সফর ১৪৩৫   ||   ডিসেম্বর ২০১৩

অদ্ভুত সহাবস্থানের নীতিহীন রাজনীতি

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

দেশে এখন নির্বাচনের সময়। সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। সে হিসেবে সময় রয়েছে ২ মাসেরও কম। কিন্তু নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে প্রধান ২টি দল সম্পূর্ণ দুই মেরুতে অবস্থান করছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল একতরফাভাবে সংবিধানে সংশোধনী আনে এবং নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধান থেকে উঠিয়ে দেয়। গরিষ্ঠ জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাশ করিয়ে নেয়া সেই ১৫ তম সংশোধনীই তাদের বড় হাতিয়ার। সংবিধান অনুযায়ী বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই নির্বাচনকালীন সরকার থাকবে-এ দাবি থেকে তারা এক চুলও নড়ছে না। অর্থাৎ গাঁয়ে না মানলেও তারাই মোড়ল। অন্যদিকে প্রধান বিরোধীদলগুলো কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে অনেক আগেই। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি নিয়ে তাদের আন্দোলন এখন তুঙ্গে। হরতাল, হরতাল প্রত্যাখ্যান, জ্বালাও-পোড়াও, হামলা-মামলা, দমন-নির্যাতনে এখন জনজীবন চরমভাবে অতিষ্ঠ। আগামী কয়েকমাসে দেশের অবস্থা কী হবে-কারো কাছেই এর সঠিক জবাব নেই। সাধারণ জনগণ চরম শংকা ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছে।

এখন ডিসেম্বর মাস। এ মাসের ১৬ তারিখ আমাদের বিজয় দিবস। ১৯৭১ এর পর পেরিয়ে গেছে ৪২টি বছর। কিন্তু এখনও এ দেশের জনগণের ভাগ্য নিয়ে বিদেশীরা করুণা করে। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক গ্যাঁড়াকলে আবদ্ধ এ জাতির বন্দিত্ব যেন কোনোক্রমইে শেষ হওয়ার নয়। যে অন্যায়-অবিচার, শোষণ ও জোর করে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীন হলাম সে সব থেকে কি আমরা মুক্তি পেয়েছি? সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানীরা যেমন জনমতকে শ্রদ্ধা করেনি। পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নির্বাচিত করার পরও তাদের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি। ঠিক স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা হেঁটে যাচ্ছেন একই পথে। তারাও কোনো রকম একবার ক্ষমতার মসনদে বসতে পারলে আর তা ছাড়তে রাজি হন না। মানুষ ভোটে অংশগ্রহণ করুক বা না করুক দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে তারা লোক দেখানো নির্বাচন করে নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করেছেন বার বার। এরপর জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি ও দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম করে সকলের কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালু হওয়ায় ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা বনাম ক্ষমতার স্বাদ পুনরায় গ্রহণ করার লড়াইয়ের জাঁতাকল থেকে দেশবাসী রেহাই পেয়েছিল কয়েকটি বছর। কিন্তু এখন আবার সেই পুরোনো জায়গাতেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১৬ কোটি জনতাকে। অর্থাৎ স্বাধীনতার অর্ধশত বার্ষিকীর কাছাকাছি এসেও জাতি নিজ দেশের রাজনীতিবিদদের অলিখিত গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ থেকে গেছে। সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ অথচ সেই জনগণ এর ভাগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর জিঞ্জিরে আবদ্ধ। তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন সে সবকিছুই তারা করে যাবেন জনগণের উপকারার্থে এবং তাদের কল্যাণে। আফসোসের কথা হল, আগে জুলুম-শোষণ করেছে ১৫ শ মাইল দূরের ভিনভাষী সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা এখন করছে স্বদেশী ও স্বভাষী আপনজনেরা। এ আফসোসের কথা তো কারো সাথে ভাগাভাগি করারও সুযোগ নেই। নিজেদের কথা অন্য কোথায় গিয়ে বলবে দেশের জনগণ? ঘরের বিচার তো আর বাইরের লোক দিয়ে করানো যায় না। যদিও ক্ষমতার মসনদে অনন্তকাল পর্যন্ত আসীন থাকা এবং সেই মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার লড়াইয়ে ব্যস্ত নেত্রী নেতাগণ সালিশ মানছেন তাদের ভিনদেশী প্রভুবন্ধুদের। দিল্লী, ওয়াশিংটন এখন তাদের দরবার সালিশ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। ক্ষমতার সাধ যে কত বেশি তা কি আর বলে বোঝাতে হয়।

দুই.

