যিলহজ্ব ১৪২৭   ||   জানুয়ারি ২০০৭

হজ্ব যাত্রা

শামীমা বিনতে নূর

জীবনের অনেকগুলো বছর কেটে গেলেও শৈশবের কিছু কিছু টুকরো ঘটনা এখনও স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে আছে। সংসারের শত ঝামেলার মধ্যে একটুখানি অবসর পেলে মাঝে মাঝেই আমার মন ছুটে যায় নির্মল প্রভাতের মত শুভ্র-সজীব সেই শৈশবের দিনগুলোতে। আমার স্মৃতির ঝুলিতে খুব অদ্ভুত কোন ঘটনা নেই। তবে কিছু স্মৃতি আছে, যা এখনও আমাকে হাসায় এবং কাঁদায়।

তখন আমি একদম ছোট। সাড়ে তিন কি চার বছর বয়স। আমরা তখন খিলগাঁও থাকতাম। সেবার নানা নানু একত্রে হজ্বে যাচ্ছিলেন। গ্রামের বাড়ি থেকে এসে তারা আমাদের বাসায় উঠলেন। এখানে এক দিন থেকে পরদিন হাজ্বীক্যাম্পে চলে যাবেন। তারপর বিমানে পবিত্র ভূমি মক্কায়। সারাদিন তাদের বিভিন্ন প্রস্তুতি চলল। তাঁদের প্রস্ততি দেখে আমি ও আমার বড় ভাই গোপনে পরামর্শ করলাম, আমরাও হজ্বে যাব। গোপনে গোপনে প্রস্তুতিও নিতে লাগলাম। ভাইয়ার বয়স তখন পাঁচ বা ছয়। আমরা দুটি ভাই বোনের সে কী উত্তেজনা। আমি আমার স্কুল ব্যগটা ঝেড়ে পরিষ্কার করে লুকিয়ে লুকিয়ে কাপড় ভরলাম। ভাইয়াও মাদ্রাসার ব্যাগ পরিষ্কার করে কাপড় স্যান্ডেল ভরলেন। একটা করে সাদা ওড়নাও নেওয়া হল ইহরাম বাঁধার জন্য। মোটামুটি সব প্রস্তুতিই সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু পাসপোর্টের ব্যবস্থা হবে কীভাবে?

নানা-নানু যখন তাদের কাগজ পত্র, পাসপোর্ট ইত্যাদি বের করে গুছাতেন তখন আমরা গভীর আগ্রহে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। একবার সাহস করে নানুকে বলে ফেললাম, নানু, আমরাও কিন্তু হজ্বে যাচ্ছি। আমাদের পাসপোর্টটা রেডি করে দেন। নানুও গভীরভাবে চিন্তা করবেন বলে আশ্বাস দিলেন। মোটামুটি আশ্বস্ত হয়ে আমরা এবার হজ্বের নিয়ম-কানুন শেখায় মন দিলাম। নানুর কাছ থেকে আমরা দুইজন লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক মুখস্থ করছি আর পাসপোর্ট হাতে পাবার অপেক্ষায় আছি।

রাতের খাবারের পর নানা আমাদের ডাকলেন এবং মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারাও কি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন? তিনি সবাইকে এখনও আপনি করে বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে উত্তর দিলাম, হ্যঁা যাচ্ছি তো। খালি পাসপোর্টের জন্য চিন্তা করছি। কথাটা বলতেই আমাদের চেহারায় বিষণ্ণভাব ফুটে উঠল।

নানার সামনে ছোট ছোট কয়েকটি বই রাখা ছিল সেগুলোতে ইংরেজীতে কী যেন লেখা। বইগুলোর দিকে হঠাৎ চোখ পড়তেই আমাদের মনে  আশার আলো জ্বলে উঠল। বললাম, এইতো পাসপোর্ট। নানা দয়া করে আমাদের দুইজনকে দুটো দিয়ে দিন। ওটা না থাকলে তো যাওয়া যাবে না। কচি দুটি মুখের দিকে তাকিয়ে নানা অশ্রম্ন গোপন করলেন  এবং দুটো বই দুজনকে দিয়ে দিলেন। বইটা পেয়ে সেদিন কী যে খুশি হয়েছিলাম- বলে বোঝাতে পারব না।

