রবিউল আউয়াল ১৪৩০   ||   মার্চ ২০০৯

অমুসলিমদের মাঝে তাবলীগের কাজ

ইসহাক ওবায়দী

হযরত মাওলানা কলিম সিদ্দিকী বহুমুখী প্রতিভার একজন ভারতীয় বুযুর্গ ব্যক্তি হিসেবে ভিন্নমুখী এক দাওয়াতী মিশন নিয়ে কাজ করছেন। বয়স আমার চেয়েও একটু কম বলেই মনে হল। ষাট এখনও পেরোয়নি। উপমহাদেশে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও খাঁটি ইসলামী আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা হযরত শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ.-এর খান্দানের সন্তান তিনি। শাহ ছাহেবের গ্রামের বাড়ি উত্তর প্রদেশের মুজাফফর নগর জেলার ফুলতের ঐ বাড়িতেই তাঁর জন্ম এবং সেখানেই তাঁর তাবলীগ-মিশনের কেন্দ্র স্থাপন করেছেন। বেশ কয়েক বছর পূর্বে বাংলাদেশ সফরকালে তাঁর সাথে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয় এবং তার সঙ্গ লাভের সৌভাগ্য হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ইসলামী বিশ্বকোষের পরিচালক বহু গ্রন্থপ্রণেতা বন্ধুবর অধ্যাপক মাওলানা আবু সাঈদ মুহাম্মাদ ওমর আলীসহ আমরা তাঁকে নিয়ে তাবলীগ জামাতের মারকায কাকরাইল মসজিদসহ অনেক জায়গায় সফরও করেছি। কাকরাইল মসজিদে তাবলীগ জামাতের অন্যতম নিবেদিত কর্মী সাবেক যুগ্ম সচিব বিগ্রেডিয়ার মোশাহেদ চৌধুরী সাহেবের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত আমাদের মিশনের মাধ্যমে প্রায় তিন লক্ষ মুরতাদ পুনরায় মুসলমান হয়েছে। এদের অধিকাংশই হচ্ছে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যের অধিবাসী। ভারত বিভক্তির আগে ও পরে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যে সমস্ত রায়ট সংগঠিত হয়েছিল সে সময় মুসলমানরা তাদের ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পদ সবকিছু ফেলে হিজরত করে পাকিস্তান যাওয়ার প্রাক্কালে তাদের যুবতী মেয়েগুলোকে হয়তো ভয়ে কোনো হিন্দু অথবা শিখ পরিবারে রেখে স্বীয় জান নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছে। এইসব মুসলিম মেয়েরা পরবর্তীতে ঐ হিন্দু বা শিখের সাথে ঘর-সংসার করেছে এবং ঐ সংসারে যে সমস্ত শিশুর জন্ম হয়েছে তারা সবাই ঐ ধর্মেরই অনুসারী হয়ে গেছে। এদের সংখ্যা এখন  লক্ষাধিক। এদের জন্যও তিনি সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে তাঁর সংস্থার পক্ষ থেকে ঐ সমস্ত এলাকায় বেশ কিছু প্রাইমারি স্কুলের ব্যবস্থা করেছেন।

মাওলানা কলিম সিদ্দিকী প্রথম দিকে জেনারেল লাইনে পড়ুয়া মাস্টার্সের ছাত্র থাকাকালেই মহান আল্লাহ পাক তাঁকে হেদায়েতের আলো দান করেন। পরে তিনি মাদরাসায় পড়াশুনা করে একজন বড় মাপের আলেমে দ্বীন ও আধ্যাত্মিক জগতের একজন বুযুর্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী মনীষী হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নাদভী রাহ. প্রথমে তাঁকে খেলাফত প্রদান করেন। পরে হযরত প্রতাবগড়ি রাহ.  এবং বিশ্ববিখ্যাত শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া রাহ.ও তাঁকে খেলাফত দানে ভূষিত করেন।

প্রসঙ্গক্রমে আমি যখন আমার পূর্বেকার রেডিওর জীবন ও গান ইত্যাদি লেখা নিয়ে আক্ষেপ করছিলাম, তখন তিনি বলেন, আমি একসময় উর্দু ভাষায় নাটক ও উপন্যাস লিখতাম। আমার লেখা উওহ দো গোলাবী আঁখেঁ (ওই দুটি গোলাপী চোখ) নামক একটি নাটক তো অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে প্রায় ২২ বার প্রচারিত হয়েছে। আল্লাহ পাক আমাকে মেহেরবানী করে হেদায়েত দান করায় ঐ জগতের অনেক সুরসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতের লোকেরাও আমার হাতে মুসলমান হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।

ভারতীয় যন্ত্রসঙ্গীতকারদের একটি অনুষ্ঠানে আমাকে তারা আমন্ত্রণ জানালে আমি তা সাদরে গ্রহণ করি এবং সেখানে ইসলামের মহানুভবতার দিক নিয়ে কিছু বলার পর ৬০০ যন্ত্রসঙ্গীতকার আমার হাতে সেদিনই মুসলমান হয়ে যায়। আমি লোক বেশি হওয়াতে পাগড়ির পরিবর্তে মাইকের তার দিয়ে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে  তাদের সকলকে বাইয়াত করে নেই এবং সকলের নাম পরিবর্তন করে মুসলমানদের নাম রাখি।

