মুতালাআয় চাই পূর্ণ সচেতনতা
অধ্যয়নের প্রতিটি স্তরেই মেধা ও বুদ্ধির ব্যবহার জরুরি। মুতালাআর প্রথম স্তর-কিতাব নির্বাচন থেকেই এর প্রয়োজন; বরং এর জন্য অভিজ্ঞতাহীন বুদ্ধিও যথেষ্ট নয়। কোনো অভিজ্ঞ ও দক্ষ বিবেকবানের পরামর্শ নেওয়ারও প্রয়োজন পড়ে। বিশেষ করে দ্বীনীয়াত অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সমঝদার আলেমের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
তালিবে ইলমদের খেদমতে যে কথাটি পেশ করতে চাই তা হল, তারা যেন ‘জাগ্রত’ অবস্থায় কিতাব মুতালাআ করেন। মনোযোগহীন মুতালাআ হয়তো পুরোপুরি নিষ্ফল হয় কিংবা এর ফল হয় যৎসামান্য।
মুতালাআর ক্ষেত্রে জাগ্রত অবস্থার অনেকগুলো স্তর আছে। যথা :
১. প্রথম স্তর তো হল, কিতাব বুঝে বুঝে পড়া। কঠিন ও জটিল স্থানগুলো সমাধান ও হল করে পড়া।
বিচক্ষণ অধ্যয়নের এটিও একটি অংশ যে, তালিবে ইলম কোনো লেখক-প্রকাশকের ভুলের শিকার না হওয়া। সঠিক বিষয়টি বের করে করে অন্তত ভুলকে সঠিক মনে করা থেকে বিরত থাকে।
আরেকটি স্তর হল, কৌতুহলী মনোভাব নিয়ে পড়া। অস্পষ্ট স্থানগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ খুঁজে খুঁজে পড়া। এটা জরুরি নয় যে, সকল অস্পষ্ট বিষয় প্রথম দিনেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে কৌতুহলী স্বভাব না হলে তালিবে ইলমী জীবনের অনেকগুলো বছর কেটে গেলেও অস্পষ্ট বিষয়গুলো অস্পষ্টই থেকে যাবে। যেমন ধরুন, আপনি প্রথমবারের মতো ‘বিসরীয়িন’ ও ‘কুফীয়িন’ পরিভাষাটি পড়লেন। এখন এর মিসদাক কারা তা খোঁজ করুন। উভয় দলের কমপক্ষে চার-পাঁচ জন ইমামের নাম জেনে নিন। তাঁদের মৃত্যুসন খুঁজে বের করুন। অনুসন্ধানের একপর্যায়ে জামালুদ্দীন কিফতীর ‘ইনবাউর রুওয়াত ফী আখবারিন নুহাত’ ও জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ.-এর ‘বুগইয়াতুল ওআত ফী আখবারিল লুগাবিয়্যীন ওয়ান নুহাত’-এর নামও জানতে পারবেন। কোনো আলেম বা মুসান্নিফের নাম এলে কিংবা কোনো কিতাবের হাওয়ালা/উদ্ধৃতি এলে খোঁজ করা দরকার যে, এই বুযুর্গ কে, তিনি কোন যুগের মানুষ? আর তার জীবনী কোথায় পাওয়া যাবে? কিতাব হলে তার পূর্ণ নাম কী? মুসান্নিফের নাম ও সময়কাল এবং কিতাবটি প্রকাশিত হয়েছে নাকি মাখতূত (হস্তলিখিত পান্ডুলিপি) আকারে অপ্রকাশিত রয়েছে ইত্যাদি বিষয়গুলোও জানতে হবে। যেমন, কোথাও ‘নিফাতাওয়াইহ’ নাম এল। জানতে হবে এর সঠিক উচ্চারণ কী, তিনি কোন যুগের? সিবওয়াইর আগের, নাকি পরের? অথবা ইবনুল আছীরের নাম এল যে, তিনি তার তারীখে এমন লিখেছেন। তাহলে জানতে হবে তারীখ বিষয়ে তার লিখিত কিতাবের নাম কী? জানা গেল কিতাবের নাম ‘আলকামিল ফিততারীখ’। এখন জানার বিষয় হল, এই কিতাবটির নির্ভরযোগ্যতা কতটুকু? এরপর জানতে হবে ‘জামিউল উসূল’-এর লেখক ইবনুল আছীর আর ‘আলমাছালুস সাইর’-এর লেখক ইবনুল আছীর একই ব্যক্তি নাকি দুজন আলাদা? খোঁজ করে জানা গেল, বড় ভাই মাজদুদ্দীন ইবনুল আছীর (৬০৬ হিজরী) ‘‘জামিউল উসূল’’ ও ‘‘আননিহায়া’’-এর লেখক। ইযযুদ্দীন ইবনুল আছীর (৬৩০ হিজরী) ‘‘আলকামিল’’ ও ‘‘আললুবাব’’-এর লেখক। আর নাসরুল্লাহ ইবনুল আছীর হলেন ‘‘আলমাছালুস সাইর’’-এর লেখক।
