অ প রা হ্ন : উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষীয় পদক্ষেপ
লালখান বাজারের নাম লালহরফে। প্রায় সব গণমাধ্যমে। এ চিত্র ৭ অক্টোবর থেকে পরবর্তী সপ্তাহ খানেকের। এর জের যে আরও কতদিন চলবে- এখনই বলা মুশকিল। কারণ সেটি একটি কওমী মাদরাসা। আর কওমী মাদরাসা নিয়ে পানি ঘোলা করে সুবিধা হাতরানোর একটা অন্ধ সময় এখন চলছে বলে অনেকেই মনে করছেন। ওই মাদরাসার একটি কক্ষে আইপিএস বিস্ফোরণ ও আগুন লেগে যাওয়ার ঘটনায় পুরো দৃষ্টি ও প্রচারণা চলছে একদিকে। যাচাই-অনুসন্ধান ও প্রমাণ ছাড়া ঢালাও অভিযোগ তুলে বলা হচ্ছে, ওই মাদরাসায় বোমা বানানো হচ্ছিল। অপর দিকে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের কথা যেন কেউ শুনতেই চাচ্ছে না। প্রশাসনও না, গণমাধ্যমও না। যেন কোনো মাদরাসায় কোনো আইপিএস বিস্ফোরিত হলেও সেটা বোমা। যেন কোনো মাদরাসায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলেও সেটা জঙ্গিবাদ। মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মাদরাসার কেউ মারা গেলেও তার রক্ষা নেই। ‘অপরাধ’-এর দায় কাটানো যাবে না কোনোভাবেই।
চট্টগ্রামের লালখান বাজারে কি সেরকম কিছুই ঘটে চলেছে? মাদরাসা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী আইপিএস বিস্ফোরণ থেকে কেরোসিনের স্টোভে আগুন ধরে যাওয়ায় মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে। সকাল ১১ টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটার পর সারা দিন পার হয়েছে। কয়েক দফা পুলিশ ও ফায়ার ব্রিগেডের লোকেরা এসেছে। দিনের বেলায় প্রশাসনের কেউ নেতিবাচক কোনো কথা বলেন নি। কিন্তু বামপন্থা প্রভাবিত বেসরকারি কয়েকটি টিভি চ্যানেল ও অনলাইন সংবাদপত্রে ওই অগ্নিকান্ডের ঘটনাকে ‘বোমাবাজির’ ঘটনা হিসেবে তুলে ধরার জন্য উসকানি শুরু হয়। প্রশাসন কেন ‘বোমাবাজির’ অভিযোগে লালখানে বড় পদক্ষেপ নিচ্ছে না-এ জন্য তারা প্রায় কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। সন্ধ্যার পর চট্টগ্রাম পুলিশের বড় এক কর্তা একদল পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন। এরপর একের পর এক তাজা গ্রেনেড, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, এসিডের বোতল উদ্ধার হতে থাকে। পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলেন, যেন সব রেডি করাই ছিল। সারাদিন কিছুই পাওয়া যায়নি। কিন্তু সন্ধ্যার পর ‘উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে’ গ্রেনেড উদ্ধার করে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করতে পুলিশের লোকেরা রীতিমতো বাধ্যই হয়েছে। এরপর এর সঙ্গে সব কওমী মাদরাসা, হেফাজতে ইসলাম আর নাস্তিকবিরোধী আন্দোলনের সমগ্র আবেদনকে একাকার করে বিষোদগার শুরু হয়েছে। এ বিষোদগারে তৃতীয় শ্রেণীর সংবাদপত্র, চতুর্থ শ্রেণীর টিভি চ্যানেল থেকে নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী কেউ পিছিয়ে নেই। যেন বিকৃত উল্লাস ও চাপা প্রতিশোধের গরম কিছু উপাদান হাতে চলে এসেছে। ঘটনার দুদিন পর চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি কওমী মাদরাসায় পুলিশি তল্লাশি চালানোর খবর পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
