একই দিনে ঈদের বিষয় দায়িত্বশীলদের উপর ছাড়ুন-- ৪
মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ প্রসঙ্গে আরো কিছু কথা
আলহামদুলিল্লাহ এ বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। তবে ইলমুল ফিকহের প্রাথমিক স্তরের তালিবে ইলম ভাইদের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, আমরা শুনেছি, ‘মুতূন’ শিরোনামে ফিকহের যে মুখতাসার কিতাবসমূহ আছে তা ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’-এর মাসাইলের জন্য সংকলিত। এ শ্রেণির একটি গুরুত্বপূর্ণ মতন ‘কানযুদ দাকাইক’, যা দরসে নেযামীর এক বিশেষ কিতাব। তাতে আছে-
لا عبرة لاختلاف المطالع
(উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়।)
এ থেকে তো বোঝা যায়, এটি ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’র মাসআলা। এ তালিবানে ইলমের খিদমতে আরজ এই যে, প্রথমত, এ কথা সঠিক নয় যে, ‘মুতূন’শ্রেণির গ্রন্থসমূহে উল্লেখিত সকল মাসআলা ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’-এর। এ সকল কিতাবে অনেক মাসআলা ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’-এর বাইরেরও আছে। দ্বিতীয় কথা এই যে, ‘মুতূন’-এর প্রাচীন গ্রন্থসমূহ, যা সালাফের মাঝে ‘মুতালাক্কা বিল কবূল’ (ব্যাপকভাবে সমাদৃত) ছিল তাতে এ মাসআলা নেই। মুখতাসারুত তহাবী, মুখতাসারুল হাকিমিশ শহীদ, মুখতাসারুল কারখী, মুখতাসারুল কুদূরী, তুহফাতুল ফুকাহা, বিদায়াতুল মুবতাদী-এ সব তো মুতূন-শ্রেণির কিতাব। এসব কিতাবে আমাদের জানা মতে এ মাসআলা নেই।
মুতাআখখিরীনের নিকটে প্রসিদ্ধ ‘মুতূন’-গ্রন্থাবলির অন্যতম হচ্ছে ‘আলবিকায়া’। এতে এ মাসআলা নেই। মাওসিলীর ‘আলমুখতার’ কিতাবে যদিওবা খানিয়ার অনুসরণে এ মাসআলা লেখা হয়েছে, কিন্তু মাওসিলী নিজেই ‘আলমুখতার’-এর ভাষ্যগ্রন্থে বিপরীত সিদ্ধান্তকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। অর্থাৎ দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য অবশ্য-অনুসরণীয় নয়।
এক ‘মতন’-গ্রন্থ সাআতীর ‘মাজমাউল বাহরাইন ওয়া মুলতাকান নাইয়িরাইন’। এতে তিনি ‘মুখতাসারুল কুদূরী’ ও ‘মানযূমাতুন নাসাফী’র মাসায়েল একত্র করেছেন। এতে তিনি উপরোক্ত মাসআলা এনেছেন د (দাল) বর্ণের নির্দেশিকার সাথে। د (দাল) বর্ণের অর্থ, এটি ‘যাইদ’ বা অতিরিক্ত মাসআলা। অর্থাৎ যে দুই কিতাব থেকে তিনি মাসআলা সংকলন করেছেন তাতে এ মাসআলা নেই।
সারকথা এই যে, অধিকাংশ মতন, বিশেষত মুতাকাদ্দিমীনের মতনসমূহে এ মাসআলার (উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়) উল্লেখ নেই। ‘মাজমাউল বাহরাইন’, ‘কানয’, ‘মুলতাকাল আবহুর’সহ দু’ চার মতনে যদিওবা এ মাসআলা আছে, কিন্তু এগুলোর লেখকগণ সকলেই খুলাসা-খানিয়ার পরের এবং এগুলোর অধিকাংশ গবেষক ভাষ্যকার অন্য সিদ্ধান্ত (দূর-দূরান্তের শহর-নগরে এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য লাযিম নয়)-কে প্রাধান্য দিয়েছেন।
‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ হওয়াই কি অগ্রগণ্যতার একমাত্র কারণ?
একথাও স্মরণ রাখা দরকার যে, কোনো মাসআলা জাহির রিওয়ায়া হওয়াই অগ্রগণ্যতার একমাত্র কারণ নয়। এটা খুবই সম্ভব যে, ‘আসহাবুত তারজীহ’ (ইখতিলাফী মাসাআলাসমূহে রাজিহ-মারজূহ নির্ধারণকারী ফকীহবৃন্দ) দলীলের শক্তি বা অন্য কোনো বিবেচনায় অন্য কওলকে (বক্তব্য) তারজীহ দিবেন। ফলে সেক্ষেত্রে ঐ অগ্রগণ্য কওল অনুসারেই আমল হবে, ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ অনুসারে নয়। যেমনটা রাসমুল মুফতী ও উসূলুল ইফতার কিতাবসমূহে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে। আর ইবরাহীম হালাবীর বাক্যে এ মূলনীতি তো খুই প্রসিদ্ধ-
ولا يعدل عن الدراية إذا وافقتها رواية
সুতরাং ‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়া’ যদি বাস্তবে ‘জাহিরুর রিওয়ায়া’ও হত এরপরও যেহেতু মাযহাবের বড় বড় ফকীহগণের কেউ হয়তো তা উল্লেখই করেননি, শুধু বিপরীত কওলটিই উল্লেখ করেছেন কিংবা উল্লেখ করলেও বিপরীত কওলটিকে ‘সহীহ’ বা ‘আশবাহ’ (অর্থাৎ দলীলের বিচারে অধিক উপযুক্ত এবং শরীয়তের নীতিমালার সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ) বলেছেন। সুতরাং এ অনুসারে ফতোয়া দেওয়া ও এর উপর আমল করায় আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। কারণ বিষয়টি তো ইজতিহাদী ও ইখতিলাফী।
তাহলে বাস্তবতা যখন এই যে, একে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বলাই ভুল, তখন এর বিপরীত কওল গ্রহণ করায় তো আপত্তির প্রশ্নই আসে না।
তলাবায়ে কেরাম এ বিষয়টিও লক্ষ্য করুন যে, যখন এই প্রসিদ্ধ কওলকে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বলা ‘তাসামূহ’ (ভ্রম) তখন পরের যে লেখকগণ এই কওলকে শুধু এ কারণে প্রাধান্য দিয়েছেন যে, তা ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ তাদের এই ‘তারজীহ’ এ কওলের শক্তি বৃদ্ধি করে না। ‘আলবাহরুর রাইক’ ও ‘মাজমাউল আনহুর’সহ বিভিন্ন ফিকহের কিতাবে এ কওলকে এ কারণেই তারজীহ দেওয়া হয়েছে যে, এটি ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ সুতরাং এ তারজীহ বিশেষ কোনো শক্তি রাখে না।
সামনে অগ্রসর হওয়ার আগে দুটি জরুরি নোট :
এক. অধম যা লিখেছি যে, আলোচিত বিষয়ে মুতাআখখিরীনের নিকটে যে সিদ্ধান্ত প্রসিদ্ধ, তা ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ নয়, এটি আমার সাধ্য অনুযায়ী তাহকীক-অনুসন্ধানের পর লিখেছি। এরপরও যদি এক্ষেত্রে আমার কোনো ভুল হয়ে থাকে তাহলে তলাবায়ে কেরাম ও ফিকহ-ফতোয়ার সাথে মশগুল উলামায়ে কেরামের কাছে বিনীত নিবেদন, তাঁরা অনুগ্রহ করে আমাকে তাম্বীহ করবেন, আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।*
