মুহাররম ১৪৩৫   ||   নভেম্বর ২০১৩

এক গরীব গভর্ণর

আবু সাঈদ মুজীব

প্রতিটি জাতি কেমন হবে, কেমন চলবে তা নির্ভর করে শাসকশ্রেণীর কর্মকান্ডের উপর। শাসকশ্রেণীর প্রতিটি সদস্যের মাঝে যদি থাকে আদল-ইনসাফ, তাকওয়া-খোদাভীরুতা, নির্মোহতা ও প্রজা বাৎসল্য তাহলে পুরো জাতি এই গুণে গুণান্বিত  হবে। এই বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হবে।

ইতিহাস সাক্ষী, কোনো ধর্ম বা মতবাদ ইসলামের চেয়ে বেশী গুণাবলিসমৃদ্ধ শাসকশ্রেণী উপহার দিতে পারেনি।

ওমর রা. হলেন সেই ইসলামী সাম্রাজ্যের এক মহান খলিফা। তাঁর খেলাফতকালের অসংখ্যা ঘটনা রয়েছে, যার প্রতিটিই প্রমাণ বহন করে সফল শাসনের, সৎ শাসকের। জুমার খুৎবায় একজন সাধারণ নাগরিক খলিফাকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছে; আপনি খুৎবা প্রদানের আগে বলে নিন আমরা একটি করে চাদর পেয়েছি, আর আপনার শরীরে দুইটা কেন? খলিফাও কোনো প্রকার তিরস্কার হুমকি ধমকি ছাড়া জবাব দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন একজন বাদশাকে জনসম্মুখে এভাবে প্রশ্ন করা সম্ভব হয়েছে শুধু খোদাভীতি ও আখেরাতের জবাবদিহিতার মানসিকতার কারণে।

হযরত ওমর রা.-এর খেলাফতকালের ঘটনা। তিনি সাঈদ ইবনে আমের রা.-কে হিমসের গভর্ণর বানিয়ে পাঠালেন। কিছুদিন পর হিমসবাসীদের এক প্রতিনিধিদল খলিফা ওমর রা.-এর সাথে দেখা করতে এলে তিনি বললেন, আমাকে তোমাদের দরিদ্র মুসলমানদের একটা তালিকা দাও, বাইতুল মাল থেকে কিছু মুদ্রা (টাকা-পয়সা) দিব। তাদের  দেয়া তালিকায় সাঈদ ইবনে আমের রা.-এর নাম দেখে খলিফা চমকে উঠলেন। ইনি কি গভর্ণর সাঈদ ইবনে আমের? তারা সমস্বরে বললেন, জ্বি, হ্যাঁ...। ওমর রা. তাঁর জন্য এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার একটি থলে দিয়ে বললেন, এটা সাঈদ ইবনে আমেরের ব্যক্তিগত খরচের। সাঈদ ইবনে আমের রা. থলেটি হাতে পেয়ে বললেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।   তার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল, খলিফা মৃত্যুবরণ করেছেন নাকি? তিনি প্রতি উত্তরে বললেন, আখিরাত ধ্বংস করার জন্য দুনিয়া আমার কাছে এগিয়ে এসেছে। তুমি এগুলো দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দাও।

কিছুদিন পর ওমর রা. হিমসবাসীদের খবরাখবর নেওয়ার জন্য এলেন। সবাইকে একত্রিত করে জানতে চাইলেন, গভর্ণরকে নিয়ে তোমাদের কোন অভিযোগ আছে কি? উত্তরে তারা বললেন, আমাদের তিনটি অভিযোগ আছে। এক. দৈনিক সকালে আমাদের কাছে উপস্থিত হন দেরি করে। দুই. রাতে কখনো আমাদের আরজি শোনেন না। তিন. সপ্তাহে এক দিন আমাদের মাঝে আসেন না। ওমর রা. সাঈদ ইবনে আমের রা.-এর কাছে এসব অভিযোগের জবাব চাইলে তিনি বললেন, ১. ‘‘আমার বাসায় কোন কাজের লোক নেই। বাসার সকল সদস্যের খাবার তৈরিতে স্ত্রীকে আমার সহযোগিতা করতে হয়। তাই সকাল বেলা আটা পেষা, খামিরা তৈরি করা, রুটি বেলা এবং রুটি সেঁকার প্রতিটি কাজে আমাকে অংশ গ্রহণ করতে হয়। ফলে বের হতে দেরি হয়ে যায়।’’  ২. ‘‘আমি আমার দিবসকে নির্ধারণ করেছি মানবসেবার নিমিত্তে। আর রাত্রকে নির্ধারণ করেছি আল্লাহর ইবাদতে।’’ ৩.‘‘গায়ের পোশাক ছাড়া আমার আর কোন পোশাক নেই। সপ্তাহে একদিন এটি ধুয়ে শুকাতে হয়। অতপর গায়ে দেই আর  এতেই আমার একটা দিন ব্যয় হয়ে যায়।

ফলে সেদিন আর জনসম্মুখে আসা সম্ভব হয় না।

পোশাক নেই, গৃহকর্মী নেই, অতিরিক্ত ভাতা দেওয়া হলে তিনি তা গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। নিজেই যে মহা গরীব তা কি তাঁর জানা নেই?

গভর্ণর হয়েও প্রতিদিন তাকে পাকঘরে সময় দিতে হয়। এ-ও গভর্ণর! আর বর্তমান সময়ের জনগণের অর্থ আত্মসাৎকারী বিলাসী মন্ত্রী-আমলারাও প্রশাসক।

 

 

advertisement