কাদিয়ানী সম্প্রদায় কেন মুসলমান নয়-৪
ঈসা আলাইহিস সালামের অবতরণ প্রসঙ্গ
সাংবাদিক ফারাক্লীত সাহেব তার নিবন্ধে ‘নুযূলে মাসীহ’ সম্পর্কেও কিছু নতুন কথা বলেছেন।
এক. নুযূলে মাসীহ তথা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন ও অবতরণের আকিদা খতমে নবুওতের আকিদা পরিপন্থী। কেননা, তিনি যদি শেষ যামানায় আগমন করেন, তাহলে তো তিনিই হবেন শেষ নবী, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহলে শেষ নবী হন কিভাবে?
দুই. নুযূলে মাসীহের আকিদা কুরআনের কোথাও নেই। বরং কুরআনে নবীজীকে খাতামুন নাবিয়্যীন বলে নুযূলে মাসীহের আকীদাকেই রদ করে দিয়েছে।
তিন.হাদীসের বিদ্যমান কিতাবসমূহের মাঝে ইমাম মালেক (মৃত্যু: ১৭৯ হি.) এর কিতাব ‘মোয়াত্তা’ সর্বপ্রথম লিখিত। এতে নুযূলে মাসীহ সম্পর্কে কোনো হাদীস নেই। সুতরাং শেষ যামানায় নুযূলে মাসীহ হবে বলে যে সমস্ত হাদীস বিভিন্ন কিতাবে এসেছে, মুহাদ্দিসগণকে ধোকা দিয়ে খৃস্টানরা সেগুলি হাদীসের কিতাবে ‘পুশ’ করে দিয়েছে।
উল্লেখিত প্রশ্নগুলির বিস্তারিত জবাব দেয়া এখানে উদ্দেশ্য নয়। শুধু নুযূলে মাসীহ সম্পর্কে জরুরি কিছু কথা বলেই ইনশাআল্লাহ আলোচনা শেষ করব।
১. নুযূলে মাসীহের আকিদাকে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’-এর আকিদার পরিপন্থী সে-ই মনে করতে পারে, যে আরবী ভাষা ও তার শব্দ-মর্ম সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ। আরবী ভাষা অনুযায়ী ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ এবং ‘আখিরুন নাবিয়্যীন’ তাঁকে বলা হয়, যিনি (দুনিয়াতে) সবার শেষে নবুওত লাভ করেছেন। যাঁর পর নতুন করে আর কাউকে নবুওত দান করা হবে না। সুতরাং নিঃসন্দেহে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই খাতামুন্নাবিয়্যীন। কারণ তাঁকেই সবশেষে নবুওত দান করা হয়েছে এবং নবুওত দানের সিলসিলা তার উপরই সমাপ্ত হয়েছে। আর ঈসা আলাইহিস সালাম যেহেতু নবুওত লাভ করেছেন নবীজীর জন্মেরও প্রায় পাঁচশত বৎসর পূর্বে, তাই তাঁর পুনরাগমন ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’-এর পরিপন্থী নয়। তিনি আল্লাহ পাকের হুকুমে জীবিত আছেন এবং পুনরায় দ্বীনে মুহাম্মাদীর অনুসারী হয়ে(যেমনটা হাদীস থেকে জানা যায়) দুনিয়াতে আগমন করবেন। তাঁর এ আগমন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শেষ নবী হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক নয়।
তাফসীরের কিতাবসমূহেও ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ শব্দের এই অর্থ স্পষ্টভাবে লেখা আছে। অর্থাৎ নবীজীর পরে কাউকে আর নবী বানানো হবে না।
তাফসীরে কাশশাফ,মাদারিকুত তানযীল, রূহুল মাআনী ইত্যাদিতে সূরা আহযাবের ৪০ নং আয়াতের তাফসীর দেখলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।
২. নুযূলে মাসীহের আলোচনা কুরআনে নেই। তাই এ আকিদা গলত!
কেমন কথা এটা! সাংবাদিক সাহেবের কথিত সুধীজনেরা ইসলাম সম্পর্কে এতটাই অজ্ঞ যে, তারা জানেই না, দ্বীনের অনেক মৌলিক বিষয় শুধু হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এবং কুরআনে না থাকাটা ঐ সকল বিধানের মৌলিকত্ব ও অকাট্যতার জন্য কোনোই বাধা নয়। যেমন ইসলামে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ। একথা কে না জানে! ঈমানের পর এটা ইসলামের দ্বিতীয় রোকন। অথচ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের কথা কুরআনে কোথাও স্পষ্টভাবে নেই! কখন কোন নামায কত রাকাত কয়টি সিজদা ইত্যাদির কিছুই তো নেই কুরআন মাজীদে। তেমনি কোন হিসাবে যাকাত আদায় করতে হবে তাও নেই কুরআনে। এই সকল বিষয় হাদীস, ইজমা এবং উম্মতের কর্মগত তাওয়াতুর দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। এসকল বিষয়কেও কি কুরআনে নেই বলে অস্বীকার করে দেয়া যাবে?
