কাদিয়ানী সম্প্রদায় কেন মুসলমান নয়-৫
কুরআন হাদীসের আলোকে ঈসা আলাইহিস সালামের জীবন ও অবতরণ
দুটি বুনিয়াদের উপর মুসলামানদের ‘নুযূলে মাসীহ’ এবং ‘হায়াতে মাসীহ’-এর আকিদা প্রতিষ্ঠিত। এক. কুরআন মাজীদের একাধিক আয়াত। দুই. বহু সংখ্যক হাদীস, যেগুলো মর্মগত দিক থেকে এবং সমষ্টিগতভাবে তাওয়াতুরের স্তরে উন্নীত।
এখানে ‘তাওয়াতুর’ মানে, হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে, বিভিন্ন সূত্রে, নানা শিরোনামে এত বিপুল সংখ্যক সাহাবী থেকে ‘নুযূলে মাসীহ’ সম্পর্কিত আকিদাটি বর্ণিত হয়েছে যে, তাদের সাহাবী হওয়ার বিষয়টি বাদ দিয়েও শুধু সংখ্যার কারণেই এমন সন্দেহ বিবেকবুদ্ধি ও স্বভাবিকতার বিচারে একেবারেই অমূলক ও অসম্ভব যে তারা সবাই একজোট হয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মিথ্যারোপ করেছেন কিংবা নবীজীর এ-সম্পর্কিত বাণী বুঝতে ভুল করেছেন
অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কেরাম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের আরও অধিক সংখ্যক ব্যক্তি হাদীসগুলি গ্রহণ করেছেন। এমনি করে সকল যুগে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হাদীসগুলির বর্ণনাকারীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এদের সম্পর্কেও নিরেট বস্ত্তবাদী ও যুক্তিবাদী বিচারবুদ্ধি অনুসারেও উপরোক্ত সংশয়-সন্দেহ পোষণ করা সম্ভব নয়।
তো যে বিষয় এমন তাওয়াতুরের সঙ্গে বর্ণিত হয়, সে বিষয়টি সম্পর্কে সুনিশ্চিত এবং অকাট্য ইলমও হাসিল হয়। আর তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। ধরুন, লন্ডন শহর কখনো আপনি দেখেন নি, যাননি কখনো প্যারিসে। নিউইয়র্ক, মস্কো, কায়রো-বাগদাদ ইত্যাদিও দেখেন নি। অথচ পৃথিবীতে এ শহরগুলো বিদ্যমান থাকার ব্যাপারে আপনার মনে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। ভেবে দেখুন তো, কীভাবে কোন দলিলে এই সুনিশ্চিত অভিজ্ঞানটুকু আপনার অর্জিত হল?
এ-ছাড়া আর কি যে, এ-শহরগুলি সম্পর্কে বহু মানুষ থেকে এত বেশি আপনি শুনেছেন, বইপুস্তক থেকে এত অসংখ্য তথ্য এবং পত্র-পত্রিকায় নানাবিধ সংবাদ আপনি জেনেছেন ও পড়েছেন যার ফলে শহরগুলির বিদ্যমান থাকা সম্পর্কে আপনার মনে কোনো সন্দেহ নেই।
তো এভাবে কোনো কিছু প্রমাণিত হওয়াকেই ‘তাওয়াতুর’ বলে। সূক্ষ্ম শাস্ত্রীয় পরিভাষায় যাকে ‘তাওয়াতুরে কদরে মুশতারাক’ও বলা হয়।
যাইহোক, নুযূলে মাসীহ (তথা শেষ যামানায় ঈসা আলাইহিস সালামের অবতরণের) আকিদাটি এ-জাতীয় তাওয়াতুর দ্বারাই প্রমাণিত। হাদীসের প্রায় সবক’টি কিতাবে বর্ণিত এসম্পর্কিত হাদীসগুলি সামনে রাখলে যে কোনো বিবেকবান মানুষ এ-ব্যাপারে পূর্ণ আশ্বস্ত ও নিশ্চিন্ত হয়ে যাবেন যে, অতি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পুনরাগমনের সংবাদ দিয়েছেন।