দুই. প্রসিদ্ধ কওলটি সম্পর্কে উপরের আলোচনায় শুধু এটুকু বলা হয়েছে যে, একে হানাফী মাযহাবের ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ সাব্যস্ত করা ভুল। এর অর্থ এই নয় যে, হানাফী মাযহাবের সাথে এ কওলের কোনো সম্পর্কই নেই। কারণ একাধিক হানাফী ফকীহর কাছে এ কওল রাজিহ-অগ্রগণ্য এবং তাঁরা একে ‘মুফতা বিহী কওল’ (যে কওল অনুসারে ফতোয়া দেওয়া হয়েছে বা ফতোয়া দেওয়া উচিত) সাব্যস্ত করেছেন। এরপর অন্যান্য ফিকহী মাযহাবের অনেক ফকীহরও মাসলাক এটিই। এবং এ কওলেরও শরয়ী দলীল আছে। এ কারণে কোনো দেশের দায়িত্বশীলগণ যদি এই কওল অনুযায়ী ফয়সালা করেন তাহলে এর উপরও আপত্তি করা ঠিক নয়। কারণ যেমনটা আগে বলা হয়েছে যে, এ মাসআলা ইজতিহাদী ও ইখতিলাফী।
আপত্তি তো ঐ সকল লোকদের উপর, যারা এই প্রসিদ্ধ কওলের আড়ালে (যাকে ভুলবশত ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বলে দেওয়া হয়েছে) মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশের ব্যাপারে কটূক্তি করে, যারা নিজেদের আলিম-উলামা ও দায়িত্বশীলদের ফয়সালা অনুসারে নিজ নিজ এলাকার চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করেন। অথচ তাদের এ আমল শরয়ী দলিলভিত্তিক এবং ঐ তরীকার মুতাবিক যা সব সময় মুতাওয়ারাছ চলে আসছে। আর যা হানাফী মাযহাবের অতি নির্ভরযোগ্য কওল, যে অনুযায়ী বহু আগে থেকেই বড় বড় ফকীহ ফতোয়া দিয়ে আসছেন। যদিও কোনো কোনো কিতাবের বর্ণনাভঙ্গি থেকে কিছু মানুষের বিভ্রান্তি হয়েছে যে, এ কওল হানাফী ফকীহগণের মাঝে শুধু যায়লায়ীর, বা কাসানী ও যায়লায়ীর কওল (সিদ্ধান্ত)!
এখন আমরা দেখব, এ কি বাস্তবেই শুধু ঐ দুই মনীষীর সিদ্ধান্ত, না তাঁরা ছাড়াও অনেক বড় বড় হানাফী ফকীহের সিদ্ধান্ত। বিশেষভাবে মুতাকাদ্দিমীনের (পূর্ববর্তীদের) কাছে তো এ কওলই বেশি প্রসিদ্ধ ছিল। সংক্ষিপ্ত করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আলোচনা লম্বা হতে চলেছে, আমি পাঠকবৃন্দের কাছে ধৈর্য ধারণের অনুরোধ করছি।
এখন সংক্ষেপে ঐ বড় বড় ফকীহর কথা শুনুন, যাঁদের সিদ্ধান্ত এ-ই ছিল যে, দূর-দূরান্তের শহর-নগরের কোনো এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অবশ্য-অনুসরণীয় নয়।
১. ইমাম আবু আবদিল্লাহ আলফকীহুল জুরজানী (৩৯৮ হি.)
ইমাম কুদূরী রাহ.-এর উস্তায ও ইমাম আবু বকর আলজাসসাস রাহ.-এর শাগরিদ। আলজামিউল কাবীর-এর ভাষ্যকার। ‘ইখতিলাফুল মাতালি’ (উদয়স্থলের ভিন্নতার) ক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্ত এ-ই ছিল যে, দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অবশ্য-অনুসরণীয় নয়।
ইমাম আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ. ‘‘আলআরফুশ শাযী’’-তে (১/১৪৯ জামে তিরমিযীর হাশিয়ায়) আল্লামা মুহাম্মাদ ইউসুফ বানূরী রাহ. ‘‘মাআরিফুস সুনানে’’ (৫/৩৩৭) ও আরবের মশহূর ও জনপ্রিয় আলিম আল্লামা আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন হুমাইদ ‘‘তিবয়ানুল আদিল্লাহ ফী ইছবাতিল আহিল্লা’’ কিতাবে (পৃষ্ঠা : ১৫) আলজুরজানীর** এ মাসলাকই (সিদ্ধান্তই) উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, এ বিষয়ে যায়লায়ীর মাসলাক যা জুরজানীর মাসলাকও তা-ই।
২. আবুল হুসাইন আলকুদূরী (৪২৮ হি.)
গত সংখ্যায় তাঁর কিতাব ‘শরহু মুখতাসারিল কারখী’ এবং ‘আলমুহীতুল বুরহানী’র বরাতে তাঁর মাসলাক লেখা হয়েছে। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, দূরবর্তী অঞ্চলসমূহের ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য ‘লাযিম’ বা অবশ্য-অনুসরণীয় নয়।
৩. মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আবু বকর আলহাসীরী (৫০০ হি.)
ইলমুল ফিকহে বিশেষভাবে শামসুল আইম্মা সারাখসী রাহ.-এর এবং ইলমে হাদীসে অনেক মুহাদ্দিসের শাগরিদ। বুখারা নগরে ৫০০ হিজরীতে ইন্তিকাল। ‘আলজাওয়াহিরুল মুযিয়্যা’হ (৩/৮) ও ‘‘আলফাওয়াইদুল বাহিয়্যা’’য় তাঁর ‘তরজমা’ (পরিচিতি মূলক আলোচনা) আছে। ফিকহ-ফতোয়া বিষয়ে তাঁর কিতাব ‘‘আলহাভী’’ খুব নির্ভরযোগ্য ও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বরাতগ্রন্থ। এবং ‘হাভিয যাহিদী’ ও ‘আলহাভিল কুদসী’র আগের। (কাশফুয যুনূন)
এ কিতাবের একাধিক মাখতূতা মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন কুতুবখানায় সংরক্ষিত আছে। এ মুহূর্তে আমি তাঁর বক্তব্য হিদায়া-গ্রন্থকার ইমাম বুরহানুদ্দীন আলমারগীনানী রাহ.-এর কিতাব ‘আততাজনীস’ থেকে নকল করছি। ছাহিবে হেদায়া লেখেন-
وفي الحاوي : أهل بلدة رأوا الهلال يوم الثلثاء، وأهل بلدة أخرى يوم الأربعاء يحكم لكل بلدة بما رأوا، ولا ينظر إلى أهل بلدة أخرى ... .
অর্থ : ‘আলহাভী’তে আছে, যদি কোনো শহরবাসী মঙ্গলবার চাঁদ দেখে আর অন্য শহরের অধিবাসীগণ বুধবার তাহলে প্রত্যেক শহরবাসীর জন্য তাদের নিজেদের চাঁদ দেখা অনুসারে ফয়সালা করা হবে। অন্য শহরের দিকে দেখা হবে না। (আততাজনীস ওয়াল মাযীদ ২/৪২৩)
ইমাম আবু বকর হাসীরী রাহ.-এর বক্তব্য বর্ণনা করে হেদায়া-গ্রন্থকার যে মন্তব্য লিখেছেন তার সারমর্ম হচ্ছে, এ বিধান দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে। কাছাকাছি অঞ্চলসমূহে এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকায় শরয়ী পদ্ধতিতে প্রমাণিত হলে দায়িত্বশীলগণ সে অনুযায়ী ফয়সালা করবেন।
৪. হুসামুদ্দীন আসসদরুশ শহীদ (৫৩৬ হি.)