অথচ বাস্তবতা হল, কুরআন মাজীদের একাধিক আয়াত দ্বারা নুযূলে মাসীহ প্রমাণিত। সে সম্পর্কে এখানে এই মুহূর্তে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। শুধু এটুকু আরজ করবো, যারা আরবী বোঝেন, তারা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ.-এর ‘আকীদাতুল ইসলাম’ নামক কিতাবখানি অধ্যয়ন করুন। আর যারা উর্দূ বোঝেন তারা মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম শিয়ালকোটীর ‘শাহাদাতুল কুরআন’ পড়ুন। এই দুটি কিতাবে নুযূলে মাসীহ সম্পর্কে কুরআন মাজীদের দলিল নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। আর এই আকিদা বহু হাদীস দ্বারা তাওয়াতুরের সঙ্গে প্রমাণিত। এর উপর রয়েছে উম্মতের ইজমা। (এ সম্পর্কে সামনে বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ)
৩. নুযূলে মাসীহ সম্পর্কে সবচে’ প্রাচীন হাদীসের কিতাব মোয়াত্তায় কোনো হাদীস নেই। অতএব সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীসের কিতাবে এ সম্পর্কে যত হাদীসই আসুক, সবই অগ্রহণযোগ্য! কারণ হাদীসগুলো যদি সহীহ হতো তাহলে ইমাম মালেকের নিকটও পৌঁছতো আর তাহলে তিনি তাঁর কিতাবে সেসমস্ত হাদীস উল্লেখও করতেন!
হাদীস সম্পর্কে সাংবাদিক সাহেব এবং তার কথিত গুণীজনদের অজ্ঞতার উপর আক্ষেপ না করে উপায় নেই! তারা মোয়াত্তা কিতাবটির ধরন সম্পর্কেই অনবগত। তারা ভেবেছেন, ইমাম মালেকের নিকট যত হাদীস পৌঁছেছে, সবই মোয়াত্তায় এসে গেছে, আর যা পৌঁছেনি বা তাঁর নিকট সহীহ বলে প্রমাণিত হয়নি, তাই কেবল মোয়াত্তা থেকে বাদ পড়েছে! সুতরাং যে হাদীস মোয়াত্তাতে নেই, সেটাই অগ্রহণযোগ্য!
হাদীস শাস্ত্র তো অনেক দূরের কথা, যারা মোয়াত্তার মতো বহুল প্রচলিত হাদীসের কিতাব এবং তার ধরন প্রকৃতি ও আঙ্গিক সম্পর্কে এতটা বেখবর, তারা যে কেন এ সকল দ্বীনি আলোচনায় মত প্রকাশের দুঃসাহস করেন, তা আমাদের বুঝে আসে না। মোয়াত্তা কিতাবখানি যিনি পাঠ করেছেন, তিনিই বুঝতে পারবেন এটি ফিকহের কিতাবের মত শুধু কর্মগত বিধান সম্পর্কিত হাদীস এবং সাহাবা ও তাবেয়ীগণের ফতোয়াসমূহের একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন। আদব-আখলাক সম্পর্কেও তাতে কিছু হাদীস রয়েছে। এর ভিতর ঈমান ও আকাইদ শীর্ষক কোনো অধ্যায়ই নেই। তাহলে এই কথা কীভাবে চলতে পারে যে, ইমাম মালেকের সমস্ত হাদীস তাঁর মোয়াত্তাতে এসে গেছে? এ তো ইমাম মালেকের ইলমী মাকাম সম্পর্কে নিতান্ত অজ্ঞতার দলিল। কারণ কেয়ামত-আখেরাত সম্পর্কে যেসমস্ত হাদীস তাওয়াতুরের সঙ্গে প্রজন্ম পরম্পরায় বহু সনদে আমাদের নিকট পৌঁছেছে, সেগুলো যদিও মোয়াত্তায় আসেনি, তবু একথা বলা সম্ভব নয় যে, ইমাম মালেক এ সমস্ত হাদীস জানতেনই না বা এগুলিকে তিনি সহীহ মনে করতেন না! যারা এমন উল্টো মূল্যায়ন করে অভ্যস্ত, তারা আসলে হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ।
মোয়াত্তা হল ফিকহের কিতাবের মতো সংক্ষিপ্ত বিষয়স্ত্তর কিতাব। আকাইদ অধ্যায় এর বিষয়বস্ত্ততেই পড়ে না। সুতরাং মোয়াত্তাতে নেই বলে নুযূলে মাসীহ সম্পর্কিত হাদীসের সমস্ত ভান্ডারকে অগ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত করা মূর্খতা। আমরা এ সম্পর্কে সামনে কোথাও বিসত্মারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কে সাংবাদিক সাহেব এবং তার সহগামী সূধীবর্গের জ্ঞানগরিমার একটা উদাহরণ দিয়ে এ প্রসঙ্গের ইতি টানছি। তিনি লিখেছেন,
‘‘ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি হাদীসকে রদ করে কুরআনের ঘোষণা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, বুখারীর হাদীসে যে সমস্ত বর্ণনাকারী রয়েছেন, তাদের কাউকে অসত্যবাদী আখ্যায়িত করার দ্বারা যদি আল্লাহর মহান নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তাই করা উচিৎ!’’