আজ (আনুমানিক ১৯৭৪ সন) থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বে সাইয়েদ আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহ. এই আকিদা সম্পর্কিত হাদীসসমূহ একত্রিত করে ‘আত তাসরীহ বিমা তাওয়াতারা ফী নুযূলিল মাসীহ’ নামক কিতাব রচনা করেছেন। তাতে শুধু ‘মারফু’ হাদীসই রয়েছে সত্তরের অধিক। সূত্রগত দিক দিয়ে যার চল্লিশটিই সহীহ ও হাসান পর্যায়ের। অথচ তাওয়াতুর প্রমাণের জন্য এবং কোনো আকিদা বা বিধান সম্পর্কে অকাট্য ইলম অর্জনের জন্য এর চেয়ে অনেক কম হাদীসও যথেষ্ট।
আর অনেক মুহাদ্দিস নুযূলে মাসীহ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির (তাওয়াতুরের সঙ্গে বর্ণিত) বলে জোরালো মন্তব্যও করেছেন। মশহুর মুফাসসির ও মুহাদ্দিস ইবনে কাছীর (মৃত্যু ৭৭৪ হি:) লিখেছেন, ‘নিশ্চই তাওয়াতুরের সঙ্গে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এমন হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, তিনিই উম্মতকে কেয়ামতের পূর্বে ঈসা আলাইহিস সালামের পুনরাগমনের সংবাদ দিয়েছেন।’ (তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪/২০১)
এ বিষয়ে মির্যা সাহেবের স্বীকারোক্তি
এখানে পাঠককে জানিয়ে রাখা খুবই সঙ্গত যে, নুযূলে মাসীহ সম্পর্কিত হাদীসসমূহকে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেও মুতাওয়াতির বরং তাওয়াতুরের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত বলে স্বীকার করেছেন। ‘ইযালাতুল আওহাম’ নামক কিতাবে তিনি লিখেছেন, ‘মসীহ (ঈসা) ইবনে মারইয়ামের পুনরাগমনের ভবিষ্যদ্বাণী প্রথম স্তরের ভবিষ্যতগুলির মধ্যে গণ্য। এ ব্যাপারে সবাই একমত। সহীহ হাদীসে যত ভবিষ্যদ্বানী এসেছে, তার কোনোটা এ ভবিষ্যদ্বানীর সমপর্যায়ের নয়। এটি তাওয়াতুরের প্রথম দরজায় উন্নীত।’ (ইযালাতুল আওহাম, ২৩১পৃ.)
এখানে এ বিষয়টাও মনে রাখার মত যে, মির্যা সাহেব নিজেকে ‘ঈসা মসীহ’ দাবী করার পরও দীর্ঘ ১০/১২ বছর পর্যন্ত মুসলমানদের মতোই আকিদা পোষণ করতেন যে, হাদীসের বিবরণ অনুযায়ী ঈসা আলাইহিস সালাম আসমানে জীবিত অবস্থায় আছেন এবং তিনি শেষ যামানায় অবতরণও করবেন। তবে মির্যা সাহেবের ‘মাসীহ’ হওয়ার অর্থ শুধু এতটুকু যে, তিনি ‘মাছীলে মাসীহ’ মাত্র, অর্থাৎ ঈসার প্রতিকৃতি (প্রকৃত ঈসা মাসীহ নন)।
প্রথম দিকে লিখিত ‘বারাহীনে আহমাদিয়া’ নামক কিতাবের টীকায় তিনি এতদূর লিখেছেন
‘দ্বিতীয়বার যখন ঈসা মাসীহ দুনিয়াতে তাশরীফ আনবেন, তখন তাঁর হাতে পৃথিবীর দিকদিগন্তে ইসলামের প্রসার ঘটবে।’ (বারাহীনে আহমাদিয়া ৪৯৮-৪৯৯ পৃ.)
মির্যাপুত্র ও খলিফা মির্যা মাহমুদ লিখেছেন, ‘হযরত (কাদিয়ানী) মাসীহে মাওউদ ‘ঈসা মাসীহ’ বলে সম্বোধিত হওয়ার পরও ১০ বছর পর্যন্ত এ-ধারণাই করতেন যে, ঈসা আলাইহিস সালাম আসমানে জীবিত অবস্থায় আছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, আল্লাহ পাক তাকে (কাদিয়ানীকে) ঈসা মাসীহ বানিয়ে (দুনিয়াতে পাঠিয়ে) দিয়েছেন! যেমনটা ‘বারাহীনে’ উল্লিখিত ইলহাম থেকে আমরা জানতে পারি। (হাকীকাতুন নবুওয়াহ, ১৪২ পৃ.)