সম্প্রতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং প্রায় ৯ বছরের সাবেক রাষ্ট্রনায়ক জেনারেল (অব.) এইচ এম এরশাদ তাঁর দলের শীর্ষনেতাদের নিয়ে ছুটে গেছেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায়। উদ্দেশ্য ঐ মাদরাসার অধ্যক্ষ ও হেফাজতে ইসলাম-এর আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেবের দোয়া নেওয়া। এরশাদ সাহেব আল্লামা শফীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি ক্ষমতায় গেলে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা বাস্তবায়ন করবেন।

জেনারেল এরশাদের দল জাতীয় পার্টি বিগত ৫ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মহাজোটের অন্যতম অংশিদার। তাঁর ভাই জি এম কাদের মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন পুরো ৫ বছর। এ সময়েরই এক সংকটময় মুহূর্তে আবির্ভূত হয় হেফাজতে ইসলাম। যখন মুষ্ঠিমেয় কিছু অবিশ্বাসী লোকজন এবং তাদের দোসররা কোটি কোটি ঈমানদার নাগরিকের বিশ্বাসে আঘাত হানার দুঃসাহস দেখাতে থাকে। আর তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ও দলীয়ভাবে পরিপূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা ও ছত্রছায়া দিতে থাকে ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠী। এরপর হেফাজতে ইসলাম সামনে আসে আল্লামা শফীর নেতৃত্বে। ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করে তারা। ঢাকায় তাদের নজীরবিহীন বৃহৎ গণসমাবেশে অংশ নেয় দল-মত নির্বিশেষে দেশের লাখো মুসলিম জনতা। প্রশ্ন হল, এরশাদের দল কি তখন জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে মন্ত্রীসভায় হেফাজতের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার প্রস্তাব তুলেছিল? এরপর ৫ ও ৬ মে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যা, নির্যাতন, হামলা-মামলা ও রিমান্ডের সময়ও জাতীয় পার্টি ঐ কর্মকান্ডগুলো যারা সংঘটিত করেছিল তাদের সরকার ও জোটের অংশিদার ছিল আগের মতোই। তারা কি এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে। সরকার থেকে তাদেরকে ইস্তফা দিতেও দেখা যায়নি। মহাজোট থেকে বের হওয়ার (স্বভাবসুলভ) হুংকারও দেননি সাবেক এই জেনারেল সাহেব। সেই এরশাদ সাহেবই এখন দোয়া চাইতে গেলেন এমন এক ব্যক্তিত্বের কাছে, যার এলাকার এমপি এরশাদের দলের শীর্ষ একজন নেতা। আর ঐ ব্যক্তিত্বকেই দীর্ঘদিন থেকে ব্যঙ্গ করে চলেছে ক্ষমতাসীন বড় থেকে ছোট ব্যক্তিবর্গ। এমনকি তাদের কুরআন শরীফ পোড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত করে দেশব্যাপী অপপ্রচার চালাচ্ছে। হাটহাজারী এলাকার সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টি নেতা এখন আল্লামা আহমদ শফীর কাছে দোয়ার/দুআর জন্য গেলেন। এতদিন কি তিনি তাঁর জোটের বড়দের বোঝাতে পারলেন না ঐ ব্যক্তিত্বের মান-মর্যাদার বিষয়টি? ৫ বছরে ইসলামবিরোধী যত অপকর্ম ক্ষমতাসীনদের দ্বারা এবং তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে সংঘটিত হয়েছে ক্ষতাসীন জোটের দ্বিতীয় প্রধান অংশিদার হিসেবে সেগুলোর দায় কি এরশাদ সাহেব এবং তার দল জাতীয় পার্টি এড়িয়ে যেতে পারবে? তাঁরা আল্লামা আহমদ শফীর নিকট দোয়া চাওয়ার আগে কি সে দায়ের জন্য মুসলিম জনতার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন? তাহলে কি দেশবাসীকে মনে করতে হবে যে, এসব দোয়া চাওয়া-চাওয়ি নিছক লোক দেখানো মাত্র। দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের করুণা লাভের জন্যই রাজনীতিবিদরা এমনটি করে থাকেন। অন্যান্য সময় ইসলামী লোকদের ধর্ম ব্যবসায়ী ও ধর্মান্ধ বলে গালমন্দ করলেও নির্বাচন এলে রাজনীতিকরা এসব করে থাকেন সম্ভবত ধর্মপ্রাণ হয়েই!