এ বক্তব্য থেকে বুঝে আসে, ঐ সূধীবর্গের মতে ইমাম আবু হানিফা হলেন ইমাম বুখারীর পরের কোনো ব্যক্তি, যিনি সহীহ বুখারীর কোনো এক হাদীসের একজন বর্ণনাকারীকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করতে চাচ্ছেন। অথচ বাস্তবতা হল, ইমাম আবু হানিফা ইমাম বুখারীর জন্মের প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বে ইন্তিকাল করে গেছেন। কারণ ইমাম আবু হানিফার মৃত্যু ১৫০হিজরীতে। আর ইমাম বুখারীর জন্মই হয়েছে ১৯৪ হিজরীতে!
আমরা খুবই দুঃখিত এবং বিস্মিত যে, সাংবাদিক ফারাক্লীত দ্বীনী বিষয়ে এ সমস্ত লোকের পরামর্শ প্রচারের উপযুক্ত ভাবলেন! এদেরকে কীভাবে ‘বিজ্ঞজন’ উপাধিতে ভূষিত করলেন! আমাদের মতে সাংবাদিক সাহেব নিজের উপর বড় বেশি অবিচার করে ফেলেছেন। আল্লাহ তাঁকে রহম করুন। এই কাজের ক্ষতি কাটিয়ে উঠার তাওফিক দান করুন। আমীন।
নুযূলে মাসীহের আলোচনা কাদিয়ানীদের প্রসঙ্গ পরিবর্তনের কৌশলমাত্র
সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন, মুসলিম জাতি ও কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মাঝে মূল বিরোধ হল খতমে নবুওতের মাসআলা নিয়ে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত (এবং কেয়ামত পর্যন্ত) সকল মুসলমানের পরম আকিদা ও বিশ্বাস হল, নবীজীর মাধ্যমে নবুওতের সিলসিলা সমাপ্ত হয়েছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ পাকের সর্বশেষ নবী ও রাসূল। সুতরাং তাঁর পর যে ব্যক্তি নবুওত দাবী করে আর যে সেই দাবী অনুসরণ করে তারা উভয়ে ইসলামের গন্ডি থেকে খারেজ ও মুরতাদ। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর শাসনকাল থেকে আজ পর্যন্ত সকল ইসলামী রাষ্ট্রের ধারাবাহিক কর্মপন্থাও তাই। এটা উম্মতে মুসলিমার সর্ববাদীসম্মত ইজমাঈ আকিদা।
যেহেতু মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী নবুওত দাবী করেছে এবং নিজেকে পূর্ববর্তী নবীগণের মতোই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্র নবী বলে প্রচার করেছে, আর তার নবুওত অস্বীকারকারীকে নবীজীসহ অন্যান্য নবীগণকে অস্বীকারকারীর মতই কাফের আখ্যায়িত করেছে, তাই মুসলমানরাও মির্যা ও তার অনুসারীদেরকে ইসলামের গন্ডিবহির্ভূত বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।
আর মির্যা সাহেবের বইপুস্তক যারা গভীর ও বিস্তৃতভাবে পড়েছেন, তাদের বক্তব্য হল, মির্যার মতো ব্যক্তি কিছুতেই নবী হওয়ার উপযুক্ত নয়। নবুওতের ধারা সমাপ্ত না হলেও তার মতো ব্যক্তিকে আল্লাহ নবী বানিয়ে পাঠাতেন না। কারণ চালচলন ও স্বভাব-চরিত্রের বিচারে এ লোক নিতান্তই নিম্ন শ্রেণির। তার লেখা বইপুস্তকই বড় প্রমাণ, একান্ত দ্বীনী ও ধর্মীয় বিষয়ে নির্জলা মিথ্যাচার করতেও তার বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা নেই। মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণী হাঁকাতেও তার কোনো দ্বিধা নেই। এক সময় তিনি কিছু ভবিষ্যদ্বাণীকে নিজের সত্য-মিথ্যার মানদন্ড বানিয়ে বাজারে ছেড়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা তার সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা করে তার মিথ্যাচার ও ধোকাবাজি দুনিয়াবাসীর সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
একটি ভবিষ্যদ্বাণী তার নিকটাত্মীয় আহমদী বেগমের বিবাহ সম্পর্কিত ছিল। যখন আহমদী বেগমের পরিবার তাকে মির্যার সঙ্গে বিবাহ না দিয়ে সুলতান মুহাম্মাদ নামক জনৈক ব্যক্তির বিবাহে দিয়ে দিলেন, তখন মির্যা সাহেব নির্দিষ্ট দিনের ভিতরে আহমদী বেগমের স্বামীর মৃত্যু হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে বসলেন । আর আল্লাহ পাক মির্যার ভবিষ্যদ্বাণীর বিপরীত ঘটনা ঘটিয়ে তাকে এমন লাঞ্ছিত ও অপদস্ত করলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে ধর্মীয় নেতৃত্বের দ্বিতীয় কোনো উমেদার এত লাঞ্ছিত-অপদস্ত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। (কিন্তু তার অপকর্ম তবু থামেনি!)