বাস্তব ঘটনা কী- আমাদের পক্ষে নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব হয়নি। অগ্নিকান্ডের ওই ঘটনায় চিকিৎসারত ও গ্রেফতারকৃত দুই অগ্নিদগ্ধ ছাত্র এরই মধ্যে নিহত হয়েছেন। আল্লাহ তাদের জান্নাতবাসী করুন। প্রশাসনের নির্দেশে লালখান বাজার মাদরাসা বন্ধ করে দেওযা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন ওই মাদরাসার তরুণ শিক্ষক ও প্রিন্সিপালের ছেলে। প্রশাসনের সূত্রে একশ্রেণীর গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, নাশকতার উদ্দেশ্যে সেখানে বোমা তৈরি করা হচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রীর চট্টগ্রাম সফরের আগে ব্যাপক নাশকতার প্রস্ত্ততি নিয়েই এসব করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ উঠানো হচ্ছে। খবর এসেছে গ্রেফতারকৃত মুফতী হারুনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। পুলিশী ‘জিজ্ঞাসাবাদে’ তাকে যা যা স্বীকার করতে হবে- সেটা নিশ্চয়ই গণমাধ্যম ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে প্রকাশ করতে ভুলবে না। কিন্তু আমরা এ পর্যায়ে এ কথাটা বলতে পারি যে, বোমা বানানোর প্রস্ত্ততি কিংবা বিস্ফোরক মজুদের মতো কোনো ঘটনা যদি সেখানে সত্যিই ঘটে থাকে তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে বিচার ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু ঘটনার শুরু থেকে বৈপরিত্বপূর্ণ প্রশাসনিক আচরণ, সরকার দলীয় গুন্ডা-পান্ডাদের তাৎক্ষণিক মিছিল ও হামলাচেষ্টা, অতিপ্রচার এবং বাড়াবাড়ি রকম হৈচৈ থেকে এ ধারণা গড়ে ওঠার মতো যথেষ্ট অবকাশ তৈরি হয়েছে যে, লালখান বাজারের পুরো ঘটনার মধ্যে কোথাও কোথাও যেন ‘সাজানো’ ও ‘বানানো’ কিছু বিষয় রয়েছে। ওই মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন বক্তব্যেও সেই ‘সাজানো-বানানো’ ঘটনার দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। আমরা আমাদের পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
করতে পারি যে, এ সরকারের আমলেই সম্ভবত ২০০৯-এর শেষ দিকে লালখান বাজারের মুফতী হারুনকে পুলিশ একবার গ্রেফতার করেছিল। তখনও আতংকের প্রলেপ দিয়ে গণমাধ্যমে তার খবর প্রচার হয়েছিল। বলা হয়েছিল, কথিত লশকরে তৈয়্যবার সহযোগিতা নিয়ে সে ঢাকার কোনো কোনো দূতাবাসে হামলার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল। কয়েক সপ্তাহ পর পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বলেছিলেন, এর সবই ছিল সাংবাদিকদের প্রচার। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো দায় নেই। পরে মুফতী হারুন আইনের স্বাভাবিক নিয়মে মুক্তি পেয়েছিলেন। এখন তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযোগে এবারও অনেক বোমা-সন্ত্রাস ও বারুদের গন্ধ। হাওয়া বদলে গেলে কিংবা বাতাস ঠান্ডা হলে কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় এবারো কি বলা হবে- এর সবই ছিল সাংবাদিকদের প্রচার। আমরা কিছুই বলিনি।’ যদি তা-ই হয়, তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষীয় নির্দেশে এসব পুলিশি খেলা আগেই বন্ধ হওয়া উচিত। কেউ কেউ বলেছেন, যে কোনো সরকারের শেষ সময়ে এ ধরণের খেলার একটা লÿণ দেখা যায়। এটা শেষ অপরাহ্নের খেলা। এ খেলা যারা শুরু করে সাধারণত শেষ করতে পারে না। সূর্য আগেই ডুবে যায়। শেষ হোক বা না হোক, আমরা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে কোনো রকম ক্ষমতার খেলার পক্ষে যেতে পারি না।