তিন.

এরশাদ সাহেব যদি বাস্তবেই আল্লামা আহমদ শফীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই তাঁর কাছে দুআর জন্য গিয়ে থাকেন এবং ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের কথা মন থেকেই বলে থাকেন তবে সেটি বাস্তবায়নের এখনই মোক্ষম সময়। কারণ নতুন মন্ত্রীসভায় তাঁর দলের এখন বিশাল অংশিদারিত্ব। সর্বদলীয় (মতান্তরে মহাজোটিয়) মন্ত্রীসভার সদস্য সংখ্যা যদি ৩০ এর মধ্যে থাকে তবে জাতীয় পার্টি হবে এক পঞ্চমাংশ বা তারও বেশির অংশিদার। এর চেয়ে বড় কথা হল জেনারেল এরশাদকে নিন্দুকেরা যাই ভাবুক বা বলুক তিনি কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের দুর্দিনের পরীক্ষিত বন্ধু। ১৯৮৬ সনে যেমনভাবে আওয়ামী লীগ-প্রধান অন্যদের বিরাগভাজন হয়েও তাঁর কাজে এসেছিলেন ঠিক তারই প্রতিদান কড়ায় গন্ডায় শোধ করেছেন জেনারেল এরশাদ। বিশেষত কিছুদিন থেকে তাঁর মহাজোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার এবং নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার হুংকার, এক তরফা নির্বাচনে অংশ নিলে মানুষ বে-ঈমান বলবে এমন কথা বারবার উচ্চারণ আওয়ামী লীগকে কঠিন ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল। এমনি জটিল মুহূর্তে তাঁর দল মহা সমারোহে (৮ জনের মধ্যে ৬ জনই তার) মন্ত্রীসভায় যোগ দেওয়ায় এবং পৃথকভাবে (দৃশ্যত প্রধান বিরোধী দল হয়ে) অংশগ্রহণ করায় শাসক মহল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পেয়েছে। এসব রাজনৈতিক বিজ্ঞজনদের কথা। আমরা এগুলোতে যেতে চাই না। এসব আমাদের বিষয়ও নয়।

আমরা যা বলতে চাই তা হল, এরশাদ সাহেব যে হেফাজত আমীরকে ১৩ দফা বাস্তবায়নের কথা বলে এলেন তা বাস্তবায়নের তো এখনি উপযুক্ত সময়। কারণ মন্ত্রীসভায় এখন তাদের দাপুটে অংশিদারিত্ব। তাঁর দলের যারা মন্ত্রী হয়েছেন তাদের কয়েকজনও হাটহাজারীতে গিয়ে দোয়া চাওয়া ও ১৩ দফা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিতে এরশাদের সঙ্গী ছিলেন। এরশাদ চাইলেই এখন নিজস্ব প্রভাব খাটিয়ে ঐ দফাগুলো বাস্তবায়ন করাতে পারেন। সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান সংসদের মেয়াদ থাকবে। সুতরাং কোনো কিছু সংশোধনের প্রয়োজন হলে তাও করা সম্ভব। যদি জেনারেল এরশাদ ঐ কথাগুলো সদিচ্ছা থেকে বলে থাকেন তবে মন্ত্রীসভার বৈঠকে তাঁর দলের মন্ত্রীগণের প্রথম সুযোগেই এ সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি উঠানো উচিত। এতে শুধু এরশাদই লাভবান হবেন না; বরং বিগত দিনগুলোর কর্মকান্ড দ্বারা আওয়ামী লীগ যে ধর্মপ্রাণ জনতার বিরাগভাজন হয়েছে তাদের অনেকেই হয়ত দলটির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবে।