তাঁর দাওয়াতী মিশনের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, অমুসলিমদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া, যা বর্তমানে আমরা অনেকেই করতে পারছি না। মুসলমানদের ঈমানী ও আমলী দুর্বলতার কারণে প্রথমে মুসলিম সমাজেই দাওয়াতী কাজ বেশি হওয়া দরকার, যাতে মুসলমানগণ সত্যিকার মুসলমান হতে পারে। তারপর অমুসলিমদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার যে নববী তরীকা রয়েছে তার ওপরও যথেষ্ট কাজ হওয়া দরকার। এই কাজে আমাদের পক্ষ থেকে যথেষ্ট দুর্বলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই তাঁর মুরববীরা তাঁকে ওদের মাঝেই দাওয়াত দেওয়ার ব্যাপারে তাকিদ করে গেছেন বলে আমাদের জানালেন।

তাঁর দাওয়াতের আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিশ্বের বিখ্যাত অমুসলিম ব্যক্তিদেরকে টার্গেট করে করে তাদের জন্য সালাতুল হাজত পড়ে একেকজনের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করা ও তার ব্যাপারে চেষ্টা-তদবীর চালানো।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্ববিখ্যাত সংগ্রামী নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার ওপরও তাদের কাজ চলছে বলে আমাদের জানালেন। নেলসন ম্যান্ডেলা যখন সাউথ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন তাঁর উপদেষ্টাদের মধ্যে ৬জনই নাকি ছিলেন মুসলিম পন্ডিত ব্যক্তি। যাদের একজনের নাম হচ্ছে ইসমাঈল। প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় কাজের ঝামেলায় যখন ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়তেন তখন তিনি তাঁর উপদেষ্টা জনাব ইসমাঈল সাহেবকে বললেন, ইসমাঈল! আমাকে ইসলামের কথা শোনাও। তখন ইসমাঈল সাহেব ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলার পর তাঁর অবসাদ দূর হয়ে যেত।

নেলসন ম্যান্ডেলা পাকিস্তান সফরের সময় মিডিয়াকে চমৎকার একটি কথা বলেছিলেন, যা বিশ্বের সকল মিডিয়াগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, বর্তমান বিশ্ব সংকটের সমাধান একমাত্র ইসলামের মাধ্যমেই করা সম্ভব।

জনাব কলিম সিদ্দিকী সাহেব আমাদেরকে আরো বললেন, ভারতীয় শিবসেনার অন্যতম কট্টর নেতা বোম্বের বাল ঠাকুরকে টার্গেট করেও তারা কাজ করছেন এবং তাতে বেশ সফলতা পাচ্ছেন বলেও তিনি মনে করেন। তিনি বললেন, তার এক কর্মী বালঠাকুরকে টার্গেট করে সালাতুল হাজত পড়ে পড়ে দোয়া করার পর তাকে দাওয়াত দিতে গিয়ে প্রথম প্রথম কিছু বলতে পারেনি, পরে একদিন বাল ঠাকুর নিজেই বলে ফেললেন যে, মাওলানা! মাই কুরআন সীখনা চাহতা হুঁ, মুঝে কুরআন সিখলা দি-জিয়ে অর্থাৎ মাওলানা সাহেব! আমি কুরআন শিখতে চাই, আমাকে কুরআন শিখিয়ে দিন। মাওলানার উদ্দেশ্য তো সফল। তারা তাকে কুরআন পড়াল এবং তার অর্থ বোঝানোর ব্যবস্থা করল। বিজেপি সরকারের আমলের কথা, বোম্বেতে তাবলীগ জামাতের একটি বিশ্ব এজতেমা হয়েছিল। তাতে নাকি যোগাযোগের সুব্যবস্থার জন্য নতুন করে একটি রেল লাইনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সরকারের এই উদ্যোগের পেছনে এবং বিশ্ব ইজতেমা সুচারুরূপে অনুষ্ঠিত হবার নেপথ্যে নাকি বাল ঠাকুরেরই সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এরপর থেকে নাকি বাবরি মসজিদের ব্যাপারেও বাল ঠাকুরের মন্তব্য অত্যন্ত মার্জিত ও শান্ত ছিল। তিনি বলেছিলেন, রাম মন্দির নির্মাণের পাশাপাশি বাবরি মসজিদটিকেও পুনরায় নির্মাণ করা আবশ্যক।

এর আগে আমার একটি লেখায় আমি লিখেছিলাম যে, আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মেয়ে চেলসির কুরআন অধ্যয়নের পেছনেও কলিম সিদ্দিকী সাহেবের কিছু অবদান আছে।

তার তাবলীগ মিশন থেকে আরমগানে শাহ ওলিউল্লাহ নামে একটি ম্যাগাজিন পত্রিকাও বের করা হয়। তার তাবলীগী মিশনের নাম দেওয়া হয়েছে নিখিল ভারত জমিয়তে শাহ ওলিউল্লাহ। আল্লাহ তার এই তাবলীগী মিশনকে কামিয়াব করুন এবং আমাদেরকেও অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করার তাওফীক দান করুন। আমীন। #

 

 

advertisement