সফর ১৪৩৫   ||   ডিসেম্বর ২০১৩

হযরত মাওলানা হারূন সাহেব রাহ.-এর ইন্তেকাল : একটি নক্ষত্রের পতন

মাওলানা আহমদ মায়মূন

 

গত কুরবানীর ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম হাতিয়ায়। ২৬ অক্টোবর শনিবার সকাল বেলা ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা করার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলাম। এমন সময় মোবাইল ফোনে একটি ক্ষুদে বার্তা পেলাম। তাতে লেখা ছিল, গত রাত সাড়ে তিনটায় হাটহাজারী মাদরাসার বিশিষ্ট মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা হারূন সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আজ বিকাল তিনটায় তাঁর নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হবে।

হযরত মাওলানা হারূন সাহেব ছিলেন আমার অতি শ্রদ্ধেয় উস্তায। হঠাৎ তাঁর ইন্তিকালের খবর পেয়ে মনটা যারপরনাই বিষণ্ণ হয়ে ওঠল। তাঁর নামাযে জানাযায় শরিক হওয়া আমার শুধু কর্তব্যই নয়; বরং কর্তব্যের চেয়ে আরও বেশি কিছু। কিন্তু হাতিয়া থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছার যে যোগাযোগ ব্যবস্থা তাতে কোনোভাবেই তাঁর জানাযার নামাযে শরিক হওয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। তাই মনের প্রবল ইচ্ছাটিকে অতি কষ্টে চেপে রেখে তাঁর জন্য মাগফিরাত কামনা ও ঈসালে সওয়াবের চিন্তা করলাম।

হযরত মাওলানা হারূন সাহেব রাহ. শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হাটহাজারী মাদরাসাতেই লেখাপড়া করেছিলেন। তখন তিনি সেখানে উসতায হিসেবে পেয়েছিলেন সে সময়কার দেশবরেণ্য বুযুর্গানে দ্বীন এবং ইলম, আমল, তাকওয়া ও ইখলাসের পর্বততুল্য মনীষাঋদ্ধ এক কাফেলাকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হযরত মাওলানা হাফেজুর রহমান পীর সাহেব হুজুর রাহ., হযরত মাওলানা আবদুল কাইউম রাহ., হযরত মাওলানা আবদুল আজীজ রাহ., হযরত মাওলানা হামেদ রাহ., হযরত মাওলানা মুফতী আহমাদুল হক রাহ., হযরত মাওলানা আহমদ শফী দামাত বারাকাতুহুম, হযরত মাওলানা আবুল হাসান রাহ., হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আলী রাহ., হযরত মাওলানা নজীর আহমদ আনওয়ারী রাহ., হযরত মাওলানা নাদেরুজ জামান রাহ. প্রমুখ।

এ সকল মনীষী ব্যক্তির সস্নেহ তালীম-তরবিয়ত ও বরকতময় সান্নিধ্য লাভ করে তিনি আল্লাহ তাআলার খাস করুণা ও রহমতে একটি খাঁটি সোনার টুকরায় পরিণত হন। নিজ চরিত্র-মাধুর্য ও অসাধারণ মেধার কারণে ছাত্র জীবনেই সকল উস্তাযের নয়ণতারা হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর মতো অনন্য প্রতিভাবান ছাত্র পেয়ে উস্তাযগণ তাঁদের মনের মতো করে তাঁকে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। তিনিও পরশপাথরতুল্য আসাতিযায়ে কেরামের সংস্পর্শ ছেড়ে অন্য কোথাও ইলম আহরণের জন্য গমন করার প্রয়োজন অনুভব করেননি। তাই হাটহাজারী মাদরাসা থেকে লেখাপড়া শেষ করেই তিনি তালীমী খেদমতে ব্যাপৃত হন।