‘‘আলমুহীতুল বুরহানী’’র লেখকের সম্মানিত চাচা, হেদায়া-লেখক ও আল্লামা কাযীখান রাহ.-এর খাস উস্তাদ, ফিকহ-ফতোয়ার প্রসিদ্ধ ইমাম। তাঁর বক্তব্য তাঁর কিতাব ‘‘আলফাতাওয়াল কুবরা’র ‘মাখতূতা’ (হস্তলিখিত পান্ডুলিপি) থেকে গত সংখ্যায় পেশ করা হয়েছে।
৫. ফকীহ আবদুর রশীদ আলওয়ালওয়ালিজী (মৃত্যু ৫৪০ হি.-এর পরে)
তাঁর কিতাব ‘আলফাতাওয়াল ওয়ালওয়ালিজিয়্যাহ’ থেকে উদ্ধৃত বক্তব্য আপনারা গত সংখ্যায় পাঠ করেছেন।
৬. রুকনুদ্দীন আবুল ফযল আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ আলকিরমানী (৫৪৩ হি.)
গত সংখ্যায় ‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’র বর্ণনায় পাঠক এ বাক্য পাঠ করেছেন-
وفي التجريد : يعتبر اختلاف المطالع
অর্থাৎ ‘তাজরীদ’-গ্রন্থে আছে, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া) এর অর্থ, তাজরীদ-লেখকের কাছে দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য লাযিম নয়।
ফিকহে হানাফীতে যদিও ‘তাজরীদ’ নামে একাধিক কিতাব আছে, তবে বেশি প্রসিদ্ধ দুটি কিতাব : এক. ইমাম আবুল হুসাইন আলকুদূরী রাহ.-এর ‘‘আততাজরীদ’’, যা কয়েক বছর আগে ১২ খন্ডে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। যেহেতু এ ‘‘তাজরীদ’’ই বেশি প্রসিদ্ধ এবং এর লেখক ইমাম কুদূরী রাহ.ও খুলাসা-লেখকের আগের আর বাস্তবেও ইমাম কুদূরীর মাসলাকও সেটিই এ কারণে কারো ধারণা হতে পারে যে, উপরের বরাতে ইমাম কুদূরীর তাজরীদই উদ্দেশ্য। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। প্রথমত এ কারণে যে, কুদূরী রাহ.-এর ‘‘তাজরীদে’’র মুদ্রিত নুসখায় আমাদের জানামতে এ মাসআলা নেই, দ্বিতীয়ত ‘‘খুলাসায়’’ এমন অনেক মাসআলায় ‘‘তাজরীদে’’র বরাত দেয়া হয়েছে ও ইবারত আনা হয়েছে যা নিঃসন্দেহে কুদূরীর তাজরীদে নেই। তৃতীয়ত কুদূরীর এ কিতাবের বিষয়বস্ত্ত হচ্ছে, ঐ সকল মাসআলার দালীলিক ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ, যেগুলোতে ইমাম আবু হানীফা রাহ. ও ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর মাঝে ইখতিলাফ হয়েছে। অথচ ‘উদয়স্থলের ভিন্নতা’ শীর্ষক মাসআলা (অন্তত ইমাম কুদূরীর মতে) এ শ্রেণির নয়। ইমাম কুদূরী রাহ. এ মাসআলার যে সমাধান ‘‘শরহু মুখতাসারিল কারখী’’ তে উল্লেখ করেছেন ফিকহে শাফেয়ীর সমাধানও তাই। এ কারণে তাঁর নিকটে এ মাসআলা তাঁর ‘‘তাজরীদ’’ গ্রন্থের বিষয়বস্ত্তর সাথে সরাসরি যুক্ত নয়।
‘‘তাজরীদ’’ নামে দ্বিতীয় মশহূর কিতাব ইমাম রুকনুদ্দীন আবুল ফযল আলকিরমানী রাহ. (৪৫৭-৫৪৩ হি.)-এর, যা ফিকহে হানাফীর বুনিয়াদী কিতাবসমূহের অন্যতম। ‘তাজরীদুল কুদূরী’ থেকে আলাদা করার জন্য কখনো কখনো একে ‘তাজরীদুর রুকনী’ নামেও উল্লেখ করা হয়।
আফসোস, এ অতি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, যা এখনো মুদ্রিত হয়নি, তবে আনন্দের কথা এই যে, মক্কা মুকাররমায় উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটির ‘কুল্লিয়াতুশ শারীয়া’য় (ফিকহ বিভাগ) এ কিতাবের তাহকীকের (পান্ডুলিপি সম্পাদনার) কাজ শুরু হয়েছে এবং ১৪৩২-১৪৩৩ হিজরীতে আবদুল্লাহ বিন সুলায়মান বিন ওয়ায়িল আত-তুয়াইজিরী কিতাবের শুরু থেকে ‘বাবুয যিহার’ পর্যন্ত তাহকীক করে ফিকহ বিষয়ে ডক্টরেট এর অভিসন্দর্ভ প্রস্ত্তত করেছেন।
‘‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’’য় যে তাজরীদের বরাত বারবার আসে তা এই ‘‘আততাজরীদুর রুকনী’’।*** এ কিতাবের উপর জামেয়া উম্মুল কুরায় যে কাজ হয়েছে সে সম্পর্কে আমাকে অবগত করেছেন আমাদের ফিকহ-বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত তালিবে ইলম মৌলভী ফয়যুল্লাহ। এরপর আমার অনুরোধে শায়খ ত্বহা হোসাইন কিতাবের সম্পাদিত নুসখা থেকে সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠাগুলো আমার জন্য পাঠিয়েছেন। এতে এ মাসআলার উপর যে আলোচনা এসেছে তা নিম্নরূপ :
ولو صام أهل مصر ثلاثين يوما للرؤية، وصام أهل بلد تسعة وعشرين يوما للرؤية فعلى هؤلاء قضاء يوم واحد، وهذا إذا كان بين البلدين تقارب لا تختلف المطالع، فإن كان يختلف لم يلزم أحد البلدين حكم الآخر.
(আততাজরীদ, আবুল ফজল আলকিরমানী ১/৩৪০-৩৪১; এতে তিনি ঐ কথাই বলেছেন, যা ইমাম কুদূরীসহ অন্যান্য ফকীহগণ বলেছেন।)
৭. রযীউদ্দীন আসসারাখসী (৫৪৪ হি.)
গত সংখ্যায় ‘‘মুহীতুস সারাখসী’’ (মাখতূত) থেকে তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে।
৮. মাজদুশ শরীয়া সুলায়মান ইবনুল হাসান আলকিরমানী (কাযি মুহাম্মাদ)
আপন যুগে কাযিল কুযাত ছিলেন এবং ফিকহ-ফতোয়ার ক্ষেত্রে সমাধানদাতা মনীষী ছিলেন। ইমাম রুকনুদ্দীন আলকিরমানী রাহ. (৫৬৫ হি.) ‘‘জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া’’য় প্রত্যেক বিষয়ের অধীনে ‘আলবাবুল খামিস’ শিরোনামে তাঁর ফতোয়াসমূহ সংকলন করেছেন। ‘‘জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া’’র ‘কিতাবুস সওমে’র ‘আলবাবুল খামিসে’ আছে-
أهل بلد عيَّدوا يوم الإثنين، وأهل بلد آخر عيَّدوا يوم الثلثاء لا يجب عليهم قضاء يوم.