যাইহোক, এক দিকে মুসলমানদের খতমে নবুওতের অটল বিশ্বাস, অন্য দিকে কাদিয়ানীদের খতমে নবুওত অস্বীকারের ব্যর্থ চেষ্টা। আমরা বলি, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী ও রাসূল, তাঁর পর কেয়ামত পর্যন্ত নতুন কোনো নবী-রাসূল নেই। বিপরীতে কাদিয়ানীরা মির্যা গোলাম আহমদকে নবী মেনে তাকে অনুসরণ করে। তার আনুগত্যের মাঝেই মুক্তি বলে বিশ্বাস করে। তাকে অস্বীকারকারী সারা দুনিয়ার মুসলমানকে কাফের মনে করে। তাদের পিছনে নামায পড়া এবং তাদের জানাযায় অংশগ্রহণ করাকে নাজায়েয বলে প্রচার করে। -এই হল মুসলমানদের সঙ্গে কাদিয়ানীদের মূল বিরোধ ও এখতেলাফ। এ বিষয়গুলো বোঝা এবং এর মাঝে কোন পক্ষ হক আর কোন পক্ষ বাতিল তা নির্ণয় করা একদম সহজ ব্যাপার। এটা বুঝার জন্য বিশেষ প্রজ্ঞা, তীক্ষ্ণ মেধা কিংবা অসাধারণ প্রতিভার দরকার নেই। এই মাসআলায় কাদিয়ানীদের ঘাপলা ধরার জন্য সাধারণ আকল-বুদ্ধিই যথেষ্ঠ। তাই সাধারণ মুসলমানদের চোখে ধূলা দিতে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। একটি কৌশল হল, তারা খতমে নবুওতের মতো মৌলিক এবং সর্বজনবোধ্য মাসআলা থেকে সর্বসাধারণের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য এবং সেই মাসআলার পাকড়াও থেকে আত্মরক্ষার জন্য হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জীবন, উর্ধ্বগমন এবং পুনরাগমনের অপেক্ষাকৃত জটিল মাসআলাটির অবতারণা করে থাকে। এটা তাদের পুরানো চাল। তারা এই চাল খাটিয়ে বড় একটা ফায়দা লুটে নেয়ার চেষ্টা করে। কুরআন হাদীসের সরাসরি ইলম যাদের নেই, তারা এই মাসআলাটির বিষয়ে আলেমগণ এবং কাদিয়ানীদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও প্রচারপুস্তিকা থেকে এই প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করে যে, এটা বোধয় কাদিয়ানী এবং মুসলমানদের মধ্যকার একটি শাস্ত্রীয় ও দালিলিক মতবিরোধ। উভয় তরফ থেকেই যার উপর কুরআন-হাদীসের দলিল দেয়া সম্ভব। পার্থক্য এটুকু যে, একপক্ষ কুরআনের আয়াত, নবীজীর হাদীস এবং পূর্ববর্তীদের বক্তব্য থেকে একটা অর্থ বুঝেছেন, অন্যপক্ষ আরেকটা বুঝেছেন। সুতরাং কাদিয়ানী এবং মুসলমানদের মধ্যকার বিরোধ তেমন জটিল কিছু নয়। এটাই কাদিয়ানীদের আসল চাওয়া! হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রসঙ্গ তুলে নিজেদের আসল চেহারা আবৃত করার ফন্দি!
হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জীবন ও পুনরাগমনের বিষয়টি অলৌকিকত্ব ও মুজিযা নির্ভর। আমাদের কালে পশ্চিমাদের রাজনৈতিক এবং বস্ত্ততান্ত্রিক অগ্রসরতা, বিশেষত এই উপমহাদেশে দুই শ’ বছরের ইংরেজ শাসন ও তাদের প্রতিষ্ঠিত চলমান শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রভাবে এই মানসিকতার বিস্তার ঘটেছে যে, ‘যা কিছু আমাদের আকল-বুদ্ধির বাইরে বা উর্ধ্বে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।’ এই এক ‘সূত্র’ জ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার অসংখ্য দাবীদারকে সৃষ্টিকর্তা অস্বীকারের পর্যায়ে নামিয়ে ছেড়েছে। আল্লাহর অস্তিত্বের যুক্তিও নাকি তাদের স্থূল মস্তিষ্কে ধরে না! পশ্চিমা ভাবধারায় প্রভাবিত বিরাট একটা মুসলিম-শ্রেণি একই কারণে জিন ও ফিরিশতার অস্তিত্ব এবং মুজিযাসমূহের সত্যতা মানতে নারাজ কিংবা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে সেগুলোকে সাধারণ কার্যকারণনির্ভর ঘটনারূপে তুলে ধরতে সচেষ্ট। এদের পরাধীন মস্তিষ্কও ফেরেশতা, জিন ও মুজিযা ইত্যাদির অলৌকিক বাস্তবতা বুঝতে অক্ষম। এজন্য এসবের উপর তারা বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা আরোপ না করে থাকতে পারে না।
তো হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আসমানে উত্তোলন, তাঁর অতি প্রলম্বিত দীর্ঘ জীবন এবং শেষ যামানায় ভূপৃষ্ঠে পুনরাগমন ইত্যাদি হল অলৌকিক ব্যাপার। সুতরাং ঈসা আলাইহিস সালামের এ সমস্ত অলৌকিকত্বকে অস্বীকার করতে পারলে পশ্চিমা ভাবধারায় প্রভাবিতদেরকেও নিজেদের জালে আটকানো সহজ হবে- এই চিন্তা থেকেও কাদিয়ানীরা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের অলৌকিকত্ব অস্বীকারের মাসআলাটি তুলে থাকতে পারে। আর ঐ সমস্ত লোক, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং কুরআন-হাদীস থেকে হেদায়াত ও পথনির্দেশনা লাভের পরিবর্তে ইউরোপীয় মুলহিদ- বেদ্বীনদের থেকে কর্ম ও বিশ্বাসের ‘সূত্র’ গ্রহণে অভ্যস্ত, এবং একেই যারা বিজ্ঞানমনস্কতা ও প্রগতিশীলতা বলে মনে করে, তারাও কাদিয়ানীদের সহজ শিকারে পরিণত হন।
কাদিয়ানীরা যেহেতু এই মাসআলাটিকে নিজেদের আত্মরক্ষার এবং পশ্চিমা চিন্তাধারায় আক্রান্তদেরকে আকৃষ্ট করার কৌশল হিসেবে নিয়েছে তাই এ শ্রেণীর পাঠকের উপযোগী করে কিছু কথা সামনে তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ। যাদের অন্তরে গোমরাহীর মোহর অঙ্কিত হয়ে যায়নি আশা করি তাদের স্বস্তির জন্য এটুকু আলোচনাই যথেষ্ট হবে।
প্রথমে কয়েকটি মৌলিক কথা আরজ করা মোনাসেব মনে করছি।
১. হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম প্রসঙ্গে আলোচনা-কালে মনে রাখতে হবে, আমরা যাঁর সম্পর্কে ভাবছি, তাঁর অস্তিত্বব লাভ হয়েছে আল্লাহ তা‘আলার সাধারণ রীতি এবং প্রাকৃতিক নিয়ম থেকে অনেকটা ভিন্ন ও বিরলভাবে। কুরআন মাজীদের বর্ণনা (বর্তমান ইঞ্জীল এবং সকল মুসলমান ও খৃস্টানের বিশ্বাস অনুযায়ীও) হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম ঐভাবে হয়নি। যেভাবে সাধারণ মানুষের জন্ম হয় অর্থাৎ মানুষ নারী ও পুরুষের মিলনের দ্বারা, সমস্ত নবী-রাসূল এমন কি আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও যে নিয়মে জন্ম লাভ করেছেন, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম সেভাবে হয়নি। বরং আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ কুদরতে, কোনো পুরুষের স্পর্শ ছাড়াই হযরত মারইয়াম সিদ্দীকার গর্ভে তিনি জন্ম লাভ করেন। সূরা আলে ইমরান ৩:৩৫-৩৬ এবং সূরা মারইয়ামের ১৯:১৯-২৩ ইত্যাদিতে তাঁর অলৌকিক জন্মবৃত্তান্ত এসেছে। কাদিয়ানীদেরকেও হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের অলৌকিক এই জন্মবৃত্তান্ত অস্বীকার করতে শোনা যায় না!