বর্তমান সরকার নির্বাচন পরিচালনাকারী সরকার। এরা নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না-এমন অজুহাত তোলারও সুযোগ আছে বলে মনে হয় না, কারণ হেফাজতের ১৩ দফা দাবির অনেকগুলোই নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নয়। সেগুলো অন্তত বাস্তবায়ন করে ফেলা সম্ভব। দেখা যাক, সর্বদলীয় মন্ত্রীসভার ২য় বড় অংশিদার (সংসদ সদস্য সংখ্যা বা প্রাপ্ত ভোটের বিচারে সর্ববৃহৎ অংশিদার) জাতীয় পার্টি ও দলটির প্রধান এরশাদ তাঁর প্রতিশ্রুতি নিয়ে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

চার.

এতদিন হেফাজতের পক্ষে কিছু না করলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্বে এরশাদ সাহেবের সদলবলে হেফাজত আমীরের দোয়া নিতে যাওয়া এবং ১৩ দফা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বিষয়টিকে একেবারে ভিন্ন ধরনের কোনো ঘটনা হিসেবে দেখছেন না অভিজ্ঞ মহল। কারণ এদেশের রাজনীতিবিদ ও নেত্রী-নেতাদের এমন কার্যকলাপ দেখে দেশবাসী অভ্যস্ত। ক্ষমতায় থাকাকালে ইসলামপন্থীদের দাবি-দাওয়ার চরম বিরোধিতা করা, তাদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা ও অত্যাচার-নির্যাতনের কোনো সুযোগ যারা হাতছাড়া করেন না, কথায়-কথায় যারা আলেম-উলামাকে হেয় প্রতিপন্ন করেন, যাদের দলীয় লোকেরা তাদেরই নির্দেশে ইমাম-খতীবদেরকে অপদস্ত-অপমান করে, চরম ধর্মবিদ্বেষীদের যারা সর্বপ্রকারের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে, শুধু তাই নয়; বরং উঁচু উঁচু পদেও আসীন করে, তারাই আবার নির্বাচনকে সামনে রেখে অতি ধার্মিক হয়ে ওঠেন। তাদের পোশাক-আশাকে ফুটে উঠে অনেক বেশি ধর্মীয় ভাব। অলি-বুযুর্গদের মাজার যিয়ারতের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেন তারা। মসজিদ-মাদরাসায়, আলেম-উলামা ও দ্বীনদার শ্রেণীর প্রতি তাদেরকে এ সময়ে বেশ সহানুভূতিশীল মনে হতে থাকে। ধর্মপ্রাণ লোকদেরকে দ্বীনী বিষয়ে অনেক প্রতিশ্রুতিও দিয়ে থাকেন তারা। যদিও নির্বাচনের পর এ সকল চিত্র পাল্টে যায়। প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষা তো হয়ই না; বরং অনেক ক্ষেত্রেই ঘটে উল্টোটা। সচেতন নাগরিকগণ এসব দেখে অভ্যস্ত। এজন্যই সরকারের একবারে শেষ বেলায় এসে কওমী মাদরাসার সরকারী স্বীকৃতি নিয়ে শাসকমহলের টোপ তাঁরা গেলেননি এবং একই কারণে তাঁরা বিভ্রান্ত হননি প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকা প্রবাসী তনয় ও তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টার গায়ে ইসলামী লেবাস দেখে। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে ভোটারগণ ততই বেশি রাজনীতিবিদদের ধর্মপ্রীতির নমুনা প্রত্যক্ষ করবেন এবং হিসাব-নিকাশ মেলাবেন ৫ বছর আগের কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন না করার ওয়াদা আর তিন বছরের মাথাতেই সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস ছুঁড়ে ফেলার মাঝে। তাদের চোখের সামনে ভাসবে ২০১৩ সালের শাহবাগ ও মতিঝিল। নেতা-নেত্রীদের অতি ধার্মিক বনে যাওয়া এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিজেদের পক্ষে টানার পুরোনো কৌশল দেখে তাদের কেউ হয়ত হতবাক হবেন। কেউবা আক্ষেপ করবেন তাদেরই দেশের নেতা-নেত্রীগণ কর্তৃক তাদেরকে এতটা বোকা ভাবার জন্য। এমনিভাবে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে সব সময় প্রগতিশীলরা (!) গালমন্দ করলেও ভোটের সময় এদের কদর করতে ভুলেন না তারা। বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে এদের মাধ্যমে আরো কিছু ভোট জোগাড় করা অথবা দ্বীনদার শ্রেণীর লোকদের আনুকূল্য পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে চেষ্টা-তদবীর চলতে থাকে। যেসব রাজনৈতিক আলেমদেরকে তারা নিয়মিত কটাক্ষ করে থাকেন, মামলা-মোকাদ্দমা দিয়ে ও কারাবন্দি করে নির্যাতন করে থাকেন এরাই কিছুদিনের জন্য তাদের কাছে ভিআইপি ও অতি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেন। তাদেরকে সংসদীয় আসন দেওয়া ও মন্ত্রী করার আশ্বাস দেওয়া হয়। রাজনৈতিক আলেমদের অধিকাংশই এসব প্রলোভনে সাড়া দেন না। আবার কখনো কখনো কেউ কেউ পথ হারিয়েও ফেলেন। যে কোনো কারণেই হোক নীতি-আদর্শের বাইরে অনাকাঙ্ক্ষিত কান্ডও ঘটিয়ে ফেলেন কেউ কেউ। ইসলামের সাথে এসব আদর্শহীনতার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও এটি যে এ দেশের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক চরিত্রের দুঃখজনক বাস্তবতা তা তো আর অস্বীকার করা যাবে না।