তাঁর এক মেধাবী সহপাঠী হাটহাজারী মাদরাসা থেকে লেখাপড়া শেষ না করে লাহোরের জামিয়া আশরাফিয়ায় গিয়ে ওপরের জামাতগুলো সমাপ্ত করেছিলেন, কিন্তু তিনি কেন লেখাপড়ার জন্য অন্য কোথাও গেলেন না এ সম্পর্কে একবার জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি আল্লামা শিবলী নুমানী রাহ.-এর একটি ফারসী বয়াত উদ্ধৃত করে বলেছিলেন যে-

ياد ايامے كہ دست افشاں گزشتم از حرم

از غرور آنكہ من ہم آستانے داشتم

  সেই সময়ের কথা মনে পড়ে, যখন আমি হরম (অর্থাৎ কোনো এক বড় দরবার) থেকে এ অহঙ্কারে হাত ঝেড়ে ফিরে এলাম যে, আমারও (শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য উপযুক্ত) একটি দরবার আছে। (সুতরাং আমার ওখানে অবস্থানের প্রয়োজন কী?)

অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন যে, সে সময়কার হাটহাজারী মাদরাসার ইলমী ও আমলী পরিবেশের পরিবর্তে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে তিনি প্রাধান্য দিতে পারেননি।

১৯৮২ সাল হাটহাজারী মাদরাসায় আমার লেখাপড়ার দ্বিতীয় বছর। এ বছরেই হযরত মাওলানা হারূন সাহেব রাহ. হাটহাজারী মাদরাসায় নতুন শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। আমরা সে বছর তাঁর কাছে দীওয়ানুল মুতানাববী পড়ি। তার আগে তিনি চট্টগ্রামের কৈগ্রাম মাদরাসায় পড়িয়েছেন। তার আগে ঢাকার লালবাগ মাদরাসায় এবং তারও আগে ফেনীর বাদাজিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছিলেন।

কৈগ্রাম মাদরাসা থেকে হাটহাজারী মাদরাসায় চলে আসার সময় সেখানকার দায়িত্বশীলগণ বলেছিলেন, আমাদের অভাব পূরণের কী হবে? তখন হাটহাজারী মাদরাসার এক নবীন মেধাবী ফাযেল ছাত্রকে সেখানে শিক্ষক হিসেবে পাঠালে তারা বললেন, এ শিক্ষক তো ছাত্র পড়াবেন, শিক্ষকদের পড়াবেন কে? অর্থাৎ সেখানকার কর্তৃপক্ষের ভাষায়, তিনি সেখানে শুধু ছাত্রই পড়াতেন না, প্রয়োজনে শিক্ষকদেরও পড়াতেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে সে অভাবটি কে পূরণ করবে? তবু তিনি তাঁর আসাতিযায়ে কেরামের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেননি। তাই তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় যোগদান করলেন।

যে সময় তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় যোগদান করেন তখন তাঁর বড় বড় উস্তাযগণ সুস্থ-সবল অবস্থায় হাদীসের কিতাবাদির খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছিলেন। তাই প্রথম কয়েক বছর তিনি দাওরায়ে হাদীসের কিতাব পড়ানোর সুযোগ পাননি। পরে তাঁর আসাতিযায়ে কেরামের কেউ কেউ দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পর তিনি দাওরায়ে হাদীসে দরস দানের সুযোগ লাভ করেন এবং ক্রমান্বয়ে আবু দাউদ, জামে তিরমিযী, মুসলিম প্রভৃতি কিতাবের দরস দান করেন। একপর্যায়ে তিনি মাদরাসার নাজেমে তালীমাত ও নায়েবে মুহতামিমের মর্যাদাপূর্ণ পদে উন্নীত হন এবং ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সাথে নিজ দায়িত্ব সুচারুরূপে আঞ্জাম দেন।

ইলমের অতল সমুদ্রের এ ডুবুরী আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে ছিলেন না। হযরত মাওলানা যমীরুদ্দীন রাহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা হযরত মাওলানা হাফেজুর রহমান পীর সাহেব হুজুর রাহ. তাঁকে খেলাফত দ্বারা ভূষিত করেন।