أهل بلد رأوا هلال رمضان وأعلموا أهل البلد الآخر بذلك، وهم لم يروا، فهذا على وجهين : إن كان المطلع في حقهما متحداً يلزم كل واحد منهما حكم الآخر، فإذا أعلمهم عدلان منهم يلزمهم حكم الصوم والفطر، وإن كان بين البلدين مسافة يختلف المطالع في حقهم فلا يلزم واحدا حكم الآخر.
অর্থ : কোনো শহরের অধিবাসীগণ সোমবার ঈদ করেছে, অন্য শহরের অধিবাসীগণ মঙ্গলবার তাহলে প্রথমোক্তদের উপর একদিনের কাযা জরুরি নয়।
কোনো শহরের অধিবাসীগণ রমযানের চাঁদ দেখেছে এবং অন্য কোনো শহরের অধিবাসীদেরকে এ সংবাদ পৌঁছাল, যারা নিজেরা চাঁদ দেখেনি, এক্ষেত্রে দুই অবস্থা : যদি উভয় শহরের উদয়স্থল অভিন্ন হয় তাহলে একের হুকুম অন্যের জন্য লাযিম হবে। সুতরাং তাদের দুজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি তাদেরকে এ সংবাদ পৌঁছিয়ে থাকলে তাদের উপর রোযা-ঈদের বিধান আরোপিত হবে।
পক্ষান্তরে দুই শহরের মাঝে যদি এ পরিমাণ দূরত্ব হয় যে, উদয়স্থল আলাদা হয়ে যায় তাহলে এক শহরের উপর অন্য শহরের বিধান ‘লাযিম’ হবে না।
(জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া : ৩৬, মাখতূতা, জামিয়াতুল মালিক সাউদ, রিয়ায, সৌদী আরব)
৯. জামালুদ্দীন আলমুতাহহির ইবনে হুসাইন আলইয়াযদী
তাঁর বক্তব্য ‘জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া’র বরাতে বিগত সংখ্যায় পাঠ করেছেন।
১০. রুকনুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে আবদুর রশীদ আলকিরমানী (৫৬৫ হি.)
‘‘জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া’’র কিতাবুস সওমে ‘‘আলবাবুছ ছালিছে’’র অধীনে আতা ইবনে হামযা সাদীর একটি ফতোয়া নকল করার পর তাঁর মন্তব্য-
وهذا إذا كان بين البلدتين لا يختلف المطالع بحيث يلزم أحدهما حكم الآخر.
অর্থাৎ এ বিধান ঐ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যখন দুই শহরের অবস্থান এমন হবে যে, তাদের উদয়স্থল অভিন্ন থাকে, যার কারণে একের হুকুম অন্যের উপর লাযিম হয়।
আতা ইবনে হামযার ফতোয়া এই ছিল যে, এক শহরের কাযীর কাছে অন্য শহরের কাযীর সামনে প্রদত্ত সাক্ষ্যের বিষয়ে যদি দুইজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেয় এবং সংশ্লিষ্ট শর্তসমূহ পাওয়া যায় তাহলে এই কাযী সে অনুযায়ী ফয়সালা করবে।
এ ফতোয়ার উপর ইমাম রুকনুদ্দীন কিরমানী উপরোক্ত মন্তব্য লিখেছেন।
১১. সিরাজুদ্দীন আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল আভীশী (৫৬৯ হি.)
তিনি ‘‘আলফতোয়াস সিরাজিয়্যাহ’’য় এ সিদ্ধান্তই ব্যক্ত করেছেন। তিনি লেখেন-
أهل بلدة صاموا للرؤية ثلاثين يوما، وأهل بلدة أخرى تسعة وعشرين يوما للرؤية فعلى هؤلاء قضاء يوم إلا إذا كان بين البلدتين تباين بحيث تختلف المطالع.
এক শহরের অধিবাসীরা চাঁদ দেখে ত্রিশ দিন রোযা রাখল অন্য শহরের অধিবাসীরা চাঁদ দেখেই রাখল উনত্রিশ রোযা তাহলে এদেরকে একদিনের রোযা কাযা করতে হবে যদি না দুই শহরের মাঝে এমন পার্থক্য হয় যার দ্বারা উদয়স্থল আলাদা হয়ে যায়। (আলফাতাওয়াস সিরাজিয়্যাহ, পৃষ্ঠা : ১৬৯, প্রকাশনায় দারুল উলূম যাকারিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা)
১২. মালিকুল উলামা আলাউদ্দীন আলকাসানী (৫৮৭ হি.)
তাঁর কিতাব ‘‘বাদায়েউস সানায়ে ফী তারতীবিশ শারায়ে’’ ফিকহে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় কিতাবসমূহের একটি। এ কিতাবে তিনি আলোচিত মাসআলায় এ সিদ্ধান্তই ব্যক্ত করেছেন, যা অধিকাংশ বড় বড় হানাফী ফকীহের সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য লাযিম নয়। যার শিরোনাম তাঁরা এভাবে দিয়েছেন যে, উদয়স্থল আলাদা হলে তার ইতিবার করা চাই এবং এক জায়গার হুকুম অন্য জায়গায় প্রয়োগ না করা চাই।
যেহেতু কাসানীর এ সিদ্ধান্ত এতই প্রসিদ্ধ যে, একে শুধু তাঁর ও যায়লায়ীর সিদ্ধান্ত মনে করা হয়েছে, এ কারণে তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারো উৎসাহ থাকলে বাদায়েউস সানায়ে (২/২২৪-২২৫, দারু ইহইয়ায়িত তুরাছিল আরাবী, বৈরুত) খুলে দেখতে পারেন।
ফিকহ-ফতোয়ার অনুশীলনে রত তলাবায়ে কিরামের খিদমতে এ কথাও আরজ করছি যে, হযরত মাওলানা মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানবী রাহ. (১৪২২ হি.) ‘‘আহসানুল ফাতাওয়া’’য় (৪/৪৯৫) ইমাম কাসানী রাহ.-এর বক্তব্যের যে ব্যাখ্যা করেছেন তা সঠিক নয়। এটি
توجيه القول بما لا يرضى به القائل
এর আওতায় পড়ে। আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি সঠিক হলে বাদায়ের ইবারত
فيعتبر في أهل كل بلد مطالع بلدهم دون البلد الآخر
না হয়ে এরূপ হত-
فيعتبر في أهل كل بلد حكم قاضيهم دون البلد الآخر.
তিনি ইমাম কাসানীর বক্তব্যকে যে মাসআলার দিকে নিতে চেয়েছেন তা তো ‘বাদায়ে’-তে আলোচনায়ই আসেনি। সুতরাং এ প্রয়াস অর্থহীন। কাসানী এখানে যে বিষয়টি আলোচনা করছেন তা হচ্ছে কোন ক্ষেত্রে উনত্রিশওয়ালাদের উপর ত্রিশওয়ালাদের কারণে এক দিনের কাযা ওয়াজিব হবে, কোন ক্ষেত্রে হবে না। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, উদয়স্থল আলাদা হলে কাযা ওয়াজিব নয়। কারণ এ অবস্থায় এক শহরের জন্য অন্য শহরের হুকুম অবশ্য-অনুসরণীয় নয়।
এখানে এ বিষয়ে একটু ইশারা করা হল। ‘চাঁদ প্রমাণিত হওয়া’ এবং চাঁদের হুকুম প্রয়োগ’ শীর্ষক আলোচনায় ‘‘আহসানুল ফাতাওয়া’’র ব্যাখ্যার ত্রুটি আরো পরিষ্কার হবে ইনশাআল্লাহ।
১৩. বুরহানুদ্দীন আলী ইবনে আবু বকর আলমারগীনানী (৫৯৩ হি.)