কোথাও আলমুহীত-এর উদ্ধৃতি এল। ফিকহের কোনো কিতাব কিংবা ফিকহী কোনো মাসআলায় এই উদ্ধৃতি পাওয়া গেলে তা হয়তো ‘‘আলমুহীতুল বুরহানী’’ হবে নতুবা ‘‘মুহীতুস সারাখসী’’। তাজরীদ-এর উদ্ধৃতি এলে দেখতে হবে তা তাজরীদুল কুদূরী, নাকি আততাজরীদুর রুকনী? কোথাও আলইমদাদ-এর উদ্ধৃতি পাওয়া গেলে জানতে হবে, এটি কি ইমদাদুল ফাত্তাহ, না অন্য কোনো কিতাব? কোথাও ফয়য-এর উদ্ধৃতি এলে জানতে হবে তা কি ফয়যুল বারী, না ফয়যুল মাওলাল কারীম? যদি ফয়যুল বারী হয় তাহলে জানতে হবে তা শাহ ছাহেবের ফয়যুল বারী, নাকি সহীহ বুখারীর ফার্সী শরাহ ফয়যুল বারী?
এই নিবন্ধটি কেউ মনোযোগের সাথে পড়লে উল্লেখিত উদাহরণসমূহে যে বিষয়গুলো অস্পষ্ট রাখা হয়েছে সে সম্পর্কে তার কৌতুহল জাগতে থাকবে এবং তার মনে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক হতে থাকবে। এই প্রশ্নগুলো আলাদা খাতায় টুকে রাখতে হবে যেন সময়-সুযোগ মতো সমাধান বের করা সম্ভব হয়।
এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, এসব বিষয়ে অপারগতার ক্ষেত্রে নিজের উস্তাযের কাছ থেকে সহযোগিতা নেওয়ার অবকাশ আছে, কিন্তু তাদের কাছে সরাসরি জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়। বরং নিজেই তা খুঁজে বের করবে। অপারগ হলে এতটুকু জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে যে, এ বিষয়টি আমি কোথায় খুঁজতে পারি?
আপনার মাদরাসার কুতুবখানায় যদি ‘কাশফুয যুনূন আন আসামিল কুতুবি ওয়াল ফুনূন’, ‘ইযাহুল মাকনূন ফিয যাইলি আলা কাশফিয যুনূন’, ‘হাদিয়্যাতুল আরেফীন ফী আসমাইল মুআল্লিফীন’ (কিতাব তিনটি একসঙ্গে ছয় খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে), ‘‘মুজামুল মুআল্লিফীন’’, ওমর রেযা কুহহালাহ, ‘‘আল’আলাম’’, খায়রুদ্দীন যিরিকলী, ‘‘তাতিম্মাতুল আ’লাম’’, ‘‘আলই‘লাম বিনাকদি আওহামিল আ’লাম’’, ‘‘আলমুসতাদরাক আলা মু‘জামিল মুআল্লিফীন’’ ইত্যাদি এ বিষয়ের কিছু কিতাব থাকে তাহলে তো আপনি ঘরে বসেই এসবের উত্তর নিজেই খুঁজে নিতে পারেন। অনেক অস্পষ্টতাই এখানে দূর হয়ে যাবে।
কৌতুহলী মুতালাআর একটি অংশ এটাও যে, কিতাবে কোনো হাদীস হাওয়ালা ও হুকুম ছাড়া উল্লেখিত হলে তার হাওয়ালা খুঁজে বের করা ও সনদগত অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করা। মাদরাসার কুতুবখানায় যদি এর তাহকীক ও গবেষণার উপায়-উপকরণ বিদ্যমান না থাকে তবে তা খাতায় লিখে রাখুন। যেন সুযোগ পেলেই তাহকীক করতে পারেন।
মোটকথা, মনে যদি কৌতুহল না থাকে তবে সকল বিষয় অস্পষ্টই থেকে যাবে।
মুতালাআর ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার আরেকটি স্তর হল, তালিবে ইলমের এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা যে, কিতাবের কোনো কথা আগের জানা বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক কি না। অথবা এই কিতাবেরই কোনো বয়ান বা এই মুসান্নিফের অন্য কিতাবের কোনো বয়ানের সাথে কিংবা অন্য মুসান্নিফের কোনো বয়ানের সাথে সাংঘর্ষিক হচ্ছে কি না? যদি সাংঘর্ষিক হয় তবে কি নিজের বুঝের দুর্বলতা বা ত্রুটির কারণে হয়েছে, না বাস্তবেই দুটোর মধ্যে বিরোধ আছে? বাস্তবেই যদি বিরোধ থাকে তাহলে দেখতে হবে কোনটি সঠিক বা সঠিক হওয়ার অধিক নিকটবর্তী নাকি দুটোই নিজ নিজ স্থানে ঠিক?