দরসে নিজামীতে পাঠ্যভুক্ত সকল শাস্ত্রে তাঁর দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ের, কিন্তু বিশেষ করে নাহব, সরফ, বালাগাত এবং আরবী, ফার্সী ও উর্দুর কাব্যে ও সাহিত্যে তাঁর অসাধারণ পান্ডিত্য ছিল। ফারসী কাব্য রচনায় তাঁর হাত ছিল স্বভাব কবির মতো। আরবী বর্ণমালার গাণিতিক মানের প্রতি লক্ষ রেখে বাক্য তৈরি করে তা থেকে নির্দিষ্ট কোনো তারিখ বা সন বের করায় তাঁর দক্ষতা ছিল বিস্ময়কর। হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. ও মুফতী ফয়জুল্লাহ রাহ.-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী এ আঙ্গিকে রচনা করে এ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন নিপুণভাবে। এগুলো তাঁদের স্মারক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।

তাঁকে উস্তায হিসেবে পাওয়ার আগেই তাঁর এ ধরনের দু একটি লেখাপড়ার সুযোগ আমার হয়। সে থেকেই তাঁর বিরল মেধার সাথে আমার কিছুটা পরিচয় ঘটে। শিক্ষক হিসেবে তাঁকে কাছে পেয়ে তাঁর জ্ঞানভান্ডার থেকে উপকৃত হওয়ার আশায় আমি অনেকের চেয়ে কিছুটা বেশি পুলকিত হই।

তখন হাটহাজারী মাদরাসায় তিনি একজন নতুন শিক্ষক হলেও নিজের অসাধারণ মেধা, যোগ্যতা, পান্ডিত্যপূর্ণ দরস ও বিমুগ্ধকর চরিত্র-মাধুর্যের গুণে ছাত্র-শিক্ষক সকলের অন্তরে শ্রদ্ধা, মর্যাদা ও ভালবাসার আসন অতি দ্রুত গড়ে নিতে সক্ষম হন তিনি। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর প্রজ্ঞাময় ব্যক্তিত্বের সুনাম-সুখ্যাতি ইলমী মহলে ছড়িয়ে পড়ে। এককথায়, তাঁর গুণোৎকর্ষ তাঁকে দ্বীনী বিদগ্ধজনদের আসরে এক ঈর্ষণীয় অনন্যতা দান করে। তাঁর মতো লোকদের সম্পর্কেই মনে হয়, আকবর এলাহাবাদী বলেছিলেন-

نگاہيں كاملوں پر پڑ ہى جاتى ہىں زمانے كى

كہاں رہتا ہے اكبر پهول پتوں سے نہاں ہو كر

গুণধরদের প্রতি যুগ-সমাজের দৃষ্টি পড়েই যায়, হে আকবর! ফুলগাছের ফুল কি কখনও পাতার আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে?

আমি যে ইলমী আবহে বেড়ে উঠি সেখানে কারও কারও মধ্যে উর্দু-ফারসীর পদ্য চর্চার প্রতি বেশ ঝোঁক ছিল। সেই আবহ আমাকেও ছন্দচর্চার বাতিকে আক্রান্ত করেছিল কৈশোরেই। হাটহাজারী মাদরাসার পরিবেশে যখন আমার পদ্যচর্চা অপরিপক্ক তারুণ্য-তাড়িত আগ্রহে এগিয়ে চলছিল, সেই মুহূর্তে হযরত মাওলানা হারূন সাহেব হুজুরকে উস্তায হিসেবে পেয়ে তাঁর কাছে আরবী ছন্দশাস্ত্র পড়ার ইচ্ছা মাথায় চাপল।