বাসায় সবাই আমাদের হাজী সাহেব বলে ডাকেন। আমরা সামনে আসলেই সবাই গম্ভীর হয়ে সম্মানের সঙ্গে কথা বলে! আমরাও সব খেলাধূলা ছেড়ে হজ্বে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই ব্যস্ত। বন্ধুরা খেলতে ছাদে যাওয়ার আগে আমাদেরকে ডাকতে আসত। কিন্তু আমাদের কথা বলারও ফুরসত নেই। কাজের মেয়েটি বলে আসত ওরা হজ্বে যাবে, তাই খেলবে না। যাই হোক পাসপোর্টপেয়ে আমাদের প্রস্তুতি একদম ফাইনাল। পরদিন সকালে নানা নানুর সঙ্গে আমরাও তৈরি হচ্ছি। টেনশনে নাস্তা খেতে পারছি না। আরবী ভাষা মোটামুটি রকম শিখেছি। নাআম, লা, ওয়াহেদ, সিনীন, ছালাছা ইত্যাদি বার বার মুখস্থ করছি। তবুও এত টেনশন হচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না।

নানু একটু অসুস্থ। তাই আব্বু আম্মুও হাজ্বীক্যাম্প পর্যন্ত যাবেন। আমরা আল্লাহর নাম নিয়ে গাড়িতে ওঠলাম। গাড়ি চলছে, আমরাও গাড়িতে বসে আছি, কিন্তু মন আমাদের মক্কায়। সেখানে আছে আল্লাহর ঘর। আমরা তার পাশে ঘুরে ঘুরে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলব। যমযমের পানি পান করব। এরপর যাব নবীজীর শহর মদীনায়সেখানে গিয়ে নবীজীর রওযা যিয়ারত করব। তারপর আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসব নবীর দেশের খেজুর আর যমযমের পানি। এজন্য দুটো বোতলও সঙ্গে নিয়েছি। এসব ভাবতে ভাবতে একসময় হাজ্বীক্যম্পে পেঁৗছলাম। নানা নানু ক্যাম্পের ভিতর ঢুকলেন। আমরাও কাঁধে ব্যাগ নিয়ে পেছন পেছন যাচ্ছি। নানু বার বার আমাদের দিকে তাকান আর কাঁদেন। আমরা বললাম, আমরাও তো যাচ্ছি কাদেন কেন? নানার চোখেও পানি, তারা আমাদের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।

কিছুক্ষণ পর আব্বু বললেন, এখনও অনেক দেরি  আছে। তোমাদের নানুরা যাবেন আরো কয়েক ঘণ্টা পর! আমরা ততক্ষণে কোথাও বেড়িয়ে আসি। আমরা নানুর কাছে ব্যাগ পাসপোর্ট রেখে যেতে চাইলে আব্বু বললেন, ব্যাগ পাসপোর্ট তোমাদের সঙ্গে থাক। তাকিয়ে দেখি, আব্বুর চোখ ভিজে উঠছে। আহা! নানুরা চলে যাচ্ছেন। আমরাও তাদের সঙ্গে চলে যাচ্ছি। তাই বুঝি আব্বুর মন খারাপ লাগছে। এসব ভাবতে ভাবতে আব্বুর সঙ্গে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এলাম। আমাদের গাড়ি অনেক দূরে রাখা। আমরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটছি তো হাঁটছিই। কোথায় যাচ্ছি কিছু জানি না, শুধু জানি হজ্বে যাচ্ছি । আব্বু-আম্মু আমাদের সঙ্গে হাঁটছেন।

একসময় গাড়িতে উঠে বসলাম। হজ্বে যাওয়ার টেনশন ও ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। কতক্ষণ পর আবিষ্কার করলাম, আমরা আমাদের বাসার সামনে। কী ব্যাপার? আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, ভাইয়া আমরা এখানে কেন? ভাইয়াও হতভম্ভ হয়ে বসে আছে। বলল, আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম। ঠিকই তো, আমরা এখানে কেন? আব্বু-আম্মু আমাদেরকে গাড়ি থেকে নামতে বললেন। এবার সবকিছু বুঝতে পেরে আর সহ্য করতে পারলাম না। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকলাম। ব্যাগটা তখনও কাঁধেই আছে। সোজা বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুজে শুধু কাঁদছি আর কাঁদছি। আর চিৎকার করে বলছি, ছোট হলে কী হয়েছে, আমরা কি হজ্ব করতে পারতাম না? আব্বু-আম্মু আমাদের আদর করে বোঝাতে লাগলেন। বাসার সবাই আদর করে আমাদের কান্না থামালেন। কিন্তু এখনও স্পষ্ট মনে আছে, আশাভঙ্গের সেই বেদনা অনেক দিন ছিল আমাদের মনে। এখনও যখন হজ্বের মৌসুম আসে আমাদের সেই হজ্ব যাত্রার ঘটনাটি আলোচিত হয়। তখনকার শিশু সূলভ সরলতার কথা মনে পড়লে আজ হাসি পায়। কিন্তু সেই হাসির গভীরেও অতি সঙ্গোপনে বয়ে চলে অন্তশীলা বেদনার একটি চিকন ধারা। স্বপ্নের আরবভূমি যে এখনও দেখা হয়নি।

 

 

advertisement