হেদায়া-গ্রন্থকারের ইলমী অবস্থান কারো অজানা নয়। তাঁর কিতাব ‘‘আততাজনীসু ওয়াল মাযীদ’’-এর বরাতে তাঁর বক্তব্য ইতিমধ্যে দুইবার উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে তাঁর কিতাব ‘‘মুখতারাতুন নাওয়াযিল’’-এর ইবারত (উদ্ধৃতি)ও উল্লেখ করছি। ঐ কিতাবের ইবারত ‘‘তিবয়ানুল আদিল্লাহ ফী ইছবাতিল আহিল্লা’’য় (পৃষ্ঠা : ১৩) নকল করা হয়েছে। তাতে আছে-
وقال في مختارات النوازل : أهل بلد صاموا تسعة وعشرين يوما بالرؤية وأهل بلدة أخرى صاموا ثلاثين يوما بالرؤية، على الأولين قضاء يوم إذا لم تختلف المطالع بينهما، وأما إذا اختلفت المطالع لا يجب القضاء ... .
এ উদ্ধৃতির অর্থও তাই যা ‘‘আততাজনীসু ওয়াল মাযীদ’’-এর উদ্ধৃতির অর্থ।****
১৪ ও ১৫. জহীরুদ্দীন আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ আল বুখারী (৬১৯ হি.)
তাঁর কিতাব ‘‘আলফাতাওয়ায যহীরিয়্যাহ’’ ও ‘‘আলফাওয়াইদুয যহীরিয়্যাহ’’ খুবই প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য বরাত-গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত। তিনি ইমাম যহীরুদ্দীন আলহাসান ইবনে আলী আলমারগীনানীর শাগরিদ ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁরই নামানুসারে নিজের কিতাবের নাম রেখেছেন। তিনি ‘আযযাহীরিয়্যাহ’র কিতাবুস সওম-এ এ মাসআলার উপর আলোচনা করেছেন, যার শুধু একটি বাক্য হিজরী অষ্টম শতকের ঐতিহাসিক ফতোয়া-সংকলন ‘‘আলফাতাওয়াত তাতারখানিয়া’’য় (৩/৩৬৫) (তাহকীক শাববীর আহমদ কাসেমী) নকল করা হয়েছে। এক প্রসঙ্গে ‘‘আযযহীরিয়্যাহ’’র ‘কিতাবুল আইমান’ (শপথ অধ্যায়)-এ-ও এ মাসআলার আলোচনা এসেছে। ওখানে তিনি যাকিছু লিখেছেন তা আল্লামা যাইন ইবনু নুজাইম ‘‘আলবাহরুর রাইক’’ কিতাবে নকল করেছেন। অপ্রাসঙ্গিক স্থানের এ বরাত আমাকে সরবরাহ করেছে আমাদের শাগরিদ মৌলভী ফয়জুল্লাহ হবিগঞ্জী। আলবাহরুর রাইক-এর ‘কিতাবুল আইমান’-এর শেষে ‘‘আযযহীরিয়্যাহ’’ থেকে অনেক মাসআলা একসাথে নকল করা হয়েছে। তন্মধ্যে একটি মাসআলা এই-
وسئل الأوزجندي عمن قال لصاحب الدين : إن لم أقض حقك يوم العيد فكذا، فجاء يوم العيد إلا أن قاضي هذه البلدة لم يجعله عيدا ولم يصل فيه صلاة العيد لدليل لاح عنده، وقاضي بلدة أخرى جعله عيدا؟
قال : إذا حكم قاضي بلدة بكونه عيدا يلزم ذلك أهل بلدة أخرى إذا لم تختلف المطالع، كما في الحكم بالرمضانية.
যহীরিয়্যাহ-লেখক বলেন, উযাজান্দীকে জিজ্ঞাসা করা হল, কেউ তার ঋণদাতাকে বলল, ঈদের দিন তোমার ঋণ আদায় না করলে এই হবে (কোনো কসম করল)। এখন ঈদ এমন হল যে, সে যে শহরের অধিবাসী সেখানের কাযী কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে ঈদ ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকল, কিন্তু অন্য কোনো শহরের কাযী ঈদ ঘোষণা করল। (তাহলে কোন দিন ঈদের দিন গণ্য হবে এবং এ লোকের কসমের কী হবে)।
উযাজান্দী রাহ. জবাব দিলেন, উপরোক্ত দুই শহরের উদয়স্থল যদি অভিন্ন হয় তাহলে এক শহরের কাযীর ঘোষণা অন্য শহরের জন্যও অবশ্য-অনুসরণীয় হবে। রমযান শুরুর ঘোষণার ক্ষেত্রেও এ মাসআলা। (আলবাহরুর রাইক, ইবনে নুজাইম মিসরী ৪/৬১৫)
এ ‘উযাজান্দী’ কে?
উযাজান্দের অধিবাসীদের মাঝে দুজন ফকীহই প্রসিদ্ধ। এক. কাযী খান রাহ. (৫৯২ হি.), যিনি ফতোয়া খানিয়ার লেখক। দুই. তাঁর দাদা শামসুল ইসলাম মাহমূদ উযাজান্দী রাহ.। কাযী খান তো কাযীখান নামেই মশহূর। আর ‘উযাজান্দী’ বলে সাধারণত তাঁর দাদাজানকেই নির্দেশ করা হয়। ‘‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’’ ও ‘‘আলমুহীতুল বুরহানী’’র কয়েক জায়গায় এ নিসবত দ্বারা তাঁকেই বোঝানো হয়েছে।
সুতরাং ‘‘যহীরিয়্যাহ’’র উপরোক্ত মাসআলা থেকে যেমন আল্লামা জহীরুদ্দীন বুখারী রাহ. (৬১৬ হি.)-এর মত জানা গেল তেমনি শামসুল ইসলাম ইমাম মাহমূদ উযাজান্দী রাহ.-এর মতও জানা গেল। আরো জানা গেল যে, ‘ফাতাওয়া খানিয়া’য় নাতী উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয় বললেও দাদা ধর্তব্যই বলেছেন।
১৬. আবদুল্লাহ ইবনে মাহমূদ আলমাওসিলী (৫৯৯ হি.-৬৮৩ হি.)
তিনি ‘‘আলমুখতার’’ গ্রন্থে খানিয়ার অনুসরণে প্রসিদ্ধ কওলটি লিখলেও ‘‘আলমুখতার’’-এর স্বরচিত ভাষ্য ‘‘আলইখতিয়ার’’-এ (১/৪০৫) ‘‘আলফাতাওয়াল হুসামিয়্যাহ’’র বরাতে ঐ মাসলাক নকল করেছেন, যা তাঁর আগের ফকীহরা লিখেছেন এবং যা হেদায়া-লেখক প্রমুখ ফকীহগণ বারবার বলেছেন।
‘‘আলফাতাওয়াল হুসামিয়্যা’’ দ্বারা উদ্দেশ্য হুসামুদ্দীন শহীদ রাহ. (৫৩৬ হি.)এ-র ফাতাওয়া। তাঁর ‘‘আলফাতাওয়াল কুবরা’’র ইবারত তো আমরা ইতিপূর্বে লিখেছি।
ফকীহ আবদুল্লাহ আলমাওসিলী তাঁর আলোচনা নিম্নোক্ত বাক্যে সমাপ্ত করেছেন-
وعن عائشة رضي الله عنها : فطر كل بلدة يوم فطر جماعتهم وأضحى كل بلدة يوم يضحي جماعتهم.