আমার ভাবনার সাথে আরও কয়েকজন উৎসাহী সহপাঠী বন্ধুকে যুগিয়ে নিয়ে জোট বেঁধে গেলাম তৎকালীন নাজেমে তালীমাত ও শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আবদুল আজীজ রাহ.-এর কাছে। তাঁর কাছে আবেদন করলাম, আমাদের জন্য উপযোগী হয়, আরবী ছন্দশাস্ত্রের এমন কোনো কিতাব আমাদের পাঠ্যভুক্ত করে দিয়ে হযরত মাওলানা হারূন সাহেব হুজুরের কাছে পড়ার ব্যবস্থা করে দিতে। তিনি আমাদের আবেদন মঞ্জুর করে আরূদুল মিফতাহ নামক কিতাবটি পাঠ্যভুক্ত করে দিয়ে দীওয়ানুল মুতানাববীর সাথে হুজুরের দায়িত্বে দিয়ে দিলেন। কিন্তু মাদরাসার গ্রন্থাগারে কিতাবটি না থাকায় তা আমাদেরকে সরবরাহ করা যায়নি এবং আমরাও কিতাবটি কোনোভাবে যোগাড় করতে না পারায় তা আর নিয়মিত ক্লাসে পড়ার সুযোগ হয়নি; তাই বলে আমরা কয়েক বন্ধু হাল ছাড়লাম না। এখন কি করা যায়? এ নিয়ে হুজুরের সাথে পরামর্শ করলে তিনি আমাদেরকে এ বিষয়ক একটি ছোট্ট কিতাবের সন্ধান দেন। কিতাবটি লেবাননের কবি ও সাহিত্যিক নাসীফ ইয়াযেজী কর্তৃক প্রণীত। নাম নুকতাতুত দায়েরা, যা মাওলানা আবদুল আহাদ কাসেমী কৃত উর্দু অনুবাদ সহকারে ইলমুল আরূদ নামে এমদাদিয়া লাইব্রেরী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।

অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর কিতাবটির একটি কপি যোগাড় করা গেল, কেউ কেউ দুরূসুল বালাগার শেষে সংযুক্ত কপিটি যোগাড় করল। আমার পক্ষে কোনোটিই সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তখন ফটোস্ট্যাটের ব্যবস্থাও ছিল না। অগত্যা আমি কিতাবখানির একটি হস্তলিখিত কপি তৈরি করি এবং আমরা কয়েকজন মিলে সন্ধ্যার পর তাঁর কাছে কিতাবখানি আলাদাভাবে পড়ি। পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা এতেই অনেক বরকত দান করেন।

এ সুবাদে তাঁর কাছে একটু বেশি যাতায়াত করার, তাঁকে কাছে থেকে জানার এবং তাঁর বিস্ময়কর মেধা কিছুটা আঁচ করার সুযোগ আমরা লাভ করি। আমাদের নিজেদের অবস্থান থেকে তাঁর মেধার তীক্ষ্ণতা ও প্রখরতা যতটুকু আমাদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে তাতে অন্যদের সাথে আমিও পুনঃপুনঃ বিস্ময়াভিভূত হয়েছি।

হয়ত কেউ আমার এ উপলব্ধিকে অপরিণত ছাত্র বয়সের অনভিজ্ঞতাজনিত বিমুগ্ধতা বলে ব্যাখ্যা করতে পারেন, কিন্তু তাঁর সাথে বিনীতভাবে আমি দ্বিমত পোষণ করব। কারণ বেশি না হলেও অন্তত চার দশক ধরে নিজের বিভিন্ন অবস্থান থেকে বিস্তীর্ণ পরিসরে অনেক সাধারণ-অসাধারণ মেধাবীর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, তবুও এখনও আমি বলব, আল্লাহ তাআলা তাঁকে যে প্রখর মেধা দান করেছিলেন তা এক কথায় অনন্য।

নিকট অতীত ও দূর অতীতের অনেক মেধাবী মানুষের কথা আমি শুনেছি, জীবন ইতিহাসের গ্রন্থাবলিতে পড়েছি। আমার এ উস্তাযে মুহতারামের মেধার প্রখরতা কিছুটা উপলব্ধি করেছি বলেই পূর্ববর্তী মনীষীদের কাহিনীগুলোর সঠিকতা বোঝা আমার পক্ষে সহজ হয়েছে।