মির্যা কাদিয়ানী এবং মির্যা মাহমুদের বক্তব্য থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট। এক. নুযূলে মাসীহ সম্পর্কিত হাদীসগুলি তাওয়াতুরের স্তরে উন্নীত। দুই. মির্যা সাহেব হাদীসগুলি থেকে বুঝতেন যে, কুরআনে উল্লেখিত ইসরাঈলী নবী ঈসা মাসীহ ইবনে মারইয়াম শেষ যামানায় আসমান হতে অবতরণ করবেন। এ বিষয়টির উপর তার অটুট আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। ফলে যখন (তার বক্তব্য অনুযায়ী) তাকে ‘মাসীহ’ আখ্যা দেয়া হল, তখনও তিনি এর অর্থ এতটুকুই মনে করতেন যে, আমি সরাসরি মাসীহ নই ‘মাছীলে মাসীহ’(মাসীহের মতো) মাত্র। এরপর থেকে ১০ বছর যাবত এমন বিশ্বাসই তিনি পোষণ করতেন এবং নিজেকে মাছীলে মাসীহের বেশি কিছু ভাবতে পারতেন না। শেষ যামানায় আসমান থেকে প্রকৃত ঈসা মাসীহের আগমন হবে, এটা যেমন সকল মুসলমানের দৃঢ় আকিদা, হুবহু তারও ছিল এই আকিদা!
কিন্তু লম্বা একটি সময় গড়িয়ে যাবার পর (১৮৯১ সনে) তিনি দাবি করে বসলেন, আমিই সেই ঈসা ও মাসীহ ইবনে মারইয়াম, বহু সংখ্যক হাদীসে যার আগমনের সংবাদ নবীজী উম্মতকে দান করেছেন!
প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করুন, মির্যার এ-দাবি কতটা অর্থহীন ও অযৌক্তিক! হাদীস শরীফের যেখানেই অন্যান্য নবী যেমন ইবরাহীম-ইসমাঈল, ইসহাক-ইয়াকুব, মুসা ও হারুন প্রমুখের (আলাইহিমুস সালাম) নাম এসেছে, সেখানে তো ঐ সকল মহান ব্যক্তিবর্গই উদ্দেশ্য, কুরআনে যাদের আলোচনা এই সকল নামে এসেছে এবং যারা এই সকল নামে সর্বজনজ্ঞাত ছিলেন। কিন্তু কাদিয়ানীদের মতে কেবল নুযূলে মাসীহের হাদীসগুলোতে যেখানে যেখানে মাসীহ ইবনে মারইয়ামের আলোচনা এসেছে এবং যিনি শেষ যামানায় আগমন করবেন বলে নবীজী সংবাদ দিয়েছেন, তার দ্বারা কুরআনে বর্ণিত এবং এই নামে প্রসিদ্ধ ঈসা মাসীহ উদ্দেশ্য নয়! বরং হাদীসগুলিতে ঈসা মাসীহ বলতে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মতো কোনো ‘মাছীল’ (প্রতিকৃতি) উদ্দেশ্য!