অর্থাৎ আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, প্রত্যেক শহরের ঈদুল ফিতর তখনই হবে যখন শহরের অধিবাসীগণ ঈদ করবে এবং ঈদুল আযহাও তখন হবে যখন সে শহরের অধিবাসীগণ কুরবানী করবে।
(আলইখতিয়ার লি-তা’লীলিল মুখতার ১/৪০৫, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন)
অর্থাৎ নিজ শহরের অধিবাসীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ ঈদ বা কুরবানী করলে না তা অনুমোদিত, না গ্রহণযোগ্য।
১৭. ফখরুদ্দীন যায়লায়ী (৭৪৩ হি.)
একজন হলেন জামালুদ্দীন যায়লায়ী (৭৬২ হি.), যিনি ‘‘নাসবুর রায়াহ লিআহাদীসিল হেদায়া’’র লেখক। উদয়স্থলের ভিন্নতার প্রসঙ্গে যে যায়লায়ীর কথা আসে তিনি ইনি নন। তিনি ‘‘নাসবুর রায়াহ’’ লেখকের উস্তায ফখরুদ্দীন যায়লায়ী (৭৪৩ হি.)। ‘‘কানযুদ দাকাইক’’-এর বিখ্যাত শরহ ‘‘তাবয়ীনুল হাকাইক’’ এঁর রচনা।
এ মাসআলায় ‘‘তাবয়ীনুল হাকায়েক’’ গ্রন্থে তিনি শক্তিশালী দালীলিক আলোচনা করেছেন। তাঁর সে আলোচনা পরের অনেক লেখক স্ব স্ব গ্রন্থে নকল করেছেন। এখনকার তালিবে ইলমদের পূর্ববর্তীদের কিতাবসমূহ খোলার অভ্যাস কমে যাওয়ার কারণে এ কথা মশহূর হয়ে গেছে যে, হানাফীদের মধ্যে শুধু যায়লায়ী উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য মনে করেন। কেউ অনুগ্রহ করে এর সাথে কাসানীর নামটিও যুক্ত করেছেন। অথচ পাঠক দেখছেন, একটি সাধারণ পর্যবেক্ষণেও যায়লায়ীর নাম কত নম্বরে এল।
১৮. ইবনে মালাক (৮০১ হি.) [আবদুল লতিফ ইবনে আবদুল আযীয ইবনে আমীনুদ্দীন ইবনে ফিরিশতা আলকিরমানী]
ফিকহ-ফতোয়ার অঙ্গনে এ নাম খুবই প্রসিদ্ধ ও আনন্দের। তিনি হাদীসের মশহূর কিতাব ‘‘মাশারিকুল আনওয়ার’’-এর শরহ ‘‘মাবারিকুল আযহার’’ নামে এবং ফিকহে হানাফীর কিতাব ‘‘মাজমাউল বাহরাইন ওয়া মুলতাকান নাইয়েরাইন’’-এরও শরহ লিখেছেন, যা ‘‘শরহুল মাজমা লিবনে মালাক’’ নামে প্রসিদ্ধ। ফাতাওয়া শামীতে এর বরাত অনেক জায়গায় এসেছে।
এ কিতাবের মাখতূতা রিয়াদের জামিয়াতুল মালিক সাউদে আছে। তাতে তিনি ২৯ ওয়ালাদের উপর ৩০ ওয়ালাদের কারণে এক রোযা কাযা করার বিধানকে-
هذا إذا كان بينهما تقارب في المطلع
(যখন দুই শহরের উদয়স্থল কাছাকাছি হয়)
শর্তের সাথে যুক্ত করেছেন এবং উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য হওয়ার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন-
هذا هو الأشبه
এ সিদ্ধান্তই শরীয়তের নীতিমালার সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। (মাখতূতা, পাতা : ৬৩)
১৯. ইবরাহীম ইবনে আবদুর রহমান আলকাহিরী, ‘ছাহিবুল ফায়য’ (৯২৩ হি.)
মুহাদ্দিস তকীউদ্দীন শুমুন্নী রাহ. থেকে ইলমে হাদীস হাসিল করেছেন এবং ইমাম ইবনুল হুমাম রাহ. থেকে ইলমুল ফিকহ ওয়াল ফতোয়া। হাদীসে হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. থেকেও তাঁর ইজাযত আছে।-আযযওউল লামি, শামসুদ্দীন সাখাবী (৯০২ হি.), ১/৫৯-৬৪
তাঁর ফতোয়া-সংকলনের নাম, যা তিনি নিজে সংকলন করেছেন ‘‘ফয়যুল মাওলাল কারীম আলা আবদিহী ইবরাহীম’’।
ইবনে আবেদীন শামী লেখেন-
وقد قال في خطبته : وضعت في كتابي هذا ما هو الراجح والمعتمد، ليقطع بصحة ما يوجد فيه أو منه يستمد.
অর্থাৎ তিনি (আল্লামা ইবরাহীম রাহ. তাঁর ফতোয়া সংকলন ‘ফয়যুল মাওলা’র) ভূমিকায় বলেছেন, এ কিতাবে আমি শুধু নির্ভরযোগ্য ও অগ্রগণ্য কওলসমূহ লিখেছি। যাতে এ কিতাবে যা কিছু পাওয়া যাবে তার বিশুদ্ধতার বিষয়ে আস্থা রাখা যায় এবং এর দ্বারা ফিকহ-ফতোয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য নেওয়া যায়। (রদ্দুল মুহতার ১/১০২)
ইবনে আবেদীন শামী রাহ. উদয়স্থলের ভিন্নতা সংক্রান্ত আলোচনায় লেখেন, ফয়েয-লেখক ঐ সিদ্ধান্তকেই নির্ভরযোগ্য সাব্যস্ত করেছেন যার উপর যায়লায়ী আস্থা রেখেছেন।
(واعتمده الزيلعي وصاحب الفيض)
২০. শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (১১৭৬ হি.)
তিনি ‘মুয়াত্তা মালিকে’র ফার্সী শরহ ‘‘আলমুসাফফা’’য় এ মাসলাকই অবলম্বন করেছেন। তিনি লেখেন-
اگر ہلال را در يك شہر ديدہ شد ودر شہر ديگر تفحص كردند ونديدند اگر آں شہر قريب است لازم است حكم رويت ايشاں، واگر بعيد است لازم نيست بحديث ابن عباس، وبقياس بر مسئلہ فطر وحج كہ در حديث منصوص شدہ.
وظاہر آنست كہ مراد از بعد مسافت قصر است، وايراد كردہ نشود كہ مسافت قصر را بامر ہلال ہيچ تعلق نيست زيرا كہ مشروعيت اكتفائے ہر ناحيہ برويت خود از جہت حرج است در تكليف بابلاغ اخبار نہ از جہت اختلاف مطالع، وعادت قاضيہ است ببلوغ اخبار در مواضع قريبہ، بس اگر از آخر شہرے كہ در آں رويت متحقق شد بر دو مرحلہ باشد حكم آں لازم نيست.
(মুসাফফা শরহে মুয়াত্তা, ফার্সী ১/২৩৭, ১২৯৩ হিজরীর মুদ্রণের ফটোসংস্করণ, প্রকাশক, মীর মুহাম্মাদ করাচী)
এ উদ্ধৃতিতে শাহ ছাহেব রাহ. পরিষ্কার বলেছেন, দূর-দূরান্তের দুই শহরের ক্ষেত্রে এক জায়গার চাঁদ দেখা অন্য জায়গার জন্য অবশ্য-অনুসরণীয় নয়। এরপর তিনি এ বিধানের হিকমত এবং দূরত্বের পরিমাণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, যা এ মুহূর্তে আলোচ্য বিষয় নয়।
২১. আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (১৩৫২ হি.)