মেধা বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। কারও স্মৃতিশক্তি প্রখর হয়, কারও বোধশক্তি তীক্ষ্ম ও গভীর হয়। এ বিবেচনায় দেখলে হযরতের মেধার গভীরতা, তীক্ষ্মতা ও স্বচ্ছতা ছিল অবাককরা মাত্রার। অনুমান করি, এ ধরনের তীক্ষ্ণ ও স্বচ্ছ মেধাসম্পন্নরাই পূর্বেকার যুগে কোনো শাস্ত্রে ইমাম অভিহিত হতেন। যাঁরা কোনো শাস্ত্রের ইমাম রূপে আখ্যায়িত হন তারা অনেকের হাবিজাবি মতামতকে গোগ্রাসে গলাধঃকরণ ও উদ্গীরণ করেন না; বরং তাঁদের অভিমতই গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তের মর্যাদা পায়। হযরত মাওলানা হারূন সাহেব রাহ. ছিলেন সে গোত্রেরই একজন। এ ধরনের মহীরূহ যত্রতত্র যখন তখন গজায় না, কালেভদ্রেই আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে পাঠান। ইতিহাস তাদেরকে ক্ষণজন্মা বলে অভিহিত করে। ইকবালের ভাষায়-

ہزاروں سال نرگس اپنى بے نورى پہ روتى ہے

بڑى مشكل سے ہوتا ہے چمن ميں ديدہ ور   پيدا

হাজার হাজার বছর ধরে নার্গিস ফুল (চক্ষু সদৃশ এক প্রকার ফুল) নিজের জ্যোতিহীনতার জন্য কাঁদে। অনেক কষ্টে পৃথিবীর উদ্যানে দৃষ্টিসম্পন্ন ফুল অর্থাৎ ব্যক্তিদের আবির্ভাব ঘটে।

চার কি পাঁচ বছর আগের কথা। একটি কিতাবের এক জায়গায় একটি লিপিগত ভুল আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়ল। আশ্চর্যের বিষয় হল, যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ ভুলটি সম্পর্কে কোনো টীকাকার বা ভাষ্যকার কোনো মন্তব্য তো করেননি; বরং ভুলটিকে আপন অবস্থায় রেখেই তৎসংশ্লিষ্ট আলোচনা করে গেছেন। এ সম্পর্কে যাঁদের কাছে কিছু জানতে পারব বলে মনে করেছি, তাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। তারা ভুলটিকে অপব্যাখ্যা করে সঠিক বানাবার চেষ্টা করলেন, তৃপ্ত হওয়ার মতো কোনো উত্তর পেলাম না। বছর তিনেক আগে যখন হাটহাজারী মাদরাসায় এতেকাফের উদ্দেশে গেলাম তখন উক্ত কিতাবের সেই জায়গাটি নিয়ে হযরত মাওলানা হারূন সাহেব হুজুরের সাথে আলোচনা করলাম। হুজুর শুনে সাথে সাথেই বললেন, ইবারতটিতে ভুল আছে। সঠিক এরকম হবে। হুজুর আমাকে কিতাবটির মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রকাশিত কোনো সংস্করণ দেখতে পরামর্শ দিলেন। হুজুরের উত্তরে মনের দ্বিধা-সংশয় তো দূর হলই, সাথে সাথে হুজুরের সূক্ষ্ম মেধার আরেকবার পরিচয় পেলাম।