কেমন কথা এটা! এমন অযৌক্তিক দাবিও কেউ করে! এতটা অর্থহীন কথাও কারো মাথায় আসতে পারে! কিন্তু আফসোস কাদিয়ানীদের জন্য এবং ঐ সমস্ত শিক্ষিত বিজ্ঞজনের জন্য, যারা এ-জাতীয় যুক্তিবিরুদ্ধ কথা মেনে নিয়েছেন, ঢাকঢোল পিটিয়ে এগুলির পক্ষে ওকালতিও করে যাচ্ছেন! (হেদায়েত আল্লাহর হাতে। তিনি যদি হেদায়েত না দেন, তাহলে কিছুই করার নেই।) আল্লাহ বড় সত্য বলেছেন, (তরজমা) বস্ত্তত আল্লাহ যাকে আলো না দেন, তার নসীবে কোনো আলো নেই। সূরা-নূর ২৪:৪০
অন্য আয়াতে বলেছেন, (তরজমা) আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন, তার আর কোনো পথপ্রদর্শক থাকে না।-সূরা মুমিন ৪ : ৩৩
যাই হোক, আমরা আরজ করছিলাম, নুযূলে মাসীহের আকিদার ভিত্তি দুটি। কোরআন মাজীদের একাধিক আয়াত এবং বহুসংখ্যক হাদীস। আর এ পর্যন্ত যা বলা হয়েছে, তা থেকে আমরা আরও বুঝলাম, নুযূলে মাসীহ সম্পর্কিত হাদীসগুলি তাওয়াতুরের সঙ্গে বর্ণিত। ফলে সুনিশ্চিত এবং অকাট্যভাবে এ-বিষয়টি প্রমাণ হয়ে গেছে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ যামানায় ঈসা আলাইহিস সালামের আগমনের সংবাদ দিয়েছেন। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আশা করি এ-আকিদার বিষয়ে হাদীস শরীফের দালিলিক ভিত্তি বোঝার জন্য উপরোক্ত আলোচনাই যথেষ্ট।
নুযূলে মাসীহ সম্পর্কে কুরআনের দলিল
মূল আলোচনার পূর্বে একটি মৌলিক কথা আরজ করছি। শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই জানেন, কুরআন নাযিল হওয়ার সময় সাধারণ খৃস্টজগতের আকিদা ছিল এবং এখনো আছে যে, (তাদের মতে শূলিতে চড়ানোর পর) ‘ঈসা আলাইহিস সালামকে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং তিনি জীবিত আছেন, শেষ
যামানায় তাঁর পুনরাগমন হবে।’ প্রচলিত বাইবেলগুলিতে পরিষ্কার ভাষায় এই আকিদার কথা বলা আছে। (দেখুন, লুক : ৩৪/৫১, মার্ক: ১৬/২৯; প্রেরিত পুস্তক ১/৯, ১০, ১০)
তো আকিদাটি এতই যখন শিরক ও গোমরাহীপূর্ণ হবে (যেমনটা মির্যা সাহেব হাকীকাতুল ওহীর সম্পূরক গ্রন্থ আল ইস্তিগনার ১৪৯ পৃষ্ঠায় এবং মির্যাপুত্র বশীরুদ্দীন মাহমুদ হাকীকাতুন নবুওয়াহর ৫৩ পৃষ্ঠায় দাবি করেছেন,) তবে তো নাসারাদের এ আকিদাও তেমনি পরিষ্কার ভাষায় রদ করে দেয়া কুরআন মাজীদের অপরিহার্য দায়িত্ব ছিল, যেমন সুষ্পষ্ট ভাষায় নাসারাদের অন্যান্য ভুল বিশ্বাসগুলিকে কুরআন মাজীদ সম্পূর্ণরূপে নস্যাৎ করে দিয়েছে! যেমন ত্রিত্ববাদ, ঈসা আলাইহিস সালামের সন্তানত্ব, পুত্রত্ব ও ঈশ্বরত্ব ইত্যাদি। তাহলে অন্তত মুসলমানরা এই শিরকী আকিদাগুলির মতো ঈসা আলাইহিস সালামের উর্ধ্বগমন, প্রলম্বিত জীবন এবং পুনরাগমনের আকিদা থেকেও বাঁচতে পারতো। আর সব ধরনের শিরকী আকিদা ও কার্যকলাপকে বাতিল সাব্যস্ত করাই তো কুরআন মাজীদের অন্যতম আলোচ্য বিষয়! কিন্তু কুরআন মাজীদের কোথাও নাসারাদের এই আকিদা খন্ডন করা হয়নি।