যাহোক বলছিলাম, আমাদের দেশের বারবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া বড় বড় দলগুলোর নেত্রী-নেতারা নির্বাচন ঘনিয়ে এলে যেমনিভাবে নিজেরা অতি ধার্মিক বনে যান তেমনি ধর্মপ্রাণ লোকজন, ধর্মীয় দলগুলোও তাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠে।

পাঁচ.

বর্তমান সর্বদলীয় মন্ত্রীসভাকে নিন্দুকেরা কত কী না বলছে, তামাশা, নাটক ইত্যাদি শব্দও ব্যবহার করছেন অনেকে। কিন্তু একটু ভিন্ন চোখে প্রত্যক্ষ করলে দেখা যাবে, এটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটি বিরল দৃষ্টান্ত। মান-অভিমান ভুলে, পুরোনো শত্রুতা ঝেড়ে ফেলে, আজীবন লালণ করা (বা প্রচার করা) আদর্শকে পিঠের পিছনে রেখে বিশেষ স্বার্থে একাকার হয়ে যাওয়ার নজীরবিহীন ঘটনাও এটি। না হয় যে সিনিয়র নেতৃদ্বয় ৫ বছর কোনো পাত্তা পেল না সর্বজ্যেষ্ঠ হয়েও, অভিজ্ঞ হয়েও নিজ দলীয় নেতৃত্বের বিরাগভাজন হয়ে যারা পাঁচ পাঁচটি বছর অবজ্ঞার শিকার হয়েছেন তারাই কিনা এখন চরম বিতর্কিত মন্ত্রীসভার নতুন সদস্য।

সর্বদলীয় মন্ত্রীসভা (মতান্তরে মহাজোটিয়)-এ ২টি বাম দলের প্রধান ব্যক্তি পুনঃমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। একজন অবশ্য নিয়োগ পেয়েছেন বছর দুয়েক আগে। সরকারের বড় অজনপ্রিয় সময়ে আরো দু একজনের সাথে তিনি পদগ্রহণের ভাগ্যবরণ করেছেন। আজীবন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি করে সম্পূর্ণ পুঁজিবাদী নীতিতে চলা একটি সরকারের মন্ত্রিত্ব গ্রহণের বিষয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুললে তিনি বলেছেন রাজনীতি তো কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয় যে মন্ত্রিত্ব পেয়েও গ্রহণ করব না-এভাবে তিনি তার রাজনৈতিক মূল আদর্শের বিষয়টি খোলাসা করে বামদের বিষয়ে এখনো ভুল চিন্তায় থাকা লোকদের কাছে অন্তত নিজ অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। ঐ ভদ্রলোক নিজ মন্ত্রণালয় কতটুকু কি চালাতে পেরেছেন সে প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায় যে, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে হতাশ করেননি। কারণ বছরখানেক থেকে সরকারের ধর্মপ্রাণ মানুষকে দমন ও ধর্মদ্রোহীদের লালনের ক্ষেত্রে এই মন্ত্রী সাহেবের কথাবার্তা ও আচার-আচরণ ছিল সম্ভবত সবচেয়ে কঠোর ও অশালীন। দেশ-বিদেশে আলেম-উলামাদের প্রতি কটূক্তি করায় তিনি ছিলেন অন্যদের থেকে এগিয়ে।