আর সকল অবস্থায় এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কোনো কথা ‘মুসাল্লাম’ (সর্বজনস্বীকৃত), ‘ইজমা’ (সর্বসম্মত) কিংবা ‘বাদীহি’ (সুস্পষ্ট ও সর্বজনবিদিত) বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক কি না? এমন সন্দেহ সৃষ্টি হলে তাৎক্ষণিকভাবে নিজ উস্তাযের শরণাপন্ন হয়ে সন্দেহ নিরসন করা উচিত। আর বাস্তবেই যদি অধ্যয়নাধীন কিতাবে ত্রুটি থাকে তবে তা চিহ্নিত করে রাখা উচিত।
বিচক্ষণতার আরেকটি দিক এই যে, লেখক যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন ইস্তিফাদা শুধু ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ না রাখা; বরং কথার প্রাসঙ্গিকতায় বিক্ষিপ্ত বিভিন্ন ফায়েদাও অর্জন করার চেষ্টা করা। যেমন আমি নূরুল ইযাহর ছাত্র। আমার উস্তায আমাকে মারাকিল ফালাহ ও তার হাশিয়া (হাশিয়াতুত তহতাবী আলালমারাকী) মুতালাআ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কুতুবে ফিকহ ও এর মুসান্নিফীন সম্পর্কে আমার জানা নেই। কে আগের আর কে পরের তাও আমি জানি না। এখন হাশিয়াতুত তহতাবীর এক জায়গায় পেয়েছি-
في البحر عن البزازية : ... .
তাহলে আমাকে লক্ষ্য রাখতে হবে, সামনে কোথাও দুই কিতাবের মুসান্নিফের নামও উদ্ধৃতিতে উল্লেখ হয়েছে কি না? নতুবা পৃথকভাবে তা জানার নিয়ত রাখব আর ধীরে ধীরে ইনশাআল্লাহ তা জানা হয়ে যাবে। আমি যদি চোখ-কান খোলা রেখে মুতালাআর অভ্যাস গড়ে তুলি তাহলে শুধু এই ইবারত থেকে আমি এ কথা সহজেই জানতে পারব যে, ‘আলবাযযাযিয়া’ কিতাবটি ‘আলবাহর’-এর আগে লিখিত। এখানে তহতাবী আমাকে বলেননি যে, বাহর পরের কিতাব। কিন্তু তার হাওয়ালার আন্দায (বর্ণনাভঙ্গি) থেকে বিষয়টি সহজেই জানা যায়। আর আমি যদি চোখ বন্ধ করে মুতালাআ করি তাহলে এই বিষয়টি না জেনেই সামনে অগ্রসর হতে থাকব।
তিনি যদি এভাবে হাওয়ালা দিতেন-
وفي البحر والبزازية : ... .