এই আকিদা যে খন্ডন করা হয়নি, তার সবচে’ সহজবোধ্য দলিল হল, কুরআন নাযিলের সময় থেকেই উম্মতে মুসলিমার এই আকিদা সর্বজনস্বীকৃত যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আসমানে তুলে নেওয়া হয়েছে এবং তিনি কেয়ামতের পূর্বে পুনরায় আসমান হতে অবতরণ করবেন। উম্মতের প্রত্যেক যুগের মুহাদ্দিস, মুফাসসির, আকিদা শাস্ত্রবিদ মুতাকাল্লিম সবাই এ আকিদা পোষণ করতেন এবং তারা তাদের কিতাবাদিতে এ আকিদার কথা লিখেও গেছেন। প্রত্যেক শতকের মুজাদ্দিদ ও সংস্কারক, যাদের বিশেষ কাজই হল উম্মতের আমলে ও আকিদায় অনুপ্রবেশ করা ভুল-ভ্রান্তি ও গোমরাহীর অপনোদন করা এবং হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য রেখা এঁকে দেওয়া, তাদের সবাই আপন আপন যুগে ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে এ-আকিদাই প্রকাশ করেছেন। এমনকি খোদ মির্যা (তার বক্তব্য অনুসারে) আল্লাহর পক্ষ হতে ‘মাছীলে মাসীহ’ পদে সমাসীন হবার পরও ১০/১২ বছর পর্যন্ত ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে এ আকিদাই পোষণ করতেন এবং এটাকে ইসলামী ও কুরআনী আকিদা বলে বুঝতেন ও বিশ্বাস করতেন। কিন্তু কী থেকে কী হল, হঠাৎ দাবি উঠল, কুরআন মাজীদে নুযূলে মাসীহের আকিদাকে প্রমাণ করা হয়নি, বরং খন্ডন করা হয়েছে। কিন্তু মুসলিম মিল্লাতের কোনো যুগে কোনো প্রজন্মের কেউ-ই তা বুঝতে পারেনি! এমনকি মির্যা সাহেবও তার বয়সের পঞ্চাশ বছর (১৮৯১ সন) পর্যন্ত তা বুঝতে সক্ষম হননি!
অথচ ঐতিহাসিক বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদি কুররআন মাজীদের পুরো ত্রিশ পারায় কোথাও এ আকিদার খন্ডনে একটি শব্দও থাকতো, তাহলেও আকিদাটিকে যুগযুগের মুসলিম উম্মাহ এভাবে গ্রহণ করতো না। এই মোটা দাগের সহজ-সরল কথাটা কে না বুঝবে? অশিক্ষিত মানুষ হোক আর শিক্ষিত মানুষ, এই সোজাসাপটা ইনসাফের কথা বুঝে নিতে কার বিলম্ব হবে?
সুতরাং কাদিয়ানী লেখক ও তার্কিকরা যে সমস্ত আয়াতের ব্যাপারে এ দাবি করবে যে, এতে নুযূলে মাসীহের আকিদা খন্ডন করা হয়েছে, উপরোক্ত স্বতঃসিদ্ধ মূল্যায়নের আলোকে আপনি নিশ্চিন্তে বলে দিতে পারেন, এটা তাদের কূটতর্ক ও প্রগলভতা ছাড়া কিছুই নয়। কুরআন হল হেদায়েতের কিতাব। তার (হেদায়েত সম্পর্কিত) ভাষা ও বর্ণনা একদম সুস্পষ্ট। এটি নাযিল হয়েছে (তরজমা) ‘এমন আরবি ভাষায়, যা বিষয়বস্ত্তকে সুষ্পষ্ট করে দেয়। -সূরা শুআরা ২৬ : ১৯৫
সুতরাং নুযূলে মাসীহের মতো এমন একটি মৌলিক বিষয়ের খন্ডন কুরআন মাজীদে থাকবে আর কুরআনের পঠন-পাঠন ও অধ্যয়নে জীবন উৎসর্গকারী উম্মতের লাখো মুহাদ্দিস-মুফাসসির ১৪ শ’ বছরেও তা টের পাবেন না, মির্যা সাহেবও নিজের বয়সের পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত অসচেতন থাকবেন এটা কীভাবে সম্ভব!
