষণস্থায়ী হয়। নানাবিধ অসংগতির কারণে সাধারণত বিচ্ছেদই হয় তার পরিণতি।
সারকথা সন্তান ও অভিভাবক উভয়কেই পারস্পরিক দায়িত্ব ও অধিকারের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। অভিভাবককে চিন্তা করতে হবে বিবাহটা যেহেতু সন্তানের তাই মতামতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার তারই। কাজেই তার অমতে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না এবং নিজ সিদ্ধান্তকে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। অন্যপক্ষে সন্তানকেও অভিভাবকের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে, তাঁর স্বপ্ন ও শুভাকাঙ্ক্ষাকে মূল্যায়ন করতে হবে এবং নিজেরই স্বার্থে তার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান-প্রজ্ঞাকে কাজে লাগানোর সুযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ মতামত দানের অগ্রাধিকার যেমন সন্তানের, তেমনি সন্তানের বিবাহ সম্পাদনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়িত্ব অভিভাবকের! এটাই মধ্যপন্থা এবং এতেই বরকনেসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কল্যাণ। ষ