শাহ ছাহেব কাশ্মীরী রাহ. ফিকহ-হাদীস-তাফসীর বিষয়ে বিগত শতাব্দীর ইমাম গণ্য হতেন। তিনি অত্যন্ত তাকীদের সাথে যায়লায়ীর মাসলাকের সমর্থন করেছেন। জামে তিরমিযীর উপর তার দরসী আলোচনা ‘‘আলআরফুশ শাযী’’ নামে তিরমিযীর হাশিয়ায় মুদ্রিত। সেখানে তাঁর আলোচনা দেখা যেতে পারে।
২২. মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. (১৩৯৬ হি.)
বহু বছর দারুল উলূম দেওবন্দের মুফতী আযম ছিলেন। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান তাশরীফ নিয়ে যান এবং আমৃত্যু পাকিস্তানের মুফতী আযম ছিলেন। এ বিষয়ে তার কিতাব ‘‘রুয়তে হেলাল’’ মুদ্রিত, যার বাংলা তরজমাও হয়েছে। আগ্রহী ব্যক্তিগণ তা পাঠ করে দেখতে পারেন, কী জোরের সাথে তিনি যায়লায়ী ও কাসানীর মাসলাকের সমর্থন করেছেন।
২৩. মুহাম্মাদ ইউসুফ বানূরী (১৩৯৭ হি.)
গত শতাব্দীর অনেক বড় মুহাদ্দিস ও ফকীহ। আরব-আজমে সমান বরণীয়। জামি তিরমিযীর উপর তাঁর পান্ডিত্যপূর্ণ ভাষ্যগ্রন্থ ‘‘মাআরিফুস সুনান’’ মুদ্রিত ও সহজলভ্য। এর পঞ্চম খন্ডে কিতাবুস সওমের পঞ্চম ও নবম পরিচ্ছেদের (বাবের) অধীনে অতি বিজ্ঞতাপূর্ণ আলোচনা করেছেন এবং যায়লায়ীর মাসলাকের জোরালো সমর্থন করেছেন। তলাবায়ে কেরাম তা পাঠ করতে পারেন। (মাআরিফুস সুনান ৫/৩৩৫-৩৪১, ৩৫১-৩৫৪)
আপাতত এ সংক্ষিপ্ত তালিকার উপরই ক্ষান্ত করছি। আশা করি, এ থেকেই পাঠকবৃন্দ বাস্তব অবস্থা অনুমান করতে পারবেন।
এ তালিকার উপর নজর বুলিয়ে গেলেও জানা যাবে যে, ‘ইখতিলাফে মাতালি’ (উদয়স্থলের ভিন্নতা) সংক্রান্ত আলোচনায় হানাফী মাযহাব বর্ণনার সময় নির্দ্বিধায় এ কথা বলে দেওয়া যে, এ মাযহাবের ‘জাহের রেওয়ায়েত’ হচ্ছে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়া, যেন এটিই একমাত্র অগ্রগণ্য মাসলাক, খুবই আপত্তিকর।
তেমনি এই অভিমত দাঁড় করানোও বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিরোধী যে, মুতাকাদ্দিমীন-মুতাআখখিরীন তথা আগের ও পরের ফকীহগণের মাঝে যেন শুধু কাসানী ও যায়লায়ীই উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য মনে করেন। ইনসাফের দাবি হচ্ছে এমন বলা :
১. হানাফী মাযহাবের ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’য় উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য হওয়া না-হওয়া কোনোটাই আলোচনায় আসেনি।
২. নাদির রেওয়ায়েতে ৩০ ওয়ালাদের কারণে ২৯ ওয়ালাদেরকে যে এক রোযা কাযা করতে বলা হয়েছে তাকে অধিকাংশ বড় বড় হানাফী ফকীহ, যাদের মাঝে আছেন হানাফী মাযহাবের বড় বড় ইমাম, কাছাকাছি শহর-নগরের বিধান মনে করেন।
৩. لا عبرة لاختلاف المطالع
(উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়) শীর্ষক মূলনীতিধর্মী বাক্যের খোঁজ হানাফী মাযহাবে পঞ্চম শতক পর্যন্ত পাওয়া যায় না। ষষ্ঠ শতকের শেষে সবার আগে খানিয়া ও খুলাসা-লেখক এ বাক্য ব্যবহার করেন।
৪. বক্তার সংখ্যা ও ইলমী অবস্থানের বিচারে দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য লাযিম না হওয়ার সিদ্ধান্তই হানাফী মাযহাবের রাজিহ-অগ্রগণ্য সিদ্ধান্ত সাব্যস্ত হওয়ার হকদার এবং আকাবির মুতাকাদ্দিমীন তথা পূর্বসূরীদের মাঝে বড় বড় ফকীহগণ এ মাসলাকই গ্রহণ করেছেন।
আল্লাহ তাআলা হায়াতে রাখলে অবশিষ্ট কথা আগামী সংখ্যায় হবে ইনশাআল্লাহ।
وما توفيقي إلا بالله، عليه توكلت وإليه أنيب
টীকা
* এখানে মনে রাখা দরকার যে, ‘যাহিরুর রিওয়ায়াহ’র প্রসিদ্ধ পরিভাষা হল, ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর ছয় কিতাবের কোনোটিতে (মূলত পাঁচ কিতাব, কেননা ‘‘আসসিয়ারুস সগীর’’ কিতাবটি ‘কিতাবুল আছল’-এর অংশ।) মাসআলাটি উল্লেখিত হওয়া, আর এ হিসেবেই উপরের পূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু ‘খানিয়া’ ও ‘খুলাসা’য় এ শব্দ অন্য কোনো অপ্রসিদ্ধ অর্থে ব্যবহার করা হলে তা আমাদের জানা নেই। তবে এ কথা স্মরণ রাখা জরুরি যে, ‘যাহিরুর রিওয়ায়াহ’ হওয়া-যা প্রাধান্যের একটি কারণ-তা এই পরিচিত ও প্রসিদ্ধ অর্থ হিসেবেই।
** ইমাম কুদূরী রাহ.-এর উস্তায আবু আবদুল্লাহ জুরজানী ছাড়াও হানাফী ফকীহগণের মাঝে আরও একজন জুরজানী নামে পরিচিত। যিনি প্রথমোক্ত জুরজানী থেকে পরের ও ‘খিযানাতুল আকমাল’ কিতাবের লেখক।
খিযানাতুল আকমালে সওম অধ্যায়ে ‘ইখতিলাফে মাতালি’-এর পক্ষে-বিপক্ষে কিছুই নেই।
‘খিযানাতুল আকমাল’-এর ভূমিকায় লেখক ইউসুফ ইবনে আলী জুরজানী রাহ. নিজেই লিখেছেন যে, ‘‘তিনি এই কিতাবটি ৫২২ হিজরীর ঈদুল আযহায় শুরু করেছেন।’’ কাশফুয যুনূন কিতাবেও তাঁর উদ্ধৃতিতে এই তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং একথা বলা ঠিক নয় যে, ‘খিযানাতুল আকমাল’-এর লেখক হলেন আবুল হাসান কারখী (৩৪১ হি.)-এর শাগরিদ। আর এ কথার পক্ষে ‘তাজুত তারাজিম’-এর সম্পাদকের সমর্থন শুধু অনুমান নির্ভর। খিযানা কিতাবে পঞ্চম শতাব্দীর কিতাবসমূহের অনেক উদ্ধৃতি রয়েছে।
হেদায়া ও বাদায়ে কিতাবে صفة الصلاة এর আলোচনায় كذا في تخريج الجرجاني কথাটি উল্লেখ আছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য ইমাম কুদূরীর উস্তায আবু আবদুল্লাহ জুরজানী, ইউসুফ ইবনে আলী জুরজানী নয়। আর বাদায়ের সম্পাদক এখানে বিষয়টি গোলমাল করে দিয়েছেন। তাই এ থেকে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়।
*** এখানে এই সংশয় হওয়া উচিত নয় যে, ‘‘আততাজরীদুর রুকনী’’র লেখকের মৃত্যুসন ৫৪৩ হি. বলা হয়েছে। অথচ ‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’র লেখকের মৃত্যুসন ৫৪২ হিজরী। তাহলে এঁরা দুজন সমসাময়িক হওয়া সত্ত্বেও এটা কিভাবে হয় যে, তিনি এত অধিক পরিমাণে তাঁর উদ্ধৃতি উল্লেখ করবেন?