কিন্তু আশ্চর্য, কাদিয়ানী লেখক ও তার্কিকেরা এই স্থূল অযৌক্তিক দাবি নিয়েই ‘সিনা জুরি’ করে বেড়ায়। আকল-বুদ্ধি খুইয়ে না বসলে কি আর কারো পক্ষে এমন উদ্ভট দাবি করা সম্ভব! আসল ব্যাপার হল, কাদিয়ানীদের উক্ত দাবি কুরআন মাজীদের উপর মারাত্মক অপবাদ আরোপের শামিল। কেননা প্রকারান্তরে এ দাবির অর্থ দাঁড়ায়, কুরআন এমন জটিল ভাষায় অবতীর্ণ, লাখো লাখো আরবী ভাষাভাষী প্রাজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ চৌদ্দশত বছর আমৃত্যু পরিশ্রম করেও তার মৌলিক মর্মগুলিই উদ্ধার করতে সক্ষম হননি! ফলে যেনতেন সমস্যা নয়, একেবারে সমস্ত উম্মতে মুহাম্মদী ‘মহা শিরকে’ নিমজ্জিত হয়ে আছে!
চিন্তা করুন পাঠক! কত বড় অপবাদ এটা! কুরআন মাজীদের উপর কত বড় অপঘাত! কাদিয়ানী, তার অনুসারী লেখক ও তার্কিকদের কুরআন মাজীদের খেদমত করার এই হল নমুনা!
যদি ধরেও নেওয়া হয় কুরআন মাজীদে ‘হায়াতে মাসীহ’ ও ‘নুযূলে মাসীহ’ এর সমর্থনে কোনো আয়াত নেই, তবে এতে তো কোনো দ্বিমত নেই যে, খৃস্টানদের অন্যান্য আকিদা (যেমন ঈসা মাসীহের ঈশ্বরত্ব, সন্তানত্ব ইত্যাদি) কুরআনে রদ করা হয়েছে, কিন্তু নুযূলে মাসীহের আকিদাকে (সমর্থন না করলেও) রদ করা হয়নি। অথচ এই আকিদাটিও খৃস্টানদের অত্যন্ত মৌলিক আকিদা (এবং রদকৃত আকিদাগুলির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত)। তো এখানে রদ না করাটাই এ-কথার স্পষ্ট প্রমাণ যে, খৃস্টানদের নুযূলে মাসীহ সম্পর্কিত এই আকিদা গলত নয়। অন্য আরও কিছূ আকিদার মতো এটিও সঠিক আকিদা। কারণ এস্থলে রদ না করাটাই সমর্থন ও সত্যায়নের দলিল। বিচার-বিবেচনা ও আইন-বিজ্ঞানের স্বীকৃত নীতি হলো-
السكوت في معرض البيان بيان
অর্থাৎ যেখানে যা বলা প্রয়োজন, সেখানে তা না বলে চুপ করে দেখে যাওয়া ঐ কথা বলারই নামান্তর।
প্রমাণ এখানেই শেষ নয়। বাস্তবতা হল, খৃস্টানদের নুযূলে মাসীহের আকিদাকে কুরআন সমর্থন করেছে, যেমন ‘পিতামুক্ত’ অবস্থায় কুমারী মাতার গর্ভে মাসীহের জন্ম লাভের আকিদাকে সমর্থন করেছে এবং মাসীহ কর্তৃক মৃতকে জীবিত করাসহ অন্যান্য অলৌকিক মুজিযা সত্যায়ন করেছে। হাঁ, ঈসা মসীহ প্রথমে একবার শূলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন বলে খৃস্টানদের যে আকিদা রয়েছে, কুরআন মাজীদ আকিদার এই অংশটুকু সম্পূর্ণ রদ করে দিয়েছে। এর মাধ্যমে তাদের ‘কাফফারা’ নামক মহাবিভ্রান্তি ও গোমরাহির মূলোৎপাটন করে দেওয়া হয়েছে। কারণ এই আকিদা তাদের সমস্ত অনাচারের মূল।
কুরআন মাজীদের বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে যিনি একেবারে অজ্ঞ নন, তিনি অবশ্যই জানেন, ঈসা আলাইহিস সালামের ব্যাপারে ইহুদী ও খৃস্টানজাতি ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থানরত। দুই জাতির মাঝে রয়েছে চরম আকিদাগত বৈপরিত্য এবং উভয় জাতি ঈসা আলাইহিস সালামকে নিয়ে মারাত্মক প্রান্তিকতার শিকার।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
ভাষান্তর : মাহমুদ হাসান মাসরুর