তাহলে আমি বিষয়টি জানতে পারতাম না।
অথবা কোথাও উল্লেখ হল-
وفي حاشية الدرر للمؤلف
এ থেকে এই বিষয়টি জানব যে, শুরুনবুলালী রাহ. দুরার-এর উপরও একটি হাশিয়া লিখেছেন। এরপর যখন অন্য জায়গায় দেখব-
ونقل المصنف في حاشية الدر عن الزيلعي
তখন জানব যে, যায়লায়ী রাহ. মুসান্নিফের (শুরুনবুলালী) আগের যুগের মানুষ। বাকি থাকল এই কথা যে, যায়লায়ী কে? এবং সুনির্দিষ্টভাবে তিনি কোন যুগের মানুষ? তাহলে তা আমার খাতায় অন্যান্য সমাধানযোগ্য বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। সামনে অগ্রসর হওয়ার আগে এই হাওয়ালার বিষয়ে আমার মাথায় এ প্রশ্ন জাগ্রত হওয়াও জরুরি যে, আমি তো সামনে-পিছনে কয়েক জায়গায় حاشية الدرر للمصنف শব্দটি দেখেছি। তাহলে এই ‘হাশিয়াতুদ্দুর’ কোন কিতাব? তবে কি তিনি আদ্দুর কিতাবেরও হাশিয়া লিখেছেন, না এটি মুদ্রণপ্রমাদ। যার সঠিক শব্দ হবে ‘হাশিয়াতুদ্দুরার’? তাহকীকের পর জানা যাবে যে, এটি আসলেই মুদ্রণপ্রমাদ। আদ্দুর অর্থাৎ আদ্দুররুল মুখতার তো হল আলাউদ্দীন হাছকাফী (১০৮৮ হিজরী)-এর কিতাব, যিনি শুরুনবুলালী রাহ.-এর পরের। তিনি এই কিতাবের হাশিয়া কীভাবে লিখবেন?
উদ্দেশ্য হল, কিতাবের বর্ণনাভঙ্গি ও তাতে উত্থাপিত বিষয়গুলো একটু গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে মাকসূদে কালাম ছাড়াও আরো অনেক মালূমাত অর্জন করা যায়। কোনো বিচক্ষণ তালিবে ইলম এ সকল মালূমাত না জেনে সামনে অগ্রসর হতেই পারে না।
বিচক্ষণতার সাথে মুতালাআ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিচক্ষণতার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, প্রধান প্রকারসমূহ ও উপকারিতা এবং মনোযোগহীন মুতালাআর অপকারিতা এক দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। আজকের এই অবসরে সংক্ষেপে এ কয়েকটি কথাই পেশ করলাম।
আল্লাহ তাআলা উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী রাহ. (১৩৩৩-১৪২০ হি.)-এর প্রতি দয়া করুন। তাঁর নিকট যখন বলা হত, হযরত! আলহামদুলিল্লাহ, অমুক কিতাবের মুতালাআ শেষ হয়েছে তখন কখনো তিনি মুবারকবাদ দিতেন, দুআ দিতেন। কখনোবা সতর্কতার জন্য প্রশ্ন করতেন-
پڑها يا ہضم بهى كيا؟
শুধু পড়েছই, নাকি হজমও করেছ? আর বাস্তবেও হজম হওয়া ছাড়া খাদ্যের উপকারিতা পাওয়া যায় না। অধ্যয়নের বিষয়টিও তেমন। অধীত বিষয় ফলপ্রসূ তখনই হয় যখন তা ভালোভাবে হজম হয়। সম্ভব নয়। হযরতের এ শিরোনাম থেকে এই শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, যে জিনিস হজমযোগ্য নয় কিংবা আমার পক্ষে যা হজম করা সম্ভব নয় তা আমার পড়া উচিত নয়।
শায়খ আবদুল ফাত্তাহ রাহ.-এর একটি বিষয় আরজ করি। শায়খের সাধারণ নিয়ম এই ছিল যে, অধ্যয়নের সময় খুব লক্ষ্য রাখতেন, এমন কোনো তথ্য-ফায়েদা তো চলে যাচ্ছে না, যা আমার অমুক কিতাব বা অমুক প্রবন্ধে যোগ হতে পারে বা অমুক তাহকীকযোগ্য বিষয়ে বা অমুক রচনাযোগ্য কিতাবে কাজে আসবে। সাথে সাথে তা নোট করে নির্ধারিত স্থানে রেখে দিতেন। এটিও অন্বেষী-অধ্যয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ রোকন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العلمين
২৯ যিলকদ ১৪৩৪ হিজরী