এই সংশয়ের কোনো ভিত্তি নেই। প্রথমত এ কারণে যে, খুলাসায় এমন অনেক কিতাবের উদ্ধৃতি আছে, যে সকল কিতাবের লেখক খুলাসা-লেখকের সমকালীন ছিলেন। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুসন ছিল ৬শ হিজরীর পরে কিংবা কিছু আগে। যেমন তাতে ‘মুহীত’ ও ‘যখীরাহ’র উদ্ধৃতি আছে। বিভিন্ন উদ্ধৃতি মিলিয়ে দেখা গেছে তা ‘আলমুহীতুল বুরহানী’র উদ্ধৃতি। আর ‘যখীরাহ’ তো আলমুহীতুল বুরহানীর লেখকেরই কিতাব, যার মৃত্যুসন ৬১৬ হিজরী বলা হয়েছে।
এমনিভাবে যানদাবিসাতীর ‘আররওযা’ ও ওস্ত্তরুশনীর ‘আলফুসূলে’র হাওয়ালা সম্পর্কেও ভেবে দেখুন।
এমনিভাবে ‘খুলাসা’তে ‘ফাতাওয়া খানিয়া’ থেকে খুব নকল করা হয়েছে এবং কাযীখানের ‘আলজামিউস সগীর’-এর শরহ থেকেও নকল করা হয়েছে। অথচ কাযীখানের মৃত্যুসন হল ৫৯২ হিজরী। খুলাসার মুসান্নিফ ও কাযীখান পরস্পর আত্মীয়ও। খানিয়ার মুসান্নিফ হলেন তাঁর মামাতো ভাই। যে ভঙ্গিতে ও যে পরিমাণে তিনি কাযীখান রাহ.-এর হাওয়ালা উল্লেখ করেছেন তাতে এটাই মনে হয় যে, কাযীখান রাহ.কে তিনি মুরববী মনে করতেন। বয়সের দিক থেকে কে বড় তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন।
‘আততাবাকাতুস সানিয়্যাহ’-এর লেখক কারো থেকে একটি বিচ্ছিন্ন সূত্রে একটি উদ্ধৃতি বর্ণনা করেছেন, যাতে খুলাসার মুসান্নিফের জন্মসন ৪৮১ বা ৪৮২ হিজরী বলা হয়েছে। আর তার মৃত্যুসন ৫৪২ হিজরী। ‘কাশফুয যুনূনে’ও তার মৃত্যুসন ৫৪২ হিজরীই উল্লেখ করেছেন। এ সকল সন-তারিখের ভিত্তিতে ধারণা ছিল যে, খুলাসার লেখক বয়সের দিক থেকে কাযীখানের বড়। কিন্তু উপরোক্ত বাস্তবতার আলোকে খুলাসার মুসান্নিফ রাহ.-এর জন্ম ও মৃত্যুসন দু’টোই আরো অনুসন্ধানের দাবি রাখে।
তেমনিভাবে ইসমাঈল পাশা বাগদাদী রাহ. ‘‘হাদিয়াতুল আরেফীনে’’ ‘আলমুহীতুল বুরহানীর মুসান্নিফের জন্মসন ৫৫১ হিজরী লিখেছেন। এটিরও তাহকীক প্রয়োজন। কারণ কাফাবী রাহ. তার উস্তাযগণের তালিকায় তাঁর চাচাজান হুসামুদ্দীন শহীদকেও উল্লেখ করেছেন, যিনি ৫৩৬ হিজরীতে শাহাদত বরণ করেছেন।
যাইহোক, এখানে আমার উদ্দেশ্য শুধু এটুকু বলা যে, আততাজরীদুর রুকনীর লেখকের মৃত্যুসন ৫৪৩ হিজরী হওয়ার কারণে এই সন্দেহের কোনো সুযোগ নেই যে, তা খুলাসাতুল ফাতাওয়ার মাসদার/উৎসগ্রন্থ কীভাবে হতে পারে?
**** তলাবায়ে কেরামের আরো অবগতির জন্য এখানে এ কথাও বলতে চাই, ‘তিবয়ানুল আদিল্লা’র মধ্যে হেদায়ার মুসান্নিফের কিতাব ‘মুখতারাতুন নাওয়াযিল’ এর উদ্ধৃতিতে যে ইবারত উল্লেখ করা হয়েছে শব্দের কিছু ভিন্নতার সাথে তা আবুল লাইছ সমরকন্দীর নামে প্রকাশিত কিতাব ‘‘ফাতাওয়ান নাওয়াযিলে’’ও বিদ্যমান আছে। কিন্তু এই প্রকাশিত কিতাব আবুল লাইছ রাহ.-এর নয়। আবুল লাইছ রাহ.-এর কিতাবের যে পরিচিতি ‘‘কাশফুয যুনূন’’ ইত্যাদি কিতাবে বর্ণিত হয়েছে তার সাথে এর কোনো মিল নেই। শতবর্ষ পূর্বে কেউ একটি মাখতূতা পেয়েছিল। কিন্তু তাতে وجادة صحيحة এর শর্তগুলো পাওয়া যায় না। তা সত্ত্বেও হিন্দুস্তানের কোনো প্রকাশক তা প্রকাশ করেছেন। আর সেই সংস্করণ থেকেই মীর মুহাম্মাদ করাচী ফটো সংস্করণ প্রকাশ করেন। আর দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ বৈরুত তা কম্পোজ করে প্রকাশ করে।
আবুল লাইছের কিতাব ‘‘আননাওয়াযিল’’ এখনও মাখতূত আকারে রয়েছে। ইস্তাম্বুলের মাকতাবায়ে ফয়যুল্লাহ ও মাকতাবায়ে দামাদ ইবরাহীম-এ এর সঠিক নুসখা বিদ্যমান আছে। হায়দারাবাদ আসফিয়্যাহ ও লাজনাতু ইহইয়াইল মাআরিফিন নুমানিয়্যাহয় দামাদ ইবরাহীম-এর নুসখার ফটোকপি সংরক্ষিত আছে। আর জামিআ উম্মুল কুরাতে উভয় নুসখার ফটোকপি আছে। মাওলানা মুশতাক আহমদ হায়দারাবাদের নুসখার সিডি সংগ্রহ করেছেন। আর শায়খ ত্বহা উম্মুল কুরার উভয় নুসখা থেকে কিতাবুস সওম-এর ফটোকপি পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাদের উভয়কে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন।
নাওয়াযিল আবুল লাইছ রাহ.-এর উভয় সহীহ নুসখা মুতালাআ করা হয়েছে। তাতে আলোচিত মাসআলা নেই।
কোনো কোনো গবেষক এ মত ব্যক্ত করেছেন যে, প্রকাশিত ফাতাওয়ান নাওয়াযিল মূলত ছাহিবে হেদায়ার কিতাব মুখতারাতুন নাওয়াদির। তবে বিষয়টি আরো অনুসন্ধানের দাবি রাখে।