অত্যন্ত দুঃখের কথা যে, জাতির এ অসাধারণ মেধাবী সন্তানটিকে তাঁর সমাজ যেমন যথাযোগ্য মূল্যায়ন করে কাজে লাগায়নি, তেমনি দরবেশ-প্রকৃতির আত্মভোলা এ মানুষটি নিজেও নিজের মেধাকে এমন কোনো কাজে ব্যাপৃত করতে উদ্যোগী হননি, যা আজ তাঁর মেধার স্বাক্ষররূপে উপস্থাপন করা যায়। তাঁর দু একটি উর্দু-ফার্সী লেখা বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হলেও তা পরিমাণে এতই সামান্য যে, সেগুলো তাঁর প্রকৃত মেধার অসাধারণত্ব তুলে ধরে না। এ আমাদের দুর্ভাগ্য যে, তাঁর মেধা থেকে এ দেশ ও জাতি যা পেতে পারত তা পায়নি। এ মাটি শুধু সোনা ফলায় না; সোনা গিলেও খায়। তার অজস্র নজির আছে।

ع ۔ قدر پہچانى نہ اپنے گوہر يك دانہ كى

আহা! দেশ ও জাতি এ একক মুক্তাটিকে চিনতে পারেনি, অথবা চিনলেও মূল্যায়ন করতে জানেনি।

ইকবালের বাল্য ও কৈশোরকালে তাঁর মেধা লালিত ও বিকশিত হয়েছিল যেই সুদক্ষ উস্তাযের সস্নেহ দৃষ্টিতে, সযত্ন পরিচর্যায় ও সুনিপুণ কারিগরি হাতে তাঁর নাম সায়্যিদ মীর হাসান। ইংরেজ আমলে শামসুল উলামা খেতাব দেওয়ার জন্য একজন কৃতী পুরুষের নাম প্রস্তাব করতে ইকবালকে অনুরোধ করা হলে তিনি তাঁর এ শিক্ষাগুরুর নাম পেশ করেন। ইকবালকে তখন বলা হল, আপনার এ শিক্ষকের কীর্তিস্বরূপ কোনো লেখা বা রচনা থাকলে তার নাম বলুন। ইকবাল উত্তরে বলেছিলেন, তাঁর জীবন্ত রচনা স্বয়ং আমি। হযরত মাওলানা হারূন সাহেব রাহ.-এর কোনো যোগ্য ছাত্র নিজেকে ইকবালের মতো সাহসের সাথে নিজ উস্তাযের জীবন্ত রচনা হিসেবে উপস্থাপন করে তাঁর বিশালতা সমাজের চোখে তুলে ধরতে পারেন কি না জানি না, তবে একটি মহীরূহ প্রকান্ডতায় মহীরূহ বিবেচিত হয়, এজন্য তার কোনো ফুল-ফলের প্রয়োজন হয় না। বটবৃক্ষ যেমন তার অতিকায়তার জন্যই প্রসিদ্ধ, অকেজো ফুল বা গোটার জন্য নয়।

দেহাকৃতিতে ছোটখাটো, কিন্তু মস্তিষ্কের উর্বরতায় অসাধারণ এ মানুষটি গুণীদের মর্যাদা দিতে না জানা এ সমাজের মায়া ত্যাগ করে যখন পরপারে চলে গেলেন তখন তারা হয়ত বুঝতে পারেনি যে, কী অমূল্য রত্ন তারা হারাল! তবে এতে দেশ ও জাতির যে অপূরণীয় ক্ষতি হল তাতে রক্তাশ্রু বিসর্জন দিলেও তার হক আদায় হবে না। আল্লাহ তাআলা তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী সৃষ্টি করে দিন, তাঁর পরিবার-পরিজন ও আপনজনদেরকে সাবরুন জামীল (অনুযোগহীন ধৈর্য) দান করুন, তাঁর প্রতি নিজ রহমত ও মাগফিরাতের অবিরাম বারি বর্ষণ করুন এবং তাঁর দারাজাত বুলন্দ করে দিন।

آسماں ان كى لحد پر شبنم افشانى كرے

سبزۂ نورستہ اس گهر كى نگہبانى كرے

তাঁর কবর আল্লাহ তাআলার করুণার শিশিরে সিক্ত হোক এবং তাঁর কবর রহমতের সবুজ চাদরে আচ্ছাদিত হোক। আমীন। ষ

 

 

 

advertisement