অন্যদিকে আরেকটি বাম দলের প্রধান যথাযথ পন্থায় দাওয়াত না পাওয়ায় বছর দুয়েক আগে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও সরকারের দুঃসময়ের বিতর্কিত মন্ত্রীসভায় ঠিকই হলফ নিয়েছেন। অর্থাৎ প্রথমবার গ্রহণ না করলেও আরেকবার সাধার পর তিনি হ্যাঁ বলতে ভুল করেননি। এগুলো খুবই স্বাভাবিক বিষয়। আজীবন গরীব-দুঃখীদের জন্য মার্কসবাদ-লেলিনবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করে আসা এমন বড় ব্যক্তিত্বরা মন্ত্রী হবেন না তো কে হবেন?

আমরা আলোচনা করছিলাম বর্তমান মন্ত্রীসভার আদর্শিক রূপ নিয়ে। এই শেষোক্ত বাম ভদ্রলোক হলফ নেওয়ার দু একদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, হেফাজতের ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশই শেষ হয়ে যাবে। তাই এ কঠিন মুহূর্তে তিনি সরকারের মন্ত্রী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খুব ভালো কথা। কিন্তু তিনি তখন তাঁর মহৎগুণের কথাটি চেপে গেছেন। সেটি হল, চরম আত্মত্যাগ ও শত্রু-মিত্র সহাবস্থানের বিরল দৃষ্টান্তের। জেনারেল এরশাদের সাথে এই ভদ্রলোক এবং পূর্বোক্ত বাম ভদ্রলোকের রাজনৈতিক শত্রুতার বিষয় কারো অজানা নয়। এরশাদের সময়ে সময়ে ধর্মের কথা বলা, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যোগ করায় তারা বেজায় ক্ষেপা থাকেন এবং সুযোগ পেলেই তাকে দু হাত নেন। পাঠকের হয়ত স্মরণ থাকবে শেষোক্ত বাম ভদ্রলোক একবার এরশাদের তরুণ ছাত্র সংগঠনের নেতা অভির কাছে পরাজিত হয়ে যাওয়ার পর এরশাদ সাহেব বলেছিলেন, আসলে বাম রাজনীতিকদের লজ্জা থাকতে নেই। না হয় অভির মতো একটি ছেলের কাছে পরাজিত হওয়ার পরও কীভাবে তারা বড় বড় কথা বলতে পারে।’’ এটি হয়ত এরশাদ সাহেবের বাড়াবাড়ি কথা ছিল। কারণ ছোট কারো কাছে পরাজিত হলেই মুখ বন্ধ করে ফেলতে হবে এমন কথা তো আর রাজনীতির বইয়ে লেখা নেই।

কিন্তু আপনি একে চরম আত্মত্যাগ না বলে আর কী আখ্যা দিবেন যে, সে বাম ভদ্রলোক এখন জাতীয় পার্টির ৬/৭ জন মন্ত্রীর সাথে কেবিনেটে বসছেন। এরশাদের সামনে দাঁড়িয়েই তাঁর একদল লোকজনের সাথে হলফ পাঠ করেছেন। এমনকি এই এরশাদ পুরাতন এরশাদ হলেও হতো। ইনি তো মাত্র একদিন আগে সদলবলে সুদূর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায় গিয়ে হেফাজতে ইসলামের আমীর থেকে দোয়া আনা এবং ১৩ দফা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এরশাদ। এরচেয়ে বড় ত্যাগ তার জন্য আর কী হতে পারে। সুতরাং তর্কের খাতিরে যদি মেনে নেওয়াও হয় যে, জাতীয় পার্টির মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা কখনো মন্ত্রীসভার বৈঠকে হেফাজতের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন তখনও ঐ বাম ভদ্রলোকেরা মাথা ঠান্ডা রেখে ডান দিক ফিরে তাকাবেন ।