দ্বিতীয় অলৌকিক বিষয় হল, যখন তিনি আল্লাহর হুকুমে কুমারী মারইয়ামের গর্ভ থেকে দুনিয়াতে আগমন করলেন এবং মাতা মারইয়াম তাঁকে কোলে নিয়ে লোকালয়ে এলেন, আর লোকেরা হযরত মারইয়ামের সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলল এবং তাঁর উপর আপবাদ আরোপ করতে লাগল, তখন নবজাতক হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের মুখ ফুটে গেল এবং তিনি তাঁর মাতার পবিত্রতার সাক্ষ্য দিলেন, নিজের নবুওতের ঘোষণাও দিলেন! -সূরা মারইয়াম ১৯: ২৯-৩০
এমনিভাবে কুরআন মাজীদে এসেছে, আল্লাহ পাকের হুকুমে তাঁর হাতে অনেক বিস্ময়কর মুজিযা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মাটির দলা পাখির মতো বানিয়ে ফুঁ দিতেন আর তা জীবন্ত পাখি হয়ে উড়ে যেতো। জন্মান্ধের চোখে হাত বুলিয়ে দিতেন আর সে দৃষ্টিশক্তি লাভ করত। কুষ্ঠ রোগীর গায়ে হাত বুলালে তৎক্ষণাৎ সে ভালো হয়ে যেতো। এমনকি আল্লাহর কুদরতে তিনি মৃতকে জীবিত করে দেখাতে পারতেন।
কুরআন মাজীদের সূরা আলেইমরান ও সূরা মারইয়ামে এ সকল মুজিযার বিবরণ রয়েছে। যারা কুরআন মাজীদ পড়েন এবং বুঝেন, তারা বলতে পারবেন-আল্লাহ তা‘আলা অন্য কোনো নবীর ক্ষেত্রে এজাতীয় মুজিযার উল্লেখ করেননি।
মোটকথা, কুরআন মাজীদ এবং মানবেতিহাসও সাক্ষী, মানুষের এই পৃথিবীতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের অস্তিত্ব একেবারে বিরল এবং তার জন্মলাভ আল্লাহ পাকের কুদরতের বড় নিদর্শন। সুতরাং এ ব্যক্তি সম্পর্কেই যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বলেন, তাঁর শত্রু ইহুদীরা তাঁকে হত্যা করার জন্য বা শূলিতে চড়ানোর জন্য যে ষড়যন্ত্র করেছিলো, আল্লাহ পাক আপন কুদরতে তা নস্যাৎ করে দিয়েছেন এবং তাঁকে নিরাপদে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন।
وما قتلوه يقينا بل رفعه الله اليله
অর্থাৎ নিশ্চিত যে, তারা তাঁকে হত্যা করতে পারেনি। বরং আল্লাহ তাঁকে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। -সূরা নিসা ৪ : ১৫৭-১৫৮)
এমনিভাবে তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন আরও বলেন, তিনি কিয়ামতের পূর্বে পুনরাগমন করবেন এবং স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করবেন, তখন আহলে কিতাব তথা ইহুদী খৃস্টানগণ (কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী) তাঁর প্রতি ঈমান আনবে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাধ্যমে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বীন ও শরীয়তের কাজ নেবেন আর তাঁর আগমন হবে কেয়ামতের বিশেষ একটি আলামত
انه لعلم للساعة فلا تمترون بها
অর্থাৎ নিশ্চয়ই তিনি কেয়ামতের একটি নিদর্শন। সুতরাং তোমরা তাঁর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করো না।-সূরা যুখরুফ ৪৩:৬১
وان من اهل الكتاب الا ليؤمنن به قبل متوته
অর্থাৎ কিতাবীদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে তাঁর (ঈসার) মৃত্যুর আগে
তাঁর প্রতি ঈমান আনবে না। -সূরা নিসা ৪ : ১৫৯
কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী তাঁর অলৌকিক জন্ম ও মুজিযাসমূহ যখন স্বীকার করা হয়, তখন তাঁর এই উর্ধ্বগমন এবং পুনরাগমনের বিষয়টির উপর ঈমান আনার মাঝে সংশয়ের কী থাকতে পারে! (তাঁর জন্মের সংবাদ যে কুরআন দিয়েছে, তার উর্ধ্বে উত্তোলন এবং পুনরাগমনের সংবাদও তো সেই কুরআনই দিয়েছে। তাহলে এক সংবাদ স্বীকার করা আর অন্য সংবাদ অস্বীকার করার কী কারণ হতে পারে!)