যে মাদরাসা-মসজিদ, আলেম-উলামার ব্যাপারে বাম ভদ্রলোকদের চরম এলার্জি সেই মাদরাসা ওয়ালাদেরকেই যখন সরকারের পক্ষ থেকে জোর করে সর্বোচ্চ ডিগ্রির স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা চলছে তখনি তারা পূর্ণাঙ্গ দুজন মন্ত্রী। এটি কি কম কুরবানী? এমন লোকেরাই তো পারেন গরীব-দুঃখীদের জন্য নিজেদেরকে বিসর্জন দিতে, তাঁরাই তো বাম রাজনীতির প্রকৃত হকদার।

ছয়.

সম্মানিত পাঠক! মাফ করবেন। আমার স্বভাববিরোধী লেখা পড়ে আপনাদের কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা চাচ্ছি।

আমি বড়-ছোট কোনো রাজনীতিক বা কোনো দলকে খাটো করতে চাইনি। জীবনে রাজনীতি করা তো দূরে থাক, এটি যে কী জিনিস তা যে কবে বুঝে উঠব তা-ও অজানা। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর যখন মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করছি তখন থেকে দেখে আসা নির্বাচন, রাজনীতি, রাজনীতিকদের চরিত্র ইত্যাদির অভিজ্ঞতা আপনার সাথে ভাগাভাগি করলাম মাত্র। এতে আমরা আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দের চরিত্র সম্পর্কে অবগত হওয়ার সুযোগ পাই। যে সমাজ, যে দেশে আমরা বাস করছি তার ভবিষ্যত নিয়েও কিঞ্চিত ধারণা পাই। এভাবে যেমনি আমাদের ধৈর্যের সীমা বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হবে তেমনি ফিতনার এ যুগে সর্বোচ্চ সতর্ক ও সচেতন থেকে নিজেদের ঈমান-আকীদা রক্ষার প্রতিও মনোযোগ দিতে পারব। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে হেফাজত করুন। ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষা করুন। রাষ্ট্রের কর্তা-কর্ত্রীদের সুমতি দিন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখা ও করার লড়াইয়ে তারা দেশ ও জনগণের কথাও যেন একবার ভেবে দেখেন।

আরেকটি কথা

এ মাসে মূলত লিখতে চেয়েছিলাম আরেকটি বিষয়ে। তা হচ্ছে আমাদের দেশের যে দলটি ধর্মপ্রাণ দেশবাসীর ভোটে বারবার নির্বাচিত হয়ে থাকে, যাদের সাথে একাধিকবার ইসলামী দলগুলোও জোট করেছে-তারা পিছনের দিনগুলোতে ইসলামের জন্য কী কী করেছে এবং ভবিষ্যতেও যে তারা ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমিক জনতার ভোট প্রত্যাশা করে-তা কীভাবে করে। জনগণের কাছে ইসলাম বিষয়ে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করা দরকার কি না? তাদের নির্বাচনী ইশতিহারে কী কী বিষয় ও ইস্যু থাকা দরকার। জাতির কাছে কোন কোন বিষয়ে তাদের পরিষ্কার ওয়াদা করা দরকার এবং ইসলামী দলগুলো তাদের সাথে নির্বাচনী জোটে থাকলে কী কী শর্তে থাকা দরকার। থাকা দরকার কী কী দাবি আদায় করে তারা জোটবদ্ধ হবেন বা থাকবেন। এসব নিয়ে কিছু আলোকপাত করার ইচ্ছা ছিল আজকের লেখায়। কিন্তু সে দলটি যেহেতু এখন পর্যন্ত নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তেই অটল রয়েছে তাই এই মুহূর্তে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক মনে হয়নি। যার কারণে লেখা চলে গেছে ভিন্ন পথে। সুযোগ ও পরিস্থিতি হলে ইনশাআল্লাহ সে বিষয়ে লেখার চেষ্টা করব। ষ

 

 

advertisement