মোটকথা ঈসা আলাইহিস সালামের অলৌকিক এবং বিরল জন্মবৃত্তান্ত যদি সামনে রাখা হয় তাহলে তার দীর্ঘ হায়াত এবং পুনরাগমনের বিষয়ে শয়তান কিংবা কাদিয়ানীরা যে সংশয় সৃষ্টির পাঁয়তারা করে থাকে, তা মনেই আসার কথা নয়।
২. এই মাসআলার উপর আলোচনার সময় এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, ঈসা আলাইহিস সালামের সেই অবতরণ (যার সম্পর্কে কুরআন মাজীদে সংক্ষেপে এবং মুতাওয়াতির হাদীসে বিস্তারিতভাবে এসেছে তা) হবে কেয়ামতের একেবারে নিকটবর্তী সময়ে। আর তখন কেয়ামত একদম নিকটবর্তী হওয়ার অন্যান্য আলামত (যেমন ঈসা আলাইহিস সালাম থাকতেই দাজ্জালের আবির্ভাব ইত্যাদিও) দেখা দেবে। বলা যায়, সে সময়টাতে কেয়ামতের সূচনাই হয়ে যাবে। পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মগুলো উল্টে যেতে শুরু করবে। এমন সব বিপর্যয় ও অত্যাশ্চর্যজনক ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকবে, যা এখন কল্পনা করাও অসম্ভব।
সুতরাং ঈসা আলাইহিস সালামের অবতরণ এবং দাজ্জালের আবির্ভাব সম্পর্কে হাদীস শরীফে যে বিবরণ এসেছে, সেটা কারো অক্ষম বুদ্ধিতে না এলেও তা অস্বীকার করে বসার কোনো কারণ নেই। এমন হলে তো কেয়ামত, আখেরাত, জান্নাত-জাহান্নাম সবই বুদ্ধির অগম্য বলে অস্বীকার করে দিতে হবে!
যারা এধরনের ছুঁতোয় দ্বীনের বিভিন্ন অকাট্য বিষয় অস্বীকার করতে দ্বিধা করে না, তারা আসলে আল্লাহ পাকের অসীম কুদরত ও তাঁর সামান্য মারেফত থেকেও বেখবর। নিতান্ত সীমাবদ্ধ কিছু অভিজ্ঞতা, বস্ত্ত পূজার অসম্পূর্ণ কিছু সূত্র এবং নিজেদের অক্ষম বুদ্ধিকে তারা আল্লাহ তা‘আলার ওহী এবং নবীগণের সংবাদ থেকেও অধিক বিশ্বাসযোগ্য ধরে নিয়েছে এবং এর নাম দিয়েছে বিজ্ঞানমনস্কতা ও প্রগতিশীলতা! একজন গ্রাম্য ব্যক্তি যদি নিজের বোধ-বুদ্ধিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভেবে আধুনিক পৃথিবীর বিস্ময়কর কোনো আবিষ্কার অস্বীকার করে, তাহলে যে কান্ড হবে এটাও তো তেমনি! এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ঈমান পরিপন্থীই নয়, সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিরও পরিপন্থী।
৩. ঈসা আলাইহিস সালামের হায়াতের উপর কাদিয়ানীরা যে সকল অমূলক প্রশ্ন তুলে থাকে এবং যে সমস্ত প্রশ্ন করে আধুনিক শিক্ষিত যুবমানসকে সংশয়ে ফেলে দেয়, তার একটি হল, ঈসা আলাইহিস সালামের পর আজ পর্যন্ত দুই হাজার বছরের অধিক কাল অতিবাহিত হয়ে গেছে। কোনো মানুষের পক্ষে এত কাল জীবিত থাকা কি সম্ভব? যদি আসমানের উপর জীবিতই থাকেন তাহলে তাঁর খাওয়া-দাওয়া অজু-
ইস্তেঞ্জাই বা কীভাবে চলছে!
এজাতীয় অবান্তর ও মূর্খোচিত প্রশ্ন এমন কারো মনে জাগতে পারে না, যার দিলে আল্লাহর কুদরত এবং নবীজীর রিসালাতের উপর ঈমান রয়েছে। (কারণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ঈসা আলাইহিস সালামের আসমানে উত্তোলন এবং ধরাধামে পুনরাগমনের সংবাদ দিয়েছেন। কিন্তু যেহেতু এজাতীয় কুমন্ত্রণা দিয়ে কাদিয়ানীরা নিয়মিত মানুষ শিকার করছে, দ্বীনের বিষয়ে অজ্ঞ লোকদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই অস্ত্র প্রয়োগ করে চলেছে, তাই এ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু কথা আরজ করা উচিত হবে বলে মনে করছি।
কোনো মানুষ শ’ দুইশ’ বছরের বেশী বাঁচতে পারে না মনে করা মূর্খতা। কারণ, কুরআন মাজীদেই হযরত নূহ আলাইহিস সালামের প্রায় হাজার বছর হায়াত লাভের কথা এসেছে
فلبث فيهم الف سنة الا خمسين عاما
অর্থাৎ তিনি তাদের মাঝে অবস্থান করেছেন পঞ্চাশ কম হাজার বছর। -সূরা আনকাবূত ২৯:১৪)। তাহলে যে আল্লাহ এই পৃথিবীতে নূহকে হাজার বছর বাঁচাতে পারলেন, নিঃসন্দেহে তিনি চাইলে কাউকে দু’চার হাজার বা তারও বেশী হায়াতও দিতে পারবেন। এতে আশ্চর্যের কী আছে! বিজ্ঞানের কোন সূত্র এর বিপরীত যাবে! তাছাড়া হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে তো আল্লাহ তা‘আলা আমাদের এই বস্ত্তজগতে রাখেননি, বরং আসমানের জগতে নিয়ে গেছেন। সেখানকার ব্যবস্থা আর এই পৃথিবীর ব্যবস্থা এক তা কে বলল?
কাদিয়ানীরা ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর উপর তোহমত দিয়ে থাকে যে, তিনিও ঈসা আলাইহিস সালামের হায়াত ও নুযূলে বিশ্বাস করেন না। অথচ ইবনে তাইমিয়া রহ. হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আসমানে বেঁচে থাকা এবং খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের প্রসঙ্গে বলেন-
ليست حاله كحالة أهل الأرض في الأكل والشرب واللباس والنوم والغائط والبول ونحو ذلك.
অর্থাৎ খাওয়া-পরা, আহার-নিদ্রা এবং পেশাব-পায়খানার ক্ষেত্রে আসমানী জগত আর দুনিয়ার জগতের অবস্থা এক নয়। -আল জাওয়াবুস সহীহ লিমান বাদ্দালা দ্বীনাল মাসীহ ৪/২৮৫
আল্লাহ পাকের তো বরং এই কুদরতও আছে যে, ইহজগতেও তিনি চাইলে কাউকে পানাহার থেকে অমুখাপেক্ষী করে দিতে পারেন। কুরআন মাজীদেই তো আসহাবে কাহফের ঘটনা বর্ণিত আছে। তারা তিনশ’ বছর গুহার মাঝে পানাহার ছাড়াই বেঁচে ছিলেন।
ولبثوا فى الكهف ثلاثمائة سنين وازدادوا تسعا.
অর্থাৎ তারা তাদের গুহার ভিতরে তিনশ’ এবং তারও বেশী নয় বছর অবস্থান করলেন।-সূরা কাহাফ ১৮:২৫)
শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী (মৃত্যু ৯৭৩ হি.) এমন প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেন, ‘পানাহার তাদের জন্য জরুরি যারা এ জগতে বাস করে। কারণ এখানে আবহাওয়ার প্রভাবে শরীরের কোষসমূহ ক্ষয় হতে থাকে। আর খাদ্য তার অভাব পূরণ করে এবং তদ্বস্থলে নতুন কোষ তৈরি করে। আমাদের এ জগতে সকল প্রাণীর জীবনধারণের জন্য আল্লাহ তা‘আলা এই নিয়ম ঠিক করে দিয়েছেন। কিন্তু যাকে আল্লাহ আসমানে তুলে নিয়েছেন, তাকে তিনি খাদ্য-পানীয় থেকে ফেরেশতাদের মত অমুখাপেক্ষী করে দেন, বরং আলস্নাহর হামদ ও তাসবীহ ইত্যাদি তাদের খাদ্যের কাজ দেয় (এবং এর মাধ্যমে তাদের জীবন ও জীবনী শক্তি বহাল থাকে।)।’
আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী এক বুযুর্গের ঘটনা লিখেছেন, যিনি দীর্ঘ ২৩ বছর কোনো খাদ্য গ্রহণ করেননি। কিন্তু রাত দিন ক্লান্তিহীনভাবে আল্লাহ পাকের ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। (যেন আল্লাহর ইবাদতই ছিল তাঁর খাদ্য। আর এটা ছিল ঐ বুযুর্গের বিশেষ কারামত।) সুতরাং আশ্চর্যের কিছু নেই যে, আসমানে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের গিযা হল তাসবীহ ও তাহলীল।-আল ইওয়াকীত ওয়াল জাওয়াহির ২/১৪৬
আমরা এখানে ইবনে তাইমিয়া এবং আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানীর বক্তব্য বিশেষভাবে নকল করেছি। কারণ মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এবং তার অনুসারীদের কাছেও এ দুই ব্যক্তিত্বের ইলমী যোগ্যতা স্বীকৃত। তাঁরা দু’জন বিষয়টিকে যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন তাতে সুস্থ বিচার-বুদ্ধির অধিকারী কারো কোনো সংশয় থাকার কথা নয়।
ভাষান্তর : মাহমুদ হাসান মাসরুর